Bangla - রহস্য গল্প

যমুনা বাগানের গোপন পথ

Spread the love

প্রিয়ম চক্রবর্তী


শরতের শেষ ভাগ, আকাশে তুলোর মতো ভাসমান মেঘ আর বাতাসে ধানের গন্ধ মিশে আছে। কলকাতার ইতিহাসবিদ অনিন্দ্য মুখার্জী ও তাঁর স্ত্রী সায়ন্তী ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে, যেখানে স্থানীয় কলেজে আয়োজিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও লোককথা নিয়ে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হবে অনিন্দ্যকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন্তী ক্যামেরা হাতে ধানক্ষেত, নদীর ধারে চরাচর, আর মাটির ঘরের ছবি তুলছিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের সরলতা সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ রাখে, আর অনিন্দ্যর কাছে লোককথা মানে ইতিহাসের ভেতরে লুকোনো এক অদেখা দরজা। সেমিনার ভেন্যুটি ছিল গ্রামপঞ্চায়েত ভবনের বড় হলঘর, যেখানে বাঁশের মাচা দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, কাগজের রঙিন ফুলে সাজানো। দুপুরের পর আলোচনার ফাঁকে স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ মানুষ অনিন্দ্যের কাছে এসে গল্প করছিলেন—কারও কাছে জমিদারি আমলের স্মৃতি, কারও কাছে স্বাধীনতার আগে ইংরেজদের অত্যাচারের কাহিনি। কিন্তু ঠিক বিকেল চারটের দিকে, সাদা শাড়ি পরা, চুলে রুপোলি আভা নিয়ে এক বৃদ্ধা ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে অনিন্দ্যের কাছে এসে দাঁড়ালেন। পাশে গ্রামের এক তরুণ পরিচয় করিয়ে দিলেন—তিনি রাজমণি দেবী, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা। তাঁর চোখে যেন বহু বছরের স্মৃতি জমাট বেঁধে আছে, কণ্ঠে অদ্ভুত এক গভীরতা। রাজমণি দেবী খুব সরল ভঙ্গিতে বললেন, “আপনি ইতিহাস লেখেন তো? তাহলে যমুনা বাগানের গল্প শোনেন—ওই গল্প কেবল ইতিহাস নয়, ওটা এক অভিশাপও।”
কথাটি বলেই তিনি ধীরে ধীরে বর্ণনা করতে শুরু করলেন। গ্রামের এক প্রান্তে, তালগাছ-জামগাছের সারির ওপারে, ধ্বংসপ্রায় এক প্রাচীন জমিদার বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে—যার পেছনে রয়েছে যমুনা বাগান। এক সময় এই বাগান নাকি ছিল রূপকথার মতো সুন্দর; মৌসুমী ফুল, বিরল গাছ, আর মাঝখানে এক পুকুর, যেখানে পদ্ম ফুটত সারা বছর। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে, পূর্ণিমার রাতে জমিদারের একমাত্র কন্যা অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁর খোঁজ মেলেনি, শুধু বাগানের মাঝখান থেকে ভেসে আসত অদ্ভুত আলো। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে, সেই রাত থেকেই বাগানে এক ‘গোপন পথ’ আছে—যেটা কেবল পূর্ণিমার রাতে খোলে। এই পথে ঢুকলে কেউ আর ফিরে আসে না। কেউ বলে, জমিদারের কন্যার আত্মা ওই পথে অপেক্ষা করে, কেউ বলে, সেখানে এমন এক অন্ধকার কক্ষ আছে যা মানুষকে গিলে নেয়। অনিন্দ্য মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, মাঝে মাঝে ছোট নোটবুকে কিছু শব্দ লিখে নিচ্ছিলেন—“পূর্ণিমা”, “আলো”, “গোপন পথ”—যেন এগুলো একদিন বড় ছবির অংশ হয়ে উঠবে। সায়ন্তীও চুপচাপ শুনছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে ছিল অন্যরকম ঝিলিক—এক ফটোগ্রাফারের তীব্র কৌতূহল, এই জায়গাটি একবার দেখেই ছবি তুলতে হবে। রাজমণি দেবী বললেন, “যদি দেখতে চান, আসবেন, কিন্তু রাতের বেলায় নয়। রাতের বেলায় ওখানে মানুষ যায় না।” কথার শেষে তাঁর কণ্ঠে এক অদ্ভুত শীতলতা ভেসে উঠল, যা অনিন্দ্যের মনে কেমন একটা শিহরণ জাগাল।
সন্ধ্যা নামার আগেই সেমিনারের পর অনিন্দ্য ও সায়ন্তী হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ওই প্রান্তের দিকে গেলেন। দূরে বড় বড় গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে লাল সূর্যের আলো পড়ছিল, বাতাসে শীতের আগমনী সুর। যমুনা বাগান তখনও অনেকটা দূরে, কিন্তু সেখান থেকে যেন হালকা কুয়াশার মতো কিছু ভেসে আসছিল। গ্রামের একজন তরুণ, কুন্তল সরকার, যিনি স্থানীয় পত্রিকায় লেখেন, তাদের দেখে এগিয়ে এসে জানালেন—তিনি বহুবার বাগানের ছবি তুলতে গেছেন, কিন্তু প্রতিবারই কিছু না কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে; ক্যামেরা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, বা ছবিতে এমন ছায়া ধরা পড়েছে যা চোখে দেখা যায়নি। কুন্তল বলল, “এখানকার বুড়োরা বলে ওই বাগান একসময় অন্য এক দুনিয়ায় যাওয়ার দরজা ছিল।” সায়ন্তী তখন মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “তাহলে হয়তো আমি ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের ছবিও তুলতে পারব।” কিন্তু অনিন্দ্য খুব গম্ভীর স্বরে বললেন, “লোককথা আর ইতিহাসের ফারাক আছে, তবে মাঝে মাঝে ওরা মিলেমিশে যায়।” সেই মুহূর্তে, রাজমণি দেবীর কথা আবার মনে পড়ে গেল—অভিশাপ, গোপন পথ, আর পূর্ণিমার রাত। তাদের কেউ তখনও বুঝতে পারেনি, এই গল্পই শীঘ্রই তাদের এমন এক অদ্ভুত যাত্রায় টেনে নেবে, যেখান থেকে ফেরার পথও রহস্যের অন্ধকারে ঢাকা থাকবে।
পরদিন দুপুরে, গ্রামের মাঝখান থেকে সরু কাঁচা রাস্তা ধরে অনিন্দ্য ও সায়ন্তী পায়ে হেঁটে যমুনা বাগানের দিকে রওনা দিলেন। তাঁদের সাথে ছিলেন হরিপদ দত্ত—শুকনো চেহারা, কুঞ্চিত মুখ, চোখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য, আর মাথায় পুরনো সাদা গামছা বাঁধা। তাঁর হাতে বাঁশের লাঠি, যা দিয়ে তিনি মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুর কিংবা ছাগলকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। রোদ তেজি হলেও শরতের হালকা বাতাসে চলা সহজ লাগছিল। গ্রামের বাড়িগুলো একে একে পেছনে পড়ে গেল, আর চোখের সামনে ধীরে ধীরে উঁকি দিল বড় বড় শিরীষ, শিমুল আর বটগাছের সারি। হরিপদ নীরবভাবে পথ দেখাচ্ছিলেন, মাঝে মাঝে শুধু বলছিলেন—“এই গাছটা একশো বছরেরও পুরনো” বা “ওই পুকুর এক সময় জমিদারের অতিথিদের জন্য ছিল।” কিন্তু যখনই বাগানের নাম আসছিল, তাঁর গলায় যেন এক চেপে রাখা শঙ্কার সুর শোনা যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর বাঁকের মুখে হঠাৎ সবুজের ভিড়ে উঁকি দিল এক লোহার ফটক—জং ধরা, আধখোলা, যার গায়ে শ্যাওলা জমে সবুজাভ হয়ে গেছে। ফটকের ওপারে প্রথম দেখা গেল যমুনা বাগানের ভেতরের অংশ—লম্বা দালানের ধ্বংসাবশেষ, মাটিতে গড়িয়ে পড়া পাথরের মূর্তি, আর চারপাশে ঘন গাছের ছায়া। দিনের আলো থাকা সত্ত্বেও ভেতরে যেন সূর্যের রোদ খুব কম পৌঁছায়, আর বাতাসে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ভাসছিল, যা পুরনো বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময় পাওয়া যায়।
ফটক পেরিয়ে ভেতরে পা দেওয়ার মুহূর্তেই সায়ন্তীর চোখে ধরা পড়ল নানা রঙের অদ্ভুত বুনোফুল, যাদের মধ্যে কিছু তিনি আগে কখনও দেখেননি। মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুকনো পাতা আর ভাঙা টালি, যেন এখানে বহু বছর ধরে কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেনি। অনিন্দ্য নোটবুক বের করে চারপাশের স্থাপত্য লক্ষ্য করছিলেন—জমিদারি আমলের খিলান, খোদাই করা পাথরের স্তম্ভ, আর ভাঙা সিঁড়ি যেগুলো কোথাও গিয়ে শেষ হয় না। মাঝেমাঝি একটি প্রাচীন পুকুর, যার জলে পদ্মপাতা ভেসে আছে, কিন্তু জল সবুজাভ ও ঘোলা, যেন বহুদিন ধোয়া হয়নি। পুকুরের ধারে কয়েকটি পুরনো মূর্তি, কিছু ভেঙে গেছে, কিছু শ্যাওলায় ঢাকা। সায়ন্তী ক্যামেরা তুলে ছবি তুলতে শুরু করলেন—মূর্তির ক্ষয়, গাছের গায়ে অদ্ভুত দাগ, আর মাটিতে অচেনা আকারের খাঁজ। তিনি লক্ষ্য করলেন, ভেতরের বাতাস যেন অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা, যা বাইরের তেজি রোদের সাথে একেবারেই মিলছে না। অনিন্দ্য সায়ন্তীর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “তুমি কি খেয়াল করেছ? এখানে ঢোকার পর থেকে পাখির ডাক বন্ধ হয়ে গেছে।” সত্যিই, বাগানের বাইরে গ্রামাঞ্চলের চিরচেনা কাক, শালিক, দোয়েল—সব মিলিয়ে গানের মতো আওয়াজ ছিল, কিন্তু এখানে কেবল হাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হরিপদ এই সময়ে ধীরে ধীরে তাঁদের কাছে এসে বললেন, “দিনের বেলা যা খুশি দেখুন, কিন্তু পূর্ণিমার রাতে এখানে থাকবেন না—সেই আলো দেখতে পাওয়া মানেই বিপদ।”
হরিপদের সতর্কবাণী শুনে সায়ন্তী কৌতূহলী হাসি দিলেও অনিন্দ্যের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। হরিপদ বললেন, পঞ্চাশ বছর আগে জমিদারের কন্যা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বাগান আর আগের মতো নেই। পূর্ণিমার রাতে মাঝখানের পুকুরপাড়ে আলো জ্বলে ওঠে, আর তারপর মাটির তল থেকে এক সিঁড়ি নেমে যায় অজানা গভীরে। কেউ কেউ চেষ্টা করেছে দেখতে, কিন্তু ফেরেনি। গ্রামের লোকেরা তাই পূর্ণিমার রাতে বাগানের দিকেও তাকায় না। সায়ন্তী তখন বললেন, “হয়তো এগুলো শুধু গল্প, পুরোনো বাড়ির গোপন কক্ষ বা ভাণ্ডারের রহস্য।” কিন্তু হরিপদ একদম দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “আমি এখানে ছোট থেকে আছি, যা দেখেছি তা গল্প নয়—সেদিনের পর থেকে আমি পূর্ণিমার রাতে এই বাগান এড়িয়ে চলি।” তাঁর চোখে যে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছিল, তা সায়ন্তীরও অস্থির করে তুলল। অনিন্দ্য মনে মনে ঠিক করলেন, এই জায়গা ও এর গল্প তাঁকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাবে। দিনের বেলায় যমুনা বাগান যতই মনোরম লাগুক, পুরনো গাছের ছায়া, ভাঙা মূর্তি, আর হাওয়ায় ভাসমান শীতলতার মধ্যে যেন লুকিয়ে ছিল এমন এক নিঃশব্দ ডাক, যা তারা তখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি—কিন্তু শিগগিরই যার উত্তর খুঁজতে হবে।
সন্ধ্যার পর গ্রামের হাটের ভিড় কমে এলে কুন্তল সরকার তাঁদের ডেকে নিয়ে গেল নিজের ছোট্ট ঘরে, যা একইসাথে তাঁর অফিস ও ঘুমানোর জায়গা। বাঁশ ও মাটির দেয়ালের ঘর, কোণে পুরনো কাঠের টেবিল, তার ওপরে ছড়ানো সংবাদপত্রের কাগজ, হাতে লেখা নোট, আর একপাশে ধুলো ধরা ট্রাঙ্ক। কুন্তল একটা কেরোসিন বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের পাশে বসালেন অনিন্দ্য ও সায়ন্তীকে, তারপর ট্রাঙ্ক খুলে ভেতর থেকে ধীরে ধীরে কিছু পুরনো ফাইল বের করলেন। “এগুলো আমার দাদুর সময়ের সংগ্রহ,” কুন্তল বলল, “তিনি ছিলেন পত্রিকার সংবাদদাতা। পঞ্চাশ বছর আগে যমুনা বাগান নিয়ে খবর বেরিয়েছিল, আর সেই সব কাগজ এখনও আমার কাছে আছে।” অনিন্দ্য কাগজগুলো হাতে নিয়ে সাবধানে উল্টে দেখতে লাগলেন—মলিন অক্ষরে লেখা শিরোনাম চোখে পড়ল: ‘জমিদার বাড়ির কন্যা অদৃশ্য’, ‘পূর্ণিমার রাতে রহস্যময় আলো’, ‘যমুনা বাগানে আতঙ্ক’। এক প্রতিবেদনে লেখা ছিল, জমিদারের কন্যা চন্দ্রিমা দেবী ছিলেন অত্যন্ত রূপবতী ও শিক্ষিতা। গ্রামের অনেকে বলত, তিনি প্রায়ই বাগানের পুকুরপাড়ে রাত জেগে বসে থাকতেন, কারো জন্য অপেক্ষা করতেন বলে। নিখোঁজ হওয়ার রাতে তাঁকে শেষবার দেখা গিয়েছিল এক সাদা শাড়ি পরা অবস্থায়, হাতে একটি চিঠি নিয়ে, যা কখনো পাওয়া যায়নি। সেই রাতের পরই, গ্রামের কয়েকজন দাবি করেন যে তারা পুকুরের মাঝখানে এক জ্বলজ্বলে আলোর বৃত্ত দেখেছেন, আর সঙ্গে শোনা গেছে অদ্ভুত গুঞ্জনময় শব্দ। এই ঘটনাই পরবর্তী কালে গোপন পথের কাহিনির জন্ম দেয়।
কুন্তল এরপর জমিদার পরিবারের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া কিছু দলিল বের করলেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল জমিদার হরিনারায়ণ রায়ের নাম, তাঁর বিপুল জমিজমা, ও কলকাতার নবাবি মহলে তাঁর প্রভাবের কথা। কিন্তু তাঁর একমাত্র কন্যা চন্দ্রিমার রহস্যময় অন্তর্ধান পরিবারের ওপর এক স্থায়ী ছায়া ফেলেছিল। লোকমুখে প্রচলিত আছে, জমিদারের প্রাসাদের তলায় বহু গোপন কক্ষ ও পথ ছিল—ব্রিটিশদের চোখ এড়িয়ে ধনরত্ন লুকিয়ে রাখার জন্য বানানো। কেউ কেউ বলে, চন্দ্রিমা সেই গোপন পথ ব্যবহার করেই পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনও কারণে আটকা পড়েন বা প্রাণ হারান। এক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত ছিল, চন্দ্রিমার প্রেমিক ছিলেন গ্রামের এক তরুণ কবি, যিনি জমিদারের বিরাগভাজন হন এবং পরে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তার পর থেকে বাগানের ইতিহাস আর লোককথা এক হয়ে গেছে—প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে আলো জ্বলে ওঠে, আর মাটির তলা থেকে অজানা এক জগতে নামার সিঁড়ি খোলে। কুন্তল গম্ভীর স্বরে বললেন, “আমি জানি, আপনারা শহরের মানুষ, প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি পূর্ণিমার আলো—যেটা কোথা থেকে আসে কেউ বলতে পারে না।” তাঁর কথায় ছিল এমন এক আন্তরিকতা, যা অনিন্দ্যকে নীরব করে দিল। সায়ন্তী চুপচাপ বসে, কাগজের এক পুরনো ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলেন—তাতে দেখা যাচ্ছিল চন্দ্রিমা দেবী, একটি প্রাচীন পাথরের সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে, মুখে যেন মৃদু হাসি, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা।
রাত গভীর হলে অনিন্দ্য ও সায়ন্তী ফিরে এলেন তাঁদের থাকার ঘরে, কিন্তু মন ছিল ব্যস্ত, যেন কুন্তলের দেখানো কাগজপত্র ও কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনিন্দ্য নিজের নোটবুকে লিখতে লাগলেন ঘটনাগুলোর টাইমলাইন—চন্দ্রিমার শেষ দেখা যাওয়া, আলোর বৃত্ত, গোপন পথের গল্প, আর গ্রামবাসীর ভয়। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই রহস্য কেবল কুসংস্কার বা ভৌতিক কাহিনি নয়; এর পেছনে হয়তো এমন কিছু বাস্তব ঘটনা লুকিয়ে আছে যা কেউ বলতে সাহস পায়নি। সায়ন্তী বিছানায় শুয়েও বারবার সেই ছবিটির কথা ভাবছিলেন—সিঁড়ি, হাসি, আর চোখের দুঃখ যেন তাঁকে ডাকছে। জানালার বাইরে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়ছিল ধানের ক্ষেতে, আর দূরে কোথাও হালকা কুয়াশার আড়ালে গাছপালার মাথা দুলছিল। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য সায়ন্তীর মনে হল, যেন খুব দূর থেকে কারো ডাক ভেসে আসছে—মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট। তিনি চমকে উঠে জানালার দিকে তাকালেন, কিন্তু বাইরে কেবল নীরব রাত। তবুও তাঁর মনে হল, যমুনা বাগানের রহস্য তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে, এবং শিগগিরই তারা এর গভীরে টেনে নেওয়া হবে, যেখানে আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে এক অদ্ভুত পথ তৈরি করেছে—যা হয়তো চন্দ্রিমার পদচিহ্ন অনুসরণ করছে।
পরদিন বিকেলে অনিন্দ্য ও সায়ন্তী আবার যমুনা বাগানে গেলেন, এবার হাতে ক্যামেরা, নোটবুক, আর কুন্তলের দেওয়া কিছু পুরনো ছবির কপি। হরিপদ তাঁদের ভেতরে ঢোকার আগে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, “অযথা বেশিক্ষণ থাকবেন না।” সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে, বাগানের ভেতরে ছায়া গাঢ় হয়ে উঠেছে। সায়ন্তী বাগানের পুকুরপাড়ে গিয়ে ছবিগুলো তুলছিলেন—শ্যাওলায় ঢাকা মূর্তি, ভাঙা খিলান, আর গাছের গায়ে খোদাই করা পুরনো চিহ্ন। অনিন্দ্য খিলানের কাছে কিছু অদ্ভুত নকশা দেখতে পেয়ে মাপজোক নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়, সায়ন্তীর ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে এক মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল সোনালি রঙের একটা সরু রেখা—যেন বাতাস কেটে নেমে যাচ্ছে মাটির দিকে। তিনি তাড়াতাড়ি শাটার চাপলেন, কিন্তু চোখ তুলে দেখেন, কিছুই নেই। আবার ভিউফাইন্ডারে তাকাতেই কিছুক্ষণ আগের আলোটা যেন মিলিয়ে গেছে। সায়ন্তী অবাক হয়ে অনিন্দ্যকে ডাকলেন, “তুমি কি দেখলে? আমি কিছু অদ্ভুত ক্যাপচার করেছি।” অনিন্দ্য কাছে এসে স্ক্রিনে ছবিটি দেখতে লাগলেন—অস্পষ্ট কিন্তু স্পষ্টতই এক আলোর রেখা, যার শেষ প্রান্ত পুকুরপাড়ের ঘাসের ভেতর হারিয়ে গেছে। চারপাশের বাতাস যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, পুকুরের জলে এক অকারণ ঢেউ উঠল। তারা দু’জনই স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেন, যেন মুহূর্তের মধ্যে বাগান আরেকটা রূপ ধারণ করেছে।
এমন সময় কোথা থেকে যেন ছুটে এল এক বালক—ছোটখাটো, চোখে দুষ্টুমি ভরা চাহনি, গায়ে ময়লা জামা। সে হাসতে হাসতে বলল, “আপনারা কি সেই আলোটা দেখেছেন?” পরিচয় দিতে গিয়ে জানাল, তার নাম গোপাল। সায়ন্তী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আগে এই আলো দেখেছ?” গোপাল মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বহুবার। রাতে, বিশেষ করে পূর্ণিমার সময়, পুকুরের ধারে এমন আলো নেমে আসে। আমি একবার কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু দিদিমা দেখে ফেলেছিল, আর এমন বকেছে যে, তার পর থেকে আর যাইনি।” অনিন্দ্য জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার দিদিমা কেন বারণ করল?” গোপাল গম্ভীর মুখে বলল, “ও বলে, ওই আলো দেখলেই খারাপ কিছু হয়। গ্রামের মানুষ বলে, যারা ওই আলোর দিকে গিয়েছে, তারা আর ফেরেনি।” গোপালের গলায় নির্ভীকতা থাকলেও চোখে এক মুহূর্তের জন্য ভয় ফুটে উঠল। সায়ন্তী চেষ্টা করলেন হেসে উড়িয়ে দিতে, “হয়তো প্রাকৃতিক কিছু—কুয়াশায় প্রতিফলন বা জলাভূমির গ্যাস।” কিন্তু অনিন্দ্য চুপচাপ ছিলেন; তাঁর মাথায় বারবার ফিরে আসছিল কুন্তলের দেখানো সেই পুরনো খবর—চন্দ্রিমা দেবীর নিখোঁজ হওয়ার রাতে আলো দেখা গিয়েছিল।
গোপাল কিছুক্ষণ তাঁদের সঙ্গে থাকল, তারপর বলল, “আপনারা যদি পূর্ণিমার রাতে আসেন, আমি দেখাবো কোথায় আলো নেমে আসে। কিন্তু দিদিমাকে কিছু বলবেন না।” বলেই ছুটে চলে গেল সরু পথে। সায়ন্তী অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা কি এটা সিরিয়াসলি নিচ্ছি?” অনিন্দ্য স্ক্রিনে আবার ছবিটি দেখলেন, তারপর বললেন, “যখন একই ধরনের বর্ণনা বহু লোক থেকে পাওয়া যায়, তখন তা কেবল কাকতাল নয়।” বাগানের ভেতরের নীরবতা তখন আরও গাঢ় হয়ে এসেছিল, যেন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে গাছগুলো নিজেদের মধ্যে গোপন কিছু ফিসফিস করছে। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ভাঙা মূর্তিগুলো যেন ছায়ার ভেতর নড়ে উঠেছে এমন ভ্রম হচ্ছিল। তারা ধীরে ধীরে ফটকের দিকে এগোলেন, কিন্তু সায়ন্তী বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলেন—মনে হচ্ছিল, যেন আলোর রেখাটি আবার উঁকি দিতে পারে। ফটক পার হয়ে রাস্তায় আসতেই গ্রামীণ কোলাহল ও গন্ধ তাঁদের ঘিরে ধরল, কিন্তু বাগানের ভেতরের শীতলতা যেন এখনও তাঁদের গায়ে লেগে আছে। দু’জনই জানতেন, আজ যা দেখেছেন তা কেবল শুরু—পূর্ণিমার রাতে হয়তো তার আসল রূপ প্রকাশ পাবে।
পূর্ণিমার আগের রাত, গ্রাম জুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। হরিপদ দত্ত সেই রাতে অনিন্দ্য ও সায়ন্তীকে ডেকে পাঠালেন তাঁর কাঠের বারান্দায়, যেখানে মৃদু কুয়াশা ঢুকে আসছিল গলিপথ দিয়ে। কুন্তলও এসে বসেছিল, হাতে নোটবুক, যেন প্রতিটি কথাই লিখে রাখবে। হরিপদ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “আমি যখন ছোট, তখনই প্রথম শুনি যমুনা বাগানের আলো আর সুরের কথা। আমার বাবা জমিদারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি বলতেন, চন্দ্রিমা দেবী হারিয়ে যাওয়ার আগের সন্ধ্যায় বাগানে এক অদ্ভুত সঙ্গীত শোনা গিয়েছিল—পঞ্চম সুরের মতো, কিন্তু কোনো মানুষের গাওয়া নয়। সেই সুর বাজলে আশেপাশের কুকুরও চুপ করে যেত, পাখিরাও ডানা মেলত না। আর সেই রাতের পরেই তিনি আর ফেরেননি।” হরিপদের কণ্ঠে শীতলতা ছিল, যেন বহু বছর আগের সেই রাত আবার তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সায়ন্তী ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কি ওই সুর আর আলো একসাথে আসে?” হরিপদ মাথা নাড়লেন, “সবসময় নয়, কিন্তু যখন আসে, তখন কিছু না কিছু ঘটে।”
রাজমণি দেবী, যিনি এতক্ষণ চুপ ছিলেন, হঠাৎ বললেন, “তোমরা যতটুকু শুনেছ, তা গল্পের অর্ধেকও নয়। চন্দ্রিমা আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল। তার চোখে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, যেন সে সবসময় কিছু খুঁজছে। শেষ কয়েক মাসে সে প্রায়ই বলত, বাগানের ভেতর এমন এক পথ আছে যা এই দুনিয়ার নয়। আমি ভেবেছিলাম, এটা শুধু তার কল্পনা। কিন্তু সেই রাতের পর থেকে আমি যখনই পূর্ণিমায় বাগানের দিকে তাকিয়েছি, আলো দেখেছি… আর মাঝে মাঝে সেই সুরও শুনেছি।” রাজমণির মুখে এক ধরনের আতঙ্ক ফুটে উঠল, কিন্তু তাঁর চোখে লুকানো দুঃখ স্পষ্ট ছিল। অনিন্দ্য নোট নিতে নিতে বললেন, “এই পঞ্চম সুর আসলে কী?” রাজমণি ধীরে বললেন, “ওই সুর এমনভাবে বাজে যে, মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। গ্রামে কেউ বলে, এটা অভিশাপ, কেউ বলে এটা আহ্বান।” ঠিক তখনই ঘরের বাতি দু’বার টিমটিম করে নিভে গেল, আর পুরো গ্রাম অন্ধকারে ডুবে গেল।
অন্ধকার নামার সাথে সাথে এক অদ্ভুত নীরবতা গ্রামকে ঘিরে ফেলল। দূরে কোথাও কুকুর ডেকে উঠল, তারপর থেমে গেল। হঠাৎ, যেন অদৃশ্য কোনো হাত বাতাসে সুর ছড়িয়ে দিল—একটা টানা, দীর্ঘ সুর, যা ধীরে ধীরে বদলে গিয়ে অদ্ভুতভাবে পঞ্চম সুরের সঙ্গে মিলতে লাগল। অনিন্দ্য অনুভব করলেন, তাঁর শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। সায়ন্তী নিঃশ্বাস আটকে শুনছিলেন, আর কুন্তল অবাক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। সুরটা যেন বাগানের দিক থেকে আসছে—দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি নোট স্পষ্ট, কিন্তু তাতে কোনো যন্ত্র বা গলার স্বর নেই, যেন বাতাস নিজেই গান গাইছে। রাজমণি হঠাৎ অনিন্দ্যের হাত চেপে ধরলেন, ফিসফিস করে বললেন, “এটাই পঞ্চম সুরের অভিশাপ… আজ হয়তো আলোও দেখা যাবে।” হরিপদ কড়া স্বরে বললেন, “আজ আর বাইরে যেও না। পূর্ণিমায় আসবে, তখনই সব দেখবে। আজ শুধু মনে রেখো—যে পথ একবার খুলে যায়, তাকে সহজে বন্ধ করা যায় না।” সুরটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু অন্ধকার আর শীতলতা ঘরের ভেতর আটকে রইল, যেন যমুনা বাগান তাদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে পরদিন রাতের জন্য।
পূর্ণিমার রাত। আকাশে রুপোলি আলো ঢেলে দিয়েছে গোল চাঁদ, চারপাশে নিস্তব্ধতার চাদর। গ্রামজুড়ে হালকা কুয়াশা, কিন্তু বাগানের দিকটা যেন আরও ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে। অনিন্দ্য, সায়ন্তী, কুন্তল ও গোপাল চুপিসারে পেছনের সরু মাটির পথে এগিয়ে চলল। চারজনের কারোর মুখেই কথা নেই, কেবল পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ আর দূরের পেঁচার ডাক। গোপাল এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে থেমে চারপাশ দেখে নিচ্ছিল, যেন কেউ অনুসরণ করছে কি না। সায়ন্তী কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে আছেন, প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর আঙুল শাটারের কাছে প্রস্তুত। অনিন্দ্য হাতে ছোট টর্চ রেখেছেন, কিন্তু আলো খুব কম করে ব্যবহার করছেন, যাতে চারপাশের অন্ধকারে মিশে যেতে পারেন। কুন্তল এক হাতে রেকর্ডার চালু করে রেখেছে, অন্য হাতে নোটবুক ধরা। তারা বাগানের পাথরের ফটক পার হয়ে ঢুকতেই চারপাশের বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেল, গাছের পাতা প্রায় নড়ছে না, যেন পুরো প্রকৃতি অপেক্ষা করছে। হরিপদের সাবধানবাণী মনে পড়তেই অনিন্দ্যের বুকের ভেতর হালকা চাপা অস্বস্তি জন্ম নিল, কিন্তু কৌতূহল সেই ভয়কে পেছনে ঠেলে দিল।
তারা ধীরে ধীরে বাগানের ভেতরে এগোতে লাগল। প্রাচীন গাছগুলো মাথার ওপরে ঝুঁকে আছে, যেন শত বছরের পুরনো গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছে। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “এই দিকেই আলো দেখা যায়।” কয়েক মিনিট হেঁটে তারা পুকুরের ধারে পৌঁছল, যেখানে এক সময় জমিদার পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আসর বসত। এখন শুধু ভাঙা মঞ্চ, মস-ঢাকা মূর্তি আর অর্ধেক ডুবে থাকা পাথরের সিঁড়ি। সায়ন্তী ক্যামেরা তোলামাত্রই পেছনে ঝোপে হালকা খসখস শব্দ হল, কিন্তু ঘুরে দেখলেই কেবল ছায়া। রাতের নীরবতায় সেই শব্দ আরও ভৌতিক লাগছিল। অনিন্দ্য কুন্তলকে ইশারা করল রেকর্ডার সচল রাখার জন্য। ঠিক তখনই দূরের ঘড়ি রাত বারোটার ঘণ্টা বাজাল—ধীর, ভারী, প্রতিটি শব্দ যেন বাগানের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ঘণ্টার শেষ ধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের পেছনে হঠাৎ ঝলসে উঠল একগুচ্ছ ছোট ছোট আলো, দেখতে ঠিক জোনাকির মতো, কিন্তু তাদের রঙ ছিল সোনালি, আর আলো ছিল অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। সেগুলো প্রথমে এলোমেলো ভেসে বেড়াল, তারপর ধীরে ধীরে সারিবদ্ধ হয়ে পুকুরের ধারের ঘাসের ওপর একটা নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করল।
চারজনই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সোনালি আলোগুলো বৃত্তের মধ্যে নাচতে লাগল, যেন অদৃশ্য কোনো ছন্দে বাঁধা। সেই আলো এতটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, চারপাশের অন্ধকার প্রায় কেটে গেল, আর তারা দেখতে পেল—বৃত্তের ঠিক মাঝখানে মাটি যেন কাঁপছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাটি ফেটে যেতে লাগল, যেন ভেতর থেকে কোনো শক্তি তা ঠেলে খুলছে। ধুলো উড়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, আর ধীরে ধীরে দেখা গেল এক পুরনো পাথরের সিঁড়ি, যা নিচের দিকে নামছে। বাতাসে হালকা ধাতব গন্ধ ভাসছিল, যেন বহু বছর ধরে বন্ধ থাকা কোনো কক্ষ খুলে গেছে। সায়ন্তীর আঙুল শাটারে থেমে নেই, তিনি একের পর এক ছবি তুলতে লাগলেন। অনিন্দ্য সামনে ঝুঁকে পাথরের সিঁড়ির খোদাই লক্ষ্য করলেন—চিহ্নগুলো দেখতে ঠিক কুন্তলের পুরনো কাগজে দেখা সেই জমিদারি প্রতীকের মতো। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “আমি বলেছিলাম না? এটাই সেই পথ।” কুন্তল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, রেকর্ডার এখনও চালু, যেন প্রতিটি শব্দ ধরে রাখছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই জানত না—এই সিঁড়ি কেবল অতীতের গোপন ইতিহাস নয়, এমন এক অজানা জগতে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে হয়তো সবাই ফেরার সুযোগ পাবে না।
মাটি কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেলে, সেই সোনালি আলোগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু তারা রেখে গেল এক অদ্ভুত নীরবতা। বৃত্তের মাঝখানটা এখন পুরো ফেটে গেছে, আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ধূসর, শ্যাওলা-ঢাকা পাথরের সিঁড়ি। সিঁড়ির ধাপগুলো অসমান, কিছু ভাঙা, কিছু খসে পড়েছে—স্পষ্ট বোঝা যায় বহু বছর কেউ এ পথে চলেনি। গর্ত থেকে উঠে আসছিল ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যেন ভেতরে মাটি আর পাথরের সঙ্গে সময়ও জমে আছে। অনিন্দ্য প্রথমে নিচের দিকে টর্চের আলো ফেলল, কিন্তু আলো কয়েক ধাপের বেশি পৌঁছাল না, যেন অন্ধকার নিজেই তা গিলে ফেলছে। সায়ন্তীর বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা ভয়, তবু ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত তিনি। কুন্তল গলা নামিয়ে বলল, “যদি এই সিঁড়ি সোজা বাগানের নিচে যায়, তাহলে হয়তো… এটা পুরনো গোপন কক্ষ হতে পারে।” গোপাল উচ্ছ্বসিত হয়ে সামনে এগোল, কিন্তু অনিন্দ্য তার কাঁধ চেপে ধরল—“আগে আমি যাচ্ছি।” বাগানের ওপরে পূর্ণিমার আলো এখনও উজ্জ্বল, কিন্তু এই সিঁড়ির মুখে দাঁড়াতেই মনে হচ্ছিল যেন চাঁদের আলোও এখানে পৌঁছায় না।
তারা একে একে নিচে নামতে শুরু করল। পাথরের দেয়াল এতটাই ঠান্ডা যে, হাত লাগালেই শীতলতা হাড়ে গিয়ে লাগছিল। বাতাস ভারী, আর কোথাও কোথাও পানি পড়ার ক্ষীণ শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কয়েক ধাপ নামতেই দেখা গেল দেয়ালের খোদাই—পুরনো ফুলের নকশা, শিকাররত মানুষ, আর কিছু প্রতীক, যা কুন্তলের মতে জমিদার পরিবারের গোপন প্রতীক ছিল। সিঁড়ি যত নিচে নামছিল, ততই সেই গন্ধ তীব্র হচ্ছিল—আর্দ্রতা আর পুরনো কাঠের মিশ্র গন্ধ। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “মনে হচ্ছে আমরা অন্য এক জগতে চলে যাচ্ছি।” সায়ন্তী নীরবে ছবি তুলতে লাগলেন, ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে, যাতে পরিবেশের রহস্য অক্ষুণ্ণ থাকে। হঠাৎ, সিঁড়ি শেষ হয়ে তারা পৌঁছল এক প্রশস্ত করিডরে, যেখানে বাতাস আরও ঠান্ডা, আর দেয়ালে ঝোলানো ছিল মরচে ধরা লণ্ঠন। কেউ স্পর্শ করলে লণ্ঠনের ধুলো বাতাসে উড়ে চারপাশে ঘুরতে লাগল। অনিন্দ্য ভাবলেন, এই জায়গা নিশ্চয় বহু আগে ব্যবহার করা হতো, হয়তো জরুরি পথ হিসেবে। কিন্তু কেন এতদিন লুকিয়ে ছিল, সেই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
করিডরের শেষ প্রান্তে এসে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে এক বিশাল দরজা—পুরু কাঠের, আর লোহার পাটে শক্ত করে বাঁধা। দরজার ওপর খোদাই করা আছে জমিদার পরিবারের রাজমুকুট চিহ্ন, আর নিচে অদ্ভুত এক লিপি, যা কেউ সহজে পড়তে পারছিল না। কুন্তল হাত বুলিয়ে বলল, “এটা সংস্কৃতের পুরনো রূপ… মনে হচ্ছে এখানে লেখা আছে—‘যা এখানে প্রবেশ করবে, সে আর ফিরে আসবে না।’” বাক্যটা শুনে গোপাল একটু পিছিয়ে গেল, কিন্তু সায়ন্তী দৃঢ় স্বরে বললেন, “আমরা এখানে এসেছি জানার জন্য, পিছিয়ে যাওয়ার জন্য নয়।” অনিন্দ্য দরজায় ধাক্কা দিলেন, আর আশ্চর্যের বিষয়, দরজাটি ধীরে ধীরে কড়কড় শব্দ করে খুলে গেল—যেন বহু বছরের নিদ্রা ভেঙে জেগে উঠছে। দরজা খুলতেই ভেতরে এক বিশাল হলঘর দেখা গেল, দেয়ালে পুরনো প্রতিকৃতি, মেঝেতে ছেঁড়া কার্পেট, আর কোণে ধুলোয় ঢাকা আসবাব। কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো জিনিস ছিল ঘরের মাঝখানে রাখা এক সিন্দুক, যা লোহার তালায় বন্ধ। তারা বুঝতে পারল—এটা শুধু গোপন পথ নয়, বরং জমিদার বাড়ির সেই হারানো অংশ, যেখানে হয়তো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া চন্দ্রিমা দেবীর রহস্য লুকিয়ে আছে। বাইরে পূর্ণিমার আলো নিভে আসছিল, আর ভেতরের অন্ধকার যেন তাদের আরও গভীরে টেনে নিচ্ছিল।
দরজার কড়কড় শব্দ মিলিয়ে গেলে তারা পা রাখল সেই বিশাল কক্ষে, যা বহু দশক ধরে অন্ধকারে ঢাকা ছিল। প্রথমে টর্চের আলো ধীরে ধীরে কক্ষের ভেতর ভেসে বেড়াল—দেয়ালের গায়ে ঝুলছে বহু পুরনো তেলরঙের ছবি, যেগুলোর রঙ সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু চোখদুটি এখনও যেন জীবন্ত, তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এক কোণে ধুলোয় ঢাকা সিন্দুক, অন্য কোণে কাঠের আলমারি, যেগুলোর দরজা আধখোলা। সায়ন্তী সতর্কভাবে ক্যামেরা তোললেন, প্রতিটি খুঁটিনাটি ধরতে চাইছেন। গোপাল টেবিলের ওপর রাখা এক পুরনো মোমদান ছুঁয়ে দেখল, তার আঙুলে লেগে গেল ধুলো আর শুকনো মোমের গুঁড়ো। কুন্তল আলমারির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করল কিছু কাগজ—ভাঙা ফ্রেমের ভেতর জমিদারের পরিবারের ছবি, যেগুলোর পেছনে তারিখ আর নাম লেখা আছে। কিন্তু তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি ছোট, কাচঢাকা তাক, যার ভেতরে রাখা আছে কয়েকটি গহনা—সোনার হার, পাথর জড়ানো কানের দুল, আর রূপার বালা। গহনাগুলো সযত্নে রাখা, কিন্তু তাতে একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতার ছাপ। অনিন্দ্য ভাবলেন, হয়তো এগুলোই জমিদারের কন্যার ব্যক্তিগত জিনিস ছিল। ঘরের ভেতরের বাতাসে সময়ের এক ভারি স্তর জমে আছে, আর প্রতিটি বস্তু যেন অতীতের গল্প বলছে।
ঘরের এক কোণে ধুলোয় ঢাকা কাঠের লেখার টেবিল। সায়ন্তী এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে ধুলো সরালেন, আর দেখা গেল একটি চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি ও কয়েকটি ভাঁজ করা চিঠি। ডায়েরির পাতা খুলতেই ধুলো উড়ে তাদের চোখে লাগল, কিন্তু পাতার হাতের লেখা এখনও স্পষ্ট। কুন্তল প্রথম চিঠিটি ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করল—এটি চন্দ্রিমা দেবীর, জমিদারের একমাত্র কন্যা, যিনি বহু বছর আগে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, “আমি এখানে বন্দি। আমি তাকে ভালোবাসি—সে আমার জীবনের আলো। আমরা পূর্ণিমার রাতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা জেনে গেছে… আমি জানি না আমি বাঁচব কি না।” এরপর কাগজে কালি ছড়িয়ে গেছে, আর কিছু লেখা নেই। অনিন্দ্য এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন, যেন সেই অসমাপ্ত বাক্যের ভেতর লুকিয়ে থাকা আতঙ্ক অনুভব করছেন। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “তাহলে… ওঁকে হত্যা করা হয়েছিল?” কিন্তু কুন্তল মাথা নাড়ল—“হয়তো বন্দি রেখেই মারা গেছে, বা পালানোর আগেই থামানো হয়েছে।” সায়ন্তী চিঠির পাশে রাখা একটি ছোট রূপার লকেট তুলে নিলেন, যাতে চন্দ্রিমা ও এক অজানা যুবকের ছবি গোপনে রাখা আছে। লকেটের ছবি দেখে স্পষ্ট—এটি জমিদারের অনুমোদিত সম্পর্ক ছিল না।
কক্ষের প্রতিটি কোণ ঘুরে দেখার পর তারা বুঝতে পারল, এই হারানো অংশ আসলে জমিদার বাড়ির গোপন ইতিহাসের কেন্দ্র। দেয়ালের প্রতিকৃতিগুলোতে দেখা যায় একই যুবক, যাকে লকেটের ছবিতে দেখা গিয়েছিল, যদিও তার নাম কোথাও উল্লেখ নেই। কুন্তল আন্দাজ করল, তিনি হয়তো নিম্নবর্ণের কেউ ছিলেন, বা জমিদারের রাজনৈতিক শত্রুর পুত্র, যার সঙ্গে সম্পর্ক মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সায়ন্তী ক্যামেরায় প্রতিটি প্রমাণ ধরে রাখছিলেন, কারণ এই ইতিহাস শুধু লোককথা নয়—এটি এক নারীর দমিয়ে দেওয়া প্রেম, যা ষড়যন্ত্রে শেষ হয়েছিল। অনিন্দ্য সিন্দুক খুলে কিছু পুরনো দলিল পেলেন—যেখানে জমিদারের স্বাক্ষর, জমির নকশা, আর এক গোপন পথের মানচিত্র রয়েছে, যা বাগানের সঙ্গে এই অংশকে যুক্ত করে। তারা যতই গভীরে যাচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হচ্ছিল—এই কক্ষ বহু বছর ধরে লুকিয়ে ছিল, যাতে চন্দ্রিমা দেবীর সত্য কেউ জানতে না পারে। কিন্তু পূর্ণিমার রাতে, সেই আলো, সেই পথ—সবই হয়তো তাঁর অশান্ত আত্মার ডাক, যাতে একদিন কেউ এসে সত্য উন্মোচন করে।
গোপন কক্ষে আবিষ্কৃত চিঠি আর লকেট হাতে নিয়ে তারা যখন বাগান পেরিয়ে মূল গ্রামের দিকে ফিরছিল, তখন ভোরের হালকা আলো গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎই পেছন থেকে মৃদু ডাক ভেসে এল—“অনিন্দ্য বাবু!” সবাই ঘুরে তাকাতেই দেখল, রাজমণি দেবী লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। তাঁর চোখে ছিল গভীর আবেগের আভা, আর মুখে এমন এক দৃঢ়তা, যা এতদিন কেউ দেখেনি। কাছে এসেই তিনি সায়ন্তীর হাতে ধরা লকেটের দিকে তাকালেন, এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ… আমি জানতাম, একদিন তোমরা এটা খুঁজে পাবে।” অনিন্দ্য বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি জানতেন? তাহলে এতদিন কিছু বলেননি কেন?” রাজমণি দেবী ম্লান হাসলেন—“কারণ তখনকার দিনে সত্য বলা মানে ছিল নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। আমি ছিলাম চন্দ্রিমার সহপাঠী, স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। একদিন খেলার ছলে আমরা বাগানের ভেতরে ঢুকে পড়ি, আর হঠাৎই পা পড়ে যায় সেই গোপন সিঁড়ির ধাপে। তখনও জানতাম না, ওটাই চন্দ্রিমার বন্দিদশার পথ হয়ে উঠবে।” তাঁর গলা খানিক কেঁপে উঠল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে বললেন, “চন্দ্রিমা তার প্রেমিকের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাকে ধরে এনে এই গোপন কক্ষে আটকে রাখা হয়। আমি জানতাম, কিন্তু বলার সাহস ছিল না।”
রাজমণি দেবী বসে পড়লেন কাছের এক পাথরের চৌকিতে, আর অতীতের স্মৃতি যেন তাঁকে ঘিরে ধরল। “চন্দ্রিমা আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিল, গোপনে, স্কুলের এক বন্ধুর মাধ্যমে। সে চেয়েছিল আমি তাকে সাহায্য করি। কিন্তু আমি তখন ছিলাম এক কিশোরী, বুঝতেই পারিনি কত বড় ষড়যন্ত্র চলছে। জমিদারের আত্মীয়স্বজন আর গ্রামের প্রভাবশালী কয়েকজন এই ঘটনা চাপা দিয়ে দেয়। তারা বলেছিল, যদি খবর বাইরে যায়, তবে শুধু পরিবারের সুনামই নয়, গ্রামেরও মানহানি হবে। সেই ভয়ে সবাই চুপ করে গিয়েছিল। আমি চেষ্টা করেছিলাম অন্তত চন্দ্রিমার বাবা-মাকে জানাতে, কিন্তু তখনই আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল—কিছু বললে আমার পরিবারকেও বিপদে ফেলা হবে।” তিনি চোখ মুছে বললেন, “এরপর একদিন শুনলাম, চন্দ্রিমা অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, কিন্তু কেউ তার দেহ দেখেনি। তখন বুঝলাম, তাকে হয়তো সেখানেই কবর দেওয়া হয়েছে।” কুন্তল গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, তারপর ধীরে বলল, “তাহলে গোপন পথ আর সেই কক্ষের অস্তিত্ব এতদিন ঢেকে রাখা হয়েছিল ক্ষমতাবানদের ইচ্ছায়?” রাজমণি দেবী মাথা নাড়লেন—“হ্যাঁ, আর সেই কারণেই পূর্ণিমার রাতে আলো জ্বলে ওঠে। ওর আত্মা হয়তো এখনও মুক্তি পায়নি।”
রাজমণি দেবীর মুখে শোনা এই কাহিনী যেন পুরো রহস্যের শেষ টুকরোটি মেলাল। অনিন্দ্য মনে মনে ভাবলেন, এই গল্প শুধু একটি প্রেমকাহিনীর মর্মান্তিক সমাপ্তি নয়, বরং সেই সময়ের সমাজব্যবস্থার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। গোপাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল ক্ষোভ—“তাহলে সবাই জানত, কিন্তু কেউ কিছু করেনি?” রাজমণি দেবী তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “সেই সময়ে সাহসী হওয়া খুব কঠিন ছিল বাবা… কিন্তু আজ যদি তোমরা এই সত্য প্রকাশ কর, তবে চন্দ্রিমা অন্তত শান্তি পাবে।” সায়ন্তী ক্যামেরার ব্যাগ থেকে মেমোরি কার্ডটি বের করে নিজের পকেটে রাখলেন—এতে ছিল প্রমাণ, যা আর কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। কুন্তল বলল, “আমি এটা পত্রিকায় ছাপাবো। মানুষ জানুক, যমুনা বাগানের আলো কোনো কুসংস্কার নয়, বরং ইতিহাসের লুকোনো কান্না।” রাজমণি দেবী মৃদু হাসলেন, যেন তাঁর বহু বছরের বোঝা আজ খানিকটা হালকা হলো। সূর্যের প্রথম রশ্মি বাগানের গাছের মাথায় পড়তেই মনে হলো, চন্দ্রিমার আত্মাও হয়তো মুক্তির পথে পা বাড়িয়েছে।
রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ছিল। যমুনা বাগানের ভেতর এখনও নরম রুপালি আলো ছড়িয়ে ছিল, কিন্তু কুয়াশার মতো হালকা আবছায়া ঘিরে ফেলছিল সেই পাথরের সিঁড়ির মুখ। অনিন্দ্য, সায়ন্তী, কুন্তল, গোপাল আর রাজমণি দেবী দাঁড়িয়ে দেখছিলেন—যে গোপন পথ এত বছর ধরে লুকিয়ে ছিল, সেটি এখন নিজেরাই মিলিয়ে যাচ্ছে। পাথরের ফাঁকগুলো ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে সরে এসে বন্ধ হয়ে গেল, যেন প্রকৃতিই তার গোপনীয়তা আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে নিচ্ছে। সেই মুহূর্তে বাতাসে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল; শুধু দূরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। রাজমণি দেবী চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বললেন, “শান্তি পেলি তো চন্দ্রিমা…?” অনিন্দ্য সায়ন্তীর হাত চেপে ধরলেন—তাঁদের মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে যেন চন্দ্রিমার আত্মা শেষবারের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল। পূর্ণিমার আলো ম্লান হয়ে এলে সেই পুরোনো বাগান আবার একেবারে সাধারণ মনে হতে লাগল, যেন কিছুই ঘটেনি।
পরদিন সকালে, শহরে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হল। অনিন্দ্য তার নোটবুক, পুরনো মানচিত্র, আর চন্দ্রিমার অসমাপ্ত চিঠি সযত্নে ব্যাগে রাখলেন। সায়ন্তী ল্যাপটপে ক্যামেরার মেমোরি কার্ডের সব ছবি কপি করলেন—প্রাচীন কক্ষ, গহনা, লকেট, আর পূর্ণিমার আলোয় খোলা গোপন পথের প্রতিটি মুহূর্ত ধরা আছে তাতে। কুন্তল তার নোটগুলো গুছিয়ে বলল, “আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গল্প প্রকাশ করব, যাতে আর কেউ এই সত্য চেপে রাখতে না পারে।” রাজমণি দেবী তাঁদের বিদায় জানাতে এলেন; তাঁর চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি—যেন দীর্ঘদিনের একটি প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে। গোপাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে অদ্ভুত এক ঝিলিক। সায়ন্তী জিজ্ঞেস করলেন, “কী ভাবছো?” গোপাল ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি জানি, একদিন আবার এই পথ খুলবে। আর তখন আমি একাই ভেতরে যাব—চন্দ্রিমার জন্য নয়, নিজের জন্য। আমি দেখতে চাই, সেখানে আর কী লুকিয়ে আছে।” অনিন্দ্য হেসে বললেন, “তুমি যদি যেতেই চাও, তবে আমার ডায়েরি পড়ে নিও—কীভাবে নিরাপদে ফিরতে হয়।”
ট্রেন যখন ধীরে ধীরে স্টেশন ছাড়ল, অনিন্দ্য জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন—দূরে যমুনা বাগান ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চাঁদের শেষ রুপালি রেখা যেন এখনও গাছের মাথায় লেগে আছে। সায়ন্তী মাথা জানালার পাশে রেখে ছবি তোলার ভঙ্গি করলেন, যেন এই মুহূর্তটাও স্মৃতির ভাঁজে বন্দি করে রাখবেন। কুন্তল ইতিমধ্যেই শহরের সংবাদমাধ্যমের কয়েকজনকে মেসেজ পাঠিয়েছে; সে জানে, এই খবর ছড়িয়ে পড়লেই যমুনা বাগান কেবল কিংবদন্তি থাকবে না—হয়ে উঠবে ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। রাজমণি দেবী গ্রামে ফিরে একা বাগানের পথে হাঁটছিলেন। তিনি থেমে আকাশের দিকে তাকালেন, যেন কোথাও চন্দ্রিমার ছায়া খুঁজছেন। বাতাসে হালকা এক সুর ভেসে এল, যা একসময় গ্রামবাসীরা ‘পঞ্চম সুরের অভিশাপ’ বলে ডাকত, কিন্তু আজ সেই সুরে কোনো ভয় নেই—শুধু মুক্তির শান্তি। আর বাগানের গভীরে, গোপন পথের সেই সিঁড়ি… হয়তো নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে, পরবর্তী পূর্ণিমার জন্য।
সমাপ্ত

1000052421.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *