Bangla

পাহাড়ের ডাকে

Spread the love

মৌমিতা সামন্ত


কলকাতার কলেজপাড়ায় পড়াশোনা আর ব্যস্ত জীবনের মাঝে ঈশান, অর্পণ আর রিমঝিম—তিন বন্ধু—চুপিচুপি একটা স্বপ্ন বুনছিল অনেকদিন ধরে। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবনটা কেমন যেন গা ছমছমে দৌড়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে থেমে দাঁড়ানোর সময় নেই, নিজেকে চিনে নেওয়ার সময় নেই, কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে একটুখানি নিঃশব্দে বসে থাকারও জায়গা নেই। কিন্তু এই তিনজন ছিল অন্যরকম। তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল ছিল—বুনো ডাক শুনলেই মনটা কেমন উড়ে যেতে চাইত দূরের কোনও পাহাড়ে, নদীর ধারে, কিংবা গাছপালার মধ্যে।

সেদিন কলেজের ক্যান্টিনে দুপুরের বিরতিতে বসে চা খেতে খেতে রিমঝিম হঠাৎ বলে উঠল, “জানো তো, আমি স্বপ্নে গতকাল পাহাড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। চারপাশে কুয়াশা, পাখির ডাক, আর আমি একা নই—তোমরাও ছিলে।”

ঈশান মুচকি হেসে বলল, “পাহাড়ের ডাক স্বপ্নে নয়, বাস্তবে শুনতে ইচ্ছে করছে আজকাল। চল না কোথাও যাই!”

অর্পণ তখন ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্ট নিয়ে একটু চিন্তায় ছিল, কিন্তু বন্ধুদের চোখের উজ্জ্বলতা দেখে আর না করতে পারল না। সে বলল, “ঘোরাই যায়। তবে কোথায় যাবে ভেবেছো?”

রিমঝিম সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল খুলে একটা ছবি দেখাল—পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের। সবুজে মোড়া সেই পাহাড়, একফালি আকাশ আর কুয়াশার মাঝে একটা সানসেটের দৃশ্য। ঈশান মুগ্ধ হয়ে বলল, “পুরুলিয়া! বেশ ভালোই তো লাগছে। পাহাড়, জঙ্গল, নদী—সব কিছুই আছে।”

অর্পণ বলল, “আরও ভালো লাগছে এই কারণে যে এটা কোনও অতিরিক্ত ট্যুরিস্ট স্পট না। শান্তিপূর্ণ হবে। নিজেদের মতো করে ঘুরে দেখতে পারব।”

পরদিন থেকেই শুরু হল তাদের প্ল্যানিং। গুগল ম্যাপ ঘেঁটে ঘেঁটে রুট ঠিক করল, কোথায় কোন স্টপ, কীভাবে ট্রেক করা যাবে, কোথায় ক্যাম্প করতে পারবে—সব কিছু নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠল। অর্পণ বলল, “একটা গিটার আমি নিয়ে যাব। পাহাড়ের ধারে বসে গান গাব। ওখানকার আদিবাসী মানুষদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারলে দারুণ হয়।”

রিমঝিম তার ডায়েরি আর কিছু পেন্টিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। “আমি পাহাড় আর গ্রামের দৃশ্য আঁকব, আর ভ্রমণলিপি লিখব।”

ঈশান তার ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করল। ওর স্বপ্ন ছিল একজন ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফার হওয়া। সেই সুযোগকে সে হাতছাড়া করতে চায়নি।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা ঠিক করল তিন দিনের সফর—কলকাতা থেকে পুরুলিয়া ট্রেনে, তারপর স্থানীয় যানবাহনে পাহাড়ের কাছে। প্রথম দিন যাবে অযোধ্যা পাহাড়ে, দ্বিতীয় দিন মায়ুর পাহাড়ে ট্রেকিং, আর শেষ দিন চরিদা গ্রাম, যেখানে ছৌ নৃত্যের মুখোশ তৈরি হয়।

তাদের উত্তেজনার শেষ ছিল না। কলেজের সবাই তাদের পরিকল্পনা শুনে হিংসে করতে লাগল। কেউ কেউ বলল, “তোমরা তিনজন কি ঠিক পারবে ওইরকম জায়গায় টেন্ট করে থাকতে?”
কেউ বলল, “সাপ, পোকা-মাকড়, পাহাড়ের রাস্তা—সাবধানে থেকো।”

কিন্তু এইসব কথায় তিন বন্ধুর মন ভাঙল না। বরং তারা আরও জেদ পোষণ করল। কারণ তাদের জানা ছিল, জীবনে সব অভিজ্ঞতা শহরের কংক্রিটের দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

যাত্রার আগের দিন রাতে ঈশান বলল, “এই ট্রিপটা যেন একটা পরীক্ষা। আমরা নিজেদের চিনে নিতে পারব কি না, সেটাও বুঝে নেওয়া যাবে।”
রিমঝিম বলল, “সত্যি! আর আমি চাই—এই ট্রিপ শেষে আমরা শুধু স্মৃতি না, কিছু লিখে, আঁকে, তুলে নিয়ে আসি যা সবসময় আমাদের মনে করিয়ে দেবে—আমরা একবার পাহাড়ে গিয়েছিলাম।”

শেষ রাতে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে অর্পণ তার পুরনো ডায়েরির একটা পাতা খুলে পড়ল—“জীবনের মানে শুধু এগিয়ে যাওয়া নয়, মাঝেমাঝে ফিরে তাকানো, থেমে দাঁড়ানো, আর প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেখাও।”

ট্রেনটা সকাল সাতটার সময় পুরুলিয়া স্টেশনে পৌঁছোল। সারারাতের সফরের পরও ঈশান, রিমঝিম আর অর্পণের চোখেমুখে ক্লান্তির চেয়ে উচ্ছ্বাস অনেক বেশি। জানালার বাইরে তারা তাকিয়ে দেখছিল—রেললাইনের দু’ধারে সারি সারি শাল, পলাশ আর মহুয়ার গাছ। লাল মাটির পথ যেন নতুন কোনও কাহিনির সূচনা করছে।

রিমঝিম বলল, “দেখো, গাছগুলো কত সুন্দর লালচে সবুজ! যেন কেউ রংতুলি দিয়ে এঁকে রেখেছে।”
অর্পণ হেসে বলল, “এটা হলো প্রকৃতির ক্যানভাস, রিম! আমরা তো কেবল অতিথি।”

পুরুলিয়া স্টেশনটা অন্য রকম এক শান্ত পরিবেশে ঘেরা। কলকাতার মত গরম নয়, আবার একেবারে ঠান্ডাও নয়। বাতাসে ধুলোর গন্ধ, সঙ্গে একরকম গ্রাম্য সরলতা। স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা একটি ছোট গাড়ি ভাড়া করল, যা তাদের নিয়ে যাবে বাঘমুন্ডি পর্যন্ত। সেখান থেকে আরও কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে অযোধ্যা পাহাড় অভিমুখে।

গাড়ির জানালা দিয়ে ঈশান ক্যামেরা হাতে নিয়েই বসেছিল। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা খেত, দূরে দেখা যায় এক একটুকরো পাহাড়, মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাঁশের কুঁড়েঘর—সবকিছুর ছবি তুলছিল সে। অর্পণ তার গিটারের কেসটা পাশে রেখে চোখ বুজে বসে ছিল, যেন এই প্রকৃতি তার ভেতরের কোন অদৃশ্য সুরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর রিমঝিম ডায়েরি খুলে একটু একটু করে লিখে চলেছিল—”আজ প্রকৃতি আমার শিক্ষক, আমার বন্ধু। এই লাল মাটির পথে হেঁটে আমি বুঝতে পারছি কত কিছুই না হারিয়ে ফেলেছিলাম শহরের কোলাহলে।”

বাঘমুন্ডিতে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। সেখান থেকে তারা সোজা হেঁটে রওনা দিল পাহাড়ের দিকে। শুরুটা মসৃণ ছিল, কিন্তু যত উপরে উঠছিল, পথ তত কঠিন হচ্ছিল। মাঝে মাঝে রোদটা চড়ে যাচ্ছিল, তবে শাল গাছের ছায়া কিছুটা আরাম দিচ্ছিল। পথের মধ্যে অর্পণ একটা লাঠি কুড়িয়ে নিল, ট্রেকিংয়ের কাজেও লাগবে আর মজাও লাগছিল। রিমঝিম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে গা থেকে শহরের সব ক্লান্তি ঝরে পড়ছে!”

এক ঘণ্টার ট্রেক শেষে তারা পৌঁছল একটি উঁচু স্থান—পাহাড়ের চূড়া নয়, তবে অনেকটাই ওপরে। সেখান থেকে নিচের গ্রামগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। কিছু দূরে ছোট একটি ঝর্ণা, আর তার পাশেই শাল ও মহুয়া গাছের ছায়া। তারা ঠিক করল এই জায়গাতেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে।

ঈশান গিয়ে প্রথমেই ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল, এবং একের পর এক ছবি তুলতে লাগল। রিমঝিম ওই ঝর্ণার ধারে বসে ডায়েরি খুলল, আর পেন্সিল স্কেচ করতে লাগল চারপাশের প্রকৃতিকে। অর্পণ গিটার নিয়ে এক কোমল সুর তুলল, গানে গানে যেন পাহাড়ের বাতাসও ধীরে ধীরে নড়ে উঠল। সেখানে বসে থাকা এক বৃদ্ধ আদিবাসী তাদের শুনছিল মন দিয়ে। তার চোখে ছিল বিস্ময় আর আনন্দের মিশ্র অনুভূতি।

“তোমরা শহর থেকে এসেছ?” সে একসময় প্রশ্ন করল।
রিমঝিম মাথা নেড়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ, বেড়াতে এসেছি।”
“ভালো করেছো,” তিনি বললেন, “এই পাহাড়ে মন ভালো হয়ে যায়, কিন্তু পাহাড়ও তোমাদের চিনে নেয়।”

এই কথাটা তিন বন্ধু কিছুতেই ভুলতে পারল না। পাহাড় কি সত্যিই অনুভব করতে পারে, কারা তার কোলে এসেছে? ঈশান ডায়েরিতে লিখল, “শহর আমাদের ক্লান্ত করে, আর পাহাড় আমাদের চিনে রাখে। আশ্চর্য!”

বিকেলের দিকে তারা পৌঁছাল চণ্ডীপাহাড়ের ধারে একটি আদিবাসী গ্রামে, যেখানে তারা আগে থেকেই টেন্ট করার অনুমতি নিয়েছিল। গ্রামের মানুষজন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তারা তিন বন্ধুকে গরম জল, কিছু চালডাল, আর শাকসবজি দিল রান্নার জন্য। অর্পণ বলল, “আজ আমি রান্না করব, পাহাড়ি রান্না!”
রিমঝিম হেসে বলল, “দেখি তো, আজ তুমি কি বানাও। না হলে লুচি-মাংস ভেবেই চলেছিলাম!”

রাতের আকাশটা শহরের আকাশের মতো নয়—একেবারে পরিষ্কার, তারায় ভরা। তারা তিনজন আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে বসে গান গাইছিল, গল্প বলছিল। গ্রামের কিছু ছেলে-মেয়েও এসে বসেছিল। তারা ‘ছৌ নৃত্যের’ আভাস দিল কিছুটা। অর্পণ বিস্মিত হয়ে বলল, “ওদের শরীরের ভঙ্গিমা আর মুখে যে অভিব্যক্তি! চমৎকার!”

রাতের খাবার শেষ করে তারা ঘুমোতে গেল টেন্টের ভিতরে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস, দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাঝে মাঝে শেয়ালের হাঁক। এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা—যে অভিজ্ঞতা শহরে কল্পনাও করা যায় না।

রিমঝিম ডায়েরি লিখল—
“আজ আমি নতুন করে বাঁচছি। ঘড়ির কাঁটা নেই, মোবাইলের শব্দ নেই, শুধু আছে পাখির ডাক, আগুনের তাপ আর প্রকৃতির নিঃশব্দ সান্নিধ্য।”

ঈশান বলল, “আজ যেন মনে হচ্ছে আমরা সত্যিই বাঁচছি। এই সফরটা শুধু ঘুরতে আসা নয়, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার একটা প্রয়াস।”

অর্পণ একটু দূরে গিয়ে গিটার হাতে একটা সুর তুলল, যার নাম দিল “পাহাড়ের ডাকে”। সেই সুর বয়ে চলল বাতাসে, গাছের পাতায়, পাহাড়ের কোল বেয়ে—আর পাহাড় যেন সত্যিই চিনে নিল তাদের।

আগের রাতে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে তাবুতে কাটানো মুহূর্তগুলো যেন একটা স্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু সকালে উঠে সূর্যের আলোয় সেই স্বপ্নের শরীর যেন আবার বাস্তবের কাঠামো পায়। তিন বন্ধু—ঈশান, অর্পণ আর রিমঝিম—তাদের দ্বিতীয় দিনের অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। আজ তাদের গন্তব্য মায়ুর পাহাড়, যেখানে পৌঁছাতে হলে আরও গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দীর্ঘপথ হেঁটে যেতে হবে।

ঘুম থেকে উঠেই ঈশান ক্যামেরা বের করে পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয়ের ছবি তুলছিল। রিমঝিম ডায়েরির পাতায় লিখছিল আগের রাতের অভিজ্ঞতা, আর অর্পণ কাঁধে গিটার ঝুলিয়ে বলল, “চলো, আজ একটু ঝুঁকি নেওয়া যাক।”

গ্রামের লোকেরা অনেকেই সাবধান করেছিল মায়ুর পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা অত সহজ নয়। বিশেষ করে কেউ যদি গাইড ছাড়া যায়, তবে পথ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থেকেই যায়। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে একটা আলাদা সাহস কাজ করছিল। তারা ঠিক করল, স্থানীয় এক যুবক, ধ্রুব, তাদের সঙ্গে যাবে—সে জন্ম থেকেই এই এলাকায় বড় হয়েছে।

যাত্রা শুরু হল সকালে। প্রথমে রোদটা বেশ মনোরম ছিল, বাতাসে শাল গাছের পাতা দুলছিল ধীর ছন্দে। রিমঝিম হঠাৎ বলল, “এই জায়গাটা যেন কথা বলে। গাছেরা যেন ফিসফিস করে বলে, ‘ভয় পেও না, আমি আছি।’”

হাঁটতে হাঁটতে তারা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল। শুরুতে খোলা রাস্তা থাকলেও পরে রাস্তা হয়ে গেল সরু, এবড়ো-খেবড়ো আর কাঁটা গাছের মাঝে। ধ্রুব বলল, “এই রাস্তায় একটু সাবধানে হাঁটতে হবে। মাঝে মাঝে বুনো জন্তু দেখা যায়। তবে দিনে সাধারণত সমস্যা হয় না।”

প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর তারা পৌঁছল একটা খোলা চত্বরে, যেখান থেকে দূরে দেখা যায় মায়ুর পাহাড়ের চূড়া। সেখানে বিশ্রাম নিতে গিয়ে হঠাৎ অর্পণ লক্ষ্য করল, তাদের জল প্রায় শেষ। ধ্রুব বলল, “আশেপাশে এখনই কোনও ঝর্ণা নেই। তবে আরও একটু ওপরে গেলে একটা ছোট ঝরনা আছে।”

তারা আবার হাঁটা শুরু করল। কিন্তু এবার রাস্তাটা আরও বেশি চড়াই, পাথুরে আর কাঠের মোচড়ানো শিকড়ে ভরা। রিমঝিম কয়েকবার পা হড়কানোর পর বসে পড়ল একটা পাথরের উপর। ঘাম দিয়ে ভিজে গেছে চুল, চোখে ক্লান্তি জমেছে।

“আর পারছি না,” সে বলল হাঁপাতে হাঁপাতে।

ঈশান পাশে বসে বলল, “একটু বিশ্রাম নিই। তারপর আবার চলব। আমরা যদি এখানেই হাল ছেড়ে দিই, তাহলে এই পুরো যাত্রার মানে থাকবে না।”

অর্পণ জল খেতে দিতে গিয়ে দেখল, বোতল একেবারে খালি। ধ্রুব কিছুটা দূরে গিয়ে একটা শুকনো বাঁশের গুঁড়ি কেটে ভেতর থেকে সামান্য জল বের করল। সে বলল, “এই জল খেতে পারো, পরিষ্কার। তবে অল্প।”

জলের স্বাদ তৃপ্তির থেকে বেশি ছিল বাঁচার আনন্দে ভরা। এরপর তারা আবার রওনা দিল। এবার প্রকৃতি যেন চ্যালেঞ্জের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। রাস্তায় একধরনের ঝোপঝাড়, যেগুলোর পাতা কাঁটার মতো ধারাল। একবার রিমঝিমের পা তাতে কেটে গেল। ঈশান ব্যাগ থেকে ফার্স্ট এইড কিট বের করে ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করল।

“চোখে জল চলে আসছে,” রিমঝিম বলল।
অর্পণ কাঁধে হাত রেখে বলল, “দেখো, কষ্ট ছাড়া প্রকৃতি তার রূপ দেয় না। তুমিও এই কষ্টটা পেরিয়ে গেলে পাহাড় তোমাকে আপন করে নেবে।”

এই কথাগুলো শুনে রিমঝিম আবার হাঁটতে শুরু করল। চূড়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছতেই হঠাৎ আকাশ ঘনিয়ে এল। কালো মেঘ, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া আর মাঝেমাঝে বজ্রধ্বনি। ধ্রুব বলল, “বৃষ্টি নামার আগে আমাদের কোনও গুহার মতো জায়গা খুঁজতে হবে, নইলে ভিজে যাব।”

তারা মিলে একটা পাথুরে কোটরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিল। অর্পণ তার ব্যাগ থেকে একটা পাতলা রেইনকভার বের করল, যেটা তিনজনেই শেয়ার করল গায়ে দেওয়ার জন্য। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি নামল, পাহাড়ের গায়ে জল বয়ে যেতে লাগল ছোট ছোট ধারা হয়ে। সেই মুহূর্তটা ছিল একেবারে সিনেমার মতো—তিনজন তরুণ, পাহাড়ের কোলে, ঝড় আর বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে, নিজেদের জীবনের সব দুঃখ, ক্লান্তি ভুলে প্রকৃতির মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে।

বৃষ্টি থামার পর তারা আবার রওনা দিল। শেষ চড়াইটা তুলনামূলক খাড়া ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা পৌঁছে গেল মায়ুর পাহাড়ের চূড়ায়। আর ওপরে দাঁড়িয়ে যে দৃশ্যটা তাদের সামনে এল, তা দেখে তিনজনেই স্তব্ধ। নিচে বিস্তৃত লাল মাটির প্রান্তর, মাঝে মাঝে শালবন, আর দূরে দেখা যাচ্ছে গ্রামের কুঁড়েঘরগুলো। রিমঝিমের চোখে জল চলে এল—এটা কেবল ক্লান্তির প্রতিফলন নয়, এটা ছিল আত্মতৃপ্তির অশ্রু।

ঈশান ক্যামেরা ফ্রেমে তুলল মুহূর্তটিকে—তিনটি ছায়া, পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে।
অর্পণ গিটারের টিউন ঠিক করে বলল, “এই জায়গাটার একটা গান হতেই পারে। একটা নাম দিলাম—‘ছায়ার মতো পাহাড়’।”

রিমঝিম ডায়েরি খুলে লিখল—
“জীবনের প্রতিটা পর্বেই একটা চড়াই থাকে। সেটা পেরোতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেও, চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়—এই কষ্টটাই তো আসল উপলব্ধি।”

ফিরতি পথেও কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু সেটা আর তাদের থামাতে পারেনি। এবার তারা জানত—প্রকৃতি তাদের মেনে নিয়েছে। তারা সফল হয়েছে।

মায়ুর পাহাড় থেকে নামার সময় আকাশটা আবার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির পরের আকাশ ছিল ঝকঝকে, একেবারে ধুয়ে যাওয়া কাঁচের মতো নীল। ঈশান, রিমঝিম আর অর্পণ – তিনজনের মুখেও একটা প্রশান্তির ছাপ ছিল, যেন নিজেদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটা বাধা তারা পেরিয়ে এসেছে।

রাতটা তারা কাটাল বাঘমুন্ডির কাছের এক ছোট হোমস্টেতে। সেই হোমস্টেটি ছিল মাটির ঘরে তৈরি, ছাদে খড়ের ছাউনি, আর জানালার পাশে বাঁশের তৈরি ঝাঁপি। মালিক, এক বৃদ্ধ আদিবাসী দম্পতি, অত্যন্ত স্নেহভরে তাদের আপ্যায়ন করলেন। রাতের খাবারে তারা পেল পেঁয়াজ দেওয়া গরম খিচুড়ি, কচুশাক ভাজা আর টাটকা টমেটোর টক। খেতে খেতে রিমঝিম বলল, “এই সরল স্বাদগুলো এতদিন কীভাবে মিস করছিলাম কে জানে!”

ঈশান ক্যামেরা পাশে রেখেই বলল, “সত্যি বলছি, এই সফরের একেকটা মুহূর্ত ছবিতে ধরা পড়লেও, যে অনুভূতিটা আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, সেটা কোনো ফ্রেমে ধরা যাবে না।”

অর্পণ একমনে উকিল বাড়ানো আঙুলে গিটারের স্ট্রিং টানছিল। হঠাৎ বলল, “জানো, এই কয়েক দিনে আমি বুঝতে পেরেছি, গানের থেকেও বড় একটা সুর আছে, সেটা হলো প্রকৃতির নিজের ছন্দ। এই পাখির ডাক, গাছের পাতার নড়াচড়া, ঝর্ণার ধ্বনি – এগুলোই আসল সংগীত।”

সেই রাতে তারা তিনজন পাশাপাশি খাটে শুয়ে গল্প করছিল। চাঁদের আলো জানালা দিয়ে আসছিল ঘরে। কোথাও কোনও কৃত্রিম শব্দ নেই, নেই শহরের গাড়ির হর্ন, মোবাইলের টুংটাং। শুধু রাত আর তার চুপিসারে ফিসফিস করা।

“এই মুহূর্তগুলো একদিন হারিয়ে যাবে, তাই না?” রিমঝিম বলল চুপচাপ।

“না, এগুলোই আমাদের ভেতরের একেকটা পাথেয় হয়ে থাকবে,” ঈশান বলল, “আমরা যখন ক্লান্ত হব, হতাশ হব, তখন এসব মুহূর্তই আবার বাঁচার ইচ্ছেটা ফিরিয়ে দেবে।”

পরদিন তারা পুরুলিয়া শহরের দিকে রওনা দিল। যাওয়ার সময় পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শাল, মহুয়া আর পলাশ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে অর্পণ বলল, “দেখো, ওরা যেন হাত নাড়ছে—‘আবার এসো’ বলে।”

ট্রেনে ওঠার আগে তারা স্টেশনের এক কোণে বসে পড়ল। ব্যাগগুলো পাশে রাখা, চোখে-মুখে সেই সফরের রেশ।

“আমরা কি বদলে গেছি?” রিমঝিম প্রশ্ন করল হঠাৎ।

ঈশান একটু ভেবে বলল, “হয়তো বদলাইনি, কিন্তু আমরা নিজেকে নতুন করে চিনেছি।”

“হুম,” অর্পণ বলল, “আমরা শহরে ফিরলেও পাহাড় আমাদের সঙ্গে থেকে যাবে। আমাদের সুরে, লেখায়, ছবিতে। আমাদের চোখে।”

ট্রেনের জানালার ধারে বসে তারা ছুটে যেতে থাকা প্রকৃতিকে দেখতে লাগল। এই ফিরতি পথ যেন তেমনটাই, যেমনটা কোনও গল্পের শেষ অধ্যায়। তবে এই অধ্যায় শেষ নয়, বরং একটা নতুন গল্পের সূচনা।

কলকাতা পৌঁছে তারা আবার ফিরে গেল নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে—ঈশান তার ফটোগ্রাফির প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হল, রিমঝিম তার কবিতা আর নোটবুক নিয়ে ক্লাসে ফিরল, আর অর্পণ স্টুডিওতে নতুন গানের কম্পোজ শুরু করল।

কিন্তু সবাই জানত, কিছু একটা বদলে গেছে।

একদিন, কয়েক সপ্তাহ পর, তারা তিনজন আবার একসাথে বসেছিল পার্ক স্ট্রিটের একটা ক্যাফেতে। আলো-আঁধারির মাঝে কফির কাপে ভেসে চলা বাষ্প, আর দূরের ট্র্যাফিকের আওয়াজ। হঠাৎ ঈশান ব্যাগ থেকে একটা অ্যালবাম বের করল। সেখানে ছিল পুরুলিয়ার সেই সফরের মুহূর্তগুলো – ঝর্ণার ধারে বসে থাকা রিমঝিম, গাছের ছায়ায় গান গাইছে অর্পণ, বৃষ্টিভেজা পথে হেঁটে চলেছে তারা।

রিমঝিম বলল, “এই ছবিগুলো দেখলেই মনে হয় আবার সেখানে ফিরে যেতে চাই। আবার হাঁটতে চাই সেই পাথুরে পথ দিয়ে।”

অর্পণ হেসে বলল, “আসলে ওই পাহাড় আমাদের ডাক দিচ্ছিল, আর এখন আমরা তার কাছে ফিরে যেতে চাইছি।”

ঈশান বলল, “চলো আবার প্ল্যান করি। এবার আরও গভীরে যাব, আরও প্রকৃতির কাছে পৌঁছবো।”

রিমঝিম ডায়েরির এক পৃষ্ঠায় লিখল –
“কখনও কখনও একটা ভ্রমণ শুধু জায়গা বদল নয়, সেটা হয়ে ওঠে আত্মার এক যাত্রা। পাহাড় শুধু আমাদের ডাকেনি, ও আমাদের ভেতরের মানুষটাকেও জাগিয়ে তুলেছে।”

তারা জানত, এই সফর কোনও ‘দ্য এন্ড’ ছিল না। বরং এটা ছিল একটি নতুন পথচলার সূচনা। পাহাড়ের ডাক তারা শুনে ফেলেছে—আর সে ডাক একবার শুনে গেলে, তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

 

শেষ

1000016463.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *