ঈশান দত্ত পর্ব ১: জানলার ধারে বসে নিউ জলপাইগুড়ির শালবন ঘেরা রেল কোয়ার্টার পাড়ার ঠিক পেছনে ছিল এক পুরনো ইংরেজ আমলের স্কুল—”নিউ জলপাইগুড়ি বয়েজ হাই স্কুল”। সেই স্কুলের দশম শ্রেণির ‘বি’ সেকশনের শেষ বেঞ্চে বসত পাঁচজন—সোহম, তন্ময়, রিমঝিম, অরিত্র আর সঞ্জনা। সবার মধ্যে কিছুটা যেন ছন্দে গাঁথা বন্ধুত্ব ছিল, আর তার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রেম, অভিমান আর একটা কাঁচা উত্তেজনা। সোহম আর তন্ময়—শৈশবের বন্ধু। একসঙ্গে হিউম্যানিটিজ নিয়েছে। ক্লাসে সবসময় তৃতীয় বা চতুর্থ রোল নম্বরেই থাকে, কিন্তু পড়াশোনায় তেমন মন নেই। সোহমের চোখের কোণ সবসময় সঞ্জনাকে খোঁজে, আর তন্ময় সেটা জানলেও কিছু বলে না। তন্ময়ের মন পড়ে থাকে নীল আকাশে, সেও…
-
-
মহুয়া দত্ত এক কলকাতার বাতাসে সেই দিনটায় একটা পুরোনো কালি আর ধুলোর গন্ধ ছিল। শরতের রোদ জানালার কাঁচে আটকে পড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল টেবিলের ওপর ছড়ানো নোট আর পাণ্ডুলিপির উপর। ঋদ্ধিমা চৌধুরী চশমার ফ্রেম একটু উঁচু করে বসল, তার সামনে রাখা একটি চোরা ধুলিধূসরিত তালপাতার পুঁথির দিকে তাকিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর এবং কালচারাল স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী সে, আর তার গবেষণার বিষয় – “হারিয়ে যাওয়া লোকগোষ্ঠীর মৌখিক সংস্কৃতি ও চিত্রভাষা”। পুঁথিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালার একটি উপেক্ষিত তাকে ধুলোর নিচে ছিল; কেউই এর গুরুত্ব বোঝেনি, যতক্ষণ না ঋদ্ধিমার নজরে পড়ে। পাতাগুলো ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে সে অনুভব করেছিল এক অদ্ভুত শীতলতা –…
-
অনিরুদ্ধ বাগচী ১ গঙ্গা, পদ্মা আর মেঘনা—তিন নদী, তিন স্রোত, তিন বুকভরা কান্না। এবং সেই কান্নার নিচে চাপা পড়ে থাকা তিনটি মুখ—রোহিমা, পার্বতী, আর নিরু। ১৯৪৩ সালের অগাস্ট মাস। আকাশ যেন প্রতিদিন আগুনে পোড়া ভাতের মতো ঝাঁজালো। সূর্য চৌচির মাটি ফাটিয়ে ঢুকতে চাইছিল মানুষের নাভিমূলে। মাঠ নেই, ফসল নেই, কুয়াশা নেই—শুধু চিৎকার আর খিদে। গঙ্গার ধারে রোহিমার গ্রামটা কখনও মাটি হারায়নি, বর্ষায় শুধু উঠোনে জল দাঁড়াত। কিন্তু এই বছর বর্ষা এল না। আর এল না বাজারের দিকে চালের গন্ধ। তার স্বামী কাসেম ঘাটে কাজ করত। একদিন ঘরে ফিরে বলল, “আজ পাঁচ পয়সার চাল বিশ পয়সায় উঠছে। দু-সপ্তাহের মধ্যে চাল থাকবে…
-
সুদীপ্তা মিত্র অধ্যায় ১ বৃষ্টি আসবে কি না, সেটি নিয়ে আকাশ যেন নিজেই দ্বিধায়। পাড়ার মাথায় পুরোনো অশ্বত্থ গাছটার পাতায় কুয়াশার মতো শিশির জমে আছে, রোদ এখনও মুখ খুলে উঠতে পারেনি। সকাল ঠিক দশটা। এই সময়েই প্রতিবারের মতো ধীরপায়ে এসে দাঁড়ালেন অনুরাধা মিত্র—মনে হলো যেন প্রতিটি পা-ই কোনও অদৃশ্য প্রতিশ্রুতির ভার বইছে। তাঁর শাড়িটা একরঙা হালকা ধুসর, মাথায় সাদা খোঁপা, কপালে ছোট্ট লাল টিপ। মুখে একরকম ধীর, নরম বিষণ্ণতা—যেটা বয়সের চিহ্ন নয়, বরং সময়ের সঙ্গে লড়াই করে রয়ে যাওয়া অভ্যেস। তিনি বোথের ভেতর ঢুকলেন, দরজাটা নিজে থেকেই খট করে বন্ধ হল, আর পাশের চায়ের দোকানে বসা সোমনাথ ঠোঁটে চায়ের কাপ…
-
মনোরঞ্জন পাল ১ শীতের ভোর। কুয়াশায় ঢাকা গ্রামের মেঠোপথ যেন সাদা চাদরে ঢাকা নিঃশব্দ প্রান্তর। দূরে কাশবনের ফাঁক গলে লাজুক সূর্য উঁকি দিচ্ছে, আর বাতাসে মিশে আছে গরুর গাড়ির ঘণ্টার শব্দ, কাকের ডাকা আর নদীর জলে কচুরিপানার হালকা দুলুনি। এমন ভোরে যখন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ উনুনে প্রথম কাঠের আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত, তখন নদীর চরে বসে এক মানুষ, নাম তার রামপ্রসাদ বাউল। গায়ে মলিন সাদা ধুতি, লাল পাগড়ি, কাঁধে লম্বা ঝোলানো একতারা, আর গলায় ছোট্ট একটি মাদুলি—যেটা তার বাবার দেওয়া আশীর্বাদপুষ্ট স্মৃতি। তার কালো চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছে, মুখে দাড়ির ভাজে লুকিয়ে আছে জীবনের ক্লান্তি আর সংগ্রামের ছাপ। তিনি চোখ বন্ধ…
-
অনির্বাণ চক্রবর্তী পর্ব ১: আলো এসে পড়ে নয়নপুর শহরের প্রান্তে, সেই লালচে ইটের পুরনো দোতলা বাড়িটা শহরের কোলাহলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বহু বছর ধরে। জংধরা গেট, একপাশে বেঁকে থাকা নারকেল গাছ, ছাদে শুকনো কাপড়ের দুলুনি—সব মিলিয়ে এক ধরনের নিস্তব্ধ নস্টালজিয়া। ওই বাড়ির দোতলায় একা থাকেন সরলা দেবী। বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে, স্বামী মারা গেছেন প্রায় বারো বছর আগে, ছেলেটা থাকে ব্যাঙ্গালোরে। আসা-যাওয়ার ব্যবধানটা বছরে একবারে এসে ঠেকেছে অনেক দিন আগে। সরলা দেবীর দিন কাটে একঘেয়ে রুটিনে—ভোরে উঠে তুলসী তলায় জল দেওয়া, কাকের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা টেনে প্রার্থনা, তারপর পত্রিকা পড়া, রেডিওতে গানের ক্লাসিক, দুপুরে নিঃশব্দ ভাত খাওয়া, আর বিকেল…
-
বহ্নি চক্রবর্তী পর্ব ১ পদ্মার ওপার থেকে সূর্য যখন মাথার ঠিক ওপর উঠে এল, তখন রমিজ আলী তার নৌকাটা ধীরে ধীরে ঘাটে বাঁধছিল। ঘাটটা এখন অস্থায়ী—বাঁশের খুঁটি দিয়ে বাধানো, পেছনে শুকনো খড়ের ছাউনি। সকালে তিনটে পরিবার পার করে এনেছে ওপার থেকে, এখন আবার পাঁচজন অপেক্ষা করছে যাবার জন্য। রমিজ কারো নাম জিজ্ঞেস করে না, ধর্মও না, শুধু বলে—“চুপচাপ বসেন, ভয় পাইয়েন না।” তার নৌকায় ওঠা মানেই যেন এক নীরব চুক্তি—পদ্মা কিছুই মনে রাখে না, আর মাঝিও না। বছরখানেক আগেও এই নদীর পাশে ছিল তার স্ত্রী আর ছেলের কুটির, দুজনেই এক রাতে উধাও। কেউ বলে হিন্দুদের দাঙ্গাকারীরা তুলে নিয়ে গেছে, কেউ…
-
Aparna Basu অধ্যায় ১: স্বপ্নের বীজ শীতলডাঙ্গা গ্রামের সকালগুলো খুব বেশি বদলায় না, বছরের পর বছর ধরে একই ছন্দে বয়ে যায় এখানকার সময়। মাটির রাস্তা বেয়ে গরুর গাড়ির চাকা আঁকিবুঁকি কেটে চলে, ঝুপড়ি ঘরের চালার ফাঁক দিয়ে প্রথম রোদের আলো মাটির উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে, আর বনে-পাহাড়ে শাল-পলাশের গন্ধ মিশে যায় হাওয়ার সাথে। সেই হাওয়াতে ভেসে আসে পাখিদের ডাক, যেটা প্রতিদিন ঘুম ভাঙায় গ্রামের মানুষদের। শীতলডাঙ্গার শেষপ্রান্তে, বাঁশঝাড়ের পাশে এক মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি দেওয়া। সেই ঘরে থাকে মুক্তা, বারো বছরের কিশোরী মেয়ে, যার চোখে আছে বিশাল স্বপ্নের জগৎ, যদিও সেই স্বপ্ন এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মায়ের ডাকেই তার সকাল শুরু…
-
ঐশী চৌধুরী জঙ্গলের ডাক মেঘমালা বসাকের বয়স পনেরো। কিন্তু তার চোখে যেন হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষের জ্ঞান আর ভবিষ্যতের বাতাসের গন্ধ। সবুজডাঙা গ্রামের এই দশম শ্রেণির ছাত্রী বরাবরই একটু অন্যরকম। পুতুল খেলায় তার মন ছিল না, বরং মাঠে ঘুরে ঘাসের গন্ধ নিতে, পাখিদের ডাক শুনতে আর গাছের ছায়ায় বসে গল্পের বই পড়তে ভালোবাসত। গ্রামের পাশেই একটুকরো জঙ্গল, যেখানে ছোট্ট খালটা বয়ে গেছে বাঁক নিয়ে। সেই খালের পাড়ে বসে মেঘমালা ভাবত, পৃথিবী যদি সবসময় এমন সবুজ থাকত! কিন্তু সবুজডাঙার সবুজ আর আগের মতো নেই। নতুন রাস্তা তৈরির নাম করে পঞ্চায়েত কয়েক মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জঙ্গলের একাংশ কেটে ফেলা হবে। গাছগুলোতে…
-
শুভাশিস রায় পর্ব ১: ঘর, সমাজ আর আমি স্নিগ্ধা যখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, শহরের কোলাহল তার গায়ে কখনও লাগত না। একসময় যে শহরে সে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, সেই শহরই এখন যেন প্রতিদিন তাকে প্রশ্ন করে—”তুমি এখনো আছো কেন?” তিন বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা যায় তার স্বামী অভিরূপ। দাম্পত্য ছিল শান্ত, যদিও প্রেমে রঙের চেয়ে দায়িত্বের ছায়া ছিল বেশি। একমাত্র ছেলে রুদ্র তখন মাত্র আট বছরে পা রেখেছে। অভিরূপের মৃত্যু সংবাদ শুনে ছেলেটার চোখে কোনো প্রশ্ন ছিল না, শুধু একটা স্থির তাকিয়ে থাকা। সেই চাহনি আজও স্নিগ্ধার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে আছে। দেখতে গেলে সমাজ তাকে দয়া করে রেখেছে। “বিধবা মেয়েদের…