• Bangla - সামাজিক গল্প

    অরণ্যের ডাক

    শান্তিলাল হেমব্রম অধ্যায় ১: পাহাড়-জঙ্গলঘেরা শালপাতা গ্রামটি যেন সারা পৃথিবীর喧 noise থেকে দূরে প্রকৃতির বুকে গড়ে ওঠা এক শান্ত আশ্রম। গ্রামের চারপাশে শাল, মহুয়া, পলাশ আর অজানা অসংখ্য লতাগুল্মের সমারোহ, যেন এক স্বপ্নলোকের দরজা খুলে বসেছে। ভোরবেলা কুয়াশা যখন আস্তে আস্তে পাতার কোণে গুটিয়ে যায়, তখনই জঙ্গলের বুক চিরে সূর্যের আলো ঝরে পড়ে, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই বনের মধ্যে এক অদ্ভুত সজীবতা অনুভূত হয়। পাখির কলকাকলি, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, বুনো প্রাণীর দূরের ডাক — এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে প্রতিটি সকাল নতুন হয়ে ওঠে। এই গ্রামেরই এক কুঁড়েঘরে থাকে রূপসী — শ্যামলা, কঠিন মুখাবয়বের এক যুবতী, যার চোখে স্পষ্ট…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    মাটির টান

    গনেশ মাহাতো পর্ব ১ ভোরের আলো ঠিক যেন সোনার ছিটে মেখে পুরুলিয়ার মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে। পিড়রা গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর, মাটির দেয়ালে ধানগাছের আঁচড়, ছাউনিতে খড়। এখানেই থাকে বছর চল্লিশের লোখো মাহাতো। নামটাই যেন ভরসার মতো। লোখো মানে লক্ষ্মী—তবে ওর জীবনে লক্ষ্মীটা কেবল নামেই আটকে। লোকটা শান্ত, নিজের মনে কাজ করে, সারাদিন মাঠে, সন্ধ্যেবেলা হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। গান গায় না ঠিক, গায়ে-গায়ে কিছু বোঝাতে চায়। সেই যে একদিন বুড়ো কনেই বলে গেছিল, “তুই কেবল চাষ করিস না রে লোখো, এই মাটির সুরটাও বুকে বাঁধিস।” এইটুকু কথা নিয়ে সে চলেছে। লোখোর বউ, ফুলমনি, সকালবেলা সিজির গর্তে জল ভরে আনছে,…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    রূপের পেছনের মানুষ

    অরিত্র পাল পর্ব ১ মাধবপুর নামের একটা ছোট্ট গ্রাম। স্টেশন পেরিয়ে একটু ভেতরে গেলে এই গ্রামটা দেখা যায়। খুব চুপচাপ, গাছপালা ঘেরা, পাখির ডাক ভরা একটা জায়গা। এই গ্রামে থাকে গণেশ। সবাই বলে, গণেশ একজন “বহুরূপী”। মানে, সে নানা রকম সেজে গ্রামের লোকেদের সামনে গল্প বলে, নাটক করে। কখনো সেজে যায় শিব, কখনো হনুমান, আবার কখনো সুভাষচন্দ্র। শুধু সাজ নয়, তার মুখের কথা, চোখের চাহনি—সব যেন বদলে যায়। পুজোর আগে থেকেই গণেশ খুব ব্যস্ত। কারণ, সে পুজোর মেলায় নাচে, অভিনয় করে। এবার সে ঠিক করেছে নতুন কিছু করবে। সে সেজে উঠবে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। অনেকেই হাসাহাসি করে, বলে, “তুই মেয়ে…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    রক্তকরবীর নীচে

    প্রশান্ত দত্ত এক সেই দিনটা ছিল এক আশ্চর্য রকমের নীরব সকাল। আশ্রমের চারপাশে যেন শব্দেরাও হাঁটুর উপর বসে ধ্যান করছিল। গ্রীষ্মের হালকা বাতাস রক্তকরবী গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে ছায়া ফেলছিল সিঁড়ির ওপর। মীনাক্ষীদেবী প্রতিদিনের মতো ছাতা হাতে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, চোখে ছিল হালকা ঘুম আর মনে কিছুদিন আগের জলছবি। তখনই তিনি প্রথম দেখেন সেই লোকটিকে—ধুলো মাখা গেরুয়া কাপড়, গলায় একতারা ঝুলছে, চোখে এমন এক প্রগাঢ় শূন্যতা, যা যেন হঠাৎই জীবনের বহুদূরের কোনো রঙ ভুলে এসে বসেছে শান্তিনিকেতনের প্রান্তে। রাস্তার পাশের সেই পুরনো কদম গাছটার ছায়ায় বসে ছিল সে। সে কারো দিকে তাকাচ্ছিল না, বরং তাকিয়ে ছিল বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোনো অদৃশ্য…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    ক্যাফে কলকাতা: কাপে কাপে গল্প

    পল্লবী গাঙ্গুলী ব্রিউড ইন পার্কস্ট্রিট শহরটা তখনও ঠিক জেগে ওঠেনি। সকাল আটটা পার্কস্ট্রিটে মানে একটা অলসতা, একটা হাই তুলতে তুলতে ভাঙা ঘুমের মাধুর্য। কিন্তু ‘ক্যাফে কলকাতা’—এই নামটা যেন একটু অন্যরকম। ওটা একটা ক্যাফে, আর একটা অনুভূতি। পিসক্যাফে নয়, স্টারবাকস নয়, এমনকি ফ্ল্যাবি চিয়ার বা কফিহাউসও নয়। এটা ছিল মায়া আর মশলার কফিতে মেশানো এক ঘরোয়া শহুরে গল্পের ঠিকানা। প্রাচীন লাল ইটের দালানে সবুজ জানালার শেড আর কাঠের ঝুলন্ত বোর্ডে লেখা “Café Kolkata – since 1986”—মোহনদার বাবা শুরু করেছিলেন। তারপর উত্তরাধিকার মেনে চলে এসেছে। এখন সামলায় অনিকেত, শহরের হিপস্টার হিরো। সবসময়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, আর কথায় সাহিত্যিক…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    ঘরহারা মানুষের ঘরকথা

    সৌম্যজিৎ বসু অধ্যায় ১: কলকাতার শহরটা যখন প্রথম সূর্যকিরণে লালচে আভা পেতে শুরু করে, তখনও ময়লা পলিথিন, ইটের টুকরো আর টিনের ছাউনি ঘেরা বস্তি ঘুম থেকে পুরোপুরি জাগেনি। তবে বস্তির মধ্যে কুমুদ আগেই জেগে উঠেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল দূর থেকে হালকা করে শোনা যায় ট্রামের ঘণ্টার টুং টুং শব্দ, আর মাঝে মাঝে কোনো বাসের গর্জন। কুমুদ একহাত দিয়ে চোখের ঘুমের ছাপ মুছে নিয়ে অন্য হাতে চোঙা প্যান্টটা ঠিক করে পরে নেয়। গায়ে পরনের ছেঁড়া গেঞ্জিটা রাতের ঘাম আর বস্তির ধুলোবালিতে আরও বিবর্ণ হয়ে গেছে। সে জল আনার পিতলের কলসি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সরু গলিটা পেরিয়ে পাশের পাম্পের দিকে। পাম্পের…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    ছায়ার নাচ

    সমীর বাউড়ি এক পুরুলিয়ার চরীদা গ্রামের আকাশে যখন সূর্য ডুবে যেতে থাকে, তখন লাল মাটির উপর এক ধরনের নরম আলো পড়ে, যেন প্রকৃতি নিজেই নৃত্যের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ছোট্ট গ্রামটি পাহাড়, শাল-পিয়াল আর বিস্তীর্ণ ধুলিধূসর পথের মাঝে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়ের নাম—যেখানে মুখোশ পরে নাচে পুরুষেরা, যেখানে ছৌ নাচ কেবল শিল্প নয়, আত্মার প্রকাশ। গ্রামের এক কোণে থাকে অরিত্র—এক কিশোর, যার চোখে মুখে জেদ, আর ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হওয়া এক আগুন। সে ছেলেবেলা থেকেই ছৌ নাচের প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু সেই ভালোবাসা যেন চোরাগোপ্তা সম্পর্কের মতো—জানাজানি হলে শাস্তি। তার মা, এক সাধারণ কিন্তু কঠোর নারী, নিজের চুল কাটার দোকান চালিয়ে কোনোরকমে…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    শেষ ট্রেনের আলো

    ঋতব্রত সেনগুপ্ত অধ্যায় ১: হাওড়া স্টেশনের ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মটা এই মুহূর্তে যেন নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, সারাদিনের ব্যস্ততা, হইচই আর মানুষের ঢেউয়ের পর এক অপার নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে সে। কেবল মাঝে মাঝে ভেসে আসে ট্রেন ছাড়ার ঘোষণার শব্দ, কিছুটা যান্ত্রিক, কিছুটা নিঃসঙ্গ। স্টেশনের ঘোলাটে আলো, ছায়া আর মাঝেমাঝে হুঁশিয়ারির সাইরেন যেন একরকম কাব্যিক সুর তৈরি করেছে রাতের গভীরে। এই রাত শহরের নয়, এই রাত শুধু প্ল্যাটফর্মের, শুধুই অপেক্ষার। এই নীরবতার মধ্যে, একটি বেঞ্চের এক প্রান্তে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ — নাম অরবিন্দ রায়। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, গায়ে পুরনো সাদা চাদর জড়ানো, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তাঁর পাশে রাখা একটি সুতির ব্যাগ,…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    রঙিন ঘুড়ি

    রৌদ্রদীপ লাহা এক সকালবেলা হাওড়ার গলি ঘুপচি ভেঙে আস্তে আস্তে সূর্যের আলো ঢুকতে শুরু করে। লোহার রেললাইনের ধারে, টালির ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোয় তখনও ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের মুখে এক চিলতে আলোর রেখা এসে পড়ে। শহরের কোলাহল তখনও শুরু হয়নি, কিন্তু বস্তির গলিতে গলিতে জীবনের আর্তনাদ যেন ঘুম ভাঙিয়ে দেয় পিন্টুর মতো হাজারো শিশুকে। সেই গলির এক কোণে মায়ের কোল থেকে আলতো করে উঠে দাঁড়ায় পিন্টু। বয়স দশ বছর, গায়ে মলিন ফাটা হাফ প্যান্ট, গায়ের ওপর পাতলা ছেঁড়া জামা। চোখদুটো বড় বড়, মলিন হলেও তার মধ্যে লুকানো থাকে অজস্র স্বপ্নের আভা। পিন্টু ধীরে ধীরে চোখ কচলে জেগে ওঠে। রাতের ঘুম তার স্বপ্নে…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    শকুনি

    সুশোভন দত্ত পর্ব ১: যুদ্ধের আগমনী ইন্দ্রপুর শহরে ভোরের আলো নামে না—এখানে আলো আসে হেডলাইন দিয়ে। একটা নতুন দিন মানে আরেকটা টক-শো, একটা নতুন বিতর্ক, আর একটা পুরনো ষড়যন্ত্রের ভিন্ন মুখ। কিন্তু আজকের সকালটা একটু আলাদা ছিল। “আজ সন্ধ্যেবেলা ৭টায় ‘রিপাবলিক ভয়েস’ টিভি চ্যানেলে মুখোমুখি হচ্ছে দর্পণ বসু আর কৃষ মালভিয়া। লাইভ বিতর্ক।”—এই নিউজ টিকারের নিচে অনবরত ঘুরছিল একটা নাম: শকুনি সেন। সে নিজে কখনও ক্যামেরার সামনে আসে না। অথচ প্রতিটি বিতর্কের পেছনে, প্রতিটি ‘এক্সপোজে’র নেপথ্যে, প্রতিটি বাছাই করা হেডলাইনের গভীরে তার ছায়া ঘন হয়ে থাকে। কৃষ মালভিয়া টের পাচ্ছিল—এটা আর বিতর্ক নয়, এটা যুদ্ধ। এবং যুদ্ধের নাট্যকার এই ব্যক্তি…