মোহর গঙ্গোপাধ্যায় এক হঠাৎ ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই মহুয়ার চোখে যেন ধূসর একটা পর্দা নামল—নিজের ঘরটা চেনা লাগল না। আলোটা ঠিক কীভাবে জানালার ভেতর দিয়ে ঢুকছে, কিংবা বিছানার পাশের বইগুলো এত এলোমেলো কেন, বুঝে উঠতে পারল না সে। নিজের শরীরটা যেন নিজের নয়, মুখের চামড়া অচেনা ঠেকছে, চুলের গন্ধ অন্যরকম, এমনকি ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যে মুখটা সে দেখল, তা যেন অচেনা কারও। ছিপছিপে, ঘাড়ের ডানদিকে ছোট একটা আঁচড়ের দাগ—যেটা তো তার থাকার কথা নয়! সেই মুখ তার দৃষ্টির দিকে ফিরেও তাকাল না, বরং এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। মহুয়া ব্যস্ত কর্মজীবনের মানুষ, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়ে বাঁচে—তবু…
-
-
শ্রাবণী দাস ১ ভোর তখন পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কিন্তু নদীয়ার ছোট্ট তাঁতশিল্পের গ্রাম বর্ণনাদহ যেন দিনের প্রথম নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। গ্রামের মাটির গন্ধ, ধোঁয়া ওঠা চুল্লির কাশফুলের মতো পাতলা ধোঁয়া, আর তাঁতের খটখট আওয়াজ—সব মিলে এক অবাক মায়ার ভোর। সেই মায়ার মধ্যেই উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল মেঘলা পাল, এক হাতে ধরা সুতোর গোছা আর অন্য হাতে তার বাবার পুরোনো নকশার খাতা। চুলে গাঁথা ছিল লাল জবা, চোখে ছিল দূরের স্বপ্নের আলো। মেয়েটির বয়স বেশি না—এই বাইশ, তবুও তার চিন্তা যেন এক শিল্পী আর বিপ্লবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সে জানে, এই গাঁয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই তাকে জড়িয়ে ধরেছে সমাজের রক্ষণশীলতা, কিন্তু একইসাথে তার চোখে…
-
অর্ণিকা সেন ১ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম সরভুমি, যেখানে শহরের কোলাহল পৌঁছায়নি, যেখানে লাল মাটির রাস্তা সরু হয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে গেছে মাঠের বুক চিরে, আর দূরে দূরে তালগাছ, খেজুরগাছ মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সরভুমির আকাশ বড় খোলা— সেখানে মেঘেরা প্রতিদিন গল্প বলে, পাখিরা ডানা মেলে উড়ে যায় দূর অজানায়, আর সন্ধ্যা হলে ধীরে ধীরে আঁধার নামে, সেই আঁধারে জোনাকিরা আলো জ্বালে। এ গ্রামেরই এক মাটির ঘরে জন্ম রেখা মণ্ডলের। তার বাবা জগদীশ মণ্ডল— গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রাক্তন পিয়ন, এখন বয়সের ভারে জমিতে কাজ করেন। মা সরলা মণ্ডল সারা দিন সংসারের কাজ সামলান, মাঠ থেকে সবজি আনে, ঘরের…
-
পূরবী মজুমদার এক কলকাতার বুকে গড়ে ওঠা এক চিরাচরিত বহুতল আবাসন। বাইরে ব্যস্ত রাজপথ, চিরচেনা হর্নের শব্দ, বাতাসে ভেসে আসা বেগুনি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর ভেজা মাটির গন্ধ। এই কোলাহল আর নিস্তব্ধতার মিশেলে একটি ঘরে বসবাস কুমুদিনীর—এক গৃহবধূ, এক মা, এক পুত্রবধূ। তার নিজের নামটা যেন আজ আর কারও মুখে উচ্চারিত হয় না। সবাই তাকে ডাকে “মা”, “বৌমা”, “মেসোমশাইয়ের বৌ”, কিংবা “ছোট বৌ” বলে। এই নামগুলির আড়ালে কোথাও হারিয়ে গেছে কুমুদিনী নামের সেই মেয়েটি, যে একদিন স্বপ্ন দেখত রঙ আর তুলির খেলায় নিজের জীবনের গল্প লেখার। সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢোকে। বারান্দার গাছগুলোয় কয়েকটা শালিকের ডাক। কুমুদিনীর দিন…
-
মৃণালিনী ধর অধ্যায় ১: কলকাতার শহরতলির প্রান্তে ছোট্ট একটি দোতলা বাড়িতে একা থাকে অরণ্যা সেন। বাইরের চোখে সে নিছকই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত তরুণীর মতো—একজন কলেজে ইতিহাস পড়ানো প্রভাষক, যার দিন শুরু হয় এক কাপ চা দিয়ে আর শেষ হয় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে। কিন্তু অরণ্যার রাতের ঘুম আর দিনের স্বপ্ন এক অদ্ভুত বৃত্তে আটকে আছে—সে দেখতে পায় আগুনে ঘেরা শঙ্খ, সাদা পাথরের মন্দিরের স্তম্ভ, আর কোনো এক নারী যার কণ্ঠস্বর ঝড়ের মতো ফুঁপিয়ে ওঠে। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল ক্লান্তির পরিণাম, কিংবা ইতিহাস বইয়ের অতিরিক্ত প্রভাব। কিন্তু যখন তার শরীর নিজের অজান্তেই মাটি ছুঁয়ে ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে বসে পড়ে, যখন তার ঠোঁট কাঁপতে…
-
অপর্ণা দে বিশ্বাস ১ পৌষের হিমেল হাওয়া বইছে। ছোট শহরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শিউলিদের সিঁড়িওলা দোতলা বাড়ি। বারান্দার গ্রিলে শুকোতে দেওয়া উলের সোয়েটার, গামছা, চাদর—সবকিছুই মায়ের যত্নে সারি করে লটকানো। ঘরের ভেতর দিয়ে একমুখী রোদ এসে পড়েছে মেঝের গায়ে, সেই রোদের উপর খেলা করছে ধুলোবালি, যেন সোনার কণা। শিউলি সবে সাত বছর পেরিয়েছে, চুলদুটো বেণী করে বাঁধা, কপালে ছোট্ট টিপ। ওর চোখে-মুখে শিশিরের মতো জড়াজড়ি করা কৌতূহল। সকালবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যায় শিউলি। বাবা একজন স্কুলশিক্ষক, নাম নারায়ণ সরকার। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারি করেন। সাদামাটা মানুষ, পড়াশোনা আর নীতিনিষ্ঠার বাইরে ওনার জীবনে খুব বেশি কিছু নেই। মাকে নিয়ে…
-
ঋতা মিত্র উত্তরের ডাক কলকাতার এক গরম বিকেল। ছেলের হোমওয়ার্ক শেষ করিয়ে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল মেঘনা। জানলার ধারে বসে থাকা সেই একচিলতে সময়টা তার খুব নিজের। সোফার পাশের টেবিলে পেতলের কেটলিতে আধখানা কফি পড়ে আছে, ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মনের ভেতরটা তখন উত্তপ্ত—আবারও সেই পুরনো ক্লান্তি, কেটে যাওয়া দিনের ভার। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল—ইরা কলিং। “হ্যাঁ বল, তুই কেমন আছিস?” মেঘনা কথা বলতে বলতেই জানলার বাইরে তাকাল। “শুনবি? এবার আর ভাবনা নয়—চল, পালিয়ে যাই। দু-একদিনের জন্য, কাশ্মীর ঘুরে আসি?” ইরার গলায় যেন একটা অদ্ভুত আবেগ, মেঘনার শরীরের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে গেল। “সত্যি বলছিস?”…
-
অর্পণা দাস নিরবতার অন্তরালে মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতায় জানালার ধারে বসে থাকা মেয়েটির নাম রায়া। বাইরের অন্ধকার যেন ঠিক ওর মনটা মতোই গাঢ়, ভারী। ঘরের ভেতরে ঝুলে থাকা ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে – সময়ও হয়তো ওর কষ্টের সামনে থেমে পড়েছে। রায়ার বয়স মাত্র পঁচিশ, কিন্তু চোখে-মুখে যেন ত্রিশ বছরের ক্লান্তি। গত পাঁচ বছর ধরে সে একটি দাম্পত্য যন্ত্রণার মধ্যে আবদ্ধ। তার স্বামী অভিষেক, বাইরে থেকে পরিপাটি, একজন শিক্ষিত মানুষ – কিন্তু ঘরের দরজার ওপারে সে এক ভয়ানক দৈত্য। প্রতিদিনের মানসিক নির্যাতন, ছোট ছোট কথা দিয়ে অপমান, সন্দেহ, একঘেয়েমি – এসবই হয়ে উঠেছিল রায়ার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অভিষেক কখনো গায়ে হাত তোলেনি,…
-
মেঘলা দাশগুপ্ত পর্ব ১ কলকাতার গরমটা জুনে এসে যেভাবে গায়ে লেগে থাকে, মেঘলার কাছে সেটা অস্বস্তিকর নয়, বরং একধরনের আশ্বাসের মতো। সে ভালোবাসে বিকেলের ছায়া যেভাবে জানালার পাল্লা ফুঁড়ে ঘরে ঢোকে, সেই রকম নিঃশব্দ আলো, যেটা কারও চোখে পড়ে না, কিন্তু মনটা একটু একটু করে ধুয়ে দেয়। এই বাড়িটা সে ভাড়া নিয়েছে এক মাসের জন্য—লেখালেখির কাজে মন বসবে ভেবেছিল। দক্ষিণ কলকাতার এই পুরনো বাড়িটা, কাঠের জানালা, ধুলো জমে থাকা বারান্দা, দেওয়ালে ধস নামা চুন—সব মিলিয়ে একটা একাকীত্বের ঠিকানা। মালকিন, বৃদ্ধা মৃণালিনী দেবী বলেছিলেন, “ঘরটা আগে এক কবি মেয়ের ছিল, নাম ছিল রত্না। বড় অন্যরকম মেয়ে ছিল, কবিতা লিখত সারাদিন। তখনকার…
-
পৌষালী চক্রবর্তী ১ সন্ধেটা ছিল অদ্ভুতভাবে নির্জন। রবিবারের শহর যেন ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। গোলপার্ক থেকে পায়ে হেঁটে সাউথ সিটির দিকে আসার মাঝপথে রূপা থেমেছিল লেকের ধারে। শরৎশেষের নরম বাতাস বইছে, কানের পাশে চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। সে বসে আছে গোল বেঞ্চে, পাশেই কফির কাপ, কোলের ওপর একটা বই—তবে পাতাগুলো নড়লেও মন আটকে ছিল অন্য কোথাও। রূপার বয়স পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। দক্ষিণ কলকাতার এক বহুতলে থাকে অরিন্দমের সঙ্গে—তার স্বামী। আট বছরের দাম্পত্য। ছেলেটা এখন ক্লাস থ্রিতে। সংসার চলে, নিয়ম মেনে, নিঃশব্দে। ভালোবাসা বলে যে আবেগটা একসময় বুকের ভেতর চড়চড় করে উঠত, সেটা যেন এখন নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়েছে,…