তানিয়া বসু অধ্যায় ১ : নিউরো সিটির স্পন্দন প্রযুক্তির সোনালী জাল যেন ২০৭৫ সালের কলকাতাকে এক নতুন ছন্দে বেঁধে ফেলেছে। মেঘছোঁয়া টাওয়ারগুলোর কাচের দেয়ালে রাতের নীয়ন আলো ঝিলমিল করে, আকাশপথে ভেসে চলা মেট্রোকারগুলো গঙ্গার ওপারে লালচে চাঁদের প্রতিচ্ছবি কেটে যায়। এই শহরের প্রতিটি মানুষ এখন এক অদৃশ্য নেটওয়ার্কের অংশ—মস্তিষ্কের ভেতর স্থায়ীভাবে বসানো নিউরো-লিঙ্ক চিপ তাদের চিন্তা, অনুভূতি, কাজকর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ব্যাংকের পাসওয়ার্ড থেকে প্রিয় গানের প্লেলিস্ট, অফিস মিটিং থেকে ঘরের দরজার লক—সব কিছু এক নিমিষে মস্তিষ্কের সিগন্যালেই নিয়ন্ত্রিত। প্রযুক্তির এই মহোৎসবে কলকাতা যেন হয়ে উঠেছে “নিউরো সিটি”—এক এমন মহানগর, যেখানে বাস্তব আর ভার্চুয়াল একে অপরের সীমানা মুছে ফেলেছে। কিন্তু…
- 
				
 - 
				
ঋত্বিক গাঙ্গুলি পর্ব ১ : অচেনা শহর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একে একে ট্রেনে উঠছে। ভোরের অন্ধকার তখনও কেটে যায়নি, দূরের আকাশে একটা অর্ধচন্দ্র ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। শহরের নাম—চন্দ্রপুর। বেশ বড় নয়, আবার একেবারেই ছোটও নয়। মফস্বল আর শহুরে জীবনের মাঝামাঝি এক টানটান অবস্থান। এ শহরে হঠাৎ এসেছিল অর্ণব দত্ত—চোখে কালো চশমা, পরনে জিন্স আর ফেডেড জ্যাকেট। লম্বা, চওড়া কাঁধ, হাঁটার ভঙ্গিতে সেনা-শৃঙ্খলার আভাস। সে ছিল একসময় আর্মির মিলিটারি পুলিশ। এখন ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ। কোথাও গন্তব্য নেই, কোথাও থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। চন্দ্রপুরে নামার সিদ্ধান্তটা ছিল সম্পূর্ণ হঠাৎ। ট্রেনটা থামলো, আর সে নেমে গেল। চারপাশের মানুষরা তার দিকে তাকালো,…
 - 
				
অরিত্র চক্রবর্তী পর্ব ১: আলোর ভেতরে অন্ধকার শহরের উত্তর কলকাতার সেই বনেদি বাড়িটা আসলে আজও এক ঐতিহাসিক চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জমিদারি টাকায় যে প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল, তার সিংহদ্বার দিয়ে এখনো ঢুকলেই মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে। বিশাল লোহার ফটক, ওপরে শ্বেতপাথরের মূর্তি, আর ভেতরে ঢুকলেই বিস্তৃত অঙ্গন—সব মিলিয়ে দুর্গাপুজোর সময়টা হয়ে ওঠে যেন এক স্বতন্ত্র জগৎ। চারদিক আলোয় ভেসে যায়, প্যান্ডেল সাজে গয়নার মতো, কিন্তু তার মাঝেই যেন লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত এক ছায়া। অর্ক প্রথম দিনেই বাড়িটায় পা রাখল। পেশায় সে সাংবাদিক, কিন্তু আসলে উৎসবের পাগল। ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপুজো নিয়ে তার এক অন্যরকম নেশা।…
 - 
				
উদ্দীপ্ত সাহা ১ মেঘলার জন্ম সেই গ্রামের মাঝখানেই, যেখানে ভোর হলে প্রথমে শোনা যেত পাখির ডাক আর দূরে ভেসে আসত গরুর ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ। চারদিক সবুজে ঘেরা, বাঁশঝাড় আর কাঁচা রাস্তার ভেতর দিয়ে সকালের আলো যখন নেমে আসত, তখনই শিশুরা মাঠের দিকে ছুটত খেলতে। মেঘলা ছোটবেলা থেকেই ছিল হাসিখুশি আর একটু দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে। তার চোখে যেন সবসময় এক ধরনের কৌতূহল ঝিলিক দিত—কোথাও নতুন কিছু ঘটছে কি না, কে কাকে নিয়ে খেলছে, নদীর জলে কত মাছ লাফাচ্ছে। আর্যের সঙ্গে তার পরিচয়ও এই খেলাধুলার মাঠেই। গ্রামের প্রায় সব শিশু একসঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করলেও মেঘলা ও আর্যের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত সখ্যতা। দুজনেই…
 - 
				
অপূর্ব ঘোষ অধ্যায় ১ – আগমন ভুবনেশ্বরের কোলাহল পেরিয়ে যখন গাড়ির চাকা ধুলো উড়িয়ে হিরাপুর গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় ঢুকল, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, যাদের চোখে স্পষ্ট কৌতূহল ও উত্তেজনা, গাড়ি থেকে নেমে এল ধীরে ধীরে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর অনিরুদ্ধ মুখার্জি, প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য ও তান্ত্রিক মন্দির নিয়ে খ্যাত এক গবেষক। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী প্রফেসর সঞ্জনা সেন, যিনি সম্প্রতি পুরাণ ও লোকবিশ্বাস নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও ছিলেন দুই তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ—অভিজিৎ ও রোহন—যাদের উচ্ছ্বাস প্রায় বালকসুলভ। তারা এসেছেন বিখ্যাত চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের রহস্য অনুধাবন করতে, যেটি শুধু শিল্পকলার নয়, আধ্যাত্মিক ও গুপ্ততান্ত্রিক…
 - 
				
সায়ন্তন বসু অধ্যায় ১ : জমিদারবাড়ির নিস্তব্ধতা প্রাচীন গ্রাম বাংলার বুক জুড়ে যে অট্টালিকা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়। সময়ের আঁচড়ে তার দেয়াল জীর্ণ হয়ে গেছে, ছাদের টালির ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে বৃষ্টির জল, দেউড়ির মোটা কাঠের দরজায় ঝুলছে মরচেধরা তালা, অথচ এখনো মনে হয়—এ যেন এক ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে। এ বাড়িটি এককালে ছিল রাজবাড়ির মতোই জাঁকজমকপূর্ণ জমিদারবাড়ি, যেখানে গরিব কৃষকদের ঘামে গড়া সম্পদ মজুত হতো, আর রাতে চলত রেশমি শাড়ি, নকশি পাঞ্জাবি, সোনার গয়নার রোশনাই। কিন্তু কালের নিয়মে জমিদারি প্রথা ভেঙে যাওয়ার পর বাড়িটি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। বংশধরেরা কেউ কলকাতায়, কেউ লন্ডনে…
 - 
				
দেবব্ৰত মণ্ডল ১ গ্রামের প্রাচীন মন্দিরটির অবস্থান যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জনবসতি থেকে খানিকটা দূরে, গা ছমছমে বটগাছের ছায়ায় ঢাকা পড়া এই মন্দিরের অস্তিত্ব আজও গ্রামের মানুষের কৌতূহল আর ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু। শতবর্ষ আগে নির্মিত হয়েছিল এই দেবালয়—পাথরের খোদাই, দেয়ালে পুরনো লিপি আর ভাঙাচোরা অলঙ্করণ এখনো ম্লান হয়ে গেলেও স্পষ্ট করে বলে দেয় তার গৌরবময় অতীতের কথা। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে মন্দিরের মূল দ্বার, যেটি লাল রঙের বিশাল কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ, কখনোই খোলা হয়নি গ্রামবাসীর চোখের সামনে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, সেই লাল কপাট শত বছর আগে হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায়, তারপর থেকে কেউ আর সাহস করেনি তা খোলার। বলা হয়,…
 - 
				
সৌম্যজিত দে শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল আর নতুন বিল্ডিংয়ের উজ্জ্বল আলো পৌঁছায় না, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরনো ফটোগ্যালারি। দীর্ঘদিন অবহেলায় ঢাকা ছিল এই জায়গা—ভাঙা ছাদের কোণ থেকে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি, কাঠের দরজায় কড়া নেড়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ, আর অযত্নে পড়ে থাকা ভাঙা-চোরা ফ্রেম যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে অপেক্ষা করছিল। শহরের মানুষ ধীরে ধীরে ভুলেই গিয়েছিল এর অস্তিত্ব, যেমন ভুলে যাওয়া যায় এক পুরনো গান বা বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা থিয়েটার। কিন্তু সম্প্রতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে আবার খুলে দেওয়া হলো গ্যালারিটি। একরাশ ধুলো সরিয়ে, মরিচা পড়া তালা ভেঙে, আলতো করে ফটোগ্যালারির দরজা খোলার মুহূর্তটা যেন…
 - 
				
সৌম্যদীপ হালদার অধ্যায় ১ : অজানার ডাক কলকাতার ভিড়ভাট্টা আর নিরন্তর দৌড়ঝাঁপের মধ্যে তরুণ নায়কের দিনগুলো যেন ক্রমশ একরঙা হয়ে উঠছিল। প্রতিদিনের সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দ, অফিসের ফাইলের পাহাড়, এবং রাতের শেষ প্রহরে ফাঁকা বারান্দায় সিগারেটের ধোঁয়া—সবকিছুই যেন তাকে এক অদৃশ্য শিকলে বেঁধে ফেলেছিল। কলেজজীবনে সে যে স্বপ্ন দেখেছিল—দূরদেশের পাহাড়ে চড়বে, অচেনা জনপদে রাত কাটাবে, নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজবে—সেই স্বপ্নগুলো এখন কেবল পুরনো ডায়েরির পাতায় বন্দি। একঘেয়েমির এই জীবন তার ভেতরের কৌতূহল, দুঃসাহস, আর স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিচ্ছিল। একদিন হঠাৎ বিকেলের অচেনা বৃষ্টি আর মেট্রোরেল স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, শহরের এই…
 - 
				
অরিন্দম মুখোপাধ্যায় পর্ব ১: সুরের প্রথম রাত দুর্গাপুরের সেই কারখানাটা শহরের বাইরে, গঙ্গার ধারে, ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে আজ। ইট-সিমেন্ট ভাঙা, জানালার কাচগুলো শূন্য চাহনির মতো তাকিয়ে থাকে। রাতের বেলা লোকজন ওদিক মাড়ায় না—কেউ বলে শিয়াল-কুকুর আছে, কেউ বলে ভুত আছে। সেই রাতে অরূপ, শহরের এক সাংবাদিক, হঠাৎ শুনতে পেল খবর— “দাদা, কারখানার ভেতরে আবার বাঁশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।” একজন চা-ওয়ালা বলছিল। গলাটা ফিসফিসে, চোখে ভয়। অরূপ সঙ্গে সঙ্গে খুঁটিয়ে জানতে চাইল। চা-ওয়ালা কাঁপা গলায় বলল, “আগের বার শুনেছিল যে, সে নাকি তিন দিনের মধ্যে নিখোঁজ হয়ে গেছে। এ বার আবার বাজছে, কাল রাত থেকেই।” অরূপের ভেতর সাংবাদিকের কৌতূহল জেগে উঠল।…