সাম্য বন্দ্যোপাধ্যায় ১ রঞ্জনের সকালগুলো ছিল শব্দহীন কিন্তু জীবন্ত, এক টুকরো জলছবির মতো। ঘুম ভাঙতো কাদামাটির বাড়ির চালা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রোদের ছায়া গায়ে মেখে। দূরে মন্দার নদী তখনো ঘুমিয়ে, শুধু কচুরিপানার মাঝখানে গুটিকয়েক হাঁস দুলে বেড়ায়, আর বাতাসে ভেসে আসে মাছ ধরার জালের গন্ধ। মা তখন রান্নাঘরে চাল বেছে, পেছনে একটা লাঙল-ধোয়া পুকুরঘাট থেকে ভেসে আসে সুর করে গাওয়া কোনো বাউল গান। রঞ্জন দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ায়—পায়ে কাদা, কাঁধে একটা ছেঁড়া তোয়ালে, হাতে বাবার দেয়া পুরনো জাল। তার দিন শুরু হয় এই নদী, ঘাস, গন্ধ, আর ছেঁড়া আকাশ নিয়ে। স্কুলে যাওয়ার আগে রঞ্জনের পছন্দ ছিল নদীর পাড়ে হাঁটা,…
-
-
কুহেলী ধর ১ বাড়ির বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে। মেঘলা গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে রইল জানলার ধারে। নীচে প্যান্ডেলের বাঁশ বেঁধে গাঁদার মালা ঝোলানো হচ্ছে, ঢাকিরা এসেছে, ঢাকের প্রতিটা আওয়াজে যেন বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। ঘরের ভেতরে চায়ের কাপ রাখা, তাতে ধোঁয়া উঠছে না — কারণ মেঘলা আর চা খায় না, কবে যে নিজের পছন্দের তালিকা থেকে চা নিজেই বাদ দিয়েছে, তার ঠিক নেই। বরং, স্বামী রণদীপ আর মেয়ের জন্য রোজ সময়মতো ব্রেকফাস্ট বানানোই এখন তার কাছে ‘প্রিয় কাজ’। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটায় দাঁড়িয়ে, স্বামী অফিসের কথা বলে আজ একটু দেরিতে উঠেছে। মেয়েটা পাশের ঘরে অনলাইন ক্লাসে ব্যস্ত, অথচ…
-
দেবব্রত জানা অধ্যায় ১: শস্যখেতের ছায়ায় পুব দিক থেকে সূর্যের আলো যখন ধানক্ষেতের কাঁচা সবুজ পাতার উপর পড়ত, রঘুবর হালদারের মনেও আলো ঝরে পড়ত। প্রতিদিনের মতো আজও সে ভোর ছ’টার মধ্যে মাঠে পৌঁছে গিয়েছিল। কুয়াশা তখনো জমির উপর পাতলা চাদরের মতো বিছানো, আর নলকূপের জলে হাত-মুখ ধুয়ে রঘুবর দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের জমির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ—যেন মাটি কথা বলছে তার সঙ্গে। এই জমি তার দাদার দাদা কিনেছিলেন, এরপর প্রজন্ম ধরে চাষ চলছে, আর এখন তিনিই সেই উত্তরাধিকার। ধান, পাট, সর্ষে, আর মাঝেমাঝে একটু আখ—এই নিয়েই তাদের সংসার চলে। জমির প্রতিটি চওড়া ডোল, প্রতিটি মাটির ফাটল, এমনকি কোথায় কাক বাসা বাঁধে—সব…
-
অরিত্র বসু পর্ব ১: শহরের রোদের মতো নয় আমার নাম অরিত্র। কলকাতা শহরের বুক থেকে উঠে আসা, ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে একটা ছোট বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করি। বেঁচে থাকি ক্যাফেতে, পাতালরেলে, রেড ওয়াইনের আলোছায়ায়। তবু, কখনো-কখনো একটা নির্জনতা আমাকে টানে, যেন নিজের ছায়াকেও চিনতে পারছি না এই ভিড়ে। তাই অফিসের এক মাসের ছুটি পেয়েই আমি ঠিক করলাম – যাবো পুরুলিয়ার এক আদিবাসী গ্রামে। নাম – করমডি। সে নাম কেউ চেনে না। আর তার মানেই হয়তো শান্তি। সেই গ্রামে যাবার আগে একমাত্র সম্বল ছিল কিছু পুরোনো গল্প – বাবা বলত, একসময় সে এখানে ক’মাস ছিল, ছাত্রজীবনে। “সেই লাল মাটির পথ দিয়ে…
-
শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় ১ সকাল সাতটার ঠিক আগেই, গলির মাথার সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে যেন জীবনের রিহার্সাল শুরু হয়। শিবুর দোকান—আসলে এক বাঁশের ফ্রেমে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে বানানো, একটা মোড়া আর তিনটে বেঞ্চ, পাশে একটা রেডিও ঝুলছে সুতোর টানে—এইখানেই বসে ভবানী কাকু তাঁর রাজত্ব চালান। পাঞ্জাবি-ধুতি পরা, সাদা চুলে হালকা তেল, আর সেই চিরচেনা গোল চশমার আড়ালে মুখভর্তি আত্মবিশ্বাস। হাতে এক কাপ লাল চা নিয়ে বসে থাকেন সবার অপেক্ষায়, যেন এই পাড়ার সকল কথোপকথনের তিনি কর্ণধার। চা-র তাপ, পত্রিকার খবর আর ফুটবল-রাজনীতি-সিনেমা নিয়ে তাঁর ধ্রুপদী বিশ্লেষণ—সব মিলে এক নিখুঁত সকাল তৈরি হয়। “শিবু, চিনি কম নিস! কালও চাপে পড়ে রেণুদি বলল,…
-
স্নেহাশিষ রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। জাদরেল রোদের আভা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের স্টেশনে। গরম বাতাসে ছিন্ন কাপড়ের মতো ওড়ানো যাচ্ছে না কোনো মন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ৩২ নম্বর লোকাল ট্রেনের কামরায় যেন আগুনের ঢেউ বইছে। সেই উত্তপ্ত কামরার মধ্যে দিয়ে হাঁটছে দশ বছরের একটি ছেলে—হাতে একগুচ্ছ তালপাতার পাখা। ছোট্ট শরীরে ঘাম জমে রেখার মতো গড়িয়ে পড়ছে, তবে চোখে কোনো ক্লান্তি নেই। তার ঠোঁটে এক মৃদু ডাক—“তালপাতার পাখা নিন… গরমে আরাম… পাঁচ টাকায় একখানা…”। প্রতিটি যাত্রীকে দেখে সে যেন কল্পনা করে, কে কিনবে, কে ফিরিয়ে দেবে। কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ তিরস্কার করে—“যাও যাও, বিরক্ত করো না।” তবু সে এগিয়ে যায়।…
-
অতুল ব্যানার্জী ১ সকাল সকাল ঘুম ভাঙে সুবলের। তার ঘুমটা গাঢ় হলেও, সীমান্তে গর্জে ওঠা ট্রাকে চেপে আসা বিএসএফের পেট্রল-জিপের শব্দ যেন কানে লেগে থাকে স্বপ্নের মধ্যেই। তাদের ছোট কুঁড়েঘরটা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে ধারঘেঁষে। কাঠের বারান্দা নেই, কুয়োর জল রোদে শুকিয়ে থাকে আধা বালতির মতো। মা জাহানারা বিবি তখনো হাঁড়িতে জল চড়িয়ে রাখেন, আর কাঁটাতারের ওপাশের ঝোপের দিকে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকেন। তিনি জানেন, সেই দিকে নজর রাখতে হয়—সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটে, তা অনেক সময় পাছে এসে ঘরেও থাবা বসায়। সুবল আজ আর স্কুলে যেতে চায় না। স্কুল মানে ধুলো জমা বেঞ্চ, অসহ্য গরম, আর মাস্টারের কাঠের স্কেলের ঠক…
-
সন্দীপন সাহা ১ জলতলার আকাশটা সকাল থেকেই ধূসর হয়ে ছিল। মেঘগুলো যেন জমাট বাধা দুঃখের মতন মাথার ওপর ঝুলছিলো, আর ঠিক বেলা এগারোটা নাগাদ প্রথম বৃষ্টি নামে। টিনের ছাউনি মাথায় চাপিয়ে থাকা ছোট ছোট ঘরগুলোর ওপর বৃষ্টির শব্দ ধাতব ঘন্টাধ্বনির মতো বাজতে থাকে। সজল জানালার ফাঁকে মুখ গলিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে তখন ঈশ্বরের খেলা—যেন নীলের বদলে আকাশের রং হয়ে গেছে রুপালি। ঘন জলকণা মাটিতে পড়তেই কাঁচা রাস্তা একাকার হয়ে যাচ্ছে, নালার জল ফুলেফেঁপে উঠছে, আর বৃষ্টির ধারায় সেই জল যেন দিকবিদিক ছুটে যাচ্ছে। সজল ভাবে—”এই জলে যদি একখানা নৌকা ভাসাই, কোথায় যাবে সেটা?” তার মা তখন ভাঙা বাসনের ওপরে…
-
সুব্রত দাশগুপ্ত ১ রিমার চোখে এই শহর ছিল এক স্বপ্নময় চিত্রপট — বড় বড় বিল্ডিং, আলোর রোশনাই, গাড়ির একটানা শব্দ, আর ছাদের ওপর নীল আকাশে উড়তে থাকা সাদা পায়রার মতো সুখ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগেনি। মায়ের মৃত্যুর পরে মামা তাকে শহরে নিয়ে আসে, একটা “ভালো” বাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। বয়স দশ হলেও, রিমা জানত কাজ বলতে কী — খাটুনি, হাঁটু পর্যন্ত ঝাঁপ দেওয়া, বকুনি খাওয়া আর সবশেষে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুতে ঘুমিয়ে পড়া। প্রথম দিন শহরে এসে মালবিকার বাড়িটা দেখে তার মনে হয়েছিল, এ যেন এক রাজপ্রাসাদ। চারপাশে ঝকঝকে কার্পেট, অচেনা গন্ধে ভরা ঘর, দেয়ালে টাঙানো ছবি আর…
-
অনিন্দিতা ধর শীতের সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছিল ধীরে ধীরে। দেয়ালের বইয়ের তাকের পাশে দাঁড়িয়ে দীপ্তেন্দু বসু আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন। আয়নায় যেন সবসময়ই তার চেহারায় একটা সন্তুষ্টির ছায়া ধরা দেয়— একটা “আমি সমাজের জন্য কিছু করছি” ধাঁচের আত্মতৃপ্তি। আয়নার সামনে ছোট্ট টেবিলে রাখা ছিল ঘড়ি, পারফিউম, স্কুল ব্যাজ আর একটা পুরোনো খাতার পাতা— যেখানে কাল রাতেই লিখেছিলেন, “নারীর মর্যাদা রক্ষায় সমাজের ভূমিকা”। আজ শহরের এক নামী স্কুলে আলোচনা সভা; তিনিই প্রধান বক্তা। টেবিলের ওপর রাখা ছিল গীতার বানানো লাল চা। গীতা— গৃহপরিচারিকা মঞ্জুর মেয়ে, বয়স চোদ্দো, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে প্রায় এক বছর হলো, তবু তার চায়ের স্বাদ দীপ্তেন্দু…