সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার শহরে শেষ বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে। একটা ছেঁড়া ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখটা দেখল শুভ্র। ২০শে জুলাই। বিখ্যাত অ্যাপোলো ১১-র মিশনের দিন। এই দিনটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য। নাসা থেকে নিয়ে আসা আসল ‘মুন রক’, অর্থাৎ চাঁদের পাথর। শুভ্র হাতের ক্যামেরাটা ভালোভাবে চেপে ধরল। সাংবাদিকতার জীবনে এমন দিন খুব কম আসে। কলকাতায় চাঁদের পাথর দেখতে এত মানুষের ভিড় দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। সিকিউরিটির বিশাল ব্যবস্থা। পুলিশের উঁচু অফিসার থেকে সাধারণ দর্শনার্থী—সবাই আসছে দেখতে। “দেখে নে শুভ্র, এই পাথরের জন্য ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছিস তুই,” পেছন থেকে শুভ্রর বন্ধু অর্ণব এসে চাপা…
-
-
অমর্ত্য ভট্টাচার্য রথের দিন, রক্তের রেখা পুরীর বাতাসে আজও শঙ্খ আর কাঁসরের ধ্বনি মিশে আছে, যেমন মিশে থাকে বালি আর ঘাম। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শহরের প্রতিটি অলিগলি ঠাসা মানুষে—ভক্ত, পর্যটক, পুলিশ, পুরোহিত, বিদেশি সাংবাদিক, দালাল, দলাল—সবাই যেন এক অদৃশ্য শক্তির টানে গড়িয়ে যাচ্ছে গ্র্যান্ড রোডের দিকে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি বিশাল রথ অলরেডি দাঁড়িয়ে আছে, কাঠের চাকায় লাল-হলুদ-সবুজের প্যাঁচানো চাদরে ঢাকা। হাজারো লোক টানবে সেই রথ, আর ঠিক সেই উৎসবের মধ্যেই—মন্দির চত্বরের দক্ষিণ কোণায়, একটি কাঠের কুঠুরির সামনে, আবিষ্কৃত হল এক নিথর দেহ। মৃত, চোখ দুটো ফ্যাঁকাসে খোলা, এক হাত তুলে থাকা যেন কাউকে শেষ মুহূর্তে কিছু দেখাতে…
-
পবিত্র মুখার্জী অধ্যায় ১: কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত আর্ট গ্যালারি “চিত্রমন্দির”-এ সে বিকেলে অদ্ভুত একটা ভারী বাতাস ছিল—যেন মেঘ জমেছে, অথচ আকাশ ছিল পরিষ্কার। গ্যালারির দেয়ালে টাঙানো চিত্রশিল্পী অমিয় গুহর আঁকা ক্যানভাসগুলো নিয়ে দর্শক-সমালোচকরা চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছিল, কেউ বা ফিসফিস করে বলছিল, “অমিয় দার পরিণত ছবিতে এবার কিছু একটা অদ্ভুত আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।” অমিয় নিজে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, তার কাঁধে ঝুলছিল মাটির রঙের একটি ব্যাগ, আর চোখ চলছিল এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে—নিজেরই আঁকা ছবি যেন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন সম্পূর্ণ অন্য সত্তা ধারণ করেছে। ঠিক সেই সময় সে থমকে দাঁড়াল—দেয়ালের একদম শেষদিকে, খানিকটা…
-
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ১. মহুয়ার গন্ধে ডুবে মধ্যরাতের সোঁদা গন্ধটা যেন গায়ে লেগে আছে। মহুয়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আমি কোন শহরের বাসিন্দা ছিলাম না কোনোদিনই। লাল মাটির রাস্তা, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একটানা বাঁক, আর সেই বাঁকের ওপারে যেন অপেক্ষা করে আছে কোন অচেনা কিছু, এক রহস্য—জঙ্গলের রহস্য। আমি নেহাতই এক নগরপ্রেমী মানুষ। কলকাতার ট্র্যাফিক, অফিসের তাড়া, বইপত্র আর রাত্রির ঘুমহীনতা নিয়ে আমার জীবন। তবু বছর খানেক আগে এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ঝাড়খণ্ডের দালমা পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এক জঙ্গলসাফারিতে গেছিলাম, আর সেখানেই আমার জীবনের গল্পটা একটু বদলে যায়। সে রাতে আমরা ছিলাম “চিলমারি কটেজ” নামে এক ছিমছাম, কাঠের ঘরের মতো…
-
অভিষেক ভট্টাচার্য পর্ব ১: কোণের ঘরে এক পুরনো নথি শোভন রায়, কলকাতার এক উঠতি ইতিহাসবিদ, চাকরি করেন একটি নামী গবেষণা সংস্থায়। চৈতন্যদেবের জীবনের ওপর একটি নতুন ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে তাকে পাঠানো হয় পুরী। উদ্দেশ্য—চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের শেষ দিনগুলির ওপর তথ্য সংগ্রহ এবং তার মৃত্যু সম্পর্কে প্রামাণ্য প্রমাণ খোঁজা। যদিও ইতিহাস বলে, ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে একরাত্রে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে কীর্তন করার সময় হঠাৎই অন্তর্ধান হয়ে যান তিনি—কেউ বলেন তিনি সমাধিস্থ হন, কেউ বলেন তিনি গিয়েছিলেন সমুদ্রপথে। কোনো স্পষ্ট সমাধান নেই। শোভনের আগ্রহ ইতিহাসের চেয়েও বেশি কৌতূহলের। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিটি অন্তর্ধান কিংবা মৃত্যু রহস্যের অন্তরালে থাকে বাস্তব। আর বাস্তব যত গোপন থাকে,…
-
প্রিয়াঙ্কা শীল পর্ব ১: লাল আলোয় ধরা দোতলার ছাদে বসে থাকা বাড়িটায় একসময় মানুষের কোলাহল ছিল, এখন পাখির ডাক ছাড়া কিছু শোনা যায় না। অনুষ্কা জানে এই বাড়িটার প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানালার শব্দ—কারণ এখানে তার শৈশব কেটেছে। কিন্তু এবার ফিরে এসেছে অন্য কারণে—দাদু মারা গেছেন। আর দাদুর রেখে যাওয়া সব জিনিস গুছিয়ে দেওয়া এখন তার দায়িত্ব। দাদুর ঘরটা যেন সময়ের মধ্যে আটকে আছে। ছিটেফোঁটা ধুলো, পুরনো কাঠের ঘ্রাণ, একটা ঘড়ি যা এখনও টিক টিক করে। জানলার পাশে রাখা কাঠের আলমারিতে পুরনো বই, ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো ছবি আর মাঝখানে একটা বড় কাঠের বাক্স। বাক্সটা খুলতেই কেমন একটা ঘর অন্ধকার হয়ে এলো।…
-
মনোরঞ্জন পাল ১ চন্দননগরের সেই বিকেলটা ছিল একেবারে অন্য রকম। গরম আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ভরা বাতাবরণে অরিজিৎ সেনগুপ্তের শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল প্রাসাদের ভেতরের অজানা ইতিহাসে। ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় চড়ে আসা পথটুকুতে সে শহরের ফরাসি স্থাপত্যের ছাপ লক্ষ্য করছিল—ভাঙা কলাম, জং ধরা ল্যাম্পপোস্ট, আর গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অতিকায় প্রাসাদ, যা যেন কালের ভারে নুয়ে পড়েছে। বাড়িটার বিশাল লোহার ফটক খুলে যাওয়ার শব্দ শুনে তার হৃদয়ে কেমন যেন অজানা শিহরণ জাগল। সে ভাবল, এমন একটা জায়গা, যেখানে ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সেখানে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য, কোনো…
-
শুভাশীষ দে পর্ব ১: ফেলে দেওয়া খাবারের গন্ধ অফিসটার নাম ‘অ্যামব্রেলা ফাইন্যান্স’। কলকাতার সাউথ সিটি টাওয়ারের ছ’তলায় তার সদর দফতর। গ্লাসের পার্টিশন ঘেরা, এসিতে জমাট ঠান্ডা, আর সারি সারি ডেস্কে বসে থাকা লোকজন, যাদের মুখে সারাদিন জুড়ে একটা অভিমান জমে থাকে। তাদের মাঝে নীরবে ঘুরে বেড়ায় শিবু—অফিসবয়। বয়স বাইশ, গড়ন ছোটখাটো। লোকে প্রায় চোখেই পড়ে না ওকে। সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা—এই তার অফিস টাইম। এই সময়ে তাকে করতে হয়, কফি-পানি পৌঁছে দেওয়া, ফাইল এগিয়ে দেওয়া, হোয়াইটবোর্ড মোছা, আর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব—টিফিন সামলানো। শিবুর একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে, যেটা কেউ ঠিক বোঝে না। সে নিজের জন্য কোনোদিন আলাদা করে খাবার…
-
সমীরণ রায় পর্ব ১: বনগন্ধ ঝড়ের রাতে বনের গন্ধটা বড় অন্যরকম। সেই গন্ধে ভিজে থাকে মাটি ভিজিয়ে ফেলা অতীত, শালপাতার দোলা, হরিণের নিঃশ্বাস, আর কোথাও লুকিয়ে থাকা এক কালের শিকারের হাহাকার। দক্ষিণ বিহারের পাহাড়ি ঢালে ঢেকে থাকা অরণ্যটার নাম কেউ ঠিকমতো জানে না, শুধু বলে—‘বনদেউলের জঙ্গল’। দিনের আলোও এখানে ঠিকঠাক ঢোকে না। সে আলো যেন গাছের ডাল, পাতার খাঁজে হারিয়ে যেতে চায়, আর পাতাঝরা মাটিতে কুয়াশার মতো লেগে থাকে। আমি, শম্ভু রায়, পেশায় বন্যপ্রাণ গবেষক, জীবনের অনেক সময়ই কাটিয়েছি জঙ্গলে। তবে এই সফরটা ছিল আলাদা। কারণ এই যাত্রায় শুধু প্রাণীর সন্ধান ছিল না, ছিল এক অমীমাংসিত পুরনো ঘটনার উত্তর খোঁজার…
-
স্বপ্না বসাক অধ্যায় ১: রুদ্রনাথের ছায়া কলকাতার প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগে এক টানা ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত অধ্যাপক অরিন্দম মুখার্জি সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পেলেন এক অদ্ভুত মোড়া খাম—কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু ছাপা হরফে লেখা “রুদ্রনাথ জীবিত!” খামের ভেতরে ছিল একটি ভাঁজ করা কাগজ, তাতে একটি সুস্পষ্ট নকশা—উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের এক রাজবাড়ির তলায় সুড়ঙ্গের মানচিত্র। কৌতূহলে আঁচ করলেন, এটি সেই কিংবদন্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তিনি ছাত্রজীবন থেকে শুনে এসেছেন—একটি দেবমূর্তি, যার নাম “রুদ্রনাথ”, যা সেন রাজবংশের আমলে তৈরি এবং বলা হয়, এটি যার হাতে থাকবে, তার জীবন থেকে চিরতরে দারিদ্র্য সরে যাবে। যদিও তিনি একে লোককথা বলে এড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এই…