প্ৰদ্যুত হালদার অধ্যায় ১ : কনটেইনারের গোপন রহস্য হাওড়ার শালিমার রেলইয়ার্ড রাতের আঁধারে যেন এক অন্য জগৎ। দিনের কোলাহল, গাড়ির গতি, রেলস্টেশনের ভিড় সব মিলিয়ে এ জায়গাটির অস্তিত্ব কেউ টেরই পায় না। কিন্তু গভীর রাত নামলে, ফাঁকা ফাঁকা রেললাইনগুলোর পাশে লম্বা সারিতে দাঁড়ানো পুরোনো মালগাড়িগুলো অদ্ভুত এক ভৌতিক আবহ তৈরি করে। সেদিনও এমনই এক রাতে, যখন কুয়াশার আস্তর ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে, তখন শ্রমিকদের নজরে আসে এক পুরোনো কনটেইনারের দিক থেকে আসা তীব্র পচা দুর্গন্ধ। প্রথমে তারা ভেবেছিল ইঁদুর বা কুকুর মারা গেছে ভেতরে, কিন্তু গন্ধ যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হতে থাকে এর পেছনে কিছু ভয়ঙ্কর লুকিয়ে আছে। চারজন…
-
-
অরিন্দম মুখোপাধ্যায় পর্ব ১ – অদ্ভুত চিঠি শহরের ভেতরে এমন সব গলি আছে যেগুলোতে সূর্যের আলো পৌঁছতে চায় না, আর চাইলেও পৌঁছতে পারে না। পুরনো ইমারত, একটার গায়ে আরেকটা ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে, জানলার গ্রিলগুলো মরচে পড়ে ক্ষয়ে গেছে, ভাঙা তার ঝুলে আছে রাস্তায়। সেই অন্ধকার গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল বারো তলা বাড়ি, যেটাকে আশপাশের মানুষ শুধু “ছায়ার বাড়ি” বলে ডাকে। কারণ এই বাড়ির জানলাগুলোতে গত দশ বছর ধরে কোনো আলো জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। তবুও মাঝেমাঝে অনেকে বলে থাকে, রাত বারোটার পর ওই বাড়ির ছাদে নাকি একটা অস্পষ্ট ছায়া দেখা যায়, কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু বোঝা যায় না।…
-
১ নদীর ধারে নৌকো এসে ভিড়ল যখন, তখন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। গোধূলির আলো মিশে আছে মেঘলা আকাশের গায়ে, আর দূরে জলপাখিদের দল ভেসে যাচ্ছে মেঘের মতো। অর্ণব সেন নৌকার গা থেকে ক্যামেরার ব্যাগ নামালেন, তাঁর চোখে এক ধরনের উজ্জ্বল উত্তেজনা—যে উত্তেজনা কেবল নতুন জঙ্গল, নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। ভিতরকনিকা ন্যাশনাল পার্কের নাম তিনি বহুবার শুনেছেন, বহু বইয়ে পড়েছেন, নানা নেচার ডকুমেন্টারিতেও দেখেছেন। কিন্তু এই প্রথমবার, নিজ চোখে, নিজ ক্যামেরা হাতে তিনি প্রবেশ করছেন সেই রহস্যময় ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভেতরে, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লবণাক্ত জলের কুমিরেরা থাকে। চারপাশে নদীর খালবিল, কাদাজল, আর শ্বাসমূলের…
-
অভিষেক দত্ত পর্ব ১ : অরণ্যের প্রান্তে সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে গড়িয়ে পড়ছে। লালচে আলো যেন মায়ার পর্দার মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। মহারানী অরণ্যের গাঢ় সবুজ ছাতার উপর সেই আলোর আভা পড়তেই জঙ্গলটা আরও রহস্যময়, আরও গম্ভীর হয়ে উঠছে। বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা, অথচ গ্রীষ্মকাল, গরমের দাপট চরমে থাকার কথা। যেন এই জঙ্গলের আলাদা এক নিজস্ব ঋতুচক্র আছে—বাকি পৃথিবীর সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। অভিজিৎ ট্রেকিং ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ধুলোমাখা কাঁচা রাস্তায়। তার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এক বন্যপ্রাণী গবেষক। তার লক্ষ্য—অদৃশ্যপ্রায় বন্যপ্রাণীদের খোঁজ পাওয়া। কত গল্পই না ছড়ানো…
-
দেবপ্রতিম সাহা কুহেলি দত্তের প্রতিদিনের কাজ ছিল একঘেয়ে অথচ ভীষণ মনোযোগের—স্যাটেলাইট ডেটার অগণিত ছবি বিশ্লেষণ করা। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল অঞ্চলের মানচিত্র সে তৈরি করছিল তার গবেষণার জন্য, বিষয় ছিল ভূ-পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব। দিনের পর দিন চোখের সামনে আসছিল নদীর প্রবাহ বদলানো, বনাঞ্চলের সবুজ কমে যাওয়া কিংবা গ্রামের বিস্তার। কিন্তু সেদিন রাতের স্যাটেলাইট ছবিতে তার চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। ঝাপসা একখণ্ড ফ্রেমে সে দেখতে পেল অদ্ভুত জ্যামিতিক রেখা—আয়তক্ষেত্র, অর্ধবৃত্ত আর সোজা প্রাচীরের মতো দাগ একসঙ্গে মিলেমিশে আছে। এগুলো প্রকৃতির তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু মানচিত্রে সে জায়গায় কোনো গ্রাম নেই, কোনো জনবসতি নেই, এমনকি সরকারি রেকর্ডেও নেই কোনো নির্মাণ। সে প্রথমে…
-
অরিন্দম লাহিড়ী পর্ব ১: রেখার ভেতর লুকোনো মুখ কলকাতার বর্ষার দিনগুলোর আলাদা একটা গন্ধ আছে। ভিজে মাটির সঙ্গে পুরোনো বইয়ের পাতা মিশে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে শ্বাস ছড়িয়ে দেয় শহরের অলিগলিতে। আড্ডাতলার সেই ভাঙাচোরা চায়ের দোকানটার সামনে বৃষ্টির ফোঁটা তিরতির করে ঝরছিল টিনের চাল থেকে। দোকানটা শহরের পুরোনো সাংবাদিক, লেখক, চিত্রশিল্পীদের এক অদ্ভুত আড্ডাখানা। সেই দোকানের কোণের টেবিলে বসেছিল অরিজিৎ সেন—চল্লিশের কোটায় পৌঁছে যাওয়া এক কার্টুনিস্ট। তার চুলগুলো কিছুটা অগোছালো, চোখের নিচে কালো দাগ, আঙুলে শুকিয়ে যাওয়া কালির ছোপ। অরিজিৎ সেই দিন একটা নতুন কাজ আঁকছিল। কাগজে আঁকা মানুষগুলো তার কাছে শুধুই ব্যঙ্গাত্মক চরিত্র নয়, যেন তারা জীবন্ত হয়ে ওঠে। আজকের…
-
১ কলকাতার এক শীতল সন্ধ্যা। হাওয়ার ঝাপটায় জানালার কাঁচ খানিকটা কেঁপে ওঠে, বাইরের রাস্তার আলো ঘরের অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে না। ছোট্ট টেবিলের ওপর খোলা ল্যাপটপে ইশিতা সেনের চোখ আটকে আছে। প্রথম বর্ষের কলেজছাত্রী সে, ক্লাস শেষ করে সাধারণত রাতেই পড়াশোনা আর সোশ্যাল মিডিয়ার খোলা জানালায় হারিয়ে যায়। তার একঘেয়ে দিনযাপনকে একটু প্রাণবন্ত করে রাখত প্রিয় বান্ধবী সুহানি দত্ত, কিন্তু সেই মেয়েটিই এখন আর নেই। ঠিক এক বছর আগে, কলেজের হোস্টেল থেকে হঠাৎ উধাও হয়েছিল সুহানি, পরে খবর এলো রহস্যজনকভাবে মারা গেছে সে। পুলিশ বলেছিল আত্মহত্যা, কিন্তু সেই কথায় কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি ঈশিতা। বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা আর অসমাপ্ত প্রশ্নের…
-
দেবদীপ মুখার্জী পুরনো ভাড়াবাড়ি শহরের প্রান্তে, যেখানে নতুন উঁচু ফ্ল্যাটের দালান এখনও পুরোপুরি গজিয়ে ওঠেনি, সেখানেই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা, শ্যাওলা-ঢাকা একটি ভাড়াবাড়ি। বাইরে থেকে দেখলেই মনে হয় বহুদিন কেউ থাকেনি। কিন্তু আসলে সেটা ভাড়ার জন্যই রাখা হয়েছে—সস্তা ভাড়া, সামান্য মেরামতির খরচে কেউ যদি সাহস করে থাকতে রাজি হয়। রুদ্র, সদ্য কলেজ শেষ করে সাংবাদিকতার চাকরিতে ঢোকা এক তরুণ, তার অফিসের কাছে একটা থাকার জায়গা চাইছিল। শহরের ভেতরে ভাড়া সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক তখনই এক প্রপার্টি ডিলারের মাধ্যমে এই বাড়ির খোঁজ পায়। বাড়িটা দেখতে এসে প্রথমেই বুক কেঁপে উঠেছিল—কালচে দেওয়াল, কাঠের জানালায় ফাটল, ছাদের কোণে বাদুড় ঝুলে আছে। কিন্তু…
-
অর্জুন ধর দ্য কল ব্যাক দিল্লির পুরোনো চাঁদনি চকের গলির ভেতরে এক ছোট্ট বইয়ের দোকান। নাম স্মৃতির আড্ডা। কাঠের তাকজোড়া ভরে আছে পুরোনো গোয়েন্দা উপন্যাস, ইংরেজি ক্লাসিক, বাংলার কবিতার বই। দোকানের মালিক অর্ণব সেন—চল্লিশ ছুঁইছুঁই, চশমা পরা, গম্ভীর মুখের মানুষ। তার বুকশপে দুপুরগুলো শান্ত, শুধু পাখির ডাক আর বাইরের যানজটের আওয়াজ ভেসে আসে। কেউ তাকে চিনে না, কেউ জানে না, এই নিরীহ বই বিক্রেতা একসময় ভারতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ গুপ্তচর ছিল। অর্ণবের দিনগুলো কাটছিল সহজেই—সকালে দোকান খোলা, দুপুরে ক’জন ছাত্রছাত্রী আসে নোটস খুঁজতে, সন্ধ্যায় তিনি একা বসে থাকেন। কিন্তু এই শান্তজীবন হঠাৎই ভেঙে দিল এক পুরনো ফোনকল। রাত তখন সাড়ে দশটা।…
-
শৌনক দে গ্রামের সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ সেন অনুভব করলেন যে, এখানে কোনো সাধারণ শীতলতা নেই; বরং এক অদ্ভুত শীতলতা আছে, যা হাড় কাঁপানোর মতো ঠান্ডা না হলেও, মনকে স্থির করে, চুপচাপ করে রাখে। গ্রামটি চুপচাপ, রাস্তার ধুলো উঠছে নিঃশব্দে, এবং বাতাসে যেন অদৃশ্য কোনো দমনের গন্ধ ভাসছে। গ্রামের মানুষের চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক, যা তাদের মুখের হাসিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তারা খুব সাবধানভাবে চলাফেরা করে, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ একটি ছোট কুঁড়েঘরের কাছে রিকশা থামালেন, যেখানে গ্রামের মানুষ সাধারণ জীবনযাপন করছে বলে মনে হলেও, তাদের আচরণে যেন প্রতিটি মুহূর্তে এক অনিশ্চয়তার চাপ…