সায়ন্তনী দে চিঠির তারিখ ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, হাতের লেখা যেন পুরনো স্কুলের বাংলা খাতা থেকে উঠে এসেছে—নির্ভুল, অথচ কেমন যেন কাঁপা কাঁপা। অনুরাধা চিঠিটা পড়ছিলো তৃতীয়বার, চশমার কাঁচে হালকা ঘাম জমে উঠেছে। “তারিখ— ১২ই জুন, ২০২৫। স্থান— দক্ষিণ কলকাতা, যাদবপুরের গলির মাথায়। সময়— রাত ১:১৫। একটি সাদা স্কুটিতে চড়ে যে যুবক ফিরছে, সে জানে না, আজই তার শেষ রাত। ঠিক তার বাড়ির পাঁচ নম্বর ল্যাম্পপোস্টের কাছে তাকে ছুরি মারা হবে।” ডা. অনুরাধা ঘোষ চিঠিটা নামিয়ে রাখলেন। ইরা সেন তখন তাঁর চেম্বারের কাঠের চেয়ারে বসে আছে, কাঁধ পর্যন্ত খোলা সাদা কুর্তির গায়ে আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। মেয়েটির মুখে ভয় নেই,…
-
-
প্রিয়ম সরকার কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের নামকরা এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল—সাউথ সিটি মডার্ন হাই—সেই শুক্রবার দুপুরে যেন কিছুক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় পিরিয়ডের গণিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর হঠাৎই হইচই শুরু হয়, যখন ছাত্রী রুদ্রানী ঘোষের দেহ পাওয়া যায় পুরনো লাইব্রেরির সিঁড়ির পাশে পড়ে থাকতে। তার চোখদুটি খোলা, ঠোঁট রক্তাক্ত, আর পাশে ছড়িয়ে আছে তার জ্যামিতি বক্স—যেন কোনও শেষ মুহূর্তের আঁচড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সব। হেডমাস্টার বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন—“আত্মহত্যা, ক্লাসের চাপ নিতে পারেনি,” এবং পুলিশকে ফোন করলেও মৃদু স্বরে অনুরোধ করেন বিষয়টি মিডিয়াতে না পৌঁছাতে। ছাত্রছাত্রীরা কাঁদছে, শিক্ষিকারা অস্বস্তিতে—কিন্তু একজন শিক্ষক, অভিজিৎ সেন, ওই সময় কিছু না বলেই ধীরে ধীরে…
-
ঋজু ভট্টাচার্য ১ কলকাতার আকাশটা সকাল থেকেই মেঘলা ছিল। শহরের কনস্ট্যান্ট কোলাহলের মাঝেও যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল কোর্ট স্ট্রিটের চত্বর জুড়ে। আইনজীবীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, কিছুটা উদ্বেগও, কারণ শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ এক্সপার্ট বরণ ঘোষাল আজও কোর্টে আসেননি। এই নিয়ে সাত দিন হয়ে গেল তিনি নিখোঁজ। প্রথম দু’দিন ভেবেছিল সবাই হয়তো কোনো প্রফেশনাল ট্রিপে গেছেন, তৃতীয় দিনে একাধিক কেসের শুনানি বাতিল হওয়ায় শুরু হয়েছিল গুঞ্জন, এবং সপ্তম দিনে এসে পুরো শহরটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। মিডিয়া জ্বলজ্বল করছে ‘সেলিব্রিটি লইয়ার নিখোঁজ’ শিরোনামে। পুলিশ অফিশিয়ালি এখনও “মিসিং পারসন” কেস ফাইল করলেও, তদন্তে নামানো হয়েছে দুই কনস্টেবল, একটি গোয়েন্দা…
-
সুদীপ্ত ঘোষাল ১ রবিবার সকালে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের শেষ প্রান্তে ঘোষ ভিলার ছাদে সূর্যের আলোর ঝলকানি তখনও পুরোপুরি পড়েনি। শীতকালীন সকালের ধোঁয়াটে আলোয় ভরে উঠছিল গৃহপ্রাঙ্গণ, বাতাসে ভাসছিল মোরগের ডাক ও কাজের লোকেদের হাঁকডাক। ঘরের মধ্যে তখন সকালের চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখছিল রাঁধুনি বিনোদিনী, যার হাতে কাঁপুনি ছিল অজানা এক উত্তেজনায়। রূপমবাবু বলেছিলেন আজ একটু আগেই চা দিতে, কারণ তাঁকে ব্যবসার কাজে বেরোতে হবে। সুমিত্রাদেবী নিজের প্রার্থনার ঘরে বসে ছিলেন চোখ বন্ধ করে, ঠাকুরঘরে ধূপের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। তীর্থবাবু বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন, পাশেই কটাহারের চা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাজের ছেলে মাধব। তবে বাড়ির বড় কর্তা বিজয়চন্দ্র ঘোষ…
-
প্রতুল মন্ডল ১ নভেম্বরের হিমেল সকাল। শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা দার্জিলিং মেল ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোলে ঢুকছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ঋত্বিক চৌধুরীর চোখে ছিল গভীর এক কৌতূহল—একটা অদ্ভুত টান। অভিষেক তার সঙ্গী, যার চোখে-মুখে রোমাঞ্চের ঝলক থাকলেও সে ছিল মূলত ছুটি কাটাতে এসেছে, হিমালয়ের শান্তি আর কিছু ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য ছবি তুলতে। ওরা দুজনেই কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু প্রকৃতির কাছে যেতে, কিন্তু ঋত্বিক জানে, এই ভ্রমণ শুধু অবকাশ নয়। গত ছ’মাসে তার হাতে কোনও ‘কেস’ আসেনি, অথচ এই পাহাড়ি গ্রাম ‘চান্দাক’-এর আশেপাশে কয়েকজন পর্যটক হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার খবর এক অখ্যাত অনলাইন ব্লগে পড়ে সে স্থির করে,…
-
ইন্দ্রনীল লাহা ১ কলকাতার জানুয়ারি শীতভরা সকালে এসপ্ল্যানেড বাসস্ট্যান্ডটা যেন একটু বেশিই কোলাহলময় লাগছিল। চারপাশে ঠান্ডা কুয়াশা, পুণ্যার্থীদের গমগম আওয়াজ, ঠাকুরের প্রসাদের গন্ধ, আর চায়ের দোকানে জমে ওঠা ভিড়—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উৎসবের আমেজ। অনির্বাণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বাকিদের সঙ্গে, গলায় ম্যারুন রঙের একটা মাফলার পেঁচানো, চোখে একটা নিরুত্তাপ ছায়া। তার পাশে ঈশান ফোনে ব্যস্ত—বাসের টাইমিং, হোটেলের কনফার্মেশন মেল, সব কিছু একে একে দেখে নিচ্ছে। তৃণা বসে ছিল ওদের ব্যাগের পাহাড়ের পাশে, ঠান্ডায় হাত ঘষছে, আর বিক্রম তার নতুন DSLR ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ক্লিক করে চলেছে—কখনও ফুটপাথের বাউল, কখনও বাসের ছাদের ওপরে বাঁধা বস্তা। “এই মেলা কিন্তু মিথ্যা…
-
ঋতব্রত সেন [১] জুলাইয়ের এক মেঘলা দুপুরে মিহির তার ঠাকুরদার পুরনো কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখান থেকে ধুলোমাখা বই আর ভাঙা পুতুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। ঠাকুরদা, বিশ্বেশ্বর পাল, এককালে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন—তার চোখে এখনও সেই অতীতের আলো জ্বলে। মিহির ছুটির দিনে তার কাছ থেকে নানা কাহিনি শুনতে ভালোবাসত, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরের পুতুলশিল্প ও রাজাদের গোপন ইতিহাস। সেই দিন, যখন বৃষ্টি বাইরের দিগন্ত ঘিরে রেখেছিল, ঠাকুরদা হঠাৎ এক গল্প শুরু করলেন—একটা পরিত্যক্ত বাড়ির, যেটি সবাই ‘পুতুলবাড়ি’ বলে চিনত। সেই বাড়ি নাকি এক কালে ছিল রামানন্দ পাল নামের এক পুতুলশিল্পীর, যিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দরবারে কাজ করতেন। কথিত আছে, রাজপরিবারের গুপ্তধন…
-
চিরন্তন ঘোষাল অধ্যায় ১: বীণারম্ভার শেষ স্বর সকালটা ছিল অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ, যেন আকাশও গানের কোনো কষ্টসুর বয়ে আনছে। সংগীত বিদ্যালয় ‘শ্রুতি নিকেতন’-এর লালটিপ দেওয়া পুরনো দোতলা ভবনটিকে ঘিরে ভোরের আলো একটু একটু করে পড়ছিল, কিন্তু আজ যেন কিছু একটা ঠিক নেই—হোস্টেল রান্নাঘরের ধোঁয়া উঠছে না, পাখিরা চুপচাপ বসে আছে তুলসিতলায়, আর সবচেয়ে অদ্ভুত, মন্দির ঘর থেকে কোনো রাগ বাজছে না। সকাল সাতটা নাগাদ, ছাত্রীরা একে একে উঠতে শুরু করে। বীণারম্ভা আজও উঠেনি—তাতে কেউ প্রথমে অবাক হয়নি, কারণ সে মাঝেমাঝে গভীর রাত পর্যন্ত রেওয়াজ করত। তবে যখন তিষাণী দরজা ধাক্কায়, কোনো সাড়া না পেয়ে জানালার কাচে উঁকি দেয়, তখন সে চেঁচিয়ে…
-
রজত চক্রবর্তী ১ কলকাতার উত্তর প্রান্তের একটি পুরনো অলিগলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর চশমার কাচে কুয়াশার মতো জমে ছিল ধুলো, আর জামার পকেটে গুঁজে রাখা ছিল কয়েকটি পুরনো বই—তার মধ্যে একটিতে পাতার মাঝখানে শুকিয়ে যাওয়া পাতাবাহার ফুল। বছর পঞ্চান্নর ঋণুতোষ এখন সিটি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, যিনি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং এখনও প্রতিটি শব্দকে প্রাণের মতো ভালোবাসেন। স্ত্রী শ্রেয়শীর মৃত্যু তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। একটা সময় ছিল, যখন তারা মিলে কবিতার বই পড়তেন, সন্ধ্যাবেলায় কোলাহলময় শহরের মাঝখানে এক কাপ লেবু চা নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকতেন, আর এখন? এখন তার একমাত্র সঙ্গী—এক ভাঙা রেডিও আর ধুলো…
-
ঐন্দ্রিলা চক্রবর্তী কলকাতার সাউথ সিটি কলেজে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ। ঐশী চৌধুরী ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল, তখন বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। দক্ষিণ কলকাতার এক কোণায় অবস্থিত ‘সুবর্ণ পল্লী আবাসন’ – চারতলা একটি পুরনো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, বাইরের রঙ প্রায় উঠে গেছে, জানালার লোহার রেলিংয়ে জং ধরেছে আর ছাদের ড্রেনপাইপ থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে টুপটাপ। ঐশী নিজের নতুন ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল—দরজার কপাটটা একটা ধাতব আর্তনাদের মতো শব্দ তুলে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাকে অভ্যর্থনা জানাল, তবে সে এমন গন্ধে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই সে পুরনো জিনিসে টান…