অভিজিৎ মল্লিক পর্ব ১: লাল মাটির পথে লাল মাটির রাস্তা ধরে যখন ইরা প্রথমবারের মতো পুরুলিয়ার দিকে এগোচ্ছিল, তখন আগস্টের ভিজে বাতাসে গায়ে লাগছিল শালপাতার গন্ধ। কলকাতার ভিড় ঠেলে, চাকরির ক্লান্তি থেকে মুক্তির খোঁজে এই জায়গায় আসা যেন তার বহুদিনের স্বপ্ন। ছুটি পেয়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ, কিন্তু সেই সামান্য সময়ের ভেতরেই সে খুঁজে পেতে চায় এক অন্য জগৎ—যেখানে মোবাইল টাওয়ারের থেকে উঁচু হয় না কোনো গাছ, যেখানে শহরের ধোঁয়া ঢেকে রাখে না আকাশের রঙ। বাসটার জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে লালচে-খয়েরি মাটির ঢিবি, দূরে ঝাপসা পাহাড়। মাঝেমাঝে গরুর গাড়ি রাস্তা পার হচ্ছে, আবার কোনো কোনো মোড়ে ঢোলের…
-
-
অনিন্দিতা ঘোষ পাল ১ প্রান্তি ছিল গ্রামের একেবারে সাধারণ মেয়ে। কাঁচা মাটির ঘর, উঠোনে মাটির চুলা, আর সারাদিন খাটুনি খাটা বাবা-মা—এই ছিল তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ। তবে তার মধ্যে এক অন্য রকম প্রাণ ছিল। চারপাশের মেয়েরা যখন মাঠের ধারেই লাজুক হয়ে বসে থাকত বা পুতুল নিয়ে খেলত, তখন প্রান্তি ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করতে বেশি ভালোবাসত। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা ফেলে দিয়ে ছুটে যেত পাড়ার মাঠে। সেখানে ফুটবল খেলছিল বড় ছেলেরা, তার চোখে পড়ল বলটা কীভাবে এপাশ-ওপাশ দৌড়চ্ছে, ছেলেরা কেমন মন দিয়ে তাড়া করছে। প্রথমবারের মতো তার মনে হল, “এই খেলাটার মধ্যে যেন এক যাদু আছে।” মনে হল, ফুটবলের ওই গোল…
-
অর্ণব দাশগুপ্ত পর্ব ১: লাল সূচকের সকাল শেয়ার বাজারের দালালদের জীবনকে বাইরের লোকেরা চকচকে ভেবে নেয়। যেন প্রতিদিনই টাকার বৃষ্টি হয়, প্রতিটি ডাকে লেনদেনের ঝলমলে খেলা। কিন্তু ভেতরে যারা থাকে, তারা জানে আসলে কেমন চাপ, কেমন দমবন্ধ করা দৌড়, আর কেমন গোপন ভয়ের সঙ্গে প্রতিদিনের হিসাব মেলাতে হয়। সৌমিক চৌধুরী সেই ভেতরের মানুষ। সবার কাছে সে “সৌমিক দা”—কলকাতার ডালহৌসির এক পুরোনো শেয়ার ব্রোকারেজ অফিসের নির্ভরযোগ্য দালাল। তার হাতে ক্লায়েন্টরা তাদের সঞ্চয় তুলে দেয়, তাদের স্বপ্ন, তাদের ভরসা। আজকের সকালটা শুরু হয়েছিল আশ্চর্যভাবে ভারী এক নীরবতায়। টিভির স্ক্রিনে তখনও বাজার খোলেনি, কিন্তু সূচকের আগে-পরে ছুটে চলা লাল আর সবুজ রেখাগুলো যেন…
-
অনিন্দিতা রায় পর্ব ১ — ট্রেনের জানালা শিয়ালদহ স্টেশন গমগম করছে মানুষের চিৎকারে, বোঝাই ট্রেনের হুইসেলে আর উদ্বাস্তুদের কান্নায়। আগস্টের আর্দ্র গরমে ছাপোষা মানুষের ভিড় যেন এক বিশাল ঢেউ হয়ে উঠেছে, যাদের কোনো ঠিকানা নেই, আছে শুধু ছিন্ন দেহের মতো ভেঙে যাওয়া স্মৃতি। অঞ্জলি দাঁড়িয়ে আছে ভাই হরিদাসকে পাশে নিয়ে, হাতের মুঠোয় একটা ভাঁজ করা চিঠি। সেই চিঠি খুলনা থেকে সঙ্গে এনেছে, অন্য কিছু আনতে পারেনি। ট্রাঙ্কে আছে সামান্য কাপড় আর কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল, কিন্তু বুকের ভেতর যেটা নিয়ে এসেছে সেটা অদৃশ্য—শিকড় ছেঁড়া এক গ্রামের ঘ্রাণ, উঠোনে ঝরা শিমুলফুল, আর রহিমার মুখ। চারপাশে রেললাইনের শব্দে ভরে উঠলেও অঞ্জলি শুনতে পাচ্ছে কেবল…
-
হিমাদ্ৰী ঘোষ ১ বস্তির সকাল সবসময় একরকম শব্দে ভরা—খটাখট হাঁড়ি-বাসনের শব্দ, চায়ের দোকানের কেটলি থেকে উঠতে থাকা সিটি, ভাঙা টিনের চালের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের লালচে আলো আর তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ছোট ছোট শিশুদের কোলাহল। এখানে সকাল মানেই নতুন দিনের লড়াই শুরু। কেউ ভোরেই কাজে বেরিয়ে পড়ে, কেউ বা কুপির আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে রাতভর ইটভাটায় কাজ করে আসার ক্লান্তি নিয়ে। মায়েদের হাঁকডাক আর কিশোরদের কাশি-মেশানো অস্থিরতা মিশে যায় বাতাসে। এর মাঝেই ঘুড়ির নাম উঠলেই বদলে যায় আবহ। যেন এক মুহূর্তের জন্য হলেও দারিদ্র্যের আঁকড়ে ধরা হাতটা আলগা হয়ে যায়, আর আকাশ থেকে নেমে আসে রঙিন আশার…
-
অনির্বাণ সেন পর্ব ১ কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল আবাসন—গ্লাসের বারান্দা, রঙিন আলো, লিফটে ওঠানামার শব্দে ভরা। সেখানকার অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে থাকে দত্ত পরিবার। সুদীপ্ত দত্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ অফিসার, মাসের শেষে তার অ্যাকাউন্টে যে বেতন জমে, তাতে অনায়াসেই চলে যায় তাদের তিন সদস্যের সংসার। তার স্ত্রী মৌসুমি, একসময় কলেজে ইংরেজি পড়াতেন, কিন্তু এখন ঘরের দেখাশোনাই তার প্রধান কাজ। মেয়ে ঐশী—নবম শ্রেণির ছাত্রী, পড়াশোনায় মেধাবী, আঁকতে ভালোবাসে, আর মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতে শিখছে। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তাকালে দূরে দেখা যায় আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, আর একটু নিচে তাকালেই উল্টো দৃশ্য। ঝুপড়ি ঘরগুলোর ছাউনিতে টিন, কোথাও পলিথিন, কোথাও বা ভাঙা বাঁশ…
-
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: আগমন কলকাতার শহরে কত রকমের গলি আছে—কোথাও শুধু হালচালহীন ইটের দেওয়াল, কোথাও পুরোনো বারান্দার ফাঁক দিয়ে নীচে ঝুলে থাকা ধুলো-কণার ঝালর, কোথাও অন্ধকার ড্রেনের কানা ধরে বাচ্চাদের খেলা। অথচ শহরের একই শরীরের ভেতরে কতগুলো ভিন্ন আত্মা বাস করে। অর্ণবের জন্য এই শহর ছিল চেনা—ক্লাসে যাতায়াত, কফিহাউসের টেবিলে আড্ডা, কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান। কিন্তু যেদিন সে উত্তর কলকাতার সেই গলিতে প্রথমবার ঢুকল, মনে হল অজানা এক শহর খুলে গেছে তার সামনে। মোড়ে একটা ছোট্ট চা-দোকান। দোকানি মিঠুন দা চেনা মানুষ, তবে এখানে দাঁড়িয়ে অর্ণবকে দেখে খানিকটা অবাক। বলল, —“কোথায় যাচ্ছিস? এই রাস্তাটা তোর পথ নয়।” অর্ণব ব্যাগ কাঁধে…
-
রুদ্রনীল সেন পর্ব ১: শুরু কলকাতার ভোর সবসময় এক অদ্ভুত শব্দে ভরে থাকে—হর্ণের মৃদু চিৎকার, ট্রামের ঘড়ঘড়ানি, ভাপওঠা চায়ের দোকান থেকে উঠে আসা ধোঁয়া, আর দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের আওয়াজ। অদ্রিজ বসু প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে ঘুম ভাঙল এই শব্দের ভেতরেই। তবে আজকের সকালটা অন্যরকম। আজ সে আর চাকরিজীবী নয়—আজ থেকে সে উদ্যোক্তা। মাত্র তিন বছর আগে সে নামকরা এক বহুজাতিক কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করেছিল। ভালো বেতন, অফিসের এয়ার কন্ডিশনড চেম্বার, আর মাথার ওপর বসের অনুমোদনের গণ্ডি—সব কিছুই তার ছিল। কিন্তু তবুও যেন কিছু একটা তাকে টানত না। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ট্রামে বসে শহরের ব্যবসায়িক…
-
সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…
-
অর্ণা মুখার্জী ১ সায়নী বসু দক্ষিণ কলকাতার মফস্বলি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নতুন প্রজেক্টের কাজে তাকে পাঠানো হয়েছিল এই অঞ্চলের একটি পুরনো জমি পরিদর্শনের জন্য, যেখানে একটা কমিউনিটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই জমির পাশেই পড়ে থাকা পুরনো বাসস্ট্যান্ডটি তার দৃষ্টি আটকে দেয়। নীল রং উঠে যাওয়া টিনের ছাউনি, ভাঙাচোরা কংক্রিটের বেঞ্চ, আর বৃষ্টির জল জমে থাকা ময়লা গর্ত — দেখলে মনে হতো এই জায়গায় কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ বোতল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জল খাচ্ছে, কেউবা টায়ারের টুকরো নিয়ে খেলছে — ওদের…