• Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - রহস্য গল্প

    অদৃশ্য উত্তরাধিকার

    সোনালী দেব ১ রায়চৌধুরী বাড়ি যেন ইতিহাসের এক প্রাচীন দলিল, যার প্রতিটি দেয়ালে লুকিয়ে আছে গৌরব ও ক্ষয়ের মিলেমিশে থাকা কাহিনি। বিশাল ফটক পেরোলেই চোখে পড়ে দোতলা প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি—উঁচু খিলানওয়ালা জানালা, বারান্দার লোহার গ্রিলের কাজ, আর সিঁড়ির মাথায় শ্বেতপাথরের সিংহমূর্তি। একসময় এ বাড়ির জমিদারি ছড়িয়েছিল আশেপাশের বহু গ্রামে, ঘোড়ার গাড়ি, হস্তিদল, পালকি, এবং শত শত কৃষকের আনাগোনায় মুখর থাকত এই প্রাসাদ। এখন অবশ্য সময়ের সঙ্গে তার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু ছায়াঘেরা আঙিনা আর খসে পড়া দেওয়ালগুলো এখনো অতীতের গৌরবের সাক্ষী। সন্ধ্যা নামলেই যেন এই বাড়ি চারপাশের অন্ধকারকে গিলে নেয়; ঝুলে থাকা পুরোনো ঝাড়বাতি, কড়কড়ে দরজা আর বাতাসে…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    নীলপদ্মের শপথ

    অন্তরা মান্না নীলমালা রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে বিশাল সোনার ঝলমলে আলো, রত্নজড়িত আসবাবপত্র, সোনার কাঁটা-পালিশ করা দরজা, কিন্তু সবকিছুই যেন তার হৃদয়ে খাঁড়া স্রোতের মতো বোঝাপড়া ছিনিয়ে নেয়। ভেতরের নিস্তব্ধতা, সিলিং থেকে ঝুলানো ক্রিস্টালের ঝুমকাগুলি হালকা হেলায় নড়ে ওঠার সময় যে মৃদু আওয়াজ করে, তা নীলমালার কানে এক অদ্ভুত সংকেতের মতো বাজে। সে দেখছে—তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, তার বিয়ে, তার নিজস্ব মতামতের বাইরে কেউ ঠিক করছে। কেবল পারিবারিক রীতি, রাজকীয় শর্তাবলী এবং সামাজিক প্রত্যাশার ঘূর্ণি তাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে। নীলমালার চোখে জল আসে, কিন্তু সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোনো অসহায় পাখি খাঁচার ভিতরে নিজের পাখনা ঝাপটাচ্ছে।…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    ছাদবাগানের লুকোনো আকাশ

    অনিতা রায় কলকাতার দক্ষিণের ব্যস্ত এলাকায় দশতলা এক বহুতলের চতুর্থ তলায় মৌসুমি সেনগুপ্তের ফ্ল্যাট। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, এ এক স্বপ্নময় শহুরে সংসার—সাদা দেয়ালের পরিপাটি ফ্ল্যাট, বারান্দায় কিছু শুকনো টব রাখা, জানালার পাশে গামছা শুকোতে দেওয়া, আর ভেতরে এক স্বামী-স্ত্রী ও তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলের নিখুঁত রুটিন। কিন্তু সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর থেকে রাত অবধি চলতে থাকা মৌসুমির দিনচক্রের ভেতরে সেই নিখুঁত ছবির ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে অদৃশ্য শূন্যতা। ভোর ছ’টা বাজতেই অ্যালার্মের আওয়াজে উঠে রান্নাঘরে ঢোকা, ছেলের টিফিন আর স্বামীর চায়ের কাপ সামলানো, এর পর বাসন মাজার শব্দে ভেসে আসা শাশুড়ির ফিসফিসে মন্তব্য, সব কিছুই যেন তাকে এক অবিরাম…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    অদম্য

    নিবেদিতা বসু অনন্যার শৈশবটা অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল। যেখানে বেশিরভাগ মেয়েরা পুতুল সাজাতে, রান্নাবান্না খেলতে কিংবা চকচকে চুলের ফিতেতে মেতে থাকে, সেখানে অনন্যার চোখ জ্বলে উঠত ব্যাট-বলের নাম শুনলেই। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই তার খেলার সঙ্গী ছিল পাশের গলির ছেলেরা। তারা যখন ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামত, অনন্যা কাঁধের ব্যাট ঝুলিয়ে দৌড়ে যেত। প্রথমে ছেলেরা তাকে নিতেই চাইত না, “মেয়েরা খেলতে পারে নাকি?”—এমন ঠাট্টা-বিদ্রুপ হতো নিয়মিত। কিন্তু অনন্যার চোখে এক অদ্ভুত জেদ ছিল, যেন প্রতিটি অবহেলার উত্তর সে ব্যাটের শব্দে দিতে চায়। খেলার সুযোগ না পেলেও সে গলি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সবার খেলা দেখত। কারও ব্যাটিং ভেঙে পড়লে,…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    নীলতরঙ্গ

    স্নিগ্ধা চক্রবর্তী এক ভোরের আলো ধীরে ধীরে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে মীরার সিঁথির পাশে খসে পড়া চুলে লেগে যায়। চায়ের কাপে দুধ গরম হওয়ার শব্দ, প্রেসার কুকারের শিস, আর পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা অরুণের গম্ভীর কাশি—সব মিলিয়ে ঘরটা যেন এক অদৃশ্য নিয়মে চলছে। অথচ এই শব্দের ভেতরে মীরার মনটা থাকে অন্য কোথাও। হাতের কাজ চলতে থাকে অভ্যাসের মতো, কিন্তু মাথার ভেতর এক ফাঁকা গহ্বর—যেন দিনের শুরু মানেই আরেকটা একই রকম দিনের পুনরাবৃত্তি। সবার জন্য সকালের নাস্তা সাজিয়ে দেওয়ার পরও মনে হয়, কেউ যেন তাকে দেখে না, শোনে না। মীরার কাছে সংসারটা এখন যেন এক অদৃশ্য খাঁচা, যেখানে সে নিজেই…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    শিমুলফুলের দিনগুলো

    তিতলি মুখার্জী অধ্যায় ১: শিমুলগাছের ছায়ায় তিতির পালের জীবনের সেইসব দিন, যেগুলো সে পরবর্তীকালে স্মরণ করত “শিমুলফুলের দিন” নামে, আসলে ছিল এক অবিচল, নির্ভেজাল গ্রামীণ শৈশবের প্রতিচ্ছবি। তার গ্রাম—জয়নগর, ছিল যেন এক আলসে দুপুরের মতো ধীর, ছায়াঘেরা, অথচ অনুভবের গভীরে গাঁথা। কাঁচা রাস্তার দু’ধারে খেজুরগাছের ছায়া, পুকুরপাড়ে বসে থাকা ধলেশ্বর মাছের প্রত্যাশায় জাল ফেলে রাখা, আর বিকেলে মাঠের ধারে ছুটোছুটি—এইসবই ছিল তিতিরের দুনিয়া। তাদের ছোট্ট কুঁড়েঘরটি ছিল শিমুলগাছের পাশে, যে গাছের ছায়ায় বসে তিতির স্কুলের হোমওয়ার্ক করত। সেই গাছ, গাঢ় লাল শিমুলফুলে ভরা, যেন তার ছোট্ট জীবনের প্রতিটি স্বপ্নকে আগলে রাখত। হরিপদ পাল—তিতিরের বাবা, ছিলেন একজন গ্রাম্য পাঠশালার শিক্ষক, যিনি…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    আয়নার অন্যপাশে

    সুতপা মল্লিক কলকাতার উত্তরের এক পুরনো বনেদি বাড়ির ভেতর দুপুরটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। ছাদের ওপর চড়া রোদ, নিচের দোতলা বাড়ির অন্দরে নিঃশব্দের এক গহ্বর। ব্রতী সেন জানলার ধারে বসে ছিল, পাশের ঘরে টিকটিকির ডাকে একটানা সময় যেন আটকে পড়েছিল। দুপুরের খাবার, থালা বাসনের শব্দ, শাশুড়ির নিয়মিত বকুনি—সবই সেদিনের মতো সেরে ফেলা হয়েছে। অরিন্দম অফিসে, শাশুড়ি ঘুমোচ্ছেন, আর এই সময়টুকু তার—সে জানে, এই এক-দেড় ঘণ্টা সে তার মতো করে বাঁচতে পারে। কিন্তু কীভাবে বাঁচে, তা সে নিজেই জানে না। তার পছন্দের খাতা, একটা পুরনো পেন আর সেই শাদা পৃষ্ঠা—যেখানে সে শব্দে শব্দে নিজের নিঃশব্দ চিৎকারগুলো গেঁথে রাখে। কেউ জানে না, কেউ…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - সামাজিক গল্প

    অপরিচিতা মোহিনী

    সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    গন্ধহীন গোলাপ

    শ্রেয়া মুখার্জী ১ রূপা সেন জানালার পাশে বসে ছিল, ঘরের অন্ধকারে আধা-দৃশ্যমান তার মুখে দিনের ক্লান্তির ছাপ। বৃষ্টি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে, জানলার কাঁচে জলের রেখাগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। বাইরের আলো আর ঘরের নিস্তব্ধতা মিলে একটা ঘুমন্ত দৃশ্যপট তৈরি করেছিল। রান্নাঘর থেকে ভাতের চাপা গন্ধ আসছিল, কিন্তু সেই গন্ধেও যেন কোথাও কোনও উষ্ণতা ছিল না। অভিরূপ একটু আগেই ঘরে ফিরেছে, অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে সোজা টিভির সামনে বসে গেছে—সাধারণ, প্রতিদিনের দৃশ্য। “আজ অফিসে অনেক চাপ ছিল,” বলেছিল সে, রূপাও মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, “আমারও।” কথাবিনিময় সেখানেই শেষ। এভাবেই শেষ হয় প্রতিদিনের আলোচনার পরিসর—যেন কোনও অদৃশ্য নিয়মের বাঁধনে তারা আটকে আছে,…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - রহস্য গল্প

    নীলপদ্মর ডায়েরি

    মোহনা বসু উত্তর কলকাতার পুরনো এক গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা তিনতলা বাড়িটার নাম ‘শ্রীনিবাস’। বয়স প্রায় একশো বছরের কাছাকাছি। দরজার কাঠে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলে এখনও মনে হয় যেন কেউ আঙিনায় রাঁধুনি দিদার হাঁকডাক দিচ্ছে, ভিতরে কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, আর পেছনের জানালা দিয়ে ভেসে আসছে ফুলকোচুর গন্ধ। এই বাড়িরই বড় কন্যা রোহিনী সেন, বয়স একুশ, প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের ছাত্রী। জন্ম থেকে বড় হওয়া এই বনেদি পরিবারে, যেখানে মেয়েরা কথা কম বলে, হাঁটে মেপে মেপে, হাসে মাথা নিচু করে। রোহিনীর বাবা অশোক সেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, মুখে মেপে কথা বলা, চোখে ঠাণ্ডা নিয়ন্ত্রণের রোশনাই। মা বাণী সেন, সমাজে পরিচিত এক ‘আদর্শ স্ত্রী…