হিমাদ্ৰী ঘোষ ১ বস্তির সকাল সবসময় একরকম শব্দে ভরা—খটাখট হাঁড়ি-বাসনের শব্দ, চায়ের দোকানের কেটলি থেকে উঠতে থাকা সিটি, ভাঙা টিনের চালের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের লালচে আলো আর তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ছোট ছোট শিশুদের কোলাহল। এখানে সকাল মানেই নতুন দিনের লড়াই শুরু। কেউ ভোরেই কাজে বেরিয়ে পড়ে, কেউ বা কুপির আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে রাতভর ইটভাটায় কাজ করে আসার ক্লান্তি নিয়ে। মায়েদের হাঁকডাক আর কিশোরদের কাশি-মেশানো অস্থিরতা মিশে যায় বাতাসে। এর মাঝেই ঘুড়ির নাম উঠলেই বদলে যায় আবহ। যেন এক মুহূর্তের জন্য হলেও দারিদ্র্যের আঁকড়ে ধরা হাতটা আলগা হয়ে যায়, আর আকাশ থেকে নেমে আসে রঙিন আশার…
-
-
সঙ্গীতা দাস ১ মেঘলার শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে কাঁচা রাস্তা, বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ আর দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা আকাশ তার শৈশবের নিত্যসঙ্গী। সকালবেলা কাকডাকা ভোরে মাটির ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া আলোয় সে ঘুম ভাঙত, আর সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল সন্ধ্যা। গ্রামের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার বাবার একটি পুরোনো রেডিও ছিল—যার শরীর ক্ষয়ে গেছে, অনেক সময় স্ট্যাটিক আওয়াজের ভেতরেই কণ্ঠ শোনা যেত। সেই রেডিওতে কখনো হঠাৎ বিমান চলাচলের খবর, কখনো বেতারে ভেসে আসা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভাঙাচোরা সিগন্যাল শোনার সময় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠত। সে জানত না…
-
অর্ণা মুখার্জী ১ সায়নী বসু দক্ষিণ কলকাতার মফস্বলি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নতুন প্রজেক্টের কাজে তাকে পাঠানো হয়েছিল এই অঞ্চলের একটি পুরনো জমি পরিদর্শনের জন্য, যেখানে একটা কমিউনিটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই জমির পাশেই পড়ে থাকা পুরনো বাসস্ট্যান্ডটি তার দৃষ্টি আটকে দেয়। নীল রং উঠে যাওয়া টিনের ছাউনি, ভাঙাচোরা কংক্রিটের বেঞ্চ, আর বৃষ্টির জল জমে থাকা ময়লা গর্ত — দেখলে মনে হতো এই জায়গায় কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ বোতল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জল খাচ্ছে, কেউবা টায়ারের টুকরো নিয়ে খেলছে — ওদের…
-
১ নদীর পাড়ের সেই ছোট্ট চায়ের দোকানটা দিনের শেষে যেন এক শান্তির আশ্রয় হয়ে উঠত আশেপাশের শ্রমজীবী মানুষদের জন্য। পাশ দিয়ে গঙ্গার একটি শাখানদী বয়ে গেছে, তার জল সবসময়ই মাটি ছুঁয়ে যায়, আর গ্রীষ্ম হোক বা শীত—সন্ধ্যার দিকে বাতাসে একধরনের স্নিগ্ধতা নেমে আসে। আব্দুল হালিম প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই দোকান চালিয়ে আসছেন। বয়স পঞ্চাশ পার করলেও মুখে এখনো সেই নরম হালকা হাসি। সকালে দোকান খোলার সময় সে নিজেই ঝাঁট দেয়, ঠেলাগাড়ি থেকে বিস্কুটের কৌটো নামায়, দুধ ফুটিয়ে চা বানায়। তারপর একে একে আসে রিনা, নিতাই আর গোলাম—তিনজন শিশু-কিশোর, যারা বাড়ির অভাবের কারণে স্কুল ছেড়ে এই দোকানেই কাজ করে। রিনা…
-
সায়ন্তন বসু ১ ধনেখালির একচালা ছোট্ট প্রাইমারি স্কুলটার ক্লাসঘরে তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, সূর্যের আলো বেখেয়ালে মেঝেতে খেলছে, কিন্তু সুধাংশু বেরা বুঝতে পারছিলেন, আজকের শিক্ষার আলো যেন কেমন ম্লান। ক্লাসরুমে মাত্র ন’জন ছাত্র—হাজিরার খাতা বলছে তেইশজন আছে রোল কল-এ। যাদের এসেছে, তাদের চোখে ঘুম নেই, আছে কেমন এক শূন্যতা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো মাথা নিচু করে বসে আছে, যেমনভাবে গরিব সংসারের শিশুরা বসে থাকে কোনো বড়লোক আত্মীয়ের সামনে—ভয়ে নয়, লজ্জায়। হঠাৎ চিন্ময় হালদার, চতুর্থ শ্রেণির সবচেয়ে শান্ত ছেলেটা, ধীরে ধীরে হেলে পড়ে। সুধাংশু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলেন। ছেলেটার নিঃশ্বাস ঠিক আছে, জ্বর নেই, কিন্তু সে সংজ্ঞাহীন। মাথায় জল দিতে দিতে…
-
অর্পিতা দাশগুপ্ত অধ্যায় ১: ইশারার প্রথম পাঠ নবনীতা মুখার্জি যখন প্রথম “পূর্ব আনন্দনিকেতন বিশেষ বিদ্যালয়”-এর ধুলোমাখা ফটকে পা রাখেন, তখন আকাশে কুয়াশা জমেছিলো যেমন, তেমনি তাঁর মনের ভিতরেও ছিল অনিশ্চয়তার এক অদৃশ্য কুয়াশা। শহরের একপ্রান্তে ঝাঁপসা হয়ে থাকা এই স্কুলটিকে অধিকাংশ মানুষ ‘বাতিল জায়গা’ বলে এড়িয়ে যায়। গেটের ধারে একটা মরচে পড়া সাইনবোর্ড—যেখানে অর্ধেক লেখা খসে গেছে, তবু বোঝা যায়: এটি বাকপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্মিত একটি বিদ্যালয়। স্কুল চত্বরের ভাঙা পাঁচিল, পুরোনো আমগাছের নিচে জমে থাকা শুকনো পাতা, আর একটি কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা কেয়ারটেকার রফিক মিঞা—এই ছিল নবনীতার নতুন কর্মস্থল। সদ্য বিএড পাশ করা নবনীতা এই স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষিকার…
-
সন্দীপন ধর খামে মোড়া নীরবতা রমেশচন্দ্র বসু বসে আছেন জানালার ধারে রাখা সেই পুরনো বেতের চেয়ারে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের আলো তার রুপোলি চুলে খেলে যাচ্ছে। মাথার ঠিক পাশেই একটা ছোট কাঠের তাক, সেখানে রাখা তার স্ত্রীর একটা ছবি — মেঘলা শাড়ি, মৃদু হাসি, কপালে ছোট্ট টিপ। নাম ছিল তার — কাবেরী। আজ অনেকদিন পর আবার পোস্টম্যান এসেছিল। লাল-হলুদ ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ। সে বলল, “বসুবাবু, আপনার পেনশনের শেষ চেকটা এসেছে।” রমেশচন্দ্র ধীরে হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। যেন মৃদু এক স্নেহে ছুঁলেন। এই খামে শুধু টাকা নেই, আছে একটা দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা। অফিসের শেষ বেতন মাসেরও বেশি…
-
মৃণাল সেনগুপ্ত ১ শীতের কুয়াশাঘেরা সকাল। কাটিয়াতলা গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে এক চেনা হুইলগাড়ি—লোহার চাকা ঘষটে ঘষটে আওয়াজ তুলছে, আর গাড়ির উপরে বাঁশের ঝুড়ি ভর্তি পুরোনো বইয়ের স্তূপ। হুইলগাড়িটা ঠেলে নিয়ে চলেছে মধু, যাঁর পুরো নাম মধুসূদন পাল—গ্রামেরই সন্তান, বয়স প্রায় পঁইচাল্লিশ, গায়ে সাদা ধুতি, গায়ে উলের পাতলা চাদর, পায়ে ছেঁড়া চটি, আর কাঁধে ঝোলানো একটা ছাপানো কাপড়ের ব্যাগ, যাতে থাকে তার দিনভর খরিদ্দারদের টাকা-পয়সা, খাতা আর তার সবচেয়ে প্রিয় কলমটা। গায়ে যেন একটা শান্ত সুবাস মেখে থাকে মধুর—পুরোনো কাগজের গন্ধ, সময়ের গন্ধ। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা তাকে চেনে, পুকুরের মাছেরা যেন তার গলার আওয়াজ…
-
তিয়াস চক্রবর্তী ১ বটগাছটা ছিল বিশাল, ছায়াময় আর পুরনো। বনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাছটাকে পাখিরা ডাকে “আকাশদ্বার”—যেন তার ডালপালায় সিঁড়ি বেয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়। সেখানে বাস করত রকমারি পাখি—নীল টিয়া, সবুজ বেনেবউ, সোনালি ঘুঘু আর শাদা পায়রা। প্রত্যেকের নিজের গান ছিল, নিজের আভিজাত্য। গাছজুড়ে প্রতিদিন সকালবেলা এক অপূর্ব সঙ্গীতসন্ধ্যা বসত—কারও কণ্ঠে মিষ্টি রাগ, কারও গলায় ঝংকারের ঝরনা। এই সংগীতের মাঝেই বসবাস ছিল একমাত্র সেই পাখিটির—যার গলায় ছিল না কোনো সুর, যার গায়ে ছিল না কোনো রং। তার নাম কেউ নেয় না—সবাই তাকে বলে “ওই কাকটা।” সে নিজে নিজের নাম রেখেছিল কাকু। কাকু কালো, সাধারণ, আর তুচ্ছ—এই তিন অভিধায়…
-
স্নেহাশিষ রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। জাদরেল রোদের আভা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের স্টেশনে। গরম বাতাসে ছিন্ন কাপড়ের মতো ওড়ানো যাচ্ছে না কোনো মন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ৩২ নম্বর লোকাল ট্রেনের কামরায় যেন আগুনের ঢেউ বইছে। সেই উত্তপ্ত কামরার মধ্যে দিয়ে হাঁটছে দশ বছরের একটি ছেলে—হাতে একগুচ্ছ তালপাতার পাখা। ছোট্ট শরীরে ঘাম জমে রেখার মতো গড়িয়ে পড়ছে, তবে চোখে কোনো ক্লান্তি নেই। তার ঠোঁটে এক মৃদু ডাক—“তালপাতার পাখা নিন… গরমে আরাম… পাঁচ টাকায় একখানা…”। প্রতিটি যাত্রীকে দেখে সে যেন কল্পনা করে, কে কিনবে, কে ফিরিয়ে দেবে। কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ তিরস্কার করে—“যাও যাও, বিরক্ত করো না।” তবু সে এগিয়ে যায়।…