সুকান্ত ঘোষ ১ সমুদ্র তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। কেউ বোঝে না ঠিক কী বলছে, কিন্তু তার ঢেউয়ের ছন্দে, গর্জনের ধ্বনিতে, নোনাজলের গন্ধে একটা পুরনো চেনা আবেশ থাকে। নয়না সেই ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে না পারলেও অনুভব করে। এই কারণেই সে এখানে এসেছে—নীলতারা কটেজ। দীঘা থেকে একটু দূরে, জনমানবহীন এক নির্জন সৈকতের পাশে ছোট্ট কাঠের কটেজ, যেন সময়ের বাইরে পড়ে থাকা এক টুকরো ফ্রেম। শহরের হাহাকার থেকে মুক্তি পেতে নয়নার বুকের মধ্যে অনেকদিন ধরেই একটা হাহাকার জমে উঠেছিল। মাথার ভেতর অবিরত শব্দ—কাজের ডেডলাইন, ফোনের রিং, ফ্ল্যাটমেটদের কলরব। মনে হচ্ছিল, নিজের ভেতরের জায়গাটায় ফিরে যেতে হলে সমুদ্রই একমাত্র উত্তর। ট্যাক্সি…
-
-
রুপালী সেনগুপ্ত অধ্যায় ১ শহরের বাতাসে তখন বৃষ্টির গন্ধ। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। স্কুল মাত্র শুরু হয়েছে গ্রীষ্মের ছুটি শেষে। বৃষ্টি হলেও ক্লাস চলছে, শুধু জানালার বাইরের দৃশ্য যেন অনেক বেশি সুন্দর আজ। সবুজ মাঠ, ভেজা মাটি, আর ছাতা হাতে ছুটে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা। অয়ন বসেছিল ক্লাস এইট–’সি’ সেকশনের জানালার ধারে, তার প্রিয় জায়গা। জানালা দিয়ে বাইরের মাঠটা ভালোভাবে দেখা যায়। শুধু মাঠ নয় — ওই পাশের করিডোরটা, যেখানে অন্বেষা প্রায় প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে। অন্বেষা, ক্লাস টেন–’এ’–র ছাত্রী। মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল অয়ন নতুন ক্লাসে উঠেই। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে ওর মধ্যে এক আলাদা শান্ত সৌন্দর্য ছিল। সাদা ইউনিফর্ম, পরিপাটি চুলে সাদা…
-
নন্দিনী গঙ্গোপাধ্যায় অধ্যায় ১ অনিক তার জীবনের অচেতন চলাচলে প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। দিনে দিনে সেই একঘেয়ে দিনগুলো যেন তার বাঁচার উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছিল। কলেজের ক্লাসগুলোতে তার আগ্রহ ছিল না, জীবনের প্রতি আর কোনো আকর্ষণ বোধ করছিল না। সকালে উঠে কলেজে যাওয়া, ক্লাসে বসে থাকা, কিছু না বলেই আবার ফিরে আসা—এভাবেই কেটে যাচ্ছিল তার প্রতিটি দিন। ছেলেটি স্বভাবতই চুপচাপ ছিল, কিন্তু এখন তা বেশি প্রকট হচ্ছিল। তার বন্ধুরা বলত, “অনিক, তুমি খুব বদলে গেছো, কিছু বলো না, হাসছো না, তোকে কী হচ্ছে?” কিন্তু সে এসবের কোনো উত্তর দিতে পারত না। জীবনের প্রতি এক ধরনের অজ্ঞতা, অযত্ন এবং অসন্তোষ জমে উঠেছিল…
-
অন্তরা দাস ক সকালের আলো যখন ধীরে ধীরে পুরনো বাড়ির জানালার ফাঁক গলে ঢুকছিল, তখন সায়ন মুখার্জি তার কাঁপা হাতে তুলির মাথায় জল দিচ্ছিলেন। ছত্রিশ বছর ধরে তিনি এই বাড়িতে আছেন, বালিগঞ্জের এক পুরনো, রাজবাড়ির মতো দেখতে প্রাসাদোপম ভবনের চিলেকোঠায়। একসময় কলকাতার শিল্পজগতে যে নাম ছিল আলাদা উচ্চতায়, আজ সেই সায়নের নামটা কেবল পুরনো গ্যালারির আর্কাইভে রয়ে গেছে। রুমটা যেন সময়ের মধ্যে জমে আছে। এক কোণে পুরনো ক্যাম্পাসের পোস্টার—‘অরণ্যের দিনরাত্রি’—বাম দিকে একটা কাঠের আলমারির ওপর অর্ধেক ক্যানভাস, যার ওপর অসমাপ্ত একটি মুখ, হালকা হাসি, চোখে অজানা আকাশের প্রতিচ্ছবি। তার স্ত্রী ছিল না কখনোই। সন্তান নেই। বন্ধুরা যে যার মতো ব্যস্ত…
-
নন্দিনী বন্দোপাধ্যায় ১ বৃষ্টি পড়ছে। শ্রেয়ার স্কুলের জানালার কাচে জল জমে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে। মনে হচ্ছে যেন সে নিজেই গলে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে। ক্লাসঘরের মেঝেতে বাচ্চাদের চিৎকার-হাসির শব্দ, টিফিনের গন্ধ, চকধুলোর গন্ধ—সবকিছু মিলেমিশে এক অলৌকিক ঘোর তৈরি করেছে। তবে আজকের সকালটা ছিল একটু অন্যরকম। “নতুন শিক্ষক এসেছেন, ইংরেজি পড়াবেন। অর্ণব চক্রবর্তী। খুব মেধাবী ছেলেটি, দিল্লি থেকে এসেছে,” হেডমিসট্রেস বলেছিলেন সবার সামনে। অর্ণব প্রথম যেদিন শ্রেয়াকে দেখেছিল, তার সালোয়ার কামিজের গায়ে জলছাপ লেগে ছিল, আর ভেজা চুল খোঁপায় আটকানো। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, হঠাৎ চোখাচোখি। তখনই একটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা ঢুকে পড়ে অর্ণবের শরীরে। শ্রেয়া তখনও জানতেন না,…