প্ৰভাত বিশ্বাস (১) হরিপদ বসু সকাল সকাল ছাপাখানার ভারী লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই যেন এক অন্য জগতে পা রাখেন, একটুখানি আলো ফাঁক দিয়ে ঢুকেই ধুলো ঝরা অক্ষর, লিনোটাইপ আর লেটার প্রেসের মৃদু গন্ধে জেগে ওঠে তার বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি। এই প্রেসের প্রতিটি মেশিন, প্রতিটি খোপের কালি শুকনো দাগ, পুরনো কাঠের তাকের রং ওঠা অক্ষরমালা সব যেন তার পরিবারের চেয়েও আপন—যেমন হয়, শৈশব থেকে চোখের সামনে বড় হতে হতে মানুষের জীবন মিশে যায় এক টুকরো জায়গায়, এক টুকরো লোহার জিনিসেও। বহু বছর আগে তার বাবা যত্ন করে খুলেছিলেন এই ছাপাখানা, “বসু প্রেস”—তখন চারপাশে নতুন দেশের গন্ধ, স্বাধীনতার রঙ,…
-
-
দীপান্বিতা রায়চৌধুরী ১ ঘূর্ণি গ্রামটা যেন সত্যিই সময়ের বাইরে পড়ে আছে—পথের ধারে টালির ছাউনির বাড়িগুলো, পুকুরঘাটে সাদা শাড়ি পরা বধূর মুখে মেঘ জমা চোখ, আর সেই নদী, যাকে ঘূর্ণি বলে, সে যেন জলের বদলে গোপন ইতিহাস বইয়ে চলে যায়। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাস, দেশভাগের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তবু এই গ্রামটায় একটা ভিন্ন নৈঃশব্দ্য। পাখির ডাক, নদীর ছলাৎছল, আর দুপুরের নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে অচিন্ত্য সেনের চোখে প্রথম দর্শনে ঘূর্ণি এক ধরনের অদ্ভুত মায়ার মতো লাগল। অচিন্ত্য তখন সদ্য পাশ করা একজন তরুণ শিক্ষক, কৃষ্ণনগরের ছাত্র, কিন্তু আদর্শে গাঁথা এক প্রবল দেশপ্রেমিক। আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির ঘা খেয়েছে, কিন্তু বাবার অশান্ত…
-
অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটপেটি ভীতু বনে দিন বদলেছে। বদলেছে শহর, বদলেছে গান, বদলেছে মানুষের মন। কিন্তু রুদ্র বাউল আর তরুণ ধ্বনি—এই দুই সুরের সাধকের জীবন যেন থেমে পড়েছে এক গোধূলি রেখায়। তাদের গলায় সুর আছে, বুকে সাহস আছে, কিন্তু মঞ্চ নেই, শ্রোতা নেই, আর নেই সেই সময়ের মরমি চাহিদা। রুদ্র এখন থাকে গোপীবাগের একচালা বাড়ির ছাদে, যেখানে জানলার পাশে একটা হাওয়াকল ঘোরে ধীরে ধীরে। তরুণ থাকে তার নিচের ঘরে, যেখানে দোলনচাঁপার গন্ধ আর পুরোনো তবলার খোলস একসঙ্গে মিশে থাকে বাতাসে। তারা এখন দিনে দিনে বাজারের পেছনের ফাঁকা মাঠে বসে গান গায়, কেউ খেয়ালে শোনে, কেউ হেসে পাশ কাটিয়ে যায়। একদিন সকালে…
-
ইন্দ্রনীল দত্ত অধ্যায় ১: কলকাতার উপকণ্ঠে একটা জায়গা আছে যেখানে শহরের শব্দ পৌঁছায় না ঠিকভাবে, শুধু হঠাৎ হঠাৎ ফ্লাইওভারের গম্ভীর গর্জন এসে কানে বাজে। সেখানে রয়েছে একটা ছোট্ট বস্তি—মাটির ঘর, টিনের চাল, বালতিভর্তি বৃষ্টির জল, আর সরু অলিগলি। এই জায়গার নাম বস্তির লোকেরা ‘জিন্নাহ কলোনি’ বলে ডাকে, যদিও কারো আধিকারিক কাগজে সেই নামে কিছু নেই। এখানকার ঘুম ভাঙে অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটের ঠুং ঠাং শব্দে, রান্নাঘরের আগুনের শিখায়, আর এক অন্যরকম শব্দে—ফুটবলের শব্দে। হ্যাঁ, প্রতিদিন ভোর পাঁচটা বাজলেই বস্তির মাঠে শুরু হয় এক আশ্চর্য দৃশ্য। ধুলো আর শিশিরে মাখা একটা কাঁচা মাঠ, পাশে নালার ধারে একটা পুরনো ব্যাগের ভেতর থেকে বেরোয় একজোড়া…
-
রুমা মণ্ডল বাহাদুরপুর গ্রামের শেষ মাথায় যে পুরনো অশ্বত্থ গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, তার নিচে প্রতিদিন বিকেলের পর থেকে একজন মেয়ে চুপচাপ বসে থাকে। নাম কেউ জানে না ঠিক, তবে গ্রামের লোকজন তাকে ‘পরী’ বলেই ডাকে। মেয়েটার চেহারায় এমন একরকম মায়া আছে, যেন অনেকগুলো বেদনার রঙে আঁকা হয়েছে তার মুখ, চোখ দুটো এত গভীর যে তাকালেই মনে হয় কিছু একটা হারিয়ে গেছে অনেক দূরে, যা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। গ্রামের ছেলেপুলেরা প্রথমদিকে ভয় পেত ওকে, এমন অচেনা এক মেয়ে, কাঁধে একটা পুরনো ঝোলানো ব্যাগ, কখনো হাসে না, কারও সঙ্গে কথা বলে না, শুধু বসে থাকে। ধীরে ধীরে সবাই ওকে গ্রহণ…
-
নির্মলেন্দু বিশ্বাস শীতকালের শুরুটা কলকাতায় যতটা না কাঁপুনির, তার চেয়েও বেশি স্মৃতির। সকালবেলায় ঠান্ডা আলো, শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো মায়েরা, আর গরম চায়ের কাপ হাতে ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে সূর্যের কুয়াশা-বাঁধা হাসি ঢুকে পড়ে ঘরে। এই শহরের অভিজাত বসতিপাড়ায় একটি তিনতলা বাড়ির প্রথম তলায় বসু পরিবার শীতের আগমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বসুদের ছেলে, আর্য, বয়স চৌদ্দ—তাকে কেউ দেখলে বলবে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো শান্ত স্বভাবের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র। তার গায়ে তখন স্কুল ইউনিফর্মের গন্ধ, মাথার চুলে ঠিকঠাক জেল, হাতে একটি কমিক্স আর টেবিলের কোণে পড়ে থাকা আধখাওয়া স্যান্ডউইচ। মা রিমা বসু, সমাজসেবায় যুক্ত, কিন্তু সামাজিক অবস্থান বজায়…
-
গৌরি রায় ছায়াপুর—পাহাড়ঘেরা সবুজ এক গ্রাম, যেখানে রেলগাড়ি আসে না, রাতের অন্ধকারে কুয়াশা গা ছমছম করে ছড়িয়ে পড়ে আর মানুষ অচেনাকে ভয় পেয়ে গল্প বানিয়ে নেয়। সেই গ্রামের এক প্রান্তে, পুরনো তালগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরের মতো কাঠের দোকান, নাম নেই, বোর্ড নেই, অথচ সবাই জানে—ওটাই “মায়ার দোকান”। গ্রামের লোকেরা তাকে “ডাইনীর দোকান” বলে ডাকে, মুখের হাসির আড়ালে জড়ায় শঙ্কা, ভয় আর অদ্ভুত সব গুজব। কেউ বলে, সেখানে গেলে মানুষ বদলে যায়, কারও রোগ সারে, কারও গোপন চিঠি এসে পৌঁছে যায় যেভাবে জানে না কেউ। এই দোকানের মালকিন—মায়া—এক রহস্যময়, একলা থাকা, অর্ধেক সাদা শাড়িতে ঢাকা, গভীর চোখের এক…
-
শ্যামল রায় পর্ব ১: শেষ প্রদর্শনের আগে পূর্ব মেদিনীপুরের একটা ছোট্ট গ্রাম—ধনঞ্জয়চক। গাছপালা ঘেরা, ধুলো মাখা পথ, আর বিকেলের শেষে চায়ের দোকানে গমগমে আড্ডা। সেই গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা টালির ঘর, চারপাশে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে, জানলার ধারে একটা কাঠের তাক। তাকের ওপর সারি সারি মুখোশ—রাবণের, হনুমানের, গরুড়ের, রাক্ষসের, বাঘের, মহিষাসুরের। এবং একটা মুখোশ—সাদামাটা, ফ্যাকাশে, যার এক চোখ সামান্য খুঁত আছে। এই মুখোশটা হাতে নিয়ে বসে আছেন সদানন্দ বাউরী। বয়স আশির কাছাকাছি, গায়ে পাটবস্ত্রের ফেটানো ফতুয়া, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। বহুরূপী জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে সদানন্দ, মনস্থির করেছেন—এবছর মহালয়ার আগের দিন, তিনি শেষবার মঞ্চে উঠবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কেবল একটা অভিনয় নয়। এই…
-
সুকুমার ঘোষ এক কলকাতার সল্টলেকের অষ্টম তলার কর্পোরেট অফিস কাচের দেওয়ালের ভিতর বন্দি এক ফ্ল্যাটস্ক্রিন-চালিত জীবন। কেবিনের মাথার উপরে দুলছে স্পটলাইট, ডেস্কের কোণায় রাখা অ্যালো ভেরা পাত্রে মাটি শুকিয়ে গেছে, অথচ অভিরূপ বসুর চোখে ক্লান্তির ছায়া নেই—সে অভ্যস্ত। প্রত্যেকদিন সকাল ন’টায় ঠিক নীল শার্ট, ধূসর ব্লেজার আর চকচকে লেদারের জুতো পরে অফিসে প্রবেশ করে; তার মুখে এক প্রকার যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাস—যেটা হয়তো মাল্টিন্যাশনাল পরিবেশের জরুরি পোশাক। অভিরূপ একজন সফল ব্র্যান্ড ম্যানেজার, মেট্রিক্স আর কনভার্সনের পরিসংখ্যানের সঙ্গে যার ঘুম–জাগরণের সম্পর্ক। সে জানে কোন ক্লায়েন্ট কবে “impression” চায়, কাকে “engagement” দিয়ে মাতাতে হয়, আর কোন প্রেজেন্টেশনের সময় একটা থ্রি-পয়েন্টার স্লাইড শেষ মুহূর্তে গুঁড়িয়ে…
-
অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী মফস্বলের স্টেশনের নামটা যতই নিস্প্রভ হোক, বিকেলের শেষ আলোয় যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে মেয়েটার, তখন যেন চারপাশের সব শব্দ থেমে যায়। নাম তার অরিত্র। পুজোর পর শহরের বাইরে প্রথমবার এসে দাঁড়িয়েছে চাঁদপুর স্টেশনে। একটা চাকরির সাক্ষাৎকার, একটা নতুন জীবনের আশ্বাস। আর তাতেই যাত্রীদের হঠাৎ ভিড় ঠেলে আলতা-লাল সালোয়ারে একটা মেয়ে চলে এলো ঠিক তার সামনে। মেয়েটার নাম—মালবিকা। “এই যে, আপনি কি হোস্টেলটা খুঁজছেন?” প্রথম কথা। অরিত্র একটু হকচকিয়ে গিয়ে হ্যাঁ বলল। “চলুন, আমিও সেদিকেই যাচ্ছি।” এইভাবেই শুরু। হেঁটে যেতে যেতে ওরা অনেক কথা বলল—ছোটখাটো। অরিত্র জানাল, সে কলকাতা থেকে এসেছে, সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। মালবিকা…