সৌম্য কর ১ গ্রামের নাম আড়বেলিয়া, নদীর ধারে ছোট্ট অথচ প্রাণবন্ত এক বসতি। এখানকার মানুষদের জীবন সহজ, হাসি-ঠাট্টা আর খুনসুটিতে ভরা। এই গ্রামেই জন্মেছে আর বড় হয়েছে শশী—পুরো নাম শশীভূষণ। শশীকে যারা চেনে, তারা জানে সে মনের দিক থেকে একেবারে স্বচ্ছ কাচের মতো, কিন্তু মাথার দিক থেকে মাঝে মাঝেই গুবলেট করে ফেলে। শশীর বোকাসোকা স্বভাব গ্রামে বহুল আলোচিত; কখনো গরুকে খড়ের বদলে নিজের নতুন ধুতি খাইয়ে দিয়েছে, কখনো আবার জমির মাপ নিতে গিয়ে লাঠির বদলে খুপরি দিয়ে দাগ কেটেছে। গ্রামের বৃদ্ধেরা বলেন—“শশী ভালো ছেলে, কোনো খারাপ কাজ করে না, কিন্তু বুদ্ধিটা যেন একটু এদিক-ওদিক।” তবে একথা সবাই মানে—শশীর অন্তর সোনার…
-
-
সুদীপ্ত নাথ ১ গ্রামের সকালের সূর্যটি কেবল ঢেউ খেলছিল ধানক্ষেতের ওপর, যখন গ্রামের মঞ্চে একটি অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করল। সবাই জানত, আজ কিছু অস্বাভাবিক ঘটতে চলেছে। ঠিক তখনই, হঠাৎই মঞ্চের মাঝখান থেকে একটি গভীর, ঝাঁঝালো কণ্ঠে ঘোষণা হল—“আমার জন্যে পাত্রী চাই!” শব্দগুলো যেন চারপাশের সব কিছুকে থামিয়ে দিয়ে অদ্ভুত এক স্থিরতা তৈরি করল। গ্রামের লোকেরা প্রথমে হতবাক হয়ে যায়, কেউ খালি চোখে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ আবার ধীরে ধীরে পেছনে সরে আসে। কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্রণে সব চোখ মঞ্চে। কেউ হাসি থামাতে পারছিল না, আবার কেউ ভয়ে কাঁপছে। বুড়ো মজুমদার, যিনি গ্রামের খবরাখবরের দায়িত্বে ছিলেন, প্রথমে অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা…
-
সুকান্ত আইচ পর্ব ১ পাড়ার নাম মধুবন কলোনি। কলকাতার এদিকেই, গঙ্গার ধার ঘেঁষা এক অদ্ভুত গলি। এই গলির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—একজন টিউশন মাস্টার। নাম—বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। বয়স পঞ্চান্ন, কিন্তু চেহারায় বোধহয় এখনও তিরিশের মতো এনার্জি। পরনে খাটো পাঞ্জাবি, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা, আর মাথার উপরে তেল দেওয়া টাকের চারপাশে জেগে থাকা ঝাঁকড়া চুল। বিষ্ণুপদবাবু একসময় কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন, পরে কাজ ছেড়ে দিয়ে “প্রাইভেট টিউশনের দুনিয়া”য় নামেন। আর তারপর থেকেই তার জীবন অন্যদিকে ঘুরে গেল। আশপাশের পাড়ায় নাকি তিনি এমন সব বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে পড়ুয়ারা ভিড় জমিয়ে ফেলল। বিজ্ঞাপনে লেখা— “যে যা পড়তে চাও, এসো আমার কাছে। আমি সব শেখাই। অংক,…
-
মৃত্যুঞ্জয় নস্কর এক সকালটা ছিল একেবারে অন্যরকম। শীতকালীন সকালের হালকা কুয়াশা এখনো খেলার মাঠের চারপাশে ঝুলে আছে, অথচ স্কুলের করিডোরে অস্বাভাবিক একটা গুঞ্জন। টিফিনের আগেই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল—এইবারের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বড় মঞ্চনাটক হবে “সিরাজউদ্দৌলা”। সাধারণত প্রতি বছর নাচ-গান, আবৃত্তি আর ছোটখাটো নাটিকা হয়, কিন্তু ঐতিহাসিক নাটক করার সিদ্ধান্তটা ছিল একেবারে চমকপ্রদ। খবর শুনেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ক্লাসে বসে কেউ মন দিয়ে পড়াশোনা করছিল না, সবাই ফিসফিস করে আলোচনা করছে—কে কোন চরিত্রে মানাবে, কে নায়ক হতে পারে, কে আবার খলনায়ক! এমনকি যারা সাধারণত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় না, তারাও এবার আগ্রহী হয়ে উঠেছে, যেন এই নাটকের…
-
ঋজু সেন ঠাকুমা ও ‘ShortyShorts’-এর প্রথম সাক্ষাৎ কলকাতার বালিগঞ্জে পুরনো বনেদি দোতলা বাড়ি, ছাদের কোণে একটা নারকেল গাছ, দেওয়ালে ফাটল, আর উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়া হিবিসকাস ফুল। বাড়িটার বয়স প্রায় একশো। আর তার একজন স্থায়ী বাসিন্দা—শৈলজা বসু, ওরফে ‘ঠাকুমা’। বয়স ৮২, চোখে চশমা, মুখে হাঁ করা চমকানো অভিব্যক্তি প্রায় সর্বক্ষণ। কিন্তু তিনি হাঁটেন সোজা, শাড়ি পরেন রঙিন—তুলসী পাতার মতো সবুজ, চেরি ফুলের মতো গোলাপি। ঠাকুমা সারাদিন খবরের কাগজ পড়েন, টিভি দেখে রান্নার শো, আর মাঝে মাঝে শঙ্খ বাজিয়ে জানান দেন তিনি এখন “যোগা” করছেন। কিন্তু এই পরিপাটি নিয়মমাফিক জীবনে হঠাৎ একদিন হট্টগোল লাগে। নাতি অভ্র, ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, তার ঘরে বসে…
-
হিমাদ্রি মুখার্জী ১ দক্ষিণ কলকাতার ‘উজ্জ্বল আলয়’ হাউজিং কমপ্লেক্সের সকালটা ছিল একেবারে সাধারণ। দুধওয়ালা এসে গেটের বাইরে হাঁক দিলো, মুন্না ওয়াচম্যান ঝিমোতে ঝিমোতে ঘাড় তুলে চাবি দিলো, আর বাচ্চারা স্কুলবাস ধরতে দৌড়োতে লাগল। নবদম্পতি তুহিন আর বুবলি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে নিজেদের ইউটিউব ভিডিওর থাম্বনেইল নিয়ে আলোচনা করছিল, ঠিক তখনই বুবলি ফিসফিস করে বলল, “তুমি লক্ষ করেছো, ৪০৩ ফ্ল্যাটের জানালাটা কাল রাত থেকে বন্ধই আছে। আজ সকালেও কেউ বেরোলো না!” তুহিন কপাল কুঁচকে বলল, “অ্যাই, ঠিক বলেছো তো! বিমলবাবু তো রোজ সকাল সাতটায় হাঁটতে বেরোন, আর অঙ্কুর গলা ফাটিয়ে গেম খেলে—আজ একটাও শব্দ নেই!” সন্দেহজনকভাবে তারা দুজনে দোতলায় উঠে…
-
তপোভন দত্ত পর্ব ১: ফেরার প্রথম দৃশ্য “ডাইরেক্ট নেমে যা বাস থেকে, তোকে কেউ ফুল নিয়ে স্বাগত জানাবে না!” — বাসের কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঘুম ভাঙল দেবদাসের। চোখ খুলতেই সামনের দৃশ্য দেখে নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছিল না — এই তো তার চেনা গ্রাম, নারায়ণপুর। পঁচিশ বছর বাদে ফিরে এসেছে, চুলে পাক ধরেছে, পকেটে এখন আর প্রেম নেই, আছে একটা পুরোনো মোবাইল, দুটো হ্যাংওভার ট্যাবলেট, আর একগুচ্ছ ফুসকু কথা — যেগুলো সে পরোর উদ্দেশ্যে বলবে ঠিক করেছে। ডান হাতের ছোট্ট ট্রলি টেনে টেনে সে যখন বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরোচ্ছে, তখন তার মাথায় সিনেমাটিক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে — অবশ্য সেটা কল্পনায়, বাস্তবে বাজছে পাশের…
-
কলকাতার উত্তরে অবস্থিত “চন্দ্রমোহন কলেজ”-এর হোস্টেলটা শহরের মধ্যে হলেও একেবারে বাইরের অংশে পড়ে। চারদিকের কোলাহলের মধ্যেও হোস্টেলের গেট পেরোনোর পরেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা আচ্ছন্ন করে রাখে জায়গাটাকে। পুরনো লাল ইটের বিল্ডিং, জংধরা লোহার গ্রিল, আর হোস্টেলের চারপাশে ছড়ানো অশ্বত্থ ও কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো যেন দিনের বেলাতেও ছায়া ফেলে রাখে আশপাশে। সোহম মুখার্জি, সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্র, বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে উঠল ওই হোস্টেলে। তার সঙ্গে একই ঘরে থাকবে রাহুল দে, ওর স্কুলজীবনের বন্ধু, আর তুষার সাহা — এক আধুনিক, সদ্য দেখা হওয়া ফেসবুক-বন্ধু। রুম নম্বর ৭ — তিনতলার এক কোণে, যেটা দেখে মনে হয় অনেক বছর কেউ পরিষ্কার করেনি। সিলিং…
-
রূপম মৈত্র অধ্যায় ১: আগমন শুভ হউক সকাল সাড়ে ন’টায় ‘Eastern Cloudwave Solutions’-এর রিসেপশনে এক নতুন মুখ। মাথায় টাক, কপালে লাল চন্দনের তিলক, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ, আর গলায় গামছার মতো হলুদ স্কার্ফ। নাম তপন কুমার ওঝা। ড্রয়িং-রুম থেকে উঠে আসা না-খাওয়া বাবাজীর মতো চেহারা দেখে রিসেপশনিস্ট জুয়েলী প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো ভুল করে কেউ পুরোহিত ডেকেছে অফিস পুজোর জন্য। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন শীটে নাম দেখে বুঝল, এ তো আজকের নতুন সিস্টেম অ্যাডমিন। “ওঝা বাবু?” বলে একটু হেসে ফেলেছিল সে, কারণ পদবি তো এমনই ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জুয়েলী বুঝে গেল, এই তপন কুমার শুধু নামেই ওঝা নন—মনপ্রাণে তিনি…
-
সঞ্জয় দে পর্ব ১: বাড়ির রহস্য অভিজিৎ ছিল ইতিহাসের ছাত্র। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পুরনো বাড়িগুলোর ইতিহাস খোঁজা, বিশেষত সেগুলোর যেগুলো সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে অথবা কেউ তাদের কাহিনী জানে না। একদিন, তার বন্ধু প্রীতম তাকে একটি পুরনো বাড়ির কথা জানায়, যে বাড়ি সম্পর্কে নানা গুজব ছড়িয়ে আছে। লোকজন বলে, এখানে অদ্ভুত হাসির শব্দ শোনা যায় এবং অনেক মানুষ এখানে হারিয়ে গেছে। সেই রাতের পর থেকেই বাড়িটির নাম তার মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। অভিজিৎ ভেবেছিল, এই বাড়ির রহস্য উন্মোচন করতে পারলে তার গবেষণায় নতুন একটি দিক যোগ হবে। তাই এক সকালে, তার গবেষণার জন্যই সেদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত…