ঋতবান চ্যাটার্জী হারিয়ে যাওয়া সকাল পুরুলিয়ার ঘাঘরা গ্রাম যেন একটানা নিঃশব্দে বেঁচে থাকে। এই গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে শীতল সুবর্ণরেখা, আর মাথার ওপর ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র শাল-সেগুন। এখানে দিনের আলো পড়ে নরম, আর রাতের অন্ধকার গাঢ়, জ্যোৎস্নাতেও কালো। কেবলই যেন কেউ দেখে, তবু ধরা পড়ে না। বিপ্লব দাস ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক। গ্রামের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু ভালোবাসার চোখে—যেন তিনি তাঁদের আশার বাতি। সকাল সাতটায় উঠোনে লাল চায়ের কাপ হাতে বসে থাকতেন, পোষা কুকুর ‘রাঙা’ পায়ের পাশে বসে। সেদিন সকালে রাঙা ছিল, কাপটাও ছিল, শুধু মানুষটা ছিল না। অরুন্ধতী, বিপ্লবের স্ত্রী, প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বাজারে…
-
-
সুশোভন দত্ত পর্ব ১: যুদ্ধের আগমনী ইন্দ্রপুর শহরে ভোরের আলো নামে না—এখানে আলো আসে হেডলাইন দিয়ে। একটা নতুন দিন মানে আরেকটা টক-শো, একটা নতুন বিতর্ক, আর একটা পুরনো ষড়যন্ত্রের ভিন্ন মুখ। কিন্তু আজকের সকালটা একটু আলাদা ছিল। “আজ সন্ধ্যেবেলা ৭টায় ‘রিপাবলিক ভয়েস’ টিভি চ্যানেলে মুখোমুখি হচ্ছে দর্পণ বসু আর কৃষ মালভিয়া। লাইভ বিতর্ক।”—এই নিউজ টিকারের নিচে অনবরত ঘুরছিল একটা নাম: শকুনি সেন। সে নিজে কখনও ক্যামেরার সামনে আসে না। অথচ প্রতিটি বিতর্কের পেছনে, প্রতিটি ‘এক্সপোজে’র নেপথ্যে, প্রতিটি বাছাই করা হেডলাইনের গভীরে তার ছায়া ঘন হয়ে থাকে। কৃষ মালভিয়া টের পাচ্ছিল—এটা আর বিতর্ক নয়, এটা যুদ্ধ। এবং যুদ্ধের নাট্যকার এই ব্যক্তি…
-
অরিত্রা মৈত্র ভোরের প্রথম কুয়াশা যখন মাঠের উপর ধোঁয়ার মতো বসে থাকে, তখন কাঁসার ঘরে একটা ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। যেন ভোর নিজেই ধাতুর গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। সেই শব্দের উৎস—হরিপদ কর্মকার, দক্ষিণ ভাদুরিয়া গ্রামের প্রাচীনতম কাঁসারু। তার হাতের চেটো আর আঙুলে শক্তি কমে এলেও, যন্ত্রণা বা ক্লান্তি তাকে থামাতে পারেনি। তার ঘরে আলো জ্বলে মাটির প্রদীপে, আর চোখে জ্বলে এক অবিনশ্বর দীপ্তি—সংগ্রামের, টিকে থাকার, আর আত্মসম্মানের। তার ছেলে অনিমেষ তখনো বিছানায়, কিন্তু সেই ঝমঝম শব্দ তার ঘুমের অংশ হয়ে গেছে। এ শব্দ তার শৈশবের লোরি, আর ভবিষ্যতের দিশা। প্রতিদিন এই শব্দেই সে জাগে। কখনো কখনো স্বপ্নেও সে…
-
অনিমেষ চট্টোপাধ্যায় ১ কলকাতার উত্তর প্রান্তে, এক পুরনো গলির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি যেন শহরের কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বাড়িটির দেওয়ালগুলোয় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। ফাটল ধরা দেওয়ালের গায়ে বুনেছে লতা-পাতা, জানালার কাঁচগুলোয় জমেছে বছরের পর বছর ধুলো। প্রতিদিন সেই জানালার ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ তাকিয়ে থাকে রাস্তায়—কোনো চেনা মুখ, কোনো সঙ্গ, বা নিদেনপক্ষে কারও একটা হাসি খুঁজে পেতে চায়। এই বাড়ির বাসিন্দা হেমন্তি দেবী। বয়স ছিয়াসট্টি। চুলের রঙ ফিকে ধূসর হয়ে এসেছে অনেক আগেই। মুখের ভাঁজগুলোয় জীবনের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। একসময় এই পাড়ার প্রিয়তম বৌদি ছিলেন তিনি। যে কোনো উৎসবে তাঁর হাতের মিষ্টি না খেলে পাড়ার মানুষদের চলত…
-
অর্জন লাহা প্রথমবারের দেখা দার্জিলিংয়ের হাওয়া যেন একেকটা কথা বলে—ভোরের মেঘে ঢাকা রাস্তা, কুয়াশায় গা ঢাকা স্কুল বিল্ডিং, আর দূর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক—সব মিলিয়ে একরকম মায়া তৈরি করে। “সেন্ট পলস হিল স্কুল” আমার দ্বিতীয় বাড়ি ছিল অনেকটা। কাঠের পুরনো দরজা, খাড়া সিঁড়ি, আর ছাদে লতানো গাছ—এই স্কুলে সময় যেন একটু ধীরে চলে। আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র, অয়ন চক্রবর্তী, আর আমার সবথেকে প্রিয় জায়গা ছিল স্কুল লাইব্রেরির জানালার ধারে চেয়ারটা। সেই চেয়ারেই একদিন বসে ছিলাম যখন প্রথম দেখলাম ওকে—মীরা সেন। সাদা স্কুল শার্ট আর নীল স্কার্টে, যেন এক মেঘভেজা সকাল হাঁটতে হাঁটতে এসে বসেছে লাইব্রেরির কোণে। মাথার চুলগুলো…
-
ঈশিতা পর্ব ১ কলকাতার একঘেয়ে বৃষ্টির দুপুরে বালিগঞ্জের এক ক্যাফেতে বসে ছিল অনিন্দিতা। তার চোখে ছিল হালকা চশমা, এক কাপ দার্জিলিং চায়ে ধোঁয়া উঠছে সামনে। বয়স হয়েছে পঁয়ত্রিশ, কিন্তু মুখে সেই শীতল সংযম—যেটা কেউ গড়ে তোলে হেরে গিয়ে বা জিতে। চুলে একটুখানি পাক ধরেছে, যা সে লুকোয় না। গলায় এক সরু রুপোর হার। ক্লায়েন্ট মিটিং বাতিল হওয়ায় সে এসে পড়েছিল এই ক্যাফেতে—নিজের সঙ্গেই কিছুটা সময় কাটাতে। তখনই দরজা ঠেলেই ঢুকল ছেলেটা। ভেজা চুল, হাতে একটা ক্যামেরা, পরনে সাদা শার্ট আর জিন্স। চোখে ছিল কৌতূহল আর হাসিতে হালকা ছেলেমানুষি। সে এসে সামনের টেবিলে বসলো, আর অর্ডার দিল—”একটা ব্ল্যাক কফি, খুব স্ট্রং।”…
-
বিমলেশ বাগচী পর্ব ১: বটগাছের ব্রত ও ভবেশের বুদ্ধি ধলেশ্বরীপুর নামটা শুনলেই হাসি পায় অনেকের। কারণ এই গ্রামে আছে এমন এক বটগাছ, যেটা নাকি ব্রহ্মচারী। গ্রামের সব গুঞ্জন আর গপ্পে এই বটগাছ নিয়ে—কে নাকি এর ছায়ায় বসে প্রেম করল, আর কে নাকি ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে পালাল। এই বটগাছকে কেন্দ্র করেই গল্পের শুরু। এই গাছটা গ্রামের উত্তর প্রান্তে, কাঁঠালতলা মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে। বিশাল, পুরনো, আর তার গায়ে মাটির সিন্দুর আর মাটি-গোলাপ দিয়ে সাজানো একটা ছোট্ট বেদি। সবাই জানে, এখানে প্রেম করা মানে কেলেঙ্কারি নিশ্চিত! গাঁয়ের ছেলেরা বলে, “এই গাছের নিচে বসে প্রেম করতে গেলেই ল্যাংটো ছাগল পেছনে ধাওয়া করে!” কেউ…
-
রুদ্রপ্রতিম সেন ১ কলকাতা বিমানবন্দর, সকাল ছ’টা দশ। মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একটি কালো সেডান গাড়ি ধীরে ধীরে থামে টার্মিনালের সামনে। চালক দরজা খুলে দেয়, এবং একটি উঁচু কাঁধ, রূপালি চুল আর ধীর পদক্ষেপে নামেন এক মধ্যবয়স্ক মানুষ—সমরেশ মিত্র, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পপতি। তাঁর গায়ে হালকা ধূসর স্যুট, চোখে এক জোড়া ধাতবচশমা। এক হাতে ছোট চামড়ার ব্রিফকেস, অন্য হাতে ধরা একটি পুরনো চামড়ার বাঁধাই করা বই—“দ্য লাস্ট সামার রেইন”, সম্ভবত তাঁর প্রিয়। সবসময় বিমানে ওঠার আগে এই বইটি তিনি পড়ে থাকেন, যেন আকাশের নির্জনে বইয়ের পাতার ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। সিকিউরিটি চেকিং, লাউঞ্জ, বোর্ডিং—সবকিছুতে ছিল অভ্যস্ত ও নিখুঁত শৃঙ্খলা।…
-
অদ্রীশা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং, সেই পাহাড়ের শহর, যেখানে সকাল আর সন্ধ্যার মাঝের সময়টা যেন চুপচাপ কল্পনাগুলোকে জাগিয়ে তোলে—সেখানে ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় অতীতের কান্না, চা-বাগানের ঢাল বেয়ে নামে সোনালি আলো, আর পুরোনো ব্রিটিশ বাংলোর ছায়াগুলো নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কালের ইতিহাসে; এই শহরের বুকেই এসেছে অনির্বাণ ঘোষ, একচল্লিশ বছর বয়সি স্বাধীনচেতা ফটোগ্রাফার, কলকাতার নাগরিক, জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, শহরের কংক্রিটের অস্থিরতা আর মানুষের মুখে মুখে ঘোরাফেরা করা নাটক, কিন্তু পাহাড় তাকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে—সেখানে সময় যেন ধীরে চলে, প্রতিটি গন্ধ, প্রতিটি ছায়া নিজের ভাষায় কথা বলে, আর সেই ভাষা বোঝার তৃষ্ণাই তাকে টেনে এনেছে এখানে; তার কাছে একটা কাজ ছিল—এক…
-
ঋতুপর্ণা বসু শীতের দুপুরে শীত তখন শহরের কাঁধে নেমে বসেছে। কলেজের লাইব্রেরির বাইরের কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল অনিরুদ্ধ। তার পরনে ছিল ধূসর সোয়েটার, গলায় মাফলার, আর হাতে ছিল একটিমাত্র বই—জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সে বইটা যেমন ছিল, তেমনই তার মনটাও—অদ্ভুত নিঃশব্দ, সময়ের গন্ধ মাখানো। বইয়ের পাতায় চোখ ছিল, কিন্তু মন ছিল বইয়ের বাইরের জগতে। প্রতিদিন বিকেলে লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে যে মেয়েটা নামে, আজও সে ঠিক সময়মতো নামছে। তার নাম প্রভা। ছিমছাম পরিপাটি সাজ, নীল-সাদা শাড়ি, কানে ছোট্ট ঝুমকা। চোখে এক অদ্ভুত আভা, যেন কোনো কথা না বলেই সে অনেক কিছু বলে যেতে পারে। অনিরুদ্ধ বহু দিন ধরেই তাকে লক্ষ করে, কিন্তু…