অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ১: প্রথম বার্তা
সৌম্য মুখার্জী প্রথম দিন স্কুলে ঢুকেই বুঝেছিল, এই স্কুলটা একটু অন্যরকম। শান্তিনিকেতনের সীমানা ছুঁয়ে থাকা এই পুরনো হাইস্কুলটির নাম ‘চৈতন্য বিদ্যামন্দির’, তবে গেটের ওপরে নামটা আধফাটা, আর নিচে একটা ছেঁড়া ব্যানারে আজও ঝুলছে গত বছরের নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্কুলের বিল্ডিংটা অনেক পুরোনো, লাল ইটের দেয়াল আর কড়ি-পাতার ছাদ। অথচ, ভেতরের পরিবেশে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। যেন কেউ কথা বলতে ভয় পায়। যেন স্কুলটা চুপচাপ নিঃশব্দে কোন কিছু লুকিয়ে রাখছে।
সৌম্য বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে, ইংরেজি পড়ায়। নিজের মধ্যেই গম্ভীর স্বভাব, কিন্তু আজ সকাল থেকেই বুকের ভেতর টানটান অস্বস্তি। প্রিন্সিপাল রুমে বসে থাকা মাঝবয়সী মহিলা, রিনা সেন, খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, “ক্লাস এইট-বি তোমার দায়িত্ব। কিছু সমস্যা থাকলে সরাসরি জানিও, আর ব্ল্যাকবোর্ড ঠিক করে নিয়ো। ওই ক্লাসে একটু… ঝামেলা হয় মাঝে মাঝে।”
“কী রকম ঝামেলা?” — সৌম্য জানতে চাইলে রিনা একগাল হাসলেন, “তুমি নবাগত, বুঝবে ধীরে ধীরে।”
সেদিন ক্লাস এইট-বি-তে ঢুকেই সৌম্য অবাক। ছাত্রছাত্রীদের চোখে একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস—হয়তো শিক্ষক বদলাতে বদলাতে তারা ক্লান্ত। ক্লাসের এক কোনায় একটা মেয়ে চুপ করে জানালার পাশে বসে আছে—চোখে কালি, মুখে বিস্ময়। তার নাম সুহানা, স্কুলের মতে “এক্সট্রা সেনসিটিভ”। সৌম্য পড়াতে শুরু করল—‘The Road Not Taken’। ক্লাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একজন ছাত্র বলে উঠল, “স্যার, আপনি ব্ল্যাকবোর্ডে টিকটিকি এঁকেছেন নাকি?”
সৌম্য অবাক হয়ে দেখে, ব্ল্যাকবোর্ডের নিচের দিকে চক দিয়ে আঁকা একটা টিকটিকির ছবি—গা ছমছমে রকমের। ওটা কখন এল? সে তো কিছু লেখেনি! ছাত্ররাও ফিসফিস শুরু করল—“আবার শুরু হল”, “কেউ লিখে দেয়”, “সোহিনী বলেছিল, আবার হবে।”
সন্ধ্যের দিকে, স্কুল ফাঁকা হয়ে গেলে সৌম্য কিছু কাজের জন্য ক্লাসরুমে ফিরেছিল। তখনই তার নজরে এল ব্ল্যাকবোর্ডে নতুন কিছু লেখা—সাদা চক দিয়ে বড় করে লেখা:
“তুমি যদি সত্যি জানতে চাও, তবে রাত ১টা ১১ মিনিটে আবার এসো। একাই এসো। লাইব্রেরি খুলবে।”
সৌম্য শিউরে উঠল। এই লেখা তো সে লেখেনি! ছাত্ররাও নয়, কারণ ক্লাসের পর তালা বন্ধ থাকে। আর এই লেখার সময় কেউ ছিল না, এটা নিশ্চিত। সে চক তুলে লেখাটা স্পর্শ করল—তাজা লেখা, ধুলো এখনও ঝরে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত, লিখাটা ছিল উল্টো—মানে, বাইরে থেকে জানালা দিয়ে কেউ দেখলে স্বাভাবিকভাবে পড়া যাবে।
তারপরেই, দরজার পাশে একটা আওয়াজ—ক্লিক করে যেন একটা তালা খুলল। কেউ নেই, অথচ দরজার বাইরের লাইব্রেরি রুমের ঝাঁপ বন্ধ থাকলেও এখন সেটা আধা খোলা।
সৌম্য মনে করল, হয়তো কাকতালীয়, হয়তো কেউ মজা করছে। কিন্তু পরদিন সকালে স্কুলে এসে সে শুনল এমন এক খবর যা তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দিল।
এক ছাত্রী—সোহিনী দাস, এই ক্লাস এইট-বি-এরই ছাত্রী—গত রাতে আত্মহত্যা করেছে। ঠিক রাত ১টা ১১ মিনিটে। সময়টা পুলিশ রিপোর্টেই লেখা। এবং তার ডায়েরিতে শেষ লাইনটা ছিল—
“ব্ল্যাকবোর্ডটা সব জানে।”
সেদিন দুপুরে ক্লাসে ঢুকতেই সৌম্য লক্ষ্য করল, সব ছাত্রছাত্রীরা চুপচাপ। টিফিনে কেউ হাসছে না। সুহানা এবার আর জানালার পাশে নয়, এসে সামনে বসেছে। ক্লাস শুরু করার আগে সে বলল, “স্যার, আপনি কী দেখেছেন কাল রাতে?”
সৌম্য চমকে উঠে তাকাল, “মানে?”
সুহানা তাকিয়ে বলল, “এই ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডটা সব জানে। কিন্তু সবাই ভয় পায়, আপনি কি ভয় পান?”
সেদিন রাতে সৌম্য আর ঘুমাতে পারেনি। সে শুধু ভাবতে থাকল—কীভাবে সম্ভব? কী বলতে চাইছে এই বার্তাগুলো? ব্ল্যাকবোর্ড তো একটা সাধারণ জিনিস—তবু কেন এর মধ্যেই যেন কেউ কথা বলে যাচ্ছে? সে ঠিক করল, আজ রাত ১টা ১১ মিনিটে লাইব্রেরির সামনে যাবে। যাই হোক, উত্তর চাই তার।
রাত বাড়ছিল। বাইরের কুকুরের ডাক থেমে গেছে। স্কুলের চারপাশটা ঝোপঝাড় আর গাছপালা ঘেরা। সৌম্য হেঁটে চলেছে লাইব্রেরির দিকে—হাতে একটা ছোট টর্চ, আর বুকের মধ্যে তীব্র কৌতূহল।
রাত ১টা ১১-তে পৌঁছে সে দেখে, লাইব্রেরির দরজা একটু ফাঁকা। সে ধীরে ধীরে হাত দিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরে ঢুকতেই সে টের পেল—এই ঘরের বাতাস অন্যরকম। থমথমে, ভারি। বইয়ের তাক গুলোর মাঝখানে রাখা একটা পুরনো ডেস্কের ওপর রাখা রয়েছে কিছু প্যাকেট। আর তার পাশে একটা খোলা নোটবুক। নোটবুকের পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে লেখা—
“The file is not missing. It’s hidden where silence is loudest.”
আর পৃষ্ঠার নিচে ছোট করে লেখা —
B.F.
পর্ব ২: লাইব্রেরির নিচে
নোটবুকের শেষ বাক্যটা এখনো সৌম্যর মাথার ভিতর গুঞ্জন তুলছে—“The file is not missing. It’s hidden where silence is loudest.”
সেই “B.F.” কি ব্ল্যাকবোর্ড ফাইল? নাকি আর কিছু? সাদা কাগজে কালো কালিতে লেখা হলেও, তা যেন রক্ত দিয়ে লেখা সংকেত হয়ে উঠেছে। ঘরের পরিবেশে একরকম শব্দহীন চাপ। সৌম্য পেছনে তাকিয়ে দেখে দরজাটা আবার আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছে। হাওয়ায় নয়, কারও ছোঁয়ায় নয়—অথচ বন্ধ।
সে কাগজটা ব্যাগে রাখে, তারপর টর্চটা আরও উঁচু করে তাকায় চারপাশে। পুরনো ধুলো জমা বুকশেলফ, কিছু ছেঁড়া বই, আর কোণায় একটা কাঠের সিঁড়ি—যেটা যায় লাইব্রেরির দোতালার দিকে। কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে যায় মেঝেতে—এক জায়গায় খুব সামান্য উঠে আছে কাঠের একটা ফ্লোরবোর্ড। যেন কেউ চেপে রাখে না বলে সেটা একটু ফেঁপে আছে।
সে হাঁটু গেড়ে বসে বোর্ডটা আলতো করে চাপ দেয়। ঠকঠক শব্দ। ফাঁপা। ভিতরে জায়গা আছে। এবার পকেট থেকে একটা স্কেল বার করে ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে বোর্ডটা তোলে। নিচে দেখা গেল অন্ধকার একটা ছোট্ট গর্ত। তার ভেতর পুরোনো কাগজে মোড়া কিছু একটা। হাত বাড়িয়ে সেটা বের করে আনে সে।
কাগজে মোড়া বস্তুটা খুলতেই দেখা গেল—একটা ছোটো রেজিস্টার, পাতাগুলো প্রায় হলুদ, আর উপরের কভারে ছোট করে লেখা “Student Record – Batch 1977”।
সৌম্য ধীরে ধীরে পাতা ওল্টাতে থাকে। পুরনো ছাত্রদের নাম, রোল নম্বর, অ্যাটেনডেন্স—সব লেখা রয়েছে। কিন্তু পাতা ২১-এ এসে সে দেখতে পায়, হঠাৎই এক ছাত্রের নামের উপর কালি দিয়ে ঘষে দেওয়া হয়েছে। নামটা প্রায় পড়া যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে “রুদ্র” দিয়ে শুরু। পাশে বড় করে লেখা আছে “Expelled – B.B.”
সে ভাবতে থাকে—B.B. কি সেই ছাত্র? তার হাত কাঁপতে থাকে, কেমন যেন গলা শুকিয়ে আসে।
হঠাৎ বাইরে এক শব্দ হয়—ম্যাও! একটা বিড়াল, হয়তো লাইব্রেরির ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সৌম্য ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, বুকের মধ্যে তখনো ধুকপুকানি চলছে। সে জানে, কাল রাতে যা দেখেছে আর পেয়েছে, সেটা শুধু কাকতালীয় নয়—এর পেছনে কিছু আছে, এবং সেটা কেউ চায় না সে জানুক।
সকালে স্কুলে আসার পরই সে একদৃষ্টে ক্লাস এইট-বি-এর ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ কিছু লেখা নেই, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মুখে ভয় আর চাপা উৎকণ্ঠা।
টিফিনের সময় সুহানা এসে বলে, “স্যার, আপনি লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন তো?”
“তুমি জানলে কীভাবে?”
“কারণ আপনি এখন জানেন—রুদ্রর নামটা। আমরাও দেখেছি ওই নামটা, কিন্তু কেউ বলতে চায় না। আর প্রিন্সিপাল ম্যাম যদি জানতে পারেন আপনি কী খুঁজছেন, তাহলে আপনাকে…”
সে থেমে গেল। সৌম্য চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি জানো রুদ্র কে ছিল?”
সুহানা মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার। কিন্তু মা বলেছিল, ওই বছর স্কুলে আগুন লেগেছিল একবার। লাইব্রেরি ঘরটায়। একজন ছাত্র আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল—তারপর সে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যায়। তার নাম রুদ্র ছিল কি না, কেউ বলে না। সবাই শুধু ভয় পায়। আর সবচেয়ে বেশি ভয় করে ব্ল্যাকবোর্ডকে।”
সৌম্যর মনে হচ্ছিল, তার সামনে একটা বড় জট তৈরি হচ্ছে—আর তার গায়ে গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে আরও অজানা রেশমি সুতোর মতো রহস্য।
সেইদিন বিকেলে সে স্কুলের পুরনো কর্মচারী নিরঞ্জন দাদুকে খুঁজে বের করল। নিরঞ্জন বয়সে অনেকটা, চোখে চশমা, আর মুখে সারাক্ষণ একটা বিদ্রুপের হাসি। সৌম্য তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “১৯৭৭ সালে কী হয়েছিল এখানে?”
নিরঞ্জন একটু চুপ করে থেকে বলল, “ভুলে যাও মাস্টারমশাই। অতীত খুঁড়লে মাটি আলগা হয়—আর স্কুলের মাটি একটু… বলো না, নরম।”
“রুদ্র নামের ছাত্র ছিল?”
নিরঞ্জন এবার হালকা গলায় বলল, “ছিল। খুব উজ্জ্বল ছেলে ছিল। কিন্তু বেশি জানত, বেশি ভাবত। একদিন হঠাৎ তার নাম কেটে যায়। তারপর কিছুদিনের মধ্যে আগুন লাগে লাইব্রেরিতে। বলে, সে-ই করেছে। কিন্তু আমি জানি, ওই ছেলে সত্য খুঁজছিল। যা কেউ চায় না তুমি জানো।”
সৌম্য এবার নিশ্চিত—রুদ্র একটা ফাইল খুঁজছিল, এবং সেই ফাইলটাই এখন তার খোঁজে রয়েছে। ব্ল্যাকবোর্ড ফাইল।
রাতে সে বাড়ি ফেরার আগে আবার ক্লাসে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিছু লেখা নেই। কিন্তু যাওয়ার আগে সে নিজের হাতে একটা লাইন লেখে—“রুদ্র, তুমি কি আছ?”
পরদিন সকালে স্কুলে এসে দেখে, সেই লেখার নিচে চক দিয়ে লেখা—
“আমি এখানেই আছি। তুমি কি সত্যটা নিতে পারবে?”
আর ঠিক তার নিচে আঁকা একটা অদ্ভুত চিহ্ন—একটা পাঁজরের হাড়ের মতো দেখতে আঁকা রেখা। সুস্পষ্টভাবে কাটা তিনটি দাগ, যেন কারও শরীর চিরে তুলে আনা হয়েছে।
সৌম্য আর ঘাবড়ে যায় না এবার। সে জানে, এ যেন এক ধাঁধা—যার প্রতিটি টুকরো তাকে নিয়ে যাচ্ছে গভীর এক ষড়যন্ত্রের দিকে। সে বুঝতে পারে, ফাইলটা কোথাও আছে। সেই “সাইলেন্স”-এর জায়গায়—যেখানে শব্দ নেই, কিন্তু ইতিহাস চিৎকার করে।
তার মানে কি লাইব্রেরির নিচে আরও কিছু আছে? নাকি প্রিন্সিপাল রিনা সেন নিজেই লুকিয়ে রেখেছেন সেই ফাইল?
রাত তখন ১টা। সৌম্য এবার নিচে নেমে আসে লাইব্রেরির সেই ফাঁকা জায়গাটার কাছে। এবার সে ব্যাগে করে আনছে একটা ছোট টুল, একটা পোর্টেবল টর্চ আর একটা ধাতব রড।
সে বোর্ডটা আবার তুলে খোঁজে আরও কিছু। গর্তটা আরও গভীর—আরও নিচে একটা পাথরের মতো কিছু।
সে রড দিয়ে সেটা খোঁচাতে না হতেই একটা কাত আওয়াজ! যেন নিচে একটা দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে হালকা গন্ধ বেরোচ্ছে—পুরনো, চাপা কেরোসিনের গন্ধ।
আর তার ভেতরে, অন্ধকারে, একজোড়া চোখ ঝিলমিল করছে।
পর্ব ৩: যে চোখ ফিরে তাকায়
অন্ধকারের মধ্যে সেই চোখ দুটো ঝিলমিল করে উঠতেই সৌম্যর শরীরের প্রতিটা রোম দাঁড়িয়ে গেল। মুহূর্তে তার টর্চের আলো ছুঁয়ে ফেলল চোখ দুটোকে। সেকেন্ডখানেকের জন্য মনে হয়েছিল কোনো জন্তু—কিন্তু না, সেটা পশুর চোখ নয়। ওটা ছিল মানুষের—কিন্তু সেই চোখে ছিল না কোনো ভয়, ছিল না কোনো সংবেদন—ছিল শুধু একরাশ গভীর, জ্বলে ওঠা রাগ। যেন শতাব্দীর অবিচার সেখানে জমে আছে।
সৌম্য সরে যেতে গিয়েও থেমে গেল। গর্তের নিচে কেউ বসে আছে। এবার সে টর্চটা ভালো করে ফোকাস করল—দেখল, একটা ছেলেমানুষের কঙ্কালসার মুখ, চুলগুলো এলোমেলো, গায়ে পুরনো ধুতি আর হাতজোড়া কাঁপছে। লোকটা কিছু বলতে পারছে না। শুধু ঠোঁট নড়ে, শব্দ হয় না।
“আপনি কে?” সৌম্য ফিসফিস করে বলে।
লোকটা মাথা নিচু করে বলে, “তোমার চেয়ে আগের শিক্ষক… আমিও খুঁজেছিলাম সেই ফাইল। ফিরে এসেছি না, বরং হারিয়ে গেছি।”
সৌম্য থমকে যায়। “মানে আপনি এই স্কুলে শিক্ষক ছিলেন?”
“ছিলাম। ২০০৩ সালে এসেছিলাম। ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। রিনা তখনও প্রিন্সিপাল ছিল। আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। তারপর একদিন আমি এই গর্তটা খুঁড়ে পাই একটা বাক্স—তার মধ্যে কিছু ছিল… যা বোঝায়, ফাইলটা শুধু কাগজ নয়, একটা ভয়ঙ্কর সত্য। তারপর থেকেই আমি এখানে। উপরে উঠতে চাইনি।”
“আপনার নাম?”
লোকটা হাসে। “তুমি কাগজ ঘাঁটলে পাবে। আমার নাম লেখাই নেই। আমাকে মুছে দেওয়া হয়েছে।”
সৌম্য বুঝে গেল, সে যেই ফাঁদে পা দিয়েছে, সেটা শুধু অতীত নয়—এখনও চলমান। সে লোকটার সামনে থেকে সরে গিয়ে গর্তটা বন্ধ করল। সে জানে, লোকটা পাগল নয়। বরং কোনো সত্য জানার দায়ে সমাজ থেকে মুছে যাওয়া এক মুখ।
পরদিন স্কুলে সে পুরনো রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে দেখে—২০০৩ সালে কোনো ইংরেজির শিক্ষক নিযুক্ত হননি বলে নথিতে লেখা। সেই জায়গাটা খালি। আর তার নিচে ছোট হরফে লাল কালিতে লেখা—“Void entry by order of R.S.”
R.S. – রিনা সেন।
সেই বিকেলে সে প্রিন্সিপাল রুমে ঢোকে।
“ম্যাম,” সে শান্ত গলায় বলে, “আমি জানতে চাচ্ছি—২০০৩ সালে কি কেউ নিযুক্ত হয়েছিলেন, যার নাম রেকর্ডে নেই?”
রিনা তার দিকে তাকিয়ে হাসে। “তোমার প্রশ্নগুলো ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, সৌম্য। তুমি কি এখানে শিক্ষকতা করতে এসেছ, নাকি গোয়েন্দাগিরি?”
সৌম্যও চোখে চোখ রেখে বলে, “আমি শুধু জানতে চাই, ব্ল্যাকবোর্ডে যে লিখে দেয়, সে কে? কবে থেকে এটা চলছে? আর ফাইলটা কোথায়?”
রিনা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। গলায় একটুও উচ্চস্বরে না গিয়ে বলে, “শোনো সৌম্য, এই স্কুলটা একটা কঙ্কাল—যার প্রতিটা হাড় ভাঙা। তুমি যদি এই হাড়গুলোতে আঘাত করো, তাহলে গোটা কাঠামো ভেঙে পড়বে। তুমি সেটা চাও?”
সৌম্য কিছু বলে না। বেরিয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, সত্যের পেছনে দৌড়ানোর মানে শুধুই সাহস নয়, একধরনের আত্মবলিদান। কিন্তু তবুও সে থামতে চায় না।
সে রাতে সুহানার কাছ থেকে একটা ফোন আসে। মেয়েটার কণ্ঠ কাঁপছে। “স্যার, ব্ল্যাকবোর্ডে আজ আবার কিছু লেখা হয়েছে। আপনি দেখে যান।”
সৌম্য দৌড়ে স্কুলে যায়। রাত তখন ১২টা ৪৫। ক্লাস এইট-বি-এর ঘরের ভেতর তখন নিঃস্তব্ধতা, বাইরের কুকুরের হালকা ডাকে শব্দ ফাটে। দরজা খুলে টর্চ মারতেই দেখা গেল—ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে চক দিয়ে লেখা:
“এবার নিচে দেখো।”
সাথে আঁকা একটা তীরচিহ্ন, যা ক্লাসের পিছনের দেয়ালের ফাঁকা ইটের দিকে ইঙ্গিত করে।
সৌম্য এগিয়ে গিয়ে ফাঁকা ইটটা চাপ দিতেই একটা ক্লিক! শব্দে একটা ছোট অংশ খুলে গেল। ভিতরে থাকা কাগজের রোল খুলে দেখে সে—পুরনো এক দলিল। লেখা—“Confession Note – 1977”। লেখক—Rudra Basu।
চোখ গোল হয়ে যায় সৌম্যর।
চিঠিতে লেখা:
“আমি, রুদ্র বসু, স্বীকার করছি যে আমি দেখেছিলাম প্রিন্সিপাল গোপন কক্ষে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা চাপা দিচ্ছিলেন। ছেলেটি মেরে গিয়েছিল—কিন্তু তাকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। আমি কিছু প্রমাণ পেয়েছিলাম, এবং আমি ঠিক করেছিলাম, ফাইলটা স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডের পেছনে লুকিয়ে রাখব। আমি জানি, ওরা আমাকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু আমি চাই, কেউ একজন একদিন এই সত্য খুঁজে পাক।”
চিঠির নিচে একটা ছোট স্কেচ—ব্ল্যাকবোর্ডের পিছনের দেয়ালের ছবি।
সৌম্য বুঝে যায়, শেষ খোঁজটা ওখানেই। ব্ল্যাকবোর্ডের পেছনে।
ঠিক তখনই তার পেছনে কাঁপা গলায় কেউ বলে, “তুমি অনেক বেশি জেনে গেছ, মাস্টারমশাই।”
সে ঘুরে দাঁড়ায়।
রিনা সেন। হাতে মোটা রুলার, চোখে আগুন। “বহু বছর ধরে আমি এই স্কুলের অভিভাবক, আর তুমি এসেই খুঁড়তে শুরু করলে! ব্ল্যাকবোর্ডটাকে মৃত বানানো হয়েছিল, কিন্তু কেউ কেউ বেঁচে থাকে। এমনকি দেয়ালের মধ্যেও।”
সৌম্য ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে যেতে বলে, “আপনি স্বীকার করছেন আপনি জানেন এটা সব…?”
“জানি না। মনে করি। কিন্তু তোমার মাথা আর হাত যদি না থাকে, তখন আর কোনো প্রশ্নও থাকবে না।”
আলো নিভে যায়।
এক মুহূর্তে নিঃশব্দ অন্ধকার।
আর ঠিক তখনই ব্ল্যাকবোর্ড নিজে থেকে গর্জে ওঠে—একটা বিকট শব্দে চক ভেঙে পড়ে, আর মাঝখান দিয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে। তাতে লেখা—“তাকিয়ে দেখো, আমি এখনও সব জানি।”
পর্ব ৪: দেয়ালের ও পাড়ে
ধোঁয়ার আস্তরণটা ঘন হয়ে আসছে। সৌম্য চোখে হাত চেপে রাখলেও জল পড়ছে। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রিনা সেন কিছুক্ষণ নিশ্চল, তারপর ধীরে ধীরে পিছিয়ে যান। তার চোখেও ভয়—যা এতদিন তাকে ছেড়ে গিয়েছিল, তা যেন হঠাৎ আবার ফিরে এসেছে, ব্ল্যাকবোর্ডের গা থেকে উঠে এসে তার মুখের সামনে দাঁড়িয়েছে। সৌম্য কাশি থামিয়ে ধীরে ধীরে টর্চটা সামনে ধরতেই বোর্ডের মাঝখানে আবার সেই বাক্য ফুটে ওঠে—“তাকিয়ে দেখো, আমি এখনও সব জানি।”
আর তারপর, একটা শব্দ—গড়ানো টিনের মত, যেন ভেতরে কিছু খুলে গেল। বোর্ডের নিচের দিকটা হঠাৎ একটু নড়ে ওঠে। সৌম্য দেখে, দেওয়ালের ঠিক ওই অংশটায় একটা প্যানেল ছিল, যা এতদিন আড়ালে ছিল—ধুলো জমা পাথরের মতো দেখতে। সে বোঝে, রুদ্র বসুর চিঠির আঁকা ছবিটা ঠিক বলেছিল—ফাইলটা ওখানেই।
সে হাত বাড়িয়ে প্যানেলটা ঠেলতেই সেটা ফাঁক হয়ে যায়। আর তার ভেতরে থাকে একটা ছোটো টিনের বাক্স। পুরনো, মরিচে খাওয়া, তবুও তালা দেওয়া। সৌম্য জানে, এই বাক্সের ভেতরেই আছে সেই রহস্য যা ব্ল্যাকবোর্ড এতদিন ধরে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিল।
রিনা এবার কাঁপা গলায় বলে ওঠেন, “ছুঁবে না! ওই ফাইল প্রকাশ পেলে স্কুলটা ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি জানো না ওখানে কী আছে।”
সৌম্য শান্ত গলায় উত্তর দেয়, “আপনিই জানেন, তাই তো এত বছর ধরে ওটা লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আপনি কি জানতেন, কতজন মারা গেছে, আত্মহত্যা করেছে, নিখোঁজ হয়েছে, শুধুমাত্র এই একটা ফাইল লুকোনোর জন্য?”
রিনা একবার চুপ করে থাকেন। তারপর ধীরে বলেন, “ওটা কাগজ নয়, অভিশাপ। আমি প্রথমে লুকোতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম স্কুলটা বাঁচুক। কিন্তু তারপর যা যা ঘটল, আমাকে চুপ করতে বাধ্য করল।”
“কে বাধ্য করল? আপনি একা নন?”
রিনা কিছু বলেন না। চুপ করে চোখ নামিয়ে নেন। সৌম্য বুঝতে পারে, পেছনে আরও কেউ ছিল, যার ছায়া আজও রিনার ওপর পড়ে আছে।
সে বাক্সটা তুলে নিয়ে দ্রুত চলে আসে, সোজা লাইব্রেরির পেছনের সেই গোপন কক্ষে। দরজা বন্ধ করে বসে পড়ে, টর্চের আলোয় তালা ভাঙার চেষ্টা করে। অবশেষে একটা পুরনো রুলার দিয়ে চেপে তালা খুলে যায়।
ভেতরে একগুচ্ছ কাগজ। খুবই পুরোনো, পৃষ্ঠাগুলোর কিনারা ছেঁড়া। প্রথম পাতায় লেখা—“Confidential Board Minutes: May 1977 – Case of Student Death”।
সৌম্য নিঃশ্বাস আটকে রেখে পড়ে—
“রুদ্র বসু কর্তৃক উপস্থাপিত অভিযোগ অনুযায়ী, ছাত্র অনিমেষ পালকে অবৈধভাবে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। ঘটনায় প্রিন্সিপালের নির্দেশে শারীরিক নির্যাতন হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে ছাত্রটি মারা যায়। ঘটনাটি স্কুল কমিটি আত্মহত্যা বলে রেকর্ড করে। রুদ্র বসু তার লিখিত আপত্তি দাখিল করে। এরপর পরবর্তী মিটিংয়ে সর্বসম্মতভাবে রুদ্র বসুকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এবং সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।”
পরের পাতায় কিছু ছবি—একটা ছাত্রের ব্লাউজ ছেঁড়া ইউনিফর্ম, একটা ছেঁড়া খাতা যার এক পৃষ্ঠায় লেখা—
“আমি কিছু করিনি। আমি শুধু ভয় পেয়েছিলাম। আমি কিছু বলিনি।”
নিচে নাম—অনিমেষ পাল।
সৌম্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এটা শুধু স্কুলের অভ্যন্তরীণ হিংসার গল্প নয়, এটা একটা অবিচারের ইতিহাস। এবং সেই ইতিহাস চাপা দিতে গিয়ে আরও অনেক প্রাণ গিয়েছে—যেমন সোহিনী, সেই ছাত্রী যে আত্মহত্যার আগে বলেছিল—“ব্ল্যাকবোর্ডটা সব জানে।”
সৌম্য ফাইলটা প্যাকেট করে ব্যাগে রাখে। সে জানে, এত সহজে এই সত্য প্রকাশ করা যাবে না। স্কুল ম্যানেজমেন্ট, রিনা, প্রশাসন—সবাই চেষ্টা করবে এটাকে চেপে যেতে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, পরের দিন সকালেই সে প্রথমে সুহানার সঙ্গে দেখা করবে। এই ছোট্ট মেয়েটার চোখে যেভাবে সাহস ফুটে ওঠে, তাতে সৌম্য আশার আলো দেখে।
পরদিন ভোরে স্কুলে পৌঁছেই সে দেখে গেটের সামনে ভিড়। কিছু অভিভাবক, পুলিশ, সাংবাদিক। কী হয়েছে?
একজন বলে ওঠে, “প্রিন্সিপাল ম্যাডামের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাল রাতে শেষবার তিনি স্কুলে ছিলেন।”
সৌম্য চুপ করে যায়।
তার মনে পড়ে, রিনার শেষ কথাগুলো—“আমি চেয়েছিলাম স্কুলটা বাঁচুক। কিন্তু তারপর যা যা ঘটল, আমাকে চুপ করতে বাধ্য করল।”
সে বোঝে, স্কুলটা এখনও কাউকে কাউকে চুপ করিয়ে দিতে জানে।
আর এই চুপ করিয়ে দেওয়া—শুধু কথায় নয়, হাড়ে হাড়ে।
সৌম্য পেছনে তাকায় ক্লাস এইট-বি-র ঘরের দিকে।
ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা—
“তোমার পালা, মাস্টারমশাই। সত্যি এবার প্রকাশ পাবে?”
পর্ব ৫: ফাইলটি যারা পাহারা দেয়
সৌম্য দাঁড়িয়ে, তার চোখ ব্ল্যাকবোর্ডের সেই কথার ওপর আটকে—“তোমার পালা, মাস্টারমশাই। সত্যি এবার প্রকাশ পাবে?”
তার মনে হচ্ছিল, দেয়ালটাই যেন তাকে প্রশ্ন করছে। চারদিকের কোলাহলের মাঝেও সে এক অদৃশ্য নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। গেটের কাছে পুলিশ, সাংবাদিক, অভিভাবক—কেউ জানে না কী খেলছে ভেতরে, আর কে ছুঁয়ে ফেলেছে সেই সত্যের গা, যার গায়ে এখনো গন্ধ লেগে আছে মৃত্যুর।
সুহানা ছুটে আসে। চোখে ভয়, মুখে চাপা প্রশ্ন। “স্যার, আপনি কি পেয়ে গেছেন?”
সৌম্য শুধু মাথা হেঁট করে বলে, “হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু প্রকাশ করতে গেলে আরও কিছু দরজা খুলবে। যেগুলো এখনো বন্ধ—বা কেউ বন্ধ রেখেছে।”
সেই মুহূর্তে এক অফিস সহকারী এসে ফিসফিস করে বলে, “স্যার, কেউ আপনাকে খুঁজছে। লাইব্রেরির পেছনের ঘরে।”
সৌম্য চমকে যায়। কে? রিনা তো নিখোঁজ। তবে?
সে সুহানাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে, আর নিজে গিয়ে পৌঁছয় লাইব্রেরির পিছনের সেই গোপন ঘরে, যেখানে সে প্রথমবার গিয়েছিল রাতে। দরজাটা অদ্ভুতভাবে খোলা। ভেতরে একটা টেবিল, আর তার সামনে বসে আছে সেই কঙ্কালসার মানুষটি—যাকে সে দেখেছিল গর্তের নিচে।
কিন্তু আজ তার মুখ পরিষ্কার, চোখে জোর, গলায় শব্দ। “আমি এখন কিছু বলব। শোনো।”
সৌম্য কিছু বলতে যায়, কিন্তু সে হাত তুলে থামায়।
“আমার নাম অমিতাভ চ্যাটার্জি। আমি এখানে ২০০৩ সালে শিক্ষক হয়ে এসেছিলাম। খুব ভালো কিছু করার স্বপ্ন ছিল। প্রথমেই শুনলাম, একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে—যার মা বলেছিলেন, ও ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু দেখেছিল। আমি খুঁড়তে শুরু করলাম। ঠিক যেমন তুমিও করছ। রিনার সামনে আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম, ব্ল্যাকবোর্ডে যে বার্তাগুলো আসে, সেগুলো কে দেয়?”
সৌম্য চুপ।
অমিতাভ বলতে থাকে, “একদিন আমিও পেয়ে যাই একটা ফাইল। সেই ফাইলেই ছিল—১৯৭৭ সালের ছাত্র অনিমেষ পালের মৃত্যুর সবকিছু। আমি সেই ফাইল দেখেই বুঝি, ব্ল্যাকবোর্ড শুধু একটা শিক্ষার যন্ত্র নয়—ওটা একটা সাক্ষী। আর যারা ফাইল পাহারা দেয়, তারা কেবল মানুষ নয়। ওরা স্মৃতি। ওরা ন্যায়বিচারের ছায়া। যাদের আর কোনও জায়গা নেই, তারা বোর্ডে লিখে রেখে যায় তাদের ব্যথা।”
“আপনি তাহলে…”
“আমি এখানেই থেকে যাই। কেউ চাইছিল না আমি ফাইলটা প্রকাশ করি। রিনা তখনও নতুন, কিন্তু কেউ ছিল তার পেছনে—পুরনো স্কুল বোর্ডের কেউ, যার নির্দেশে আমি… ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাই। আমাকে কাগজ থেকে মুছে দেওয়া হয়।”
“আপনি কি সেই পাহারাদারদের একজন হয়ে গেছেন?”
“হয়তো। আমি জানি না আমি এখন কী। আমি খাই না, ঘুমাই না, বাইরে যাই না। শুধু অপেক্ষা করি কেউ আসবে সত্য খুঁজতে। আজ এত বছর পর তুমি সেই কাজ করছ। তাই বলছি—এই ফাইল শুধু তুলে নেওয়ার না, এটাকে বুঝে প্রকাশ করতে হয়। নইলে স্কুলটা পড়ে যাবে।”
সৌম্য থমকে যায়। “আপনি কি চান, আমি থেমে যাই?”
অমিতাভ ধীরে মাথা নাড়ে। “না। আমি চাই তুমি চালিয়ে যাও। কিন্তু একা নয়।”
“কে থাকবে আমার সঙ্গে?”
“যারা বোর্ডে লিখে গেছে, যারা হারিয়ে গেছে। যারা নিঃশব্দে বলেছে ‘আমি কিছু করিনি’। তারা থাকবে। কিন্তু সত্য প্রকাশের আগে তোমাকে বোর্ডের পরীক্ষা দিতে হবে।”
“কী পরীক্ষা?”
অমিতাভ হেসে উঠে বলে, “যেটা সবাই দিতে পারে না। বোর্ড এখনো পাহারা দেয় সেই ফাইলকে—একটা দরজার আড়ালে। সেখানে ঢুকলে ফিরে আসা নিশ্চিত নয়। কিন্তু যদি পারো, তাহলে শুধু স্কুল নয়, সিস্টেম বদলাবে।”
সৌম্যর মুখে দৃঢ়তা ফিরে আসে। “আমি যাব।”
অমিতাভ টেবিলের নিচ থেকে বের করে একটি চাবি দেয়। “এটা ব্যবহার করো। পশ্চিম দিকের পুরনো ঘরটা, যেটা আজ দশ বছর ধরে বন্ধ—সেখানে আছে শেষ দরজা।”
সেইদিন রাতে, সৌম্য পৌঁছয় স্কুলের পুরনো প্যাভিলিয়ন ভবনে। দরজায় তালা। চাবিটা ঠিকঠাক ফিট করে। খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এক গন্ধ—পুরনো ধুলো, পচা কাগজ আর কেরোসিনের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। ভেতরে নিঃস্তব্ধতা। একপাশে একটা পুরনো খাট, দেয়ালে ফ্রেমবিহীন বোর্ড।
সে এগিয়ে গিয়ে বোর্ডে হাত রাখতেই অনুভব করে ঠান্ডা একটা স্রোত তার হাত থেকে গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। চোখের সামনে দুলে ওঠে দেওয়াল। আর হঠাৎই দেয়াল ভেঙে যায়—তার সামনেই খুলে যায় এক গোপন কক্ষ।
সেখানে মাঝখানে রাখা এক স্টিলের আলমারি। খুলে ফেলে সে।
আর ভেতরে থাকে শুধু একটি জিনিস।
“The Final File”—রক্তমাখা একটি নামফলকে লেখা, কাঁচের জারে রাখা পৃষ্ঠাগুলো।
আর তাতে প্রথম বাক্য—
“আমি রুদ্র বসু। আমি মরিনি।”
পর্ব ৬: রুদ্রর প্রত্যাবর্তন
ফাইলের প্রথম পাতায় লেখা—“আমি রুদ্র বসু। আমি মরিনি।”
সৌম্যর গা শিরশির করে ওঠে। ঝিম ধরা অন্ধকার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা সেই কাঁচের জারে রাখা পৃষ্ঠা, যেন এক জীবন্ত আত্মকথা—যা এতদিন বোর্ডের পেছনে দম বন্ধ করে শুয়ে ছিল, আজ তার সামনেই জেগে উঠছে। কাঁচের ভিতরের পাতাগুলো ধূসর, কিনারা ছেঁড়া, আর লেখাগুলো অদ্ভুতভাবে ঝাঁঝালো কালিতে লেখা—যেন তাড়াহুড়োয়, যেন কাউকে কিছু বলার আগে শেষ সুযোগ।
সে ধীরে ধীরে পড়তে থাকে।
“২৮শে মে, ১৯৭৭ — আমি বুঝে গেছি, অনিমেষকে মারার নির্দেশ এসেছিল ওপরে থেকে। ওকে ধরে শাস্তি দেওয়ার নাম করে রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল রিনা সেন ও আরেকজন—কমিটির তৎকালীন সভাপতি। ওর মাথায় রুলার দিয়ে মারা হয়, তারপর ঘাড়ে চাপ পড়ে গিয়ে ছেলেটা নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা যায়। আমি সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। আমার রোল নম্বর ছিল ২৩। কিন্তু আজ স্কুল রেজিস্টারে আমি নেই।”
সৌম্যর বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা আতঙ্ক।
ফাইলের দ্বিতীয় পাতায় ছিল অনিমেষের আঁকা একটা স্কেচ—দেয়ালে ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে একজন শিক্ষকের ছবি। মুখ আবছা, কিন্তু চোখ দুটো ঠিকরে বেরোচ্ছে—অসহায় আতঙ্ক। নিচে লেখা—
“আমি সব জানি।”
আর তৃতীয় পাতায়—সেইসব ছাত্রদের নাম যাদের ‘বিশেষ অনুশাসনে’ রাখা হয়েছিল। এদের মধ্যে ৭ জন আজ আর বেঁচে নেই। আত্মহত্যা, হারিয়ে যাওয়া, কেউ দুর্ঘটনায়। অথচ সবই স্কুলে ঘটেছে।
“আমি মরিনি”—এই লাইনটা রুদ্র হয়তো কথার অর্থে বলেছেন। হয়তো তাঁর স্মৃতি মরেনি। তাঁর চিহ্ন, তাঁর লেখা, তাঁর দেখা ঘটনাগুলো, সবকিছু টিকে আছে ব্ল্যাকবোর্ডে।
হঠাৎ কক্ষের এক কোণায় কেঁপে ওঠে বাতাস। যেন অদৃশ্য কারো নিঃশ্বাস। সৌম্য কাচের জারটা হাতে করে ফিরে যেতে যায়, কিন্তু দরজা আর খোলা নেই। আলো নিভে যায়। অন্ধকারে শুধু একটা শব্দ ভেসে আসে—
“তুমি কি সত্যিই প্রস্তুত?”
সৌম্য থেমে যায়। সেই কণ্ঠস্বরের মধ্যে কোনো হুমকি নেই, বরং যেন এক আশ্চর্য দুঃখ। সে হালকা গলায় বলে, “হ্যাঁ, আমি জানি—সব না বললে কিছুই ঠিক হবে না। আমি শিক্ষক হয়ে এসেছি, ছাত্র হয়ে যাচ্ছি।”
এক মুহূর্তে সামনে আবার জ্বলে ওঠে বোর্ড। এবার লেখা—
“তবে দেখে যা। আমিও ফিরছি। এবার ক্লাস আমি নেব।”
বাইরে ততক্ষণে ঝড় উঠেছে। পাতা উড়ছে, স্কুলের বারান্দার কাঁচ জানালা ধাক্কা খাচ্ছে। সৌম্য জারটা ব্যাগে ভরে দৌড়ে বাইরে বেরোয়, দেখে লাইব্রেরির পেছন থেকে আলো জ্বলে উঠেছে—আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন—বেশ লম্বা, গায়ে হালকা সাদা পাঞ্জাবি, পিঠ অবধি চুল।
সৌম্য থমকে দাঁড়ায়। লোকটি ঘুরে তাকায়—চোখে চশমা, ঠোঁটে হালকা হাসি।
“তুমি হয়তো আমাকে খুঁজছিলে,” লোকটা বলে।
“আপনি কে?”
“রুদ্র। রুদ্র বসু। কেউ বলে আমি মরে গেছি, কেউ বলে পাগল হয়ে পালিয়ে গেছি। আসলে আমি লুকিয়ে ছিলাম—বেঁচে থাকার জন্য না, এই সত্যটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।”
“কিন্তু এত বছর চুপ করে ছিলেন কেন?”
“কারণ সময় লাগত। স্কুল নিজে তৈরি ছিল না। ব্ল্যাকবোর্ড এখনো হাঁসফাঁস করছিল। এখন তুমি এসেছ—তুমি প্রশ্ন করছ, ছাত্রদের ভয় নেই। আমি জানি, এবার সময় এসেছে ফাইলটা সামনে আনার।”
সৌম্য হতবাক হয়ে বলে, “তাহলে আপনি…”
“হ্যাঁ, আমি এখন ফিরে এসেছি। আমি শুধু ফাইল দিই না, আমি এখন প্রত্যক্ষ করব—তুমি কী করো সেটা। কারণ এটা শুধু তোমার নয়, আমারও লড়াই।”
সেই সময় স্কুল গেটে ভিড় বাড়ে। পুলিশ নতুন কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছে—প্রিন্সিপাল রিনা সেনের খোঁজে তদন্ত চলছে। রিনার ঘর থেকে একটি চাবি উদ্ধার হয়েছে—চাবি, যা নাকি “Board Room D” নামে তালিকাভুক্ত।
সৌম্য ও রুদ্র একসঙ্গে স্কুলের সেই রুমের দিকে যায়—যেটা আজ ৪০ বছর ধরে খোলা হয়নি।
চাবি ঘোরানোর সাথে সাথে দরজা খোলে। ভেতরে ঢুকে তারা দেখে—একটি ঘর, যা যেন সময়ের সংরক্ষণশালা। দেয়ালে পুরনো ছাত্রছাত্রীদের ছবি, একটা গ্লোব, রোল কল রেজিস্টার, আর মাঝখানে রাখা ব্ল্যাকবোর্ড—ঠিক যেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু।
সৌম্য বোর্ডের দিকে এগিয়ে যায়। এবার আর কেউ কিছু লেখেনি। বোর্ড নিঃশব্দ।
সে চক তুলে হাতে নেয়। লেখে—
“সত্য এবার মুক্ত। আপনি কি ফিরে এলেন?”
ঠিক তখনই, বোর্ডে উঠে আসে একটিই লাইন—
“হ্যাঁ, রোল নম্বর ২৩ আবার ক্লাসে এসেছে।”
পর্ব ৭: রোল নম্বর ২৩
“হ্যাঁ, রোল নম্বর ২৩ আবার ক্লাসে এসেছে।”
এই লাইনটা যখন বোর্ডে ভেসে উঠল, সৌম্যর মেরুদণ্ডে একটা হিম শিরশিরানি ছড়িয়ে গেল। রুদ্রর মুখে তখন আর কোনো দ্বিধা নেই, বরং একটা নিঃশব্দ বিজয়ের ছায়া। ক্লাস এইট-বি-র হেড বোর্ডরুমটা এখন যেন আর একটা জাদুর কক্ষ, যেখানে সময়, ইতিহাস আর সত্য—সব একসঙ্গে নিশ্বাস নিচ্ছে।
সৌম্য চোখ রাখে রুদ্রর দিকে।
“আপনি ফিরে এলেন, কিন্তু কীভাবে?”
রুদ্র হেসে বলে, “আমি কখনোই পুরোপুরি যাইনি। আমি ছিলাম—প্রতিটা মোমবাতির আঁচে, প্রতিটা চক ভাঙার শব্দে। আমি ছিলাম সেই সমস্ত ছাত্রদের স্বপ্নে, যারা বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ভয় পেয়েছিল। আমি ছিলাম সেই লেখাগুলোয়, যেগুলো কেউ কখনো লেখেনি—তবু রয়ে গেছে।”
সৌম্য জানে, এসব কথার মধ্যে শুধু প্রতীক নেই, সত্যও আছে। সত্য—যা এতদিন সবাই চাপা দিয়ে রেখেছিল, আজ তার চোখের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে।
“আপনি তাহলে এবার সামনে আসবেন?”
“হ্যাঁ, কারণ এবার বোর্ডও চায় আমি আসি। আজ থেকে বোর্ড নিঃশব্দ থাকবে না। ক্লাস এইট-বি-র ব্ল্যাকবোর্ড আজ থেকে আবার শিক্ষক হবে।”
রুদ্র বুক পকেট থেকে একটা ছোট খাতা বের করে দেয় সৌম্যর হাতে। “এটা আমার শেষ নোটস। ছাত্র অনিমেষের লেখা, প্রিন্সিপাল রিনার স্বীকারোক্তি, আর কিছু এমন প্রমাণ যা কোনো কমিটি চাপা দিতে পারবে না। তবে শর্ত একটাই—তুমি ওটা ছাত্রছাত্রীদের সামনে পড়বে। মিডিয়ার সামনে নয়, পুলিশের সামনে নয়—এই স্কুলের ভিতরেই, ছাত্রদের সামনে।”
সৌম্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “ঠিক আছে। তাহলে কাল সকালে আমি ক্লাস এইট-বি-তে গিয়ে পড়ব।”
“না,” রুদ্র হাসে, “আজ রাতেই। ঠিক রাত ১১টা ২৩ মিনিটে—আমার রোল নম্বরের সময়।”
সেই রাতে স্কুল অন্ধকার। জানালাগুলো হাওয়ায় দুলছে। ক্লাস এইট-বি-তে একটি মাত্র কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলছে, তার নিচে বসে সৌম্য আর পাশে রুদ্র। ফ্যান বন্ধ। বাইরে দূরে কুকুরের গলা।
সৌম্য ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। ছাত্রছাত্রী নেই। তবু সে পড়তে শুরু করে—
“এই স্কুলে আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম সত্যকে হত্যা করা। অনিমেষ ছিল আমার বন্ধু, তার চোখে স্বপ্ন ছিল, কিন্তু তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাকে ‘শাস্তি’ দিতে গিয়ে হত্যা করা হয়। আমি সেই মৃত্যুর প্রতিবাদ করেছিলাম। আর তাই আমাকে মুছে দেওয়া হয় রেজিস্টার থেকে, দেয়াল থেকে, সনদ থেকে। কিন্তু ব্ল্যাকবোর্ড আমাকে মুছে দেয়নি।”
তার গলা কাঁপে। ল্যাম্পের আলোয় রুদ্রর চোখ ছলছল করে ওঠে।
“এই ফাইল, এই ডায়েরি, এই ব্ল্যাকবোর্ড—সবাই মিলে একটাই কথা বলেছে, ইতিহাস মুছে গেলেও স্মৃতি মুছে যায় না। আজ আমি ফিরে এসেছি, শুধু শিক্ষক হয়ে নয়, ছাত্রদের ভরসা হয়ে।”
এই শেষ লাইনটা বলতেই বোর্ডে নিজে থেকে চক দিয়ে লেখা হতে থাকে—
“আমি রোল নম্বর ২৩। এবার ক্লাস শুরু।”
ঠিক তখনই একদল ছাত্র এসে দাঁড়ায় ক্লাসরুমের দরজায়। সুহানার চোখে বিস্ময়, পাশে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী—তাদের কারও মুখে ভয় নেই।
সুহানা বলে, “স্যার, আপনি বলেছিলেন সত্য লুকিয়ে ছিল। আজ সেটা আমাদের সামনে। এবার আমরা লিখব।”
সৌম্য চুপচাপ বোর্ডের সামনে চক রেখে বেরিয়ে আসে। ক্লাসের ভিতর থেকে শুধু একটাই শব্দ শোনা যায়—চক চালানোর ঘর্ষণ।
পরদিন সকালে খবর ছড়িয়ে পড়ে—
“চৈতন্য বিদ্যামন্দির স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে এক অদ্ভুত স্বীকারোক্তি! ১৯৭৭ সালের এক ছাত্র হত্যার তথ্য প্রকাশ্যে। ফাইল হাতে পেয়েছে শিক্ষকেরা। নিখোঁজ প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু।”
সৌম্য পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ে, কিন্তু সে শুধু একটা বাক্য বলে—
“আমি শুধু পড়িয়েছি, লেখেনি আমি।”
সুহানা আর তার বন্ধুরা সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরাই পড়েছি, আমরাই লিখেছি। এবার ভয় নেই।”
রুদ্র আর একবার সৌম্যর পাশে এসে দাঁড়ায়।
“তোমার কাজ শেষ নয়। ব্ল্যাকবোর্ড এখনো বাঁচে। তুমি শিক্ষক, কিন্তু বোর্ডই আসল শিক্ষক। ওকে ভুলে যেও না।”
সৌম্য জানে, তার নতুন জীবনের শুরু আজ থেকে। স্কুলের দেয়ালে শুধু ইট নেই, ইতিহাস আছে। ব্ল্যাকবোর্ড শুধু চকধরা কালো পাথর নয়, সে একটা জীবন্ত আত্মা—যে প্রত্যেক ছাত্রকে বলছে—
“তুমি যদি প্রশ্ন করো, আমি উত্তর দেব।”
পর্ব ৮: যে ক্লাস কখনও শেষ হয় না
ঘণ্টাধ্বনি হয়নি, তবু ক্লাস শুরু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের মুখে আলো—তারা জানে, তারা কোনো গল্প শুনছে না, পড়ছে ইতিহাস। এমন এক ইতিহাস, যা বইয়ে নেই, কারো পাঠ্যক্রমে নেই, কিন্তু তাদের চোখে-চোখে লেখা হয়ে যাচ্ছে। ব্ল্যাকবোর্ডে চক চালিয়ে যারা লিখছে, তারা জানে—আজ এই লেখাগুলো শুধু শব্দ নয়, প্রতিরোধ।
সৌম্য একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। আজ সে শিক্ষক নয়, শ্রোতা।
সুহানা পড়ছে—
“আমরা ভুলে যেতে শিখেছি, সেটাই আমাদের শিক্ষা ছিল। কিন্তু আজ থেকে আমরা মনে রাখতে শিখব। আমরা জানব কে হারিয়েছিল, কে লড়েছিল, কে চুপ করেছিল। আজ আমরা ব্ল্যাকবোর্ডকে কথা বলতে দিচ্ছি।”
বোর্ডের এক কোণে চক দিয়ে আঁকা হয়েছে একটা ছোট্ট ঘড়ি—সময় থেমে আছে ১টা ১১ মিনিটে। সেই সময় যখন সোহিনী আত্মহত্যা করেছিল। তার নিচে লেখা—
“ও চুপ ছিল, আমরা আর থাকব না।”
রুদ্র বসু পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর চোখের কোণায় জল। তিনি চেয়েও এমন দৃশ্য দেখেননি। একসময় তিনি হার মেনেছিলেন—ভেবেছিলেন, সত্য শুধু দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়। কিন্তু আজ বোঝেন, দেয়াল যদি ব্ল্যাকবোর্ড হয়, তাহলে ধাক্কা নয়—সেটা একদিন লেখা হয়ে দাঁড়ায়।
সৌম্য ধীরে ধীরে লাইব্রেরির দিকে হাঁটে। ভিতরে সেই পুরনো ফাঁকা রুমে অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের বসে থাকা কঙ্কালসার শরীরটা নেই। চেয়ার ফাঁকা। ডেস্কে রাখা একটা চিরকুট:
“আমি ক্লাস ছেড়ে গেলাম, কারণ ক্লাস আবার শুরু হয়েছে। এবার আর আমার দরকার নেই।”
সে চিরকুটটা পকেটে রেখে জানালার বাইরে তাকায়। আলো ফুটছে। এক নতুন সকাল। স্কুলের বাইরের দুনিয়ায় যদিও এখনো তদন্ত, সাংবাদিকতা, দোষ-খোঁজা চলছে, ভিতরের এই শ্রেণিকক্ষে জন্ম নিয়েছে এক নতুন শিক্ষা—সত্যের শিক্ষা।
তদন্ত কমিটি রিনা সেনের নিখোঁজ থাকা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। কয়েকদিন পর তার মৃতদেহ মেলে স্কুলের পাশের পুকুরঘাটে। মৃত্যুর কারণ অজানা। তবে তার হাতের মুঠোয় একটা পৃষ্ঠা ছিল—ছেঁড়া, কালি লেগে থাকা—সেখানে লেখা একটাই লাইন—
“আমি ওদের থামাতে পারিনি। এখন বোর্ড আমার বিরুদ্ধেও লিখে দেবে।”
এই খবর জানাজানি হলে মিডিয়ায় শোরগোল হয়, কিন্তু সৌম্য আর মুখ খোলে না। সে শুধু একদিন স্কুলে এসে বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সামনে বলে—
“তোমরা জানো, এই ক্লাসের একটা নম্বর ছিল—এইট-বি। কিন্তু আজ থেকে এটা আর শুধু ক্লাসরুম নয়, এটা একটা জায়গা—যেখানে কেউ যদি সাহস করে প্রশ্ন করে, উত্তর ঠিক এসে পড়ে বোর্ডে।”
সুহানা প্রশ্ন করে, “স্যার, বোর্ড এখনো লিখবে?”
সৌম্য উত্তর দেয়, “যতদিন তোমরা সত্য চাও, বোর্ড জবাব দেবে।”
এরপর মাস যায়, বছর। চৈতন্য বিদ্যামন্দির বদলায়। আর পাঁচটা স্কুলের মতো বাইরের দিকটা সাধারণ, কিন্তু ভিতরে একটি ঘর—এইট-বি—যেখানে আজও মাঝে মাঝে কেউ Chalk নিয়ে কিছু না লিখলেও ব্ল্যাকবোর্ড নিজে থেকে বলে ফেলে একটা কথা, একটা সতর্কতা, একটা ইতিহাসের নাম।
সেই রুমে একজন ছাত্র একদিন এসে দেখে বোর্ডে লেখা—
“রোল নম্বর ২৩ মারা যায়নি। সে এখন প্রত্যেক শিক্ষকের মধ্যে বেঁচে আছে, যিনি প্রশ্ন করেন।”
সেই ছাত্র Chalk তুলে নিচে লেখে—
“আমি রোল নম্বর ২৪। আমিও প্রশ্ন করব।”
এভাবেই ক্লাস চলে। ছুটি হয় না।
এভাবেই “ব্ল্যাকবোর্ড ফাইল“ হয়ে ওঠে একটা চলমান দলিল। একটা অদৃশ্য পাঠ্যক্রম।
একটা ক্লাস…
যেটা কখনও শেষ হয় না।
— সমাপ্ত কিন্তু জীবন্ত —