অভিক ধর শহরের জীবন মানেই একটানা দৌড়ঝাঁপ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসের চাপ, যানজট, হর্নের শব্দ আর ব্যস্ততার ক্লান্তি। কংক্রিটের এই জগতে মানুষ খুঁজে ফেরে একটুখানি শান্তির আশ্রয়, যেখানে নেই হইচই, নেই ক্লান্তি—শুধু নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সুযোগ। এই শহরের এক বহুতল ভবনের ছাদে ঠিক তেমনই এক আশ্রয় তৈরি করেছে নায়িকা তৃণা। দিনভর অফিসের কাজ আর একা থাকার নিঃসঙ্গতার মাঝেও তার মন খুঁজে নেয় অন্যরকম আনন্দ—গাছপালার সান্নিধ্য। ছাদের এক কোণ জুড়ে সাজানো টব, ড্রাম, পুরোনো বালতি আর কৌটোতে নানা রঙের ফুল, ঔষধি গাছ আর শাকসবজি। প্রতিদিন সকালে কাজের আগে সে গাছগুলোকে জল দেয়, শুকনো পাতা ছেঁটে ফেলে, আর বিকেলে…
- 
				
 - 
				
পল্লব সেনগুপ্ত ১ প্রতি বছর শরৎকালের সেই বিশেষ সকালটি যেন গ্রামটির বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। রাতভর কুয়াশা আর শিশিরে ভিজে থাকা বাতাস যখন আস্তে আস্তে আলোয় গা ভিজিয়ে নেয়, তখনই শুরু হয় সেই সুর—চণ্ডীপাঠের গম্ভীর ও সুরেলা ধ্বনি। গ্রামটি খুব সাধারণ, মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা, পুকুর আর ধানখেত দিয়ে ঘেরা, অথচ প্রতি মহালয়ার ভোরে এই গ্রাম হয়ে ওঠে রহস্যময়। সূর্যের প্রথম কিরণ ওঠার আগেই দূর থেকে ভেসে আসে ধ্বনি, যেন দেবীর আহ্বান চলছে। যারা গ্রামে থাকে তারা সবাই জানে, এই সুর অন্য কোনো মাইক থেকে নয়, কিংবা মন্দির থেকেও নয়। এটা ভেসে আসে সেই পুরোনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি…
 - 
				
১ পশ্চিমবঙ্গের অন্তঃস্থলে, নদীর ঘাট ছুঁয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তার শেষে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ি—এক প্রাচীন জমিদার বাড়ি, যার গাঢ় লাল ইঁটগুলো সময়ের আঘাতে ফেটে গেছে, দেয়ালের চুনকাম খসে পড়েছে, আর শ্যাওলা জমে অন্ধকার হয়ে উঠেছে প্রতিটি কোণ। এককালে এখানে আলো ঝলমলে উৎসব হতো, রথযাত্রার দিন প্রাসাদের প্রাঙ্গণে ভিড় জমত হাজার হাজার মানুষ, আর মহিষাসুরমর্দিনীর বিসর্জনকালে শোনা যেত ঢাক-ঢোলের কর্ণভেদী শব্দ। আজ সেই জমকালো ঐতিহ্য কেবল স্মৃতির কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে গেছে। রাজবাড়ির প্রধান ফটকটি অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে, জায়গায় জায়গায় ঘাসে ঢাকা পথ আর ঝোপঝাড় দাঁড়িয়ে আছে অনাহূত প্রহরীর মতো। বাতাসে যেন এক শীতলতা ভেসে বেড়ায়, যে শীতলতা গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরেও চামড়া…
 - 
				
সহেলী দেব অগ্নিশিখা দত্ত ছিলেন এক মফস্বল শহরের সাধারণ স্কুলশিক্ষিকা, কিন্তু তার ভেতরে ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি, যা বাইরের সাধারণ চোখে ধরা পড়ত না। শাড়ির আঁচল গুঁজে স্কুলে গিয়ে তিনি যেমন মাটির গন্ধে ভিজে থাকা খড়ের ছাউনিওয়ালা শ্রেণিকক্ষে মেয়েদের পড়াতেন, তেমনি দিনের শেষে ঘরে ফিরে নিজের বুকের ভেতর জমতে থাকা অস্থির স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই বই ছিল তার নিঃশ্বাসের মতো—বইয়ের পাতায় সে খুঁজে পেয়েছিল পৃথিবীর অচেনা দরজা, ইতিহাসের আলো, আর ভবিষ্যতের কল্পনা। অথচ তার গ্রামে মেয়েদের হাতে বই পৌঁছাত না, তারা বইকে দেখে শুধু পড়াশোনার বোঝা ভেবেই ভয় পেত। অনেক মেয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো, কেউ কেউ সংসারের…
 - 
				
প্রমিত চৌধুরী ১ শান্তিনগর গ্রামের প্রাচীন জমিদারবাড়িটি যেন এক ইতিহাসের দলিল, কিন্তু সেই ইতিহাস আজ ধ্বংসস্তূপের স্তূপে চাপা পড়ে আছে। লাল ইটের গা বেয়ে নেমে এসেছে লতাপাতা, জানালার কাঠের খাঁচাগুলো ভেঙে পড়েছে, আর দালানের ছাদের টালিগুলো অর্ধেক জায়গায় খসে গিয়ে আকাশের আলো ঢুকে পড়েছে ভেতরে। গ্রামবাসী দিনের আলোয় জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও ভেতরে প্রবেশ করতে ভয় পায়, কারণ তারা বিশ্বাস করে এখানে কেবল ভগ্নদালান নয়, লুকিয়ে আছে অভিশপ্ত অতীত। তবে এই জমিদারবাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝেও যেটি অদ্ভুতভাবে টিকে আছে তা হলো আটচালা। প্রাচীন কালের মতোই তার খিলানদ্বারগুলো দাঁড়িয়ে আছে, অর্ধেক জায়গায় ধসে গেলেও এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তায় সে দাঁড়িয়ে থেকে যেন…
 - 
				
সুপ্ৰকাশ মুখার্জী ১ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের অলিগলিতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধের প্রার্থনা শেষ হলে কাকাদের আড্ডা থেমে যায়, খুদেরা দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে মায়েদের আঁচলের আড়ালে ঢুকে পড়ে। একমাত্র যিনি তখনও সক্রিয়, তিনি রাধিকা কাকিমা। বয়স আশির কাছাকাছি, মুখভর্তি কুঁচকানো ভাঁজ, মাথার চুল প্রায় সাদা, তবুও তার চোখদুটি এখনো অদ্ভুত উজ্জ্বল। গ্রামের বাচ্চারা যখন চারদিকে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সন্ধেবেলায় তার উঠোনে জড়ো হয়। উঠোনের মাঝখানে রাখা মাটির প্রদীপটিতে হলদেটে আলো জ্বলে ওঠে, আর কাকিমার গলায় ভেসে আসে সেই পুরোনো দিনের গল্প। আজও তিনি বসে আছেন শালপাতার পাখা হাতে, যেন সেই আলো আর বাতাসকে গল্পের তালে তালে…
 - 
				
১ শহরের একেবারে প্রান্তে, ব্যস্ততা ও জনবসতির বাইরে যেন পৃথিবীর ভিন্ন এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো শ্মশান। চারদিক ঘন গাছপালা দিয়ে ঢাকা, লতাগুল্মে জড়ানো ভাঙাচোরা ঘাট, অর্ধেক ডুবে থাকা শিলাস্তম্ভ আর শেওলা ধরা সিঁড়ি—সব মিলিয়ে জায়গাটি যেন সময়ের হাতে পরিত্যক্ত। দিনের আলোয়ও এখানে এক অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করে, আর রাতের অন্ধকারে শ্মশান হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ অন্য রূপে। বহু বছর আগে এখানে চিতা জ্বলত নিয়মিত, শবদেহ সৎকারের জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসত, কিন্তু এখন অনেক বছর হলো কেউ আর এখানে শবদাহ করতে আসে না। ধীরে ধীরে জায়গাটা জনশূন্য হয়ে পড়ে, শুধু কাক, শেয়াল আর বাদুড়েরা এটিকে নিজেদের…
 - 
				
১ শহরের একেবারে প্রান্তে, ব্যস্ততা ও জনবসতির বাইরে যেন পৃথিবীর ভিন্ন এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো শ্মশান। চারদিক ঘন গাছপালা দিয়ে ঢাকা, লতাগুল্মে জড়ানো ভাঙাচোরা ঘাট, অর্ধেক ডুবে থাকা শিলাস্তম্ভ আর শেওলা ধরা সিঁড়ি—সব মিলিয়ে জায়গাটি যেন সময়ের হাতে পরিত্যক্ত। দিনের আলোয়ও এখানে এক অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করে, আর রাতের অন্ধকারে শ্মশান হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ অন্য রূপে। বহু বছর আগে এখানে চিতা জ্বলত নিয়মিত, শবদেহ সৎকারের জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসত, কিন্তু এখন অনেক বছর হলো কেউ আর এখানে শবদাহ করতে আসে না। ধীরে ধীরে জায়গাটা জনশূন্য হয়ে পড়ে, শুধু কাক, শেয়াল আর বাদুড়েরা এটিকে নিজেদের…
 - 
				
জয়ন্ত চক্রবর্তী অধ্যায় ১ – নতুন বাড়ি অর্পিতা নতুন ভাড়া বাড়িতে ওঠার দিনটি ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির। শহরের রাস্তায় গাড়ি, মানুষ আর চেনা ভিড়ের মধ্যে থেকে বের হয়ে নতুন ঠিকানায় পৌঁছানো, মনে একধরনের অচেনা উত্তেজনা এবং অজ্ঞাত ভয়ের সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, এটি যেন এক সাধারণ, পুরনো শহরের বাড়ি—সাদা দাগ, ছেঁড়া রঙের দেয়াল, এবং অল্প গাছপালার ছায়া—কিন্তু ভেতরে ঢুকেই সবকিছু বদলে যায়। লম্বা করিডর, ফাঁকা ঘরের নিস্তব্ধতা এবং ধুলোমাখা জানালার কাচের মাঝে ধীরে ধীরে রোদ পড়া, তার মনকে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি দিয়ে ভরিয়ে দেয়। অর্পিতা ভাড়া বাড়িতে ওঠার আগে যেমন অনেক সময় চিন্তিত…
 - 
				
অধ্যায় ১ : পুরনো ডাকঘর অরিন্দম চক্রবর্তী শহুরে মানুষ। কলকাতার ভিড় আর ব্যস্ততার ভেতর বহু বছর চাকরি করে হঠাৎই একদিন ট্রান্সফারের চিঠি এসে যায় তার হাতে—পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে তাকে বদলি করা হয়েছে নতুন পোস্টমাস্টার হিসেবে। প্রথমে একটু মন খারাপ হয়েছিল, কেননা শহরের আরাম, বন্ধুদের আড্ডা, সিনেমা হল বা বইয়ের দোকান সব কিছুই ছেড়ে আসতে হবে। তবু ভেতরে ভেতরে কৌতূহলও ছিল, গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নেওয়া যাবে, আর নতুন জায়গার নতুন অভিজ্ঞতাও তো একরকম রোমাঞ্চ। ট্রেন থেকে নামতেই গ্রামের ছবিটা তার চোখে ধরা দেয়—চওড়া কাঁচা রাস্তা, দুই পাশে ধানক্ষেত, হাওয়ায় ভেসে আসা খড়ের গন্ধ, আর দূরে সাদা মন্দিরের শিখর। এমন সরল…