অর্জুন ধর
দ্য কল ব্যাক
দিল্লির পুরোনো চাঁদনি চকের গলির ভেতরে এক ছোট্ট বইয়ের দোকান। নাম স্মৃতির আড্ডা। কাঠের তাকজোড়া ভরে আছে পুরোনো গোয়েন্দা উপন্যাস, ইংরেজি ক্লাসিক, বাংলার কবিতার বই। দোকানের মালিক অর্ণব সেন—চল্লিশ ছুঁইছুঁই, চশমা পরা, গম্ভীর মুখের মানুষ। তার বুকশপে দুপুরগুলো শান্ত, শুধু পাখির ডাক আর বাইরের যানজটের আওয়াজ ভেসে আসে। কেউ তাকে চিনে না, কেউ জানে না, এই নিরীহ বই বিক্রেতা একসময় ভারতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ গুপ্তচর ছিল।
অর্ণবের দিনগুলো কাটছিল সহজেই—সকালে দোকান খোলা, দুপুরে ক’জন ছাত্রছাত্রী আসে নোটস খুঁজতে, সন্ধ্যায় তিনি একা বসে থাকেন। কিন্তু এই শান্তজীবন হঠাৎই ভেঙে দিল এক পুরনো ফোনকল।
রাত তখন সাড়ে দশটা। দোকান গুছিয়ে তালা দিতে যাচ্ছিলেন অর্ণব। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে কোনো নাম নেই, শুধু অচেনা একটা নম্বর। কৌতূহল আর আশঙ্কার মিশ্র অনুভূতিতে কল রিসিভ করতেই ভেসে এলো কাঁপা কণ্ঠ—
“অর্ণবদা… আমি কাবেরী। মনে আছে?”
কাবেরী—RAW-তে তার পুরনো সহকর্মী। বারো বছর আগে শেষ কথা হয়েছিল। অর্ণব স্থির গলায় বললেন, “হ্যাঁ, মনে আছে। তুমি কোথায়?”
ওপাশ থেকে কাবেরী তাড়াহুড়ো করে বলল, “সময় নেই। শোনো, ওরা ‘প্রোটোকল শ্যাডো’ চালু করেছে। পারমাণবিক ডেটা ফাঁস হয়েছে। তোমাকেই ফিরে আসতে হবে।”
অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বুকশপের দেয়ালের ভেতরে হঠাৎ যেন অদৃশ্য অ্যালার্ম বাজতে লাগল। এতদিন দূরে থাকা অতীত আবার টেনে আনছে তাকে। কণ্ঠে শীতলতা এনে বললেন, “কাবেরী, আমি খেলা ছেড়েছি।”
ওপাশ থেকে নিঃশ্বাস ভাঙা স্বরে উত্তর এলো, “তাহলে দেশটা শেষ। আর আমিও…” তারপর হঠাৎ লাইন কেটে গেল।
ফোনটা নিঃশব্দ হয়ে পড়ে রইল, কিন্তু অর্ণবের ভেতরে বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠল সন্দেহ। “প্রোটোকল শ্যাডো”—এই শব্দটা কেবল RAW-এর অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হত। এর মানে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে অন্ধকার হুমকি ফিরে এসেছে।
পরদিন ভোরে অর্ণব দোকান বন্ধ রেখে বেরিয়ে পড়লেন। কাঁধে ছোট ব্যাগ, ভেতরে কেবল একটি নোটবুক আর পুরনো গ্লক পিস্তল। তিনি জানতেন, কেউ না কেউ তাকে নজর করছে। চাঁদনি চকের ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কালো স্যুট পরা দুই লোকের চোখে তিনি সেই ছায়া দেখতে পেলেন।
কনট প্লেসের এক গোপন কফিশপে অর্ণব দেখা করলেন অন্য এক পুরনো পরিচিতর সঙ্গে—মেজর সিংহ। এখনো RAW-এ কর্মরত। সিংহ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার আড়ালে ফিসফিস করে বললেন, “তুমি ফিরে আসবে ভাবিনি। কিন্তু সময় এসেছে।”
অর্ণব ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিলেন, “আমাকে ফিরতে হয়নি, ওরা আমায় টেনে আনল। বলো, পরিস্থিতি কতটা খারাপ?”
সিংহ একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন। কাগজের ভেতরে স্যাটেলাইট ইমেজ, কিছু কোডেড বার্তা আর একটি নাম—The Broker।
“এই মানুষটার নামও আসলে আমরা জানি না,” সিংহ বলল। “ও একজন ছায়া ব্যবসায়ী। অস্ত্র, তথ্য, সন্ত্রাস—সব বেচাকেনা করে। গতরাতে ইস্তানবুল থেকে সিগন্যাল ধরা গেছে। ভারতের পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত ডেটা ওর হাতে গেছে।”
অর্ণবের চোখ সরু হয়ে এল। বারো বছর আগে এমনই এক মিশনে তিনি নিজের টিম হারিয়েছিলেন। আর সেই দুঃস্বপ্নই তাকে গুপ্তচর জীবন ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আজ সেই পুরনো ছায়া আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সন্ধ্যার আগে অর্ণব ফিরে এলেন নিজের ফ্ল্যাটে। দরজা খুলেই বুঝলেন কিছু অস্বাভাবিক। টেবিলের উপর রাখা বইগুলো এলোমেলো, জানলার পাশে একটুকরো কাগজ পড়ে আছে। তুলে নিতেই গায়ে কাঁটা দিল। তাতে কেবল লেখা—
“Welcome back to the game, Mr. Sen.”
তার মানে, The Broker ইতিমধ্যেই তাকে চেনে। খেলাটা শুরু হয়ে গেছে। অর্ণব জানতেন, এখন আর পিছু হটার উপায় নেই।
রাত গভীর হলে তিনি পুরোনো ল্যাপটপটা খুললেন। নিজের কোড নাম Raven টাইপ করতেই একে একে উঠে এল নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া ফাইলগুলো। কাবেরীর নামের ফাইল খুলে দেখলেন সর্বশেষ লোকেশন—ইস্তানবুল। তার মানে, ওখানেই যেতে হবে।
কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। বাইরে তিনজন মুখোশ পরা লোক। অর্ণব পিস্তল হাতে নিলেন। টানটান উত্তেজনা। গুলির শব্দে ঘর কেঁপে উঠল। কয়েক মিনিটের গোলাগুলির পর যখন ধোঁয়া সরে গেল, তখন তিনজনই অচেতন মেঝেতে পড়ে আছে। তাদের জ্যাকেট তল্লাশি করে অর্ণব পেলেন একটুকরো চিপ, যেখানে আরবিতে লেখা কিছু কোড।
চোখে রক্তিম আগুন নিয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তাহলে খেলা সত্যিই শুরু হয়েছে।”
সেই রাতে দিল্লির আকাশে ঝড় বয়ে গেল। বিদ্যুতের ঝলকানির মতো অর্ণবের ভেতরেও সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে গেল। তিনি আর শুধু বইয়ের দোকানদার নন। তিনি আবার Raven—ভারতের একমাত্র গুপ্তচর যে The Broker-কে থামাতে পারবে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই টিকিট কাটা হলো। গন্তব্য—ইস্তানবুল।
ঘোস্টস অব ইস্তানবুল
ইস্তানবুল। বসফরাসের শহর, যেখানে ইউরোপ আর এশিয়ার সীমানা এক হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে আলো ঝলমল করছে মসজিদের মিনার, নদীর ওপরে ভেসে যাচ্ছে নৌকা, কিন্তু অর্ণব সেনের চোখে কোনো রোমান্টিক সৌন্দর্য নেই। তার কাছে শহরটা এখন কেবল যুদ্ধক্ষেত্র।
অর্ণব অবতরণ করতেই বুঝলেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই ভিড়ের মধ্যে একটা ছায়া বারবার চোখে পড়ছিল। লম্বা কোট, গলার কাছে মাফলার জড়ানো। অর্ণব সোজা ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন, কিন্তু ব্যাগের ভেতর হাত রেখেই গ্লকের ঠান্ডা ধাতু স্পর্শ করলেন।
ট্যাক্সি যখন পুরোনো শহরের দিকে যাচ্ছিল, তখন ফোনে একটা অচেনা মেসেজ এল: “Raven, welcome to Istanbul. Watch your back.” অর্ণব জানতেন, এ শহরে তাকে কেউ স্বাগত জানাতে আসেনি। মেসেজের মানে একটাই—খেলা শুরু হয়ে গেছে।
রহস্যময় নারী এজেন্ট
সুলতানাহমেত স্কোয়ারে পৌঁছোনোর পর তিনি হোটেলে চেক-ইন করলেন। কিন্তু রাতে দরজায় টোকা পড়ল। অর্ণব সাবধানে পিস্তল হাতে নিলেন। দরজা খুলতেই দাঁড়িয়ে এক তরুণী—কালো চুলে হালকা ঢেউ, চোখে হালকা কৌতূহল আর তীক্ষ্ণতা। সে বলল,
“Mr. Sen? আমি নায়লা। MI6 থেকে।”
অর্ণব চোখ সরু করলেন। “MI6 কেন হঠাৎ আমার খোঁজে আসবে?”
নায়লা ঠান্ডা গলায় বলল, “কারণ The Broker শুধু ভারতের সমস্যা নয়। লন্ডন, তেহরান, মস্কো—সব জায়গাতেই তার হাত রয়েছে। আমরা ট্র্যাক করেছি, গত সপ্তাহে সে বসফরাসের ওপারে এক নিলামে দেখা দিয়েছিল। আর আপনার সহকর্মী কাবেরী এখানেই হারিয়ে গেছে।”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। কাবেরী বেঁচে আছে নাকি মৃত, এখনো অজানা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে আমার কাছে কেন এসেছ?”
নায়লা মুচকি হেসে বলল, “কারণ আপনি Raven। আপনাকে বাদ দিয়ে এই খেলাটা জেতা যাবে না।”
ইস্তানবুলের আঁধারে
পরদিন ভোরে তারা দু’জনে বেরোলেন গ্র্যান্ড বাজারের ভেতর। অর্ণব জানতেন, গুপ্তচরদের জন্য বাজারটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা—হাজার মানুষের ভিড়, চোখের আড়ালে হাতবদল হতে পারে যেকোনো তথ্য।
নায়লা তাকে ইশারা করে এক বুড়ো লোককে দেখাল। দাড়ি-গোঁফে ঢাকা, হাতে সোনার আংটি। সে একে একে ছোট ছোট কাগজ গুঁজে দিচ্ছিল ক্রেতাদের হাতে।
“ও হচ্ছে মুনির,” নায়লা ফিসফিস করে বলল। “The Broker-এর লোক। কাবেরীর সাথে ওকেই শেষ দেখা গিয়েছিল।”
অর্ণব ভিড়ের মধ্যে মিশে মুনিরের কাছে পৌঁছোনোর আগেই হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ধাক্কা দিল। চোখে পড়ল—দুই মুখোশধারী বন্দুক বের করেছে। মুহূর্তেই বাজারের মধ্যে চিৎকার আর দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো।
অর্ণব দ্রুত মাটিতে গড়িয়ে গুলি এড়ালেন। একটা ফলের দোকানের আড়াল নিয়ে প্রতিঘাত করলেন। গুলির শব্দে বাজার কেঁপে উঠল। নায়লা বিদ্যুতের মতো একটা ছুরি ছুঁড়ে দিল, একজন আক্রমণকারী লুটিয়ে পড়ল। অন্যজন ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
কিন্তু এর মধ্যেই মুনির উধাও।
রহস্য গভীরতর হয়
হোটেলে ফিরে এসে অর্ণব টেবিলে ছড়িয়ে দিলেন উদ্ধার করা একটা ছেঁড়া কাগজ। তাতে অদ্ভুত কিছু সংখ্যার ধারা—“17-4-92-11-23”। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “এটা কোড। হয়তো লুকানো কোনো লোকেশন।”
নায়লা মাথা নাড়ল, “আমাদের অনুমান, এটা বসফরাসের কোনো গুদামঘর। সেখানে নিলাম হবে। অস্ত্র নয়, তথ্যের নিলাম।”
অর্ণব বুঝলেন, এটাই The Broker-এর খেলা। সরকারী সার্ভার হ্যাক করে আনা তথ্য এখন কালোবাজারে বেচা-কেনা হচ্ছে। আর সেই তথ্যের মধ্যে ভারতের পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত ফাইলও আছে।
শিকার আর শিকারি
রাত বারোটায় তারা পৌঁছোলেন বসফরাসের ধারে এক গুদামঘরে। অন্ধকারে ঢুকে গেলেন, কেবল টর্চের আলো সামনে। ভেতরে হঠাৎ ভেসে এলো কণ্ঠস্বর—
“Welcome, Raven. I was expecting you.”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। The Broker কি এখানেই? কিন্তু কণ্ঠস্বরটা যেন কোনো রেকর্ডেড বার্তা। ভেতরে হঠাৎ এক প্রজেকশন জ্বলে উঠল—কালো মুখোশ পরা এক লোকের ছায়া।
“তুমি অনেক দূর এসেছ, কিন্তু খেলা তো সবে শুরু হলো। তোমার বন্ধু কাবেরী এখনো বেঁচে আছে। তবে কতদিন থাকবে, তা তোমার উপর নির্ভর করছে।”
নায়লা হতভম্ব। “এটা মানে কী?”
অর্ণব ঠান্ডা চোখে তাকালেন। “এটা মানে, আমরা শিকার নই। আমাদের শিকার করা হচ্ছে।”
মারণ ফাঁদ
হঠাৎই গুদামঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। চারদিক থেকে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। অর্ণব দ্রুত ব্যাগ থেকে মাস্ক বের করে দু’জনের মুখে চাপালেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে হলো। বাইরে এসে তারা দেখল, গুদামঘরটা জ্বলতে শুরু করেছে।
অগ্নিশিখার ভেতর থেকে ভেসে আসছে একটাই শব্দ—একটা শিশুর হাসির মতো, কিন্তু যান্ত্রিক। যেন The Broker তাদের নিয়ে খেলছে।
সত্যের কাছাকাছি
নদীর ধারে দাঁড়িয়ে নায়লা বলল, “তুমি কি মনে করো কাবেরী সত্যিই বেঁচে আছে?”
অর্ণবের চোখে তীক্ষ্ণ দৃঢ়তা, “আমি জানি, ও বেঁচে আছে। আর The Broker জানে, আমি তাকে খুঁজতে আসব। এটাই তার আসল ফাঁদ। কিন্তু ভুলে গেছে—Raven কোনোদিন ফাঁদে ধরা পড়ে না।”
ইস্তানবুলের আকাশে তখন ভোরের আলো ফুটছে। অর্ণবের ভেতরেও নতুন সংকল্প জাগছে। তার কাছে এটা শুধু দেশের মিশন নয়, ব্যক্তিগত প্রতিশোধও।
পরের পদক্ষেপ? কাবেরীকে খুঁজে বের করা, আর The Broker-এর মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা।
দ্য ব্রোকার’স কোড
ইস্তানবুলের ভোর মানে সোনালি আলোয় ভেসে থাকা মিনার আর কুয়াশায় মোড়া বসফরাস। কিন্তু অর্ণব সেনের চোখে শহরটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। গুদামঘরের আগুনে বেঁচে ফেরার পর তিনি জানতেন—The Broker কেবল তাকে ভয় দেখাচ্ছে না, খেলা শুরু করেছে।
নায়লা তার সামনে বসে বলল, “আমাদের হাতে যা আছে, সেটা ওই ছেঁড়া কাগজ। কোডটা যদি ভাঙতে না পারি, তবে আমরা শুধু ছায়ার পেছনে ছুটব।”
অর্ণব টেবিলে কাগজটা ছড়িয়ে দিলেন—১৭-৪-৯২-১১-২৩। চোখ বন্ধ করে মনে মনে সংখ্যা সাজালেন। তিনি জানতেন, The Broker কখনো সোজা ক্লু দেয় না। সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকে জায়গা, সময়, কিংবা নাম।
“এটা কোনো সাইফার,” অর্ণব ফিসফিস করে বললেন। “সম্ভবত বই কোড।”
নায়লা ভ্রু কুঁচকাল, “মানে?”
অর্ণব উত্তর দিলেন, “RAW-তে আমরা একসময় এ ধরনের কোড ব্যবহার করতাম। কোনো নির্দিষ্ট বইয়ের পাতার নম্বর আর শব্দের অবস্থান মিলিয়ে বার্তা তৈরি হয়।”
কোডের ধাঁধা
তিনি ব্যাগ থেকে বের করলেন এক পুরনো বই—ওরহান পামুকের My Name Is Red, যা তিনি বিমানবন্দরে কিনেছিলেন। প্রথম সংখ্যা ১৭—পৃষ্ঠা ১৭। তারপর ৪—সেই পাতার চতুর্থ শব্দ। চোখ বুলিয়ে পেলেন শব্দটা: Warehouse।
দ্বিতীয় কোড ৯২-১১—পৃষ্ঠা ৯২, শব্দ ১১। পেলেন: Galata।
শেষে ২৩—পৃষ্ঠা ২৩-এর প্রথম শব্দ: Midnight।
নায়লার চোখ জ্বলে উঠল। “Warehouse… Galata… Midnight। মানে আজ রাতেই গালাটা টাওয়ারের আশেপাশে কোনো গুদামে নিলাম হবে।”
অর্ণব চুপ করে জানলার বাইরে তাকালেন। The Broker খুব ভালো করেই জানত, সে কোড ভাঙবে। এই ফাঁদে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো চাল।
পুরনো মুখ
সন্ধ্যায় গালাটা ব্রিজ পার হয়ে তারা পৌঁছোলেন নদীর ধারে। গুদামঘরগুলো খালি দেখালেও ভেতরে নিশ্চয়ই চলছিল প্রস্তুতি। অর্ণব দূরবীন দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন, হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল।
অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক পরিচিত চেহারা—আকাশ মালহোত্রা।
একসময় অর্ণবের সঙ্গী ছিল RAW-তে। দিল্লির মিশনে একসাথে রক্ত ঝরিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর আগে আকাশ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। আজ সে দাঁড়িয়ে আছে The Broker-এর লোকজনের সঙ্গে।
নায়লা ফিসফিস করে বলল, “তুমি ওকে চেনো?”
অর্ণবের ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। “হ্যাঁ, আর এটাই প্রমাণ করছে যে শত্রু শুধু বাইরে নয়, ভেতরেও।”
নিলামের ছায়া
রাত বারোটায় গুদামের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বিশাল একটা পর্দা, সামনে অল্প আলোয় বসে আছে বিভিন্ন দেশের ডেলিগেট। মুখ ঢাকা, কিন্তু তাদের চোখে লোভ স্পষ্ট। টেবিলের উপর রাখা আছে পেনড্রাইভ—যার ভেতরে ভারতের পারমাণবিক গবেষণা ফাইল।
প্রজেক্টর জ্বলে উঠতেই পর্দায় আবার ভেসে উঠল The Broker-এর মুখোশধারী অবয়ব। কণ্ঠস্বর ঠান্ডা, “Welcome to the market of shadows. Tonight, information is power. Let the bidding begin.”
অর্ণব আর নায়লা ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ক্রেতাদের মধ্যে রাশিয়ার, ইরানের, এমনকি চীনের প্রতিনিধি আছে। নিলামের দাম বাড়তেই অর্ণবের ধৈর্য ভেঙে যাচ্ছিল।
তিনি নায়লাকে বললেন, “আমাদের কিছু করতে হবে। না হলে এ ডেটা ছড়িয়ে পড়বে।”
নায়লা মাথা নেড়ে ব্যাগ থেকে একটি ইলেকট্রনিক জ্যামার বের করল। “দশ মিনিটের মধ্যে সিগন্যাল কেটে যাবে। কিন্তু পালাতে হলে তোমার সাহস চাই।”
দ্বিমুখী খেলা
অর্ণব এগিয়ে গেলেন গোপনে, কিন্তু হঠাৎই পেছন থেকে গলায় ঠান্ডা ধাতুর স্পর্শ। আকাশ ফিসফিস করে বলল, “হ্যালো, Raven। অনেকদিন পর।”
অর্ণব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “তুই দেশদ্রোহী।”
আকাশ হেসে উঠল। “দেশ? Raven, দেশ মানে শুধু একটা খেলার মাঠ। আসল খেলাটা টাকা আর ক্ষমতার।”
অর্ণব আঘাত করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বন্দুকের নলের ঠান্ডা ইশারা তাকে থামিয়ে দিল। আকাশ বলল, “তুই এখনো বুঝলি না? Broker আসলে কোনো ব্যক্তি নয়। এটা একটা নেটওয়ার্ক। আমরা সবাই মিলে ও।”
এই কথাটা অর্ণবের কানে বাজল বজ্রপাতের মতো। মানে, The Broker আসলে অনেকগুলো মুখ, এক সংগঠন—যার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রভেদী।
বিস্ফোরণ আর বিশ্বাসঘাতকতা
ঠিক তখনই জ্যামার সক্রিয় হলো। নিলামের পর্দা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল, আলো নিভে গেল। চারদিকে হট্টগোল।
নায়লা বন্দুক বের করে চিৎকার করল, “RUN!”
গুলির ঝড় শুরু হলো। অর্ণব দ্রুত এক টেবিল উল্টে আড়াল নিলেন। গোলাগুলির শব্দে ভরে গেল গুদামঘর। এর মধ্যেই আকাশ কোথায় মিলিয়ে গেল।
অর্ণব ছুটে গিয়ে পেনড্রাইভটা তুলে নিলেন, কিন্তু দেখলেন ওটার ভেতরে ডেটা নেই—শুধু একটাই ভিডিও ফাইল। তাতে কাবেরীকে দেখা যাচ্ছে, বাঁধা অবস্থায়, মুখে কাপড়, চোখে আতঙ্ক।
স্ক্রিনে লেখা—“Find me before it’s too late. Athens.”
অজানা পথে
অর্ণবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। আকাশের বিশ্বাসঘাতকতা, Broker-এর আসল রূপ আর কাবেরীর অবস্থান—সবকিছু একসাথে মাথায় ঘুরছে।
নায়লা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “Athens… মানে গ্রিস। Broker আমাদের সাগরের ওপারে টেনে নিচ্ছে।”
অর্ণব ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলেন। চোখে সেই পুরোনো আগুন ফিরে এসেছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
“তাহলে এবার খেলা হবে গ্রিসের মাটিতে। Broker ভেবেছে আমাকে দাবার ঘুঁটি বানাবে। কিন্তু আমি খেলার বোর্ডটাই উল্টে দেব।”
ইস্তানবুলের রাতের আকাশে তখন আগুনের ধোঁয়া মিশছে। Raven আবার পথে নেমে পড়ল—এইবার গন্তব্য Athens, যেখানে অপেক্ষা করছে নতুন ফাঁদ আর আরও ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা।
দ্য ডাবল এজেন্ট
এথেন্সের আকাশ তখন গোধূলির রঙে ভিজে আছে। প্রাচীন অ্যাক্রোপলিসের আলো জ্বলজ্বল করছে দূরে, কিন্তু শহরের অলি-গলিতে আধুনিক ষড়যন্ত্রের ছায়া ঘন হয়ে উঠছে। অর্ণব সেন এবং নায়লা নিঃশব্দে ট্যাক্সি থেকে নেমে এক ছোট্ট হোটেলে ঢুকলেন। বারবার তারা পেছন ঘুরে দেখছিলেন, যেন প্রত্যেকটা ছায়াই তাদের অনুসরণ করছে।
অর্ণব জানতেন, The Broker ইচ্ছে করেই তাদের এখানে ডেকে এনেছে। ভিডিও ফাইলে কাবেরীকে বাঁধা অবস্থায় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এও সম্ভব—এটা কেবল ফাঁদ। তবু অর্ণবের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত টান, কারণ কাবেরী শুধু সহকর্মী ছিল না, ছিল পুরোনো স্মৃতির অংশ।
নায়লা বলল, “আমরা সরাসরি RAW-কে জানাতে পারি। তাদের হেডকোয়ার্টার থেকে টিম আসবে।”
অর্ণব ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিলেন, “না। ভেতরে ফাঁস আছে। কেউ ডাবল এজেন্ট, না হলে আকাশ এত কিছু জানত কীভাবে?”
রহস্যময় সতর্কতা
রাতের খাবার শেষ করে তারা ঘরে ফিরছিলেন, হঠাৎ লবির একপাশে এক বৃদ্ধা কাগজের খাম এগিয়ে দিল। “For Mr. Sen,” শুধু এটুকুই বলল।
অর্ণব খাম খুলতেই একটা ফটোগ্রাফ পড়ে গেল। ছবিতে কাবেরী—কোনো এক অন্ধকার ঘরে বসে আছে। আর ছবির নিচে লেখা: “Trust no one in your circle.”
নায়লা ভ্রু কুঁচকাল, “মানে?”
অর্ণব উত্তর দিলেন, “মানে The Broker আমাদের ভেতরেই কাউকে কিনে ফেলেছে। আমাদের টিমের মধ্যেই একজন দেশদ্রোহী।”
ছায়ার ভেতর মুখোশ
পরদিন সকালে তারা একটি ক্যাফেতে বসে লোকেশন ট্র্যাক করার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ নায়লার ফোনে অচেনা কল এল। ওপাশ থেকে ঠান্ডা কণ্ঠ—“Agent Nayla, remember your mission. Don’t get carried away by Raven. Deliver him.”
নায়লা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অর্ণব কেবল তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
নায়লা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ফিসফিস করে বলল, “আমার মিশন ছিল তোমাকে পর্যবেক্ষণ করা। MI6 চায় Broker-এর হাত ধরে উঠে আসা পুরো নেটওয়ার্ক, আর তোমাকে ব্যবহার করা তাদের প্ল্যান। কিন্তু আমি তোমার শত্রু নই, Raven। আমি… আমি তোমার পাশে।”
অর্ণবের ভেতর সন্দেহ আর ক্রোধ মিশে গেল। তিনি জানতেন, গুপ্তচরের জগতে বিশ্বাস সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। কিন্তু নায়লার চোখে সেই মুহূর্তে যে আতঙ্ক আর সততা তিনি দেখলেন, তা মিথ্যে মনে হলো না।
কাবেরীর ক্লু
তারা গ্রিক পুলিশের গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থায় হ্যাক করলেন। ডাটাবেসে এক অজ্ঞাত নামের বন্দীর ফাইল পাওয়া গেল—কোডনেম “Red Bird।” ছবিটা ঝাপসা, কিন্তু অর্ণব নিশ্চিত—এ কাবেরী।
লোকেশন ট্রেস করা গেল শহরের প্রান্তে এক পরিত্যক্ত থিয়েটার।
অর্ণব ফিসফিস করে বললেন, “আজ রাতেই আমরা সেখানে যাব।”
নায়লা মাথা নাড়ল, কিন্তু চোখে এখনো অনিশ্চয়তার ছাপ।
পরিত্যক্ত থিয়েটার
রাত বারোটায় তারা থিয়েটারে পৌঁছোলেন। ভাঙাচোরা চেয়ার, ছাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে। মঞ্চের ওপর সত্যিই কাবেরী বসে আছে, হাত-পা বাঁধা।
অর্ণব ছুটে গিয়ে গিঁট খুলতে গিয়েছিলেন, তখনই চারদিক থেকে আলো জ্বলে উঠল।
আকাশ মালহোত্রা মঞ্চের পাশ থেকে বেরিয়ে এলো, বন্দুক হাতে। মুখে সেই পরিচিত ঠান্ডা হাসি।
“অভিনন্দন Raven। তুমি সবসময়ই ক্লু ভাঙতে পারো। কিন্তু এবার তুমি ফাঁদেই পা দিয়েছ।”
বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ
অর্ণব বন্দুক তুলতেই আকাশ হেসে বলল, “তুই ভাবছিস আমি একা? Nayla, এখনই সময়। Broker-এর নির্দেশ ছিল Raven-কে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া।”
নায়লা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মুহূর্তের জন্য অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল—তাহলে কি ও সত্যিই ডাবল এজেন্ট?
কিন্তু ঠিক পরের সেকেন্ডেই নায়লা নিজের বন্দুক আকাশের দিকে তাক করে গর্জে উঠল, “Enough! আমি Broker-এর জন্য কাজ করছিলাম না। আমি আমার দেশের জন্য কাজ করছিলাম। আর Raven-এর পাশে দাঁড়ানোই আমার মিশন।”
আকাশের মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে গেল। মুহূর্তেই গোলাগুলি শুরু হলো। অর্ণব কাবেরীকে আড়ালে টেনে নিলেন, নায়লা আক্রমণকারীদের গুলি করে ফেলল।
Broker-এর ছায়া
হট্টগোল থেমে গেলে তারা তিনজন—অর্ণব, কাবেরী আর নায়লা—দম নিতে লাগলেন। কাবেরী কাঁপা গলায় বলল, “ওরা… ওরা শুধু আমার ডেটার জন্য নয়। Broker চাইছে ভারতের ভেতর থেকে কাউকে ডাবল এজেন্ট বানাতে।”
অর্ণবের চোখে শীতল আগুন জ্বলে উঠল। “মানে আমাদের ভেতরে কেউ এখনো আছে। আর তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”
হঠাৎই থিয়েটারের ভেতর স্পিকার থেকে ভেসে এলো সেই শীতল কণ্ঠ—Broker-এর।
“ভালো কাজ করেছ, Raven। তুমি ভাবছো খেলা তুমি জিতছো। কিন্তু মনে রেখো, তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমার হাত।”
শব্দটা মিলিয়ে গেল। থিয়েটার আবার নিস্তব্ধ।
নতুন গন্তব্য
নায়লা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার কী করবে?”
অর্ণব কাবেরীর কাঁধে হাত রাখল। “আমরা একসাথে ফিরব দিল্লিতে। Broker ভেবেছে আমাদের বিভক্ত করতে পারবে। কিন্তু এবার খেলা আমরা খেলব।”
কিন্তু অর্ণব জানতেন—Broker যে ইঙ্গিত দিল, সেটা মিথ্যে নয়। তার চারপাশে এখনো ছায়ার মতো কেউ ঘাপটি মেরে আছে। আর সেই ডাবল এজেন্টের মুখোশ খুলে দেওয়াই তার পরের লক্ষ্য।
এথেন্সের রাতের আকাশে তখন ভেসে যাচ্ছে হাওয়া। Raven জানতেন, ছায়ার খেলা এখনো শেষ হয়নি—এবার শুরু হবে প্রকৃত শিকার।
কলকাতা শ্যাডোজ
কলকাতার হাওয়া যেন অন্যরকম। গ্রীষ্মের শেষে হালকা বৃষ্টির ছোঁয়া, গলির কোণে চায়ের ভাপ, আর ভাঙা রাস্তার উপর ছড়ানো অটো আর ট্রামের শব্দ—সব মিলিয়ে শহরটা যেন অতীত আর বর্তমানের সংমিশ্রণ। কিন্তু অর্ণব সেনের কাছে কলকাতা এবার কেবল বাড়ি নয়, যুদ্ধক্ষেত্র।
দিল্লি থেকে কাবেরী ও নায়লাকে নিয়ে তিনি গোপনে পৌঁছেছিলেন এই শহরে। RAW-এর অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে পাওয়া রিপোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছিল—Broker-এর নেটওয়ার্কের এক বড় অংশ কলকাতার অন্ধকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সক্রিয়। এখানেই সেই “ডাবল এজেন্ট” কাজ করছে, যে ভেতর থেকে খবর সরবরাহ করছে।
শহরের অন্ধকারে
অর্ণব ট্যাক্সি থেকে নামলেন শ্যামবাজারের কাছে এক পুরনো বাড়ির সামনে। বাড়িটার নাম চৌধুরী ভিলা—দেখতে জীর্ণ, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে রহস্য। একসময় এখানে নাটকের মহড়া হতো, এখন এটা Broker-এর শেল্টার বলে সন্দেহ।
কাবেরী ফিসফিস করে বলল, “তুই নিশ্চিত? এটা ফাঁদও হতে পারে।”
অর্ণব চোখ সরু করলেন। “খেলাটা ফাঁদেই খেলা হয়। আমরা না ঢুকলে কিছুই জানব না।”
ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল ধুলো জমে থাকা আসবাব, ভাঙা মঞ্চ আর পুরনো পোস্টার। কিন্তু মেঝেতে ছড়ানো কয়েকটা কাগজ অর্ণবের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এগুলো সাম্প্রতিক প্রিন্টআউট—RAW-এর গোপন ফাইল।
নায়লার চোখ বড় হয়ে গেল। “মানে আমাদের ভেতরের কেউ কলকাতায় ডেটা পাচার করছে।”
পুরনো মুখের প্রত্যাবর্তন
হঠাৎই ঘরের অন্ধকার থেকে গলা ভেসে এল। “স্বাগত Raven। কলকাতায় আবার দেখা হলো।”
আলো জ্বলে উঠতেই অর্ণব তাকালেন—তার সামনে দাঁড়িয়ে রুদ্রনাথ দত্ত, RAW-এর সাবেক অফিসার, যাকে অর্ণব ভেবেছিলেন বছর আগে মরে গেছে।
রুদ্রনাথ হাসল। “আমাকে কবর দেওয়ার তাড়াহুড়ো করেছিলে, তাই না? কিন্তু Broker আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এখন আমি তার চোখ আর কান।”
কাবেরী চিৎকার করে উঠল, “তুই আমাদের সবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস!”
রুদ্রনাথ শান্ত গলায় বলল, “বিশ্বাসঘাতকতা? না, বাস্তবতা। রাষ্ট্র আমাদের ব্যবহার করেছে, ফেলে দিয়েছে। Broker অন্তত সম্মান দেয়, আর ক্ষমতা।”
শিকার আর শিকারি
অর্ণব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তুই যদি ভেবে থাকিস আমি সহজে ছেড়ে দেব, ভুল করছিস। আমি Raven, আর আমার শপথ—দেশের সাথে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাকে শেষ করব।”
রুদ্রনাথ বন্দুক বের করল। “তুই Raven, ঠিকই। কিন্তু ভুলে যাসনি—আমি একসময় তোর শিক্ষক ছিলাম।”
সেকেন্ডের মধ্যে গুলির লড়াই শুরু হলো। পুরনো ভিলার দেয়ালে গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কাবেরী আর নায়লা আড়াল নিয়ে প্রতিঘাত করছিল, অর্ণব এগিয়ে যাচ্ছিলেন রুদ্রনাথের দিকে।
কিন্তু রুদ্রনাথ সহজ শিকার নয়। একসময় সে-ই অর্ণবকে লড়াই শেখিয়েছিল। তাদের দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হলো—একদিকে শিক্ষক, অন্যদিকে শিষ্য। ঘুষি, লাথি, ছুরির ঝলক—পুরোনো ভিলাটা যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হলো।
বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া
লড়াইয়ের মাঝে রুদ্রনাথ ফিসফিস করে বলল, “তুই জানিস না, Broker আসলে কে। সে একজন নয়, সে এক ছায়া। আর সেই ছায়ার ভেতর তোর পরিচিত মুখও আছে।”
অর্ণব গলা শক্ত করে বললেন, “যে-ই হোক, আমি মুখোশ ছিঁড়ব।”
অবশেষে অর্ণব রুদ্রনাথকে পরাস্ত করে মাটিতে ফেলে দিলেন। কিন্তু গুলি চালানোর আগেই রুদ্রনাথের ঠোঁটে হাসি ফুটল।
“খেলাটা এখনো শেষ হয়নি, Raven। Kolkata শুধু শুরু।”
হঠাৎ বাইরে থেকে সাইরেনের শব্দ। পুলিশ ভিলা ঘিরে ফেলেছে। কেউ তথ্য ফাঁস করেছে।
নায়লা আতঙ্কিত, “এখন কী করব?”
অর্ণব দৃঢ় স্বরে বললেন, “পালাতে হবে। Broker চাইছে আমরা এখানেই ধরা পড়ি।”
শহরের রাত
তারা গলিপথ দিয়ে পালিয়ে এলেন। চারদিক অন্ধকার, দূরে হাওড়া ব্রিজের আলো ঝলমল করছে। বৃষ্টির ভেজা রাস্তায় ছুটতে ছুটতে কাবেরী বলল, “এখন আমরা কোথায় যাব?”
অর্ণব ফিসফিস করে বললেন, “আমাকে রুদ্রনাথের দেওয়া কথাটা মনে রাখতে হবে। Broker-এর ভেতর পরিচিত মুখ আছে। আর কলকাতার ভেতরেই সেই সূত্র।”
তারা শেষমেশ পৌঁছোলেন কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানে—অর্ণবের এক পুরোনো সূত্রধরের কাছে। বৃদ্ধ দোকানদার, যিনি একসময় RAW-এর গোপন ইনফরম্যান্ট ছিলেন, তাদের আড়াল দিলেন।
সেখানে অর্ণব টেবিলে ছড়ানো নথি দেখে বুঝলেন—পরবর্তী চাল শিলিগুড়ি করিডোরে। সেখানে Broker বড় অস্ত্র চালান পাঠাচ্ছে।
সংকল্প
রাতের শেষে তারা তিনজনই চুপচাপ বসে ছিল। কাবেরী আহত, নায়লা ক্লান্ত। অর্ণব জানতেন, এবার শুধু মিশন নয়—এটা ব্যক্তিগত যুদ্ধ। কলকাতার অলি-গলিতে যে ছায়া লুকিয়ে আছে, সেটাই তার দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
তিনি ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললেন,
“খেলা এবার সীমান্তের পথে যাবে। Broker ভেবেছে সে ছায়ায় অদৃশ্য থাকবে। কিন্তু আমি তাকে দিনের আলোয় টেনে আনব। শিলিগুড়ি হবে তার শেষ খেলার মাঠ।”
কলকাতার রাতের আকাশে মেঘ জমে আসছিল। অর্ণব জানতেন, ঝড় এখনো আসেনি—কিন্তু খুব শিগগিরই আসছে।
দ্য ট্রেন টু নোহোয়ার
শিলিগুড়ির আকাশে তখন ঘন মেঘ জমেছে। পাহাড় থেকে নামা কুয়াশা শহরের রাস্তাগুলো ঢেকে দিয়েছে। রাত বারোটার ট্রেন ধরতে হবে অর্ণব সেনদের—একটা মালবাহী ট্রেন, যা দার্জিলিংয়ের দিকে যাবে। RAW-এর তথ্য বলছে, Broker-এর অস্ত্র চালান ওই ট্রেনেই লুকিয়ে পাঠানো হচ্ছে।
অর্ণব, কাবেরী আর নায়লা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছোনোর আগেই বুঝলেন কেউ তাদের নজর করছে। ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন লোক কেবল তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্ণব ঠান্ডা স্বরে বললেন, “ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে। কিন্তু এটাই সুযোগ। Broker যদি চালান পাঠায়, সেটা ধরতে হলে আমাদের ট্রেনে উঠতেই হবে।”
যাত্রার শুরু
ট্রেন ছাড়ল রাত বারোটায়। অর্ণবরা উঠে পড়লেন, কিন্তু ট্রেনটা সাধারণ যাত্রীবাহী নয়—পুরো ট্রেনজুড়ে যেন অদ্ভুত নীরবতা। কিছু কামরায় অল্প লোক, বাকিগুলো অন্ধকার।
কাবেরী ফিসফিস করে বলল, “এটা যেন কোনো ভূতের ট্রেন।”
অর্ণব উত্তর দিলেন, “ভূতের ট্রেন নয়, মৃত্যুর ট্রেন।”
তারা তিনজন ভাগ হয়ে গেলেন। নায়লা সামনে, কাবেরী মাঝের কামরা, আর অর্ণব শেষের দিকে। প্রতিটি কামরার মধ্যে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন—লোহার বাক্স, যেগুলোতে ইংরেজি আর আরবিতে লেখা কোড।
প্রথম মুখোমুখি
অর্ণব শেষের কামরায় ঢুকতেই দেখলেন তিনজন সশস্ত্র লোক বসে আছে। তারা তাকে দেখেই বন্দুক তুলল। কিন্তু Raven আর পুরনো বই বিক্রেতা অর্ণব একই মানুষ নয়।
সেকেন্ডের মধ্যে তিনি দুইজনকে আঘাত করলেন, আরেকজনকে আঘাত করে অজ্ঞান করলেন। বাক্স খুলে দেখলেন—ভেতরে আধুনিক রাইফেল, বিস্ফোরক, আর একাধিক ড্রোন।
নায়লা তার কমিউনিকেটরে জানাল, “আমি সামনে দুইজন গার্ড দেখেছি। Broker চাইছে এ ট্রেন সোজা সীমান্ত পেরিয়ে যাক।”
অর্ণব উত্তর দিলেন, “না, সেটা হবে না। এই ট্রেনই আমাদের প্রমাণ।”
অদৃশ্য যাত্রী
কাবেরী মাঝের কামরায় একা ছিল। হঠাৎই আলো নিভে গেল। অন্ধকারে কারও নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। সে বন্দুক তুলতেই পেছন থেকে একটা ঠান্ডা কণ্ঠস্বর—
“Welcome back, Kaberi.”
কাবেরী ঘুরে তাকাল—সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ মালহোত্রা। মুখে সেই ঠান্ডা হাসি।
“Broker চায় না তুমি এ ট্রেন থেকে জীবিত নামো। Raven আসবে, আর আমি তাকে এখানেই শেষ করব।”
কাবেরী মরিয়া হয়ে লড়াই করল। কামরার ভেতর হাতাহাতি, বন্দুকের ঝলক, জানালা ভেঙে বাইরে অন্ধকার দৌড়ে চলা বনভূমি।
ট্রেনের ভেতরে যুদ্ধ
শব্দ শুনে অর্ণব দৌড়ে এলেন। তিনি আকাশকে দেখেই রক্তে আগুন অনুভব করলেন।
“আকাশ!”
আকাশ হেসে উঠল। “তুই আবারও সময় মতো হাজির, Raven। কিন্তু এটাই তোর শেষ রাত।”
দু’জনের লড়াই শুরু হলো চলন্ত ট্রেনের কামরার ভেতর। চারদিক অন্ধকার, কেবল ট্রেনের ঝাঁকুনিতে আলো-ছায়া পাল্টাচ্ছে। আকাশ দক্ষ, কিন্তু অর্ণবের চোখে প্রতিশোধের আগুন। ঘুষি, ছুরি, বন্দুক—সব মিলিয়ে কামরাটা যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
নায়লা এসে যোগ দিল। একসাথে তিনজনের লড়াই চলল। কিন্তু ঠিক তখনই ট্রেনের সামনের দিক থেকে ভেসে এলো অদ্ভুত শব্দ—একটা টিকটিকির মতো আওয়াজ, কিন্তু আসলে সেটা টাইমার।
বিস্ফোরণের ছায়া
অর্ণব বুঝলেন, ট্রেনে বোমা বসানো হয়েছে। আকাশ হেসে বলল, “যদি আমি মরিও, তোমরাও মরবে। Broker কাউকে বাঁচতে দেবে না।”
অর্ণব আঘাত করে আকাশকে অজ্ঞান করলেন। তারপর দ্রুত বাক্সগুলো খুলে দেখলেন—একটা শক্তিশালী বিস্ফোরক, যা পুরো ট্রেন উড়িয়ে দেবে। টাইমার চলছে—মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।
কাবেরী কাঁপা গলায় বলল, “আমরা কি নেমে যাব?”
অর্ণব মাথা নাড়লেন। “না। যদি ট্রেনটা উড়ে যায়, সীমান্ত পেরোনোর আগে ভারতের নাম কালো হবে। আমাকে এটা নিষ্ক্রিয় করতেই হবে।”
সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়
নায়লা বিস্ফোরকের সার্কিট খুঁজে বের করল। কিন্তু সেটি ছিল জটিল। তিনটি তার—লাল, নীল, সবুজ। কোনটা কাটলে বিস্ফোরণ থামবে, আর কোনটা কাটলে সেকেন্ডের মধ্যে সব উড়ে যাবে—কেউ জানে না।
অর্ণব ঠান্ডা মাথায় নিঃশ্বাস ফেললেন। “Broker সবসময়ই মানসিক খেলা খেলে। যদি আমরা ভুল করি, ও জিতবে।”
তিনি চোখ বন্ধ করলেন, পুরনো প্রশিক্ষণ মনে পড়ল। তারপর ছুরি দিয়ে নীল তার কেটে দিলেন।
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা—তারপর টাইমার থেমে গেল।
মুক্তির শ্বাস
কাবেরী চেয়ারে বসে পড়ল, নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই আবারও অলৌকিক কাজ করলি, Raven।”
নায়লা মৃদু হাসল। “আমরা এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু আকাশ?”
অর্ণব তাকাল অজ্ঞান আকাশের দিকে। “ওকে আমরা দিল্লিতে নিয়ে যাব। Broker-এর নেটওয়ার্কের ভেতরকার তথ্য ওর কাছেই আছে।”
ট্রেন ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছিল। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু অর্ণব জানতেন, খেলা এখানেই শেষ নয়।
Broker এখনো ছায়ার আড়ালে আছে। আর ওর পরের চাল আরো ভয়ংকর হবে।
তিনি জানালার বাইরে তাকিয়ে ধীরে ফিসফিস করলেন,
“ট্রেন থেমেছে, কিন্তু যুদ্ধ চলছেই। এবার আমি Broker-কে খুঁজে বের করব, যেখানেই সে থাকুক।”
লন্ডন ফগ
লন্ডনের আকাশ সবসময়ই কুয়াশাচ্ছন্ন। বসন্তকাল হলেও শহরের রাস্তায় যেন অদৃশ্য কুয়াশার চাদর পাতা। হিথ্রো থেকে বেরোনোর মুহূর্তেই অর্ণব সেন বুঝলেন, এখানে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি মুখ তার দিকে নজর রাখছে। Broker এবার তাকে একেবারে ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দুতে টেনে এনেছে।
অর্ণবের সাথে আছে কাবেরী আর নায়লা। আকাশ মালহোত্রাকে গোপনে MI6-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আকাশ অজ্ঞান, কিন্তু জেগে উঠলে Broker-এর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য বের করা সম্ভব হবে। তবুও অর্ণব জানতেন—Broker কখনো এত সহজে তার ছায়া ফাঁস করবে না।
লন্ডনের অলি-গলি
প্যাডিংটনের এক পুরনো হোটেলে তারা আড়াল নিলেন। রাতে নায়লা বলল, “আমরা MI6-এর সদর দফতরে আকাশকে হস্তান্তর করেছি। কিন্তু হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে মেসেজ এসেছে—সতর্ক থাকতে। Broker-এর লোকজন লন্ডনেই সক্রিয়।”
কাবেরী ক্লান্ত গলায় বলল, “তাহলে এবার কী?”
অর্ণব জানালার বাইরে তাকিয়ে বললেন, “Broker চায় আমরা হোঁচট খাই। কিন্তু ওর নেটওয়ার্ক ভাঙতে হলে আমাদের শত্রুর পেছনে ছুটতে হবে না—ওদের টেনে আনতে হবে আমাদের সামনে।”
প্রথম সূত্র
পরদিন সকালে লন্ডন ব্রিজের নিচে এক গোপন মিটিং ঠিক হয়েছিল। MI6-এর এজেন্ট থমাস অর্ণবকে একটা ডসিয়ার দিল। তাতে উল্লেখ ছিল “Project Helix”—একটা সাইবার প্রোগ্রাম, যা সেকেন্ডের মধ্যে যেকোনো দেশের সিকিউরিটি সিস্টেম ভেঙে ফেলতে পারে। রিপোর্ট অনুযায়ী, Broker এটা কালোবাজারে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছে।
থমাস ঠান্ডা স্বরে বলল, “আমরা সন্দেহ করছি ভারতীয় ডেটার সাথে মিলিয়ে Helix ব্যবহার করে এশিয়া জুড়ে সাইবার ব্ল্যাকআউট ঘটাতে চাইছে।”
অর্ণব ফাইল বন্ধ করলেন। “তাহলে Broker শুধু অস্ত্র ব্যবসায়ী নয়। ও একেবারে বৈশ্বিক অন্ধকার তৈরি করতে চাইছে।”
ছায়ার আক্রমণ
মিটিং শেষ হতেই হঠাৎ ব্রিজের উপর বিস্ফোরণ হলো। ধোঁয়া আর আতঙ্কে ভরে গেল চারদিক। ছায়ার মতো কয়েকজন লোক গুলি চালাতে শুরু করল।
অর্ণব দ্রুত কাবেরীকে আড়ালে টেনে নিলেন। নায়লা প্রতিঘাত করল, গুলির শব্দে থেমে গেল টেমস নদীর শান্ত ঢেউ।
একজন আততায়ী কাছে চলে আসতেই অর্ণব গলা চেপে ধরে মাটিতে ফেললেন। মুখোশ খুলে দেখলেন—ও MI6-এরই একজন ভেতরের এজেন্ট।
অর্ণবের বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। “তাহলে Broker-এর হাত লন্ডনের ভেতরেও।”
আকাশের জাগরণ
MI6 সদর দফতরে ফিরে এসে তারা দেখল আকাশ জেগে উঠেছে। বাঁধা অবস্থায়ও তার মুখে সেই ঠান্ডা হাসি।
অর্ণব তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বল কে Broker?”
আকাশ মুচকি হেসে উত্তর দিল, “Broker কেউ নয়, সবাই। আর Raven, তুই বুঝতেছিস না—তোর চারপাশে যাদের উপর ভরসা করছিস, তাদের মধ্যেই আমার মানুষ আছে।”
নায়লা রাগে গর্জে উঠল, “চুপ কর!”
কিন্তু আকাশ ফিসফিস করে বলল, “Nayla… don’t you remember London mission, two years back? তুমি তো তখনই Broker-এর সাথে যোগাযোগে ছিলে।”
কাবেরীর চোখ বড় হয়ে গেল। “নায়লা, এটা কি সত্যি?”
নায়লা চিৎকার করে উঠল, “না! Broker শুধু বিভ্রান্ত করতে চাইছে। আমি Raven-এর পাশে।”
অর্ণব চুপ করে সব দেখছিলেন। গুপ্তচরের জগতে বিশ্বাস ভাঙার মুহূর্তগুলোই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
কুয়াশার আড়ালে
সন্ধ্যায় তারা লন্ডনের ডকল্যান্ডস অঞ্চলে গেলেন। তথ্য অনুযায়ী, সেখানেই Project Helix-এর সিক্রেট সার্ভার রাখা হয়েছে। কিন্তু পৌঁছাতেই অর্ণব বুঝলেন, এটা কোনো সাধারণ জায়গা নয়। গুদামঘর ভরে আছে সশস্ত্র প্রহরীতে, আর ছাদের উপর স্নাইপার।
নায়লা ফিসফিস করে বলল, “আমাদের ভেতরে ঢোকার উপায় নেই।”
অর্ণব ঠান্ডা স্বরে বললেন, “যত শক্ত সিকিউরিটি, তার ভেতরেই সবচেয়ে বড় ফাঁক থাকে।”
তারা তিনজন ভাগ হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। কাবেরী ভেতরের সার্ভার রুম খুঁজে পেল। কিন্তু কোড ভাঙতে গিয়ে দেখল, সিস্টেমে ইতিমধ্যেই অর্ণবের নাম ঢোকানো আছে। অর্থাৎ, Broker চায় দোষটা অর্ণবের কাঁধেই চাপানো হোক।
লন্ডনের অন্ধকার
হঠাৎই অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল। লাল আলো জ্বলে উঠল চারদিকে। সশস্ত্র প্রহরীরা ছুটে এলো।
অর্ণব চিৎকার করে বললেন, “RUN!”
গুলির ঝড়ে ভরে গেল গুদাম। কাবেরী একটা হার্ডড্রাইভ নিয়ে দৌড় দিল। নায়লা অর্ণবকে আড়াল করে গুলি চালাচ্ছিল।
টেমসের ধারে এসে তারা থেমে গেল। কুয়াশার মধ্যে লন্ডন ব্রিজ ঝাপসা দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু হঠাৎ কানে ভেসে এলো সেই পরিচিত কণ্ঠ—Broker-এর।
“Raven, তুমি এখনো বুঝতে পারছো না। তুমি যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করো, সেখানেই আমার মুখোশ।”
অর্ণব চারপাশে তাকালেন। কাবেরী আর নায়লা—দু’জনই তার পাশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কে? কাকে বিশ্বাস করবেন?
সন্দেহের শিকড়
হার্ডড্রাইভ হাতে কাবেরী কাঁপা গলায় বলল, “এটা Helix-এর আসল কোড। যদি আমরা এটা দিল্লিতে নিয়ে যেতে পারি, Broker-এর খেলাটা শেষ।”
নায়লা চোখ সরু করে তাকাল। “তুমি কি নিশ্চিত? নাকি Broker আবার আমাদের ফাঁদে ফেলছে?”
অর্ণবের বুকের ভেতর হঠাৎ দ্বিধার ঢেউ উঠল। দু’জনেই তার সহযোদ্ধা, দু’জনেরই প্রাণ সে বাঁচিয়েছে। কিন্তু Broker-এর কণ্ঠে যে ইঙ্গিত এসেছে—তার মানে একটাই, বিশ্বাসঘাতকতা এখনো ছায়ার মতো ভেতরে লুকিয়ে আছে।
শেষ দৃশ্য
তারা যখন হোটেলে ফিরছিল, তখন দূরে ঘণ্টার ধ্বনি বাজছিল—বিগ বেনের টাওয়ার ঘড়ি।
অর্ণব নিঃশব্দে জানালার বাইরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“London fog-এর আড়ালে সত্যিকারের মুখ লুকিয়ে আছে। আমি Broker-এর সেই মুখোশ ছিঁড়ব। যেই হোক, সে এখন আমার শিকার।”
কুয়াশার শহরে রাত আরও গভীর হলো। Raven জানতেন, খেলাটা এখন তার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছেছে।
(চলবে…)
ব্লাড সাইফার
লন্ডনের রাত
লন্ডনের রাত অদ্ভুত রকম শান্ত, কিন্তু অর্ণব সেন জানতেন সেই নীরবতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে বজ্রপাত। হোটেলের জানালায় কুয়াশার ফোঁটা জমে গেছে। দূরে বিগ বেনের ঘড়ি বাজছে। কাবেরী সোফার উপর বসে ঘুমিয়ে পড়ার মতো ক্লান্ত, কিন্তু হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেই হার্ডড্রাইভ। নায়লা চুপচাপ বসে সিগারেট খাচ্ছিল, চোখের দৃষ্টিটা যেন অস্পষ্ট।
অর্ণব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে তাকালেন। তিরিশ বছরের গোয়েন্দা জীবনে তিনি অনেক ছায়া দেখেছেন, অনেক বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করেছেন। কিন্তু এবার যেন ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। Broker শুধু শত্রু নয়—সে যেন এক অদৃশ্য অর্কেস্ট্রা, আর অর্ণব বাধ্যত মিউজিশিয়ান।
হার্ডড্রাইভের রহস্য
পরদিন সকালে তারা MI6-এর সেফ হাউসে গেলেন। হার্ডড্রাইভ খুলতেই দেখা গেল ভেতরে এক অদ্ভুত সাইফার, রক্তের মতন লাল রঙে এনক্রিপ্টেড। ফাইলের নাম: “Blood Cipher”।
MI6 টেকনিশিয়ানরা হ্যাক করার চেষ্টা করল, কিন্তু সাইফার খুলতেই স্ক্রিনে শুধু একটি লাইন ঝলসে উঠল—
“Truth demands sacrifice.”
থমাস, MI6 অফিসার, আতঙ্কিত গলায় বলল, “এটা শুধু এনক্রিপশন না। যদি ভুল চাবি ঢোকাও, কোড নিজে থেকেই ডিলিট হয়ে যাবে।”
অর্ণব শান্ত স্বরে বললেন, “Broker জানে আমাদের তাড়াহুড়ো। তাই সে চাইছে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করি সূত্র।”
কাবেরীর আবিষ্কার
কাবেরী রাতভর কাজ করে একটি সূত্র খুঁজে পেল। কোড ভাঙতে হলে প্রাচীন ভাস্কর্য লিপির সঙ্গে তুলনা করতে হবে। Blood Cipher কোনো আধুনিক কোড নয়, বরং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো এনক্রিপশন।
কাবেরী উৎসাহিত স্বরে বলল, “এটা মিশরের হায়ারোগ্লিফ আর ভৈদিক সংখ্যার মিশ্রণ। যিনি কোড লিখেছেন, তিনি শুধু কম্পিউটার হ্যাকার নন—একজন ঐতিহাসিক।”
অর্ণবের মাথায় হঠাৎ একটা ছবি ভেসে উঠল। কয়েক বছর আগে ইস্তানবুলে Broker-এর নামে এক আর্ট কালেক্টরের কথা শোনা গিয়েছিল—যিনি ইতিহাস আর প্রযুক্তি মিশিয়ে কাজ করতেন।
বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া
নায়লা হঠাৎ ঠান্ডা স্বরে বলল, “আমরা কি নিশ্চিত যে কাবেরীর সূত্র ঠিক? Broker চাইলে আমাদের ভুল দিকেও পাঠাতে পারে।”
কাবেরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। “তাহলে তোমার মতে আমরা বসে থাকব?”
নায়লা উত্তর দিল না, শুধু সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।
অর্ণব বুঝলেন, দলের মধ্যে ফাটল তৈরি হচ্ছে। Broker-এর সবচেয়ে বড় অস্ত্র এটাই—বিশ্বাস নষ্ট করা।
লন্ডন লাইব্রেরি
পরদিন তারা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গেলেন। বিশাল গম্বুজের নিচে বইয়ের সমুদ্রের ভেতর কাবেরী হঠাৎ একটি পুরনো পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেল। তাতে এক রহস্যময় প্রতীক আঁকা—যা Blood Cipher-এর সাথেই মিলে যায়।
কাবেরী চিৎকার করে উঠল, “এই প্রতীক! এটা Broker-এর সিগনেচার। Helix প্রোগ্রাম বিক্রি করতে চাইলে তাকে এই কোড ব্যবহার করতেই হবে।”
ঠিক তখনই লাইব্রেরির ভেতর গুলির শব্দ। কালো পোশাকের ভাড়াটে লোক ঢুকে পড়ল।
রক্ত আর ধাওয়া
অর্ণব দ্রুত কাবেরীকে আড়াল করলেন। লাইব্রেরির মার্বেল মেঝেতে রক্ত ছিটকে পড়ল। নায়লা পেছনের দরজা দিয়ে প্রতিঘাত করছিল। গুলি, চিৎকার, বইয়ের স্তূপ ভেঙে পড়া—সব মিলে লাইব্রেরি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল।
একজন আততায়ী অর্ণবকে লক্ষ্য করে ছুটে এলো। অর্ণব তার হাত মুচড়ে বইয়ের তাকের সাথে আছড়ে ফেললেন। কিন্তু আততায়ী শেষ মুহূর্তে বলল, “You can’t trust her…” তারপর নিস্তেজ হয়ে গেল।
অর্ণবের চোখে ধাঁধা—সে কি নায়লার দিকে ইঙ্গিত করল, নাকি কাবেরীর দিকে?
গোপন নথি
তারা পালিয়ে এসে এক নির্জন চার্চে আশ্রয় নিল। কাবেরী হার্ডড্রাইভ আর পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে একটি বাক্য উদ্ধার করল—
“In the blood of the betrayed, lies the key.”
নায়লা হতবাক। “মানে কী?”
অর্ণব ঠান্ডা স্বরে বললেন, “মানে হচ্ছে, কোড ভাঙতে হলে কাউকে বলি দিতে হবে। আর সেই বলি হতে হবে বিশ্বাসঘাতকের।”
চুপচাপ অন্ধকারে তিনজন একে অপরের দিকে তাকাল।
নায়লার স্বীকারোক্তি
মধ্যরাতে নায়লা একা অর্ণবের কাছে এলো। ফিসফিস করে বলল, “Raven, আমি স্বীকার করছি—Broker একসময় আমাকে যোগাযোগ করেছিল। লন্ডনের পুরনো মিশনে। আমি তখন ওদের তথ্য দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমি বেরিয়ে আসি।”
অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেলেন। “তাহলে আকাশ যা বলেছিল, সেটা মিথ্যে নয়।”
নায়লার চোখে জল। “আমি ভুল করেছি। কিন্তু আজ আমি শুধু তোমার পাশে।”
অর্ণবের মনে দ্বিধা। সে জানে গুপ্তচরের জগতে একবার বিশ্বাসঘাতক মানেই মৃত্যু। কিন্তু নায়লার চোখে যেন সত্যের ছায়া।
কোডের চাবি
কাবেরী অবশেষে আবিষ্কার করল, সাইফার ভাঙতে হলে রক্তের ডিএনএ দরকার। কিন্তু কাদের? Broker এমন এক ফাঁদ বানিয়েছে, যেখানে দল ভেতর থেকেই ভাঙবে।
হার্ডড্রাইভে একটা প্রম্পট এলো: “Choose the sacrifice.”
নায়লা শান্ত গলায় বলল, “আমার রক্ত ব্যবহার করো। আমি একসময় ভুল করেছি, তাই শাস্তি আমার প্রাপ্য।”
কাবেরী কেঁপে উঠল, “না! এটা ঝুঁকিপূর্ণ। যদি ভুল হয়, সাইফার পুরো ডিলিট হয়ে যাবে।”
অর্ণবের মনে দ্বন্দ্ব। একজন সঙ্গীকে উৎসর্গ করা কি ঠিক? নাকি Broker-এর আরেকটা চাল?
অদ্ভুত ফলাফল
নায়লার রক্ত দিয়ে যখন ডিএনএ ইনপুট করা হলো, স্ক্রিনে ধীরে ধীরে খুলে গেল কোড।
একটি লাইন জ্বলে উঠল—
“Next move: Delhi. 72 hours.”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। Broker-এর আসল খেলা এখন শুরু হবে দিল্লিতে। মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা সময় হাতে।
শেষ দৃশ্য
অর্ণব জানালার বাইরে তাকিয়ে দিল্লির আকাশ কল্পনা করলেন। শহরের মেট্রো টানেল, লাখো মানুষের জীবন, আর সেই অদৃশ্য ছায়া Broker।
নায়লা চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে। তার রক্তই কোড খুলেছে। কিন্তু এটা কি সত্যিকারের প্রায়শ্চিত্ত, নাকি আরেকটা ফাঁদ?
কাবেরী ফিসফিস করে বলল, “Raven, এবার যদি আমরা হেরে যাই, পুরো দেশ অন্ধকারে ডুবে যাবে।”
অর্ণব ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিলেন, “আমি হারব না। Broker এবার নিজের রক্তেই ডুবে যাবে।”
লন্ডনের কুয়াশার রাত যেন বিদায় নিল। কিন্তু আসন্ন ঝড়ের হাওয়া ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লির পথে।
বিট্রেয়াল
দিল্লিতে ফেরা
লন্ডনের কুয়াশার ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া বার্তাটা এখন অর্ণব সেনের বুকের ভেতর পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে—“Next Move: Delhi. 72 Hours.”
তিনজন — অর্ণব, কাবেরী আর নায়লা — আবার ফিরল দিল্লিতে। শহরটা যেন আগের থেকেও ভারী, অস্বস্তিকর। মেট্রো টানেলে, অফিস চত্বরগুলোয়, এমনকি বইয়ের দোকানের গলিতেও যেন এক অদৃশ্য অ্যালার্ম বাজছে।
RAW সদর দফতরে গোপন বৈঠক ডাকা হলো। অর্ণব রিপোর্ট দিলেন, “Broker-এর পরবর্তী হামলা দিল্লিতেই হবে। আমাদের হাতে সময় কম।”
কিন্তু কনফারেন্স রুমে বসা সিনিয়র অফিসারদের চোখে অদ্ভুত এক শীতলতা। কেউ যেন তার কথা বিশ্বাস করছে না।
কাবেরী ফিসফিস করে বলল, “তুই বুঝছিস না? এখানেই ভেতরে কেউ আছে, Broker-এর লোক।”
অর্ণব জানতেন, এবার বিশ্বাসঘাতকতার মুখোশ খোলার সময় এসেছে।
অদ্ভুত আচরণ
নায়লা আগের কয়েকদিন অদ্ভুত চুপচাপ। তার হাতে এখনো রক্তের দাগ, যেটা Blood Cipher খুলতে ব্যবহার হয়েছিল।
কাবেরী এক রাতে অর্ণবকে বলল, “আমি নায়লাকে বিশ্বাস করি না। Broker বারবার বলছে আমাদের টিমেই তার লোক আছে। আকাশও ইঙ্গিত দিয়েছিল। তুই কি অন্ধ?”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করি না। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কাউকে অভিযুক্ত করলে আমরা সবাই শেষ।”
মেট্রো টানেলের ছায়া
তথ্য এল—Broker দিল্লি মেট্রো টানেলে বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করছে। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াত করে, একবার বিস্ফোরণ হলে শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী কেঁপে উঠবে।
অর্ণব, কাবেরী আর নায়লা RAW-এর ট্যাকটিক্যাল টিম নিয়ে ঢুকলেন টানেলে। বাতাস ভারী, আলো ম্লান।
হঠাৎ নায়লা থেমে গেল। তার চোখে অদ্ভুত এক দ্বিধা। অর্ণব প্রশ্ন করল, “কি হলো?”
নায়লা উত্তর দিল না। দূর থেকে একটা শব্দ শোনা গেল—ক্লিক! টাইমারের শব্দ।
বিস্ফোরক আবিষ্কার
টানেলের ভেতরে একাধিক ব্যাগে বিস্ফোরক রাখা। টাইমার চলছে, মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি। টিম ভয় পেয়ে গেল।
কাবেরী বলল, “আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। কেউ যদি ভুল করে, সব শেষ।”
অর্ণব ঠান্ডা মাথায় ব্যাগ খুলল। ভেতরে আবারো সেই Broker-এর সিগনেচার—রক্তলাল প্রতীক। আর একটা নোট: “Betrayal begins within.”
মুখোশ খুলে যায়
ঠিক তখনই হঠাৎ পিছন থেকে গুলি। RAW-এর এক অফিসার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সবাই ঘুরে তাকাল—নায়লার হাতে ধোঁয়া ওঠা বন্দুক।
কাবেরী চিৎকার করে উঠল, “আমি বলেছিলাম! সে-ই বিশ্বাসঘাতক!”
নায়লার চোখে জল, কিন্তু গলায় দৃঢ়তা। “না! আমি বাধ্য। Broker আমার পরিবারকে বন্দী করেছে। আমি যদি না মানি, ওরা মারা যাবে।”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। এই স্বীকারোক্তি সবকিছু ওলটপালট করে দিল। বিশ্বাসঘাতকতা, কিন্তু প্রয়োজনে বাধ্য।
অর্ণব ধীরে ধীরে বললেন, “তুই আমাকে বিশ্বাস করতে পারতি। আমি পরিবারকেও বাঁচাতাম।”
নায়লা ভাঙা গলায় বলল, “আমাকে বিশ্বাস? গুপ্তচরের জগতে সেটা সবচেয়ে বড় মিথ্যে।”
দ্বিমুখী লড়াই
হঠাৎ টানেলের অন্যদিক থেকে আকাশ মালহোত্রা বেরিয়ে এল। সে RAW-এর হেফাজত থেকে পালিয়ে এসেছে। ঠোঁটে সেই চেনা হাসি।
“দেখেছ Raven? আমি বলেছিলাম, তোমার পাশে থাকা মানুষই একদিন তোমার শত্রু হবে।”
নায়লা বন্দুক তুলল আকাশের দিকে। “আমি শত্রু নই। আমি আমার ভুল শোধ করতে চাই।”
আকাশ হেসে উঠল। “তাহলে শোধ দাও, আমাকে বাঁচিয়ে।”
গুলির ঝড় শুরু হলো টানেলের ভেতর। আলো নিভে গেল, চারদিক অন্ধকার। বিস্ফোরণের টাইমার নামতে নামতে ১৫ মিনিটে এসে দাঁড়াল।
চরম মুহূর্ত
অর্ণব আকাশের সাথে হাতাহাতি করছিল। লড়াই এতটাই নির্মম যে মাটিতে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল। কাবেরী বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার হাতে কাঁপুনি।
নায়লা দু’জনের দিকে তাকাল। তার চোখে দ্বিধা—কাকে বাঁচাবে, কাকে হত্যা করবে?
হঠাৎ সে নিজের বন্দুক আকাশের দিকে তাক করল। গুলির শব্দে আকাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু একইসাথে নায়লার বুকেও রক্ত ঝরে পড়ল—পাশ থেকে আরেক আততায়ীর গুলি লেগেছে।
নায়লা মাটিতে পড়ে ফিসফিস করে বলল, “Raven… আমাকে ক্ষমা করো। Broker-কে থামাও।”
অর্ণব তার হাত চেপে ধরল। কিন্তু নায়লার নিঃশ্বাস থেমে গেল।
বিস্ফোরণ থামানো
শেষ কয়েক মিনিট। কাবেরী কাঁপা হাতে তারগুলো কেটে দিল। টাইমার ০০:০১-এ এসে থেমে গেল।
অর্ণব গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। দিল্লি বেঁচে গেল। কিন্তু নায়লা রক্তে ভেসে গেল।
নতুন শক
RAW সদর দফতরে ফিরে এসে রিপোর্ট জমা দেওয়া হলো। সবাই নায়লাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই দেখল।
কিন্তু কাবেরী গোপনে অর্ণবকে একটা নথি দেখাল। Broker থেকে পাঠানো গোপন মেসেজ—
“She was never ours. The real betrayal is still beside you.”
অর্ণবের চোখে বজ্রপাত।
মানে—নায়লা আসলেই Broker-এর এজেন্ট ছিল না। আসল বিশ্বাসঘাতক এখনো তার একেবারে কাছেই লুকিয়ে আছে।
শেষ দৃশ্য
রাতের দিল্লি শহর তখন শান্ত। মেট্রোর আলো জ্বলছে। কিন্তু অর্ণব জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবলেন—
“আমি যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি, হয়তো সেই-ই আমার বিরুদ্ধে।”
কাবেরী পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “Raven, এবার শেষ খেলা। Broker-কে নামাতে হবে।”
অর্ণবের চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
“হ্যাঁ। শেষ খেলা। Shadow Protocol।”
শ্যাডো প্রোটোকল
দিল্লির শেষ রাত
দিল্লির আকাশে অদ্ভুত এক চাপা অন্ধকার নেমে এসেছে। অর্ণব সেন জানতেন—এটাই চূড়ান্ত মুহূর্ত। নায়লা আর নেই, কাবেরী আহত, আর তিনি একাই দাঁড়িয়ে আছেন Broker নামের ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
RAW সদর দফতরে বিশৃঙ্খলা। অফিসাররা বিভক্ত—কেউ অর্ণবের উপর সন্দেহ করছে, কেউ আবার বিশ্বাস করছে। আকাশ মালহোত্রা মৃত, নায়লা আত্মাহুতি দিয়েছে, কিন্তু Broker এখনো অদৃশ্য।
কাবেরী ক্লান্ত গলায় বলল, “Raven, আমরা একা হয়ে যাচ্ছি। ভেতরে এখনও কোনো ডাবল এজেন্ট আছে।”
অর্ণব ঠান্ডা চোখে তাকাল। “হ্যাঁ। আর আজ রাতেই তার মুখোশ আমি খুলব।”
চূড়ান্ত সূত্র
Blood Cipher-এর শেষ লাইন অর্ণবকে তাড়া করে ফিরছিল: “Truth demands sacrifice.”
RAW-এর সার্ভার রুমে ঢুকে তিনি গোপন লগ চেক করতে শুরু করলেন। কয়েক ঘণ্টার অনুসন্ধানে উঠে এল চমকপ্রদ তথ্য—ডাবল এজেন্ট আসলে সদর দফতরের শীর্ষ অফিসার, জেনারেল রাঠোর।
এই মানুষই একসময় অর্ণবকে নিয়োগ করেছিলেন, আজ সেই-ই Broker-এর ছায়া। অর্ণব বুঝলেন, তাই এতদিন তথ্য ফাঁস হচ্ছিল ভেতর থেকে।
মুখোমুখি
মধ্যরাতে অর্ণব রাঠোরের অফিসে ঢুকলেন। দরজা বন্ধ। ভেতরে অদ্ভুত নীরবতা।
রাঠোর চেয়ারে বসে ছিল, হাতে এক গ্লাস হুইস্কি। ঠোঁটে হাসি।
“অর্ণব, আমি জানতাম তুই আসবি। তুই সবসময়ই তীক্ষ্ণ।”
অর্ণব বন্দুক তুললেন। “তুমি Broker-এর লোক?”
রাঠোর হেসে উঠল। “লোক না, আমি-ই Broker। না, পুরো নেটওয়ার্ক আমি চালাই না। কিন্তু Shadow Protocol আমার সৃষ্টি। সরকার আমাকে উপেক্ষা করেছিল, আমার পরিকল্পনাকে অবমূল্যায়ন করেছিল। তাই আমি আমার নিজের সাম্রাজ্য গড়েছি।”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। এতদিন যাকে তিনি মেন্টর ভেবেছিলেন, সে-ই আসল বিশ্বাসঘাতক।
যুদ্ধ শুরু
হঠাৎ আলো নিভে গেল। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল সশস্ত্র লোকজন। RAW সদর দফতরের ভেতরেই Broker-এর সৈন্যরা। গুলির ঝড়ে কেঁপে উঠল ভবন।
অর্ণব আড়াল নিয়ে প্রতিঘাত করলেন। কাবেরী পাশ থেকে গুলি চালাচ্ছিল। সার্ভারের লাল আলো জ্বলে উঠল, যেন শহরের হৃদয় কেঁপে উঠছে।
রাঠোর ফিসফিস করে বলল, “তুই চাইলে আমাকে গুলি করিস, কিন্তু Shadow Protocol ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে। দিল্লির মেট্রো টানেল, পাওয়ার গ্রিড, সব কন্ট্রোল আমার হাতে।”
সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়
অর্ণব কাবেরীকে বললেন, “তুই সার্ভারে ঢুক। Shadow Protocol থামাতে হবে।”
কাবেরী কীবোর্ডে হাত চালাল, কিন্তু কোড ভাঙা অসম্ভব। স্ক্রিনে আবারও ভেসে উঠল সেই লাল প্রতীক।
“Truth demands sacrifice.”
অর্ণব বুঝলেন, এবার সত্যিকারের বলিদান দিতে হবে।
চরম মুহূর্ত
রাঠোর বন্দুক তুলে অর্ণবকে লক্ষ্য করল। “Raven, এবার খেলা শেষ।”
ঠিক তখনই কাবেরী চিৎকার করে উঠল, “অর্ণব! সার্ভার থামাতে হলে মূল বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিতে হবে। কিন্তু সেটা করলে ভেতরে থাকা মানুষও মরবে।”
অর্ণব এক সেকেন্ডের জন্য থমকালেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
“আমি শপথ নিয়েছিলাম দেশকে বাঁচাব। যদি আমাকে মরতে হয়, তবে সেভাবেই।”
তিনি ছুটে গিয়ে বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে সার্ভার ধসে পড়ল, Shadow Protocol থেমে গেল। বিস্ফোরণ আর হলো না।
রক্তে লেখা বিজয়
গোলাগুলির মধ্যে রাঠোর পালাতে যাচ্ছিল। অর্ণব তার পথ আটকাল। দুজনের মধ্যে নির্মম হাতাহাতি শুরু হলো।
রাঠোর গর্জে উঠল, “তুই আমাকে থামাতে পারবি না। Broker অমর।”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বললেন, “কোনো ছায়াই চিরকাল থাকে না।”
এক ঝটকায় তিনি রাঠোরের বন্দুক ছিনিয়ে নিলেন। গুলির শব্দে অফিস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। Broker—অন্তত তার এই মুখ—শেষ হলো।
ভোরের আলো
দিল্লির আকাশে তখন ভোর। মেট্রোর ট্রেন চলতে শুরু করেছে, মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। কেউ জানে না রাতের অন্ধকারে কীভাবে শহরটা বেঁচে গেল।
অর্ণব বাইরে এসে দেখলেন, কাবেরী রক্তাক্ত হলেও বেঁচে আছে। দু’জনের চোখে এক নিঃশব্দ বোঝাপড়া।
কাবেরী ফিসফিস করে বলল, “খেলা কি সত্যিই শেষ হলো?”
অর্ণব আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না। Broker একটা নাম নয়, একটা ছায়া। আজ আমরা এক মুখ থামালাম, কাল আবার নতুন মুখ আসবে। কিন্তু আমি লড়ব।”
RAW সদর দফতরের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে Raven বুঝলেন—তার শান্তির জীবন আর ফিরে আসবে না। বইয়ের দোকানের নিরিবিলি কোণ, পুরোনো পৃষ্ঠার গন্ধ—সবই এখন অতীত। তিনি আবার Raven, ছায়ার ভেতরকার ছায়া।
কিন্তু এবার তার বুকের ভেতর একটাই প্রতিজ্ঞা—
“Broker যতবারই ছায়া নিয়ে ফিরুক, আমি তাকে আলোতে টেনে আনব। Shadow Protocol হয়তো থেমেছে, কিন্তু আমার যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।”
দিল্লির ভোরের আকাশে সূর্যের আলো ফুটল। Raven হাঁটতে লাগলেন, যেন ছায়ার ভেতর থেকেও আলো খুঁজে নিতে জানেন।
শেষ