শিবানী চৌধুরী এক মাধবীলতার জীবনের ভোর আর রাতের মধ্যে যেন আর কোনো পার্থক্য নেই। সকালবেলায় জানালার ফাঁক গলে আলো এসে পড়লেও তার চোখে সেই আলো ঢোকে না। দিন শুরু হয় কড়াইতে ছটফট করা তেলের শব্দে, চাল ধোয়ার গন্ধে আর শ্রীময়ীর স্কুলে যাওয়ার তাড়াহুড়োয়। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই থাকে এক গভীর শূন্যতা। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই কয়েক বছরে সে শিখে গেছে কীভাবে মানুষ নিঃশব্দে বাঁচতে শেখে, কীভাবে একা থেকে চারপাশের মানুষের সহানুভূতির অভিনয় সহ্য করতে হয়। সবাই মুখে বলে—“কি সুন্দর শক্ত করে বাঁচছো গো, মাধবী”—কিন্তু সেই কথার আড়ালে থাকে এক অদৃশ্য বিদ্রূপ, যেন বিধবার জীবনে হাসি-খুশি মানায় না। ঘর সামলাতে,…
-
-
চৈতালি ঘোষ কলকাতার এক আর্দ্র গ্রীষ্মের দুপুরে সায়ন্তনী মুখার্জী তার চেম্বারে বসে ছিল, ডেস্কে জমে থাকা কেস ফাইলের পাতাগুলো উল্টাচ্ছিলেন। জানলার বাইরে থেকে ভেসে আসছিল রাস্তার গরম ধুলো আর রিকশাওয়ালার ক্লান্ত গলার আওয়াজ। এদিনটা অন্য দিনের মতোই ছিল, যতক্ষণ না দরজায় ধীর, দ্বিধাগ্রস্ত কড়া নাড়ার শব্দ হয়। “ভেতরে আসুন,” বলতেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, এক তরুণী — বয়স তিরিশের কম — সাদামাটা কটন সালোয়ারে, মুখে চাপা আতঙ্কের ছাপ। তার হাতে এক পাতলা ফাইল আর একটি ছোট ব্যাগ। চেয়ার টেনে বসতে বললেও মেয়েটি প্রথমে বসেনি, যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না। অবশেষে বসে, এক গ্লাস জল হাতে নিয়েই সে ফাইলটি সায়ন্তনীর…
-
অদিতি সাহা ১ নীল আভাসের আলোকছটায় জ্যোৎস্নার রাজ্য যেন এক স্বপ্নিল জগৎ। সকাল বেলা, সূর্য ক্রমশ উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে হালকা নীল কুয়াশা রাজ্যের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যা জমিনের নরম সবুজ এবং আকাশের সাদা মেঘের সঙ্গে মিশে এক অনন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। রাজ্যের প্রতিটি গলি, প্রতিটি চত্বর যেন এক সুরের মতো নরম নরম নীল আলো নিয়ে ঝলমল করছে। রাজপ্রাসাদের বিশাল দ্বার, যেখানে আকাশছোঁয়া মিনার আর ঝিলমিল করে ওঠা কাঁচের জানালা রয়েছে, তা দেখলেই বোঝা যায় রাজকন্যা অন্বেষার জীবন কতটা অদ্ভুত এবং জাঁকজমকপূর্ণ। রাজ্যের মানুষেরা শান্তিপ্রিয় এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। বিভিন্ন রঙের পতাকা বাতাসে লড়িখড়ি করে উড়ছে, আর শিশুদের হাসি…
-
প্রাপ্তি দাস ১ জীবন যেন একঘেয়েমি স্রোতে ভেসে চলছিল অন্বেষার। সকালবেলা চোখ মেললেই রান্নাঘরের ধোঁয়া, বয়স্ক মায়ের বকুনি আর সমাজের অলিখিত নিয়মের চাপ তাকে ঘিরে ধরত। বইয়ের তাক ভর্তি অসংখ্য খাতা, ডায়েরি, অর্ধলিখিত গল্প—সবকিছু যেন নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দমিয়ে রাখা কণ্ঠের। লেখার হাত তার থেমে গেছে, অথচ ভেতরে জমে থাকা শব্দেরা ক্রমাগত কড়া নাড়ছে। মায়ের একটাই কথা—“এত পড়াশোনা করেছ, কিন্তু লিখে কী হবে? সংসার সামলানোই আসল কাজ।” বাইরে প্রতিবেশীদের কটাক্ষ, আত্মীয়স্বজনদের দৃষ্টি—সবই যেন তাকে বোঝাতে চায়, লেখালিখি কোনো জীবিকা নয়, এটা নিছক খেয়াল। অথচ অন্বেষা জানত, তার কলমের ভেতরে লুকিয়ে আছে তার সত্যিকারের জীবন, এক নতুন পৃথিবী।…
-
অনিন্দিতা ঘোষ পাল ১ প্রান্তি ছিল গ্রামের একেবারে সাধারণ মেয়ে। কাঁচা মাটির ঘর, উঠোনে মাটির চুলা, আর সারাদিন খাটুনি খাটা বাবা-মা—এই ছিল তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ। তবে তার মধ্যে এক অন্য রকম প্রাণ ছিল। চারপাশের মেয়েরা যখন মাঠের ধারেই লাজুক হয়ে বসে থাকত বা পুতুল নিয়ে খেলত, তখন প্রান্তি ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করতে বেশি ভালোবাসত। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা ফেলে দিয়ে ছুটে যেত পাড়ার মাঠে। সেখানে ফুটবল খেলছিল বড় ছেলেরা, তার চোখে পড়ল বলটা কীভাবে এপাশ-ওপাশ দৌড়চ্ছে, ছেলেরা কেমন মন দিয়ে তাড়া করছে। প্রথমবারের মতো তার মনে হল, “এই খেলাটার মধ্যে যেন এক যাদু আছে।” মনে হল, ফুটবলের ওই গোল…
-
ঋতুপর্ণা দাশগুপ্ত পর্ব ১: নদীর ডাক গাঁটা যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়ানো ছিল। শীতল দমকা হাওয়া ভোরের আকাশে নীলচে ছাপ রেখে দিত আর দূরে শাল-সেগুনের বনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসত নদীর গুঞ্জন। এই নদীর নাম ছিল কুলেশ্বরী। তবে মাধুরী ছোটবেলা থেকেই জানত, নামটা পুরোটা নয়—এই নদীর আরেকটা নাম আছে, একেবারে গোপন নাম, যা শুধু রাতের আঁধারেই ফিসফিস করে শোনা যায়। মাধুরী তখন দশ বছরের মেয়ে। প্রতিদিন বিকেলে সে বাঁশের ডাল দিয়ে বানানো কঞ্চির দোলনা নিয়ে নদীর ধারে যেত। নদীর পাড়ে বসেই তার পড়াশোনা, খেলাধুলো সবকিছু। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে, হঠাৎ করেই সে শোনে অদ্ভুত একটা আওয়াজ—যেন নদী গুনগুন করছে। প্রথমে ভেবেছিল…
-
১ শহরের সকাল সবসময়ই ব্যস্ততার সঙ্গে শুরু হয়—বসন্তপুর নামের এই আধুনিক নগরীটা যেন ঘুমায় না। উঁচু উঁচু বহুতল ভবনের জানালা থেকে সূর্যের আলো গড়িয়ে এসে পড়ছে নিচের ব্যস্ত রাস্তায়, যেখানে গাড়ির হর্ন আর মানুষের ভিড় মিলেমিশে এক অদ্ভুত কোলাহল তৈরি করেছে। এই ভিড়ের মাঝেই প্রতিদিনের মতো পথ হাঁটছে বনলতা—পঁচিশ বছরের এক তরুণী, যার চেহারায় ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট হলেও চোখে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে নোটবুক, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিমায় যেন কেবল দায়িত্ব পালন করার যান্ত্রিকতা। শহরের এই কোলাহল তাকে কখনোই আপন মনে হয়নি; বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভিড় তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সে এই ব্যস্ত মানুষের…
-
মৌসুমী সেনগুপ্ত এক অর্পিতা সেনগুপ্তের জীবনে যেন এক অচেনা ঝড় নেমে এসেছে হঠাৎই। বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় সম্পর্ক ভাঙনের সিলমোহর এসে পড়ল তার কপালে। চারপাশের মানুষজনের মুখে একরাশ ফিসফিসানি, একরাশ হাহাকার, আর হাজারো প্রশ্ন—সবকিছুই যেন তাকে এক নিমেষে নীচে ফেলে দিল। দিন কয়েক আগেও যে সংসারের স্বপ্ন চোখে ভাসতো, ঘর সাজানোর পরিকল্পনা করতো, মনের গোপনে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতো—আজ সেসব কিছুই যেন ধুলোয় মিশে গেছে। রোহিতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা শুরু থেকেই খুব মসৃণ ছিল না। রোহিত চেয়েছিল অর্পিতা সংসারে ডুবে যাক, তার নিজের ক্যারিয়ার, নিজের স্বপ্ন যেন গুটিয়ে রেখে দেয়। অথচ অর্পিতা চেয়েছিল নিজের পড়াশোনা, নিজের মেধা আর পরিশ্রমকে কাজে…
-
প্রেরণা দত্ত এক সকালবেলা স্কুলের ঘণ্টা বাজতেই মফস্বল শহরের মেয়েদের স্কুলের ক্লাসরুম ভরে ওঠে কোলাহলে। দেয়ালের রং অনেক জায়গায় খসে পড়েছে, বেঞ্চিগুলো পুরনো আর খটখটে, জানালার কাচ ভাঙা বলে আলো ঢোকে টুকরো টুকরো হয়ে। এই ক্লাসেই দাঁড়িয়ে থাকেন ইতিহাসের শিক্ষিকা সুবর্ণা দত্ত। বয়স ত্রিশের কোঠা পেরোলেও চোখে যেন এক আশ্চর্য দীপ্তি লেগে আছে। তিনি যখন বোর্ডে ইতিহাসের কথা লিখে বোঝাচ্ছিলেন, তখন তার চোখ হঠাৎ আটকে গেল ছাত্রীদের মুখে। অঞ্জলি, মীরা, গৌরী, ফারজানা—তাদের চোখে অদম্য কৌতূহল, কিন্তু সেই কৌতূহলের পাশে যেন অসহায়ত্বও ভেসে উঠছিল। ক্লাসের শেষে তিনি খেয়াল করলেন, বই পড়তে গিয়ে মেয়েরা বারবার একে অপরের কাছে বই চেয়ে নিচ্ছে। অনেকেরই…
-
ঐশানী সেন পর্ব ১: দাসীর যাত্রা শুরু আরাকানের ছোট্ট এক উপকূলগ্রাম। চারদিকে পাহাড় আর সমুদ্রের মিলন, নারকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে কুটির। সেই গ্রামেই বাস করত কিশোরী মেয়ে মায়ারী। বয়স মাত্র ষোলো, চোখদুটো ঝকঝকে কালো, কপালে যেন সর্বদা একটা অবুঝ কৌতূহলের রেখা। মায়ারী ছিল মৎস্যজীবীর মেয়ে। প্রতিদিন সকালবেলা বাবার সঙ্গে সাগরে মাছ ধরতে যেত, মা ঝুড়ি বুনত আর ছোট ভাইটির যত্ন নিত। গ্রামজীবন ছিল সরল, অথচ সাগরের অনিশ্চয়তা সর্বদা তাদের বুকে ভয় জাগিয়ে রাখত। সেই ভয়াবহ রাতটা আজও গ্রামের লোকেরা ভুলতে পারেনি। দূর সমুদ্র থেকে হঠাৎ কিছু অচেনা পালতোলা জাহাজ এসে ভেড়ে। ওরা ছিল পর্তুগিজ দাসব্যবসায়ী। আগুন লাগানো হয়…