ঋদ্ধি সেনগুপ্ত
পর্ব ১: ভোরট্রেন
কলকাতার ভ্যাপসা গরম আর অনন্ত জটের ভিড়ের মধ্যে অর্ণার বুক ভরে উঠছিল এক অদৃশ্য ক্লান্তিতে। প্রতিদিন সকালেই সে অফিসের বাস ধরত, ফাইল আর কম্পিউটার স্ক্রিনে ডুবে থেকে সন্ধ্যার পরে ঘরে ফিরত। চারপাশের সবাই যেন শুধু ছুটছে, অথচ কোথাও পৌঁছোচ্ছে না। গত কয়েক মাসে সে বুঝতে পেরেছিল—তার নিজের ভেতরেও এক রকম শূন্যতা জমেছে, যা ভরাট করার মতো কিছু নেই। এই শহর তাকে আর টানে না। একরাতে ডেস্কে বসেই সে হঠাৎ বুকিং করেছিল দার্জিলিংয়ের ট্রেন টিকিট—আর ভাবেনি।
সকাল সাড়ে তিনটেয় অ্যালার্ম বাজার আগেই তার ঘুম ভেঙে যায়। চারদিক তখনও অন্ধকার, কেবল ভেজা বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ। ছোট ব্যাকপ্যাকে গুছিয়ে রাখা ছিল কয়েকটা জামাকাপড়, একটা নোটবুক, আর মায়ের দেওয়া একটা উলের শাল। বাবার পুরোনো হাতঘড়ি পরে সে ট্যাক্সি ধরে পৌঁছে গেল শিয়ালদা স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই মনে হচ্ছিল—এখান থেকেই যেন তার ভেতরের একঘেয়েমি ছিঁড়ে পড়তে শুরু করেছে।
ভোরট্রেন আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলে অর্ণা জানালার ধারে বসে রেলের শব্দে ভেসে যেতে থাকে। শহরের আলো পিছিয়ে যায়, ধূসর মাঠ, গাছপালা আর দূরের কুয়াশায় ঢাকা জলাভূমি তার চোখের সামনে খুলে যায়। সঙ্গে একটা অদ্ভুত মুক্তির অনুভূতি—যেন নিজের অচেনা জীবনকেই সে পেছনে ফেলে যাচ্ছে।
শিলিগুড়ি পৌঁছনো পর্যন্ত জানলার পাশে বসা বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে গল্প হলো। তাঁরা বললেন প্রতি বছর এই সময়ে পাহাড়ে যান, কারণ তখন বাতাসে অন্য রকম নরম গন্ধ থাকে। অর্ণা হেসে বলল, “আমার প্রথমবার যাচ্ছে।” বৃদ্ধা মিষ্টি হেসে কেবল বললেন, “পাহাড় একবার ডাকলে বারবার ডাকবে।” সেই কথাটা যেন কানে বাজতেই থাকল।
পাহাড়ি পথে গাড়ি চড়তেই আসল দৃশ্য শুরু। আঁকাবাঁকা রাস্তায় একপাশে খাড়া খাদের ঢাল, অন্য পাশে অগভীর মেঘ। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অসংখ্য চা-বাগান, সবুজের ঢেউ, আর মাঝে মাঝে কাঠের বাড়ি। অর্ণা কানে হেডফোন দিলেও গান শোনেনি—সে চাইছিল প্রকৃতির নিস্তব্ধতা যেন বুকভরে নিতে। মাঝে মাঝেই হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা এসে জানালায় লেগে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল—শহরের ধুলো মুছে ফেলছে এই বৃষ্টি।
দুপুর নাগাদ দার্জিলিং পৌঁছনো। পাহাড়ি হাওয়া প্রথমবার চুলে ছুঁতেই যেন শীতল নেশা এসে গেল। হোটেলে ঢুকে ব্যাগ রেখে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। মল রোডের ভিড়, দোকানের সামনে গরম মোমো আর চায়ের গন্ধ, আর দূরে কুয়াশায় ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা—সব মিলিয়ে যেন একেবারে ভিন্ন জগৎ। অর্ণা বারবার থেমে ছবি তুলছিল, যদিও মনে হচ্ছিল ক্যামেরা কখনও আসল সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারে না।
সন্ধে ঘনিয়ে আসতেই কুয়াশা আরও ঘনীভূত হলো। রাস্তার ধারে এক ছোট চায়ের দোকানে ঢুকে গরম লেবু চা অর্ডার করল সে। চায়ের কাপ হাতে নিতে না নিতেই তার দৃষ্টি পড়ল পাশের টেবিলে বসা এক যুবকের দিকে। মাথায় টুপি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে ক্যামেরা—সে বারবার কুয়াশার ভেতরে তাকাচ্ছিল, যেন কিছু অপেক্ষা করছে। যুবকের চোখে একটা অদ্ভুত গভীরতা ছিল, যা সাধারণ আলাপচারিতায় ধরা পড়ে না।
হঠাৎই ক্যামেরার লেন্স তার দিকে ঘুরল, অর্ণা একটু চমকে উঠল। যুবক হেসে নরম গলায় বলল, “আলো ঠিক এই সময়েই সবচেয়ে বদলায়। আপনি লক্ষ্য করছেন?”
অর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি শুধু পর্যটক…আপনার মতো খেয়াল করার চোখ নেই।”
যুবক উত্তর দিল, “পাহাড়কে দেখতে চোখ লাগে না, শুধু নীরব থাকতে জানতে হয়।”
সেই কথাগুলো অর্ণার মনে অদ্ভুতভাবে দাগ কেটে গেল। নাম জানতে চাইল না, তবু মনে হলো লোকটা খুব পরিচিত। কুয়াশায় গলে যাওয়া আলোয় সে মুখটাও পুরো স্পষ্ট দেখতে পেল না। চায়ের কাপ ফাঁকা করে যখন অর্ণা উঠতে যাচ্ছিল, তখন যুবক শুধু বলল, “ভোরে টাইগার হিলে গেলে আকাশের রং দেখবেন—কিন্তু সবটা দেখবেন না, একটা অংশ আলো পড়ে না কখনও। সেখানেই রহস্য।”
অর্ণা কিছুটা অবাক হয়ে হোটেলের পথে হাঁটল। মাথায় কেবল ঘুরছিল সেই শেষ বাক্যটা—“আলো পড়ে না যেখানে…”
সেই মুহূর্তে সে টের পেল, তার ভ্রমণটা হয়তো শুধু পাহাড় দেখা নয়, আরও কিছু খুঁজে পাওয়ার যাত্রা হতে চলেছে।
পর্ব ২: আলো যেখানে পড়ে না
ভোর পাঁচটার আগেই হোটেলের রিসেপশনের ফোনে ঘুম ভাঙল অর্ণার। অর্ধেক ঘুমচোখে শাল গায়ে চাপিয়ে সে ব্যাগ থেকে ছোট টর্চটা নিয়ে নিল। পাহাড়ি ভোরের হাওয়ায় একটা শীতল আর্দ্রতা ছিল, যেন প্রতিটা ফোঁটা কুয়াশার ভিতর লুকিয়ে আছে পাহাড়ের গোপন কথা। হোটেলের বাইরে জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল—টাইগার হিলে ভোর দেখতে নিয়ে যাবে। আরও কয়েকজন পর্যটক উঠল, হাসিঠাট্টা চলতে থাকল, কিন্তু অর্ণা চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। তার বুকের ভিতর অদ্ভুত এক কৌতূহল জমে উঠছিল—সেই অচেনা যুবক কি সত্যিই এখানে থাকবে?
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি যত ওপরে উঠছিল, ততই চারপাশের কুয়াশা ঘন হয়ে যাচ্ছিল। দূরে কালো গাছের রেখা যেন হঠাৎ ভেসে ওঠা ছায়ার মতো কেটে যাচ্ছিল। অর্ণার মনে হচ্ছিল—এই নিস্তব্ধতার মধ্যে এক ধরনের চাপা শব্দ আছে, যা কানে শোনা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। পাহাড় যেন নিশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে।
টাইগার হিলে পৌঁছনোর পর সবাই ঠান্ডায় গা গুটিয়ে দাঁড়াল। ভোরের আলো তখনও পুরো ফোটেনি, আকাশ ধূসর আর নীলের মিশ্রণে রঙ ছড়াচ্ছে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাদা শৃঙ্গগুলো কেবল আবছা ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছিল। ভিড়ের ভেতর হঠাৎই অর্ণা দেখতে পেল—একজন নিরিবিলি দাঁড়িয়ে ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে। সেই একই টুপি, একই ফ্রেমের চশমা। তার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল।
সে আলতো করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু যুবক কোনো শব্দ করল না। শুধু চোখে ক্যামেরা তুলে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ হিমালয়ের শৃঙ্গে প্রথম সূর্যের আলো পড়তেই এক ঝলকে চারপাশ যেন সোনার মতো জ্বলে উঠল। মানুষজন হাততালি দিয়ে চিৎকার করল, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল। কিন্তু যুবকের চোখের দৃষ্টি ছিল ভিন্ন—সে তাকিয়ে ছিল সেই জায়গায়, যেখানে আলো পৌঁছোয়নি। অর্ণা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এক কোণে কুয়াশার আড়ালে পাহাড়ের ঢালে অন্ধকার জমে আছে, যেন আলোরও সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
অর্ণা সাহস করে বলল, “আপনি আবার এসেছেন।”
যুবক হেসে মৃদু গলায় উত্তর দিল, “আসিনি, আমি এখানেই থাকি।”
অর্ণা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। “থাকেন মানে? পাহাড়ে?”
সে শুধু কাঁধ ঝাঁকাল, “আলো যেখানে পড়ে না, আমি সেখানেই খুঁজে বেড়াই।”
তারপর ক্যামেরা নামিয়ে অর্ণার দিকে তাকাল। চোখদুটি গভীর, যেন অরণ্যের ভিতরকার গোপন আলো লুকিয়ে আছে।
“আপনি শহর থেকে এসেছেন, তাই না?”
অর্ণা মাথা নেড়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ। পালাতে। শহর আর সহ্য হচ্ছিল না।”
যুবক আবার ক্যামেরা তুলে নিল, “পাহাড় কাউকে পালানোর জায়গা দেয় না। সে শুধু তোমাকে তোমার নিজের সঙ্গে দাঁড় করায়।”
এই অদ্ভুত কথাগুলো শুনে অর্ণার মনে হলো, সে যেন বহুদিনের পরিচিত কাউকে শুনছে। কিন্তু নাম জানতে চাইলেও জিজ্ঞেস করতে পারল না। তার আগেই যুবক নরম গলায় বলল, “যদি সত্যিই পাহাড়কে বুঝতে চান, কাল ভোরে বনের ভেতর আসবেন। লেবং কার রোডের পাশে একটা পুরোনো পথ আছে, সেখানেই অপেক্ষা করব।”
অর্ণা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। চারপাশের ভিড়ের মধ্যে, পাহাড়ি আলো-অন্ধকারে, সেই কণ্ঠস্বর যেন তার ভেতরের নিস্তব্ধতায় দাগ কেটে গেল। সে জানত না কেন—কিন্তু মনে হলো এই ডাক এড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
গাড়ি আবার নেমে এলো দার্জিলিং শহরে। লোকজন হাসি-ঠাট্টা করতে লাগল, ক্যামেরার ছবি দেখাতে লাগল একে অপরকে। অর্ণা চুপচাপ বসে রইল। তার মনে হচ্ছিল—আজকের ভোর কেবল একটুকরো সূর্যোদয় নয়, বরং এক অদৃশ্য দরজা খুলে দিয়েছে।
হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন সে শেষবারের মতো পাহাড়ের দিকে তাকাল, কেবল সেই কথাটাই মনে হচ্ছিল—
“আলো যেখানে পড়ে না, সেখানেই লুকিয়ে আছে সত্যি।”
পর্ব ৩: কুয়াশার ভেতর
অর্ণার মনে রাতভর কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—সে কি যাবে? এক অচেনা যুবকের ডাকে, অচেনা বনের ভিতর, অচেনা পথে—এ সবই যেন যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। তবু পরদিন ভোর হওয়ার অনেক আগে থেকেই তার ভেতরে অদ্ভুত টান কাজ করছিল। যেন কারও অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিচ্ছে।
ব্যাগে শুধু একটা নোটবুক আর টর্চ ঢুকিয়ে অর্ণা শাল গায়ে দিল। পাহাড়ি শহর তখনও ঘুমিয়ে আছে, কুয়াশার চাদরে ঢেকে। হোটেলের ফটক দিয়ে বেরোতেই চারপাশের বাতাসে ভিজে কাঠের গন্ধ এসে লাগল। মৃদু আলোয় লেবং কার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে টের পাচ্ছিল, প্রতিটা পদক্ষেপ তাকে শহরের নিরাপদ কোলাহল থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
রাস্তায় যখন পৌঁছল, চারপাশ একেবারে নীরব। শুধু দূরে কোনো অচেনা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। রাস্তার ধারে হঠাৎই একটা বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল সেই যুবক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ক্যামেরা, চোখে সেই একই গভীর চশমা। অর্ণাকে দেখে কেবল মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল, কিছু বলল না।
তারা দু’জনে সরু পথ ধরে নেমে যেতে লাগল। চারপাশে উঁচু দেবদারু আর পাইন গাছ, কুয়াশার ফাঁক দিয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটি আর অচেনা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। একসময় যুবক হঠাৎ থেমে বলল,
“আপনি ভয় পাচ্ছেন?”
অর্ণা একটু থেমে উত্তর দিল, “হ্যাঁ… কিন্তু ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে ফারাক বুঝতে পারছি না।”
যুবক মৃদু হেসে বলল, “পাহাড় সবসময় মানুষকে এভাবেই টেনে নেয়—ভয়ের আড়ালেই থাকে তার সত্যি।”
আরও ভেতরে ঢোকার পর তারা পৌঁছল এক খোলা জায়গায়। চারপাশে গাছের মাথায় কুয়াশা ঝুলছে, মাটির উপর শিশির জমে চকচক করছে। যুবক ক্যামেরা বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অদৃশ্য আলোয়। অর্ণা অবাক হয়ে দেখল—আসলে আলো নেই বললেই চলে, তবু কোথা থেকে যেন একটা নরম দীপ্তি ভেসে আসছে, যা গাছের ছায়া আর কুয়াশার ফাঁকে মিশে যাচ্ছে।
“এটাই আমার আলো,” যুবক ধীর গলায় বলল, “যা চোখে ধরা পড়ে না, তবু ক্যামেরা তাকে ধরে রাখে।”
অর্ণা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনার নামটা জানব না?”
যুবক ক্যামেরা নামাল, অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ঋত্বিক।”
নামটা শুনে অর্ণার মনে অদ্ভুত এক স্রোত বয়ে গেল। সে যেন কোথাও আগে শুনেছে—কিন্তু মনে করতে পারল না। কুয়াশার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটির নাম যেন পাহাড়েরই মতো প্রাচীন আর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
হঠাৎ হাওয়া জোরে বয়ে উঠল। কুয়াশার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে এল, যেন বহু লোক একসাথে মন্ত্র পড়ছে। অর্ণা বিস্মিত হয়ে বলল, “আপনি শুনলেন?”
ঋত্বিক শান্ত গলায় উত্তর দিল, “শুনলে ভয় পাবেন। কিন্তু এটাকেই বলে পাহাড়ের কণ্ঠস্বর। শহরের মানুষরা এটাকে হাওয়ার শব্দ বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু আসলে এ হলো পাহাড়ের স্মৃতি।”
অর্ণার বুক কেঁপে উঠল। তার মনে হচ্ছিল—সে আর আগের মতো পর্যটক নেই। সে যেন প্রবেশ করেছে এক অচেনা, গোপন জগতে।
ঋত্বিক ক্যামেরা নামিয়ে তার দিকে তাকাল, “আপনি চাইলে আর আসবেন না। এ পথ সবার জন্য নয়।”
অর্ণা চুপ করে রইল। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর অদ্ভুত টান কাজ করছিল। হয়তো এ ভয়ই তাকে আটকে রাখবে, আবার হয়তো এই ভয়কেই আলিঙ্গন করতে হবে।
যখন তারা শহরের পথে ফিরে আসছিল, তখন আকাশের কোণে প্রথম সূর্যের আলো ফুটেছে। কিন্তু অর্ণার মনে হচ্ছিল, আজকের ভোর আর গতকালের ভোর এক নয়।
তার মাথায় ঘুরছিল শুধু একটা কথাই—
“পাহাড় মানুষকে তার নিজের মুখ দেখায়।”
পর্ব ৪: ছবির ভিতরের ছায়া
দু’দিন কেটে গেল দার্জিলিংয়ে। দিনে দিনে অর্ণার মনে হচ্ছিল, শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে এসে সে কেবল পাহাড়ের নরম হাওয়া, কুয়াশা আর শান্তি খুঁজতে আসেনি—তার ভ্রমণ যেন অচেনা এক পথে বাঁক নিয়েছে। যতবার সে ঋত্বিকের সঙ্গে দেখা করছে, ততই অনুভব করছে এই মানুষটা যেন শুধুই এক আলোকচিত্রী নয়, বরং পাহাড়ের অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের বাহক।
এক বিকেলে অর্ণা হোটেল থেকে বেরিয়ে মল রোডে হাঁটছিল। দোকানগুলোতে তখন ভিড়, কাঠের ঘরে গরম চায়ের গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎই এক ফাঁকা কোণায় তাকে দেখতে পেল ঋত্বিককে। হাতে তার ক্যামেরা নেই, শুধু একখানা পুরোনো নোটবুক। কাছে গিয়ে অর্ণা বলল,
“আজ ক্যামেরা নেই?”
ঋত্বিক হেসে নোটবুকটা উলটে দেখাল—পাতায় ভরা অসংখ্য ছবি, কিন্তু রঙ বা রেখায় নয়, শুধু আলো-অন্ধকারের ছাপ। যেন ফাঁকা জায়গার মধ্যেই ছবি তৈরি হয়েছে।
অর্ণা বিস্মিত হয়ে বলল, “এগুলো তো… অদ্ভুত! আলো ছাড়া ছবি কেমন করে সম্ভব?”
ঋত্বিক ধীরে উত্তর দিল, “যা আমরা দেখি তা সব নয়। পাহাড়ে কিছু আলো আছে, যা কেবল ছায়া হয়ে ধরা দেয়। আমি সেটাই রাখার চেষ্টা করি।”
সেই রাতে হোটেলের ঘরে ফিরে অর্ণার ঘুম আসছিল না। বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ঋত্বিকের নোটবুকের অদ্ভুত ছবি। সে মনে করছিল, ছবিগুলোর ফাঁকেই যেন কোনো গল্প লেখা আছে, কিন্তু সাধারণ চোখে বোঝা যায় না। নোটবুকে আঁকা রেখাগুলো যেন গোপনে ডাক দিচ্ছে তাকে।
পরদিন সকালে ঋত্বিক তাকে আবার ডেকে নিয়ে গেল এক পুরোনো লেন ধরে। চারপাশে মানুষের ভিড় নেই, শুধু চা-বাগান আর অগভীর কুয়াশা। সেখানে দাঁড়িয়ে সে ক্যামেরা বের করে বলল,
“আজ আপনাকে কিছু দেখাব। তবে ভয় পেতে পারেন।”
অর্ণার বুক কেঁপে উঠল। তবু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
ঋত্বিক ক্যামেরার ভিউফাইন্ডার এগিয়ে ধরল। অর্ণা চোখ রাখতেই চমকে উঠল—সে যা দেখল তা কোনো সাধারণ দৃশ্য নয়। পাহাড়ের সবুজ ঢালের উপর যেন অসংখ্য ছায়া নড়ছে, যেন অদৃশ্য মানুষ চলাফেরা করছে। চোখ সরাতেই দৃশ্য মিলিয়ে গেল, আবার তাকাতেই ফিরল।
অর্ণা বিস্ময়ে বলল, “এগুলো কী?”
ঋত্বিক শান্তভাবে বলল, “এরা হলো পাহাড়ের যাত্রীরা। যাদের গল্প আমরা ভুলে গেছি, যাদের নাম শহর জানে না—তাদের ছায়া রয়ে গেছে। ক্যামেরা শুধু তা ধরে রাখে।”
অর্ণার গা শিউরে উঠল। মনে হচ্ছিল সে যেন ইতিহাসের অদৃশ্য পাতা উলটে ফেলছে। কিন্তু ভয়কে ছাড়িয়ে তার মনে জাগল গভীর কৌতূহল।
“তাহলে আপনার ছবিগুলো… শুধু ছবি নয়?”
ঋত্বিক নীরব থেকে কেবল বলল, “ছবি হলো স্মৃতির আড়ালে লুকোনো ছায়ার দরজা। কেউ যদি দরজা খুলতে চায়, তবে তাকে নিজের ভেতরও আলো-অন্ধকার মেনে নিতে হয়।”
অর্ণা হঠাৎ বুঝতে পারল—এই ভ্রমণটা তার আগের মতো নিছক আনন্দের নয়। পাহাড় তাকে টেনে নিয়েছে এমন এক পথে, যেখানে দৃশ্য আর অদৃশ্য, আলো আর ছায়া মিশে গেছে।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার সময় হঠাৎই তার বুকের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এতদিনের শহুরে জীবন, একঘেয়ে চাকরি, সম্পর্কের টানাপোড়েন—সব যেন এক মুহূর্তে তুচ্ছ মনে হলো।
কিন্তু একটা ভয়ও তাকে পেয়ে বসল—ঋত্বিক যে পথ দেখাচ্ছে, সে পথ কি সত্যিই মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব?
রাতভর সেই প্রশ্নই তার ঘুম কাড়ল। বারবার মনে হচ্ছিল, হয়তো কোনো দরজা খুলে গেছে, আর সে পেছনে ফিরতে পারবে না।
পর্ব ৫: ছায়ার দরজা
ভোরের আলো ফুটতেই অর্ণা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। পাহাড়ের নীল কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল, অথচ তার ভেতরে যেন ঘন অন্ধকার জমে উঠছিল। ঋত্বিকের দেখানো ছবিগুলো বারবার মনে পড়ছিল—যেন কোনো অচেনা মানুষদের ছায়া পাহাড়ের ঢালে হাঁটছে। আজ সে ঠিক করল, যাই হোক না কেন, সেই রহস্যটা তাকে জানতে হবে।
ঋত্বিক যেন আগেই বুঝে রেখেছিল। মল রোডের ভিড় এড়িয়ে সে অর্ণাকে নিয়ে গেল শহরের এক নির্জন প্রান্তে। পাহাড়ি পথ নেমে গিয়েছে গভীর অরণ্যে। চারপাশে দেবদারুর অন্ধকার, কোথাও পাখির ডাক নেই, শুধু বাতাসে ভিজে কাঠের গন্ধ। পথ যত গভীরে যাচ্ছিল, অর্ণার বুকের ভিতর ততই শূন্যতা আর অজানা ভয় জমে উঠছিল।
একটা পুরোনো, ভাঙা কাঠের সেতু পার হয়ে তারা পৌঁছল এক খোলা জায়গায়। মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক ভগ্নস্তূপ—মনে হচ্ছিল কোনো পুরোনো পাহাড়ি আশ্রমের ধ্বংসাবশেষ। ঋত্বিক থেমে ক্যামেরা বের করল।
“এটাই সেই জায়গা, যেখানে আলো আর ছায়া একসাথে থাকে,” সে ধীর গলায় বলল।
অর্ণা অবাক হয়ে চারপাশ দেখল। দিনের আলোয়ও জায়গাটা যেন অদ্ভুত অন্ধকারে ঢাকা। মাটিতে ভাঙা মূর্তির টুকরো, গায়ে শ্যাওলা জমে আছে। হঠাৎ ঋত্বিক ক্যামেরার ভিউফাইন্ডার এগিয়ে দিল। অর্ণা চোখ রাখতেই তার শরীর কেঁপে উঠল—সে দেখল ধ্বংসাবশেষের ভেতর অসংখ্য ছায়ামূর্তি বসে আছে, যেন প্রার্থনা করছে। মুখগুলো স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাদের ঠোঁট নড়ছে, যেন একসাথে মন্ত্র পড়ছে।
অর্ণা তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
“ওরা কারা?” সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
ঋত্বিক ধীরে বলল, “যারা এই পাহাড়ে একসময় বেঁচেছিল, যাদের নাম ইতিহাসে লেখা নেই। ওরা মুছে যায়নি—ওরা আলো পায়নি, তাই ছায়ায় থেকে গেছে। আমার ছবিতে ওরা ধরা পড়ে।”
অর্ণা অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু এটা কি সত্যিই সম্ভব? নাকি…আপনার কল্পনা?”
ঋত্বিক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল, “আপনি যদি মনে করেন কল্পনা, তবে এ-ই আপনার মুক্তি। কিন্তু একবার যদি বিশ্বাস করেন, তবে এ ছায়া আপনাকে ছাড়বে না।”
বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল অর্ণার। সে অনুভব করছিল—কোনো অচেনা শক্তি যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছিল অদ্ভুত গুঞ্জন, যেন শতবর্ষ পুরোনো কোনো স্তবগান।
ঋত্বিক ধীরে ক্যামেরা নামিয়ে বলল, “আমি চাইলে আপনাকে আর এখানে আনতে পারতাম না। কিন্তু পাহাড় আপনাকে ডেকেছে। আপনি এখন এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।”
অর্ণা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল—এই ভ্রমণ আর সাধারণ ভ্রমণ নয়। কোনো অদৃশ্য দরজা খুলে গেছে, যার ওপারে আলো নেই, আছে কেবল ছায়ার গভীর সত্যি।
সেদিন সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার পরও অর্ণা আয়নায় নিজের মুখ দেখে আতঙ্কিত হলো। চোখের নিচে কালো ছাপ, ঠোঁটে শুকনো রেখা—সে যেন আগের সেই শহুরে মেয়ে নেই। তার মনে হচ্ছিল, পাহাড় তাকে নিজের মতো করে গড়ে নিচ্ছে।
বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই আবার ভেসে উঠল সেই ছায়াগুলো। তারা ফিসফিস করছে, ডেকে যাচ্ছে। অর্ণা জানত—সে আর পেছনে ফিরতে পারবে না।
ছায়ার দরজা একবার খোলা হলে তা বন্ধ হয় না।
পর্ব ৬: ঋত্বিকের অতীত
অর্ণার ঘুম ভাঙল গভীর রাতে। জানলার বাইরে পাহাড়ি অন্ধকার নেমে এসেছে, কেবল দূরে কোনো অচেনা পাখির ডাক ভেসে আসছিল। বুকের ভেতরটা ভারী লাগছিল, যেন কারও ফিসফিসানি এখনও কানে বাজছে। সে মনে করতে পারছিল না—এটা কি স্বপ্ন, নাকি সত্যিই কোনো অদৃশ্য কণ্ঠ তাকে ডেকেছে।
পরদিন সকালে মল রোডে গিয়ে ঋত্বিককে আবার খুঁজে পেল। সে এক কোণের কাঠের বেঞ্চে বসেছিল, ক্যামেরা হাঁটুর ওপর রাখা। অর্ণাকে দেখেই চোখ তুলল, কিন্তু কিছু বলল না। অর্ণা নীরবতা ভেঙে বলল,
“আমি কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি। যেন কেউ আমায় ডেকেছিল… ছায়ার ভেতর থেকে।”
ঋত্বিক শান্ত গলায় বলল, “এটা শুরু হয়ে গেছে।”
অর্ণা হতবাক হয়ে তাকাল, “শুরু মানে?”
ঋত্বিক মৃদু হেসে ক্যামেরা বন্ধ করল, “যখন কেউ ছায়ার দরজায় দাঁড়ায়, তখন পাহাড় তাকে চিনে নেয়। আপনার ভেতরের ভয়গুলোই এখন আপনাকে ডাকছে।”
অর্ণা চুপ করে বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেন এইসব করেন? কেন এই ভয়ঙ্কর ছায়াগুলো খোঁজেন?”
ঋত্বিক চোখ নামিয়ে বলল, “কারণ ওরা আমারও পরিচিত।”
তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের গল্প বলতে শুরু করল। বহু বছর আগে ঋত্বিকের বাবা ছিলেন দার্জিলিংয়ের এক স্কুলশিক্ষক। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করতেন। গ্রামের বয়স্কদের মুখে শোনা অদ্ভুত সব কাহিনি তিনি লিখে রাখতেন—পাহাড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষ, পুরোনো আশ্রমের গোপন আচার, আর অদৃশ্য যাত্রীদের কথা। কিন্তু একদিন হঠাৎই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ খুঁজে পেল না। কেবল তার নোটবুকে ছিল অস্পষ্ট কিছু লেখা—
“আলো যেখানে পৌঁছোয় না, সেখানেই থেকে যায় মানুষের ছায়া।”
ঋত্বিক ছোটবেলায় বাবার সেই নোটবুক খুঁজে পায়। তখন থেকেই তার ভেতরে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত টান। সে ক্যামেরা হাতে নেয়—কিন্তু তার ছবিতে ধরা পড়তে শুরু করে এমন কিছু, যা অন্যের চোখে ধরা পড়ে না।
“আমি জানি, অনেকে আমাকে পাগল ভাবে,” ঋত্বিক বলল, “কিন্তু এই পাহাড়ে আমার বাবা এখনও আছেন। তার ছায়া, তার কণ্ঠস্বর—সবকিছু। আমি শুধু খুঁজে বেড়াই।”
অর্ণা স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন সে ভেবেছিল ঋত্বিক হয়তো কেবল রহস্যময় এক আলোকচিত্রী। অথচ তার নিজের অতীতও এই পাহাড়ের ছায়ার সঙ্গে বাঁধা।
“তাহলে আপনি কি বিশ্বাস করেন, আপনার বাবাও এই ছায়ার ভেতরে আছেন?”
ঋত্বিকের চোখ গভীর হয়ে উঠল। “হ্যাঁ। আমি বহুবার তার কণ্ঠ শুনেছি। কখনও কখনও ছবিতে তার ছায়াও ধরা পড়ে।”
অর্ণার শরীরে কাঁটা দিল। যদি সত্যিই তাই হয়, তবে পাহাড় কি কেবল দৃশ্য নয়—বরং অতীতের অদৃশ্য কবরখানা?
তারা চুপচাপ বসে ছিল কিছুক্ষণ। বাতাসে ভেসে আসছিল গরম চায়ের গন্ধ আর দূরের বাচ্চাদের হাসির শব্দ। অথচ এই নিস্তব্ধতার ভেতর অর্ণার বুক ভারী হয়ে উঠছিল। সে বুঝতে পারছিল—ঋত্বিকের যাত্রায় সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।
“আপনি চাইলে এখনও ফিরতে পারেন,” ঋত্বিক ধীর গলায় বলল।
অর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, “না। আমি জানি আমি আর ফিরব না। আমি দেখতে চাই ছায়ার আড়ালে কী লুকিয়ে আছে।”
ঋত্বিক মাথা নেড়ে হালকা হাসল। তার চোখে অদ্ভুত এক জ্যোতি ফুটে উঠল।
“তাহলে প্রস্তুত থাকুন। কারণ যা দেখবেন, তা হয়তো আপনাকে বদলে দেবে চিরদিনের মতো।”
সন্ধে নামতেই তারা আবার বেরোল। পাহাড়ি পথ তখন আরও নীরব, কুয়াশা যেন ঘন সাদা দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণার মনে হচ্ছিল, এই যাত্রা আর নিছক ভ্রমণ নয়—এ যেন এক অদৃশ্য পরীক্ষার শুরু।
পর্ব ৭: আশ্রমের ভিতরে
সন্ধ্যার নীল অন্ধকার নামতেই ঋত্বিক অর্ণাকে নিয়ে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গেল। পাহাড়ি পথের পাশে চুপচাপ দাঁড়ানো গাছগুলো কুয়াশায় যেন আরও লম্বা হয়ে উঠছিল। অর্ণার মনে হচ্ছিল, প্রতিটা গাছের ফাঁক থেকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠছিল, অথচ পা থামাতে পারছিল না।
“আজ আমরা যাব সেই আশ্রমে,” ঋত্বিক বলল শান্ত গলায়, “যেখানে আলো আর ছায়ার সীমারেখা মিশে গেছে।”
অর্ণা কিছু বলল না। পথ ধরে যত তারা ভেতরে নামছিল, ততই চারপাশের নিস্তব্ধতা তীব্র হচ্ছিল। কেবল বাতাসের ফিসফিস আর অদৃশ্য কোনো গুঞ্জন কানে আসছিল। একসময় পৌঁছল সেই ধ্বংসাবশেষের সামনে, যেটা অর্ণা আগে দেখেছিল। দিনের আলোয় তা ছিল ভাঙা ইট-পাথর, কিন্তু আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে জায়গাটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
অশ্বত্থ গাছের শেকড়ে শ্যাওলা জমে আছে, ভাঙা দেওয়ালের গায়ে অদ্ভুত ছায়া খেলে যাচ্ছে। ঋত্বিক ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে মশাল জ্বালাল। মশালের আলোয় দেখা গেল, মাটিতে ভাঙা মূর্তির টুকরো ছড়িয়ে আছে, আর তার মাঝে লালচে রঙের দাগ—যেন পুরোনো রক্তের ছাপ।
অর্ণা শিউরে উঠল। তবু সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হয়েছিল?”
ঋত্বিক গভীর দৃষ্টিতে তাকাল, “শত বছর আগে এখানে এক গোপন আচার হত। বলা হয়, তন্ত্রসাধকেরা এখানে এমন এক প্রার্থনা করত, যা মানুষের ছায়াকে অমর করে রাখে। শরীর মরে যায়, কিন্তু ছায়া থেকে যায়—চিরকাল।”
অর্ণার বুক কেঁপে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটা শব্দ যেন চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হঠাৎ হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার ভেসে এল সেই অদ্ভুত গুঞ্জন—অসংখ্য কণ্ঠ একসাথে মন্ত্র পড়ছে।
ঋত্বিক মশাল উঁচু করে বলল, “এখন চোখ খোলা রাখুন। ভয় পাবেন না।”
অর্ণা চারপাশে তাকাতেই দেখল—ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে ছায়াগুলো বেরিয়ে আসছে। প্রথমে অস্পষ্ট রেখা, তারপর মানবাকৃতি। তাদের চোখ নেই, মুখ নেই, তবু চলাফেরা করছে। তারা যেন ভাঙা আশ্রমে আবার বসে পড়ল, মূর্তির টুকরোগুলো ঘিরে প্রার্থনা করছে।
অর্ণার গা শিউরে উঠল। পা কাঁপছিল। তবু দৃষ্টি সরাতে পারছিল না। যেন এই দৃশ্য তার মগজে পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা ছায়া আলাদা হয়ে দাঁড়াল। তার মুখে অস্পষ্ট রেখা ফুটে উঠছিল—চোখের গহ্বর, ঠোঁটের ছায়া। অর্ণার বুক কেঁপে উঠল, কারণ মুখটা অদ্ভুতভাবে ঋত্বিকের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।
“এটা…” অর্ণা কাঁপা গলায় বলল।
ঋত্বিক ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এ আমার বাবার ছায়া।”
অর্ণা অনুভব করল, তার চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসছে। যেন সময় থেমে গেছে। ছায়াগুলো মন্ত্র পড়ছে, কিন্তু শব্দগুলো সরাসরি তার বুকের ভিতর ঢুকছে।
ঋত্বিক এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরা তুলল। ক্লিকের শব্দে হঠাৎ ছায়াগুলো থেমে গেল। চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তারপর তারা আবার অন্ধকারে মিশে যেতে লাগল।
অর্ণা হাঁপাতে লাগল, শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল।
“এগুলো কি আমাকে দেখতে পায়?” সে জিজ্ঞেস করল।
ঋত্বিক উত্তর দিল না। শুধু ক্যামেরার ভেতর তাকিয়ে রইল, যেন কোনো নিশ্চিত জবাব দিচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায় বলল,
“এখন আপনি বুঝলেন কেন আমি এখানে আসি? আমি একদিন আমার বাবাকে ফিরিয়ে আনব। কিন্তু তার আগে… হয়তো আপনাকেও আপনার ছায়ার মুখোমুখি হতে হবে।”
অর্ণা কিছু বলল না। চারপাশের অন্ধকারে শুধু নিজের দ্রুত হৃদস্পন্দন শুনছিল। সে জানত—এ যাত্রা আর ফিরে যাওয়ার নয়।
পর্ব ৮: নিজের ছায়ার মুখোমুখি
অর্ণা ভেবেছিল পাহাড় কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য, কুয়াশার রহস্য আর নিস্তব্ধতার শান্তি। কিন্তু সেই রাতে ধ্বংসস্তূপের আশ্রম থেকে ফেরার পর তার ভেতরে যেন অন্য এক পাহাড় গড়ে উঠল—অদৃশ্য, অথচ ভারী। ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই সে টের পেল, মুখের ভিতর চেনা রেখার পাশাপাশি অচেনা কিছু দাগ ফুটে উঠছে। চোখের কোণে কালো ছাপ, ঠোঁটের রেখায় শুকনো অন্ধকার। যেন আয়নায় তাকানো মানুষটা আর সে নয়, তারই কোনো পুরোনো ছায়া।
পরদিন সকালে ঋত্বিক আবার এল। অর্ণাকে দেখে বলল,
“আজ আপনাকে আপনার ছায়ার মুখোমুখি হতে হবে।”
অর্ণা কেঁপে উঠল, “আমারও ছায়া?”
ঋত্বিক শান্তভাবে বলল, “প্রত্যেক মানুষেরই থাকে। কেউ দেখে না, কেউ দেখতেও চায় না। কিন্তু পাহাড় কাউকে ছাড়ে না।”
তারা আবার বনের ভেতরে ঢুকল। এবার অর্ণার মনে হচ্ছিল প্রতিটি পদক্ষেপ তার পায়ের নিচে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেন পাহাড় তার হাঁটার শব্দ লিখে রাখছে। গাছের ডাল ঝুঁকে পড়েছে, পাতার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে না। জায়গাটা এমনভাবে অন্ধকার যে দুপুরেও রাতের মতো।
হঠাৎ ঋত্বিক থেমে গেল। মশাল জ্বালিয়ে অর্ণার দিকে তাকাল।
“এখানেই হবে,” সে বলল।
অর্ণা চারপাশে তাকাল—ভাঙা পাথরের বেদি, তার উপর অজস্র শ্যাওলা, আর বাতাসে সেই একই মন্ত্রগুঞ্জন।
“চোখ বন্ধ করুন,” ঋত্বিক নির্দেশ দিল।
অর্ণা চোখ বন্ধ করতেই বুকের ভেতর ধকধক শুরু হলো। মনে হচ্ছিল হৃদস্পন্দন নয়, যেন মাটির তলা থেকে কোনো ড্রাম বাজছে। হঠাৎ কানে ফিসফিসানি ভেসে এল—অচেনা অথচ ভীষণ ঘনিষ্ঠ।
“তুমি পালিয়েছিলে… তুমি ভেবেছিলে ভুলে যাবে…”
অর্ণা চোখ খুলে দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া। অস্পষ্ট রেখা, কিন্তু আকারটা স্পষ্ট। আর সেই মুখ—অদ্ভুতভাবে তার নিজের মতো। চোখদুটো ফাঁকা, কিন্তু তাতে ভেসে উঠছে ক্লান্তি, ভয় আর লুকোনো কান্না।
অর্ণার শরীর অবশ হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল,
“এটা… আমি?”
ছায়াটা মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “তুমি যে জীবন থেকে পালিয়েছিলে, আমি সেই জীবন।”
তার চোখে ভেসে উঠল অফিসের ব্যস্ত দিনগুলো, কোলাহলের মধ্যে একা ফেলে রাখা সন্ধে, অবহেলিত সম্পর্ক, হারানো স্বপ্ন। সব মিলে যেন এক বিশাল অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরল।
অর্ণা চিৎকার করে উঠতে চাইলো, কিন্তু গলা শুকিয়ে গেল। বুকের ভেতর কেবল একটাই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“ফিরে যাও, নাহলে আমি তোমাকে গ্রাস করব।”
ঋত্বিক এগিয়ে এসে মশাল উঁচু করল। আলো পড়তেই ছায়াটা কেঁপে উঠল, কিন্তু মিলিয়ে গেল না। বরং আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ঋত্বিক বলল, “এটাই তোমার আসল পরীক্ষা। ছায়াকে মেনে না নিলে তুমি পাহাড়ে টিকতে পারবে না।”
অর্ণার চোখ ভিজে গেল। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল নিজের ছায়ার দিকে। প্রথমে ভয়, তারপর কাঁপুনি, শেষে এক অদ্ভুত শান্তি—যেন সে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাকে ছুঁয়ে ফেলছে। ছায়াটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেল, বাতাসে মিশে গেল, রেখে গেল কেবল এক শীতল হাওয়া।
অর্ণা হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল মাটিতে। চোখে জল, কিন্তু মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি। যেন বহু বছর পর নিজের ভার নামাতে পেরেছে।
ঋত্বিক তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“এখন আপনি বুঝলেন, পাহাড় কেন আপনাকে ডেকেছিল?”
অর্ণা মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। আমি বুঝলাম, আমি আসলে নিজের কাছ থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। আর ছায়াই আমাকে ফিরিয়ে দিল।”
দূরে পাহাড়ি আকাশে তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের প্রথম রঙ এসে পড়ছে। অনেকদিন পর অর্ণার মনে হলো—আলো সত্যিই আছে, কিন্তু তার মানে বোঝা যায় কেবল অন্ধকারকে ছুঁলে।
পর্ব ৯: বাবার ছায়া
অর্ণা ভেবেছিল নিজের ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার পর হয়তো সব শেষ। বুক হালকা হবে, ভেতরের ভয় সরে যাবে। কিন্তু পরদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াতেই বুঝল, তার যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে। পাহাড় যেন আরও কাছে এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে। প্রতিটা বাতাস, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা ছায়া যেন তাকে এক অদৃশ্য রহস্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ঋত্বিক এল শান্ত মুখে, কিন্তু চোখে অদ্ভুত ক্লান্তি। তার কণ্ঠে চাপা ভার—
“আজ আপনাকে আমার সঙ্গে শেষবার যেতে হবে। আজ আমার বাবার ছায়া আপনাকে চিনবে।”
অর্ণা বিস্ময়ে তাকাল।
“আমাকে কেন?”
ঋত্বিক ধীরে উত্তর দিল, “কারণ আপনি নিজের ছায়াকে মেনে নিয়েছেন। তাই পাহাড় এখন আপনাকে সাক্ষী হতে দেবে।”
তারা বেরোল গভীর বনের দিকে। পথ আরও নির্জন, আরও ভিজে। গাছের পাতায় জল জমে টপটপ করে পড়ছিল। একসময় পৌঁছল সেই ধ্বংসাবশেষ আশ্রমে। এবার জায়গাটা যেন অন্যরকম লাগছিল—আরও অন্ধকার, আরও ভারী। বাতাসে ভেসে আসছিল গুঞ্জন, আগের চেয়ে তীব্র।
ঋত্বিক মশাল জ্বালিয়ে বেদির সামনে দাঁড়াল। চোখে ছিল অদ্ভুত জেদ।
“বাবা,” সে ফিসফিস করল, “আজ আমি ফিরে এসেছি। দেখাও নিজেকে।”
অর্ণার বুক কেঁপে উঠল। গুঞ্জন হঠাৎ থেমে গেল। চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে একটি ছায়া বেরিয়ে এল। অন্য সব ছায়ার চেয়ে উঁচু, ভারী। মুখে অস্পষ্ট রেখা, তবু বোঝা যাচ্ছে—একজন প্রৌঢ় মানুষ।
ঋত্বিক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, চোখ ভিজে উঠল।
“বাবা!”
অর্ণা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে মনে হচ্ছিল, ছায়াটা সত্যিই ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। শুধু বাতাসে এক অদ্ভুত কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল।
ঋত্বিক কাঁপা গলায় বলল, “আপনি আমাকে ছেড়ে গেলেন কেন? আমি তো খুঁজে ফিরছি এতদিন।”
হঠাৎ অর্ণার মনে হলো, ছায়ার ফাঁকা চোখ দুটি তার দিকেও তাকাল। আর সেই মুহূর্তেই কানে ভেসে এল চাপা এক কণ্ঠ—
“ছায়া কাউকে ছেড়ে যায় না। আমি আছি, কিন্তু ফিরতে পারি না।”
অর্ণা শিউরে উঠল। ঋত্বিক হয়তো শুনতে পাচ্ছিল না, কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি কি আপনাকে ফিরিয়ে আনতে পারব না?”
ছায়াটা এগিয়ে এল। বেদির উপর মশালের আলো কেঁপে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য মুখের রেখাগুলো স্পষ্ট হলো—আর তাতে অর্ণা দেখল এক শিক্ষকের ক্লান্ত মুখ, যিনি অজস্র কথা বলতে চাইছেন কিন্তু পারেন না।
“ফিরিয়ে আনা যায় না,” সেই কণ্ঠ আবার বাজল অর্ণার কানে, “কেবল স্মৃতির মতো বয়ে নিতে হয়।”
ঋত্বিক হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল। ক্যামেরা বের করে ছায়ার দিকে তাক করল। ক্লিকের শব্দ হতেই চারপাশে প্রচণ্ড হাওয়া বইতে লাগল। মশাল নিভে গেল। আশ্রম অন্ধকারে ঢেকে গেল।
অর্ণা আতঙ্কে ঋত্বিকের হাত ধরল। অন্ধকারের ভেতরে কেবল সেই ছায়াটির অস্পষ্ট রেখা ভেসে রইল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অদৃশ্য হয়ে।
চারপাশে আবার নিস্তব্ধতা। কেবল ঋত্বিক হাঁপাচ্ছিল। তার চোখে পাগলামির ঝিলিক—
“আমি তাকে আবার পেয়েছিলাম… কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না।”
অর্ণা জানত না কী বলবে। বুকের ভেতর কেবল ভয় আর মায়া মিশে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই ভ্রমণ তাকে এমন এক সত্যির সামনে দাঁড় করিয়েছে, যেখান থেকে ফেরার পথ নেই।
রাতের আকাশে তখন পাহাড় ঢেকে গেছে ঘন মেঘে। দূরে বজ্রপাতের ঝলকানি আলোয় অর্ণা শেষবারের মতো দেখল—ঋত্বিক দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা আশ্রমের সামনে, হাতে ক্যামেরা, চোখে বেদনার ছায়া।
পর্ব ১০: শেষ ভোর
ঋত্বিকের বাবার ছায়ার সাথে সেই মুখোমুখি হওয়ার পর অর্ণার ভেতর যেন অন্য এক স্তর খুলে গেল। সে বুঝতে পারছিল, এই পাহাড়ে প্রতিটা শ্বাস, প্রতিটা ছায়া আসলে সময়ের জমে থাকা গল্প। শহরের ব্যস্ত রাস্তায়, ভিড়ের চিৎকারে এই সত্যি বোঝা যায় না। কিন্তু এখানে, অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার ভিতর, মানুষের ভেতরের মুখোশ ভেঙে যায়।
সেই রাতেই অর্ণা ঠিক করল—কাল সকালে শহরে ফেরার ট্রেন ধরবে। তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছিল, তবু সে জানত, আরেকটু থাকলে হয়তো আর ফেরা হবে না। পাহাড় তাকে ধরে রাখবে নিজের ছায়ার সাথে।
ভোর হওয়ার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। দূরে তখনও কালো আকাশ, শুধু একফালি নরম আলো ফুটছে। কুয়াশা ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে হালকা হচ্ছে। সেই সময়ই দরজায় কড়া নাড়ল ঋত্বিক।
“যাচ্ছেন?” তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত শূন্যতা।
অর্ণা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমার ফেরা দরকার।”
ঋত্বিক কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “সবাই ফিরতে পারে না।”
অর্ণা তার দিকে তাকাল। তার চোখে কেবল দুঃখ আর হাহাকার। “আপনি ফিরবেন না?”
ঋত্বিক মৃদু হেসে ক্যামেরা তুলে ধরল। “আমার ফেরা এই ছবিগুলোর ভেতরেই। আমি যদি যাই, তবে আমার বাবার ছায়া একেবারে হারিয়ে যাবে। আমি তাকে হারাতে চাই না।”
অর্ণার গলা ভারী হয়ে এল। সে বুঝতে পারল, ঋত্বিক আর শহরের মানুষ নয়। পাহাড় তাকে নিজের করে নিয়েছে। তার দায়িত্ব আর নিয়তি একসাথে বাঁধা পড়েছে সেই ছায়ার সাথে।
ট্রেন ছাড়ার আগে শেষবারের মতো তারা মল রোডে দাঁড়াল। দোকানের ভেতর আলো জ্বলছিল, মানুষজন তখনও ঘুমে। কেবল দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে ভোরের আলো পড়ছিল। অর্ণা বুক ভরে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে বলল,
“আমার মনে হয় পাহাড় আসলে আমাদের আয়না। আমরা যা হতে চাই, তাই আমাদের দেখায়।”
ঋত্বিক তার দিকে তাকাল। চোখে ভিজে ঝিলিক। “হয়তো ঠিকই বলেছেন। আপনার ছায়া মেনে নিয়েছেন বলে হয়তো আপনি ফিরে যেতে পারবেন।”
স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অর্ণার মনে হচ্ছিল—সে হয়তো আর আগের মানুষ থাকবে না। অফিসের ডেস্ক, ফাইল, শহরের একঘেয়েমি—সবকিছুই বদলে যাবে। কারণ সে জানে, তার ভেতরের অন্ধকারকে মেনে নেওয়া ছাড়া আলো খুঁজে পাওয়া যায় না।
ট্রেন চলতে শুরু করল। জানালার বাইরে পাহাড় ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিল। তবু অর্ণা জানত, দূরে যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়। পাহাড় একবার ডাকলে সেই ডাক থেকে মুক্তি নেই।
শেষবারের মতো জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল সে। ভোরের আলোয় সেখানে ভেসে উঠছিল তার মুখ, আর ঠিক পেছনে অস্পষ্ট এক ছায়া—যেন পাহাড় এখনও তাকে ছাড়েনি।
অর্ণা মৃদু হাসল। তার ঠোঁট থেকে ফিসফিস করে বেরিয়ে এল একটিমাত্র বাক্য—
“আলো যেখানে পড়ে না, সেখানেই আমি আমার সত্যি খুঁজে পেয়েছি।”
গল্প শেষ