অর্ঘ্যনীল চট্টোপাধ্যায় পর্ব ১ ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটার ঘর ছুঁতেই হালকা একটা কাঁপুনির শব্দ উঠল ঘরটার কোণ থেকে। জানলার বাইরে শীতের রাত, অন্ধকার নেমে এসেছে জলের মতো। অনিরুদ্ধের হাতে তখনও লেখা শেষ হয়নি, কাঠের টেবিলের উপরে একটা হলুদ আলো ছড়াচ্ছে বাল্বটা। হঠাৎ করেই টেবিলের পাশে রাখা পুরোনো রেডিওটা একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। প্রথমে ভেবেছিল বোধহয় কোনও তার আলগা হয়েছে। কিন্তু তারপর স্পষ্ট গলার স্বরে ভেসে এল—”আপনার জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু হচ্ছে এখন…” অনিরুদ্ধ চমকে উঠে তাকাল রেডিওর দিকে। বেজে চলেছে এক নারীকণ্ঠ, অবিশ্বাস্যভাবে পরিষ্কার উচ্চারণ, অথচ কোনও রেডিও চ্যানেলের নাম নেই, কোনও জিঙ্গেল নয়। শুধু একটানা সেই কণ্ঠ…
-
-
ঈশান মৈত্র পর্ব ১: পুরীর ডাকে সকালবেলা, কলকাতার গড়িয়াহাটের এক পুরনো ক্যাফেতে ছ’জন পুরনো বন্ধু বসে আছে—অর্ণব, রাহুল, কিয়া, দৃষ্টি, অদ্বিতী, আর নীলয়। কলেজ ফেস্টে গান, নাটক, ট্রেক—সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা এই টিম একসাথে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছিল বহুদিন ধরে। “এইবার সমুদ্র চাই,” বলে উঠল কিয়া, “আর কোনো পাহাড় টাহাড় নয়।” অর্ণব মুখ তুলে বলল, “পুরী? শ্রীমন্দির, বিচ, খানা-দানা?” “ডান! ডান!” চেঁচিয়ে উঠল সবাই। সপ্তাহখানেক পর তারা রওনা দিল পুরীর দিকে। ট্রেনে কাটানো রাত, জানালার বাইরে ছুটে যাওয়া মাঠ আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূরের আলো যেন নতুন এক অভিযান শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। পুরী পৌঁছে তারা উঠল সমুদ্রের কাছে একটা ছোট্ট হোটেলে।…
-
প্রীতম দে পর্ব ১ দিল্লির এক গোপন ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরে বসে ছিল একজন মধ্যবয়সী বিজ্ঞানী। নাম তার ডঃ সমরনাথ দে। কাঁধে হালকা ঝুঁকে থাকা শরীর, চোখে পুরু পাওয়ার চশমা, আর মুখে চিরন্তন ক্লান্তির রেখা। কিন্তু এই রাতে তার চোখ জ্বলছে। কারণ, তার সামনে রাখা কাঁচের একটি ছোট্ট ফ্লাস্কের ভেতরে রয়েছে এমন কিছু, যার খোঁজে বহু দেশের গোয়েন্দা সংস্থারা রাতের ঘুম হারাম করেছে। একটি লালচে তরল—একে বলা হয় রেড মারকারি। এই বস্তু নিয়ে বহু গুজব ছড়িয়েছে। কেউ বলে এটি নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির গোপন উপাদান। কেউ আবার দাবি করে, এর এক ফোঁটায় সম্পূর্ণ শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ডঃ দে জানেন,…
-
বৈশাখ দত্ত বারাভটেসগাডেনের ডাক অনিরুদ্ধ দাশগুপ্তের পায়ের নিচে ক্রঞ্চ করল ঝরাপাতায় ঢাকা পাথুরে রাস্তা। মে মাসের ঠান্ডা বাতাসটা কানের পাশ দিয়ে শিস বাজিয়ে চলে গেল। সে একবার পেছনে তাকাল—রেলস্টেশন থেকে বাসে করে উঠে এসেছে এই পাহাড়ি পথে, এখন দাঁড়িয়ে আছে বারাভটেসগাডেনের ঠিক গা ঘেঁষে। দূরে দেখা যাচ্ছে সেই বিখ্যাত পাহাড়, যার চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে হিটলারের berüchtigte Kehlsteinhaus—ঈগল নেস্ট। “Sir, are you going up alone?” পাশের একজন ট্যুরিস্ট গাইড জিজ্ঞাসা করল। “Just exploring the base first,” অনিরুদ্ধ ইংরেজিতে হেসে বলল। তার ব্যাগের ভেতরে একটা কালো মলাটের ফাইল, যার উপর লেখা: “Third Reich and the Eastern Front: A Subaltern Perspective”. এই গবেষণাপত্রটাই…
-
ঋজুরাজ ভট্টাচার্য পর্ব ১ শোভাবাজার সুতানুটি স্টেশনের সকালটা অন্যান্য দিনের মতোই ব্যস্ত ছিল। মেট্রোর ফ্লোরে পলিশ করা ধুলো, গুমগুম শব্দে নেমে আসা রেলগাড়ি, আর সবার কানে হেডফোন গুঁজে থাকা যাত্রীদের থমথমে মুখ—এই চেনা ছকে হঠাৎ যেন একটা ফাটল ধরে গেল। ৯টা ৪৭ মিনিট। সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায়—নীলা সেন, ২১ বছরের ইতিহাস অনার্সের ছাত্রী, নীল ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। হালকা বেগুনিরঙা কুর্তি, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। সে ফ্ল্যাটফর্মের ডান প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়, মোবাইল বের করে কিছু একটা টাইপ করে। এরপর মাথা তুলে সামনে তাকায়। ৯টা ৪৮-এ তার পাশে এক বয়স্ক লোক এসে দাঁড়ায়। এরপর—স্টিল। ৯টা ৫৫। পরবর্তী ফুটেজে দেখা…
-
পুরবী রায় শর্মা অধ্যায় ১: পুরনো মানচিত্রের ছায়া কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। জানালার ফাঁক গলে সোনালি রোদের রেখা ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরনো কাঠের টেবিলের ধূলো জমা পৃষ্ঠ। সেই টেবিলে বসে অভীক ঘোষ ডুবে ছিল একটা ছেঁড়া বইয়ের পাতায়। বইটি এক ব্রিটিশ অভিযাত্রীর লেখা—১৮৭০ সালের মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত। অভীক এসব নিয়ে আগেও কাজ করেছে, তবে আজকের সন্ধান তার সমস্ত আগ্রহকে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে ফেলেছে। কারণ, পাতার প্রান্তে আঁকা একটি ছোট, অদ্ভুত মানচিত্র, তার মনোযোগ টেনে নিয়েছে। “এইটা কোনো সাধারণ নক্সা না…” সে নিজের মনেই ফিসফিস করে বলে। বইয়ের পাশে রাখা মাগে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে ততক্ষণে,…
-
সুভাষ বৰ্মন অধ্যায় ১: পুরনো দরজার ওপার কলকাতা শহরের কোলাহলের মাঝখানে ইতিহাসের পাতায় ডুবে থাকা ঋদ্ধিমা বসুর জীবন ছিল এক ধীরগতির প্রবাহ, যেটা কেবলমাত্র মুছে যাওয়া নাম, ধুলো জমা নথি আর পুরনো চিঠির ভাঁজেই নিজের ছন্দ খুঁজে পেত। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষক, এবং সম্প্রতি তার গবেষণার বিষয় নির্ধারিত হয়েছে—”১৯৪৬-৪৭ সালের পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের জমিদার সমাজের মনস্তত্ত্ব ও ভয়াবহতা”। তার থিসিসের জন্যই শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি পুরনো জমিদার বাড়ি—‘দত্ত কুঠি’—তাকে ডাকা দিয়েছে, যেটি ১৯৪৭ সালের পর থেকে প্রায় পরিত্যক্ত। এই কুঠিরে কেউ থাকে না, তবে পুরাতত্ত্ব দফতরের অনুমতি নিয়ে ঋদ্ধিমা এক মাসের জন্য এখানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। কুঠিরে…
-
সুমন দাস ১ শিলচরের একান্ত কোণে, যেখানে সরু গলি ছুঁয়ে উঠে যায় পাহাড়ের ঢালে এবং সেখানেই ছড়িয়ে আছে কামাক্ষ্যা মন্দিরের প্রাচীন কমপ্লেক্স—সেখানকারই এক জনমানবহীন অংশে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ পুরোনো গ্রন্থাগার, ‘তান্ত্রচক্র পাঠাগার’। লাল ইটের দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, কাঠের জানালার পাল্লা আধা খোলা, যেন কেউ সদ্যই ভিতরে ঢুকেছে—বা বেরিয়ে এসেছে। এখানে কর্মরত গ্রন্থাগারিক সায়ন্তন রক্ষিত, নিজেকে খুব সাধারণ মানুষ বলেই ভাবেন। ইতিহাসের ছাত্র হলেও জীবনের কোনো দিকেই তিনি সাহসী পদক্ষেপ নেননি। দিনগুলো কাটে ধুলো ঝাড়া, বই গোছানো, আর কামাক্ষ্যার মন্দিরে যাত্রার আগে কিছু সাধুদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কিন্তু সেইদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিক। বাতাসে এক রকম কাঁপুনি ছিল, এবং গ্রন্থাগারে ঢোকার মুখে…
-
দীপন চক্রবর্তী পর্ব ১ ঘড়ির কাঁটা রাত সোয়া বারোটায় এসে থেমে গেছে যেন। কলকাতার উত্তরের এই পুরনো পাড়াটায় এমনিই রাতের নির্জনতা নেমে আসে একটু আগে, কিন্তু আজকের রাতটা যেন আরও ভারী, যেন বাতাসেও কেউ গোপনে নিঃশ্বাস ফেলছে। রায়চৌধুরি বাড়িটা ছিল এক সময় নামকরা জমিদারদের বাসভবন, এখন তা আধভাঙা প্রাসাদ, চারপাশে বড় বড় শালিকের ডাক আর পেছনের বাঁশবনে মৃদু শব্দে ফিসফিসে বাতাস। আজ সেই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী সায়ন্তন রায়চৌধুরি ফিরেছে বিদেশ থেকে, বারো বছর পর। এয়ারপোর্ট থেকে সে সোজা এসেছিল এখানেই, চালকের হাতে চাবি দিয়ে ঢুকেছিল সেই গম্বুজওয়ালা লোহার ফটক ঠেলে। কিন্তু তার ফেরা শুধুমাত্র একটা ছুটির কারণে নয়। পৈতৃক সম্পত্তির…
-
সৌমেন লাহা পর্ব ১: স্টেশনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শিয়ালদহ স্টেশনের বিকেলের ভিড়ে হঠাৎ এক চিৎকার কানে এলো—”রুচি! রুচি কোথায় গেলি?” লোকজন থমকে দাঁড়াল, কেউ মোবাইল বের করল, কেউ ঝুঁকে তাকাল, কিন্তু কারও চোখে কিছু ধরা পড়ল না। মেয়েটির নাম কৃশা সেন। সাংবাদিক। তার ছোট বোন রুচিরা সেন, প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, হঠাৎ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৮ থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল। কিছু বলার সুযোগই দিল না। দু’জনে একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল, আর সেই ফাঁকেই রুচি যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। পুলিশ রিপোর্ট করেও কোনও লাভ হয়নি। কৃশা জানত, পুলিশের হাতে এই কেস দিলে তা জমা থাকবে ফাইলে। তাই…