কুহেলী ধর ১ বাড়ির বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে। মেঘলা গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে রইল জানলার ধারে। নীচে প্যান্ডেলের বাঁশ বেঁধে গাঁদার মালা ঝোলানো হচ্ছে, ঢাকিরা এসেছে, ঢাকের প্রতিটা আওয়াজে যেন বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। ঘরের ভেতরে চায়ের কাপ রাখা, তাতে ধোঁয়া উঠছে না — কারণ মেঘলা আর চা খায় না, কবে যে নিজের পছন্দের তালিকা থেকে চা নিজেই বাদ দিয়েছে, তার ঠিক নেই। বরং, স্বামী রণদীপ আর মেয়ের জন্য রোজ সময়মতো ব্রেকফাস্ট বানানোই এখন তার কাছে ‘প্রিয় কাজ’। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটায় দাঁড়িয়ে, স্বামী অফিসের কথা বলে আজ একটু দেরিতে উঠেছে। মেয়েটা পাশের ঘরে অনলাইন ক্লাসে ব্যস্ত, অথচ…
- 
				
 - 
				
এক রোদ ঝলমলে একটা দুপুরে কলকাতা থেকে রওনা হয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ডঃ অনিন্দিতা সরকার পৌঁছালেন দক্ষিণবঙ্গের এক প্রাচীন গ্রামে—সোনাচূড়া। চারদিকে যেন কুয়াশার আস্তরণ, অথচ বর্ষা নয়, শীতও নয়। তিনি জানতেন, এই জায়গার নাম ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নয়, তবুও এখানে একটি বিশেষ জমিদার প্রাসাদ আছে, যার কথা প্রায় কেউ জানে না। স্থানীয় লোকজন ভয়ে তার ধারে-কাছে যায় না। পুরনো দলিলপত্র ঘাঁটতে গিয়ে এই রায়চৌধুরী বাড়ির নাম ও বর্ণনা পেয়ে যান অনিন্দিতা। জমিদাররা নাকি ১৮৪০-এর দশকে গড়ে তুলেছিলেন এই রাজবাড়ি, কিন্তু ১৯৪৭-এর পর ধীরে ধীরে পরিবার ছড়িয়ে যায়, প্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। আজও বাড়িটির উত্তরাধিকারী আছে — এক অরিন্দম রায়চৌধুরী…
 - 
				
মৌসুমী ধর অধ্যায় ১: আয়নার ওপারে মেহেরা দত্ত সকালবেলার সূর্যের মৃদু আলোয় ঘুম থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকালেন। আয়নাটা ছোট্ট, বাথরুমের দরজার ভেতর লাগানো, আর সেই আয়নাতেই প্রতিদিনই তার ছায়াটা দেখতে হয়। ছায়াটা যেন কিছুক্ষণ আগের থেকে একটু ভিন্ন হয়ে গেছে—একটু ক্লান্ত, একটু বিষণ্ণ, আর কখনো কখনো যেন আড়ালে চুপ করে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। গৃহবধূ মেহেরা, যিনি স্বামী কৌশিক ও দুই সন্তানের জন্য জীবন গড়েছেন, আজও রাঁধুনির কাজ থেকে একটু বিরতি নিয়ে চুপচাপ সেই আয়নার দিকে তাকালেন। দেড় দশক আগে কলেজে ইংরেজিতে অনার্স করার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করেছিল সে; শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল, বইয়ের সঙ্গেই জীবন কাটানোর তাগিদ ছিল। কিন্তু…
 - 
				
মোহনা বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যায় ১: জীবনের যাত্রা শুভ্রা ছোটবেলায় অনেক স্বপ্ন দেখত, একটি সুন্দর এবং মুক্ত জীবন কাটানোর। তার ছোট্ট গ্রামটি ছিল একদম সাধারণ, যেখানে দিনের পর দিন একই রকম একঘেয়ে জীবন কাটত। প্রতিটি সকালের শুরু হত পাখির চিরচিৎকারে, এবং সন্ধ্যে আসত নিস্তব্ধতার মাঝে, শুধুমাত্র বাতাসের শব্দ আর দূরের মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যেত। গ্রামে সবাই জানত একে অপরকে, কেউ কাউকে ভুলে যেত না। তবে, শুভ্রার মনে কখনও এমন অনুভূতি জন্মেছিল যে সে যেন এই পরিবেশের বাইরে কোথাও চলে যেতে চায়। সে জানত, জীবন এখানে থেমে থাকবে না, কিন্তু কিভাবে সে তার জীবনের পথ খুঁজে বের করবে, সেটা বুঝে উঠতে পারত…
 - 
				
সোমশুভ্র লাহিড়ী “এইবার নামো রে, শেষ চিৎকারটুকু রাখ, মাইক-ফাইক ভাঙিস না,” — পেছন থেকে ডাকল তপন, যাত্রাদলের আলো-ধরা ছেলে। শম্ভুদা হাত তুলে বললেন, “এই শেষবার, তপন, আরেকটা ডায়লগ বলি।” মঞ্চে দাঁড়িয়ে শম্ভু সেন, বয়স বাহাত্তর, কাঁপা গলায় বললেন— “জীবনটাই একটা যাত্রা, কিন্তু থিয়েটারটা? ওটা আত্মার আয়না!” চারদিক নিস্তব্ধ। দর্শক বলতে গুটিকয়েক লোক, সবাই চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে। কেউ মোবাইলে, কেউ ঝিমুচ্ছে। কেউ আবার পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলছে, “ওই বুড়োটা এখনও মরে না কেন?” শম্ভুদা নামলেন মঞ্চ থেকে, হাঁটুর ব্যথায় কুঁজো হয়ে পড়েছেন। কিন্তু চোখে একরকম দীপ্তি। যেন কোনও জয় এসেছে। তপন বলল, “আর কতদিন এইরকম চলবে, দাদা?” “ততদিন চলবে,…
 - 
				
ঊর্মি পাল অধ্যায় ১: “অশ্রু ও বিষ” অমৃতা এক কঠিন সন্ধ্যায় ঘরের জানালার কপাট বন্ধ করে বসেছিল। তার চারপাশে সন্ধ্যার অন্ধকার পসরানো শুরু করেছে, কিন্তু তার মনে এখনও মায়ার মতো সাদা আলোয় একটা বিষণ্ণ রূপের প্রতিফলন। এক সময় সে স্বপ্ন দেখেছিল, কী সুন্দর হবে তার জীবন! কিন্তু এখন তার সামনে শুধু একটা দীর্ঘ অন্ধকার পথ, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তার জীবনের সবকিছুই যেন একটা অদৃশ্য বেষ্টনীতে আটকে গেছে, পরিবারের চাহিদা, তার স্বামী রোহিতের প্রত্যাশা, তার সন্তান মাহির স্নেহের আগ্রহ—এসব কিছু মিলে এক ভারী বোঝা হয়ে গেছে। রোহিত একজন সফল ব্যবসায়ী, কিন্তু তার সাফল্যের পেছনে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।…
 - 
				
অনিন্দিতা ধর শীতের সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছিল ধীরে ধীরে। দেয়ালের বইয়ের তাকের পাশে দাঁড়িয়ে দীপ্তেন্দু বসু আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন। আয়নায় যেন সবসময়ই তার চেহারায় একটা সন্তুষ্টির ছায়া ধরা দেয়— একটা “আমি সমাজের জন্য কিছু করছি” ধাঁচের আত্মতৃপ্তি। আয়নার সামনে ছোট্ট টেবিলে রাখা ছিল ঘড়ি, পারফিউম, স্কুল ব্যাজ আর একটা পুরোনো খাতার পাতা— যেখানে কাল রাতেই লিখেছিলেন, “নারীর মর্যাদা রক্ষায় সমাজের ভূমিকা”। আজ শহরের এক নামী স্কুলে আলোচনা সভা; তিনিই প্রধান বক্তা। টেবিলের ওপর রাখা ছিল গীতার বানানো লাল চা। গীতা— গৃহপরিচারিকা মঞ্জুর মেয়ে, বয়স চোদ্দো, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে প্রায় এক বছর হলো, তবু তার চায়ের স্বাদ দীপ্তেন্দু…
 - 
				
মৌমিতা ঘোষ অধ্যায় ১: প্রথম সংকট অঞ্জলী রায় সকালে অফিসে পৌঁছাতেই এক তরুণ পুলিশ অফিসার তার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটি ফাইল, আর চোখে তীব্র উদ্বেগ। “স্যার, ডিএসপি ম্যাম, আপনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কেস এসেছে।” অঞ্জলী দ্রুত ফাইলটি খুললেন। ফাইলের মধ্যে ছিল এক নারীর মৃতদেহের ছবি, এবং সাথে কয়েকটি প্রতিবেদন। ছবিতে ওই নারীর চোখ বন্ধ, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, এবং শরীরের চারপাশে অসংখ্য রক্তের দাগ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নারীর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, তবে তার মৃত্যু সন্দেহজনক। এই কেসের পেছনে কোনো অপরাধী রয়েছে কিনা, তা জানার জন্য তদন্ত শুরু করতে হবে। অঞ্জলী একটি গভীর শ্বাস নেন।…
 - 
				
রুবিনা মাহমুদ ১ রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। এমন শান্ত যে খুলনার বাতাসেও যেন শব্দ ঢুকতে সাহস পায় না। কিন্তু এই নিশুতি রাতেই শব্দ জন্ম নিচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে এমন এক তরঙ্গ, যা ভবিষ্যতের কান্না বা বিজয়—দুটোর একটিকে জাগিয়ে তুলবে। রওশন আরা জানালার পর্দাটা সরিয়ে একবার বাইরে তাকালেন। তামাটে চাঁদের আলোয় গাছের ছায়া লম্বা হয়ে উঠেছে। একটা কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠলো দূরে, যেন ইশারা দিচ্ছে—“সব ঠিক নেই।” ঘরের কোণার ছোট মেজেতে পাতলা লেপ, একটা সেলাই মেশিন আর একটা কাঠের বাক্স। কিন্তু বাক্সটা ছিল আলাদা। সাধারণ কাঠের নয়, ভিতরে ছিল রেডিও ট্রান্সমিটার, নিজ হাতে বানানো। ধীরে ধীরে মুখের চশমাটা খুলে রাখলেন রওশন। চুলের…
 - 
				
জয় সাহা গলির মেয়ে সহেলীর জন্ম এক ছোট্ট শহরের এক অজপাড়া গলিতে। সে ছিল এক সাধারণ মেয়ে, যেখানে সমাজের চোখে তার কোন বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। তার জীবন ছিল একেবারে নিরস, রুটিনমাফিক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কাজ ছিল ঘরের কাজ, মা-বাবার সহায়তা, ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা, আর মাঝে মধ্যে স্কুলে যাওয়া। তবে, সহেলী কখনোই এই নির্ধারিত জীবনটিকে সঙ্গী করতে পারেনি। তার মন ছুটতে চেয়েছিল দূরে, তার চোখ ছিল নতুন দিগন্তে, যেখানে জীবনের অনেক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সে জানত, সে তার ছোট্ট গলির মধ্যেই বন্দী। সেই গলির প্রাচীরের বাইরের পৃথিবী তার জন্য এক কল্পনা মাত্র। সহেলী ছিল খুব চুপচাপ। একা থাকলেই…