মায়া মুখোপাধ্যায়
পর্ব ১: অদৃশ্য কালি
রাত সাড়ে বারোটার পর কলকাতার গলিগুলো এমন এক শ্বাসে ঢুকে পড়ে, যাকে আলাদা করে বোঝানো যায় না— যেন শহরটা এক বিশাল ঘড়ির কেসিং, ভেতরে অদেখা গিয়ারেরা ধীরে ধীরে ঘোরে, আর প্রতিটি ক্লিকের মাঝে কোথাও একটুখানি অন্ধকার জমে ওঠে। সেই অন্ধকারে পায়ের শব্দ মিশিয়ে দ্রুত হাঁটছিল শায়ন্তনী সেন— শহরের ছোট্ট এক সংবাদমাধ্যমের ক্রাইম রিপোর্টার। এক ঘণ্টা আগেই তার কাছে এসে পৌঁছেছে একটি অদ্ভুত খাম— কোন প্রেরকের নাম নেই, শুধু টপাটপ করে বসানো তিনটি কালো ডট, যেন কেউ ইচ্ছা করে বাকিটুকু গিলে ফেলেছে। খামের ভেতরে একটিই কাগজ, তাতে মাত্র এক লাইন: “ঘরের নিশ্বাস শুনতে পেলে বুঝবে তুমি একা নও।” আর নিচে সময়— ০০:৪৭— আর জায়গা— কাঁকুড়গাছি, ১৭/বি, দ্বিতীয় তলা। অবাক হওয়ার বিষয়, সেই লাইনটা তিন সেকেন্ড দেখেই মিলিয়ে গেল, শুধু হালকা লবণের গন্ধ রেখে। অদৃশ্য কালি? না, যেন চোখের সামনেই শব্দগুলো বাতাসে ভেঙে ছাই হয়ে উড়ে গেল। এতদিন বহু হুমকি চিঠি পেয়েছে শায়ন্তনী, কিন্তু এমন প্রবঞ্চক কালি আগে কখনও দেখেনি।
যেখানে পৌঁছল, সেটা পুরোনো এক তিনতলা বাড়ি— জানালার কাচে জং ধরা গ্রিল, সিঁড়ির ধাপে গন্ধ ওঠা শ্যাওলা। নিচতলার দারোয়ান নেই, চৌকি ফাঁকা; মাত্র একটা বাতি ঝুপঝাপ করে জ্বলছে। দ্বিতীয় তলায় ওঠার মুখেই সে শুনল, খুব ক্ষীণ একটা শব্দ— যেন দূরের ঘরে কেউ ধীরে ধীরে শ্বাস টানছে, আর ছাড়ছে। মানুষ হলে চেনা যেত, এই শ্বাসে এক অনভ্যস্ত যন্ত্রের মতো যান্ত্রিকতা, তবু মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো কাঁপুনি। ১৭/বি ফ্ল্যাটের দরজা আধখোলা। শায়ন্তনী ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শ্বাসের শব্দ থেমে গেল। ঘর একেবারে ফাঁকা, মাঝখানে শুধু একটি টেবিল— তার উপর কাঁচের জার, জারের ভেতরে রাখা হলদেটে জল আর জলের মধ্যে ভাসছে কালো কিছু— আকারে ক্ষুদ্র, যেন কুঁচকে যাওয়া কালি-ফোটা। দেওয়ালে একটাও ছবি নেই, কিন্তু সারা ঘরজুড়ে চকের আঁচড়ে আঁকা বৃত্ত— তিনটি বৃত্ত পাশাপাশি, আর প্রতিটি বৃত্তের কেন্দ্রে কলকব্জার মতো ছোট ছোট ক্রসচিহ্ন। বৃত্তগুলোর একপাশে লেখা: ৩-৭-১১। অন্যদিকে: দেখলে, নিঃশব্দে বেরিয়ে যাও।
শায়ন্তনী আঁচ পেল— এই ফাঁকা ঘরটা আসলে ফাঁকা নয়। কোথাও একটা যন্ত্র চলছে— চোখে পড়ছে না, কিন্তু সারা শরীরে তার মৃদু গুঞ্জন টের পাওয়া যাচ্ছে। টেবিলের পাশে ঝুঁকে জারের ঢাকনা খুলতেই হালকা মাছের মতো গন্ধ উঠল— অথচ এই বাড়ির আশেপাশে কোনও বাজার নেই, রাতও গভীর— কোথা থেকে এই গন্ধ? হঠাৎ, তার ফোনের স্ক্রিনে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা নোটিফিকেশন— কোনো অ্যাপ নাম নেই, শুধু কালো পর্দায় সাদা অক্ষর: ০০:৪৭। সেই একই সময়, যা চিঠিতে ছিল। স্ক্রিন কালো হয়ে গেল। পরক্ষণেই আলোর মতো ঝলক— ঘরের মাঝিক্কানে বাঁদিকের বৃত্তের ভিতরে হালকা ছায়া নড়ে উঠল। শায়ন্তনী টর্চের আলো সেই বৃত্তে ফেলতেই শুকনো কাগজের মতো একটা শব্দ— ক্রিঞ্চ! — আর মেঝের এক টালি সামান্য দেবে গিয়ে আবার উঠে এল, যেন নিচে কিছু চাপা পড়ে আছে আর শ্বাস নিচ্ছে।
“কে?” শায়ন্তনী স্বাভাবিক গলায় ডাক দিল। তার নিজের কণ্ঠই যেন এই ঘরের ভেতর গিয়ে একটু বদলে গেল— প্রতিধ্বনির মতো নয়, তবে টোনালিটির কোথাও এক অচেনা রুক্ষতা। কোনও উত্তর নেই। শুধু টেবিলের জারের জলটা ধীরে ধীরে ঘূর্ণির মতো ঘুরতে শুরু করল, যেন কেউ ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। শায়ন্তনী তৎক্ষণাৎ জারটা তুলে আলোয় আনতে যাবে, এমন সময় দরজার দিক থেকে পায়ের টুপটাপ— খুব ধীর, কিন্তু পাকা। সে ঘুরে দাঁড়াতেই দরজায় দেখা গেল মধ্যবয়স্ক এক মানুষ— কাঁধে পুরোনো নীল জামা, চোখে লালচে চশমা, গালে কাঁচা-পাকা দাড়ি। তিনি হালকা হাসলেন, বললেন, “এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন? আপনাকে তো ভাবার সময় দিতে চেয়েছিলাম।”
শায়ন্তনী সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে? এই খামটা কে পাঠিয়েছে?” লোকটা দরজার চকচকে কপাটে হেলান দিয়ে বলল, “খাম? আমরা তো এখন খামের যুগে নেই। আপনি যে অক্ষরগুলো দেখেছেন, সেগুলো দেখতে নয়, শুনতে— বোঝেন তো? অক্ষরেরও নিশ্বাস থাকে। আপনি যদি শোনেন, বুঝবেন, কীভাবে কালি অদৃশ্য হয়।” শায়ন্তনী এগিয়ে গেল এক পা। “আপনি কি আমাকে এখানে ডেকেছেন?” লোকটা মাথা নাড়ল— “ডেকেছি, আর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, আপনি কেন এলেন? এই শহরে প্রতিদিন দশটা খুনের খবর পড়ে, আপনি কি তাতে যান? না। তাহলে এই ফাঁকা ঘরের প্রতি এতো টান কেন?” সে স্তব্ধ। স্বীকার করতেই হবে, এই ডাকটা নিছক হুমকি ছিল না; ছিল এক ধরণের কৌতুক আর চ্যালেঞ্জ, যা তাকে টেনেছে।
লোকটা বলল, “আমার নাম আকাশেশ মিত্র। পেশায়, আপনি আমাকে গবেষক বলতে পারেন। শহরের পুরোনো ঘর, পুরোনো যন্ত্র আর তাদের স্মৃতি নিয়ে কাজ করি। এই ঘরে একটি স্মৃতি আটকে আছে। আপনি সেটাকে মুক্ত করতে পারবেন— যদি ঠিক শুনতে পারেন।” শায়ন্তনী টেবিলের জারের দিকে ইশারা করল, “ওটা কী?” আকাশেশ চাপা স্বরে বলল, “ওটা কালি— যাকে একসময় এই শহরের কয়েকজন লোক ‘শুনে’ লিখতেন। রেকর্ডিংয়ে কণ্ঠ যেমন ধরা পড়ে, ও কালি অক্ষরের নিশ্বাস ধরে। তারপর একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়— কিন্তু মুছে যায় না। শুধু ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করে।”
ঘরের বাতাস আরও ঘন হয়ে উঠছে। দূরে কোথাও ট্রামের ঘণ্টা— কিন্তু এখানে পৌঁছতে পৌঁছতে সেটা যেন সুর বদলে ফেলে। শায়ন্তনী বৃত্তগুলোর দিকে একবার তাকাল। ৩-৭-১১— তার মাথায় সংখ্যাগুলো ক্লিক করল— এগুলো কি ফ্রিকোয়েন্সি? তিন হার্টজ, সাত, এগারো? না, তেমন হলে শোনা যেত না। তার মনে পড়ল, পুরোনো ক্যালেন্ডারের তারিখ? তিন, সাত, এগারো— অদ্ভুত তিনটি দিন? আকাশেশ বলল, “আপনি যদি এই জারের জলটা বামদিকের বৃত্তে একফোঁটা ফেলেন, ঘরটা কথা বলবে। তবে সতর্ক থাকবেন— ঘরের কথা মানুষকে ডাকে। সব ডাকে সাড়া দেওয়া ভালো নয়।”
এমন সময় দুর থেকে করিডোরে এক নারীকণ্ঠ— খুব ধীর, ভেঙে যাওয়া কাঁচের মতো— “মিত্তা… মিত্তা… মিত্তা…” শায়ন্তনী চমকে আকাশেশের দিকে তাকাল। লোকটা নিরুত্তর। কণ্ঠটা আবার এল, এবার আরও কাছে, কিন্তু যেন ফ্ল্যাটের দেয়াল ভেদ করে সোজা বামদিকের বৃত্তে এসে থামল। শায়ন্তনী জার তুলে নিল। আকাশেশ নরম স্বরে বলল, “একফোঁটা যথেষ্ট।” শায়ন্তনী জার থেকে একটা ফোঁটা জল বামদিকের বৃত্তের কেন্দ্রে ছাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মেঝের টালিটা আবার দেবে গেল— আর শায়ন্তনী স্পষ্ট শুনল শ্বাস— একটা দীর্ঘ, ক্লান্ত, কর্কশ নিশ্বাস— যেন কোনও বৃদ্ধা বহুদিন পরে প্রথমবারের মতো গভীর হাওয়া নিচ্ছে। তার সাথে সাথেই ঘরের দেওয়ালে অদৃশ্য কালি ভেসে উঠল— বড় বড় বর্ণে— “মিতালির ডায়েরি ফিরিয়ে দাও।”
শায়ন্তনীর বুকের ভেতরটা একবার ধক করে উঠল। মিতালি? এই নামটা সে চেনে। তিন বছর আগে সে একটি আত্মহত্যার প্রতিবেদন করেছিল— কলেজ স্ট্রিটের এক পুরোনো বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন গবেষক মিতালি রায়— মৃত্যুর আগে তিনি এক ডায়েরির কথা বলেছিলেন, যা নাকি শহরের ‘ঘরেদের নিশ্বাস’ নিয়ে তার গবেষণার দলিল। ডায়েরিটা আর পাওয়া যায়নি। মামলাটা আত্মহত্যা হিসেবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আকাশেশ শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “আপনি যদি সেই প্রতিবেদন লিখে থাকেন, তাহলে জানেন, ডায়েরি হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ডায়েরি হারায় না, মানুষ হারিয়ে দেয়। এখানে যে স্মৃতি আটকে আছে, সেটার একটাই দাবি— ডায়েরি ফিরিয়ে দাও।”
শায়ন্তনী ঠান্ডা গলায় বলল, “ডায়েরি কোথায়?” আকাশেশ বলল, “যে নিয়ে গেছে, সে ভাবছে খুব সুরক্ষিত জায়গায় আছে। কিন্তু ভুল করেছে— ডায়েরি কালি নয়, কালি ডায়েরি। যেখানেই রাখো, অক্ষরের নিশ্বাস ঘরে ঘরে হাঁটতে থাকবে। আপনি যদি সত্যিই চান, আমি আপনাকে নামটা বলতে পারি। তবে তার আগে আপনাকে বোঝাতে হবে— আপনি শুনতে পারেন কি না।”
ঘরের বাতাসে তখন এক অদ্ভুত সাঁই সাঁই শব্দ। শায়ন্তনী দেখল, টেবিলের কাঁচের জারের জলে ঘূর্ণি আরও তীব্র, আর জলের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষর ফুটে উঠছে— যেন কেউ ভেতর থেকে ডায়েরির পাতা উল্টে দিচ্ছে। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি শুনছি।” আকাশেশ মাথা নাড়ল— “তাহলে চোখ বন্ধ করুন, আর এই ঘরের নিশ্বাস গুনুন— তিনটে দীর্ঘ, সাতটা ক্ষুদ্র, তারপর এগারোটা থেমে— সংখ্যাগুলোই দরজা খুলবে।” শায়ন্তনী চোখ বন্ধ করল। প্রথম দীর্ঘ নিশ্বাস— ঘরের ভেতর কোথাও টালির নিচে কাঠের কর্কশ ধ্বনি। দ্বিতীয়— জানলার গ্রিল হালকা কম্পমান। তৃতীয়— দূরের ট্রামের ঘণ্টা, এবার ঠিক সুরে। তারপর ক্ষুদ্র সাত— তার নিজের বুকের ধকধক মেলাতে গুনছে, যেন কোনও অদেখা মেট্রোনমে শহরটা টিকটিক করছে। এগারোটা থেমে— ঠিক সেই মুহূর্তে সে শুনল— খুব স্পষ্ট, খুব কাছে— এক নিঃশ্বাসের ভিতর কথা: “শুদ্ধাংশু…”
শায়ন্তনী চোখ খুলে ফেলল। “শুদ্ধাংশু?” আকাশেশের ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি— “তাহলে আপনি শুনলেন। নামটা আপনার কাছে নতুন নয়, রিপোর্টারবাবু। তিন বছর আগের আপনার খবরে একটা নাম ছিল— ড. শুদ্ধাংশু নন্দী— মিতালির গবেষণার সহপাঠী, পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান। আপনি একবারও ভেবেছিলেন, কেন তিনি আত্মহত্যার বিষয়টাকে এত দ্রুত ‘ব্যক্তিগত বিষণ্নতা’ বলে মিটিয়ে দিলেন?” শায়ন্তনীর গলা শুকিয়ে গেল। তার রিপোর্টে সেই নাম ছিল, সাক্ষাৎকারও ছিল— শুদ্ধাংশু বলেছিলেন, মিতালি নাকি ‘অবাস্তব গবেষণার’ মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন। সে ভাবেনি, এই নামটা আবার এভাবে ফিরে আসবে।
দরজার বাইরে হঠাৎই কারও দৌড়োনোর শব্দ। দু’জনেই চমকে তাকাল। করিডোরে ছায়া সরে গেল— কেউ যেন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, তারপর থেমে গেল— তৃতীয় তলার ধারে। আকাশেশ দ্রুত ফিসফিস করল, “আজ এখানেই থাকুক। আপনার ফোনে একটু আগেই যে ০০:৪৭ দেখাল— সেটা আজকের মতো শেষ সংকেত। আপনি যদি এগোতে চান, কাল রাত বারোটার পরে কলেজ স্ট্রিটের ডানকার্স লেনের পুরোনো প্রেসে আসুন। মিতালির ডায়েরির পরের পাতাটা আপনিই শুনবেন।”
শায়ন্তনী আর একবার বামদিকের বৃত্তে তাকাল— জল শুকিয়ে গিয়েছে, বৃত্তের চকের রেখা ক্ষীণ— অথচ দেওয়ালে অদৃশ্য কালির অক্ষর এখনও ঝলমল করছে— “ডায়েরি ফিরিয়ে দাও।” সে জারটা আবার টেবিলে রেখে দিল। দরজার চৌকাঠ পেরোনোর সময় পেছনে তাকাতে ইচ্ছে করল— কিন্তু আকাশেশ আগেই বলে দিয়েছিল— “দেখলে, নিঃশব্দে বেরিয়ে যাও।” সে তাই করল। করিডোরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দিল। বাইরে এসে তার মনে হল, এই বাড়িটা যেন অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ— যেন পাঁচ মিনিট আগের শ্বাসপ্রশ্বাস, শব্দ, সবটাই বাড়ির ভেতরে আটকে পড়েছে।
সিঁড়ি নামতে নামতে তার ফোন আবার কেঁপে উঠল— এবার কোনও লেখা নেই, শুধু খুব ক্ষীণ এক অডিও প্লে হতে শুরু করল— কারও শ্বাস, তারপর ফাঁসফাঁস কণ্ঠে মাত্র তিনটি শব্দ— “ডান… কার্স… লেন…”। শায়ন্তনী থেমে গেল, রেলিংটা শক্ত করে ধরল। সে জানে, এই শহরে কিছু কিছু রাস্তা আছে, যেগুলো রাতের পর অন্য নামে ডাকে। ডানকার্স লেন তেমনই— দিনের বেলা পুরোনো প্রেস আর বইয়ের গুদাম, রাতের বেলা অক্ষরের জঙ্গল। সে রেকর্ডিংটা সেভ করে পকেটে রাখল। তারপর ধীরে ধীরে বাইরে এল। রাস্তায় তখন একটি শহুরে বিড়াল হাই তুলছে, দূরে শো-রুমে রাতের প্রহরী কাশছে, আর একটা অদ্ভুত হাওয়া বইছে— যেমন হাওয়া কেবল তখনই ওঠে, যখন কোথাও কোনও অক্ষর তার নিশ্বাস বদলাতে শুরু করে।
ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে সে নিজের নামটা মনে পড়ল— শায়ন্তনী সেন— যাকে এই শহর চেনে প্রশ্ন করার জন্য। আজ থেকে প্রশ্নের সংখ্যা বাড়ল। প্রথম প্রশ্ন— ড. শুদ্ধাংশু নন্দী ঠিক কীসের জন্য মিতালির ডায়েরি চেয়েছিলেন? দ্বিতীয়— আকাশেশ মিত্র আসলে কে? তৃতীয়— অদৃশ্য কালি কি সত্যিই অদৃশ্য, নাকি আমরা দেখতে চাই না বলে তাকে অদৃশ্য বানাই? আর শেষ প্রশ্ন— যে ঘর নিশ্বাস নেয়, সে কি শুধু স্মৃতি ধরে, নাকি মানুষকেও?
ট্যাক্সি ছুটল। রিয়ারভিউ মিররে শহরের আলো গুনে গুনে ছোট হতে লাগল। ঘড়িতে তখন ০০:৫৯। পরের রাত বারোটার আগে তার হাতে খুব বেশি সময় নেই— কারণ সে ঠিক করেছে, ডানকার্স লেনে গিয়ে আজ রাতের ‘শ্বাস’কে শব্দে ধরবে। আর শব্দ ধরা পড়লেই রহস্য কথা বলে— সে জানে।
পর্ব ২: ডানকার্স লেনের ছায়া
কলেজ স্ট্রিটের রাতের মুখটা দিনের চেনা মুখ নয়। দিনের ভিড়, বইয়ের দোকানের টানা আওয়াজ, চা-ওয়ালার হাঁক—সব কিছুই রাতের বেলায় মুছে গিয়ে জায়গা নেয় ছায়ার স্তর। মাঝেমধ্যে পুলিশ ভ্যান যায়, তবে সেটাও এদিকটায় ঢোকে না। শায়ন্তনী জানে, ডানকার্স লেন মানে একফালি রাস্তা— দু’পাশে তালা মারা প্রেস, কালচে শাটার আর মাটির উপর ছড়িয়ে থাকা শুকনো কালি-গুঁড়ো। রাতে এই লেনের বাতাসে এক ধরনের ধাতব গন্ধ থাকে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না— যেন পুরোনো মুদ্রার গন্ধের সঙ্গে অদৃশ্য আগুন মিশে আছে।
সে সময়মতো পৌঁছল— ঘড়িতে ঠিক ০০:১৫। অটো তাকে রেখে চলে গেল, রাস্তায় দূরে মিলিয়ে গেল গাড়ির শব্দ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, চাঁদ মেঘের আড়ালে, স্ট্রিটল্যাম্পগুলো আধভাঙা। একটা বাতি ঝুলছে হেলে, আলো ঝাপসা করে ফেলছে। আকাশেশ মিত্র এখনো আসেনি। শায়ন্তনী ব্যাগের ভেতরে রেকর্ডার আর নোটবুক চেক করল— অভ্যাসবশত সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়।
হঠাৎ পেছন থেকে পায়ের শব্দ— খুব ধীর, মাপা। সে ঘুরে তাকিয়ে দেখল, আকাশেশ কোটের কলার তুলে এগিয়ে আসছে। হাতে পুরোনো এক চামড়ার ব্যাগ, চোখে আজ ভিন্ন এক দৃঢ়তা। “আপনি এসেছেন, ভাল,” সে বলল, “আজ আপনাকে শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ডানকার্স লেনের এই প্রেসের ভেতরে মিতালির ডায়েরির পরের পাতা আছে। তবে সেটা চোখে দেখা যায় না, কানে ধরা পড়ে।”
তারা একটা মরচে ধরা লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে অন্ধকার, শুধু দেয়ালের ফাঁক দিয়ে হালকা চাঁদের আলো ঢুকছে। ধুলো, কাগজের গন্ধ, আর ভাঙা মেশিনের নিঃশব্দ আর্তনাদ যেন মিশে আছে বাতাসে। প্রেসের কোণে একটা বিশাল ছাপাখানা পড়ে আছে, তার রোলারে শুকনো কালি জমে শক্ত হয়ে গেছে। আকাশেশ হাতের ব্যাগ থেকে ছোট্ট এক যন্ত্র বের করল— দেখতে পুরোনো টেপ-রেকর্ডারের মতো, কিন্তু তার বোতামগুলোতে অদ্ভুত প্রতীক— ত্রিভুজ, বৃত্ত, আর এক ধরনের ভাঙা-লেখার মতো চিহ্ন।
“এটা দিয়ে আমরা ডায়েরির নিশ্বাস ধরব,” আকাশেশ বলল, “মিতালি একসময় এই মেশিনে তার গবেষণার টেপ করত। কিন্তু শব্দগুলো কালি-অক্ষরে বদলে গিয়েছিল। আমি সেই টেপগুলো উদ্ধার করেছি।”
শায়ন্তনী অবাক— “তাহলে আপনি ডায়েরি খুঁজে পেয়েছেন?”
আকাশেশ মাথা নাড়ল— “ডায়েরি পুরোটা নয়। শুধু যে পাতাগুলো ঘরগুলো ‘বলেছে’।”
সে যন্ত্রের বোতাম টিপতেই হালকা ফিসফিস শব্দ উঠল— যেন অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে খুব ধীরে কিছু বলছে। শব্দগুলো স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাতে একটা ছন্দ আছে— তিন দীর্ঘ, সাত ক্ষুদ্র, এগারো থামা। শায়ন্তনীর বুকের ভেতর কাঁপন উঠল— এটাই সেই ফ্রিকোয়েন্সি যা আকাশেশ তাকে বলেছিল। ধীরে ধীরে শব্দগুলো মিলিয়ে গিয়ে স্পষ্ট হলো একটি নারী-কণ্ঠ:
“ডায়েরি… ছয়তলায়… কাচের আলমারি…”
তারপর কণ্ঠ থেমে গেল, আবার শুরু হলো ভাঙা কিছু শব্দ— “শুদ্ধাংশু… ভুল করেছে… অক্ষররা রাগ করেছে…”
শায়ন্তনী আঁচ পেল, এই শব্দ শুধু তথ্য নয়, সতর্কবার্তাও বটে। সে আকাশেশের দিকে তাকাল— “এটা কোন ছয়তলা?”
আকাশেশ বলল, “শুদ্ধাংশুর বাড়ি। উত্তর কলকাতায়, বেলগাছিয়ার পুরোনো দালান। তবে পৌঁছনো সহজ নয়— সে ঘরটাকে বদলে ফেলেছে।”
বদলে ফেলেছে— কথাটা যেন বাতাসে ঝুলে রইল।
হঠাৎ বাইরে থেকে একটা ধাক্কার শব্দ এল। গেট কেঁপে উঠল, যেন কেউ লাথি মারল। দু’জনেই চুপ করে দাঁড়াল। আকাশেশ যন্ত্রটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। “আমাদের কেউ অনুসরণ করছে,” সে ফিসফিস করে বলল।
দ্বিতীয় ধাক্কায় গেটের তালা নড়ে উঠল। শায়ন্তনী দ্রুত টর্চ বের করল, আলো ফেলতেই দেখা গেল— গেটের ফাঁকে একজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। মানুষ নয়, আবার পুরোপুরি প্রাণীও নয়— চোখে এক ধরনের স্থির, ধাতব দীপ্তি। আকাশেশ হাত দিয়ে ইশারা করল— আলো সরিয়ে নিতে।
তারা প্রেসের ভিতরের সরু করিডোর ধরে পিছনের দিকে এগোল। এখানে পুরোনো বইয়ের গাদা, ফেলে রাখা কাঠের টাইপ ব্লক, আর ভাঙা তাক। করিডোরের শেষে একটা আধখোলা দরজা— সেখান দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। তারা বেরিয়ে এলো পিছনের গলিতে।
আকাশেশ দ্রুত বলল, “আজকের মতো এখানেই শেষ। আপনি কাল সকালে এই রেকর্ডিং শুনে নোট করুন। তারপর আমরা বেলগাছিয়ার ঠিকানা ধরব। কিন্তু মনে রাখবেন— ছয়তলার ঘরটা আপনি যতটা ভাবছেন, ততটা স্থির নয়। সেটা নিজের অবস্থান বদলাতে পারে।”
শায়ন্তনী হতভম্ব— “মানে?”
আকাশেশ গম্ভীর গলায় বলল, “যে ঘর নিশ্বাস নেয়, সে চলাফেরা করতে পারে। ঠিক যেমন মানুষ ঘর বদলায়, তেমনি ঘরও মানুষ বদলায়।”
গলির মুখে এসে তারা দু’দিকে চলে গেল। শায়ন্তনী বুঝতে পারল, তার সাংবাদিকতার এই তদন্ত এখন আর শুধু তথ্য বা প্রমাণের ব্যাপার নয়— এখানে শহরের ইট, দেয়াল, আর শ্বাস নেওয়া ঘরগুলো জড়িয়ে আছে। আর সেই শ্বাসের তাল মেনে চলতে না পারলে সত্যি পাওয়া যাবে না।
রাতের শেষ দিকে, বাড়ি ফিরে সে রেকর্ডিং প্লে করল। কণ্ঠ এবার অনেক স্পষ্ট—
“শুদ্ধাংশুর কাছে যা আছে, সেটা ফিরিয়ে নিতে হবে। না হলে ঘরগুলো চুপ থাকবে না।”
তার মনে হলো, বেলগাছিয়ার পথে যাত্রা শুধু রহস্য উন্মোচন নয়— নিজের ভিতরের ভয়কে দেখারও প্রস্তুতি।
পর্ব ৩: ছয়তলার বদলে যাওয়া ঘর
বেলগাছিয়ার পুরোনো রাস্তার বাতিগুলো যেন ইচ্ছে করেই ধোঁয়াটে আলো ছড়ায়। সকালের আলো হলেও এই পাড়ায় একটা গুমোট আচ্ছন্নতা থাকে— দোতলার বারান্দা থেকে ঝুলে থাকা মরচে ধরা গ্রিল, জানালার কাঁচে জমে থাকা ধুলোর স্তর, আর মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসা পুরোনো লাল শালের গন্ধ। শায়ন্তনী দাঁড়িয়ে আছে ৪৩ নম্বর বাড়ির সামনে— এটাই ড. শুদ্ধাংশু নন্দীর ঠিকানা।
বাড়িটা অদ্ভুত উঁচু, ছ’তলা হলেও পাশের দালানের চেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন পুরোনো ফটোতে ভুলবশত লম্বা হয়ে গেছে। উপরের তলার জানালাগুলো ঢাকা গাঢ় সবুজ শাটারে, কিন্তু একটায় ফাঁক আছে— সেখান থেকে যেন অদৃশ্য কেউ তাকিয়ে আছে।
আকাশেশ মিত্র ঠিক সময়ে এসে পৌঁছল, হাতে সেই পুরোনো চামড়ার ব্যাগ।
— “প্রস্তুত?” সে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল।
— “প্রস্তুত,” শায়ন্তনী উত্তর দিল, কিন্তু তার নিজের গলায়ও একটু দ্বিধা শোনা গেল।
গেটে কোনও ঘণ্টা নেই, শুধু কাঠের কপাটে একটা পিতলের নক। আকাশেশ নক করতেই ভেতর থেকে শব্দ এল— ধীর পায়ের টোকা, যেন কারও ইচ্ছাকৃত বিলম্ব। দরজা খুলল একজন বৃদ্ধ, চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা, মুখে অভ্যস্ত শীতলতা।
— “আপনারা?”
— “ড. নন্দীর সঙ্গে দেখা করতে চাই,” আকাশেশ বলল, “গবেষণার ব্যাপারে।”
বৃদ্ধ একটু তাকিয়ে রইল, তারপর চুপচাপ সরে দাঁড়াল। ভেতরের করিডোরটা লম্বা, অল্প আলো— দেয়ালের ধুলো ধরা ফ্রেমে পুরোনো ফটোগ্রাফ: যন্ত্রপাতি, মানুষের দল, আর এক যুবতীর হাসিমুখ— শায়ন্তনী চিনে ফেলল, মিতালি রায়। ছবিটা দেখে তার বুকের মধ্যে হালকা শিরশির করে উঠল।
লিফট নেই, সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হবে। সিঁড়িগুলো সরু, আর প্রতিটি ল্যান্ডিং-এ আলাদা গন্ধ— প্রথম তলায় তামাকের গন্ধ, তৃতীয়তে ল্যাভেন্ডারের, পঞ্চমে স্যাঁতসেঁতে কালি-গুঁড়োর।
ছয়তলায় পৌঁছেই তারা থমকে গেল। এখানে কোনও করিডোর নেই— সোজা এক বিশাল হলঘর, যার মাঝখানে গোল টেবিল। টেবিলের চারপাশে বারোটা চেয়ার, কিন্তু সব চেয়ারেই কেউ যেন অদৃশ্য হয়ে বসে আছে— কুশনগুলো সামান্য দেবে গেছে। ঘরের চারদিকের দেয়াল বইয়ের তাক, আর সেই তাকগুলোয় সারি সারি কাচের আলমারি। প্রতিটিতে পুরোনো কাগজ, বাঁধানো ডায়েরি, আর ধাতব কৌটো।
ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন ড. শুদ্ধাংশু নন্দী। উজ্জ্বল সাদা চুল, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা— যেন অনেকদিন ধরে কোনও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
— “আকাশেশ,” তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, “তুমি ফিরেছ।”
— “আর এই সাংবাদিক,” আকাশেশ শান্ত স্বরে বলল, “যিনি তিন বছর আগে মিতালির মৃত্যু নিয়ে লিখেছিলেন। তিনি ডায়েরির কথা শুনেছেন।”
শুদ্ধাংশুর ঠোঁটে হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি— “ডায়েরি কোনও বস্তু নয়। এটা একটি অবস্থা। আর সব অবস্থা সবার জন্য নয়।”
শায়ন্তনী বলল, “তাহলে মিতালির ডায়েরি আপনার কাছে কেন?”
শুদ্ধাংশু ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গেলেন এক কাচের আলমারির কাছে। হাতের আঙুলে চাবির গোছা ঘুরিয়ে তালা খুললেন। ভেতরে একটা মোটা খাতা— মলাট কালচে, পাতাগুলো প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো পুরোনো।
— “এটা কি সেই ডায়েরি?”
— “হ্যাঁ এবং না,” শুদ্ধাংশু বললেন, “এতে মিতালির লেখা আছে, কিন্তু প্রতিটি পাতা এই ঘরের শ্বাসে বদলে গেছে। আপনি যদি পড়েন, আপনি নিজেও বদলে যাবেন।”
আকাশেশ এগিয়ে এসে ফিসফিস করল, “পড়তে হবে। নইলে আমরা জানব না সে মৃত্যুর আগে কী শুনেছিল।”
শুদ্ধাংশু খাতাটা টেবিলে রাখলেন। পাতার ওপরে অদ্ভুত দাগ— যেন অক্ষরগুলো ফসকে বেরিয়ে গেছে, শুধু ছায়া রয়ে গেছে। শায়ন্তনী একটা পাতায় আঙুল রাখতেই শ্বাসকষ্টের মতো অনুভূতি হলো— মনে হলো, ঘরটা হঠাৎ ছোট হয়ে আসছে, দেয়াল এগিয়ে আসছে।
ডায়েরির অক্ষরগুলো হালকা ভেসে উঠতে লাগল—
“যে ঘর তার শ্বাস হারায়, সে অন্য ঘরের শ্বাস চুরি করে বাঁচে।”
শুদ্ধাংশু গভীর গলায় বললেন, “মিতালি আবিষ্কার করেছিল, শহরের কিছু পুরোনো বাড়ি একে অপরের শ্বাস বিনিময় করে। যখন কোনও বাড়ি ভেঙে যায়, তার শ্বাস নিকটবর্তী অন্য ঘরে আশ্রয় নেয়। সেই শ্বাসে পুরোনো বাসিন্দার কণ্ঠ, গন্ধ, স্মৃতি— সবকিছু লেগে থাকে। আর এই ডায়েরি সেইসব শ্বাসের মানচিত্র।”
শায়ন্তনী বলল, “আপনি এটাকে নিজের কাছে রেখেছেন কেন?”
শুদ্ধাংশু একটু থামলেন— “কারণ কিছু শ্বাস আছে যা ছেড়ে দিলে শহর বদলে যাবে। সব সত্য সবার জানা দরকার নেই।”
আকাশেশ গলা শক্ত করে বলল, “কিন্তু কিছু সত্য না জানলে শহর ভুলে যায়।”
শুদ্ধাংশু এবার তাকালেন শায়ন্তনীর দিকে— “আপনি সাংবাদিক। যদি এই পাতাগুলো পড়েন, আপনাকে ঘরের শ্বাস নিজের ভেতরে নিতে হবে। তখন আপনি কেবল মানুষ থাকবেন না— আপনি ঘরের অংশ হয়ে যাবেন। সিদ্ধান্ত আপনার।”
শায়ন্তনী বুঝল, এ সিদ্ধান্ত শুধু পেশাগত নয়, ব্যক্তিগতও। কণ্ঠ শুকিয়ে এলেও সে বলল, “আমি পড়ব।”
শুদ্ধাংশু পাতাটা খুলে দিলেন। মুহূর্তেই শায়ন্তনী শুনল— কর্কশ, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ, যা কোনও মানুষের নয়— যেন বহু পুরোনো কাঠের দরজা ধীরে ধীরে খুলছে। সেই কণ্ঠ বলল—
“আমায় ফিরিয়ে নাও কলেজ স্ট্রিটের প্রেসে… আকাশের নিচে যেখানে প্রথম শ্বাস নিয়েছিলাম…”
তারপর হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেল। ডায়েরির পাতা নিস্তব্ধ।
শুদ্ধাংশু চোখ ছোট করে বললেন, “এটাই শেষ সতর্কবার্তা। এর পর যা হবে, তা আর ফেরানো যাবে না।”
ঘরের বাতাস তখন ভারি হয়ে গেছে। শায়ন্তনীর মনে হলো, ছয়তলার এই ঘরটা এখন ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান বদলাচ্ছে— যেন দেয়ালের ভেতরে অদৃশ্য করিডোর তৈরি হচ্ছে, আর সেই করিডোর কোথাও এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যেখান থেকে ফেরা কঠিন।
সে জানে, এখান থেকে গল্প আর শহরের মাঝের সীমানা ভেঙে যাবে।
পর্ব ৪: ঘরের ভিতরে ঘর
শায়ন্তনী ডায়েরির পাতার ওপর আঙুল রাখতেই কালি-ছায়াগুলো ধীরে ধীরে নড়ে উঠল, যেন পাতার ভিতর থেকে শ্বাস উঠছে। প্রথমে মনে হলো ঘরের বাতাস ভারি হয়ে আসছে, তারপর বুঝল— বাতাস নয়, সময় বদলাচ্ছে। তার চোখের সামনে ছয়তলার আলমারিগুলো যেন পিছিয়ে যাচ্ছে, আর টেবিল-চেয়ার সরে গিয়ে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে এক লম্বা, অন্ধকার করিডোরকে।
আকাশেশ ফিসফিস করল, “এটাই সেই বদলে যাওয়া পথ। ভয় পাবেন না, কিন্তু থামবেনও না।”
শুদ্ধাংশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, মুখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য— যেন এই দৃশ্য তিনি আগেও দেখেছেন।
শায়ন্তনী এক পা এগোতেই করিডোরের দেওয়ালে কালি ছোপের মতো নকশা দেখা গেল— বাঁকানো অক্ষর, ভাঙা ত্রিভুজ, আর একের পর এক বৃত্ত যার মাঝে সংখ্যা লেখা: ৩, ৭, ১১। করিডোরের মেঝে স্যাঁতসেঁতে, তাতে পুরোনো মুদ্রার গন্ধ মিশে আছে। মাথার ওপরে আলোর উৎস নেই, তবু অন্ধকার পুরোপুরি নয়— অদৃশ্য কিছুর আলো যেন ভেতর থেকে জ্বলছে।
দূরে হালকা শব্দ— যেন ছাপাখানার চাকা ধীরে ধীরে ঘুরছে। শব্দের সাথে সাথে বাতাসে ভেসে আসছে কালি-পোড়া কাগজের গন্ধ। সে যত এগোচ্ছে, শব্দ তত পরিষ্কার— এখন মনে হচ্ছে, কেবল যন্ত্র নয়, কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। কণ্ঠ অচেনা, তবু শব্দগুলো গলায় ধরা পড়ছে:
“প্রেস… কলেজ স্ট্রিট… প্রথম শ্বাস…”
হঠাৎ করিডোরের একপাশের দেওয়াল কেঁপে উঠল। সেখানে একটা দরজা ফুটে উঠল, যেন আগে ছিল না। দরজার ওপর আঁকা একটি চোখ— অর্ধেক খোলা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছড়িয়ে আছে। শায়ন্তনী হাত বাড়িয়ে ঠেলতেই দরজাটা নরম কাগজের মতো ভেঙে গেল, আর সে ঢুকে পড়ল এক বিশাল ঘরে।
ঘরের মাঝখানে রাখা পুরোনো ছাপাখানা, কিন্তু তার চাকা ধীরে ধীরে নিজেরাই ঘুরছে। চাকার উপরে আটকে আছে একখণ্ড পাতলা সাদা কাগজ, তাতে লেখা— “মিতালি রায়, ১৯ অক্টোবর”। শায়ন্তনীর বুক কেঁপে উঠল— এটাই তো মিতালির মৃত্যুর আগের দিন।
ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ডায়েরির পাতা— কিন্তু প্রতিটা পাতা মেঝের ওপর নয়, বাতাসে ভাসছে। অক্ষরগুলো পাতার গা থেকে উঠে এসে বাতাসে ঝুলে আছে, যেন নিজে নিজেই লিখছে আর মুছে যাচ্ছে।
আকাশেশ ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল, চোখ ভিজে উঠেছে— “এটাই মিতালির প্রথম প্রেস। এখানে সে শোনার কৌশল আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু শুদ্ধাংশু ওকে থামিয়ে দেয়।”
শায়ন্তনী একটা ভাসমান পাতার কাছে গেল। অক্ষরগুলো ভাঙা গলায় বলল— “আমাকে ফিরিয়ে নাও… শ্বাস দাও…”।
শায়ন্তনী জিজ্ঞেস করল, “কোথায় ফিরিয়ে নেব?”
অক্ষর থেমে আবার বদলে গেল— “যে ঘর নিজের জানালা বন্ধ করেছে, সেখানে…”
সে বুঝল, ইঙ্গিতটা শুদ্ধাংশুর ছয়তলার ঘরের দিকে।
ঠিক তখনই হাওয়ার ঝাপটা লাগল। ছাপাখানার চাকা হঠাৎ দ্রুত ঘুরতে শুরু করল, পাতাগুলো বাতাসে উড়ে গিয়ে শায়ন্তনীকে ঘিরে ধরল। প্রতিটা পাতায় মিতালির হাতের লেখা, কিন্তু শব্দগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে— তৈরি করছে নতুন বাক্য:
“যদি শুনতে চাও, নিজের নাম ভুলে যাও।”
তার মনে হলো, ঘরটা ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিচ্ছে— দেয়াল সরে যাচ্ছে, মেঝে ঢেউ তুলছে। আকাশেশ চিৎকার করল, “পিছিয়ে আসুন!” কিন্তু তখনই শুদ্ধাংশুর কণ্ঠ শোনা গেল, করিডোরের দিক থেকে—
— “না, ওকে আসতে দাও। ও এখন ডায়েরির অংশ।”
শায়ন্তনী মাথা ঘুরে গেলেও দাঁড়িয়ে থাকল। ছাপাখানার চাকা একবার থেমে গিয়ে বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করল— আর তার নিচে থেকে বেরিয়ে এল কালো কালি-ভেজা এক প্যাকেট। প্যাকেটটা তার দিকে গড়িয়ে এল। সে তুলে নিতেই টের পেল, ভেতরে ডায়েরির আসল অংশ— যার পাতা শহরের কোনও মানচিত্রের মতো।
হঠাৎ সবকিছু থেমে গেল। পাতাগুলো মাটিতে পড়ে গেল, আলো নিভে এল। চোখ মেলতেই শায়ন্তনী নিজেকে আবার ছয়তলার সেই হলঘরে দেখতে পেল। টেবিলে শুদ্ধাংশু দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।
— “তুমি ফিরে এসেছ। এর মানে, ঘর তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে… আপাতত।”
আকাশেশ তাড়াহুড়ো করে বলল, “প্যাকেটটা খুলবেন না এখনই। বাইরে যেতে হবে। ঘর বেশি সময় কাউকে রাখতে চায় না।”
শায়ন্তনী হাতের মুঠোয় প্যাকেট চেপে ধরল। সে জানে, এর ভেতরে শহরের শ্বাসের গোপন মানচিত্র আছে— আর সেই মানচিত্রই তাকে নিয়ে যাবে পরের দরজায়।
পর্ব ৫: শ্বাসের মানচিত্র
ছয়তলার সেই বদলে যাওয়া ঘর থেকে নেমে আসার পর শায়ন্তনী যেন স্বাভাবিক আলোয় ফিরেও পুরোপুরি ফিরে আসতে পারছিল না। চারপাশের গাড়ির হর্ন, মানুষের হাঁক—সবকিছুই একধরনের পাতলা পর্দার আড়াল থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছিল। হাতে ধরা প্যাকেটটা গরম— যেন ভেতরে কিছু নড়ছে।
আকাশেশ শ্বাস ফেলে বলল, “চলুন, এখানে দাঁড়িয়ে খোলা যাবে না। ঘরের শ্বাস এখনও আমাদের পেছনে লাগতে পারে।”
তারা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছল আকাশেশের ছোট্ট ফ্ল্যাটে, উত্তর কলকাতার এক পুরোনো বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। ফ্ল্যাটটা ভরা পুরোনো বই, যন্ত্রপাতি, আর দেওয়ালে ঝোলানো নকশা— বৃত্ত, ত্রিভুজ, আর ভাঙা অক্ষরের ডায়াগ্রাম।
আকাশেশ টেবিলে প্যাকেটটা রাখল।
— “আপনি প্রস্তুত?”
— “হ্যাঁ,” শায়ন্তনী বলল, কিন্তু তার হাতের তালু ঘামছে।
প্যাকেটের মোড়ক খুলতেই প্রথমে একটা গন্ধ বেরোল— মাটির সঙ্গে মেশানো পুরোনো কালি ও ধাতুর গন্ধ। ভেতরে পাতলা চামড়ার মলাটে বাঁধানো একটা খাতা। খোলার সাথে সাথেই পাতার গায়ে ভাসতে লাগল অদ্ভুত রেখাচিত্র— শহরের মানচিত্রের মতো, কিন্তু প্রতিটি রাস্তা বেঁকে বেঁকে বৃত্ত তৈরি করেছে। রাস্তার পাশে চিহ্নিত কয়েকটি বিন্দুতে লেখা— “শ্বাস বিনিময় কেন্দ্র”।
শায়ন্তনী বিস্ময়ে বলল, “এগুলো কি সেই বাড়ি যেগুলো শ্বাস বিনিময় করে?”
আকাশেশ মাথা নাড়ল— “হ্যাঁ। মিতালি এগুলোকে ‘শ্বাস নোঙর’ বলত। যখন কোনও বাড়ি ভেঙে যায়, তার শ্বাস এই নোঙরগুলোতে এসে জমা হয়। তারপর সুযোগমতো অন্য ঘরে গিয়ে বসে।”
মানচিত্রে মোট সাতটি বিন্দু— কলেজ স্ট্রিটের সেই প্রেস, বেলগাছিয়ার ছয়তলার দালান, শ্যামবাজারের এক পুরোনো সিনেমাহল, বৌবাজারের ভগ্ন প্রাসাদ, চেতলার পুরোনো গুদামঘর, কুমোরটুলির এক পরিত্যক্ত মৃৎশিল্পের আঙিনা, আর দক্ষিণেশ্বরের ঘাটের পাশে এক ভাঙা গোডাউন।
পাতার পাশে মিতালির হাতের লেখা—
“সব নোঙরের শ্বাস একবারে মুক্ত হলে শহরের মুখ বদলে যাবে। কিন্তু মুক্তির আগে শ্বাস গুনতে জানতে হবে।”
শায়ন্তনী আঙুল বুলিয়ে লেখাটা পড়ল। তার মনে হলো, শ্বাস গুনতে জানাটা কেবল সংখ্যার খেলা নয়— এটা এক ধরনের টিউনিং, যেমন রেডিও সঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতে ধরতে হয়।
আকাশেশ মানচিত্রে আঙুল রাখল— “আমাদের প্রথমে যেতে হবে এই সিনেমাহলে। তিন বছর ধরে বন্ধ, কিন্তু শুনেছি রাতে ভেতর থেকে প্রোজেক্টরের শব্দ আসে।”
শায়ন্তনী বলল, “আমরা কি একসাথে যাব?”
— “অবশ্যই,” আকাশেশ বলল, “এই মানচিত্র একা নিয়ে ঘোরাফেরা করলে মানুষ শুধু পথ হারায় না, নিজের শ্বাসও হারাতে পারে।”
তারা ঠিক করল, সেই রাতেই যাত্রা শুরু হবে। সন্ধ্যার আগে আকাশেশ একটা ছোট্ট যন্ত্র বের করল— দেখতে হ্যান্ডহেল্ড মাইক্রোফোনের মতো, কিন্তু মাথায় গোলাকার কাচের গম্বুজ।
— “এটা শ্বাস ধরার যন্ত্র,” আকাশেশ ব্যাখ্যা করল, “ঘরের ভেতরের বাতাসে যে শব্দ শোনা যায় না, সেটা এর মাধ্যমে রেকর্ড করা যায়। মিতালি নিজের হাতে বানিয়েছিল।”
শায়ন্তনী যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দেখল— গম্বুজের ভিতরে ধীরে ধীরে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু ঘুরছে।
— “এটা কি?”
— “ধরা পড়া শ্বাস,” আকাশেশ বলল, “যেটা আপনি প্লে করলে কণ্ঠে বদলে যাবে।”
রাত নামতেই তারা রওনা দিল শ্যামবাজারের দিকে। সিনেমাহলটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, নামফলক ঝাপসা, পোস্টারের কাগজ ছিঁড়ে গিয়ে দেয়ালে কেবল আঠার দাগ। গেট বন্ধ, কিন্তু পাশে সরু গলির শেষে একটা ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়।
ভেতরে অন্ধকার, শুধু চাঁদের আলো স্ক্রিনে পড়ে হালকা রূপালি আভা ফেলছে। দর্শকাসনের আসনগুলো ধুলোয় ঢাকা, আর মেঝেতে ছড়িয়ে পুরোনো ফিল্ম রিলের টুকরো।
আকাশেশ যন্ত্রটা চালু করল। গম্বুজের ভেতরের কালো ধোঁয়া দ্রুত ঘুরতে শুরু করল, তারপর ধীরে ধীরে শব্দ ফুটে উঠল— প্রথমে হাওয়ার মতো সোঁ সোঁ, তারপর স্পষ্ট এক কণ্ঠ:
“শেষ দৃশ্য চালু করো… আলো নিভে যাক…”
হঠাৎ প্রোজেক্টর রুমের দিক থেকে ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠল। তারা তাকাতেই দেখল— ভেতরে কেউ নেই, অথচ প্রোজেক্টরের লেন্সে ঘূর্ণি ঘুরছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক নারীর ছায়া— মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঠোঁট নড়ছে।
আকাশেশ যন্ত্রটা কাছে ধরল, শব্দ ধরা পড়ল—
“আমি এখানে আটকে আছি… শ্বাসের বিনিময় বন্ধ হয়েছে… মুক্তি দাও…”
শায়ন্তনী এগিয়ে স্ক্রিন ছুঁতে গেল, কিন্তু হাত লাগতেই আলো নিভে গেল, ঘর আবার অন্ধকার। যন্ত্রের গম্বুজে এবার ধোঁয়ার ভেতরে ক্ষুদ্র নকশা ফুটে উঠেছে— যেন এই নোঙরের পথ পরবর্তী নোঙরে নিয়ে যাচ্ছে।
আকাশেশ বলল, “দেখলেন? এভাবেই আমরা পথ পাব।”
শায়ন্তনী মানচিত্রে নতুন দাগ টেনে নিল— সিনেমাহলের শ্বাস এখন তাদের হাতে।
কিন্তু বেরোবার সময় তারা বুঝল, কেউ তাদের দেখছে। গেটের বাইরে এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে— মুখ দেখা যায় না, কিন্তু চোখে সেই ধাতব দীপ্তি, যেটা তারা কলেজ স্ট্রিটের প্রেসে দেখেছিল।
ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে হাত তুলল, আঙুলে ইশারা করল— “থামো।”
আকাশেশ ফিসফিস করে বলল, “এরা ঘরের রক্ষক— নোঙরের শ্বাস যাতে ভুল হাতে না যায়, সেজন্য তৈরি।”
শায়ন্তনী জানে, এখন তাদের শুধু মানচিত্রের পথ নয়, সেই পথের রক্ষকদেরও মোকাবিলা করতে হবে। আর প্রতিটি শ্বাস মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে শহরের অদৃশ্য মানচিত্র বদলে যাবে।
পর্ব ৬: বৌবাজারের রক্ষক
বৌবাজারের পুরোনো গলিগুলো রাতের বেলায় একেবারে আলাদা চেহারা নেয়। দিনের কোলাহল, বাজারের হট্টগোল, দোকানের উজ্জ্বল আলো—সব মিলিয়ে যে প্রাণচাঞ্চল্য থাকে, তা সূর্য ডোবার সাথে সাথে ফিকে হয়ে গিয়ে জায়গা ছেড়ে দেয় এক চাপা স্যাঁতসেঁতে গন্ধকে। এই গন্ধে পুরোনো কাঠ, ধুলো, আর মানুষের অচল স্মৃতি মিশে থাকে।
আকাশেশের মানচিত্রে তৃতীয় নোঙর চিহ্নিত— বৌবাজারের ভগ্ন প্রাসাদ। বাড়িটা একসময় নাকি জমিদারের ছিল, পরে ১৯৭০-এর দশকে সিনেমা প্রযোজকের হাতে যায়, আর তারপর থেকে নানা অদ্ভুত ঘটনার গুজব ছড়ায়। শেষমেশ তালা পড়ে যায়, কিন্তু স্থানীয়রা বলে, গভীর রাতে ভেতর থেকে কখনও পিয়ানোর সুর ভেসে আসে, কখনও ফিসফিস করে কারও নাম ডাকা হয়।
শায়ন্তনী আর আকাশেশ রাত বারোটার পর গলিতে ঢুকল। গলির মাথায় কেবল একটি বাতি, সেটিও ঝাপসা আলো ফেলছে। প্রাসাদের গেট মরচে ধরা, একপাশে বাঁকানো লোহার রড, যা চাপ দিলেই ফাঁক তৈরি হয়।
ভেতরে ঢুকেই তারা থমকে দাঁড়াল। উঠোনের মাঝখানে বিশাল আমগাছ, কিন্তু শিকড়গুলো যেন মাটির বদলে পাথরে ঢুকে গেছে। চারপাশের বারান্দাগুলো ফাঁকা, কেবল দুলছে ছেঁড়া পর্দা। হাওয়া নেই, তবু পর্দার দুলুনি যেন কারও অদৃশ্য হাতে।
আকাশেশ ব্যাগ থেকে শ্বাস-ধরার যন্ত্রটা বের করল। গম্বুজের ভেতরের কালো ধোঁয়া এক মুহূর্তে ঘূর্ণি তুলল— যেন এই বাড়ির শ্বাস বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল। হালকা সোঁ সোঁ শব্দের পরই শোনা গেল এক নারীকণ্ঠ, স্বর ভারি, ধীর:
“তুমি দেরি করেছ…”
শায়ন্তনী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
কণ্ঠ উত্তর দিল না, বরং এক পিয়ানোর নোট ভেসে এল। তারপর ধীরে ধীরে কণ্ঠ আবার বলল—
“শ্বাস বিনিময় থেমে গেছে… গাছের শিকড় মরে যাবে…”
আকাশেশ ফিসফিস করল, “এ নোঙরের শ্বাস গাছের সঙ্গে বাঁধা। গাছটাই বাড়ির প্রাণ।”
ঠিক তখনই উপরের বারান্দায় ছায়া দেখা গেল। কেউ দাঁড়িয়ে, সোজা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শায়ন্তনী চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল— পরিচিত কি? না, কিন্তু চোখে সেই একই ধাতব দীপ্তি, যা তারা সিনেমাহল আর প্রেসে দেখেছে।
ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। আলোয় আসতেই বোঝা গেল, এটি একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, কিন্তু তার চলাফেরায় অদ্ভুত এক যান্ত্রিক শৃঙ্খলা। ঠোঁটে কোনও ভাবপ্রকাশ নেই, কণ্ঠ ঠান্ডা:
— “মানচিত্র দাও।”
আকাশেশ এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি কে?”
— “আমরা রক্ষক। আমাদের কাজ, শ্বাস ভুল হাতে যেতে না দেওয়া।”
শায়ন্তনী বলল, “ভুল হাত মানে?”
রক্ষকের চোখে ধাতব ঝিলিক জ্বলে উঠল— “যারা শহরের শ্বাস মুক্তি দিয়ে ভারসাম্য নষ্ট করবে, তারা ভুল হাত। মুক্তি মানেই সবসময় স্বাধীনতা নয়— কখনও তা ধ্বংস।”
আকাশেশ বলল, “আমরা মিতালির কাজ শেষ করতে চাই।”
রক্ষক থমকে গেল— “মিতালি ভারসাম্য ভাঙতে চেয়েছিল। তাই ওকে থামানো হয়েছে।”
শায়ন্তনী রাগে গলা শক্ত করল, “আপনারা ওকে মেরেছেন?”
রক্ষক সরাসরি উত্তর দিল না— “শ্বাস কারও মালিকানাধীন নয়। কিন্তু যারা শ্বাস শোনে, তাদের দায়িত্ব আছে সেটাকে সঠিক স্থানে রাখা।”
আকাশেশ যন্ত্রটা চালু রাখল। গম্বুজের ভেতর থেকে এবার গাছের দিক থেকে শব্দ এলো— পাতার ফিসফিসানি, তারপর স্পষ্ট একটি বাক্য:
“আমার শ্বাস ফিরিয়ে দাও নদীর ঘরে…”
শায়ন্তনী অবাক— “নদীর ঘর?”
আকাশেশ মানচিত্র খুলে দেখাল— নদীর ঘর মানে দক্ষিণেশ্বরের সেই ভাঙা গোডাউন, শেষ নোঙরের একটি। এর মানে, বৌবাজারের শ্বাস সোজা নদীর ধারে গিয়ে মিলতে চায়।
রক্ষক ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে একটাই কথা বলল—
— “তোমরা যদি সব নোঙর ভাঙো, শহর তোমাদের ফিরিয়ে দেবে না।”
ছায়া মিলিয়ে যেতেই আকাশেশ গাছের গুঁড়িতে যন্ত্রটা চেপে ধরল। গম্বুজে কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে থেমে গেল— শ্বাস ধরা পড়েছে। গাছের পাতাগুলো হালকা কেঁপে উঠল, তারপর নিস্তব্ধ।
বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে শায়ন্তনীর মনে হলো, রক্ষকদের কথায় হয়তো কিছু সত্যি আছে— সব শ্বাস মুক্তি মানেই কি শহরের মঙ্গল? কিন্তু মিতালির মৃত্যুর রহস্য না জেনে সে থামতে পারবে না।
রাতের বৌবাজার পেরিয়ে তারা যখন আবার বড় রাস্তায় এল, দূরে কোথাও ট্রামের ঘণ্টা বাজল— কিন্তু সেই সুরটা শায়ন্তনীর কানে অন্য রকম লাগল, যেন কোনও ঘরের ভিতরের শ্বাস তাকে ডেকে বলছে—
“শেষটা আমার কাছে আছে…”
পর্ব ৭: মাটির শ্বাস
কুমোরটুলি ভোরের আলোয় যেমন রঙিন আর কোলাহলমুখর, রাত নামলেই তেমনই নিঃশব্দ, ছায়ায় মোড়া। দিনের ব্যস্ততার পর প্রতিটি আঙিনা যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। চারপাশে মাটির গন্ধ, অর্ধসমাপ্ত প্রতিমার ছায়া, আর শুকনো খড়ের ঝাঁপি— সব মিলিয়ে একরকম নিঃশব্দ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
আকাশেশের মানচিত্রে চতুর্থ নোঙর স্পষ্ট— এক পুরোনো, ব্যবহারহীন মৃৎশিল্পের আঙিনা, যা নাকি কয়েক দশক ধরে বন্ধ। স্থানীয়রা বলে, এখানে একসময় সবচেয়ে দক্ষ কারিগর কাজ করতেন, কিন্তু এক দুর্ঘটনার পর তিনি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান। তারপর থেকে মাঝরাতে আঙিনার ভেতরে মাটির চাকা ঘুরে ওঠে— কেউ না থেকেও।
শায়ন্তনী ও আকাশেশ পৌঁছল রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে। আঙিনার গেট ভাঙা, কিন্তু খোলা। ভেতরে ঢুকতেই চাঁদের আলোয় দেখা গেল, মাটির চাকা ধীরে ধীরে ঘুরছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে আধা-তৈরি মুখ— মূর্তির, কিন্তু চোখ নেই; ফাঁকা গহ্বর যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আকাশেশ ফিসফিস করল, “এই আঙিনা শ্বাস ধরে রাখে মাটিতে। এখানকার মাটি শহরের অন্য নোঙরে নিয়ে গেলে শ্বাসও সেখানে পৌঁছয়।”
শ্বাস-ধরার যন্ত্র চালু হতেই গম্বুজের ভেতর কালো ধোঁয়া দ্রুত পাক খেতে লাগল। তারপর এক গভীর, গলা-বদ্ধ কণ্ঠ ভেসে এল— পুরুষের স্বর, কিন্তু ক্লান্ত:
“মাটির ভিতরেই শ্বাস লুকানো… জল ছুঁইয়ে দাও…”
শায়ন্তনী চারপাশে তাকাল। আঙিনার কোণে একটি বড় হাঁড়ি— তাতে শুকনো মাটি ভরা। পাশে ভাঙা কলসি। সে হাঁড়ির মাটি আঙুল দিয়ে ছুঁতেই ঠান্ডা স্রোতের মতো কিছু ভেতরে বইতে লাগল, যেন মাটির গায়ে অদৃশ্য ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।
হঠাৎ সামনের প্রতিমার মুখে হালকা ফাটল ধরল, আর সেই ফাঁক দিয়ে বেরোল কালি-মিশ্রিত জল। জল মাটিতে পড়তেই গম্বুজে ধোঁয়া থেমে গেল— শ্বাস ধরা পড়েছে।
ঠিক তখনই আঙিনার ছায়া নড়ে উঠল। এক মহিলা এগিয়ে এলেন— বয়স বোঝা যায় না, চুল এলোমেলো, গায়ে মাটির দাগ, চোখে একই ধাতব দীপ্তি। শায়ন্তনী বুঝল, এ-ও একজন রক্ষক।
মহিলা বললেন, “তোমরা মাটির শ্বাস নিয়ে যাচ্ছ, জানো এর মানে কী?”
আকাশেশ উত্তর দিল, “আমরা মিতালির কাজ শেষ করছি।”
মহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন— “মিতালি ভুল পথে গিয়েছিল। শ্বাসের সব পথ খুলে দিলে শহরের পুরোনো স্মৃতি মুক্তি পাবে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে উঠে আসবে যা লুকিয়ে রাখা হয়েছে— হিংসা, মৃত্যু, অভিশাপ।”
শায়ন্তনী সাহস করে বলল, “তাহলে আপনারা কী চান? সব আটকে রাখা হোক?”
মহিলা ধীরে বললেন, “সব নয়। কেবল যেগুলো শহর সামলাতে পারবে না।”
আকাশেশ এগিয়ে গেল, “আমরা বেছে নেব কোনটা মুক্তি পাবে।”
মহিলা হালকা হাসলেন— “বেছে নেওয়ার ক্ষমতা তোমাদের আছে মনে করো? শহর নিজে ঠিক করে দেবে।”
এই বলে তিনি মাটির এক মুঠো তুলে শায়ন্তনীর হাতে দিলেন— “যতদিন এটা তোমার কাছে থাকবে, মাটির শ্বাস তোমাকে চিনবে। কিন্তু সাবধান— যদি ভুল জায়গায় ফেলে দাও, শ্বাস তোমাকে গ্রাস করবে।”
তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন, যেন ছায়ার মধ্যে গলে গেলেন।
শায়ন্তনী মাটির গন্ধ শুঁকল— গন্ধের মধ্যে নদীর হালকা লবণ আর পুরোনো খড়ের গন্ধ মিশে আছে। সে জানে, এই মাটিই পরবর্তী নোঙরের চাবি।
আকাশেশ মানচিত্রে নতুন দাগ টেনে বলল, “পরের নোঙর চেতলার গুদামঘর। কিন্তু মনে হচ্ছে, রক্ষকেরা আমাদের পথ আগে থেকেই সাজিয়ে দিচ্ছে।”
শায়ন্তনীর মনে প্রশ্ন জমল— রক্ষকেরা আসলে শত্রু, নাকি সহযোগী? আর শহর যদি সত্যিই নিজে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তারা কি কেবল সেই সিদ্ধান্তের বাহক?
গলিপথে বেরোতে বেরোতে সে শুনল, আঙিনার ভেতরে আবার চাকা ঘুরছে— এবার গতি বেশি, যেন বিদায় জানাচ্ছে বা সতর্ক করছে।
পর্ব ৮: সময়ের গুদাম
চেতলার পুরোনো গুদামঘরগুলো দিনের বেলাতেও প্রায় ফাঁকা থাকে, কিন্তু রাত নামলেই এরা যেন পুরোপুরি আরেক জগতে ঢুকে পড়ে। উঁচু ইটের দেয়াল, তালা মারা লোহার গেট, আর ভিতরে সারি সারি লম্বা শেড— যেগুলো একসময় নাকি জাহাজে আসা পণ্য রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো। আকাশেশের মানচিত্রে পঞ্চম নোঙর স্পষ্ট চিহ্নিত— এই গুদাম, যা নাকি সময়কে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে।
রাত ১টার পর তারা পৌঁছল। চারপাশে বাতাস নিস্তব্ধ, কেবল নদীর দিক থেকে হালকা জোয়ারের গন্ধ ভেসে আসছে। আকাশেশ বলল, “এখানে শ্বাস ধরা পড়ে না শব্দে— ধরা পড়ে সময়ে। একবার সময়-ফাঁদে ঢুকে গেলে, বেরোতে হলে সঠিক মুহূর্ত চেনা লাগবে।”
গেটের তালা মরচে ধরা, কিন্তু চাপ দিতেই খুলে গেল, যেন অনেকদিন পর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হলো। ভেতরে ঢুকেই শায়ন্তনী টের পেল, এখানে বাতাস অন্যরকম— ভারি, কিন্তু ঠান্ডা নয়; বরং যেন সময়ের ওজন জমে আছে।
গুদামের ভেতর অন্ধকার, তবে দূরের এক শেডের ফাঁক দিয়ে হালকা আলো ঝলমল করছে। তারা এগোতেই মেঝের উপর ছড়ানো পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতা দেখা গেল— ১৯৮৩, ১৯৯৭, ২০০৫— সব বছরের, কিন্তু আজকের তারিখটাই নেই।
আকাশেশ শ্বাস-ধরার যন্ত্র চালু করল। গম্বুজের ভেতরের কালো ধোঁয়া প্রথমে থেমে রইল, তারপর হঠাৎ পাক খেয়ে ভেতরে ভেতরে বিস্তার পেল। আর ঠিক তখনই গুদামের ভেতরের ঘড়িগুলো একসাথে বাজতে শুরু করল— টিক, টিক, টিক— যেন একসঙ্গে হাজার ঘড়ি চলছে।
শায়ন্তনী অবাক হয়ে দেখল, গুদামের এক দেয়ালে সারি সারি ঘড়ি ঝোলানো— প্রতিটা আলাদা সময় দেখাচ্ছে। একটার কাঁটা সকাল ৭টায়, আরেকটার মধ্যরাত ১২টায়, আবার অন্য একটার ৩:৪৫-এ আটকে আছে।
হঠাৎ চারপাশের শব্দ বদলে গেল— নদীর জোয়ারের আওয়াজ স্পষ্ট হয়ে উঠল, তারপর মিলিয়ে গেল গাড়ির হর্ন, মানুষের হাঁক, পুরোনো ট্রামের ঘণ্টা— সব একসঙ্গে। আকাশেশ বলল, “এটাই সময়-ফাঁদ। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এখানে মিশে যায়।”
দূরের আলোটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর সেই আলোর ভেতরে এক বৃদ্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে। লম্বা চাদর, হাতে মরচে ধরা পকেট-ঘড়ি। কণ্ঠ গভীর, কিন্তু স্পষ্ট:
— “তোমরা সময়ে হাত দিচ্ছ। শ্বাসের পথ সময়ের উপর চলে, কিন্তু সময়কে বদলালে শ্বাসও বদলে যাবে।”
শায়ন্তনী জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি রক্ষক?”
বৃদ্ধ হালকা হাসলেন— “আমি রক্ষকদেরও রক্ষক। আমার কাজ, শ্বাস যেন তার সঠিক সময়ে পৌঁছয়।”
আকাশেশ বলল, “আমরা মিতালির অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই।”
বৃদ্ধের চোখে এক ঝিলিক— “মিতালি তাড়াহুড়ো করেছিল। সে একসাথে সব শ্বাস মুক্তি দিতে চেয়েছিল, আর তাই সময়ের তাল নষ্ট হয়েছিল। ফল জানো তো?”
শায়ন্তনী মাথা নাড়ল।
— “তার মৃত্যু,” বৃদ্ধ বললেন, “আর শহরের কিছু অংশ আজও অচল হয়ে আছে।”
আকাশেশ গম্ভীর গলায় বলল, “তাহলে আপনি চান না আমরা পথ চালিয়ে যাই?”
— “চাই, কিন্তু শর্তে,” বৃদ্ধ বললেন, “এই গুদাম থেকে শ্বাস নিতে হলে তোমাদের একটাই মুহূর্ত বেছে নিতে হবে— যে মুহূর্তে শহর তোমাদের অনুমতি দেবে। ভুল মুহূর্ত বেছে নিলে, তোমরা এখানেই আটকে যাবে, সময়ের ভেতর।”
বৃদ্ধ তাদের একটি ঘড়ি দেখালেন— কাঁটা ১:১৭-এ থেমে আছে।
— “যখন এই ঘড়ি আবার ১:১৭-এ আসবে, তখনই শ্বাস ধরো।”
তারা অপেক্ষা করতে লাগল। গুদামের ভেতরে সময় যেন ধীরে চলতে লাগল— মিনিট যেন ঘণ্টা, ঘণ্টা যেন দিন। অপেক্ষার মাঝে শায়ন্তনীর চোখে ভাসতে লাগল মিতালির ছবি— হাসিমুখ, তারপর আতঙ্ক, আর শেষে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
অবশেষে ঘড়ির কাঁটা ১:১৭-এ এলো। আকাশেশ যন্ত্রটা ঘড়ির নিচে ধরতেই কালো ধোঁয়া দ্রুত পাক খেল, আর গম্বুজে ভেসে উঠল এক ফিসফিস কণ্ঠ—
“শেষ দুই নোঙরে সাবধান… রক্ষকেরা আর অপেক্ষা করবে না…”
শ্বাস ধরা পড়তেই গুদামের সব ঘড়ি থেমে গেল। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বললেন, “তোমরা সঠিক মুহূর্ত বেছেছ। কিন্তু মনে রেখো, পরের নোঙরে যাওয়ার পথ সরল হবে না। কুমোরটুলির মাটি আর চেতলার সময় একসাথে মিললে শহরের গভীরতম ঘরগুলো খুলে যাবে।”
গুদাম থেকে বেরিয়ে তারা বাইরে এল, কিন্তু বাইরে এসে বুঝল, রাত এগিয়ে যাওয়ার বদলে যেন পিছিয়ে গেছে— ঘড়িতে ১২:০৫। শায়ন্তনী আকাশেশের দিকে তাকাল— “আমরা কি সময় হারালাম?”
আকাশেশ ধীরে বলল, “না, সময় আমাদের হারিয়েছে।”
পর্ব ৯: নদীর ঘরের সতর্কবার্তা
দক্ষিণেশ্বরের ঘাট ভোরের আলোয় যেমন শান্ত, রাত নামলেই তেমনই গম্ভীর হয়ে যায়। গঙ্গার কালো জলে দূরের আলোয় ছায়া ভেসে ওঠে, ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে আসে ঘণ্টার ধ্বনি আর ভাসমান ফুলের গন্ধ। কিন্তু এই রাত অন্য— আকাশ মেঘে ঢাকা, আর বাতাসে একরকম ভার, যেন নদী নিজেই গভীর শ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো গোডাউন— কাঠের দরজা আধভাঙা, ছাদের টালির কিছু অংশ নেই, আর দেওয়ালের রঙ খসে গিয়ে ধূসর হাড়ের মতো বেরিয়ে পড়েছে। আকাশেশ মানচিত্রে আঙুল দিয়ে দেখাল, “এটাই ষষ্ঠ নোঙর— নদীর ঘর। এখানে শ্বাস সবচেয়ে ভারী, কারণ জল একে ধরে রাখে।”
শায়ন্তনী ধীরে ধীরে দরজা ঠেলল। ভিতরে পা রাখতেই এক ঠান্ডা স্রোত গায়ে লাগল— যেন বাতাস নয়, বরং জল বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। গোডাউনের মেঝে কাদামাটি আর পচা কাঠে ভরা, আর এক কোণে পুরোনো বালতি, দড়ি আর ভাঙা নৌকার পাল।
আকাশেশ শ্বাস-ধরার যন্ত্র চালু করল। গম্বুজের ভিতরে কালো ধোঁয়া প্রথমে স্থির, তারপর হঠাৎ পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল। আর ঠিক তখনই শোনা গেল গভীর এক নারীকণ্ঠ— নদীর মতো গম্ভীর, তবু তাতে ব্যথা:
“আমার শ্বাস ফিরিয়ে দাও… কিন্তু সাবধান… সব শ্বাস মুক্তি মানে শহরের ভাঙন…”
শায়ন্তনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
কণ্ঠ উত্তর দিল, “আমি নদীর ঘর… আমি সব দেখেছি… শহরের জন্ম, মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা…”
আকাশেশ বলল, “আপনার শ্বাস কোথায় যেতে চায়?”
— “যেখান থেকে এসেছি— বৌবাজারের আমগাছের শিকড়ে। কিন্তু এবার পথ বন্ধ আছে… রক্ষকেরা দেয়াল তুলেছে।”
শায়ন্তনীর মনে পড়ল, বৌবাজারে রক্ষক পুরুষ কীভাবে সতর্ক করেছিল— সব নোঙর মুক্তি মানে বিপদ। এখন নদীর ঘরের কণ্ঠও একই সতর্কতা দিচ্ছে।
ঠিক তখনই দরজার বাইরে শব্দ হলো— ভারী বুটের পায়ের আওয়াজ, যেন একসাথে অনেকজন এগিয়ে আসছে। আকাশেশ চোখের ইশারায় যন্ত্র বন্ধ করল। বাইরে তাকাতেই দেখা গেল তিনজন রক্ষক— দু’জন পুরুষ, একজন মহিলা— চোখে সেই ধাতব দীপ্তি।
একজন বলল, “এখানে শ্বাস নেওয়া যাবে না।”
শায়ন্তনী দৃঢ় গলায় বলল, “আমরা মিতালির পথ শেষ করছি।”
মহিলা রক্ষক এগিয়ে এসে বলল, “মিতালিও ভেবেছিল সে শেষ করবে। কিন্তু সে ভুলেছিল— সব নোঙর একসাথে ভাঙলে শহর আর থাকবে না।”
আকাশেশ বলল, “শহর যদি সত্যিই বাঁচতে চায়, তবে শ্বাস চলাচল থামানো যাবে না।”
রক্ষক পুরুষ ধীরে বলল, “তাহলে তোমরা শহরের মৃত্যুকেও মেনে নিচ্ছ?”
বাতাস হঠাৎ ভারি হয়ে গেল, আর নদীর ঘরের কণ্ঠ আবার শোনা গেল— এবার যেন সবার কানে একসাথে পৌঁছল:
“আমাকে ছাড়ো… কিন্তু শর্তে— শেষ নোঙর খোলার আগে সত্য জানো।”
আকাশেশ শায়ন্তনীর দিকে তাকাল। দু’জনেই বুঝল, নদীর ঘর চাইছে তারা যেন শেষ নোঙরে যাওয়ার আগে মিতালির মৃত্যুর সত্য খুঁজে বের করে।
যন্ত্রে ধরা শ্বাস ধীরে ধীরে গম্বুজে জমতে লাগল। রক্ষকেরা আর বাধা দিল না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, যেন নিজেরাই দ্বিধায়।
শ্বাস ধরা পড়তেই নদীর গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠল— লবণ, কাদামাটি আর ভিজে কাঠের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত আভাস দিচ্ছে। শায়ন্তনীর মনে হলো, এই শ্বাস শহরের বুকে কোনও পুরোনো ক্ষত খুলে দিতে পারে।
গোডাউন থেকে বেরোবার সময় রক্ষকদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে বলল, “শেষ নোঙরে যাবার আগে কলেজ স্ট্রিটের প্রেসে ফেরত যাও। মিতালির শেষ রেকর্ডিং সেখানে আছে। ওটা ছাড়া শেষ দরজা খোলেনি।”
রাতের গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে শায়ন্তনী বুঝল— এখন পথ দুই ভাগে। একদিকে শেষ নোঙর, অন্যদিকে মিতালির সত্য। আর এই দুই পথই একসময় মিলবে, কিন্তু কোথায় মিলবে, তা শহরই জানে।
পর্ব ১০: শেষ নিশ্বাস
কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরোনো প্রেসে ফিরে আসার পথে শায়ন্তনীর মনে হচ্ছিল, সে যেন বারবার একই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, অথচ প্রতিবারই শহরের মুখ বদলে যাচ্ছে। গলির মোড়ে আজ বাতিগুলো ভিন্ন ছায়া ফেলছে, দোকানের শাটার যেন আরও পুরোনো, আর বাতাসে সেই ধাতব গন্ধ— যা সে কেবল শ্বাস নোঙরের কাছেই টের পেয়েছে।
প্রেসের গেট এ বার তালা মারা। আকাশেশ পকেট থেকে ছোট্ট লোহার চাবি বের করল।
— “এটা মিতালির,” সে বলল, “তার মৃত্যুর পর আমি রেখেছিলাম।”
ভেতরে ঢুকতেই শায়ন্তনী দেখল, প্রেস আগের চেয়েও নির্জন। ছাপাখানার রোলার ধুলোয় ঢাকা, কিন্তু মাঝখানে রাখা কাঠের টেবিলে এক অদ্ভুত যন্ত্র— টেপ রেকর্ডার আর প্রোজেক্টরের সংমিশ্রণ। পাশে একটা কাঁচের জার— তার ভেতরে অর্ধেক ভরা কালি, যার মধ্যে সূক্ষ্ম বুদবুদ উঠছে, যেন কেউ ভেতর থেকে শ্বাস ছাড়ছে।
আকাশেশ যন্ত্রটা চালু করল। প্রথমে শুধু হাওয়ার মতো শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে কণ্ঠ স্পষ্ট হলো— নারীর কণ্ঠ, কাঁপা অথচ দৃঢ়:
“আমি মিতালি রায়। যদি এই রেকর্ডিং শোনো, বুঝবে আমি শহরের শেষ শ্বাসের পথে আছি। আকাশেশ, যদি তুমি শোনো— মনে রেখো, সব নোঙর একসাথে খোলা যাবে না।”
শায়ন্তনী আকাশেশের দিকে তাকাল, কিন্তু সে চুপ।
রেকর্ডিং চলতে লাগল—
“শুদ্ধাংশু আমাকে থামাতে চাইছে, কারণ সে জানে শেষ নোঙর খুললে শহরের লুকোনো ইতিহাস উঠে আসবে— যা তার নিজের পরিবারকে ধ্বংস করবে। কিন্তু আমি জানি, সত্য ঢেকে রাখলে শহরের শ্বাস বিষাক্ত হবে। তাই আমি যাচ্ছি শেষ দরজায়… যদি ফিরতে না পারি, আমার শ্বাসও নোঙরের অংশ হয়ে যাবে।”
শব্দ থেমে গেল, কিন্তু প্রোজেক্টরের লেন্সে হালকা ঝিলিক উঠল। দেয়ালে ভেসে উঠল এক দৃশ্য— মিতালি নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে, হাতে সেই শ্বাস-ধরার যন্ত্র। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে অদ্ভুত শান্তি। হঠাৎ পেছনে কারও ছায়া— চেনা ধাতব দীপ্তি। তারপর ছবি কেঁপে উঠল, মিলিয়ে গেল।
শায়ন্তনী গভীর শ্বাস নিল, “মানে, রক্ষকই তাকে…”
আকাশেশ ধীরে বলল, “হয়তো, বা হয়তো রক্ষকরা কেবল উপস্থিত ছিল। মিতালি নিজেও জানত, এই পথে গেলে ফেরা নেই।”
ঠিক তখনই প্রেসের দরজায় শব্দ— ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে। ভেতরে ঢুকল তিনজন রক্ষক, যাদের তারা নদীর ঘরে দেখেছিল। মহিলা রক্ষক সোজা শায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখন মিতালির জায়গায়। শেষ সিদ্ধান্ত তোমার।”
শায়ন্তনী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি শেষ নোঙর খুলব।”
রক্ষক বলল, “তাহলে জানো— শেষ নোঙর খুললে শ্বাস শহরে ফিরে যাবে, কিন্তু শহরের পুরোনো ঘরগুলোও জেগে উঠবে। সেখানে যা আছে, তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।”
আকাশেশ বলল, “আমরা চেষ্টা করব।”
রক্ষকেরা সরে দাঁড়াল, যেন অনুমতি দিল। শায়ন্তনী শ্বাস-ধরার যন্ত্রে প্রেসের কালি ঢালল। গম্বুজের ভেতরে ধোঁয়া পাক খেল, তারপর ভেতর থেকে এক বিশাল শ্বাস বেরিয়ে এসে প্রেসের দেয়াল ভেদ করল। বাইরে শহরের দিকে হাওয়া ছুটে গেল— গলি, বাড়ি, ছাদ, নদীর ঘাট— সব জায়গায় যেন অদৃশ্য ঢেউ লাগল।
দূর থেকে শোনা গেল একসাথে হাজার কণ্ঠ— কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ নাম ধরে ডাকছে। শহর যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল।
কিন্তু সেই সাথে শুরু হলো অন্য কিছু— দূরের পুরোনো বাড়ির জানালা নিজে থেকে খুলে গেল, পরিত্যক্ত থিয়েটারে আলো জ্বলে উঠল, নদীর ঘাটে ফাঁকা নৌকা ভেসে এল। শায়ন্তনী জানে, এ সবকিছুই শহরের সেই পুরোনো স্মৃতি, যা বন্ধ ছিল।
রক্ষকেরা চুপচাপ চলে গেল। আকাশেশ ধীরে বলল, “এখন থেকে শহর আমাদের শ্বাসের অংশ। আর আমরা শহরের।”
প্রেসের বাইরে বেরোতেই শায়ন্তনী দেখল, হাওয়ায় সেই কালি-গন্ধ মিশে আছে, আর তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি। মিতালির কথা মনে পড়ল— “সব শ্বাস মুক্তি মানে শহরের মুখ বদলে যাবে।”
আজ সেই বদল শুরু হয়েছে।
শেষ




