সোনালী গুপ্ত অধ্যায় ১ – নিখুঁত প্রারম্ভ রচনার জীবন শুরু হয়েছিল এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তির আভায়, যা অনেক দিন ধরে সে অনুভব করছিল। সকালগুলো নরম আলোয় ভরে ওঠা রঙিন কফির গন্ধ এবং অরুণের সঙ্গে হালকা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে শুরু হতো। শহরের মাঝারি আয়ের একটি বস্তিতে বসবাস করলেও তাঁদের জীবনযাত্রা সবসময়ই সরলতার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেত। রচনা এবং অরুণের সম্পর্ক দেখলে মনে হতো, তাঁদের সুখী দাম্পত্য জীবন যেন এক নিখুঁত ছায়া যা কখনও ফাটে না। রান্নাঘরে অরুণের হাসি, রচনার চোখে তার মৃদু দৃষ্টি, ছোট্ট বিকেলের খোলা জানালার বাইরে পাখির ডাক—সবকিছুই যেন এক নিরবসঙ্গীতের মতো। তবে, রচনার মন কিছুটা অশান্ত থাকত এমন সময়গুলোতে।…
-
-
শ্রেয়া বসু গ্রামের ভেতরটা এখনও যেন এক পুরোনো ছবির মতো আটকে আছে—মাটির রাস্তা, গাছপালার ছায়া, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী জমিদারবাড়ি। বাড়িটার সামনে বিশাল দোতলা বারান্দা, অথচ তার উঠোনে কারও পদচিহ্ন নেই। বছরের পর বছর ধরে শুনে আসা কড়া নিয়ম—“মেয়েরা এই উঠোনে পা রাখবে না।” যেন মেয়েদের উপস্থিতি ওই পুরুষতান্ত্রিক প্রতীকের গাম্ভীর্য ভেঙে দেবে। শিউলি, গ্রামের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, ছোট থেকেই শুনে এসেছে সেই নিষেধাজ্ঞার কথা। ছোটবেলায় ঠাকুমা গল্প শোনাতেন—একসময় নাকি জমিদারবাড়ির উঠোনে উৎসব হতো, নাটক হতো, পুজো হতো। কিন্তু সবই পুরুষদের দখলে। নারীরা থাকতো রান্নাঘরে বা অন্দরমহলে, দূর থেকে গোপনে তাকিয়ে দেখতো আনন্দ। সন্ধ্যার পর একদিন শিউলি হাঁটতে হাঁটতে…
-
সোমা সেন শহরের ভিড়ভাট্টা আর হট্টগোলের মধ্যে অনন্যার জীবন যেন এক অন্য ছন্দে বাঁধা। সকালবেলায় তার দিন শুরু হয় একেবারে মেশিনের মতো—অ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভাঙা, দ্রুত শাওয়ার নেওয়া, নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা শার্ট আর স্কার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়ানো। সেই আয়নায় প্রতিদিনই ফুটে ওঠে এক সফল নারীর প্রতিচ্ছবি—চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিকের টান, আর কাঁধে দামী চামড়ার ব্যাগ। দামী গাড়ির দরজা খুলে যখন সে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় নামে, তখন মানুষ তাকে দেখেই ভাবে—এই তো আধুনিক নারীর প্রতীক, সাফল্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদে তার কাজ, মাস শেষে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া মোটা বেতন, আরামদায়ক ফ্ল্যাট—সব মিলিয়ে অনেকের কাছে ঈর্ষার বস্তু।…
-
অদিতি পাল অধ্যায় ১ : স্বপ্নের সূত্রপাত কলকাতার ভোরের শহর তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। পুরোনো পাড়ার সরু রাস্তাগুলোতে ছায়া আর কুয়াশার মিশ্রণ, দূরে কোথাও হালকা চায়ের গন্ধ ভেসে আসছে। এই পরিচিত পরিবেশের মধ্যেই হাঁটছে ঈশানি দত্ত—মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, বয়স মাত্র ছাব্বিশ। সকালটা যেন তার কাছে এক নতুন দিনের প্রতীক, যেখানে দায়িত্ব আর স্বপ্নের সীমানা মিলেমিশে একাকার। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করত সে। কলেজে পড়ার সময় গঙ্গার পাড়ে হাঁটতে গিয়ে বারবার লক্ষ্য করেছে নদীর পানিতে ভেসে থাকা প্লাস্টিক, মরা মাছ, আর মানুষের অজান্তে ফেলে দেওয়া নানান বর্জ্য। সেই দৃশ্যগুলো তার মনে গোপনে এক ধরনের প্রশ্ন জাগিয়েছে—প্রকৃতি যদি…
-
নয়না ঘোষ অধ্যায় ১: নিঃসঙ্গতার ছায়া মায়া বড় শহরের এক আধুনিক স্টুডিওর মধ্যে বসে থাকে, যেখানে জানালার কাচে বিকেলের আলো আলোর খেলা খেলে। স্টুডিওর দেয়ালগুলো সাদা, কিন্তু সেই সাদার মধ্যে যেন অদৃশ্যভাবে তার নিজের ভাঙা জীবনের ছায়া ঢেকে আছে। প্রায়শই সে নিজেকে ভেতরে ভেতরে শূন্য বোধ করে, যেন চারপাশের কোলাহল, মানুষের উদাসীন হাসি এবং শহরের ব্যস্ততা কিছুতেই তার আত্মার মধ্যে ঢুকতে পারছে না। ফাঁকা ক্যানভাসগুলো কোণে একাকী দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তারা যেন শুধু শূন্যতার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং মায়ার নিঃসঙ্গতার গভীর অনুভূতি প্রকাশ করছে। তার দৃষ্টিতে প্রতিটি ফাঁকা ক্যানভাস যেন একটি মৃদু ডাক, যা তার ভিতরে লুকানো আবেগকে ছুঁয়ে দিচ্ছে—আবেগ যা…
-
এক রিবা, এক স্বপ্নের মতো জীবনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তার নবগৃহে পা রাখল। অভিজাত পরিবারের নববধূ হিসেবে তার আগমন ছিল যেন এক চলচ্চিত্রের দৃশ্য—দীর্ঘ কার্পেট, সোনালি আলোয় ঝলমলানো হালকা পর্দা, দারুণ সজ্জিত হল এবং চারপাশে ঝলমলে ক্রিস্টাল লাস্টার। তার স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেছে বিশাল বাগান, ফোয়ারার ছোঁয়া, আর রঙিন ফুলের ছটা যা বাড়ির প্রতিটি কর্নারে ছড়িয়ে রয়েছে। সামাজিক দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তার নতুন পোশাক, হীরার গহনা এবং নিখুঁত চেহারা যেন প্রতিদিনের নাট্যশালা। রিবা নিজেকে দেখছিল এক নিখুঁত ছবির অংশ হিসেবে—যেখানে তার জীবন হবে প্রশান্ত, অভিজাত, এবং প্রতিটি মুহূর্ত হবে সুশৃঙ্খল। তবে এই বাহ্যিক গ্ল্যামারের পেছনে লুকানো বাস্তবতা ধীরে ধীরে…
-
অনিন্দিতা মুখার্জি সন্ধ্যার আঁধারে গ্রামটা যেন এক অচেনা বিষণ্নতার আস্তানা। খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলো, ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা আর কাদামাটি ভেজা উঠোন—সবকিছুই যেন নিঃশব্দে নিজের অসহায়তার গল্প বলে চলে। মীরার জন্ম এই গ্রামেই, মাটির গন্ধ মেখে বড় হওয়া সেই ছোট্ট মেয়ে আজ কিশোরীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে, তার জীবনটা আর পাঁচজন মেয়ের মতোই হবে—বাল্যবিবাহ, সংসারের ঘানি টানা, আর সারাজীবন কেবল রান্নাঘর আর ঘরের কোণে বন্দি থাকা। অথচ তার চোখের গভীরে যে অদ্ভুত আলো ঝলমল করে, সেটাকে কেউই দেখতে চায় না। ছোটোবেলা থেকেই মীরা বইয়ের প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করত। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের ভাঙা বেঞ্চে বসে যখন মাস্টারমশাই অক্ষর শেখাতেন, মীরার…
-
অন্তরা মান্না অধ্যায় ১ – মায়ার জীবন, বাইরের চোখে, এক নিখুঁত শান্তির গল্পের মতো মনে হয়। সকালে উঠে রিয়াদের সঙ্গে চায়ের কাপ ভাগ করে নেওয়া, রাস্তার ধারের ছোট্ট ফুলের দোকান থেকে রঙিন ফুল আনা, এবং বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে হালকা আড্ডা—সবকিছু যেন একটি সুন্দর ছন্দে বাঁধা। মায়া মনে করত, এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তার জীবনের আসল সম্পদ। রিয়াদের হাসি, তার কোমল স্পর্শ, এমনকি তার ক্ষুদ্র অভ্যাসগুলোও—যেমন বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে পড়া, কফি খাওয়ার ধরণ—সবই মায়ার মনে একধরনের উষ্ণতা সৃষ্টি করত। তারা দুজনেই একে অপরের মেলবন্ধনে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল, এমনকি দিনের শেষে নিঃশব্দে একে অপরের হাত ধরার অভ্যাসও মায়াকে অদ্ভুত সান্ত্বনা দিত।…
-
সহেলী দেব অগ্নিশিখা দত্ত ছিলেন এক মফস্বল শহরের সাধারণ স্কুলশিক্ষিকা, কিন্তু তার ভেতরে ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি, যা বাইরের সাধারণ চোখে ধরা পড়ত না। শাড়ির আঁচল গুঁজে স্কুলে গিয়ে তিনি যেমন মাটির গন্ধে ভিজে থাকা খড়ের ছাউনিওয়ালা শ্রেণিকক্ষে মেয়েদের পড়াতেন, তেমনি দিনের শেষে ঘরে ফিরে নিজের বুকের ভেতর জমতে থাকা অস্থির স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই বই ছিল তার নিঃশ্বাসের মতো—বইয়ের পাতায় সে খুঁজে পেয়েছিল পৃথিবীর অচেনা দরজা, ইতিহাসের আলো, আর ভবিষ্যতের কল্পনা। অথচ তার গ্রামে মেয়েদের হাতে বই পৌঁছাত না, তারা বইকে দেখে শুধু পড়াশোনার বোঝা ভেবেই ভয় পেত। অনেক মেয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো, কেউ কেউ সংসারের…
-
তমালিকা দাস মহামারীর প্রথম ঢেউ এসে যেন শহরের প্রাণ এক নিমেষে কেড়ে নিল। কলকাতার মতো এক কর্মব্যস্ত মহানগর, যেখানে প্রতিদিনের সকাল মানেই ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন, গাড়ির হর্নে মুখরিত রাস্তা, আর মানুষের ভিড়ের কোলাহল—সেই শহর হঠাৎই হয়ে গেল এক বিরান চৌহদ্দি। অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে মানুষ ঘরে বন্দি, যেন কেউ আর সাহস করছে না রাস্তায় পা বাড়াতে। দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ, ফুটপাতের চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চা নেই, স্কুল-কলেজের ফটকগুলো তালাবন্ধ, সিনেমাহলের আলো নিভে গেছে। শহরের বাতাসে মিশে আছে শুধু আতঙ্ক আর শূন্যতা। এই নিস্তব্ধতায় একমাত্র ভেসে আসে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—একটা ভৌতিক আর্তনাদের মতো, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, মৃত্যু যেন প্রতিদিনই আরও…