• Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    ডাকবাক্সের দুলালী

    তনুশ্রী রায় এক রোজকার মতো সকালটা শুরু হয় একঘেয়ে নিয়মে—চা, শাড়ির আঁচল গুঁজে নেওয়া, আর বাড়ির সদর দরজাটা হালকা শব্দে টেনে বন্ধ করা। শহরের কিনারে পুরোনো একটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষপ্রাচীন ডাকঘরটি যেন সময়কে আটকে রেখেছে নিজের দেওয়ালে। দুলালী ঘোষ, যাকে শহরের সকলে ‘দিদি’ বলে জানে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় এসে সেই সাদা-লাল রঙের গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। দেওয়ালে ঝোলানো পিতলের ঘড়িটা তার আগমনের সাক্ষী হয়ে থাকে, তার চলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চুপচাপ টিক টিক করে। খোলা জানালার ফাঁকে মৃদু আলো ঢোকে, আর তাতে ধুলোর কণাগুলি বাতাসে ভাসে যেন স্মৃতির মতো। দুলালী টেবিলে রাখা তার কাঠের বক্স খোলে, যেখানে…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - সামাজিক গল্প

    ঝুমরির গানের দল

    দীপান্বিতা মাহাতো ১ পুরুলিয়ার বাঁশডাঙা গ্রামে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই পাখির ডাকে জেগে ওঠে পাহাড়-জঙ্গলের বুক চেরা গ্রামটা। মাটির বাড়ির চালের নিচে কুয়াশার কুয়াশা, আর তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলে যায় একটা কিশোরী—ঝুমরি হাঁসদা। তার পরনে হালকা লাল পাড়ের ধবধবে সাদা শাড়ি, হাতে জলভরা কলসি, কিন্তু ঠোঁটে একটানা চলতে থাকা সুর—”গেলি চলে পাহাড়ি পথে, কাহার ডাকে রে মন।” সে একা, কিন্তু একলা নয়। ঝুমরির কণ্ঠে যেন গমগম করে ওঠে পুরো বাঁশডাঙার ঝরা পাতা, মাঠঘাট, আর সেই পাহাড়ের পেছনের রক্তিম সূর্য। ছোট থেকেই ঝুমরির গলার জোর ছিল গ্রামের অন্যসব মেয়েদের চেয়ে আলাদা। মা পূর্ণিমা হাঁসদা ছোটবেলায় নিজের ঠাকুমার কাছ থেকে যে…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    জাদুকরী লালরঙ

    বর্ণালী রাহা ১ শহরের উত্তর দিকের পুরনো অলিগলির মধ্যে এমন একটা গলি আছে, যার নাম কেউ ঠিক ঠাহর করতে পারে না। লোকমুখে বলে “লালগলি”, কেউ আবার “ঠাকুরদালান গলি” বলে ডাকেন— কিন্তু অফিসিয়াল মানচিত্রে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই গলির একদম শেষে, পুরোনো পাথরের সিঁড়ি ঘেঁষে, এক আধভাঙা দোকান। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না কী বিক্রি হয় সেখানে। দোকানের নামফলক নেই, কাচের জানালাও নেই—শুধু লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা কাচবিহীন গেট। কিন্তু সন্ধ্যে নামতেই ভেতর থেকে একরকম আলো ঝলসে ওঠে, যেন কেউ ভিতরে রক্তমাখা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। দোকানটির নাম কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে না—যারা আসে, তারা ঠিক পথ খুঁজে নেয়।…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    টিফিনবক্স

    চৈতালি মুখার্জী ১ ভোর সাড়ে চারটে। দমদমের একটি পুরোনো একতলা বাড়ির উঁচু-নীচু ইটের মেঝেতে পা রাখতেই ঠান্ডা সরে আসে পায়ের পাতায়। মীরা কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। উনুনে কেরোসিন ঢালার শব্দ, দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে আগুন জ্বালায় সে—শব্দ হয় ফিসফিসে, অথচ বুকের ভিতর এই মুহূর্তেই যেন এক ধরণের আগুন জ্বলে ওঠে। চাল ধোয়া জল হাতে করে হাঁড়িতে ফেলে সে, পেঁয়াজ কুচো করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে—তাড়াহুড়োতে আঙুল কেটে গেলে পাত্তা দেয় না। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে সে মাঝে মাঝে—আজ তিনটি নতুন অর্ডার এসেছে, তার মানে ১৩টা টিফিন বানাতে হবে, একটাও যেন কম তেল না হয়, বেশ ঝাল না হয়, আরেকটায় যেন কড়ি…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    নবাববাড়ির নটি

    সুচেতনা দত্ত অধ্যায় ১: আসর কলকাতার নবাববাড়ি সেই সন্ধ্যায় যেন স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল—ঝাড়বাতিতে আলো, আতরের সুবাস, পানের স্বাদে ভারী ঠোঁট, আর আড়ম্বরপূর্ণ শেরওয়ানিতে মোড়ানো অতিথিদের মৃদু গুঞ্জন। মাঝে মাঝে চামচ-চামচির শব্দ, কাঁচের গ্লাসে লেবুর জল, আর পেছনের দিক থেকে সেতারের টানা সুর—সব মিলে এক অভিজাত রাত্রির উপসংহার রচনা করছিল। এই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন নবাব আহসান উল্লাহ নিজে, তাঁর পাশে সংস্কৃতিভাজন গুণিজনেরা, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবিগণ। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করছিলেন যার জন্য, সে তখনও পর্দার ওপারে। কেউ বলছিল, “আজ নাকি নতুন বাঈ এসেছে, লক্ষ্মী নামে।” কেউ মৃদু হাসছিল—“নাম শুনেই তো বোঝা যাচ্ছে, লক্ষ্মী সে বটে। তবে সে কি শুধু নাচবে, না…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    ঘুঙুর

    মহুয়া নাগ এক রাধিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের ঘুঙুরজোড়ায় আলতো করে আঙুল বোলায়। সে জানে এই ঘুঙুরগুলো কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এগুলো তার অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি। ঘরে বাতাস চলাচল করে না, মশারির ফাঁকে ভোরের আলো ঢুকে চিবুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; তবু তার মন যেন কোথাও চলে গেছে—এক বিস্তৃত মঞ্চে, যেখানে কেবল সে আছে, তার নাচ আছে, আর আছে নিঃশব্দ দর্শক। বাইরে থেকে শোনা যায় তবলার ঠেক-ঠুক শব্দ—তার বাবা সুবীর সেনের রেওয়াজ চলছে, ভোর পাঁচটার ধারা বজায় রেখে। রাধিকা সেই তাল চেনে, সেই লয় তার ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিদিন, কিন্তু আজকাল সে তবলার তাল নয়, শরীরের সঞ্চালনের ভাষা বুঝতে চায়। তার মা মীনাক্ষী…

  • Bangla - কল্পবিজ্ঞান - নারীবিষয়ক গল্প

    তারাদের গৃহিণী

    পৃথিবী তার চেনা আলোয় জেগে ছিল সেই ভোরে। কলকাতার আকাশটা কেমন গাঢ় ছায়ায় মোড়া, আর বাসের হর্ণ, চায়ের দোকানের কাশা কাশা আওয়াজ—সবকিছু যেন অরুনিমার শরীরে গেঁথে ছিল সেদিন। ওর চোখে তখন ব্যাগভরা কাগজ, অ্যাস্ট্রো-বায়োলজির রিপোর্ট, এক জোড়া ঘুমহীন চোখ, আর একটা রুমাল—যেটা ঈরা বানিয়ে দিয়েছিল ফেলে যাওয়ার আগের রাতে। অরুনিমা জানত, এই যাত্রা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি—চাঁদের বুকে ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে অবতরণ করা শুধু তার নয়, গোটা দেশের গর্ব। তবুও একটা ভার যেন বুকের বাঁ পাশে দলা পাকিয়ে ছিল, ঠিক যেমন বোঝা জমে মেঘলা আকাশে। ট্যাক্সি যখন বাড়ি থেকে বেরোলো, ঈরা তখন তার গাল চেপে ধরে বলেছিল, “তুমি কি আকাশে…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    চোরাবালি

    মীনাক্ষী ধর ভোর সাড়ে পাঁচটা। গ্রামের কুয়াশার চাদরের ভেতর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে চারপাশের ধুলোমাখা জগৎ। রেনু মণ্ডল মাটির বারান্দায় বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা লাল চা হাতে নিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাড়ির ভেতর গরুর ঘটি থেকে টুপটাপ করে দুধ পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর রান্নাঘর থেকে বীণা খাঁর গলা — “আজি মাইনসেগো পেট ভরাই খাওয়াবার হইব না, রেনুবৌদি?” — রেনু কিছু বলল না। তার চোখে ক্লান্তি ছিল না, কিন্তু শান্তিও ছিল না। চোখদুটো যেন অনেক দূর দেখছিল, অনেক গভীরে—সেই জায়গায়, যেখানে শব্দ পোঁছায় না, শুধু গর্জন জমে থাকে। তার স্বামী কুন্তল মারা গিয়েছিল এই বাড়ির একচালা ঘরের…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    চারুলতা

    ইশিতা রায়চৌধুরী এক কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির এক বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে বসে চারুলতা জানলার পাশে একটা নীলকাঠের চেয়ার টেনে বসে আছে। সকালবেলার আলো জানলার গ্রিল পেরিয়ে তার কপালের ওপর পড়েছে, পাতলা চুলগুলো একটু উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়, আর তার হাতে ধরা আছে এক কাপ গরম লিকার চা। বাইরে হালকা কুয়াশা, ব্যালকনির গাছগুলোয় টুপটাপ জল ঝরে পড়ছে — শহরের এত কোলাহলের মধ্যেও তার ভেতরটা কেমন নিঃশব্দ হয়ে আছে। এই নিঃশব্দতা কেবল শব্দহীন নয় — এখানে লুকিয়ে আছে অনেক না-বলা কথা, চাপা কান্না, চেনা ও অচেনা অভিমান। আজ নয়, বহুদিন ধরেই এমন চলছে। তার স্বামী ভাস্কর, এক রাজনৈতিক সাংবাদিক, প্রতিদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যান…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    অন্তর্লীন

    চৈতালি মুখার্জি সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে বিছানার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। তৃষা সেন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন দেয়ালের দিকে। একটা থমথমে নিঃশব্দতা, যেন প্রতিটি দিন একই ভাবে নিজের ভারে এগিয়ে আসে তার জীবনে। পাশের ঘর থেকে কাবেরী সেন—তার মা—চায়ের কাপ রাখার আওয়াজে ব্যস্ততার সূচনা জানিয়ে দেয়। “চা ঠান্ডা হয়ে যাবে,”—এটাই তৃষার প্রতিদিনের প্রথম শোনা সংলাপ। সে কিছু না বলে উঠে পড়ে, মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। কাবেরী চায়ের কাপে চিনি কম দেখেই মুখ বাঁকান, “আজকাল এসব মিষ্টিহীন জীবনটাই কি খুব ফ্যাশনেবল?” তৃষা হেসে বলে, “না রে মা, আজকে গলায় একটু সমস্যা, তাই মিষ্টি কম। ক্লাসে তো সারাদিন কথা…