• Bangla - সামাজিক গল্প

    পড়শির কাহিনি

    অনির্বাণ সেন পর্ব ১ কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল আবাসন—গ্লাসের বারান্দা, রঙিন আলো, লিফটে ওঠানামার শব্দে ভরা। সেখানকার অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে থাকে দত্ত পরিবার। সুদীপ্ত দত্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ অফিসার, মাসের শেষে তার অ্যাকাউন্টে যে বেতন জমে, তাতে অনায়াসেই চলে যায় তাদের তিন সদস্যের সংসার। তার স্ত্রী মৌসুমি, একসময় কলেজে ইংরেজি পড়াতেন, কিন্তু এখন ঘরের দেখাশোনাই তার প্রধান কাজ। মেয়ে ঐশী—নবম শ্রেণির ছাত্রী, পড়াশোনায় মেধাবী, আঁকতে ভালোবাসে, আর মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতে শিখছে। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তাকালে দূরে দেখা যায় আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, আর একটু নিচে তাকালেই উল্টো দৃশ্য। ঝুপড়ি ঘরগুলোর ছাউনিতে টিন, কোথাও পলিথিন, কোথাও বা ভাঙা বাঁশ…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    লাল বাতির জানালা

    সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: আগমন কলকাতার শহরে কত রকমের গলি আছে—কোথাও শুধু হালচালহীন ইটের দেওয়াল, কোথাও পুরোনো বারান্দার ফাঁক দিয়ে নীচে ঝুলে থাকা ধুলো-কণার ঝালর, কোথাও অন্ধকার ড্রেনের কানা ধরে বাচ্চাদের খেলা। অথচ শহরের একই শরীরের ভেতরে কতগুলো ভিন্ন আত্মা বাস করে। অর্ণবের জন্য এই শহর ছিল চেনা—ক্লাসে যাতায়াত, কফিহাউসের টেবিলে আড্ডা, কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান। কিন্তু যেদিন সে উত্তর কলকাতার সেই গলিতে প্রথমবার ঢুকল, মনে হল অজানা এক শহর খুলে গেছে তার সামনে। মোড়ে একটা ছোট্ট চা-দোকান। দোকানি মিঠুন দা চেনা মানুষ, তবে এখানে দাঁড়িয়ে অর্ণবকে দেখে খানিকটা অবাক। বলল, —“কোথায় যাচ্ছিস? এই রাস্তাটা তোর পথ নয়।” অর্ণব ব্যাগ কাঁধে…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    চুক্তির শহর

    রুদ্রনীল সেন পর্ব ১: শুরু কলকাতার ভোর সবসময় এক অদ্ভুত শব্দে ভরে থাকে—হর্ণের মৃদু চিৎকার, ট্রামের ঘড়ঘড়ানি, ভাপওঠা চায়ের দোকান থেকে উঠে আসা ধোঁয়া, আর দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের আওয়াজ। অদ্রিজ বসু প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে ঘুম ভাঙল এই শব্দের ভেতরেই। তবে আজকের সকালটা অন্যরকম। আজ সে আর চাকরিজীবী নয়—আজ থেকে সে উদ্যোক্তা। মাত্র তিন বছর আগে সে নামকরা এক বহুজাতিক কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করেছিল। ভালো বেতন, অফিসের এয়ার কন্ডিশনড চেম্বার, আর মাথার ওপর বসের অনুমোদনের গণ্ডি—সব কিছুই তার ছিল। কিন্তু তবুও যেন কিছু একটা তাকে টানত না। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ট্রামে বসে শহরের ব্যবসায়িক…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - সামাজিক গল্প

    অপরিচিতা মোহিনী

    সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…

  • Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - সামাজিক গল্প

    খেলাঘর

    অর্ণা মুখার্জী ১ সায়নী বসু দক্ষিণ কলকাতার মফস্বলি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নতুন প্রজেক্টের কাজে তাকে পাঠানো হয়েছিল এই অঞ্চলের একটি পুরনো জমি পরিদর্শনের জন্য, যেখানে একটা কমিউনিটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই জমির পাশেই পড়ে থাকা পুরনো বাসস্ট্যান্ডটি তার দৃষ্টি আটকে দেয়। নীল রং উঠে যাওয়া টিনের ছাউনি, ভাঙাচোরা কংক্রিটের বেঞ্চ, আর বৃষ্টির জল জমে থাকা ময়লা গর্ত — দেখলে মনে হতো এই জায়গায় কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ বোতল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জল খাচ্ছে, কেউবা টায়ারের টুকরো নিয়ে খেলছে — ওদের…

  • Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - সামাজিক গল্প

    “অ আ ক খ”

    ১ নদীর পাড়ের সেই ছোট্ট চায়ের দোকানটা দিনের শেষে যেন এক শান্তির আশ্রয় হয়ে উঠত আশেপাশের শ্রমজীবী মানুষদের জন্য। পাশ দিয়ে গঙ্গার একটি শাখানদী বয়ে গেছে, তার জল সবসময়ই মাটি ছুঁয়ে যায়, আর গ্রীষ্ম হোক বা শীত—সন্ধ্যার দিকে বাতাসে একধরনের স্নিগ্ধতা নেমে আসে। আব্দুল হালিম প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই দোকান চালিয়ে আসছেন। বয়স পঞ্চাশ পার করলেও মুখে এখনো সেই নরম হালকা হাসি। সকালে দোকান খোলার সময় সে নিজেই ঝাঁট দেয়, ঠেলাগাড়ি থেকে বিস্কুটের কৌটো নামায়, দুধ ফুটিয়ে চা বানায়। তারপর একে একে আসে রিনা, নিতাই আর গোলাম—তিনজন শিশু-কিশোর, যারা বাড়ির অভাবের কারণে স্কুল ছেড়ে এই দোকানেই কাজ করে। রিনা…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - সামাজিক গল্প

    ঝুমরির গানের দল

    দীপান্বিতা মাহাতো ১ পুরুলিয়ার বাঁশডাঙা গ্রামে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই পাখির ডাকে জেগে ওঠে পাহাড়-জঙ্গলের বুক চেরা গ্রামটা। মাটির বাড়ির চালের নিচে কুয়াশার কুয়াশা, আর তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলে যায় একটা কিশোরী—ঝুমরি হাঁসদা। তার পরনে হালকা লাল পাড়ের ধবধবে সাদা শাড়ি, হাতে জলভরা কলসি, কিন্তু ঠোঁটে একটানা চলতে থাকা সুর—”গেলি চলে পাহাড়ি পথে, কাহার ডাকে রে মন।” সে একা, কিন্তু একলা নয়। ঝুমরির কণ্ঠে যেন গমগম করে ওঠে পুরো বাঁশডাঙার ঝরা পাতা, মাঠঘাট, আর সেই পাহাড়ের পেছনের রক্তিম সূর্য। ছোট থেকেই ঝুমরির গলার জোর ছিল গ্রামের অন্যসব মেয়েদের চেয়ে আলাদা। মা পূর্ণিমা হাঁসদা ছোটবেলায় নিজের ঠাকুমার কাছ থেকে যে…

  • Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - সামাজিক গল্প

    এক মুঠো চাল

    সায়ন্তন বসু ১ ধনেখালির একচালা ছোট্ট প্রাইমারি স্কুলটার ক্লাসঘরে তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, সূর্যের আলো বেখেয়ালে মেঝেতে খেলছে, কিন্তু সুধাংশু বেরা বুঝতে পারছিলেন, আজকের শিক্ষার আলো যেন কেমন ম্লান। ক্লাসরুমে মাত্র ন’জন ছাত্র—হাজিরার খাতা বলছে তেইশজন আছে রোল কল-এ। যাদের এসেছে, তাদের চোখে ঘুম নেই, আছে কেমন এক শূন্যতা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো মাথা নিচু করে বসে আছে, যেমনভাবে গরিব সংসারের শিশুরা বসে থাকে কোনো বড়লোক আত্মীয়ের সামনে—ভয়ে নয়, লজ্জায়। হঠাৎ চিন্ময় হালদার, চতুর্থ শ্রেণির সবচেয়ে শান্ত ছেলেটা, ধীরে ধীরে হেলে পড়ে। সুধাংশু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলেন। ছেলেটার নিঃশ্বাস ঠিক আছে, জ্বর নেই, কিন্তু সে সংজ্ঞাহীন। মাথায় জল দিতে দিতে…

  • Bangla - সামাজিক গল্প - স্মৃতিকথা

    ধুলো জমা স্মৃতি

    মৈনাক ঘোষ অধ্যায় ১ ঈশানীর কাছে উত্তর কলকাতার সুবর্ণা দিদার বাড়ি মানে ছিল একটা নিঃশব্দ, ধুলো জমে যাওয়া সময়ের বাক্স। বহুদিনের পুরনো এই দোতলা বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই একটা শীতল বাতাস শরীর বেয়ে নামে, যেটার উৎস জানে না কেউ। দালানে ফেলে রাখা কাঠের চেয়ার, দেয়ালে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবি, আর সিঁড়ির কর্কশ কড়কড়ে শব্দ সব যেন এক অতীতের গর্জন ছড়িয়ে রাখে। সে এসেছে এইবার ছুটি কাটাতে, কিন্তু সঙ্গে নিয়েছে নিজের ল্যাপটপ আর কিছু গবেষণার বই—কারণ প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে তার এম.ফিল. চলছে, আর সে এই ছুটির সময়টাও খালি যেতে দিতে চায় না। দ্বিতীয় দিনের সকালে, বৃষ্টি নামার পরপরই, সে দিদার ঘরের পাশে একটা…

  • Bangla - সামাজিক গল্প

    চিঠির ভাঁজে সমাজ

    সৌমিত্র চৌধুরী ১ শ্যামল সাঁতরা জীবনের অধিকাংশ সময়টাই কাটিয়েছেন চাঁদিপুরের ছোট্ট পোস্ট অফিসের কাঠের কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন সকাল নয়টার আগে তিনি পৌঁছে যেতেন, সেই পরিচিত ঘন্টা বাজিয়ে খোলার সঙ্কেত দিতেন, আর দুপুর পর্যন্ত চিঠি ছাঁটা, ডাকসেবকের ব্যাগ সাজানো, খামে ডাকটিকিট লাগানো, টাকা জমা নেওয়া আর বাকি সময়টুকু গ্রামের মানুষের সুখদুঃখের শ্রোতা হয়ে উঠতেন। অবসরের পর প্রথম সকালে তাঁর ঘুম ভাঙে একটি অস্পষ্ট, বিষণ্ণ নীরবতায়। আর কোনও অফিস নেই, আর কোনও চিঠি নেই, আর কোনও হাঁকডাক নেই। দরজার বাইরে রোদ পড়েছে, পাখির ডাক এসেছে, কিন্তু তাঁর মনে এক ধরণের বর্ণহীন শূন্যতা জমে। সকালের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে পড়ে,…