শ্রেয়সী ঘোষাল ১ তপনজ্যোতি মুখার্জি ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আগরতলা রেলস্টেশনের ঠিক বাইরে। ভোরবেলা ট্রেন এসে পৌঁছেছে, কিন্তু ত্রিপুরার পাহাড়ি বাতাসে যেন এক অজানা কিছুর গন্ধ ছিল—অদ্ভুত, রহস্যময়, আর আকর্ষণীয়। সামনে এসে দাঁড়ালেন মৃণালিনী ধর, তার একহাতে একটি নোটবুক, আর অন্যহাতে একটি পুরনো মানচিত্র। এই মানচিত্রেই চিহ্নিত করা ছিল মানিকছড়ি—একটা প্রায় হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ি গ্রামের নাম, যেটা আজকের কোনও আধুনিক ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যায় না। তপনজ্যোতি, একজন ডকুমেন্টারি নির্মাতা, পুরনো লোককথা নিয়ে কাজ করেন। কিছুদিন আগে একটি ট্রাইবাল মিউজিয়ামে পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়ে এই ‘সময়-বিচ্ছিন্ন’ গ্রামের খোঁজ পান। তখনই ঠিক করেন, তিনি সেখানে যাবেন—যা খুঁজে পাওয়ার নয়, তাকেই…
-
-
অভিষেক দাশগুপ্ত ১: মেটিয়াবুরুজের গলিগুলো ভোরবেলা সবচেয়ে বেশি কথা বলে—হলুদ আলোয় ভিজে থাকা চায়ের দোকান, ঠেলাগাড়িতে করে পাঁউরুটি বয়ে নিয়ে চলা কিশোর, আর কুকুরের দল ঘুম থেকে উঠে একে অপরকে চেনার জন্য ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয়। সৌভিক ঘোষ, শহরের এক ক্ষুদ্র কুরিয়ার কর্মী, প্রতিদিন এই জীবনের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে ফেরে। মাথায় হেলমেট, পিঠে বড় ডেলিভারি ব্যাগ, আর মুখে একরকম নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে, সে বাইকে চড়ে চুপচাপ চলে যায় অজানা ঠিকানার খোঁজে। সেদিন সকালটাও তেমনই ছিল—সৌভিক মেটিয়াবুরুজের কুরিয়ার হাব থেকে ডেলিভারির জন্য তিনটি পার্সেল হাতে পায়। দুইটা ছিল সাধারণ—একটা ফুড প্রসেসরের বাক্স, আরেকটা একটা নতুন মোবাইল ফোন। কিন্তু তৃতীয় প্যাকেটটা…
-
অমিতাভ বসু পর্ব ১: জলের ওপারে শব্দ ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাস। আন্দামানের বাতাসে তখনও রৌদ্রের ছায়া। দূর থেকে দেখা যায় সেলুলার জেলের লোহা-দেওয়া গঠন, যেটা যেন কোনো বিশাল মাছের কঙ্কালের মতো পড়ে আছে দ্বীপের বুক চিরে। লম্বা বারান্দা, ভয়ানক নির্জনতা, আর তিনতলার ফাঁসির মঞ্চ—সব মিলিয়ে এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের এক ঠান্ডা নরক। এই সেলুলার জেলেই এসে পৌঁছেছিল এক কবি—নাম হেমচন্দ্র সেন। কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে সাহিত্য পড়াতেন, বিপ্লবী ভাবনার জন্যে যুবকদের মধ্যে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তবে তাঁর বিপ্লবের অস্ত্র ছিল আগুন নয়—কবিতা। তাঁর লেখা ‘রক্তঝরা বসন্ত’ কবিতা ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তিনি তাতে এক বদ্ধঘরের ছাদ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে…
-
শঙ্খনীল মুখোপাধ্যায় (১) নাইট মোড অন করা ল্যাপটপের স্ক্রিনজুড়ে লাইভ স্ট্রিমিং চলছিল। ইউটিউবের সেই ঝলমলে লাল বক্সে লেখা – LIVE – 2 Hours 13 Minutes। তাতে দেখা যাচ্ছে একটি অন্ধকার রুম, মাঝখানে রাখা একটা কাঠের চেয়ার, জানালার পাশে একজোড়া পর্দা হালকা দুলছে, যেন কোথাও একটা হাওয়া ঢুকছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই রুমে কেউ নেই—তবু ভিডিও চলছে। আর অদ্ভুতভাবে, প্রতি কিছুক্ষণ পর পর ভিডিওতে শব্দ শোনা যায়—ক্লিক ক্লিক… ফিসফাস… অথবা দূরে কোথাও ঘড়ির টিক টিক। ইরা বসু, বিখ্যাত ব্লগার, ট্র্যাভেল-ভ্লগার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, মাত্র রাত দশটায় এই রুমেই ছিলেন, হাজার হাজার দর্শকের সামনে লাইভে। সে গল্প করছিল তার নতুন ভিডিও নিয়ে—একটি পুরনো,…
-
নির্মাল্য বসু এক হেমন্তের সকালে কলকাতার আকাশ ছিল ধোঁয়াটে, যেন স্মৃতি জমা ধুলোয় ধরা পড়ে আছে। ড. অনিরুদ্ধ বসু তার বাগুইআটির ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সিগারেট ধরালেন, সামনে একটা পুরনো কাঠের টেবিলে ছড়ানো ইতিহাসের বইপত্র আর হিন্দু-মিথলজির লিপিবদ্ধ নথি। গত কয়েক বছর ধরে তিনি সক্রিয় গবেষণা থেকে দূরে ছিলেন, কিন্তু পুরনো অভ্যাসটা এখনও যায়নি—প্রতিদিন ভোরবেলা ধোঁয়ায় মিশে যাওয়া শহরটাকে দেখতে দেখতে কল্পনায় ফিরে যেতেন হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার দিকে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কেয়ারটেকার কমল একটা বাদামি খাম এগিয়ে দিল—অদ্ভুত ধরনের মোটা কাগজে মোড়া, প্রেরকের নাম নেই, শুধু লেখা: “ড. অনিরুদ্ধ বসু, পুরাতত্ত্ব গবেষক, কলকাতা।” খাম খুলে অনিরুদ্ধ প্রথমে দেখলেন একটা…
-
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: প্রথম বার্তা সৌম্য মুখার্জী প্রথম দিন স্কুলে ঢুকেই বুঝেছিল, এই স্কুলটা একটু অন্যরকম। শান্তিনিকেতনের সীমানা ছুঁয়ে থাকা এই পুরনো হাইস্কুলটির নাম ‘চৈতন্য বিদ্যামন্দির’, তবে গেটের ওপরে নামটা আধফাটা, আর নিচে একটা ছেঁড়া ব্যানারে আজও ঝুলছে গত বছরের নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্কুলের বিল্ডিংটা অনেক পুরোনো, লাল ইটের দেয়াল আর কড়ি-পাতার ছাদ। অথচ, ভেতরের পরিবেশে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। যেন কেউ কথা বলতে ভয় পায়। যেন স্কুলটা চুপচাপ নিঃশব্দে কোন কিছু লুকিয়ে রাখছে। সৌম্য বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে, ইংরেজি পড়ায়। নিজের মধ্যেই গম্ভীর স্বভাব, কিন্তু আজ সকাল থেকেই বুকের ভেতর টানটান অস্বস্তি। প্রিন্সিপাল রুমে বসে থাকা মাঝবয়সী…
-
আরিত্র সান্যাল ১ মুর্শিদাবাদ। ইতিহাস আর নদীর গন্ধে ভেজা এক প্রাচীন শহর। যেখানে প্রতিটি দেওয়াল ফিসফিস করে বলে ফেলে অতীতের গোপন কথা। সেই শহরে নতুন ডিসি হয়ে এসেছেন ঈশান চট্টোপাধ্যায়—ত্রিশের কোঠায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক, এরপর আইএএস। কিছুটা আদর্শবাদী, কিছুটা কৌতূহলী। আর তার এই কৌতূহলই একদিন তাকে দাঁড় করিয়ে দেবে ইতিহাসের এক অন্ধকার গলির সামনে, যেখান থেকে ফেরা আর কখনো ঠিকভাবে সম্ভব নয়। গাড়ি যখন লালবাগ ডিসি বাংলোর সামনে থামে, তখন ভরা বর্ষা। আকাশ মেঘলা, রাস্তায় পিচ্ছিল কাদা। ব্যাগ হাতে নামতে গিয়ে ঈশানের চোখ পড়ে বাংলোর ঠিক ডানদিকে, মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বিশাল ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদে। গায়ে লালচে…
-
শঙ্খ সেন ১ কলকাতার গরমটা যেন এ বছর আগের থেকেও একটু বেশি বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। স্টেট আর্কাইভস বিল্ডিং-এর ভেতরে যদিও পাখার শব্দ আর পুরনো কাগজের গন্ধ ছাড়া কিছু নেই, তবুও ঘাম চুঁইয়ে পড়ে অনির্বাণ মিত্রর কপাল দিয়ে। সে কাজ করে ৩ নম্বর সেকশনে — যেখানে ফাইল নম্বর, শ্রেণি, মাইক্রোফিল্মের ক্যাটালগ এইসব ঘেঁটে দিনের পর দিন কাটে। অনির্বাণ একজন আর্কাইভ অ্যাসিস্ট্যান্ট, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, চোখে চশমা, গলায় ঝুলে থাকা একটা আইডি কার্ড আর স্যাঁতসেঁতে ফাইল ঘাঁটার অভ্যেস। সেদিনও ছিল একটা ক্লাসিক বুধবার। দুপুর নাগাদ অনির্বাণকে ডাকা হয় ৫ নম্বর ভল্টে, যেখানে এক কলেজের অধ্যাপক এসেছেন ১৯৭৬ সালের এক বিশেষ ফাইল খুঁজতে।…
-
শুভ্রজিৎ দত্ত অধ্যায় ১: চরকালী গ্রামটি একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন পড়েনি। চারপাশে শুধু সবুজ ক্ষেত-খামার, নদী এবং পুরনো বাড়ি-ঘর। তবে গ্রামের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান ছিল তার পুকুরটি। পুকুরটির পানি এমন স্বচ্ছ ছিল, যা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করত, কিন্তু তার নিচে এক অদৃশ্য বিপদ lurked করত। স্থানীয়দের মধ্যে একটি গুজব প্রচলিত ছিল যে, পুকুরের পানিতে একটি দানবের আত্মা বাস করে। শোনা যায়, রাতের অন্ধকারে পুকুরের কাছে গেলেই শুনতে পাওয়া যায় এক অদ্ভুত হাসির গুঞ্জন, যেন কেউ বা কিছু জঙ্গলে হেসে চলেছে। কোনো এক সময়, কিছু মানুষ পুকুরের কাছে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, আর কখনো ফিরে আসেনি। গ্রামের…
-
দীপায়ন গুহ ১ সুন্দরবনের ঘন সবুজের বুক চিরে চলে যাওয়া সরু জলপথে সকালবেলায় ধোঁয়াশা ছেয়ে ছিল। কেওড়া, গরান আর সুন্দরী গাছের পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আলো ফোটার চেষ্টা করলেও ঘন কুয়াশার কুন্ডলীতে হারিয়ে যাচ্ছিল সমস্ত দৃশ্য। বন বিভাগের টহল নৌকোটি ঘোলা জলে এগিয়ে চলছিলো—চালকের মুখে গভীর উদ্বেগ। সামনে বসে থাকা বিট অফিসার রবিউল শেখ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল জলের পাশে সদ্য দেখা দেওয়া কয়েকটি বাঘের পায়ের ছাপের দিকে। এই চতুর্থ বার, গত এক মাসে, এই অঞ্চলেই মৃতদেহ মিলেছে বন দফতরের আধিকারিকের, আর এই বার… সেই মৃতদেহটি ছিল তাঁরই বহু বছরের পরিচিত, ডিএফও প্রফুল্ল ঘোষ। গাছে গাছে কাকের চিৎকার, হঠাৎ…