তানিয়া বসু অধ্যায় ১ : নিউরো সিটির স্পন্দন প্রযুক্তির সোনালী জাল যেন ২০৭৫ সালের কলকাতাকে এক নতুন ছন্দে বেঁধে ফেলেছে। মেঘছোঁয়া টাওয়ারগুলোর কাচের দেয়ালে রাতের নীয়ন আলো ঝিলমিল করে, আকাশপথে ভেসে চলা মেট্রোকারগুলো গঙ্গার ওপারে লালচে চাঁদের প্রতিচ্ছবি কেটে যায়। এই শহরের প্রতিটি মানুষ এখন এক অদৃশ্য নেটওয়ার্কের অংশ—মস্তিষ্কের ভেতর স্থায়ীভাবে বসানো নিউরো-লিঙ্ক চিপ তাদের চিন্তা, অনুভূতি, কাজকর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ব্যাংকের পাসওয়ার্ড থেকে প্রিয় গানের প্লেলিস্ট, অফিস মিটিং থেকে ঘরের দরজার লক—সব কিছু এক নিমিষে মস্তিষ্কের সিগন্যালেই নিয়ন্ত্রিত। প্রযুক্তির এই মহোৎসবে কলকাতা যেন হয়ে উঠেছে “নিউরো সিটি”—এক এমন মহানগর, যেখানে বাস্তব আর ভার্চুয়াল একে অপরের সীমানা মুছে ফেলেছে। কিন্তু…
-
-
রণজিৎ চক্রবর্তী পর্ব ১: শেষ ধানের দানা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। বর্ষার শেষ দিক। চারপাশে কাদামাটি, শুকনো খাল, ফাটল ধরা জমি। যেদিকে তাকানো যায়, মানুষ হাহাকার করছে একফোঁটা শস্যের জন্য। কারণ পৃথিবীর আর কোথাও প্রকৃত ধানের চারা নেই—সবটাই কর্পোরেট কোম্পানির হাতে। তাদের বিশাল “জিন-ব্যাংক” থেকে কিনতে হয় বিশেষ বীজ, যা একবার চাষ হলে আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যায় না। কৃষক নীলমাধব দত্ত প্রতিদিন নিজের খালি গোলাঘরে বসে থাকেন। তাঁর বাবা-ঠাকুর্দার আমলের গাদা ধানের খড় শুকিয়ে মাটির গন্ধ ছড়াচ্ছে, কিন্তু একটাও বীজ বাকি নেই। গ্রামের মানুষ রেশন কুপনের লাইনে দাঁড়ায়, শহর থেকে আসা ট্রাকে যে-টুকু বীজ আসে, তা কিনতে হুমড়ি…
-
অমিত সিনহা ১ হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরে রাতটা ছিল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার। বাইরে বরফঢাকা পর্বতের মাথায় ছড়িয়ে থাকা ঠান্ডা হাওয়া যেন পৃথিবীর অন্তিম যুগের শীতলতার পূর্বাভাস দিচ্ছিল। শতাব্দীর শেষ প্রহরগুলোতে পৃথিবীর মানুষ আর প্রকৃতি, দুজনেই এক অচেনা ছন্দে বেঁচে ছিল। সূর্যের শক্তি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত, গ্লোবাল তাপমাত্রা কখনও অস্বাভাবিক উষ্ণতায় ফেটে পড়ছে, আবার মুহূর্তেই হিমেল শীতের ছুরিকাঘাত নামছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আকাশের উচ্চতায়। শহরগুলো ধীরে ধীরে নিভে গেছে, সভ্যতার আলো কমেছে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় নয়, বরং মহাবিশ্বের এক অচেনা চক্রে। এই মৃত্যুপথযাত্রী পৃথিবীতে আর্যন সেন যেন এক ব্যতিক্রম। তরুণ, মেধাবী জ্যোতির্বিজ্ঞানী সে, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আকাশের ভাষা বোঝা। অজানাকে ছুঁতে চাওয়ার নেশায়…
-
দীপক মিস্ত্ৰী ১ বেঙ্গালুরুর উপকণ্ঠে অবস্থিত বিশাল স্পেস রিসার্চ কমপ্লেক্সটি দিনের বেলায় সাধারণ সরকারি গবেষণাগারের মতোই মনে হয়, কিন্তু রাত নামলেই তার প্রকৃত চেহারা ধরা দেয়—যেখানে হাজারো যন্ত্রপাতি, স্যাটেলাইটের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ, এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বাধুনিক ল্যাবগুলো এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। এখানে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চলতে থাকা গোপন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ও রহস্যময় ছিল প্রকল্প নক্ষত্রবীজ। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য শুধু মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানো নয়, বরং এমন এক জীবন্ত সত্তা তৈরি করা, যে অক্সিজেনশূন্য চাঁদের ধূসর মাটি কিংবা মঙ্গলগ্রহের লৌহসমৃদ্ধ মৃত প্রান্তরে বেঁচে থাকতে পারবে এবং নিজে থেকেই অক্সিজেন উৎপন্ন করে একটি ক্ষুদ্র বাস্তুতন্ত্রের সূচনা ঘটাবে। পৃথিবীর সীমিত সম্পদ ও…
-
ঋজু দত্ত ১ ২১২০ সালের কলকাতার সকাল যেন এক মহাপ্রলয়ের পূর্বাভাস হয়ে নেমে এসেছিল। একসময় প্রাণচঞ্চল এই শহর তখন অর্ধেক ডুবে আছে গঙ্গার অশান্ত জোয়ারে। আকাশজুড়ে ঘন নীল-ধূসর মেঘের স্তর, যেন সূর্যের আলোকে গ্রাস করে নিয়েছে। লালবাজারের পুরনো রাস্তাগুলো, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গলি, বউবাজারের পুরাতন অট্টালিকাগুলি—সবকিছু এখন দৃষ্টিসীমার নীচে নেমে গেছে। কেবল ছাদগুলোর কিছু অংশ, ভেসে থাকা কাঠের ঘাট ও পরিত্যক্ত ট্রামলাইন জলরাশির মধ্যে সেতুর মতো ভেসে আছে। বাতাসে ভিজে শ্যাওলার গন্ধ, মিশে আছে মরচেধরা লোহার গন্ধ, যেন শহরের প্রতিটি নিঃশ্বাসে মরণঘণ্টা বেজে চলেছে। আকাশে অস্থির ড্রোন টাওয়ারগুলো অবিরাম চক্কর দিচ্ছে, তাদের মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর—সরকারের শেষ সতর্কবার্তা: “নিম্নভূমি খালি…
-
অনিন্দ্য মুখাৰ্জী অধ্যায় ১ : অচেনা আলো শিলিগুড়ির শহর তখনও পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েনি। পাহাড়ি হাওয়ায় মিশে ছিল চায়ের গন্ধ, দূরে ট্রেনের হুইসেল বাজছিল, আর আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই সময়েই ঘটে গেল অদ্ভুত ঘটনা। অর্ণব, বয়সে মাত্র চৌদ্দ, তখন জানালার পাশে বসে খাতা-কলমে আঁকাআঁকি করছিল। হঠাৎই তার চোখে পড়ল, আকাশে যেন এক বিশাল আগুনের গোলা ছুটে আসছে। প্রথমে মনে হলো কোনো বিমান হয়তো দুর্ঘটনায় পড়েছে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা আরও কাছে আসতে থাকলে স্পষ্ট হলো—এটা একেবারেই অন্যরকম। সেই গোলার চারপাশে ছিল নীল-সবুজ আলোর আভা, যা কোনোদিন কোনো আতশবাজিতেও দেখা যায়নি। মুহূর্তের মধ্যে পুরো আকাশ কেঁপে উঠল, আর সেই…
-
অভিষেক দাশগুপ্ত অধ্যায় ১ : অভিযানের সূচনা তাদের যাত্রার শুরুটা যেন ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। পৃথিবীর আকাশে ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কন্ট্রোল রুমের ভেতরে ব্যস্ত প্রকৌশলীরা, বিজ্ঞানীরা আর সামরিক পর্যবেক্ষকরা একসঙ্গে চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। উৎক্ষেপণের স্থানটি ছিল হাজারো মানুষের ভিড়ে মুখরিত, যেন সমগ্র মানবজাতি চোখ মেলে অপেক্ষা করছে নতুন দিগন্তের। দলের ছয়জন তরুণ বিজ্ঞানী—অর্পিতা, রাহুল, নীল, মায়া, কাব্য ও আদিত্য—এই অভিযানের নেতৃত্বে। প্রত্যেকের চোখে ছিল অনাবিষ্কৃত এক পৃথিবীর স্বপ্ন, আর বুকে ছিল অদম্য সাহস। তারা জানত এই মিশন শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন। উৎক্ষেপণের…
-
অম্বরীশ সেন অচেনা সকালের শহর—এ যেন এক অনন্ত মরীচিকা, যেখানে প্রতিটি দিন শুরু হয় সম্পূর্ণ নতুন এক জগৎ নিয়ে। আরিয়ানের ঘুম ভাঙতেই জানালার বাইরে যে দৃশ্য ধরা পড়ে, তা কখনোই আগের দিনের সঙ্গে মেলে না। কখনো দেখা যায় রাস্তার দুই ধারে গজিয়ে উঠেছে অচেনা ভবন, আবার কখনো আগের দিনের চেনা পার্কের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কাঁচের টাওয়ার। ফুটপাতের রঙিন পাথর রাতারাতি বদলে গেছে, ট্রাফিক সিগন্যালের স্থানে হঠাৎ দেখা যায় একটি হোলোগ্রাফিক স্ক্রিন, যা শহরের নতুন মানচিত্র দেখাচ্ছে। এমনকি আকাশের রঙও যেন প্রতিদিনের সকালকে আলাদা করে তুলতে চায়—কখনো হালকা বেগুনি, কখনো সোনালি, আবার কখনো অদ্ভুত নীলচে ধূসর। আরিয়ান প্রথমে ভাবে এটা…
-
ঋত্বিক মুখোপাধ্যায় পর্ব ১: কাঁচের গম্বুজের নীচে গঙ্গার স্রোত নেমে আসছিল কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ বেয়ে। একসময়ের মহার্ঘ্য ভবনগুলো এখন কেবল ডুবে থাকা প্রেতনগরের ভগ্নাবশেষ—কলকাতা আর নেই, কেবল ভেসে থাকা নাম-অস্তিত্ব। সমুদ্রপৃষ্ঠ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে মহানগরীর রাস্তাঘাট, চৌরঙ্গি, কলেজস্ট্রিট, এমনকি হাওড়া ব্রিজের অর্ধেক অংশও জলের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ হাল ছাড়েনি। তারা গড়ে তুলেছে নতুন এক পৃথিবী—গঙ্গার তলদেশে কাঁচের স্বচ্ছ গম্বুজ ঘেরা এক নগরী। সেই নগরীর নাম—অমরাবতী। কাঁচের গম্বুজটিকে বলা হত AquaDome, বিশাল বায়োটেক কাঠামো। এর ভেতর অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য লাগানো হয়েছিল নীল শৈবাল আর কৃত্রিম বনভূমি। শহরের ভেতর আবার তৈরি হয়েছিল রাস্তা, আলো, বাজার, আবাসন, ল্যাবরেটরি। মানুষের পরবর্তী…
-
হিমাদ্ৰী ঘোষ ১ মানিক ছিল ছোট্ট এক গ্রামীণ ছেলেবেলা থেকে দুষ্টু আর কৌতূহলী, তবে তার দুষ্টুমির রূপটা অন্যরকম। যখন অন্য বাচ্চারা মাঠে ঘুড়ি ওড়াতো কিংবা নদীর ঘাটে সাঁতার কাটতো, তখন মানিক অচেনা এক জগতে ডুবে থাকতো। সে ভাঙা রেডিওর ভেতর থেকে লাল-সবুজ রঙের তার টেনে বের করতো, পুরোনো ফ্যানের মরিচা ধরা পাখা খুলে এনে হাতে ঘোরাতো, কিংবা ফেলে দেওয়া ব্যাটারির ভেতরের কালো পেস্ট নিয়ে পরীক্ষা করতো। তার চোখে এগুলো নষ্ট জিনিস নয়, বরং একেকটা অজানা খেলার মাঠ। বাবা ছিলেন গ্রামে লোহার কাজের কারিগর, তার হাতের যন্ত্রপাতি অনেক সময় চুপিচুপি নিয়ে গিয়ে মানিক নিজের খেলায় ব্যবহার করতো। মা খেতে কাজ করতেন,…