অর্ণব দত্ত পর্ব ১: অপরিচিত সংকেত রাত তখন গভীর। সল্টলেকের গবেষণাগারের কাচঘেরা জানলার বাইরে দূরের হাইওয়ে আলো ঝলমল করছে। চারদিকে নির্জনতা, কেবলমাত্র মেশিনের নিরবচ্ছিন্ন গুঞ্জন আর মাঝে মাঝে হাওয়ার ফিসফিস শব্দ। ডঃ অদিতি মুখার্জি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন, চোখে লালচে ক্লান্তি। কয়েক মাস ধরে যে পরীক্ষাটি চালাচ্ছেন, সেটি মূলত ছিল রেডিও ওয়েভ শনাক্তকরণ। পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা যেকোনো সংকেত বিশ্লেষণ করা তাঁদের কাজ। সাধারণত ভাঙাচোরা তরঙ্গ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। তবুও আজ রাতটা অন্যরকম লাগছিল। ঘড়িতে তখন ১টা ৪৫। হঠাৎ করে স্ক্রিনে দপদপ করে ওঠা এক অদ্ভুত প্যাটার্ন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তরঙ্গগুলো যেন কোনো ছন্দে সাজানো,…
-
-
দেবপ্রতিম সাহা কুহেলি দত্তের প্রতিদিনের কাজ ছিল একঘেয়ে অথচ ভীষণ মনোযোগের—স্যাটেলাইট ডেটার অগণিত ছবি বিশ্লেষণ করা। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল অঞ্চলের মানচিত্র সে তৈরি করছিল তার গবেষণার জন্য, বিষয় ছিল ভূ-পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব। দিনের পর দিন চোখের সামনে আসছিল নদীর প্রবাহ বদলানো, বনাঞ্চলের সবুজ কমে যাওয়া কিংবা গ্রামের বিস্তার। কিন্তু সেদিন রাতের স্যাটেলাইট ছবিতে তার চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। ঝাপসা একখণ্ড ফ্রেমে সে দেখতে পেল অদ্ভুত জ্যামিতিক রেখা—আয়তক্ষেত্র, অর্ধবৃত্ত আর সোজা প্রাচীরের মতো দাগ একসঙ্গে মিলেমিশে আছে। এগুলো প্রকৃতির তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু মানচিত্রে সে জায়গায় কোনো গ্রাম নেই, কোনো জনবসতি নেই, এমনকি সরকারি রেকর্ডেও নেই কোনো নির্মাণ। সে প্রথমে…
-
আত্মদীপা সেন পর্ব ১ – আগমন শীতের শেষ দিকের হাওয়া নামছিল পাহাড় থেকে। সন্ধেবেলা দার্জিলিংয়ের ধারে মেঘলা সেন ছোট্ট একটা লোকাল বাসে চেপে নামল জনশূন্য রাস্তায়। চারদিক জুড়ে তখন কুয়াশার ধোঁয়া, যেন পাহাড়টা নিজের বুকের ভেতর পৃথিবীকে গিলে নিতে চাইছে। তার হাতে একটা পুরনো নোটবুক, ভেতরে টুকে রাখা এক রহস্যময় ঠিকানা—“শেষ গ্রন্থাগার, রংটং পাহাড়তলি।” মেঘলা কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তার থিসিস ছিল প্রাচীন বই নিয়ে—কাগজের গন্ধ, ছাপার দাগ, মানুষের হাতের ছোঁয়া। অথচ এই পৃথিবীতে এখন বই বলতে বোঝানো হয় কেবল স্ক্রিনের আলো। সব দেশ, সব সরকার, সবকিছু ডিজিটাল আর্কাইভে সরিয়ে নিয়েছে। কাগজের বই নিষিদ্ধ না হলেও, বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া…
-
নিশীথ চক্রবর্তী সুন্দরবনের উপকূল সবসময়ই রহস্যে ঘেরা, অর্ধেক জল আর অর্ধেক জঙ্গলের মিলিত রূপ যেন সময়ের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত ভূমি। ভোরবেলা আকাশ যখন ধীরে ধীরে আলোকিত হয়, তখন কাদা মাটির গন্ধ আর লবণাক্ত বাতাস জেলেদের নাকে এসে লাগে, নদীর স্রোত যেন ডাকে নতুন দিনের শিকারে নামতে। রফিকুল ইসলাম সেই দিনও স্বাভাবিক নিয়মে নিজের ছোট্ট নৌকো নিয়ে বের হয়েছিল। জীবনের প্রতিদিনের লড়াই, পরিবারকে দু’মুঠো খাবার জোগানোর চিন্তা আর সমুদ্রের অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলে তার দিনগুলোর রং একঘেয়ে, কিন্তু এই দিনের সকালটা যেন অন্যরকম কিছু হয়ে উঠতে চলেছে। জাল ফেলার জন্য সে যখন নৌকো থেকে ভর করে দাঁড়াল, তখন নদীর পানি ছিল…
-
দেবাশিস রায় ২১ শতাব্দীর শেষ দিকে কলকাতা শহর অনেক বদলে গেছে। হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে ভেসে চলা চৌম্বক ট্রেন, আকাশছোঁয়া কাচের অট্টালিকা, আর চারপাশে ভেসে থাকা নীয়ন আলোয় ঢাকা রাস্তা—সব মিলিয়ে পুরনো কলকাতা যেন একেবারেই অন্য রূপ নিয়েছে। কিন্তু এই শহরের ভিড়ের মাঝেই এক কোণে আছে দত্ত পরিবার—একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার। বাবা অরিন্দম দত্ত পেশায় ব্যবসায়ী, নানা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে যুক্ত, আর মা শর্মিষ্ঠা দত্ত গৃহিণী হলেও নিজের মতো করে পুরোনো বাংলা গান আর গাছপালা নিয়ে সময় কাটান। এই সংসারের সবচেয়ে আলাদা মানুষ নিঃসন্দেহে অভ্রজিত দত্ত, সবার কাছে অভ্র নামে পরিচিত, যার বয়স মাত্র ১৪ বছর হলেও কৌতূহল যেন আকাশের মতো…
-
ঋষভ সরকার এক ২০৭৫ সালের কলকাতা তখন একেবারে নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। গঙ্গার তীর ঘেঁষে উঁচু উঁচু টাওয়ার, আকাশপথে নীরব ভেসে চলা ম্যাগনেটিক ট্রেন, আর রাস্তায় স্বয়ংচালিত যানবাহনের মৃদু গুঞ্জন মিলে শহরকে দিয়েছে ভবিষ্যতের স্বাদ। রাস্তার দুই পাশে আলোকিত বিলবোর্ডে ভেসে আসে হোলোগ্রাফিক বিজ্ঞাপন—কখনও তাজা ফল বিক্রি করছে, কখনও পুরনো বাংলা সিনেমার ডিজিটাল রিমাস্টার রিলিজের ঘোষণা দিচ্ছে। শহরের উপর আকাশে ভেসে থাকে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম মেঘ, যা নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টি নামিয়ে দেয়, আবার কোথাও রোদ ঝলমল রাখে। এই ব্যস্ত শহরের এক কোণে, গঙ্গার ধারের পুরনো পোস্ট অফিসের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঝকঝকে, সাদা-নীল কাঁচের “টাইম-পোস্ট সেন্ট্রাল হাব”—যেখানে কাজ করে অরুণেশ সেন,…
-
শুভ্রজিত ঘোষাল অধ্যায় ১ – সূর্যের ডাক ২১শ শতকের শেষ দিকে, পৃথিবীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে সূর্যের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনও শনাক্ত করা সম্ভব। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ISRC) কলকাতা শাখায় সেই রাতে সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। রাত দুইটা পেরিয়ে গেছে, পর্যবেক্ষণ ঘরে শুধুই যন্ত্রের মৃদু শব্দ, আর কম্পিউটার স্ক্রিনে অনবরত ভেসে আসা ডেটা। হঠাৎ, স্যাটেলাইট “সৌরবিকাশ–৭” থেকে আসা লাইভ ফিডে দেখা গেল এক অদ্ভুত সিগন্যাল—তীব্র তাপের সমুদ্রের মাঝে যেন একটি স্থির, ঠান্ডা বিন্দু। ডিউটি অফিসার প্রথমে ভাবলেন, হয়তো সেন্সর ত্রুটি। কিন্তু চেক করার পর দেখা গেল, সব সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করছে। সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাঠানো হল ড. সৌম্যদীপ…
-
অর্কপ্রভ মুখার্জী ঘন বর্ষার রাতে, দক্ষিণ কলকাতার বেহালার উপকণ্ঠে নিজের ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরির এক কোণে বসে ড. অনিরুদ্ধ সেন চুপচাপ তাকিয়ে ছিল ছেলের শেষ ব্যবহৃত খেলনা ট্রেনটার দিকে। ট্রেনটা থেমে আছে ট্র্যাকের মাঝখানে, ব্যাটারির অভাবে নয়, বরং সময়ের অভাবে। সেই ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ভিতরে এক ছায়া যেন থিতু হয়ে গেছে—সেই ছায়া, যেটা সে এক বছর ধরে প্রতিদিন বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের হৃদয়ের গভীরে। তার একমাত্র ছেলে ঋদ্ধি সেন, মাত্র বারো বছর বয়সে মারা গেছে এক মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায়। স্কুল থেকে ফেরার পথে এক মিনি ট্রাক তাকে পিষে দেয়, এবং সে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। অথচ সেই দিনটি ছিল অনিরুদ্ধর জন্মদিন—ছেলেটা…
-
১ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গা-ছমছমে সেই পুরোনো গবেষণা রুমটা দিনের আলোতেও যেন কিছুটা অন্ধকারময়। তারই এক কোণে বসে রেখা সেনগুপ্ত চোখ গুঁজে পড়ছিল পুরনো এক সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি—জীর্ণ, পোড়া পাতাগুলো যেন শতাব্দী প্রাচীন রহস্যের সাক্ষ্য বহন করছে। বেশ কিছুদিন ধরেই সে খুঁজছিল এমন এক প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থ যা তন্ত্রশাস্ত্রের অপ্রকাশিত ধারার অন্তর্ভুক্ত। লাইব্রেরির পুরাতন ক্যাটালগে হঠাৎ করেই তার চোখে পড়েছিল ‘ভৈরব তন্ত্র’ নামক একটি অচেনা শিরোনাম। কোনো কাগজে তার উল্লেখ নেই, কোনো অনুবাদ নেই, এমনকি কেউ এটি সম্পর্কে জানেও না। আজ সকালে প্রাচীন গ্রন্থসংগ্রহ থেকে লাইব্রেরিয়ান তার জন্য এক মোটা কাঠের বাক্স এনে দেয়। রেখার হাত কাঁপছিল উত্তেজনায়। সাদা তুলোর ভেতর পেঁচানো পাণ্ডুলিপি…
-
অভিরূপ মুখার্জি চোখ খুলতেই আরুণাভ টের পেল কিছু একটা অস্বাভাবিক। জানালার ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো ঢুকছে, কিন্তু সেই আলোয় একধরনের ধূসরতা মিশে আছে, যেন রোদ নয়—কোনো স্ক্রিনের আলো। বিছানায় বসে চারপাশ তাকাল সে—ঘরটা পরিষ্কার, ছিমছাম, কিন্তু যেন গতকালের ঘর নয়। দেয়ালে যে রঙটা ছিল সবুজাভ, আজ সেটা হালকা নীল; জানালার বাইরে যে গাছটা ছিল, সেটা নেই, তার জায়গায় একটা পুরোনো ইলেকট্রিক পোস্ট, আর দূরে অদ্ভুত সব শব্দ—যেন লোকজন হাঁটছে, অথচ একটাও কণ্ঠস্বর নেই। আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠল আরুণাভ—চোখের নিচে কালি, মুখে ক্লান্তির রেখা, অথচ মনে পড়ছে না কেন। সে তো মাত্র ঘুম থেকে উঠল। পাশে টেবিলের ওপর একটা…