Bangla - ভূতের গল্প

সন্ধ্যার পর কেউ আসে

Spread the love

অরিন্দম বসু


লালগ্রাম—একটা ছোট্ট, প্রায় ভুলে যাওয়া গ্রাম দক্ষিণবঙ্গের এক প্রান্তে। জনসংখ্যা হাতে গোনা, কিন্তু কাহিনির অভাব নেই। দিন যতই আধুনিক হোক, লালগ্রাম সন্ধ্যা নামতেই আজও হারিয়ে যায় অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়। কেউ বলে, এই সময়ে কেউ আসে। কাকে বলা হয় “কেউ”? কেউ জানে না। দেখা যায় না তাকে। কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়—মনে হয় ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের কাছ ঘেঁষে।

এই গল্প ঠিক এখান থেকেই শুরু। রুদ্র বসু—একজন তরুণ চিত্রনাট্যকার। শহুরে জীবন থেকে ক্লান্ত হয়ে কয়েক মাস আগে এসেছিল লালগ্রামে, একটি সিনেমার লোকেশন দেখতে। তারপর হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল। পুলিশ, সাংবাদিক, বন্ধু—সবাই খুঁজেছে। কিছুই মেলেনি। শুধু তার ব্যাগ, ফোন, ডায়েরি পড়ে ছিল লালগ্রামের শেষ মাথায় একটি পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরের সামনে। ওটাই শেষ চিহ্ন।

রুদ্রর ভাই ঋষভ বসু—একজন বিজ্ঞান শিক্ষক, যুক্তিবাদে বিশ্বাসী। অন্ধবিশ্বাস, অতিপ্রাকৃত—এসবকে মনে করে লোক ঠকানোর ফন্দি। কিন্তু দাদার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা তাকে নাড়িয়ে দেয়। অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে সে আসে লালগ্রামে। তার লক্ষ্য—সত্য খুঁজে বের করা। এবং সেটা বিজ্ঞান দিয়েই।

গ্রামের মধ্যে একমাত্র ভরসাযোগ্য মানুষ সুবর্ণবাবু। অবসরপ্রাপ্ত ডাক বিভাগের কর্মচারী। তিনিই ঋষভকে নিজের বাড়িতে থাকতে দেন। সুবর্ণবাবুর বাড়ি লালগ্রামের প্রায় শেষপ্রান্তে—যেখান থেকে দূরে কুঁড়েঘরটা দেখা যায়।

ঋষভের অভ্যেস—সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা, লিখে রাখা। সে প্রথম দিন বিকেল পাঁচটার পরে বের হয়। কুঁড়েঘরের দিকে হাঁটে, আশপাশটা দেখে। চারপাশটা যেন একটু বেশিই নির্জন। গাছপালা ঘন হয়ে রয়েছে। হালকা রোদ পড়ে থাকলেও মনে হয় ছায়া গাঢ়তর হচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে।

হঠাৎ করে চারদিকের বাতাস থেমে যায়। গাছের পাতা নড়ছে না। পাখির ডাক নেই। কুকুররা সটান দাঁড়িয়ে যায়, যেন কিছু একটা টের পাচ্ছে। সময় তখন ঠিক ৫:৪০। অদ্ভুতভাবে ঘড়ির কাঁটা মনে হয় একটু হেঁটে থেমে গেল।

ঋষভ অনুভব করে—কারও দৃষ্টির ভার যেন তার ঘাড়ে চাপছে। সে পিছনে ফিরে দেখে—কেউ নেই। কিন্তু বুক ধড়ফড় করতে থাকে। এমন অনুভব জীবনে কখনও হয়নি। তার চোখ যায় কুঁড়েঘরের দিকে। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে মনে হয় হালকা ছায়া নড়ছে। অথচ সেখানে কেউ ঢোকেনি।

ঠিক তখনই সে একটি গলা শোনে। ফিসফিস করা গলা। স্পষ্ট শব্দ—“আমার কাহিনি শুনবি?”
ঋষভ চমকে পেছনে ঘোরে। কেউ নেই। বাতাস থেমে। ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। সে বুঝে যায়—কিছু একটা আছে এখানে, যাকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু সে আছে।

সে ছুটে ফিরে আসে সুবর্ণবাবুর বাড়িতে। কিছু বলে না। শুধু নিজের ডায়েরিতে লেখে—
“৫:৪০—বাতাস স্তব্ধ। শব্দ নেই। হঠাৎ অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—‘আমার কাহিনি শুনবি?’ যেন কেউ আমায় জানে। কে সে?”

সুবর্ণবাবু নীরবে বসে ছিলেন। চোখ সরু করে বললেন, “ঋষভবাবু, আপনি এখানে এসেছেন সত্য খুঁজতে, সেটা ভালো কথা। কিন্তু একটা কথা বলি—এই গ্রামে সন্ধ্যার পর কেউ ওদিকে যায় না। আমার স্ত্রী আজ দশ বছর আগে গিয়েছিল… ফেরেনি।”

ঋষভ স্তব্ধ হয়ে গেল। সে চেয়ে রইল দূরের অন্ধকার পথটার দিকে। একটা কথা মনে হচ্ছিল—যদি সত্যিই কিছু থাকে, তাহলে তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো যুক্তি আছে। এবং সেই যুক্তি খুঁজে পাওয়াই তার কাজ।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই—যদি কেউ থাকে, তবে সে কে?

আর সবচেয়ে বড় কথা—সে যা বলেছিল, “আমার কাহিনি শুনবি?”
তা কি শুধুই একটি ডাক ছিল? নাকি কোনও ফাঁদ?

পরদিন আবার সে যাবে। এবার প্রস্তুতি নিয়ে।

***

রাতটা ছিল অস্থির। ঘুম নামেনি ঋষভের চোখে। মাথার ভেতর বারবার বাজছিল সেই ফিসফিসে গলার আওয়াজ—“আমার কাহিনি শুনবি?”
শব্দটা যেন স্নায়ুর ভেতর ঢুকে গিয়েছে। সকাল হতেই সে আবার ডায়েরি খুলে বসে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অনুভূতি সে বিশ্লেষণ করে। তার যুক্তিবাদী মন বলছে—হ্যালুসিনেশন। কিন্তু মন বলে—এটা কেবল শুরু।

সুবর্ণবাবু সকালের চা নিয়ে এলেন বারান্দায়। চেয়ে রইলেন ঋষভের দিকে, একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “আপনি যদি দাদাকে খুঁজতেই চান, তাহলে আগে নিজের বিশ্বাসটাও খুঁজে নিন। লালগ্রামে আসা মানে শুধু একটা লোকেশন দেখা নয়। এটা একটা দাগ হয়ে থাকে মানুষের উপর।”

ঋষভ অবাক। “আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?”

সুবর্ণবাবু শান্ত গলায় বললেন, “রুদ্র এসেছিল, একা ছিল। কিন্তু একা থাকেনি। সন্ধ্যার পর সে বদলে গিয়েছিল। আমি নিজে দেখেছি ওর চোখের চাহনি—যেন কারো হয়ে গেছে।”

ঋষভ মুখ তুলে চাইল, “কারো হয়ে গেছে মানে?”

“মানে, সে আর ও ছিল না।”

ঋষভ কিছু না বলে উঠে গেল। আজ তার পরিকল্পনা অনেক বড়। সে সাথে রাখল একটি টর্চ, ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার, এবং পুরোনো দাদার ডায়েরি। রুদ্রর শেষ লেখাগুলি সে পড়েছে। শেষ পাতায় লেখা ছিল—
“আজ সন্ধ্যায় আবার সে আসবে। এবার আমি তার কথা শুনব। আমি জানি, এই গল্পটা আমাকেই লেখার জন্য ডাকছে কেউ।”

ঋষভ বিকেলের দিকে আবার সেই রাস্তায় হাঁটল। গ্রাম তখনও স্বাভাবিক। বাচ্চারা খেলে, পাখি ডাকছে। কিন্তু ঠিক ৫টা ৪০ মিনিটে, সব থেমে গেল। এমন এক নিঃশব্দতা নামল, যেন শব্দও ভয়ে জমে গেছে।

আজ সে কুঁড়েঘরের অনেক কাছাকাছি দাঁড়ায়। ভিতর থেকে অন্ধকার ছড়িয়ে আছে বাইরে। হঠাৎ তার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ নিজে থেকেই একবার জ্বলে উঠল। সে চমকে গেল। কেউ কি ছবি তুলল?

তারপরে সেই কণ্ঠস্বর—এবার একটু জোরে।
“শুনিস তো? কাহিনিটা অনেক পুরোনো…”

ঋষভ চারদিক দেখল। কেউ নেই। কিন্তু শব্দ এবার একদিক থেকে নয়, চারদিকে ঘুরে ফিরে আসছে।

“কে তুমি?” সে জিজ্ঞেস করল।

কণ্ঠস্বর থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর কুঁড়েঘরের দরজাটা নিজে থেকেই খুলে গেল। ভিতরে এক চিলতে আলো জ্বলে উঠল, ঠিক যেন আগুন নয়, আলো নয়—একটা জ্বলন্ত স্মৃতি।

ঋষভ ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকল।

ঘরের ভেতরটা ফাঁকা, তবে দেওয়ালে অদ্ভুত সব ছবি আঁকা—মুখ, চোখ, হাত—সবকিছু যেন ভয় আর কষ্টের চিহ্ন বহন করছে। মাটিতে একটা পুরোনো কাঠের বাক্স। সে নিচু হয়ে খোলে।

ভেতরে পাওয়া গেল তিনটি জিনিস—
১. একটি পুরোনো কাগজের টুকরো, তাতে লেখা—“যাকে ভালোবাসি, তাকেই আমি হারিয়েছি। সে আবার ফিরে আসবে, কিন্তু ভিন্ন রূপে।”
২. একটা কালো রঙের রুমাল, তাতে লাল রঙের দাগ—রক্ত নয়, কিছু যেন লিখে রাখা।
৩. আর একটা আয়না—যেটাতে নিজেকে দেখলে অন্য কিছু দেখা যায়।

ঋষভ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার প্রতিচ্ছবি দেখা গেল না। বরং দেখা গেল রুদ্রর মুখ। চোখ স্থির, ঠোঁট ফিসফিস করছে, কিন্তু শব্দ নেই।

হঠাৎ দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভিতরের বাতাস ঘূর্ণি হতে থাকল। মেঝের উপর আঁকা মুখগুলো যেন নড়ে উঠল, চোখ খুলল, কাঁদতে শুরু করল।

ঋষভ ভয় পায় না। সে গম্ভীর গলায় বলে, “তুমি চাইছো আমি শুনি। তবে সত্যি চাইলে, নিজেকে প্রকাশ করো। কে তুমি?”

কণ্ঠস্বর আবার আসে। এবার সে বলে—
“আমার নাম নেই। আমি ছিলাম, আছি, থাকব। আমি সেই শোক, যা লেখা হয়নি। আমি সেই গল্প, যা কেউ কখনও শেষ করেনি। আমি শুধু চাই, তুই শুনে যা লিখবি, তা হোক শেষ।”

ঋষভের গা শিউরে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এটা শুধু রহস্য নয়—এ এক অসমাপ্ত আত্মার আকুতি।

তারপর দরজাটা আবার খুলে যায়। সে বেরিয়ে আসে, হাতে আয়নাটা নিয়ে।

ঘরে ফেরার সময় কুয়াশা ঘন হয়ে আসে। সে মনে করে, বাতাসে কেউ তার কানে বলে গেল, “আজ শুরু হল আমার গল্প। শুনে যা, লিখে যা। কিন্তু মনে রেখ—গল্প যত গভীর হবে, ততই তুই হারিয়ে যাবি।”

***

রাত্রি গভীর হলেও ঘুম আসেনি ঋষভের চোখে। ঘরে লাইট অফ, তবুও আয়নাটা অন্ধকারে নিজে থেকেই ঝকমক করছে, ঠিক যেন কেউ ভিতর থেকে তাকিয়ে আছে। কীভাবে সম্ভব? আয়নার তো নিজস্ব আলো থাকার কথা নয়।

সে বারবার আয়নার দিকে তাকায়। প্রথমে নিজেকে দেখতে পায়, তারপর আবার সেই মুখটা—রুদ্র বসুর মুখ, কিন্তু যেন বদলে গেছে। চোখদুটো গভীর কুয়াশায় ঢাকা, ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু শব্দ নেই।

হঠাৎ, আয়নার ভিতরে আরও এক জোড়া চোখ ভেসে ওঠে। সেই চোখের চারপাশ কেবল আঁধার। আর সেই চোখদুটো যেন কাঁদছে। কিন্তু অশ্রু নেই, কেবল অভিমান।

ঋষভ মনে মনে বলে, “তুমি কে? রুদ্র? না আর কেউ?”

সেই মুহূর্তে আয়না নিভে যায়। আর এক ঝটকায় ঘরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে দ্রুত ডায়েরি খুলে লেখে—

“আয়নার মধ্যে সময় আটকে গেছে। আমি রুদ্রর মুখ দেখি, কিন্তু সে মুখ আমার দাদার নয়। ওই মুখটা যেন আরো পুরোনো—অচেনা, তবু চেনা। আরেকটি মুখ—নারীর—অশ্রুহীন চোখ, অথচ কান্না শুনতে পেলাম মনে।”

সকালবেলা সুবর্ণবাবুর বাড়িতে খাওয়া সেরে সে বেরোয় স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে। গ্রামের বয়স্ক একজন, মদনচাচা, তাকে ডেকে বলেন, “আপনি যা খুঁজছেন, তা খুঁজে পাবেন না কথায়। আপনার দাদা যে ঘরটায় গিয়েছিল, সেটা আগে শ্মশান ছিল।”

ঋষভ চমকে উঠে, “শ্মশান? অথচ এখন তো একটা কুঁড়েঘর!”

মদনচাচা হাসেন না, কাঁপা গলায় বলেন, “এই ঘরটা শ্মশানের ছাই দিয়ে বানানো। এখানেই এক সময় এক মেয়ে আগুনে পুড়ে মরেছিল। তার নাম ছিল কামিনী।”

“কামিনী? কে সে?”

“এক বিধবা মেয়ে ছিল। স্বামী না থেকেও মা হতে চেয়েছিল। গাঁয়ের লোক বলত—অলৌকিক ব্যাপার। কেউ কেউ বলত, সে নিজের মৃত স্বামীর আত্মাকে বশে আনতে চেয়েছিল। তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে। তার কাহিনি কেউ লিখে রাখেনি। সে নাকি এখনও সন্ধ্যার পর ঘুরে বেড়ায়—একটা গল্প বলার অপেক্ষায়।”

ঋষভ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায় সেই কণ্ঠস্বর—“আমার কাহিনি শুনবি?”

ঘরে ফিরে এসে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। এবার নিজেকে দেখতে পায়, কিন্তু তার চোখে ভেসে ওঠে এক নারীর ছায়া। সেই ছায়া বলতে থাকে—

“তুই কি পারবি শেষ করতে আমার গল্প? পারবি লেখার শেষটায় দিয়ে যেতে আমার মুখ?”

ঋষভ বলতে পারে না—হ্যাঁ বা না। শুধু ভাবে, যদি সেই মুখ কখনও দেখা যেত!

রাত বাড়তে থাকে। আয়না এবার কেবল ছবি দেখায় না—শোনাতে শুরু করে। ঘুমে-ঘুমে ঋষভ দেখতে পায় এক বিশাল শ্মশান, আগুন জ্বলছে, আর সেই আগুনের পাশে বসে এক মেয়ে—চুল এলোমেলো, চোখে অপার শূন্যতা। তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—

“ওরা আমাকে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার দোষ ছিল—আমি ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার গল্প কেউ লেখেনি। তুমি কি পারবে?”

ঘুম ভেঙে যায় ঋষভের। সে ঘামে ভিজে গেছে। ডায়েরিতে লেখে—

“এই গল্প, আমার দাদার নয়। এ গল্প তার, যার মুখ নেই ইতিহাসে, যার নাম নেই কোনও লেখায়। আমি তার লেখক। যদি শেষ করতে পারি…”

আরও একটা কথা মাথায় ঘুরতে থাকে—যদি সে কামিনীর গল্প লেখে, তবে রুদ্র কি ফিরে আসবে?

নাকি… তার আত্মা এখন সেই গল্পেরই অংশ হয়ে গেছে?

***

রাত গড়িয়ে ভোর হয়, কিন্তু ঘুম ছোঁয় না ঋষভকে। চোখের পাতায় ঘূর্ণি করে কামিনীর মুখ। মুখ, না বলা ঠিক হবে না—ছায়া। কারণ মেয়েটির কোনও স্পষ্ট মুখ নেই। এক ধরনের অস্পষ্টতা, যেন জলরঙে আঁকা এক ক্লান্ত আকৃতি। তবু তার চোখ, সেই দুটো চোখ—নির্বাক অথচ অনুরোধে ভরা।

ঋষভ ঠিক করে—সে আজ এক ধাপ এগোবে। কেবল পর্যবেক্ষক হয়ে থাকবে না, জেনে নেবে পুরোনো কাহিনির টুকরোগুলো, যদি পাওয়া যায় কোথাও।

সে হাঁটে গ্রামের পুরোনো প্রান্তের দিকে। যেখানে লোকে আর তেমন যায় না। সেখানে দেখা মেলে গঙ্গাধর পণ্ডিতের। বয়স আশির ঘরে, তবুও চোখে দৃষ্টি ঝকঝকে। একসময় গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়াতেন। এখন কেবল স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা।

ঋষভ জিজ্ঞেস করে, “কামিনী সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”

পণ্ডিত একটু চুপ করে বলেন, “এই নামটা এত বছর পরে কেউ জিজ্ঞেস করল? আশ্চর্য! অনেকে তাকে অপয়া বলে মনে করত, কিন্তু আমি জানি, সে অভিশপ্ত ছিল না—সে ছিল বঞ্চিত।”

“বঞ্চিত?”

“হ্যাঁ। সে ভালোবেসেছিল এক সেনানিকে। লোকটা তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল—ফিরে এসে বিয়ে করবে। ফিরে এসেছিল, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এসেছিল আরেকজন স্ত্রী। কামিনী তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল। কারো কথায় নয়—নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল শরীরে। আর সেই মুহূর্ত থেকেই সন্ধ্যার সময় গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে যায়।”

ঋষভ নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনে। মনে হয়—সেই আগুন এখনও জ্বলছে কোথাও। হয়তো নিজের ভেতরেই।

পণ্ডিত হঠাৎ থেমে বলেন, “তবে একটা কথা মনে রেখো। কামিনীর গল্প শোনার মানে হচ্ছে—তুমি তার সাক্ষী। সাক্ষী হলে নিঃসন্দেহে লিখতেই হবে। কিন্তু তার বিনিময়ে দিতে হবে কিছু। যাকে হারাও, তাকে ফিরে পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয়।”

এই কথা শুনে রক্ত হিম হয়ে যায় ঋষভের। ফিরে পেতে চায় সে—দাদাকে। কিন্তু ছাড়বে কী?

বিকেলে সে ফিরে আসে সেই কুঁড়েঘরের সামনে। আজ সে ভিতরে ঢোকে একা নয়—সাথে আনে রুদ্রর শেষ ডায়েরি। ভিতরে প্রবেশ করতেই বাতাস বদলে যায়। গন্ধ লাগে পুড়ে যাওয়া তুলসী পাতার। দেওয়াল এখনও আঁকা সেই মুখগুলো দিয়ে, কিন্তু আজ একটায় এক ফাটল দেখা গেছে—যেন কেউ ভিতর থেকে বাইরে আসার চেষ্টা করছে।

আয়নাটা এখনও সেখানে। সে আয়নার দিকে তাকাতেই ভেসে ওঠে এক দৃশ্য—রুদ্র, হাত পেতে কাঁপছে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ছায়ামূর্তি। দুজনেই কাঁদছে।

“আমি চাইনি,” রুদ্র বলছে। “তুমি তো আমার গল্প নও। তবুও তুমি এসেছ, ছায়ার মতো ঢুকে পড়েছ আমার মধ্যে।”

ছায়ামূর্তি উত্তর দেয় না, শুধু চোখের জল ফোঁটা হয়ে আয়নার কাচে গড়িয়ে পড়ে।

ঋষভ এবার প্রথমবার স্পষ্টভাবে বলে ওঠে, “আমি লিখব। কিন্তু আগে আমাকে বলো, শেষ কী হয়েছিল? কাহিনির শেষ পৃষ্ঠা কোথায়?”

সে মুহূর্তে কুঁড়েঘরের মেঝে ফেটে ওঠে। ভিতর থেকে এক পাথরের বাক্স বেরিয়ে আসে। সেটার ঢাকনা খুলতেই দেখা যায় একটা পুরোনো কাগজ, অর্ধেক জ্বলেছে, বাকিটা ছাই।

তাতে লেখা—
“আমার শরীর পুড়েছে, কিন্তু আত্মা নয়। আমি ফিরে আসব। যতদিন না কেউ আমার গল্পটা শেষ করে… আমি আলোতে ফিরতে পারব না।”

ঋষভ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের রঙ গাঢ় হচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে।

আর সেই সময়, কণ্ঠস্বরটা আবার ফিরে আসে।

“তুই যদি শেষ করতে পারিস, তবে আমি চলে যাব। কিন্তু যদি তোর কলম থেমে যায়… তোর জীবনও আটকে যাবে আমার সাথে।”

আকাশে হঠাৎ একটা বজ্রপাত, আর আয়নার কাচে ফুটে ওঠে একটি প্রশ্ন—
“তুই কি শেষ করতে পারবি?”

***

সন্ধ্যা যখন পায়ের পাতায় হেঁটে আসছে লালগ্রামে, ঠিক তখন ঋষভ বসে আছে কুঁড়েঘরের ভিতরে, হাতের মুঠোয় সেই ছাই-মাখা অর্ধেক চিঠি। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু একটানা শোনায় ঝিঁঝিঁর শব্দ, যেন তারা প্রাচীন শোকগাথা গাইছে।

সে চিঠির দিকটায় তাকিয়ে থাকে যেখানে শেষ লাইনটা পুড়ে গেছে। শব্দগুলো অস্পষ্ট, কিন্তু যেন বোঝা যায়—কামিনী ফিরে আসতে চায়নি, তাকে ডেকে আনা হয়েছিল। কার দ্বারা?

ঋষভ তার ডায়েরির পাতায় লেখে,
“গল্পটা কেবল কামিনীর মৃত্যু নয়। গল্পটা সেই প্রতিশ্রুতির, যা ভাঙলে মৃত্যু শান্তি দেয় না। এবং সেই মৃত্যু ফিরে আসে গল্প হয়ে—শ্রুতিহীন, মুখহীন, অথচ জীবন্ত।”

ঠিক তখনই কুঁড়েঘরের মেঝের ছাই একটু সরে গিয়ে উঁকি দেয় কিছু—একটা ক্ষুদ্র ঘুঙুর। বহু পুরনো, তবু চকচকে। ঋষভ সেটা তুলতেই শুনতে পায় দূর থেকে ঘুঙুরের শব্দ। কেউ কি নাচছে?

সে বাইরে বেরিয়ে আসে। গ্রামের রাস্তা তখন আর আগের মতো নয়। বাতাসটা ভারি, গন্ধটা ঘামে ভেজা শরীরের, আগরবাতির, পুড়ে যাওয়া ফুলের। আর একটা কুয়াশা ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে পথকে।

ঘুঙুরের শব্দটা বাড়ছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচে থেকে উঠে আসছে এক ছায়া—লম্বা, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।

ঋষভ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মনে হয় সে কথা বলল না, তবু তার ভিতরের কণ্ঠস্বর বাইরে এসে প্রশ্ন করে,
“তুমি কি কামিনী?”

ছায়াটা থেমে যায়। তারপর একটা কণ্ঠস্বর, স্পষ্ট, স্তব্ধতার মধ্যে খসখসে শব্দে বলে ওঠে,
“কামিনী বলেছিলাম আমিই। কিন্তু তুই জানিস না, আমি কে ছিলাম তার আগে। আমি নামহীন, পরিচয়হীন এক সুর। আর আমার জীবনটা ছিল নিষিদ্ধ।”

ঋষভ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে সেই ছায়ার দিকে। এখন আর ভয় নেই, বরং এক অদ্ভুত টান। সে জিজ্ঞেস করে, “তোমার গল্পটা কোথা থেকে শুরু করবো?”

ছায়াটা বলে, “যেখান থেকে গল্প কেউ লেখে না—যেদিন আমি প্রেমে পড়লাম।”

এক মুহূর্তের জন্য দৃশ্য বদলে যায়। ঋষভ দেখে এক ভাঙা মন্দির, বিকেলের আলোয় দাঁড়িয়ে এক তরুণী, চোখে খুশির ছায়া। পাশে দাঁড়িয়ে এক যুবক, সেনার পোশাকে। দু’জনের হাত একসঙ্গে। কণ্ঠস্বর বলে, “সে বলেছিল ফিরে এসে আমায় বিয়ে করবে। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। সেদিন আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম ওর নামে, যেখানে লিখেছিলাম—‘যদি না ফিরে আসো, আমি আগুন হয়ে যাব।’”

ছবিটা মিলিয়ে যায়। আবার আসে ছায়া।

“সে ফিরেছিল, কিন্তু সঙ্গে এনেছিল আরেকজন স্ত্রী। তখনও আমি মা হওয়ার অপেক্ষায়। গ্রাম আমাকে অভিশাপ দিল। আর আমি নিজেকে আগুনে দিয়ে দিলাম।”

ঋষভ চুপ করে শোনে। গলা শুকিয়ে গেছে। ছায়া এবার একটু কাছে এসে বলে,
“তুই লিখছিস, কারণ তোর দাদা লিখেছিল। কিন্তু ও থেমে গিয়েছিল। ওর ভেতরে আমি ঢুকে গিয়েছিলাম। ও নিজেই আর নিজের ছিল না। তোর কি মনে হয়, তুই পারবি?”

ঋষভ ধীরে মাথা হেঁট করে। বলে, “আমার ভয় করে, তবু আমি লিখব। কিন্তু দাদা…?”

ছায়া তখন ফিসফিস করে বলে,
“ওর শরীর গেছে, মন গেছে, কেবল শব্দগুলো আটকে রয়েছে। যদি তুই লিখতে পারিস, তোর কলম যদি আমার কাহিনির শেষ শব্দটা জানে, তবে আমি যাব। আর ও ফিরবে।”

ঋষভ ফিরে আসে কুঁড়েঘরে, সেই ছাই-ঢাকা ঘরে। সামনে আয়না, পাশে রুদ্রর পুরনো খাতা। সে কলম তোলে। খাতার একদম শেষ পাতায় লেখে—
“একটা গল্প যখন অসম্পূর্ণ থাকে, তখন লেখক একা নয়, আত্মাও অপেক্ষা করে কলমের নিচে শেষ শ্বাস ফেলতে। এবার শুরু করব… কামিনীর কাহিনি।”

আয়নার কাচে হঠাৎ এক নতুন শব্দ ভেসে ওঠে—
“তুই আমার সত্যিই লেখক হবি?”

***

ঋষভ লিখতে বসেছে। বাইরে কুয়াশা জমেছে গলা অবধি। রাত ঠিক যেন জমে আছে পাথরের মতো ভারি। কুঁড়েঘরের ভিতর বাতাস নেই, অথচ দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে এক অদৃশ্য স্পন্দন। তার কণ্ঠে না আছে রক্তমাংস, না আছে শব্দ—তবুও সেই উপস্থিতি হাড়ে হাড়ে শোনা যায়।

খাতার প্রথম পাতায় ঋষভ লিখে—
“এই গল্প এক মেয়ের, যে ভালোবেসেছিল নিষিদ্ধভাবে। যার প্রেমকে ইতিহাস স্থান দেয়নি। আর তার নাম—কামিনী। হ্যাঁ, সেই নামই, যার উচ্চারণে আগুন জ্বলে ওঠে।”

ঠিক তখনই কুঁড়েঘরের আলো নিভে যায়। শুধু আয়নাটার কাচে ভেসে ওঠে আগুনের রেখা। শব্দ শোনা যায়, যেন দূরে কোথাও কাঠ পোড়াচ্ছে কেউ। ঘরের গন্ধ বদলে যায়—কাঠকয়লা, আগরবাতি, আর নারীর চুলের পোড়া গন্ধ।

ঋষভ থামে না। লিখতে থাকে।
“কামিনী জন্মেছিল এমন এক ঘরে, যেখানে নারী মানে ছিল বোঝা। কিন্তু ওর চোখে ছিল আগুন, আর ঠোঁটে ছিল নিজের গল্প বলার আগ্রহ। সে ভালোবেসেছিল রণজয় নামে এক সেনাকে—যে তাকে বলেছিল, এই যুদ্ধ শেষ হলে সে ফিরবে, বিয়ে করবে।”

অদ্ভুতভাবে আয়নার কাচে রণজয়ের মুখ ফুটে ওঠে। সুন্দর, তীক্ষ্ণ, অথচ চোয়ালে কেমন যেন একটা দ্বিধা।

ঋষভ লিখে,
“রণজয় ফিরেছিল। কিন্তু সঙ্গে এনেছিল আরেকজন স্ত্রী। কামিনীর গর্ভে তখন রণজয়ের সন্তান। সে গ্রামবাসীর কাছে অপয়া, পাপিনীর তকমা পেল। তখন রাত্রি ছিল, পূর্ণিমা। কামিনী নিজেই আগুন জ্বালিয়ে ঢুকে পড়েছিল ভিতরে।”

ঠিক তখন ঘরের মেঝে কেঁপে ওঠে। ছাইয়ের স্তূপের নিচে থেকে বেরিয়ে আসে একটা হাতের ছাপ, যেন কেউ কবর থেকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ঋষভ ভয় পায় না। এবার সে জানে, এ কাহিনি লিখে শেষ করতে হবে। কারণ প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ একরকম মুক্তির পথ।

সে লেখে,
“কামিনী মরে যায়নি। সে গল্প হয়ে উঠেছিল। যে গল্প লেখা হয়নি, সে থেকে যায় ঘুরে বেড়াতে বাতাসে, ছায়ায়, আয়নায়। সেই গল্প খুঁজছিল এক লেখক, রুদ্র। আর সে হারিয়ে গিয়েছিল এই কাহিনির ভিতর। এখন তার ভাই লেখে…”

ঋষভ থেমে যায়। তার কলমটা গরম হয়ে গেছে। যেন শব্দগুলো আগুনের স্পর্শে তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ পেছনে এক ফিসফিস শব্দ—
“তুই আমার নাম লিখেছিস। এখন তোর ভেতর আমি ঢুকব। কারণ নাম জানার মানে শুধু পরিচয় নয়, দায়ও। তুই কি নেবে?”

ঋষভ ধীরে আয়নার দিকে তাকায়। এবার সে নিজের মুখের মধ্যে দেখতে পায় আরেক মুখ—কামিনীর মুখ। কপাল জ্বলছে, ঠোঁটে রক্তের রেখা, কিন্তু চোখে কৃতজ্ঞতা।

“আমি লিখব,” বলে সে। “তবে শর্ত একটাই—আমার দাদাকে ফিরিয়ে দাও।”

আয়নার কাচে এবার এক নতুন মুখ—রুদ্র। মুখে ক্লান্তি, চোখে প্রশান্তি। সে বলে না কিছু, শুধু মাথা নাড়ে।

ঠিক তখনই আয়নার ভিতরে আলোর রেখা ভেঙে পড়ে। ঘরের ভিতর যেন ঝড় বয়ে যায়। কাঁপে দেওয়াল, ছিটকে পড়ে পুরনো বাক্স। এক মুহূর্তে সব নিস্তব্ধ।

ঋষভ মাথা তোলে। ঘর আগের মতো, আয়নাটা ফেটে গেছে। কিন্তু কোণার দিকে বসে আছে কেউ—একজন মানুষ, নিঃশ্বাস নিচ্ছে ভারীভাবে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না পুরো। কিন্তু ছায়াটা বলে দিচ্ছে—সে ফিরে এসেছে।

রুদ্র।

***

ঘরের কোণে বসে থাকা মানুষটার নিঃশ্বাস তখনও ভেঙে ভেঙে আসছে। শরীর নড়ছে ধীরে, মাথা নিচু। বাতাসে এক ধরনের গন্ধ—না ঠিক মানুষজনের, না ঠিক মৃতদের। কুঁড়েঘরের প্রতিটি কোণ যেন সেই নিঃশ্বাসের ভারে ভারাক্রান্ত।

ঋষভ ধীরে এগিয়ে যায়। বলে, “দাদা…?”

মাথাটা উঠে আসে, ধীরে। চোখে জ্যোতি নেই, কিন্তু চেনা। মুখ শুকিয়ে গেছে, চুল এলোমেলো। চোখজোড়া লাল, যেন বহুদিন ঘুমায়নি। ঠোঁট কাঁপে।

“ঋষু?” রুদ্রের গলা যেন ভেসে আসে অনেক দূর থেকে, কুয়াশার ঘন সীমানা পেরিয়ে।

ঋষভ ছুটে যায়। জড়িয়ে ধরে। শরীর ঠান্ডা, অথচ স্পন্দন আছে।
“তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?”

রুদ্র কাঁপা গলায় বলে, “আমি কোথায় ছিলাম বলতে পারব না। আমি ছিলাম… কোথাও, যেখানে গল্পগুলো লেখা হয়নি, কেবল অনুভব করা যায়। আমি হাঁটতাম, কাঁদতাম, আর শুনতাম। কামিনী আমায় গল্প শোনাত, আবার থামিয়ে দিত। বলত—যদি শেষ না করতে পারো, তুমি থাকবি আমার ভেতর।”

ঋষভ জিজ্ঞেস করে, “তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেছো? নাকি…?”

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তুই লিখেছিস বলেই এসেছি। তোর কলম আমায় পথ দেখিয়েছে।”

ঋষভ এবার বুঝতে পারে—এই ফিরে আসা শরীরের নয়, শব্দের। এই প্রত্যাবর্তন শেষ নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু।

রুদ্র বলে, “কিন্তু তুই থামবি না, বুঝলি? কামিনী এখনও পুরোটা বলেনি। তুই লিখবি, যতক্ষণ না গল্পটা সত্যি শেষ হয়।”

ঋষভ মাথা নাড়ে। দুই ভাই এবার একসঙ্গে কুঁড়েঘরের মাঝখানে বসে। বাতাস থেমে থাকে। যেন অপেক্ষা করছে।

ঠিক তখনই মেঝের ছাই আবার নড়ে ওঠে। একটা পাতলা কাগজ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। দুজনেই তাকিয়ে দেখে—তাতে লেখা—

“তৃতীয় মুখের খোঁজ করো। ও-ই বলবে শেষ বাক্য।”

ঋষভ জিজ্ঞেস করে, “তৃতীয় মুখ? তাহলে দ্বিতীয় কে? আমি?”

রুদ্র মাথা নাড়ে, “না। আমি। তুই লেখক। কিন্তু ছিল আরও একজন। যে কামিনীর মৃত্যুর দিন ছিল সেখানে। যার মুখ কেউ কোনোদিন লেখেনি।”

ঋষভ তখন ভাবে—এই গল্পে তো রণজয়ও ছিল, সেই সেনা। তবে কি সে? নাকি কেউ আরও?

বাইরের বাতাস হঠাৎ ভারি হয়ে যায়। দূরে এক ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসে। যেন মন্দির নয়, বরং সময়ের ধ্বনি। আয়নার ভাঙা টুকরো একটায় আবার ভেসে ওঠে ছায়ামূর্তি। এবার তার মুখ স্পষ্ট—রণজয়।

রণজয় বলে,
“আমি কামিনীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। রাখিনি। ফিরে এসে পালিয়ে গেছিলাম। ওর মৃত্যুর পর আমি চোখে চোখ রাখতে পারিনি নিজের। আমি নিজের মুখটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন আমি চাই, কেউ সেই মুখটা লেখায় তুলে রাখুক।”

ঋষভ জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি চাও ক্ষমা?”

রণজয় থেমে বলে, “ক্ষমা নয়। আমি চাই কামিনীর নামের পাশে আমার নামও লেখা হোক। যেন ভবিষ্যতে কেউ জানে, ভালোবাসা শুধু আগুন নয়—কখনও কখনও ছাইও কথা বলে।”

ঋষভ চেয়ে থাকে আয়নার দিকটায়। নিজের ভেতর কলমের শব্দ অনুভব করে। সে জানে, এবার গল্পটা তিনজনের। কামিনী, রণজয়, আর সেই মানুষ—যে লিখছে।

ঠিক তখনই এক অদৃশ্য হাত, ভাঙা কাচের ওপর দিয়ে লেখে—
“শেষ অধ্যায়ের দরজা খুলছে…”

***

ঋষভের সামনে আয়নার ভাঙা টুকরোগুলো ধীরে ধীরে স্থির হয়ে আসছে। যেন অদৃশ্য শক্তি কোনো ছবি জোড়া দিতে চাইছে, সময়কে একটা শেষ রূপ দিতে চাইছে। আয়নার প্রতিফলনে রুদ্র বসে আছে শান্তভাবে, কিন্তু চোখদুটি গভীর, যেন এখনো কোথাও আটকে আছে।

রুদ্র বলে, “তুই জানিস, আমি ফিরেছি ঠিকই। কিন্তু আমার কিছু অংশ এখনো ওর সঙ্গে, কামিনীর সঙ্গে। আমি তখনকার মতো চলে এসেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়।”

ঋষভ চমকে ওঠে, “মানে? তুই তো…”

“আমি একটা শর্তে ফিরেছি,” রুদ্র বলে। “যদি তুই গল্পটা শেষ করতে পারিস, তবে আমি পুরোপুরি ফিরব। যদি না পারিস, আমার আত্মা আবার ফিরবে সেই কুঁড়েঘরে। কামিনীর ছায়ার পাশে।”

ঋষভ বুঝতে পারে—এই লেখা আর শুধুই কাহিনি নয়, এটা সময় আর অস্তিত্বের যুদ্ধ। এখন সে যেটুকু লিখবে, তা শুধু এক অলৌকিক ঘটনার নথি নয়, বরং এক আত্মার মুক্তি, এক অপরাধীর অনুশোচনার চিহ্ন।

সে আবার খাতায় লেখে—
“রণজয় ফিরেছিল, কিন্তু কামিনীকে চিনতে পারেনি। সেই সন্ধ্যা, যখন পুরো গ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায়, কামিনী শেষবারের মতো তাকিয়ে ছিল তার দিকেই—কিন্তু প্রেমে নয়, বিদায়ে। যে আগুন ও নিজেই জ্বালিয়েছিল, তা কোনো অভিশাপ ছিল না। ওর ছিল শেষ ক্ষমা।”

ঘরের ভিতর তখন আর আগের মতো নেই। বাতাস ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসছে। আয়নার ভাঙা কাচে একে একে ফুটে উঠছে নাম—কামিনী, রণজয়, রুদ্র।

তারপর সেই কণ্ঠস্বর—যে প্রথম দিন বলেছিল, “আমার কাহিনি শুনবি?”—ফিরে আসে। এবার তার আওয়াজ স্পষ্ট, শান্ত।

“তুই লিখেছিস। তুই শুনেছিস। আর তুই বিশ্বাস করেছিস। এখন সময় এসেছে আমায় বিদায় জানানোর।”

ঋষভ চোখ বুজে বলে, “তুমি কি শান্তি পাবে?”

“যদি কেউ আর আমার নাম শুনে ভয় না পায়, যদি কেউ জানে আমি অপয়া ছিলাম না, ভালোবাসার এক ভিন্ন রূপ—তাহলে হ্যাঁ, আমি যেতে পারি। আগুন আর ছায়া তো স্থায়ী নয়। লেখা হলে, তারা সময়ের ভিতরে গলে যায়।”

ঘরের কোণ থেকে ধোঁয়ার মতো এক আলোর রেখা উঠে যায় ছাদে। আয়নার কাচ এক এক করে গলে পড়ে মাটিতে। আর রুদ্র উঠে দাঁড়ায়, এবার চোখ দুটো স্পষ্ট, উজ্জ্বল।

সে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই আমায় ফিরিয়ে এনেছিস। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা—তুই ওকে মুক্তি দিয়েছিস।”

ঋষভ জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এবার কী হবে?”

রুদ্র হেসে বলে, “তুই শেষ কর, পুরো গল্পটা। এরপর আমরা ফিরে যাব। লালগ্রাম এবার আর সন্ধ্যায় ভয় পাবে না। কারণ, কেউ আর ফিরে আসবে না। কেউ আর অপেক্ষায় থাকবে না।”

কুঁড়েঘরের দরজাটা তখন হালকা খোলা। বাইরে এক ঝলক হাওয়া, হালকা সূর্যের শেষ আলো। আর কোথাও নেই সেই কুয়াশা, সেই অদ্ভুত গন্ধ। কামিনীর গল্প এবার ছাপার অক্ষরে ধরা পড়তে চলেছে।

আর হয়তো, একদিন, এই গল্প পড়বে কেউ, যার চোখে ভয় নয়—কথা থাকবে, সাহস থাকবে, আর থাকবে ছায়ারও প্রতি মমতা।

***

লালগ্রামের বাতাস এখন বদলে গেছে। সন্ধ্যা নামে ঠিকই, কিন্তু আগের মতো নয়। আর আগুনের গন্ধ নেই, কুয়াশার আড়ালে কান্নাও নেই। তবুও ঋষভ জানে—গল্প এখনো পুরো শেষ হয়নি। কারণ প্রতিটি লেখা তখনই শেষ হয়, যখন পাঠক তাকে মেনে নেয়।

রুদ্র এখন পুরোপুরি ফিরে এসেছে—চোখে জ্যোতি, কথায় ভার। তবে মাঝে মাঝে সে চুপ করে যায়, তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, যেন কারও উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানায়।

ঋষভ নিজের খাতায় শেষ অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে চলে। লেখে—
“কামিনী এক অদ্ভুত উদাহরণ। তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তার গল্পটুকু কেউ ছাই করতে পারেনি। যে ভালোবাসে, সে মরলেও থেকে যায় তার কথার ভেতর। কামিনীর কাহিনি কেবল এক নারীর নয়, বরং সমস্ত না-বলা কথার, সমস্ত দমিয়ে রাখা ভালোবাসার, যার জায়গা হয়নি কোনো ইতিহাসে।”

সে যখন লিখে চলে, তখন দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায় সুবর্ণবাবু। হাতে নিয়ে আসেন একটা পুরোনো কাগজ। বলেন, “এটা পাবে বলে রেখে দিয়েছিলাম। রুদ্র যেদিন গিয়েছিল, তার আগের দিন আমার হাতে এটা দিয়েছিল। বলেছিল, যদি ফিরে না আসে, তুই যেন এটা পান।”

ঋষভ কাগজটা খোলে। লেখা—

“যদি ফিরে আসি, আমি তো বাঁচবই। আর যদি না আসি, তবে জানিস—আমি হারাইনি, বরং খুঁজে পেয়েছি সেই গল্প, যেটা আমায় মানুষ করে তুলেছে। কামিনী ছিল ছায়া নয়, আলো। তুই যদি সত্যি লেখক হবি, তবে ওর গল্পটা শেষ কর।”
—রুদ্র বসু

ঋষভ কিছুক্ষণ ধরে চুপ করে থাকে। তারপর লেখে—

“আমি লেখক হইনি গল্প লিখে। আমি লেখক হয়েছি অন্যের কাহিনি শুনে, বুঝে, এবং তা লিখে তাকে মুক্তি দিয়ে। কামিনী এখন আর অলৌকিক নয়। সে এখন নাম, ইতিহাস, আর ভালোবাসার উত্তরাধিকার।”

রাত বাড়ে। দুই ভাই খাতার চারপাশে বসে থাকে। কুঁড়েঘরটা এবার আর গা ছমছমে নয়—বরং শান্ত, আলোয় ভরা। ঘরের কোণ থেকে আয়নার শেষ টুকরোটা পড়ে থাকে, নীরব, নিস্তব্ধ।

রুদ্র সেটা হাতে তুলে বলে, “তুই জানিস, এখন আর কেউ সন্ধ্যার পর ভয় পাবে না। কারণ ভয় তখনই থাকে, যখন কেউ অবুঝ থাকে। এখন তো সবাই জানবে, কামিনী কে ছিল। কেন সে ফিরে আসত, কেন সে আর আসবে না।”

ঋষভ জিজ্ঞেস করে, “তুই কি আবার লেখবি?”

রুদ্র হাসে, “লিখব। তবে এইবার নিজের গল্প। কারণ আমি বুঝেছি, গল্প লেখা মানে শুধু কল্পনা নয়। এটা দায়িত্ব। এক জীবনের, এক মৃত আত্মার, এক কথার—যা না বলা ছিল এতদিন।”

আকাশে তারারা উঠছে। কুঁড়েঘরের দরজাটা একটানা খোলা থাকে। বাইরে বাতাসে ভেসে আসে একটা স্বর, খুব মৃদু—
“ধন্যবাদ…”

সে স্বর কার, জানা যায় না। তবু জানে ঋষভ—এবার সত্যিই কেউ চলে গেছে।

***

একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামলে লালগ্রাম নিঃশব্দ হয়ে যেত। ঘর বন্ধ করে দিত সবাই, বাতি নিভিয়ে ফেলত। যেন কেউ এসে ঢুকে পড়বে চৌকাঠ পেরিয়ে, শ্বাস ফেলবে ঘাড়ের ওপর, ছায়া হয়ে জড়িয়ে ধরবে।

কিন্তু আজ সন্ধ্যায় ঋষভ হাঁটছে সেই রাস্তায়, যেখানে একসময় তার দাদা হারিয়ে গিয়েছিল। তার পাশে রুদ্র, যার চোখে এখন ক্লান্তি নেই, বরং গভীর প্রশান্তি।

আজ তারা শেষবারের মতো ঢুকছে কুঁড়েঘরে। ঝড় থেমেছে, বাতাস নরম, আলো কেমন ঝলমলে। মেঝেতে পড়ে থাকা ছাই ঝড়ে উড়ে গেছে। শুধু একটা জিনিস বেঁচে আছে—একটা আয়নার ফ্রেম, যার কাচ নেই, তবু তার ভেতর এখন আর কাউকে দেখা যায় না। শূন্যতা কখনও কখনও সম্পূর্ণতার চিহ্ন হয়ে থাকে।

ঋষভ সেই ফ্রেমটা হাতে তুলে নেয়। ভাবে, “তোমার প্রতিচ্ছবি এখন নেই, কারণ তোমার গল্পটা এখন ইতিহাস। তোমার মুখ আর দেখতে হবে না, কারণ এখন আমরা জানি তুমি কে।”

রুদ্র বলে, “তুই জানিস, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমি ফিরে এসেছি। মনে হচ্ছে যেন এক দীর্ঘ ঘুম কাটিয়ে উঠলাম।”

ঋষভ মৃদু হেসে বলে, “কারণ তুই শুধু ফিরিস না, তুই ফিরেছিস সম্পূর্ণ হয়ে। এখন তোর কথায় কল্পনা নয়, অভিজ্ঞতা।”

রুদ্র এবার ছুঁয়ে দেখে কুঁড়েঘরের দেওয়ালে আঁকা মুখগুলো। একসময় যেগুলো নড়ত, কাঁদত, তারা এখন স্থির, শান্ত। যেন সেই ছায়াগুলো তাদের নিজস্ব আকাশে ফিরে গেছে।

বাইরে নীলচে আকাশ। তারার আলোয় লালগ্রামের পথরেখা জ্বলজ্বল করছে। ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দুই ভাই দেখল—একদল বাচ্চা খেলছে সন্ধ্যাবেলায়। আগে যা ছিল অশুভ সময়, এখন তা যেন এক নতুন জীবনের শুরু।

সুবর্ণবাবু হাঁটতে হাঁটতে এসে বলেন, “তোমরা বদলে দিয়েছো সময়কে। এই গল্পটা একদিন আমার নাতি-নাতনিরাও পড়বে। আর তারা জানবে—যে ছায়া ভয়ের ছিল, সে আসলে কেবল শোনা চেয়েছিল।”

ঋষভ উত্তর দেয় না। সে শুধু ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—
“গল্পটা শেষ হলো না। কারণ কামিনী শুধু একজন নয়। তার মতো হাজারো নাম, হাজারো না-বলা কথা আছে এই সমাজে, এই বাতাসে। আমি শুধু একটাকে শুনেছিলাম। লিখেছিলাম। আর তাতেই হয়তো মুক্তি এসেছে কোথাও।”

শেষ লাইনের নিচে সে লেখে তার নিজের নাম। তার পর লিখে—

“সন্ধ্যার পর এখন আর কেউ আসে না। কারণ, সে যে এসেছিল, তার কথা শুনে গেছে কেউ।”

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে দুই ভাই হাঁটা দেয় গ্রামের মূল রাস্তার দিকে। আকাশে তখন পূর্ণিমার আলো। মৃদু বাতাস বইছে। আর পেছনে পড়ে থাকে সেই কুঁড়েঘর—একটা সময়, একটা কাহিনি, এক আত্মার দীর্ঘ অপেক্ষার ঠিকানা।

আজ সে অপেক্ষা ফুরিয়েছে।

 

****

1000018246.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *