অদ্রিতা সেন
পর্ব ১ : নীরবতার প্রথম ফাটল
কলকাতার উত্তর শহরের পুরনো বাড়ি। উঁচু ছাদের ঘর, লাল ইটের দেওয়াল, বারান্দায় শুকোতে দেওয়া সাদা শাড়ি আর মাটির টবে মানিকজোড় তুলসী গাছ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ার ছবি। এই বাড়ির ভেতরেই বাস করে মৈত্র পরিবার। বড়ো ছেলে অনিরুদ্ধ মৈত্র, তার স্ত্রী অনন্যা আর ছোটো ভাই অরিত্র। গল্প শুরু হয় এখান থেকেই।
অরিত্র, পেশায় তরুণ অধ্যাপক। শহরের নামী কলেজে ইতিহাস পড়ান তিনি। মেধাবী, সুদর্শন, আর ভেতরে ভেতরে সংবেদনশীল। বাবা-মা চলে যাওয়ার পর বড়ো ভাই-ই তার অভিভাবক। পরিবারের সকলেই তাকে নিয়ে গর্বিত। অন্যদিকে অনন্যা—অরিত্রর কাকিমা। বয়সে সামান্য বড়ো, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে তাকে সবসময় যেন এক অদৃশ্য শূন্যতায় ডুবে থাকতে দেখা যায়।
অনন্যার বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। অনিরুদ্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল নিছক দায়িত্বের। সংসার চালানো, সামাজিক আচার পালন—সবই ছিল, কিন্তু কোথাও কোনো উষ্ণতা ছিল না। অনন্যা ধীরে ধীরে বুঝেছিলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু ছাদের নিচে একসঙ্গে থাকার নাম নয়, এর মধ্যে আরও কিছু গভীরতা থাকা উচিত। কিন্তু সেই গভীরতা অনিরুদ্ধের কাছে ছিল অচেনা শব্দ।
অন্যদিকে অরিত্র পড়াশোনার জন্য বাইরে চলে গিয়েছিল বহু বছর। সম্প্রতি শহরে ফিরে এসে কলেজে চাকরি শুরু করেছে। সে শহুরে জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, বুঝেছে। কিন্তু মনের ভেতরে একরকম একাকীত্ব সবসময় বাসা বাঁধত। সেই একাকীত্বের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে আবার মুখোমুখি হয় অনন্যার।
দুজনের সম্পর্কের ভিত্তি আসলে ছোটবেলার বন্ধুত্ব। বাড়ির আঙিনায় খেলা, পরীক্ষার প্রস্তুতি, কিংবা সন্ধ্যায় বই পড়া—সবকিছুতেই তারা একে অপরের সঙ্গী ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বন্ধুত্বের রূপ বদলাতে থাকে। একসময় তারা আলাদা হয়ে গেলেও, ভাগ্যের খেলায় আবারও পাশাপাশি এসে দাঁড়াল।
প্রথম ফাটল ধরা পড়ল এক বর্ষার দুপুরে। দুপুরটা ছিল আর্দ্র, আকাশে কালো মেঘ। বাড়ির ছাদে শুকোতে দেওয়া কাপড় হাওয়ায় উড়ছিল। অনন্যা দৌড়ে গিয়ে কাপড় টানছিলেন। হঠাৎ একটা শাড়ি ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে গেল। অনন্যা হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলেন, তখনই পিছন থেকে অরিত্র এগিয়ে এসে শাড়ির এক প্রান্ত আঁকড়ে ধরল। মুহূর্তে দুজনের আঙুল ছুঁয়ে গেল একে অপরকে।
সে এক অদ্ভুত অনুভূতি—যেন ভিজে বাতাস হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। চোখে চোখ পড়তেই শরীর কেঁপে উঠল দুজনের। যেন সমস্ত শূন্যতা, সমস্ত একাকীত্ব গলে গেল সেই এক মুহূর্তের স্পর্শে। অনন্যার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে গেল, যদিও তা সঙ্গে সঙ্গে চাপা দিলেন। অরিত্রও চুপ করে গেল, কিন্তু চোখের ভাষা লুকোনো গেল না।
সেই দিন থেকে দুজনেই বুঝতে পারলেন—সবকিছু আর আগের মতো থাকবে না।
অনন্যা চেষ্টা করলেন দূরত্ব বজায় রাখতে। সংসারের কাজ, রান্নাঘর, আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ—সবকিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন। কিন্তু অরিত্রর উপস্থিতি যেন ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল চারপাশে। তিনি যখন রাতের খাবারের আয়োজন করতেন, অরিত্র টেবিলে বসত আর অনন্যা অজান্তেই খেয়াল করতেন তার প্রতিটি নড়াচড়া।
অন্যদিকে অরিত্রও ক্রমশ বুঝতে লাগল, এই টান সে উপেক্ষা করতে পারবে না। তার ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ জন্ম নিলেও, আকর্ষণের টান আরও প্রবল হয়ে উঠছিল। রাতে একা ঘরে বসে বই পড়ার সময় সে বারবার শুনতে পেত অনন্যার হাসির প্রতিধ্বনি। দিনের বেলা কলেজে পড়াতে গিয়েও মন চলে যেত বাড়ির দিকে।
একদিন সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। অন্ধকারে বাড়ির সব আলো নিভে গিয়েছিল। মোমবাতি আনতে গিয়ে অনন্যার হাত কেঁপে উঠল। অরিত্র তখনই তার হাতটা ধরে ফেলল মৃদু স্বরে বলল—
— “ভয় পাচ্ছেন নাকি?”
অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন—
— “ভয় তো পাচ্ছি না, তবে… এই অন্ধকারে সবকিছুই যেন বদলে যায়।”
অরিত্রর চোখে তখন শুধু অনন্যা। আর অনন্যার চোখে ফুটে উঠল সেই লুকোনো আকাঙ্ক্ষা, যা এতদিন চাপা পড়েছিল।
সেই মুহূর্তেই যেন দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হল। যে সেতু পেরোলেই শুরু হবে এক নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প।
কিন্তু প্রশ্ন ছিল—কীভাবে তারা সেই সেতু পেরোবে? সমাজের চোখ, পরিবারের দায়িত্ব, আত্মীয়তার বাঁধন—সবকিছুই তো তাদের টেনে ধরবে। তবু হৃদয়ের কথা কে আটকাতে পারে?
অনন্যা সেদিন রাতে নিজের ঘরে বসে থাকলেন দীর্ঘক্ষণ। মনের ভেতর অস্থিরতা, অপরাধবোধ, তবু এক অদ্ভুত আনন্দও। যেন কেউ তার ভেতরে আলো জ্বেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে অরিত্র জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছিল। তার চোখে-মুখে ভাসছিল শুধু অনন্যার ছবি। সে জানত, এই টান থেকে আর মুক্তি নেই। যা-ই হোক না কেন, এই অনুভূতিকে অস্বীকার করা যাবে না।
এভাবেই শুরু হল নীরবতার প্রথম ফাটল—যেখান থেকে একদিন ভেঙে পড়বে সমস্ত নিয়মের দেয়াল।
পর্ব ২ : অন্ধকারে জ্বলে ওঠা আলো
সেই রাতের অন্ধকারে মোমবাতির ঝিকিমিকি আলো যে সেতু তৈরি করেছিল, তা আর ভাঙার নয়। অরিত্র আর অনন্যার মধ্যে হঠাৎ তৈরি হয়ে যাওয়া নীরব আকর্ষণ তাদের দুজনকেই অস্থির করে তুলল। অথচ কেউই তা মুখে বলার সাহস পেল না।
অন্যদিনের মতোই সকাল হল। বাড়ির উঠোনে সূর্যের আলো পড়ল, মেঝেতে ছায়ার নকশা আঁকল। অনন্যা সকালের নিত্যকাজে ব্যস্ত। ফুল তোলা, রান্না করা, দুধ গরম করা—সবই চলছিল। বাইরে থেকে দেখলে মনে হত সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অশান্তি ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
অরিত্রও কলেজে যাওয়ার আগে উঠোনে দাঁড়িয়ে কাকিমাকে দেখছিল। চোখ নামিয়ে নিলেই যেন অপরাধবোধ, কিন্তু চোখ তুললেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি। এই টান থেকে মুক্তি নেই—সে জানত।
সকালের নাস্তার টেবিলে তাদের প্রথমবারের মতো একসঙ্গে বসা। অনিরুদ্ধ তখনো বের হয়নি অফিসে। অরিত্র চুপচাপ চা খাচ্ছিল, অনন্যা রুটি পরিবেশন করছিলেন। হঠাৎ অনন্যার হাত থেকে রুটি পড়ে গেল। অরিত্র সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে রুটি তুলল। দুজনের চোখ আবারও মিলল। এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল। অনিরুদ্ধ কাশির শব্দ করে উঠতেই তারা দুজনেই সোজা হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি।
দিনগুলো এভাবেই চলতে লাগল। বাইরের পৃথিবীতে সব স্বাভাবিক, ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল আগুন।
গোপন দৃষ্টি
অরিত্র সন্ধ্যেবেলা কলেজ থেকে ফিরত। অনন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, অজান্তেই। সে আসবে কি না দেখার অজুহাতে। আর অরিত্রও ফিরে এসে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকাতেন বারান্দায়। চোখে চোখ পড়লে দুজনেই চুপ করে যেতেন, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে যেন বজ্রপাত হত।
একদিন বিকেলে, অনিরুদ্ধ বাড়ি ফেরার আগে, অনন্যা বাগানে ফুল তুলছিলেন। অরিত্র বই হাতে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসেছিল। তাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, তবু শব্দহীন সংলাপ চলছিল। অনন্যা ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে হঠাৎ বললেন—
— “বৃষ্টির পর এই ফুলগুলো কতটা টাটকা হয়ে ওঠে, জানো?”
অরিত্র হেসে বলল—
— “হয়তো বৃষ্টি না হলে এরা নিজেদের আসল রঙ দেখাতে পারত না।”
কথাটা শুনেই দুজনেই থেমে গেলেন। মনে হল, কথার ভেতরে লুকিয়ে আছে অন্য মানে। অনন্যার চোখ ভিজে উঠল।
প্রথম সাহস
সেই রাতে বাড়িতে অনিরুদ্ধ ফিরল দেরিতে। অফিসের কাজের অজুহাতে সে প্রায়ই দেরি করত। অনন্যা খাবার গরম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অরিত্র তখন বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘর আবারও অন্ধকারে ঢেকে গেল।
অরিত্র মোমবাতি জ্বালাতে উঠতেই অনন্যা এসে দাঁড়ালেন তার কাছে। দুজনের মুখ খুব কাছে চলে এল। আলো ঝিকিমিকি করছে, আর দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরের গায়ে লেগে যাচ্ছে।
অনন্যা আস্তে বললেন—
— “এভাবে তাকিয়ে থাকো না।”
অরিত্র কণ্ঠ থরথর করে বলল—
— “চাইলেও পারছি না।”
এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। তারপর অনন্যার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। অরিত্র ধীরে ধীরে হাত রাখল তার হাতে। সেই স্পর্শে যেন পৃথিবী কেঁপে উঠল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছিল, ভেতরে দুজনের হৃদয়ের শব্দ আরও জোরে বাজছিল।
তাদের ঠোঁট প্রায় ছুঁয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনই গেটের কড়া নড়ল। অনিরুদ্ধ ফিরে এসেছে। চমকে দুজনেই সরে গেলেন। মোমবাতির আলোতে আবার সব স্বাভাবিক সাজিয়ে তুললেন। অনিরুদ্ধ ভেতরে ঢুকে হেসে বলল—
— “আরে! বিদ্যুৎ নেই বুঝি? ভাগ্যিস, অফিসে এত দেরি হল, নইলে অন্ধকারে বসে থাকতে হত।”
অনন্যা চুপ করে রইলেন, অরিত্রও মুখ নামিয়ে বই পড়তে লাগল। কিন্তু তাদের শরীর তখনো কাঁপছিল।
মনের কাঁপুনি
সেই রাতটা অনন্যা ঘুমোতে পারলেন না। বারবার মনে হচ্ছিল, তিনি একটা সীমা পেরোতে যাচ্ছেন। কিন্তু তার ভেতরের শূন্যতা আর একাকীত্ব যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অরিত্রর দিকে। একদিকে সামাজিক দায়িত্ব, অন্যদিকে অস্বীকার করা যায় না এমন ভালোবাসার টান।
অন্যদিকে অরিত্রও সারা রাত জানালার ধারে বসে থাকল। সে জানত, এই পথ বিপজ্জনক। কিন্তু সেই নিষিদ্ধ অনুভূতি ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
গোপন প্রতিশ্রুতি
পরের দিন সকালে, অরিত্র বই হাতে বারান্দায় বসেছিল। অনন্যা এসে দাঁড়ালেন কাছে। কেউ কিছু বললেন না। শুধু চোখে চোখ রেখেই যেন একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন—
“আমরা যা-ই হোক না কেন, এই অনুভূতিকে অস্বীকার করব না।”
তাদের মধ্যে কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের ভাষা স্পষ্ট।
শেষের ছায়া
এভাবেই শুরু হল অন্ধকারে জ্বলে ওঠা আলো। আলো যা নিষিদ্ধ, তবু অমোঘ। সমাজের নিয়ম, আত্মীয়তার বাঁধন, সবকিছুর ওপরে তারা টের পেলেন—এটাই সত্যি।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—কতদূর তারা যেতে পারবেন? কবে তারা ভেঙে ফেলবেন সমস্ত বাঁধন?
পর্ব ৩ : প্রথম অবাধ্যতা
অনন্যা সারারাত ঘুমোতে পারেননি। বিছানায় শুয়ে থেকেও মনে হচ্ছিল যেন ঘরে ঘন কুয়াশা জমে আছে, তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করলেই দেখা দিচ্ছিল অরিত্রর মুখ। তার চোখের গভীরে যে আকাঙ্ক্ষা অনন্যা দেখেছিলেন, তা এত সহজে মুছে দেওয়া সম্ভব নয়।
সকালের আলো উঠল। বাড়ি ধীরে ধীরে জেগে উঠল। অনিরুদ্ধ যথারীতি ব্যস্ত হয়ে অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে গেলেন তিনি। বাড়ি ফাঁকা হল। তখনই যেন নিঃশ্বাস নিতে পারলেন অনন্যা। অরিত্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছিল। অনন্যা কাপড় শুকোতে দিয়ে দাঁড়ালেন একটু দূরে। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই মনে হল গত রাতের অসম্পূর্ণ আলাপন আবার শুরু হল নীরবে।
গোপন আড্ডা
দুপুরের ভাত খাওয়ার পর অরিত্র নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ অনন্যা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। কণ্ঠস্বর নিচু—
— “একটু ছাদে যাবে?”
অরিত্র চমকে তাকাল। ভেতরে উত্তেজনা আর ভয় মিশে গেল। তবু মাথা নেড়ে রাজি হল।
ছাদে তখন দুপুরের রোদ নরম। হাওয়া বইছে হালকা। দূরে কোথাও ভিজে মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। অনন্যা রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়ালেন, অরিত্র পাশে এসে দাঁড়াল।
— “তুমি জানো তো, এভাবে কারও সঙ্গে কথা বলাটা ঠিক নয়,” অনন্যা বললেন।
— “জানি,” অরিত্র উত্তর দিল, “কিন্তু যদি সত্যিই মনে হয় এটাই ঠিক?”
অনন্যা চুপ করে গেলেন। হাওয়ায় তার চুল উড়ছিল। অরিত্রর মনে হল, এত সুন্দর তিনি আগে কখনো দেখেননি।
নিষিদ্ধ স্পর্শ
একটি মুহূর্ত আসে, যখন সমস্ত বাঁধন ভেঙে যায়। অরিত্র ধীরে ধীরে অনন্যার হাত ধরল। অনন্যা সরে যেতে চাইলেন, কিন্তু পারেননি। হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন উল্টো করে। যেন অনেকদিনের তৃষ্ণা মিটল। দুজনের চোখে জল এসে গেল, অথচ ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি।
— “আমাদের এভাবে করা উচিত নয়,” অনন্যা ফিসফিস করলেন।
— “কিন্তু তুমি কি সত্যিই চাও আমি তোমার কাছ থেকে দূরে থাকি?” অরিত্রর গলা থরথর করছিল।
উত্তর এল না। উত্তর না দেওয়াই যেন উত্তর।
অচিরেই পায়ের শব্দ শুনে তারা চমকে গেলেন। বাড়ির কাজের মেয়েটি ছাদে উঠেছে কাপড় গুছোতে। তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিলেন দুজনে। কিন্তু সেই এক মুহূর্তের স্পর্শ শরীর জুড়ে জ্বালিয়ে দিল আগুন।
প্রথম অবাধ্যতার স্বাদ
রাত নামল। অনিরুদ্ধ আবারও দেরি করে ফিরলেন। অনন্যা বসেছিলেন ডাইনিং টেবিলে, খাবার গরম করা। অরিত্র এসে চুপচাপ পাশে দাঁড়াল। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই বুঝলেন, আজ আর ফাঁকি দেওয়া যাবে না।
অরিত্র আস্তে বলল—
— “তুমি যদি বলো, আমি সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি।”
অনন্যা ভয় পেয়ে তাকালেন। — “চুপ করো! এসব মুখে বোলো না। দেয়ালও শুনে ফেলতে পারে।”
— “আমি ভয় পাই না,” অরিত্র বলল, “আমি শুধু জানি, তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।”
সেদিন রাতে তারা প্রথমবার একসঙ্গে অনেকক্ষণ কাটালেন। একে অপরের পাশে বসে শুধু কথা বললেন। কোনো সীমা লঙ্ঘন করলেন না, তবু মনের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল। সেই রাত ছিল তাদের প্রথম অবাধ্যতা—যেখানে সমাজের নিয়ম ভেঙে তারা নিজের সত্যিকারের অনুভূতিকে স্বীকার করে নিলেন।
অস্থিরতা ও অপরাধবোধ
কিন্তু প্রতিটি আনন্দের সঙ্গেই জন্ম নেয় ভয়। অনন্যার মনে হচ্ছিল, তিনি এক অদ্ভুত সীমানায় দাঁড়িয়ে আছেন। একদিকে সংসার, দায়িত্ব, সমাজ—অন্যদিকে এই নিষিদ্ধ প্রেম।
তিনি বারবার ভাবছিলেন, যদি কারও চোখে পড়ে যায়? যদি অনিরুদ্ধ বুঝে ফেলে? তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ মনের ভেতরের আকর্ষণ থামানো যাচ্ছে না।
অরিত্রও দ্বিধায় ছিল। কলেজে ক্লাস নিতে গিয়ে মন পড়ে থাকত বাড়িতে। ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়েও সে দেখতে পেত অনন্যার মুখ। রাতে বই খুললেও অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে যেত।
গোপন বার্তা
একদিন অরিত্র অনন্যার ঘরে ঢুকল, যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে। টেবিলের উপর একটা ছোটো চিরকুট রেখে গেল। তাতে লেখা—
“আমরা কি সারাজীবন ভয় পেয়েই কাটাব? নাকি একদিন সত্যিটাকে বেছে নেব?”
পরদিন সকালে অনন্যা চিরকুটটা পড়ে দীর্ঘক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন। তাঁর চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি। তিনি জানতেন, আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়।
আলোর নিচে ছায়া
সেই বিকেলে আবার তারা ছাদে দেখা করলেন। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। আকাশ লালচে। অরিত্র অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল—
— “তুমি কি ভেবেছো, যদি সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়?”
অনন্যা মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন—
— “তাহলে আমাদের পুড়ে মরতে হবে, অরিত্র। কিন্তু এই আগুন নিভবে না।”
দুজনেই চুপ করে রইলেন। বাতাসে পাখির ডাক ভেসে আসছিল, দূরে শঙ্খ বাজছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, যেন পৃথিবীর সব শব্দ মিলে তাদের নিষিদ্ধ সম্পর্ককে সাক্ষী দিচ্ছে।
শেষ দৃশ্য
সেদিন রাতে অনন্যা আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। নিজের চোখে তাকালেন। মনে হল, এই চোখ আর তার নয়। এই চোখে নতুন আগুন জ্বলে উঠেছে।
অন্যদিকে অরিত্র জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, অন্ধকার যত ঘন হবে, আলো তত জ্বলে উঠবে।
এভাবেই শুরু হল তাদের প্রথম অবাধ্যতা—শব্দহীন স্বীকারোক্তি, গোপন চিরকুট, আর সেই অদম্য আকর্ষণ যা থামানো অসম্ভব।
পর্ব ৪ : ছায়ার ভেতরে আগুন
ছাদের সেই আলাপন যেন চিরকালের জন্য বদলে দিল তাদের সম্পর্ক। আগুন একবার জ্বলে উঠলে আর নিভিয়ে রাখা যায় না—সেটাই বুঝতে পারলেন অনন্যা আর অরিত্র। কিন্তু আগুন যেমন আলো দেয়, তেমনই ভস্মও করে।
দিনের ছদ্মবেশ
বাড়ির ভেতরে সবকিছু বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখাত। অনিরুদ্ধ তার মতো অফিস করতেন, অনন্যা সংসার সামলাতেন, আর অরিত্র কলেজে যেতেন প্রতিদিন। কিন্তু এই স্বাভাবিকতার আড়ালে ক্রমশ জমে উঠছিল গোপন অস্থিরতা।
অনন্যা লক্ষ্য করছিলেন, রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁর চোখ বারবার চলে যায় অরিত্রর ঘরের দিকে। কাপড় ভাঁজ করতে করতে মনে হত, সে যদি এসে পেছন থেকে কথা বলে ওঠে! অরিত্রও একই অবস্থায় ছিলেন। ছাত্রদের ক্লাস নিতে গিয়েও তার মনে চলত অনন্যার হাসি, অনন্যার চোখের ভিজে দৃষ্টি।
দিনের বেলা তারা দূরত্ব বজায় রাখতেন। কিন্তু রাত নামলেই বাড়ির ভেতরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা জমতে লাগত।
অশরীরী সেতু
একদিন সন্ধ্যায় অনিরুদ্ধ বাইরে গিয়েছিলেন অফিসের সহকর্মীর বাড়িতে। বাড়ি ফাঁকা। অনন্যা বারান্দায় গাছের টবগুলোতে জল দিচ্ছিলেন। অরিত্র নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন তাঁর পেছনে।
— “এভাবে কাছে আসা উচিত নয়,” অনন্যা বললেন, জল ঢালতে ঢালতে।
— “তাহলে কেন তুমি থামাচ্ছ না?” অরিত্রর গলায় কাঁপুনি।
অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখে চোখ মেলালেন। সেই চোখের ভেতরে অদ্ভুত টান, যেন কত বছর ধরে জমে থাকা নদীর জল একসঙ্গে ছুটে আসছে।
অরিত্র হাত বাড়িয়ে দিল। অনন্যা কিছু বললেন না, শুধু হাতটা ধরে ফেললেন। সেই স্পর্শে শরীর জ্বলে উঠল আগুনে। তারা জানতেন, এ আগুন নিষিদ্ধ, তবু এ আগুনই তাদের বাঁচিয়ে রাখছে।
প্রথম ভাঙন
কিছুদিন পরেই পাড়ায় দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হল। বাড়িতে অতিথি আসা-যাওয়া বাড়ল। অনন্যা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নানা কাজে। তবুও চোখে চোখ পড়লেই থমকে যেতেন দুজনেই। ভিড়ের মধ্যে থেকেও এক অদ্ভুত সেতু তৈরি হত তাদের মাঝে।
একদিন সন্ধ্যায় পুজোর আলো দেখতে দেখতে অনন্যা ফিসফিস করে বললেন—
— “এই ভিড়ের মধ্যে থেকেও আমার মনে হচ্ছে আমরা দুজনেই একা।”
অরিত্র উত্তর দিল—
— “কারণ আমরা দুজনেই লুকিয়ে আছি। আলোয় দাঁড়িয়েও ছায়ার ভেতর আটকে আছি।”
কথাগুলো শুনে অনন্যার শরীর কেঁপে উঠল। হঠাৎ তাঁর মনে হল, সমাজ, পরিবার, নিয়ম—সবই এক অদৃশ্য খাঁচা। আর সেই খাঁচার ভেতরেই তারা দুজন একসঙ্গে আটকে আছেন।
গোপন মুহূর্ত
এক রাতে অনিরুদ্ধ অফিস ট্যুরে বেরিয়ে গেলেন। বাড়িতে কেবল অনন্যা আর অরিত্র। সেই রাত যেন ভাগ্যের লিখে দেওয়া পরীক্ষা।
ডাইনিং টেবিলে বসে তারা একসঙ্গে খাচ্ছিলেন। বাতাসে এক অদ্ভুত টান। খাবার প্রায় স্পর্শই করেননি কেউ। হঠাৎ অরিত্র থালা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে অনন্যার দিকে এগিয়ে গেল।
অনন্যার বুক কাঁপছিল। তিনি বললেন—
— “না, অরিত্র… এভাবে পারব না।”
অরিত্র থেমে গেলেন।
— “তাহলে আমাকে এভাবে দগ্ধ হয়ে বাঁচতে বলছো?”
অনন্যার চোখে জল চলে এল। তিনি মাথা নিচু করলেন। আর সেই মুহূর্তেই অরিত্র তাঁর হাত ধরে ফেলল। টেবিলের ওপর রাখা মোমবাতির আলোয় দুজনের হাত জড়িয়ে গেল।
এবার অনন্যা আর সরে গেলেন না। বরং ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালেন অরিত্রর চোখে। সেখানে যা দেখলেন, তা আর অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, অস্থিরতা—সব মিলেমিশে এক অগ্নিস্রোত।
তাদের ঠোঁট ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগল। চারপাশে কেবল ঘড়ির টিকটিক শব্দ। তারপর এক মুহূর্তে ভেঙে গেল সব বাঁধন। তারা প্রথমবার সীমা অতিক্রম করলেন।
অপরাধ আর মুক্তি
সেই রাতে তারা দুজনেই বুঝলেন, আর ফেরার পথ নেই। একদিকে অপরাধবোধ গ্রাস করছিল অনন্যাকে—স্বামীকে ঠকানোর অপরাধ, সমাজের চোখে অপরাধ। কিন্তু অন্যদিকে তিনি অনুভব করলেন এক অভূতপূর্ব মুক্তি। বহু বছরের শূন্যতা যেন ভরে উঠল এক মুহূর্তে।
অরিত্রর ভেতরেও দ্বন্দ্ব চলছিল। কিন্তু অনন্যার পাশে শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, এটাই জীবনের সত্যি। সমাজের নিয়ম, সম্পর্কের বাঁধন—সবই মিথ্যে। সত্যি কেবল এই মুহূর্ত।
ভোরের আলো
ভোরে যখন অনিরুদ্ধ ফেরার জন্য ট্রেন ধরলেন দূর শহর থেকে, অনন্যা তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাতের অগ্নিদগ্ধ শরীর এখনও জ্বলছিল। চোখের নিচে কালি, কিন্তু ঠোঁটে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
অরিত্র এসে দাঁড়ালেন তাঁর পাশে। নিঃশব্দে বললেন—
— “তুমি কি অনুতপ্ত?”
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
— “অনুতপ্ত হলে কি সম্ভব হত অরিত্র? আমি জানি, আমরা পাপ করেছি সমাজের চোখে। কিন্তু আমার ভেতরে যে শূন্যতা ছিল, তা আজ পূর্ণ হয়েছে।”
অরিত্র ধীরে ধীরে তাঁর হাত ধরলেন।
— “তাহলে আমরা আর লুকোব না।”
অনন্যা অবাক হয়ে তাকালেন।
— “তুমি কি বুঝতে পারছো, এটা কত বড় ঝুঁকি?”
— “ঝুঁকি না নিলে আলো পাওয়া যায় না,” অরিত্র দৃঢ়স্বরে বললেন।
সমাপ্তি
সেদিন থেকে তাদের জীবনে শুরু হল নতুন অধ্যায়। তারা জানতেন, ছায়ার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, তা একদিন প্রকাশ পাবে আলোয়।
কিন্তু আলোয় দাঁড়ালে আগুন কি কেবল উষ্ণতা দেবে? নাকি সবকিছু ভস্ম করে দেবে? সেই প্রশ্নের উত্তর তখনও তারা পাননি।
তবু একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—
“যা-ই ঘটুক, আমরা আর পিছিয়ে যাব না।”
পর্ব ৫ : মুখোশের আড়ালে
পাঁচ দিনের অফিস ট্যুর শেষে যখন অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরলেন, বাড়ির পরিবেশ তখন অদ্ভুতভাবে শান্ত। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানো, ঘরদোর পরিষ্কার, অনন্যার মুখে স্বাভাবিক হাসি। যেন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অথচ বাস্তবে গত পাঁচ দিনে এমন এক অগ্নি ঝড় বয়ে গিয়েছে, যার ছাই এখনও ভেতরে ভেতরে ধুঁকছে।
অরিত্র সেদিন কলেজ থেকে দেরি করে ফিরল। মনে হচ্ছিল, যেন সচেতনভাবে সময় মেপে আসছে। মুখে সেই আগের মতো সৌজন্যপূর্ণ ভদ্রতা, কাকিমার সঙ্গে চোখাচোখি হলে কেবল এক চিলতে নীরবতা। বাইরে থেকে সবই স্বাভাবিক, কিন্তু চোখে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল এক অনাবিষ্কৃত অস্থিরতা।
দ্বৈত জীবন
এখন তাদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন অভিনয়। অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরলে তারা তিনজন টেবিলে একসঙ্গে খেতেন। আলোচনার বিষয় হতো কলেজ, অফিস, পাড়ার খবর। অনন্যা মাঝে মাঝে হাসতেন, অরিত্র মৃদু গলায় উত্তর দিত। কিন্তু দুজনের চোখের গভীরে চলত অন্য সংলাপ—যা কেউ দেখতে পেত না।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো এ এক সুশৃঙ্খল সংসার। কিন্তু ভেতরে জমে উঠছিল গোপন ঝড়।
আড়ালের মুহূর্ত
একদিন দুপুরে অনিরুদ্ধ ঘুমোচ্ছিলেন। অরিত্র নিজের ঘরে বই পড়ছিল। অনন্যা হালকা পায়ে এসে দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই অরিত্র বই নামিয়ে রাখল। অনন্যা ভেতরে ঢুকে গেলেন।
— “সব ঠিক আছে তো?” অনন্যার গলায় কাঁপুনি।
— “তুমি থাকলে সব ঠিক হয়ে যায়,” অরিত্র উত্তর দিল ধীরে।
দুজনেই জানতেন, এই মুহূর্ত বিপজ্জনক। কিন্তু দূরত্ব রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। অনন্যা হাত বাড়িয়ে দিলেন, অরিত্র ধরে ফেলল। বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত নামল। ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে কাশির শব্দ। অনিরুদ্ধ জেগে উঠেছেন। ভয়ে কেঁপে উঠলেন দুজনেই। দ্রুত দূরে সরে গেলেন।
আয়নার সামনে
সেই রাত অনন্যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে কাজল মাখতে মাখতে হঠাৎ মনে হল, তিনি যেন অপরিচিতা। এই চোখ, এই ঠোঁট—সবকিছুই যেন নতুন। যাকে তিনি আগে চিনতেন, সে আর নেই। এই রূপে লুকিয়ে আছে অপরাধ, আকাঙ্ক্ষা, আবার মুক্তিও।
নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখে ফিসফিস করে বললেন—
— “আমি কি তবে অন্যায় করছি? নাকি অবশেষে নিজের সত্যিকে বেছে নিচ্ছি?”
আয়নার ওপারে উত্তর ছিল না, শুধু মৃদু বিদ্রূপের হাসি।
সন্দেহের বীজ
পরদিন অনিরুদ্ধ অফিসে যাওয়ার আগে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন—
— “তুমি কদিন যেন অন্যরকম লাগছো। ক্লান্ত? নাকি অসুস্থ?”
অনন্যা চমকে উঠলেন। ঠোঁটে জোর করে হাসি এনে বললেন—
— “না তো, সব ঠিক আছে।”
কিন্তু সেই মুহূর্তে বুঝলেন, খেলা আর সহজ নেই। মুখোশ যতই নিখুঁত হোক, একদিন না একদিন ফাঁক ধরা পড়বেই।
গোপন বার্তা
সন্ধ্যায় অরিত্র নিজের বইয়ের ভেতরে গুঁজে দিল ছোট্ট কাগজ। অনন্যার হাতে এসে পৌঁছল তা। লেখা ছিল—
“আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। আমরা কি সারাজীবন মুখোশ পরে বাঁচব?”
চিঠি পড়ে অনন্যার বুক কেঁপে উঠল। তিনি জানতেন, সত্যিই আর বেশিদিন আড়াল করে থাকা যাবে না।
দুর্ঘটনা
সেই সপ্তাহেই ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অনিরুদ্ধ অফিস থেকে ফেরার পথে সিঁড়ি ভেঙে পড়ে গেলেন। হাঁটুর চোট, কয়েকদিন বিছানায় বিশ্রাম নিতে হবে। হঠাৎ করে বাড়ির পরিবেশ আরও টানটান হয়ে উঠল।
অনন্যা তখন দিনের বেশিরভাগ সময় স্বামীর পাশে বসে থাকতেন, ওষুধ খাওয়াতেন। অরিত্র বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক রাখলেও ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল। দুজনের চোখে চোখ পড়ার সুযোগও ছিল না প্রায়। যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে।
কিন্তু মানুষের হৃদয়কে কি আটকানো যায়? অনিরুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়লেই অনন্যা অরিত্রর ঘরের দিকে তাকাতেন। অরিত্রও অজুহাত খুঁজে বারান্দায় আসত। দূর থেকে চোখের সঙ্কেতই ছিল তাদের একমাত্র আলাপ।
দমবন্ধ অস্থিরতা
এক রাতে অনিরুদ্ধ গভীর ঘুমে। অনন্যা চুপচাপ উঠে দাঁড়ালেন। দরজা টিপটো করে খুলে অরিত্রর ঘরের দিকে গেলেন। অরিত্র তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে দেখে অনন্যা ধীরে ফিসফিস করলেন—
— “আমি আর পারছি না। এই মুখোশে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
অরিত্র এগিয়ে এসে তাঁর হাত ধরল। চোখে চোখ রেখে বলল—
— “তাহলে এবার সত্যিটাকে বেছে নাও।”
অনন্যার চোখে জল ভেসে উঠল।
— “কিন্তু সব ভেঙে যাবে অরিত্র।”
— “হোক না। অন্তত আমরা ভেতরে আর ভাঙা ভাঙা থাকব না।”
দুজনের ঠোঁট মিলে গেল সেই মুহূর্তে। বাইরের পৃথিবী তখন গভীর অন্ধকারে ঢাকা। কেবল তাদের ভেতরের আগুনই আলোকিত করে দিল চারপাশ।
শেষ প্রশ্ন
সকালে অনিরুদ্ধ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন—
— “অরিত্র, তুমি কি কখনো অন্য কোথাও যেতে চাইবে? নতুন শহরে, নতুন কলেজে?”
অরিত্র থমকে গেল। অনন্যার বুক ধড়ফড় করে উঠল। সন্দেহ কি তবে শিকড় গেড়ে বসছে?
অরিত্র শান্ত গলায় উত্তর দিল—
— “এখানেই তো ভালো আছি, দাদা।”
অনিরুদ্ধ কিছু বললেন না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
সমাপ্তি
এভাবেই প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তারা কাটাচ্ছিলেন মুখোশের আড়ালে। বাইরের মানুষদের কাছে নিখুঁত সংসার, ভেতরে নিষিদ্ধ প্রেমের আগুন।
কিন্তু আগুন কি চিরকাল আড়ালে রাখা যায়?
তাদের দুজনের জীবন এখন এক সুতোর উপর ঝুলছে। যে কোনো মুহূর্তে মুখোশ খুলে পড়তে পারে, আর তখনই বেরিয়ে আসবে সত্যের নগ্ন আলো।
পর্ব ৬ : উন্মোচনের সঙ্কেত
শরতের ভোর। বাতাসে কাশফুলের গন্ধ, দূরে কোথাও শঙ্খ বাজছে। অনন্যা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে অদৃশ্য হাসি। গত কয়েক সপ্তাহে জীবনের গতি এমনভাবে বদলে গেছে যে নিজেকেই চিনতে পারছিলেন না। আগে তিনি ছিলেন নিস্তেজ, দমবন্ধ এক সংসারের স্ত্রী। এখন তিনি এক নিষিদ্ধ প্রেমের শরিক, যার প্রতিটি মুহূর্ত বিপদের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
অদৃশ্য সন্দেহ
অনিরুদ্ধ হাঁটুর ব্যথার কারণে এখনও অফিসে যেতে পারছেন না। সারাদিন বাড়িতে বসে বই পড়েন, সংবাদপত্র ওল্টান। মাঝে মাঝে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন—
— “তুমি কেমন যেন বদলে গেছো অনন্যা। চোখে অদ্ভুত আলো দেখছি।”
অনন্যা হাসি চেপে রাখেন, কিন্তু বুক কেঁপে ওঠে। তিনি জানেন, এই আলো ম্লান করা অসম্ভব। অরিত্রর চোখে চোখ পড়লেই যে আগুন জ্বলে ওঠে, তা লুকোনো যায় না।
অন্যদিকে অরিত্রও সতর্ক। কলেজে সময় বাড়িয়ে দেওয়া, বাড়ি ফেরার সময় এড়িয়ে চলা—সবই কৌশল। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনন্যার ঘরের দিকে একবার তাকাতে না পারলে মনে হয় জীবন থেমে গেছে।
চিঠির ঝড়
এক বিকেলে বইয়ের ভেতর থেকে একটি চিঠি এসে পড়ল অনিরুদ্ধর হাতে। অরিত্র অসাবধানতায় রেখে দিয়েছিল। চিঠির উপরে লেখা ছিল— “আমরা কি সারাজীবন আড়ালে থাকব?”
অনিরুদ্ধ কপাল কুঁচকালেন। ভ্রূ কুঁচকে চিঠি পড়লেন। লেখা খুব স্পষ্ট কিছু নয়, তবু প্রশ্ন জেগে গেল। তিনি চুপ করে কাগজটা গুছিয়ে রাখলেন ড্রয়ারের ভেতর।
সেদিন রাতে অনিরুদ্ধ অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন—
— “তুমি কি আমাকে কিছু লুকোচ্ছো?”
অনন্যা চমকে উঠলেন, তবু ঠোঁটে হাসি টেনে বললেন—
— “তুমি এসব কী বলছো? আমি কেন লুকোব?”
অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ স্ত্রীর চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
গোপন আলাপন
রাত গভীর হলে অনন্যা চুপিচুপি গিয়ে দাঁড়ালেন অরিত্রর ঘরের দরজায়। চোখে ভয় আর আকাঙ্ক্ষার ছাপ। অরিত্র দরজা খুলতেই তিনি ফিসফিস করে বললেন—
— “চিঠিটা তুমি কীভাবে ফেলে এলে? দাদা পেয়ে গেছে।”
অরিত্র থমকে গেল। — “সে কিছু বলেছে?”
— “না, শুধু প্রশ্ন করেছে। আমি সামলে দিয়েছি।”
অরিত্র তাঁর হাত শক্ত করে ধরল। — “আমাদের সাবধান হতে হবে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। তুমি আছো তো।”
অনন্যা জানতেন, অরিত্রর আত্মবিশ্বাসই তাঁর আশ্রয়। তবু ভেতরে ভেতরে ভয় গ্রাস করছিল।
দুর্গাপুজোর ভিড়
পাড়ায় দুর্গাপুজো শুরু হল। আলো, ঢাক, ভিড়, আনন্দ। বাড়ির ছাদ থেকে নিচের মাঠে তাকিয়ে ছিলেন অনন্যা। পাশে এসে দাঁড়াল অরিত্র। ভিড়ের মধ্যে থেকেও মনে হচ্ছিল, দুজন আলাদা এক জগতে আছেন।
— “দেখছো, সবাই কতটা মুক্ত?” অনন্যা বললেন।
— “কিন্তু আমরাই সবচেয়ে বন্দি,” অরিত্র উত্তর দিল।
চোখে চোখ মেলামাত্রই বোঝা গেল, মুখোশ আর বেশিদিন টিকবে না।
অপ্রত্যাশিত সঙ্কেত
একদিন রাতে অনিরুদ্ধ ড্রয়ারের ভেতর থেকে আবার চিঠিটা বের করলেন। এবার আলোতে বসে দীর্ঘক্ষণ পড়ে রইলেন। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, কেবল ভেতরে কিছু জমছিল। অনন্যা তা টের পেলেন।
সকালে তিনি হঠাৎ বললেন—
— “অরিত্র, তোমার কি অন্য কোথাও পোস্টিং নিতে ইচ্ছে করছে না? কলেজ বদলানো সম্ভব হলে ভালো হতো।”
ঘরে থমথমে নীরবতা নেমে এল। অনন্যা বুঝলেন, সন্দেহ এখন কেবল অদৃশ্য নয়, বাস্তব আকার নিচ্ছে।
বিদ্রোহের শপথ
সেই রাতেই অনন্যা আর অরিত্রর গোপন সাক্ষাৎ। অরিত্রর গলায় রাগ আর যন্ত্রণা—
— “সে কি আমাদের আলাদা করে দিতে চাইছে? আমি যাব না, শুনছো? আমি এখানেই থাকব।”
অনন্যার চোখ ভিজে উঠল। — “যদি সত্যি ফাঁস হয়ে যায়?”
— “তাহলে আমরা লড়ব। অন্তত মিথ্যে মুখোশ পরে আর বাঁচব না।”
তাদের ঠোঁট আবারও মিশে গেল। এই চুম্বন ছিল আর্তি, প্রতিজ্ঞা আর বিদ্রোহের মিশ্রণ।
সংকীর্ণ দেয়াল
কিন্তু বাড়ির দেয়াল যেন এখন আরও কাছে এসে দাঁড়াচ্ছিল। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছিল অনিরুদ্ধ। তাঁর চোখে যেন অদৃশ্য সন্দেহের ছায়া।
অনন্যা বুঝলেন, সময় আর বেশি নেই। আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে, শিগগিরই তা ছড়িয়ে পড়বে।
ভোরের আতঙ্ক
ভোরে অনিরুদ্ধ হঠাৎ অরিত্রর ঘরে ঢুকে পড়লেন। বইয়ের তাক ঘেঁটে দেখতে লাগলেন। অরিত্র চমকে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলল না। অনিরুদ্ধ কেবল বললেন—
— “সতর্ক থেকো, অরিত্র। সবকিছুই চোখে পড়ে।”
অরিত্রর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তিনি জানলেন, খেলা শেষের দিকে এগোচ্ছে।
সমাপ্তি
উন্মোচনের সঙ্কেত স্পষ্ট। অনিরুদ্ধের চোখ এখন আগের মতো নিরীহ নেই। সেখানে সন্দেহের আঁচ। অনন্যা আর অরিত্র জানেন, একদিন মুখোশ খুলে পড়বেই। প্রশ্ন কেবল—তারা আগে নিজেই সত্যি স্বীকার করবে, নাকি সমাজ তাদের নগ্ন করে দেবে?
পর্ব ৭ : পতনের প্রারম্ভ
বাড়ির আঙিনায় শিউলি ফুটেছে। শরতের বাতাসে ভেসে আসছে তার মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু এই সৌন্দর্যের ভেতরেও অনন্যা আর অরিত্রর বুকের ভেতর চলছিল অস্থির ঝড়। অনিরুদ্ধর চোখের দৃষ্টি এখন আর আগের মতো ছিল না। সেখানে প্রতিদিন একটু একটু করে সন্দেহ জমছিল, আর সেই সন্দেহই তাদের চারপাশে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করছিল।
অস্বস্তির নৈশভোজ
এক সন্ধ্যায় তিনজন একসঙ্গে খেতে বসেছিলেন। ডাইনিং টেবিলে ভাত, মাছের ঝোল, ডাল সাজানো। অনিরুদ্ধ খাবারের মাঝে হঠাৎ বললেন—
— “অরিত্র, শুনলাম কলেজে তোমাকে অন্য শহরে বদলি করার প্রস্তাব এসেছে।”
অরিত্র থমকে গেল। — “হ্যাঁ, কিন্তু আমি রাজি হইনি।”
অনিরুদ্ধ ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন। — “কেন রাজি হওনি? নতুন অভিজ্ঞতা হতো।”
ঘরে হিম নেমে এল। অনন্যা হাত থামিয়ে তাকালেন অরিত্রর দিকে। তাদের চোখের মিলনে অনিরুদ্ধ কিছুটা উত্তর পেয়ে গেলেন। তিনি চুপ করে আবার ভাত খেতে লাগলেন। কিন্তু নিস্তব্ধতার ভেতরে শিউলি ফুলের গন্ধও তখন বিষের মতো লাগছিল।
সমাজের দেয়াল
পাড়ায় হঠাৎ কানাঘুষো শুরু হল। কারা যেন বলছিল—“মৈত্র বাড়িতে সব ঠিক আছে তো? কাকিমা আর ভাসুরের মধ্যে অদ্ভুত সখ্য।”
এই ফিসফিসানি কানে আসতে দেরি হল না অনিরুদ্ধর। তিনি বাইরে গিয়ে তর্কে জড়াননি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কঠিন হয়ে উঠলেন।
অনন্যা জানতেন, সমাজের দেয়াল একবার ভেঙে পড়লে কেউ আর রক্ষা করতে পারবে না। তাই তিনি অরিত্রকে বারবার বলছিলেন—
— “আমাদের আরও সাবধান হতে হবে।”
কিন্তু অরিত্র বলত—
— “সাবধান থাকতে থাকতে তো জীবনটাই ফুরিয়ে যাবে। আমরা কি চিরকাল বন্দি থাকব?”
গোপন সাক্ষাৎ
রাত নামলেই তারা গোপনে দেখা করতেন। কখনও ছাদে, কখনও বারান্দায়। অন্ধকারের আড়ালে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতেন। প্রতিটি স্পর্শ ছিল বিদ্রোহের মতো, প্রতিটি চুম্বন ছিল দুঃসাহসের মতো।
এক রাতে অনন্যা বললেন—
— “আমি বুঝি না, অরিত্র। এত অন্যায়ের পরও তোমার চোখে এত সাহস কোথা থেকে আসে?”
অরিত্র তাঁর চুলে হাত বুলিয়ে বলল—
— “কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। পাপ হোক বা না হোক, এটাই আমার সত্যি।”
অনন্যার চোখ ভিজে উঠল। — “কিন্তু আমি ভয় পাই। সবকিছু ভেঙে গেলে?”
— “তাহলে ভেঙে যাক,” অরিত্র দৃঢ় স্বরে বলল। — “আমরা অন্তত মুখোশ পরে বাঁচব না।”
সন্দেহের ছায়া
এক রাতে অনিরুদ্ধ আচমকা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অনন্যা তখন অরিত্রর সঙ্গে কথা বলছিলেন, ফিসফিস করে। শব্দ হয়তো তাঁর কানে যায়নি, কিন্তু দৃশ্য চোখ এড়াল না।
— “এত রাতে বারান্দায়?” অনিরুদ্ধ প্রশ্ন করলেন স্ত্রীর দিকে।
অনন্যা কেঁপে উঠলেন। — “গরম লাগছিল, তাই…”
অরিত্র তৎক্ষণাৎ যোগ করল—“আমিও বই পড়ছিলাম, একটু বাতাস খেতে বেরোলাম।”
অনিরুদ্ধ আর কিছু বললেন না, শুধু ভেতরে ঢুকে গেলেন। কিন্তু তাঁদের বুক কেঁপে উঠল। তাঁরা বুঝলেন, এবার আর সময় বেশি নেই।
পতনের প্রথম ফাটল
পরদিন সকালে অনিরুদ্ধ অরিত্রকে ডাকলেন।
— “তোমার আর আমার মধ্যে সবসময়ই বন্ধুত্ব ছিল। তুমি আমার ছোট ভাই, আমি তোমার অভিভাবক। কিন্তু মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে কোনোভাবে প্রতারিত করছো।”
অরিত্র স্তব্ধ। মুখে কিছু বলতে পারল না। অনিরুদ্ধর কণ্ঠস্বর তখন শান্ত, অথচ ভয়ংকর—
— “মনে রেখো, মিথ্যে বেশিদিন টেকে না।”
এই কথাগুলো কানে গিয়ে বাজল কামানের শব্দের মতো।
ছাদের ঝড়
সেদিন রাতে আবার ছাদে দেখা হল অনন্যা আর অরিত্রর। হাওয়া বইছিল জোরে। আকাশে মেঘ জমেছে।
অনন্যা কেঁদে ফেললেন। — “সব শেষ হয়ে যাবে, অরিত্র। আমি জানি।”
অরিত্র তাঁর মুখ দু’হাতে ধরে বলল— “শেষ হলেও তাতে কী? অন্তত আমরা একসঙ্গে থাকব।”
তাদের চোখে ভেসে উঠল বিদ্রোহের ঝলক। কিন্তু তারা জানতেন, এই বিদ্রোহের মূল্য ভয়ংকর।
চিঠির খাম
দু’দিন পর অনিরুদ্ধ ডাকবাক্স থেকে একটি খাম পেলেন। ভেতরে পাড়ার কারও লেখা চিঠি—
“আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার ভাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে পুরো পাড়া কথা বলছে। আপনি যদি কিছু না করেন, একদিন সব প্রকাশ পাবে।”
চিঠি পড়ে অনিরুদ্ধের মুখের রঙ বদলে গেল। চোখে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।
সমাপ্তি
পতনের প্রারম্ভ ঘটে গেছে। অনিরুদ্ধ এখন নীরব আগ্নেয়গিরি, যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে। অনন্যা আর অরিত্র জানেন, আর লুকোনো সম্ভব নয়।
তাদের নিষিদ্ধ প্রেমের আগুন এখন শিউলি ফুলের সুগন্ধে ঢাকা থাকলেও, একদিন এই আগুন ছাই করে দেবে সবকিছু।
পর্ব ৮ : বিস্ফোরণের আগমুহূর্ত
চিঠিটা অনিরুদ্ধর হাতে এসে পড়ার পর বাড়ির ভেতরের বাতাস বদলে গেল। তিনি কিছুই বলেননি, কিন্তু তাঁর চোখের স্থির দৃষ্টি যেন ঘরে ঘরে ছায়া ফেলছিল। অনন্যা বুঝতে পারছিলেন—এ নীরবতা আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। অরিত্রর বুকও ধড়ফড় করছিল প্রতিটি মুহূর্তে।
নিস্তব্ধ টানাপোড়েন
ডাইনিং টেবিলে তিনজন একসঙ্গে বসে খাচ্ছিলেন। অনিরুদ্ধ নীরব। অনন্যা সাধ্যমতো স্বাভাবিক থাকতে চাইছিলেন, কিন্তু হাত কাঁপছিল। অরিত্র চুপচাপ ভাত মুখে তুলছিল। হঠাৎ অনিরুদ্ধ বললেন—
— “অরিত্র, তুমি কি ভাবো না, নতুন কলেজে গেলে তোমার ক্যারিয়ার আরও ভালো হবে?”
অরিত্র গলা শক্ত করে উত্তর দিল—
— “না দাদা, আমি এখানেই ভালো আছি।”
অনিরুদ্ধ কেবল হেসে মাথা নাড়লেন। সেই হাসির ভেতরেই ছিল হিমশীতল হুমকি।
সমাজের চাপ
পাড়ায় গুজব বাড়ছিল। কারও চোখে চোখ রাখলেই অনন্যার মনে হচ্ছিল, তারা সব জানে। বাজারে গেলে মহিলাদের ফিসফিসানি শুনতে পেতেন—“ওঁদের বাড়িতে কিছু একটা চলছে।”
এইসব কথা কানে আসত অরিত্ররও। কলেজে সহকর্মীরাও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেছিল। ভেতরে ভেতরে সবাই হয়তো কিছু টের পাচ্ছিল।
অনন্যার দ্বন্দ্ব
রাতে শুয়ে শুয়ে অনন্যা ভাবতেন—“আমি কি ভুল করছি? স্বামীকে ঠকিয়ে অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছি। কিন্তু এই সম্পর্ক ছাড়া আমি কি বাঁচতে পারতাম?”
অরিত্রর স্মৃতি তাঁকে কাঁপিয়ে দিত। তাঁর স্পর্শ, তাঁর কথা, তাঁর চোখের আগুন—এসব ছাড়া জীবন কল্পনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিবার অনিরুদ্ধর মুখ মনে পড়লেই অপরাধবোধে বুক ভেঙে যেত।
অরিত্রর বিদ্রোহ
অরিত্র এক রাতে স্পষ্ট বলল—
— “আমরা আর লুকোতে পারব না, অনন্যা। সব ফাঁস হোক। আমি চাই সবার সামনে বলি—আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
অনন্যা আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন।
— “তুমি কি জানো, তার পরিণতি কী হবে? সমাজ আমাদের পুড়িয়ে মারবে।”
অরিত্রর গলায় দৃঢ়তা—
— “আমি মরতে রাজি, কিন্তু মিথ্যে মুখোশ পরে বাঁচতে রাজি নই।”
অনিরুদ্ধর খেলা
একদিন সকালে অনিরুদ্ধ হঠাৎ বললেন—
— “আজ রাতে বাইরে ডিনার করব, তিনজনে মিলে। অনেকদিন একসঙ্গে কোথাও বেরোনো হয়নি।”
অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন দুজনেই। কিন্তু রাজি না হওয়ার উপায় ছিল না। সেদিন রাতে রেস্তোরাঁয় গিয়ে অনিরুদ্ধ দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন—
— “মানুষের সম্পর্ক খুব অদ্ভুত। কেউ কাছে থেকেও দূরে থাকে, কেউ দূরে থেকেও কাছে। তাই না?”
অরিত্র আর অনন্যা চুপ করে রইলেন। কথা যেন ধারালো ছুরির মতো এসে বিঁধছিল। অনিরুদ্ধ মুখে হাসি রেখে খাচ্ছিলেন, কিন্তু চোখে ছিল ঝড়।
বিস্ফোরণের ইঙ্গিত
বাড়ি ফিরে রাত গভীর হলে অনিরুদ্ধ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলেন। অনন্যা দূর থেকে দেখছিলেন। তাঁর চোখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, তিনি সব জেনে গেছেন।
অরিত্র নিজের ঘরে হাঁটাহাঁটি করছিল। বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলছিল। যদি অনিরুদ্ধ মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করেন, কী উত্তর দেবে?
ছাদের সাক্ষাৎ
সেই রাতে আবার ছাদে দেখা করলেন অনন্যা আর অরিত্র। আকাশে মেঘ, দূরে বজ্রপাত।
অনন্যা বললেন—
— “আমাদের শেষ হয়ে যাবে, অরিত্র। আমি টের পাচ্ছি।”
অরিত্র তাঁর কাঁধে হাত রাখল। — “যদি শেষ হয়, একসঙ্গেই শেষ হোক।”
তাদের ঠোঁট মিলল বৃষ্টির ভেজা অন্ধকারে। দুজনেই জানতেন, এ চুম্বন হয়তো শেষ শান্তির মুহূর্ত।
সন্দেহের বিস্তার
পরের দিন অনিরুদ্ধ হঠাৎ বললেন—
— “অনন্যা, তোমার চোখে আমি এমন কিছু দেখি যা আগে দেখিনি। তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
অনন্যা স্থির থাকতে পারলেন না। চোখ নামিয়ে নিলেন। অনিরুদ্ধ কোনো উত্তর পেলেন না, তবুও তাঁর মনে দৃঢ় হল সন্দেহ।
সমাপ্তি
সবকিছু এখন বিস্ফোরণের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। অনিরুদ্ধর নীরব দৃষ্টি, পাড়ার গুজব, অনন্যা আর অরিত্রর অস্থির আকর্ষণ—সব মিলিয়ে পরিবেশ যেন এক অগ্নিগর্ভ।
প্রশ্ন কেবল, প্রথম বিস্ফোরণ ঘটবে কার হাতে? অনিরুদ্ধ নিজে মুখ খুলবেন, নাকি সমাজ আগুন ধরাবে?
পর্ব ৯ : সত্যের মুখোমুখি
শরতের শেষ বিকেল। আকাশে রঙিন মেঘ, পাড়ায় পূজোর কোলাহল শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। অথচ মৈত্র বাড়ির ভেতরে যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। এই নীরবতা ছিল আসন্ন ঝড়ের মতো, যেটা সবাই অনুভব করছিল, কিন্তু কেউ উচ্চস্বরে বলছিল না।
অনিরুদ্ধর নীরব দৃষ্টি
সেই সন্ধ্যায় অনিরুদ্ধ হঠাৎ ড্রইংরুমে ডাকলেন দুজনকে। চোখে কোনো রাগ নেই, কিন্তু অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর চাহনিতে।
— “তোমরা দুজন আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো না তো?”
প্রশ্নটা ছিল সরাসরি। অনন্যার বুক ধড়ফড় করে উঠল। ঠোঁট শুকিয়ে গেল। তিনি কিছু বলতে পারলেন না। অরিত্রর বুকেও চাপ পড়ল ভীষণ। তবু সে শান্ত গলায় বলল—
— “না দাদা, এমন কিছু নয়।”
অনিরুদ্ধ দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, যেন মনের ভেতর দিয়ে খুঁজে নিচ্ছেন সত্যিটা। তারপর ধীরে ধীরে উঠে ঘরে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর এই নীরবতা ভয়ংকর হয়ে উঠল।
ভেতরের অস্থিরতা
অনন্যা সেই রাতে ঘুমোতে পারলেন না। বারবার মনে হচ্ছিল, আর ফাঁকি দেওয়া যাবে না। অনিরুদ্ধ সব বুঝে গেছেন। অরিত্রর মুখ মনে পড়তেই বুক কেঁপে উঠছিল। তিনি জানতেন, এ প্রেম তাঁর সত্যি, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর পাপও।
অন্যদিকে অরিত্র নিজের ঘরে পায়চারি করছিলেন। মনে হচ্ছিল, সব শেষ হয়ে যাবে একদিনেই। তবু ভেতরে ভেতরে একটা শক্তি জেগে উঠছিল—‘সত্যিটা একবার প্রকাশ হোক, মিথ্যের বোঝা আর বইতে পারছি না।’
মুখোমুখি প্রথম সঙ্কেত
পরদিন সকালে অনিরুদ্ধ হঠাৎ বললেন—
— “আজ সন্ধ্যায় আমাদের তিনজনের দরকারি কথা আছে। খাবার শেষে ড্রইংরুমে আসবে।”
অনন্যার পা ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি জানলেন, আজ হয়তো সত্যি প্রকাশ পাবে।
অরিত্রর চোখে তখন দৃঢ়তা। সে মনে মনে ঠিক করল—যা-ই হোক, মিথ্যে বলবে না।
ড্রইংরুমের অগ্নিপরীক্ষা
সন্ধ্যায় টেবিলে খাবার শেষ হল নিস্তব্ধতায়। তারপর তিনজন বসে পড়লেন ড্রইংরুমে। জানালার বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ভেতরে নিস্তব্ধতা।
অনিরুদ্ধ প্রথমে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। — “অনন্যা, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
প্রশ্নটা ছুরির মতো এসে বিঁধল। অনন্যা চোখ নামিয়ে ফেললেন। ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু কোনো উত্তর এল না।
তারপর অনিরুদ্ধ তাকালেন অরিত্রর দিকে। — “তুমি কি আমার ভাই, নাকি আমার শত্রু?”
অরিত্র বুক চিতিয়ে বসে রইল। — “আমি মিথ্যে বলব না দাদা। আমি অনন্যাকে ভালোবাসি।”
ঘরে বজ্রপাত নামল। অনন্যা চোখ বড় বড় করে তাকালেন। অনিরুদ্ধর মুখ লাল হয়ে উঠল, কিন্তু তিনি বিস্ময়করভাবে শান্ত রইলেন।
সত্যের নগ্নতা
অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন—
— “আমি জানতাম। তোমাদের চোখে দেখে বুঝেছিলাম। সমাজ এখন যা-ই বলুক, তোমরা ইতিমধ্যেই সব ভেঙে ফেলেছো।”
অনন্যা কাঁদতে কাঁদতে বললেন—
— “আমাকে ক্ষমা করো। আমি চেষ্টা করেছি সবকিছু সামলাতে, কিন্তু পারিনি। আমি বহুদিন ধরে শূন্য ছিলাম। অরিত্র আমার সেই শূন্যতা পূরণ করেছে।”
অরিত্র অনন্যার হাত শক্ত করে ধরে বলল—
— “হ্যাঁ দাদা, আমি স্বীকার করছি। আমি এই সম্পর্ক থেকে পিছিয়ে আসতে পারব না।”
অনিরুদ্ধ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর চোখে যন্ত্রণা, রাগ, আবার অদ্ভুত এক ক্লান্তি।
ভেঙে পড়া সম্পর্ক
— “তোমরা জানো, এটা সমাজের চোখে পাপ। আত্মীয়তার চোখে পাপ। কিন্তু আমি একা লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি চাই না আর এই বাড়িতে মিথ্যে মুখোশ থাকুক।”
এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পদক্ষেপের শব্দ যেন মৃত্যুর ঘণ্টার মতো বাজছিল ঘরে।
অনন্যা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। অরিত্র তাঁকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু দুজনেই জানলেন, তাদের জীবনে আর শান্তি নেই।
সমাজের বিচার
কিছুদিনের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ায় আর গোপন কিছু থাকল না। বাজারে, মন্দিরে, পাড়ার আড্ডায়—সর্বত্র আলোচনার ঝড়।
“মৈত্র বাড়িতে লজ্জার কাণ্ড!”
“ভাসুর আর বৌদি একসঙ্গে!”
এই তিরস্কার সহ্য করা যাচ্ছিল না অনন্যার। তিনি দরজা বন্ধ করে দিন কাটাতেন। কিন্তু অরিত্রর চোখে তখনও দৃঢ়তা। সে বলত—
— “আমরা সত্য বেছে নিয়েছি, অনন্যা। এই পথ সহজ নয়, কিন্তু এটাই আমাদের জীবন।”
শেষ দৃশ্য
এক রাতে অনন্যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে কান্নার ছাপ, কিন্তু ঠোঁটে অদ্ভুত শান্তির রেখা। তিনি নিজের প্রতিচ্ছবিকে বললেন—
— “আমি আর লুকোব না। আমি অরিত্রকে ভালোবাসি। এর জন্য সমাজ আমাকে দোষী করুক, আমি তবু নিজের সত্যি থেকে সরে আসব না।”
অরিত্র এসে তাঁর পেছনে দাঁড়াল। দুজনের চোখে মিলল প্রতিজ্ঞার আগুন।
বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। হাওয়ায় জানালার কাচ কাঁপছে। ঘরের ভেতরে দুই মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন সত্যের নগ্ন আলোয়।
পর্ব ১০ : ছাই থেকে যে আগুন বাঁচে
বাড়ির ভেতর ঝড় বয়ে গেছে। সত্যিটা প্রকাশের পর মৈত্র পরিবারের আকাশে আর কোনো মুখোশ রইল না। সমাজের চোখে অনন্যা আর অরিত্র এখন কলঙ্কিত। অনিরুদ্ধ নীরব, অথচ সেই নীরবতার ভেতরে লুকিয়ে আছে অগ্নিকাণ্ড। তবু দুজনেই জানতেন—এখন আর ফেরার পথ নেই।
সমাজের বিচারে
কিছুদিনের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পাড়ার আড্ডায়, বাজারে, আত্মীয়স্বজনের ঘরে—সর্বত্র তাদের নাম টেনে গুজব ছড়াতে লাগল।
“কাকিমা আর ভাসুর! এ কেমন লজ্জা?”
“এমন কলঙ্ক কি সহ্য করা যায়?”
অনন্যা বাইরে বেরোলে মহিলারা চোখে চোখ রাখতেন না। কেউ কেউ কানে কানে বিদ্রূপ করত। অরিত্র কলেজে গেলেও সহকর্মীরা ফিসফিস করত। ছাত্ররা আড়চোখে তাকাত।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা, অরিত্র ভেঙে পড়ল না। সে বরং আরও দৃঢ় হল।
— “যারা কথা বলছে, তারা আমাদের জীবন জানে না, অনন্যা। তারা বোঝে না আমরা কী যন্ত্রণা পেয়েছি।”
অনন্যা অশ্রুসজল চোখে বলতেন—
— “তবু এই বিদ্রূপ সহ্য করা দুঃসহ।”
অরিত্রর কণ্ঠ দৃঢ় থাকত—
— “সহ্য করতে হবে। কারণ আমরা নিজেদের সত্যিটা বেছে নিয়েছি।”
অনিরুদ্ধর সিদ্ধান্ত
অনিরুদ্ধ একদিন ডাকলেন দুজনকে। তাঁর চোখে ছিল ক্লান্তি।
— “তোমরা যদি একসঙ্গে থাকতে চাও, আমি বাধা দেব না। কিন্তু এই বাড়িতে তোমাদের সঙ্গে আর আমার থাকা সম্ভব নয়।”
শব্দগুলো বজ্রপাতের মতো বাজল। অনন্যার বুক কেঁপে উঠল। তিনি বললেন—
— “তুমি চাইলে আমি চলে যাব একাই।”
কিন্তু অরিত্র দৃঢ় গলায় উত্তর দিল—
— “না, আমরা একসঙ্গে যাব। যদি মরতেও হয়, আমরা মরব একসঙ্গে।”
অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লেন। — “আমি আর কিছু বলতে চাই না। সমাজ তোমাদের ক্ষমা করবে না, আমি-ও পারব না। তবে তোমরা যদি মনে করো এটাই সত্যি, তবে তোমাদের জন্য এ বাড়ির দরজা বন্ধ।”
ঘরছাড়া
পরদিন ভোরে অরিত্র আর অনন্যা গুছিয়ে নিলেন কিছু কাপড়চোপড়। অনন্যা শেষবারের মতো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালেন। তুলসী গাছ, শুকোতে দেওয়া কাপড়, লাল ইটের দেওয়াল—সবই তাঁর পরিচিত। তবু তিনি জানলেন, আর ফিরে আসা হবে না।
অরিত্র পাশে এসে বলল—
— “চলো। নতুন জীবন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। — “নতুন জীবন, না নতুন শাস্তি?”
অরিত্র মৃদু হেসে বলল—
— “যত শাস্তিই হোক, আমি তোমার সঙ্গে থাকলে তা সহ্য করব।”
নতুন আশ্রয়
তারা শহরের অন্য প্রান্তে এক ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে উঠলেন। চারপাশে অপরিচিত মুখ, অপরিচিত গলি। এখানে কেউ তাদের অতীত জানে না। প্রথমদিকে মনে হল যেন মুক্তি মিলেছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাটাতে লাগলেন দিন।
কিন্তু সমাজের চোখ থেকে চিরকাল পালানো যায় না। কিছুদিনের মধ্যেই খবর পৌঁছে গেল নতুন মহল্লাতেও। বাজারে গেলে ফিসফিসানি শুরু হল, বাড়িওয়ালা সন্দেহভরে তাকাল।
অনন্যা ক্লান্ত হয়ে বললেন—
— “কোথাও কি আমরা শান্তি পাব না, অরিত্র?”
অরিত্র উত্তর দিল—
— “শান্তি নয়, আমরা শুধু সত্যি পেয়েছি। সেটাই যথেষ্ট।”
ভেতরের দ্বন্দ্ব
তবু রাতে অনন্যা প্রায়ই কেঁদে ফেলতেন। স্বামীর মুখ, সমাজের বিদ্রূপ, আত্মীয়দের তিরস্কার তাঁকে তাড়া করত। তিনি অরিত্রর বুকে মুখ লুকিয়ে বলতেন—
— “আমি কি ভুল করেছি?”
অরিত্র তাঁর চুলে হাত বুলিয়ে বলত—
— “ভুল নয়। তুমি শুধু নিজের হৃদয়ের কথা শুনেছো। সমাজ বুঝুক বা না বুঝুক, এটাই তোমার মুক্তি।”
শেষ সংঘর্ষ
একদিন হঠাৎ অনিরুদ্ধ এসে হাজির হলেন নতুন বাড়িতে। তাঁর চোখে ছিল যন্ত্রণা, কিন্তু রাগও।
— “তোমরা কি সত্যিই ভেবেছো সমাজ এভাবে মেনে নেবে? আত্মীয়স্বজন তোমাদের নাম নিতে কুণ্ঠা বোধ করছে। আমি রাস্তায় বেরোলে লোকে বিদ্রূপ করে। তোমরা আমার সম্মান ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলে।”
অনন্যা কাঁদতে কাঁদতে বললেন—
— “ক্ষমা করো। আমি আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না।”
অরিত্র এগিয়ে এসে বলল—
— “আমি অনন্যাকে ছাড়ব না, দাদা। তোমার চোখে আমি অপরাধী, সমাজের চোখেও। কিন্তু আমি সত্যি ছেড়ে মিথ্যে বাঁচতে চাই না।”
অনিরুদ্ধ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি যেন বলে গেল—‘তোমরা ছাই থেকে আগুন তুলেছো, কিন্তু সে আগুন তোমাদেরও ভস্ম করবে।’
সময়ের আগুন
দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। সমাজের অবজ্ঞা, আত্মীয়দের তিরস্কার, চারপাশের বিদ্রূপ—সবই তাদের সহ্য করতে হচ্ছিল। তবু তারা একসঙ্গে ছিলেন। এই একসঙ্গে থাকার মধ্যেই তারা খুঁজে পেতেন বাঁচার শক্তি।
অনন্যা একদিন বললেন—
— “আমরা কি ভুলে গেছি, একসময় আমরা লুকিয়ে বেঁচে থাকতাম? এখন অন্তত আমরা খোলাখুলি আছি। যদিও সবাই ঘৃণা করছে, তবু আমরা একে অপরকে লুকোতে হচ্ছে না।”
অরিত্রর চোখে আলো জ্বলে উঠল। — “হ্যাঁ, আমরা ছাই থেকে জন্ম নেওয়া আগুন। এই আগুন সমাজ নিভিয়ে ফেলতে পারবে না।”
সমাপ্তি
বছর ঘুরল। তাদের চারপাশে এখনও গুজব, বিদ্রূপ, অপমান। কিন্তু অনন্যা আর অরিত্র জানলেন—সত্যি বেছে নেওয়ার মূল্যই এই। সমাজ হয়তো তাদের ক্ষমা করবে না, কিন্তু তারা নিজেদের অন্তরকে আর অস্বীকার করেননি।
এক শীতের সকালে অনন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোদে ভিজছিলেন। অরিত্র এসে পাশে দাঁড়াল। দুজনের চোখে মিলল এক শান্তির ঝিলিক। সমাজের চোখে তারা অপরাধী, কিন্তু একে অপরের চোখে তারা ছিল মুক্ত।
অনন্যা ধীরে বললেন—
— “আমরা কি তবে জিতলাম?”
অরিত্র মৃদু হাসল। — “হয়তো জিতিনি, হয়তো হেরেছি। কিন্তু একে অপরকে পেয়েছি—এটাই সত্যি।”
বাইরে তখন হাওয়ায় শুকোতে দেওয়া কাপড় উড়ছিল। অনেকটা সেই প্রথম দিনের মতো—যেদিন আঙুল ছুঁয়ে গিয়েছিল আঙুলে। সেদিন থেকে শুরু হওয়া আগুন আজও নিভেনি। ছাইয়ের তলায় লুকিয়ে থাকা সেই আগুনই তাদের জীবনের আসল সত্যি।
শেষ




