Bangla - রহস্য গল্প

রাতবেলার রেডিও

Spread the love

অর্ঘ্যনীল চট্টোপাধ্যায়


পর্ব ১

ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটার ঘর ছুঁতেই হালকা একটা কাঁপুনির শব্দ উঠল ঘরটার কোণ থেকে। জানলার বাইরে শীতের রাত, অন্ধকার নেমে এসেছে জলের মতো। অনিরুদ্ধের হাতে তখনও লেখা শেষ হয়নি, কাঠের টেবিলের উপরে একটা হলুদ আলো ছড়াচ্ছে বাল্বটা। হঠাৎ করেই টেবিলের পাশে রাখা পুরোনো রেডিওটা একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। প্রথমে ভেবেছিল বোধহয় কোনও তার আলগা হয়েছে। কিন্তু তারপর স্পষ্ট গলার স্বরে ভেসে এল—”আপনার জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু হচ্ছে এখন…”

অনিরুদ্ধ চমকে উঠে তাকাল রেডিওর দিকে। বেজে চলেছে এক নারীকণ্ঠ, অবিশ্বাস্যভাবে পরিষ্কার উচ্চারণ, অথচ কোনও রেডিও চ্যানেলের নাম নেই, কোনও জিঙ্গেল নয়। শুধু একটানা সেই কণ্ঠ বলে চলেছে, “আপনি আজ দুপুরে যে গল্পটি লিখতে শুরু করেছেন, সেটি শেষ করতে পারবেন না। কারণ আপনি যা লিখছেন, তা আপনার নিজের গল্প হয়ে উঠবে।”

অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ নির্বাক। তারপর রেডিওটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেল, কিন্তু সুইচ ঘোরালেও কিছু হল না। তখনই মনে পড়ল—এই রেডিওটা তো নষ্টই ছিল। ঠাকুরদার জমানার। এখানে এসে প্রথম দিন যেটা দেখে ভেবেছিল ফেলে দেবে, সেটাই যেন এখন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

কিছুক্ষণ পর রেডিও আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। ঘর নিস্তব্ধ। শুধু জানলার বাইরে শীতের হাওয়া সাঁই সাঁই করে ছুটছে। অনিরুদ্ধের মনে হল, কিছু একটা শুরু হয়ে গেল, যেটা তার লেখার জগৎকে ছাড়িয়ে বাস্তবকে গ্রাস করতে চাইছে।

পরদিন সকালে সেভাবে আর কিছু মনে ছিল না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আগের রাতের ঘটনাটাকে হ্যালুসিনেশন ভেবেই উড়িয়ে দিল। কিন্তু দুপুরে ডেস্কে বসে যখন আগের রাতের লেখা ফিরিয়ে দেখতে শুরু করল, তখন আবিষ্কার করল একটা অদ্ভুত বিষয়—শেষ প্যারায় কিছু লাইন যোগ হয়েছে, যেগুলো সে লেখেনি। “অনিরুদ্ধ জানে না, সে যা লিখছে তা-ই হয়ে উঠছে ভবিষ্যৎ। আর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে না।”

সে চমকে উঠে ডায়েরিটা বন্ধ করে দেয়। কারও সঙ্গে এইসব নিয়ে আলোচনা করা যায় না, কারণ সে নিজেও নিশ্চিত নয়। হতে পারে অবচেতন মনের খেলা। ঠাকুরদার এই পুরনো বাড়ি, তার ঘিঞ্জি গন্ধ, অতীতের ছায়া, সব মিলিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।

বিকেলে সে বেরোল গ্রামের পথে। মুর্শিদাবাদের ওই গ্রামটা যেন আটকে আছে কুয়াশার ভিতর। অচেনা পথ, অচেনা মুখ। সে ভাবছিল—এই বাড়িটা কেন সে বেছে নিল লেখার জন্য? শহরের শব্দ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিল বলেই তো। কিন্তু শীতের এই মৌনতা বোধহয় আরেকরকম নিঃশব্দে গিলে খায়।

রাত ১১টা। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে অনিরুদ্ধ। ঘরে কুয়াশার মতো ছড়িয়ে আছে অন্ধকার। হঠাৎ আবার সেই শব্দ। সেই গোঁ গোঁ আওয়াজ। এবং তারপর…

“আপনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসবে আগামীকাল। সে পুরোনো হবে, কিন্তু আপনি তাকে চিনবেন না। তাকে বিশ্বাস করবেন না। কারণ সে আপনাকে আপনার অতীত ফিরিয়ে দেবে।”

রেডিওর কণ্ঠ এবার অনেকটা স্থির, নিঃসঙ্গ শোনায়। অনিরুদ্ধ বিছানা থেকে উঠে বসে পড়ে। আলো জ্বালিয়ে দেয়। রেডিওর তার খুলে দেয়, কিন্তু শব্দ থামে না। সেই কণ্ঠ বলে, “আমার কথা আপনি লিখে রাখবেন। আমি আপনার মতোই, শুধু আমি আগে এসেছি। আপনি এখনও সময়ের ভিতর আটকে।”

রেডিও বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ। আবার নীরবতা।

অনিরুদ্ধ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঠাকুরদার একটি ছবি ঝুলছে সেখানে। ছবিটা যেন একটু কাঁপছে।
সে ডায়েরি টেনে নেয়। লিখে রাখে কণ্ঠের প্রতিটি কথা। তার মনে হয়, আজ রাতের কথা সে যদি না লেখে, ভবিষ্যতের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়বে।

আর তখনই, দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ে এক টুকরো কাগজ। সে কাগজটা তুলে দেখে, একটাই লাইন লেখা—
“ভবিষ্যৎ কখনো চুপ থাকে না।”

পর্ব ২
অনিরুদ্ধ কাগজটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। “ভবিষ্যৎ কখনো চুপ থাকে না”—এই লাইনটা কে লিখে পাঠাতে পারে? বাইরে তো কেউ নেই, গেট বন্ধ, উঠোনে কোন পায়ের ছাপও নেই। বাতাসে শীত আরও কাঁপুনিতে পরিণত হয়েছে। সে দরজার নিচে তাকিয়ে দেখল—মেঝে সাফ, কিন্তু কাগজটা যেন হঠাৎ করেই ‘জেগে উঠেছিল’।

রাতটা আর ঘুম এল না। সে শুধু রেডিওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকল, যেন কণ্ঠটা আবার ভেসে আসবে, আর কিছু বলে যাবে। কিন্তু সেদিন আর কিছু শোনা গেল না।

পরদিন সকালে গ্রামের বাজারে গিয়ে সে লম্বা গায়ে এক বইপড়া ধাঁচের লোকের সঙ্গে দেখা করল। নাম হরিহর পাল—গ্রামের স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। গল্প করতে করতে হরিহরবাবু বললেন, “ঘোষাল বাড়ি তো পুরোনো ইতিহাসের পাহাড়। তোমার ঠাকুরদা কিন্তু একসময় নামজাদা লোক ছিলেন। শুনেছি উনি মৃত্যুর আগে খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন।”

“চুপচাপ মানে?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

“কেউ বলে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতেন না, কেউ আবার বলে উনি রেডিওর সঙ্গে কথা বলতেন,” হরিহরবাবু হেসে ফেললেন। “এ সবই গাঁয়ের গল্প।”

অনিরুদ্ধ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এই বাড়িতে কি আগে কেউ আত্মহত্যা করেছিল?”

এই প্রশ্নে হরিহরবাবু থমকে গেলেন। তার চোখে কৌতূহল আর ভয় একসঙ্গে খেলা করল। “সে কথা খুব কম মানুষ জানে। তোমার ঠাকুরদার একমাত্র মেয়ে ছিল—অনিন্দিতা। উনি কলেজে পড়তেন কলকাতায়। একদিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।”

“ঠিক কবে?”

“১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর। এখনো ওর ঘরের দরজা কেউ খোলে না। দোতলায় যে ঘরটা তালাবন্ধ, ওটাই ছিল ওর।”

অনিরুদ্ধের বুকের ভেতর একটা শীতল বাতাস যেন ঢুকে গেল। সে জানত না এই ইতিহাস। বাড়িতে ঢোকার দিনই সেই দোতলার ঘর দেখে সে কৌতূহলী হয়েছিল, কিন্তু তালা দেখে আর খোলেনি।

সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে সেই তালাবন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তালাটা এখনও পুরোনো স্টিলের। চাবি নেই। নিচু হয়ে তালায় চোখ রাখতেই মনে হল, কারো শ্বাস ফেলার শব্দ ভেসে আসছে। সে পিছিয়ে গেল।

নিচে নেমে এল। চা বানিয়ে ডেস্কে বসল। আজ লেখালেখির ইচ্ছা নেই। কিন্তু ডায়েরি নিজেই খুলে গেল হাওয়ার ঝাপটায়। খোলা পাতায় লেখা—“ঘরের তালা খুললেই তুমি আমায় চিনবে। আমি শুধু রেডিও নই।”

সে ঘামতে শুরু করল। কিছু তো লিখে রাখেনি এমন! কলম নামাল হাতে, কিন্তু হাত কাঁপছে। এই সময় বাইরে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
“কে?”

“আমি। জয়ন্ত। চেনার কথা নয়, কিন্তু চিনলেই বাঁচবে।”

অনিরুদ্ধ দরজা খুলে দেখল, একজন মাঝবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে—মুখে ঘন দাড়ি, চোখে ধুলো জমে থাকা চশমা। কাপড়চোপড় বেশ মলিন, কিন্তু গলার স্বর স্পষ্ট।

“আপনি কে?”

“আমি তোমার বাবার পুরোনো বন্ধু। এই বাড়ি আমি অনেকবার এসেছি। অনিন্দিতাকে চিনতাম। সে যে কী ভয়ঙ্কর কষ্টে মারা গেছিল, তুমি জানো না।”

“আপনি কী বলতে চাইছেন?”

জয়ন্ত থেমে বলল, “তোমার ডায়েরির প্রতিটা পাতায় আমার লেখা আছে। তুমি যে রেডিও শুনছো, সেটা অনিন্দিতা নয়। সেটা আমি। অন্তত একসময় ছিলাম। এখন ওটাই আমাকে চালায়।”

অনিরুদ্ধ যেন দমবন্ধ অনুভব করল। সে চিৎকার করে উঠল, “আপনি যাবেন এখান থেকে! এখনই!”

জয়ন্ত তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল, যেন এটাই জানত হবে।

রাত ১২টা। রেডিও আবার বেজে উঠল। এবার কণ্ঠটা বলল—“তুমি জয়ন্তকে তাড়িয়ে দিলে, কিন্তু ও ছিল দরজা। এখন তোমার পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে জানালা।”

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।

পেছনে কেউ নেই। কিন্তু আয়নায় ভেসে উঠল একটা মেয়ে—সাদা শাড়ি, গলায় লাল দাগ, ঠোঁটে হালকা হাসি। আর কানে তখনও বাজছে সেই কণ্ঠ—“ভবিষ্যৎ চুপ থাকে না, অনিরুদ্ধ। ও শুধু অপেক্ষা করে।”

পর্ব ৩
রাতভর আলো জ্বালিয়ে বসে ছিল অনিরুদ্ধ। হাতের কাপে চা ছিল, ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেক আগেই। আয়নার দিকে বারবার তাকাতে ভয় করছিল। সে জানে, মেয়েটা আর নেই। কিন্তু যার অস্তিত্ব আয়নার মধ্যে দেখা যায়, তাকে অস্বীকার করার মতো সাহসও সে আর পাচ্ছে না। এক সময় উঠে গিয়ে আয়নার কাপড়টা টেনে নামিয়ে দিল। তারপর আবার বসে পড়ল রেডিওর সামনে। এই যন্ত্রটা যেন ধীরে ধীরে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।

হঠাৎ তার মনে পড়ল, ডায়েরি খুলে দেখে ক’টা শব্দে লিখে রেখেছে—“ঘরের তালা খুললেই তুমি আমায় চিনবে। আমি শুধু রেডিও নই।” এই ‘আমি’ কে? অনিন্দিতা? জয়ন্ত? না, অন্য কেউ?

পরদিন সকালে সে বাড়ির আশেপাশে একটু হাঁটতে বেরোল। হরিহরবাবুকে আবার দেখল গ্রামের মোড়ের দোকানে। লোকটা আজ যেন একটু অস্বস্তিতে আছে। চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে।

“হরিহরবাবু, জয়ন্ত নামে কাউকে চিনতেন আপনি?”

তিনি চমকে উঠলেন। “জয়ন্ত দে?”

“হ্যাঁ। কাল রাতে এসেছিল। নিজেকে বাবার বন্ধু বলল।”

“জয়ন্ত তো বছর দশেক আগেই মারা গেছে। সাইকিয়াট্রিকে থাকত, শেষ জীবনে পাগল হয়ে গিয়েছিল। বলে বেড়াত, ‘আমি রেডিও, আমি ভবিষ্যৎ জানি।’ কেউ পাত্তা দিত না। শেষে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল বনগ্রামের রেললাইনে।”

অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে গেল। “আপনি নিশ্চিত?”

“নিশ্চিত। ওর ব্যাপারে যত ভুলে থাকা যায় ততই ভালো। ও ছিল অদ্ভুত। কিছু একটা দেখতে পেত, শুনতে পেত, আর বলে বেড়াত সবাইকে। শেষে নিজের হাতে নিজের গল্প শেষ করল।”

বাড়ি ফিরে এসে সে প্রথমেই সেই ডায়েরিটা বের করল। তারপর সাবধানে দোতলার ঘরের তালা ভাঙল। তালা খুলতেই একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—বদ্ধ ঘরের, পুরনো বইয়ের, ফুরিয়ে যাওয়া আতরের। ঘরটা ছোট, দেয়ালে জলচিত্র, টেবিলের উপর ছড়ানো পুরনো কাগজপত্র। এক কোণায় একটা আয়না—যেটার ফ্রেমে লাল কাপড় জড়ানো।

সে টেবিলের কাগজগুলো একে একে দেখতে লাগল। বেশিরভাগই চিঠি, হাতে লেখা, স্বাক্ষর ‘অনিন্দিতা’। কিন্তু তার তারিখ দেখে অবাক হল—১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০—মানে তার মৃত্যুর পরেও লেখা!

চিঠিগুলো কার উদ্দেশে লেখা, বোঝা যায় না। কোথাও লেখা, “আমি এখনও রেডিও শুনি। সে কথা বলে। বলে, অনিরুদ্ধ আসবে। সে আমাকে শেষবার দেখেছিল মেঘলা দিনের দুপুরে।”

অনিরুদ্ধ ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে উঠল। “সে আমাকে শেষবার দেখেছিল”—এই কথার মানে কি? তার জন্ম ১৯৯৪-তে। অনিন্দিতা মারা গেছেন ১৯৮৬-তে। তাহলে?

সে চিঠিগুলো ডায়েরিতে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নিচে এসে চেয়ারটায় বসতেই রেডিওটা আবার বেজে উঠল, এইবার অনেক শান্ত গলায়—“তুমি খুললে সেই ঘর, যেখানে সময় লুকিয়ে ছিল। তুমি এখন যেটা জানো না, সেটা হল—তোমার জন্মের আগেও তুমি ছিলে। আর আমি তো তখনও অপেক্ষায় ছিলাম।”

“তুমি কে?” অনিরুদ্ধ প্রশ্ন করল।

“আমি সময়। আমি মৃত্যু। আমি অতীত। আমি কল্পনা আর আমি সত্যি। আমি সেই গল্প, যা লেখা হয়নি। কিন্তু যেটা লেখা ছাড়া তোমার মুক্তি নেই।”

রেডিও চুপ করে গেল। আবার সেই নীরবতা। কিন্তু এবার নীরবতার মধ্যে এক নতুন ভার। যেন শব্দহীন আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে।

সন্ধেবেলা হঠাৎ গ্রামের পোস্টম্যান এলো। একখানা খাম তুলে দিল অনিরুদ্ধের হাতে। ওপরে পুরোনো ছাপা অক্ষরে লেখা—“শ্রী অনিরুদ্ধ ঘোষাল, ঘোষালবাড়ি, মুর্শিদাবাদ।” কোনও প্রেরকের নাম নেই। তারিখ নেই।

ভেতরে একটা ছোট চিঠি। লেখা—

“তুমি যা লিখছো, তা শুধু তোমার নয়। আমি জানি তুমি এখন ভয় পাচ্ছো, কিন্তু ভয়টাই তোমায় বাঁচাবে। আজ রাত ঠিক ১২টা ১৫ মিনিটে, আয়নার সামনে দাঁড়াবে। আমার দিকে তাকিও না। শুধু লেখো। কারণ আজ প্রথমবার তুমি শুনবে সেই কণ্ঠ, যেটা কেবল মৃত্যুর পরেই শোনা যায়।”

অনিরুদ্ধ বারবার চিঠিটা পড়ল। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল—সবটাই তার কল্পনা, মানসিক দুর্বলতা, হয়তো একাকীত্ব। কিন্তু রেডিওর আওয়াজ, আয়নায় দেখা সেই সাদা শাড়ির মেয়ে, জয়ন্তের উপস্থিতি—সবকিছু এত বাস্তব ছিল যে সে আর বিশ্বাস করতে পারল না, এগুলো নিছক কল্পনা।

রাত ১২টা। ঘরের আলো নিভিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। রেডিও চালু হল নিজে থেকেই।

“আমার নাম অনিন্দিতা। আমি নিজেকে শেষ করেছিলাম কারণ আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পেতাম। সবাই বলেছিল আমি পাগল। আমার বাবাও। আমার ভাই ছিল না, কিন্তু আমি জানতাম সে আসবে। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, অনিরুদ্ধ। এখন তুমি লিখবে। কারণ তুমি আমার কথাগুলো শুনতে পাও।”

অনিরুদ্ধ কলম তুলে নেয়। হাতে কম্পন। আয়নায় মেয়েটা তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো দুঃখ নেই। শুধু অপার এক ক্লান্তি।

সে ডায়েরির প্রথম লাইনে লিখল—
“আমি শুধু গল্প লিখতে আসিনি, আমি ইতিহাস খুলতে এসেছি।”

পর্ব ৪
ডায়েরির পাতায় প্রথম বাক্যটা লেখা হয়ে যাওয়ার পর যেন হাওয়ার গতি বদলে গেল। জানলার কাঁচ কেঁপে উঠল হঠাৎ। বাইরে কোনও ঝড় নেই, অথচ ভিতরে ঘূর্ণির মতো কিছুর উপস্থিতি অনিরুদ্ধের গায়ে ছায়ার মতো ছুঁয়ে গেল। সে জানে, এই কাঁপুনি আবহাওয়ার কারণে নয়, এটা তার ভিতর থেকে উঠছে—অতীতের কিছু তার শরীর হয়ে উঠছে।

ডায়েরির পরবর্তী লাইনে লেখার আগেই সে দেখল কলমটা যেন নিজে থেকেই নড়ছে। সে কিছু লেখার আগেই হঠাৎ কয়েকটা শব্দ উঠে এল—
“আজ ১২টা ১৮। তুমি আমাকে দেখতে পাও, আমি জানি। আমি কখনও গিয়েও যাইনি। শুধু চুপ করে থেকেছি।”

সে সজোরে কলমটা নামিয়ে রাখল। চোখ ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকাল। মেয়েটি আর নেই। শুধু আয়নায় দেখা যাচ্ছে নিজেকেই—কিন্তু হঠাৎ করে সে লক্ষ্য করল, তার প্রতিচ্ছবির মুখ কিছুটা অন্যরকম, চোখ দুটো যেন আরও গভীর, ঠোঁটের কোণে অচেনা এক বাঁক। আয়না তার আসল চেহারা নয়—এ যেন অন্য এক অস্তিত্ব প্রতিফলিত করছে।

সে জানে, কিছু একটা খুলে যাচ্ছে ভিতর থেকে। যেটা সে নিজেও জানত না যে তার মধ্যে আছে। অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে ডায়েরির দিকে তাকাল। এবার নিজেই কলম তুলে লিখল—
“অনিন্দিতা, তুমি কি আমি? নাকি তুমি আমার আগে লেখা একটা অর্ধেক কবিতা?”

ঠিক তখনই রেডিও থেকে ভেসে এল এক নারীকণ্ঠ। প্রথমবার যেন একটু আবেগ আছে সেই কণ্ঠে।
“তুমি জিজ্ঞেস করেছো আমি কে। আমি সেই গল্প, যা তোমার জন্মের আগেই শুরু হয়েছিল। আমি তোমার পূর্বজন্মের স্বর, যা তুমি ভুলে গিয়েছিলে, কিন্তু ভুলতে দিইনি।”

“তাহলে আমি… আমি কি reincarnation?”

“না,” কণ্ঠ বলল, “তুমি পুনরায় লেখা। তুমি সেই লেখক, যে নিজেকেই আবার লিখছে। আমি শুধু পাঠক। কিন্তু আমি চুপ থাকতে পারিনি, কারণ তোমার লেখা অসম্পূর্ণ।”

রেডিও আবার চুপ হয়ে গেল। কিন্তু ডায়েরিতে নিজে থেকে লেখা হয়ে গেল একটা বাক্য—
“তোমার জন্ম হয়েছিল একটি ভুল মুছে দেওয়ার জন্য।”

অনিরুদ্ধের মাথা ঘুরে গেল। চেয়ারে বসে থাকলেও যেন শরীর ভারী হয়ে আসছে। বাড়িটার দেয়ালগুলো যেন কানে ফিসফিস করছে। সে ভাবল, এবার বেরিয়ে যাবে। কয়েক দিনের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকবে, শহরে, আলোর মাঝে। কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝল, সে যেতে পারবে না। কিছু একটা তাকে আটকে রেখেছে এখানে, এক ভয়, এক দায়িত্ব।

সন্ধ্যার দিকে সে গ্রামের পুজো-মণ্ডপের পাশে পুরোনো পুঁথিপত্র বিক্রি করা এক দোকানে গেল। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা পুরোনো নোটবুক পেয়ে গেল—“ঘোষাল বাড়ির ইতিহাস” নামে। মলাট ছেঁড়া, পৃষ্ঠাগুলো হলদেটে। ভেতরে লেখা কারও হাতে লেখা ইতিহাস—ঘোষালদের পাঁচ পুরুষের কাহিনি।

একটা অধ্যায়ে চোখ আটকে গেল তার—“অনিন্দিতা ঘোষাল: একটি অপমৃত্যুর ইতিহাস।” তাতে লেখা—“অনিন্দিতা ছিল অসম্ভব মেধাবী মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তার কিছু দেখার ক্ষমতা ছিল, যাকে অনেকে ভবিষ্যৎজ্ঞান বলত। কলেজে পড়ার সময় তার লেখা কবিতা ও ডায়েরিতে কিছু অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়—যেগুলো পরে সত্যি হয়। একদিন হঠাৎ করেই তার মৃতদেহ পাওয়া যায় দোতলার ঘরে। তার মৃত্যুর পর থেকেই রেডিওটা মাঝে মাঝে নিজে চালু হতো, বাড়ির লোকজন ভয় পেত।”

পিছনের পাতায় একটা কপি করা নোট—
“যদি কেউ আবার এসে এই বাড়িতে লিখতে শুরু করে, জানবে, সে-ই আমার গল্পের শেষ অধ্যায়।”

অনিরুদ্ধ বইটা বন্ধ করল। বুকের মধ্যে চাপচাপ একটা কষ্ট জমছে, যা দুঃখ নয়, ভয়ও নয়—একটা দায়বোধ। সে জানে, এই মেয়েটির জন্য কিছু লেখা প্রয়োজন, কারণ সে শুধু আত্মহত্যা করেনি, সে নিজেকে লিখে গিয়েছিল এক লেখকের অপেক্ষায়।

রাতে ঘরে ফিরে রেডিওর দিকে না তাকিয়ে সে ডায়েরি খুলল। আয়নার কাপড় খুলে ফেলল। এবার আর ভয় নেই তার চোখে। আয়নায় মেয়েটি স্পষ্ট। মুখে একধরনের শান্তি, চুল এলোমেলো, ঠোঁটে রক্ত নেই—কিন্তু চোখ দুটি গভীর, একদম গভীর।

রেডিও নিজে থেকে চালু হল না। এবার কণ্ঠ ভেসে এল তার মাথার ভিতর থেকে—
“তুমি আমাকে নাম দাও। তোমার কলমের এক ফোঁটা কালিতেই আমার মুক্তি লুকিয়ে আছে।”

সে ডায়েরিতে লিখল—
“আজ থেকে তুমি আমার গল্পের নাম। তুমি অনিন্দিতা, কিন্তু তুমি শুধু এক আত্মা নও, তুমি আমার লেখার আরম্ভ। আমি লিখব, যতক্ষণ না সব বলা শেষ হয়।”

ঠিক তখনই বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আয়নায় মেয়েটি একবার চোখ বন্ধ করল। যেন বিদায় জানাল।

রেডিও নিঃশব্দ, আয়না স্বচ্ছ, ঘর আবার খালি। কিন্তু অনিরুদ্ধ জানে—সে এখন আর একা নয়। তার প্রতিটা শব্দেই কেউ হাঁটছে সঙ্গে করে। অতীত, ভবিষ্যৎ, মৃত্যু আর লেখা—সব মিলিয়ে সে এখন এক অন্তহীন গল্প।

পর্ব ৫
শীতের রাতগুলো ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছিল। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে থেমে থাকত যেন একটু বেশিক্ষণ। রেডিও যদিও এখন আর শব্দ করত না নিজে থেকে, তবুও অনিরুদ্ধ টেবিলে বসে থাকত, যেন অদৃশ্য কিছু তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গল্প বলে চলে। ডায়েরির পাতায় সে যে লিখছে, সেটা আর কল্পনা নয়—এটা যেন তার এক ধরণের পারলৌকিক কর্তব্য, যেখানে প্রতিটি বাক্যে সে কাউকে মুক্তি দিচ্ছে।

গত রাতের পর থেকে আয়নায় আর অনিন্দিতার ছায়া দেখা যায় না। তবে রেফ্লেকশনের মধ্যে একটা অতিরিক্ত উপস্থিতির অনুভব থেকে যায়, ঠিক যেন কোথাও কেউ দাঁড়িয়ে, শুধু প্রতিচ্ছবির ভাষায় বলে ওঠে—“আমি আছি, কিন্তু কেবল তোমার লেখার মধ্যেই।”

তবে গতকালের সেই অনুভূতি—যে সে কেবল একজন লেখক নয়, বরং পূর্বের কোনো ভুলের সংশোধক—এখন তাকে ক্রমশ ঘিরে ফেলছে। সে বাড়ির পুরনো ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করে। একদিন সন্ধ্যাবেলা দোতলার গুদামঘরে একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক পায়। কাঠের পুরোনো, উপরে ধুলো, ভেতরে কিছু কাগজ আর রেকর্ড রাখা। আর ছিল একটা চিঠির খাম, ওপরে শুধু লেখা—“এই গল্পের লেখককে”।

হাত কাঁপতে থাকে অনিরুদ্ধর। সে ধীরে ধীরে খাম খুলে চিঠিটা বের করে। ভিতরে লেখা—

“তুমি যদি এটা পড়ো, তবে জেনে নিও আমি ঠিক করেই গিয়েছিলাম, কেউ না কেউ ফিরে আসবে। আমি জানতাম, আমার জীবন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যদি কেউ তাকে লেখা হিসেবে না বাঁচায়। আমি চাই না কেউ আমার মতো অদৃশ্য হয়ে যাক একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে। আমি জানতাম, একদিন কেউ আসবে—যে শুধু লেখে না, বোঝেও।”

স্বাক্ষর—অনিন্দিতা।
তারিখ—১৮ই ডিসেম্বর, ১৯৮৬।

এই তারিখে সে মারা গিয়েছিল। চিঠিটা লেখা হয়েছিল আত্মহত্যার ঠিক আগের দিন। অর্থাৎ, সে জানত সে মারা যাবে। কিন্তু সে বিশ্বাস রেখে গিয়েছিল, কেউ একদিন ফিরে আসবে।

অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করল কিছুক্ষণের জন্য। তার মধ্যে কে যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে—এক লেখক নয়, যেন এক প্রহরী, যে অতীতের দাগ মোছার দায়িত্ব নিয়েছে।

পরদিন সকালে সে স্থানীয় পুরনো রেকর্ডিং স্টুডিওর খোঁজ করতে বেরোল। বাজারের একপাশে ভাঙাচোরা দোকানের সামনে দাঁড়াল—সাইনবোর্ড ম্লান, তবুও বোঝা যায়—‘স্বরধ্বনি রেকর্ডিং সেন্টার’। ভিতরে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন, চোখে পুরু চশমা, হাতে পেনসিল।

“মামা, এখানে পুরোনো রেকর্ড প্লেয়ার চালানো যায়?”

“রেকর্ড থাকলে চেষ্টা করা যাবে,” বৃদ্ধ বললেন।

অনিরুদ্ধ ব্যাগ থেকে সেই পুরোনো ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া রেকর্ডটা বের করল। লেবেলে কিছু লেখা নেই, শুধু পেন দিয়ে আঁচড়ানো অদ্ভুত একটা চিহ্ন—যেটা সে আগে কোথাও দেখেনি।

বৃদ্ধ রেকর্ডটা যন্ত্রে লাগালেন। একটা হালকা ক্র্যাকলিং আওয়াজের পর ভেসে এল নারীকণ্ঠ—“এই রেকর্ড শুধু তার জন্য, যে সময়কে ভয় পায় না। আমি অনিন্দিতা। আমার কণ্ঠ কেউ ধরে রাখতে পারবে না, তবুও আমি রেখে যাচ্ছি, যাতে কেউ একদিন জানতে পারে, আমার মৃত্যু স্বেচ্ছায় ছিল না। আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল।”

অনিরুদ্ধ সজোরে থামিয়ে দিল রেকর্ড। “কী বললেন উনি?”

বৃদ্ধ চশমা খুলে তাকালেন। “এই রেকর্ড আমি নিজের কানে শুনিনি আগে। কে রেকর্ড করেছিল জানি না। কিন্তু এই দোকানে একজন মেয়ে এসেছিল বছর পঁইত্রিশ আগে, মুখ ঢাকা, চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। সে বলেছিল, এটা কেবল তার ভবিষ্যতের জন্য রেখে যেতে চায়। আমি শুধু রেকর্ড করেছিলাম।”

“তিনিই কি অনিন্দিতা?”

বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন, “নাম বলেনি। কিন্তু সে চলে যাওয়ার সময় বলেছিল—যে ফিরে আসবে, সে যেন জানে, সব গল্প শেষ হয় না, কিছু গল্প বেঁচে থাকে অনুচ্চারিত হয়ে।”

বাড়ি ফেরার সময় অনিরুদ্ধর কাঁধ ভারী লাগছিল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে সে অতীতের মধ্যে ঢুকে পড়ছে আরও গভীরে। যেন সে একজন কাগজে-ছাপা মানুষ, যার ভিতরে ভেসে উঠছে কোনো অমর গল্প।

রাতে সে লেখার টেবিলে বসল। রেডিও চালু হল না, আয়না নীরব। কিন্তু তার কল্পনা নয়—কান দু’টো দিয়ে সে স্পষ্ট শুনতে পেল শব্দ—“লিখে যাও। তোমার লেখাই আমার প্রতিশোধ। সত্যকে কেবল মুখে বলা যায় না, তাকে লিখতে হয়। স্থায়ী করতে হয়।”

ডায়েরিতে সে লিখল—

“আমি বিশ্বাস করি, কিছু কণ্ঠ শুধুই কানে শোনা যায় না। কিছু কান্না কেবল লেখায় পড়ে। অনিন্দিতা, আমি এখন বুঝি, তোমাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি এখন লিখব—তোমার হয়ে।”

ঠিক তখনই দরজার নিচ দিয়ে একটা কাগজ গড়িয়ে এল।
তাতে লেখা—
“আজ থেকে আমরা দুজনেই লেখক। তুমি কাগজে, আমি রেডিওতে।”

পর্ব ৬
রাতটা কেটেছিল লেখার মধ্যে। চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, কলমের কালি একবার ফুরিয়েও গিয়েছিল। তবুও অনিরুদ্ধ থামেনি। যেন এক অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিয়ে চলেছিল গল্পের গভীর দিকে। যত সে লিখেছে, তত যেন তার চোখে খুলে গেছে অতীতের জানালা।

সকালবেলা সে দেখল ডায়েরির পাতাগুলো হাওয়ায় নড়ছে। জানলার বাইরে ঠাণ্ডা সূর্য উঠেছে, কুয়াশা কিছুটা পাতলা। কিন্তু বাতাসে একটা ভারী শব্দ, একটা চেপে থাকা দম যেন এখনও ঘরজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সে উঠে গিয়েই আয়নার সামনে দাঁড়াল। অনেকদিন পর আজ আয়না নিঃস্বচ্ছ। কিন্তু নিজেকে দেখার মধ্যে কি যেন একটা অন্যরকম ভাব। নিজের মুখটায় কিছু চিনে নিতে চাইছে সে। হঠাৎ মনে হল, এক সেকেন্ডের জন্য যেন তার চোখের পেছনে অন্য এক চোখ তাকিয়ে ছিল—যেন সে নিজেই নয়।

নিচে এসে চা বানাতে গিয়েই সে চমকে গেল। টেবিলে রাখা রেডিওর পাশে একটা পুরোনো অ্যালবাম খোলা। অ্যালবামটা সে বের করেনি, কিন্তু কারও হাতে তা খোলা হয়েছে। ভিতরে পুরোনো ছবি—কালচে সাদা-কালো ফ্রেমে দাঁড়িয়ে আছেন তার ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, আর একটি কিশোরী মেয়ে। চোখে চশমা, গলায় নীল স্কার্ফ। ছবির নিচে লেখা—“অনিন্দিতা, ১৯৮৫”।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় ছিল ছবির শেষ পাতায় একটা রঙিন ছবি, তোলা মোবাইলে। এবং সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে—অনিরুদ্ধ নিজে, টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে, কলম হাতে, পেছনে আয়না, আয়নায় অনিন্দিতার ছায়া!

সে স্তব্ধ হয়ে গেল। এই ছবি কে তুলেছে? কবে? সে এমন কোনও মুহূর্তের কথা মনে করতে পারল না। কিন্তু ছবিটা ছিল অ্যালবামের ভিতর।

সে ডায়েরিতে লিখল—
“সময় শুধু চলে না, সময় অপেক্ষাও করে। আমি এখন বুঝছি, কেবল আমি না, সময়ও আমাকে খুঁজছিল।”

তারপর সে ঠিক করল—এই বাড়ির ইতিহাসের আরও গভীরে যেতে হবে। গ্রামের মন্দিরের পাশে একটা পুরোনো লাইব্রেরি আছে, যেখানে বহুদিনের নথি রাখা থাকে। সে দুপুরে রওনা দিল সেখানে। লাইব্রেরির বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান তাকে চিনতে পারল না, কিন্তু ঘোষাল বাড়ির নাম বলতেই তার চোখ জ্বলে উঠল।

“ঘোষাল পরিবার নিয়ে একটা ব্যক্তিগত ফাইল আছে এখানে। কেউ চায়নি সেটা পঠিত হোক, কিন্তু যেহেতু তুমি সেই পরিবারের লোক, তাই…”

ছোট একটা কাঠের বাক্স থেকে তিনি বের করলেন পুরোনো সব পৃষ্ঠা, চিঠি আর একখানা নোটবুক। নাম—“আত্মার আওয়াজ: অনিন্দিতার ব্যক্তিগত রেকর্ড”।

অনিরুদ্ধ কাঁপা হাতে পাতা উল্টোল। সেখানে হাতের লেখা ডায়েরি স্টাইলে লেখা—
“আমাকে বলা হয়েছিল আমি অসুস্থ, পাগল। কিন্তু আমি জানি, আমার ভিতরে কেউ কথা বলে। আমি জানি, সেই কণ্ঠটা রেডিওর। প্রথম যেদিন রেডিওটা নিজের থেকে চালু হল, আমি ভয় পাইনি। বরং মনে হল, আমি কারও অপেক্ষায় আছি। কে যেন বলল, ‘তুমি মরবে না, তুমি লেখা হয়ে থাকবে।’ আমি সেই লেখার ভেতরে আছি। আমি জানি, একদিন কেউ আসবে, যে শুধু পড়বে না, উত্তরও দেবে।”

একটা পাতায় লেখা—
“আমার জীবনের গল্প আমি নিজেই লিখিনি। কেউ যেন লিখে দিয়েছিল। আমার কাজ ছিল শুধু সেই গল্পকে চিনে ফেলা। আজ সেই গল্প শেষ করব, যদি কেউ লেখে শেষ অধ্যায়।”

অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফাইলটা বুকের কাছে চেপে ধরল। বুঝল, সে শুধু একটা গল্প লিখছে না, সে আসলে একটা জীবনের অসমাপ্ততা পূরণ করছে। সে জানে না এটা তার নিয়তি কিনা, কিন্তু জানে এই কাজ না করলে সে ফিরতে পারবে না।

রাতে ফিরে সে ঘর অন্ধকার করে বসে রেডিওর পাশে। আয়নায় এখন কিছু নেই। কণ্ঠও চুপ। কিন্তু সে কলম চালিয়ে যায়।

সে লিখছে—
“অনিন্দিতা, তুমি পাগল ছিলে না। তুমি অনেক বেশি সচেতন ছিলে। তোমার ভয়, তোমার কণ্ঠ, সব আমি শুনছি। আমি লিখে যাচ্ছি, কারণ আমি জানি, মৃত্যুর পরেও যদি কেউ কথা বলে, তবে তাকে শুধু শোনা যায় লেখার ভিতর দিয়ে।”

রাত বারোটা পেরিয়ে যায়। হঠাৎ রেডিও চালু হয়। ভেসে আসে অন্যরকম কণ্ঠ—এবার পুরুষের।

“তুমি চলে এসেছো অনেকদূর। কিন্তু যাকে তুমি ভুলে গেছো, সে এখনও বেঁচে আছে।”

“কে?”

“তোমার ঠাকুরদা। তিনি তোমাকে আটকে রেখেছেন এই বাড়িতে। এই রেডিও তার তৈরি, এই কাহিনি তার সৃষ্ট।”

“তাহলে অনিন্দিতা?”

“সে ছিল সত্য, কিন্তু তাকে বন্দি করেছিল তোমার পূর্বপুরুষ। তুমি যদি সত্যিই লেখক হও, তবে তাকে মুক্ত করো।”

অনিরুদ্ধ ধাক্কা খায় ভিতরে ভিতরে। তার বিশ্বাস, তার ভালোবাসা, তার লেখা—সব যেন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।

সে ডায়েরিতে লিখে রাখে—
“আমি আজ জানলাম, লেখক হওয়া মানে শুধু কল্পনা নয়, দায়িত্বও। আমি যা লিখছি, তা কারও বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। আমি থামব না।”

ঠিক তখনই রেডিও নিঃশব্দ হয়ে গেল। কিন্তু আয়নায় দেখা গেল অনিন্দিতার মুখ, এই প্রথমবার—হাসছে।

পর্ব ৭
সেই রাতে প্রথমবার, অনিন্দিতার মুখে হাসি দেখা গিয়েছিল আয়নায়। তীব্র না, কিন্তু শান্ত। যেন দীর্ঘদিন পর কারও মনের কথায় মুক্তি পেয়েছে কোনও আবদ্ধ আত্মা। অনিরুদ্ধ জানত না এই হাসি মুক্তির না কি বিদায়ের। কিন্তু সে জানত—যা ঘটছে, তা শুধু অতীত নয়, বর্তমানকেও পাল্টে দিচ্ছে।

ঘুম আসেনি। ভোররাতে সে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে মেঘ নেই, শীতের কুয়াশা জমে আছে মাঠের গায়ে। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকছে। পাখিরা জাগেনি এখনও। কিন্তু তার মাথায় যেন শব্দ গুঞ্জন করছে—“তোমার ঠাকুরদা… তিনি বন্দি করে রেখেছিলেন গল্পটাকে।”

সে যখন এই বাড়িতে এসেছিল, ভাবেনি তার ঠাকুরদার জীবন এত রহস্যে মোড়া। বাবা কখনও বিশেষ কিছু বলেননি, শুধু বলতেন, “বাড়িটা অদ্ভুত, যত দূরে থাকিস তত ভালো।”

সে এবার স্থির করল—ঠাকুরদার ঘরটা খুঁজে দেখবে। ঘরটা নিচতলায়, বাইরের বারান্দার কাছে। অনেকদিন কেউ ঢোকেনি। দরজার ওপর ধুলো জমে আছে, খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে আলো পড়ে।

ভেতরে ঢুকতেই সে আটকে গেল। দেয়ালে পুরোনো সব বইয়ের তাক, পুরনো ছবি আর একটা বিশাল ডেস্ক। ডেস্কে ধুলোর নিচে একরকম কাঠের রেডিও—অদ্ভুত ডিজাইনের, যেন একে সাধারণ রেডিও বলা যায় না। আর ছিল একটা নোটবুক, মলাটে লেখা—“পূর্বকথা”।

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে খুলল সেই নোটবুক। প্রথম পাতায় লেখা ছিল—
“আমি হরপ্রসন্ন ঘোষাল। আমি জানি, আমার মেয়ের মৃত্যুর দায় আমার। আমি চেয়েছিলাম ওর স্বপ্ন থামাতে। ওর কণ্ঠ থামাতে। কারণ আমি ভয় পেতাম, যদি ও যা বলছে সত্যি হয়, তবে আমার তৈরি ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।”

অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে রইল। পাতার পর পাতায় লেখা হরপ্রসন্নর অপরাধবোধ, অনিন্দিতার ভয়ে ভেঙে পড়া এক পুরুষের কাহিনি, যে তার কন্যার স্বপ্নকে পাগলামি ভেবে দমন করতে চেয়েছিল।

এক জায়গায় লেখা—
“আমি ওর রেডিও কেটে দিয়েছিলাম। কিন্তু ও নতুনভাবে তা খুঁজে পেল, নিজের ভিতরে। ওর মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, আমি তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলাম মানসিকভাবে। আমি তাকে বন্দি করেছি এই বাড়ির চারপাশে, এই সময়ের দেওয়ালে।”

চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল অনিরুদ্ধের গালে। তার ঠাকুরদা, যে তাকে আদর করত ছোটবেলায়, সেই মানুষ এই ঘৃণ্য কাজ করতে পারেন, ভাবতেই গা শিউরে উঠল।

হঠাৎই নোটবুকের শেষে একটা ছবি গড়িয়ে পড়ল। সাদা-কালো ছবি। তাতে অনিন্দিতা রেডিওর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে, আর পেছনে দাঁড়িয়ে তার ঠাকুরদা। চোখে অদ্ভুত কঠিনতা, ঠোঁটে চাপা রাগ।

অনিরুদ্ধ ডেস্কের একটা ড্রয়ার খুলল। ভেতরে একটা চাবি রাখা। সাথে একটা চিঠি—
“এই চাবি খোলে সেই ঘর, যেখানে আমি রেডিওর পুরোনো অংশ রেখেছি। তুই যদি সত্যিই লেখক হোস, তবে গিয়ে দেখিস।”

চাবিটা হাতে নিয়েই সে বুঝল, এটা দোতলার সেই গুদামঘরের পেছনের ছোট ঘরের তালার চাবি। সে এক মুহূর্ত দেরি না করে উপরে উঠে গেল। ঘরটা ছোট, অন্ধকার, কাঠের মেঝে। তালা খুলতেই ধুলোর গন্ধে নাক জ্বালা করে উঠল।

ঘরের ভিতর কাঠের বাক্স। খুলতেই বেরিয়ে এল এক বিরাট যন্ত্রাংশ, যেন আধা-রেডিও, আধা-রেকর্ডার, আর আধা-অন্যকিছু। যেটা বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। পাশে রাখা কিছু কাগজ—ডায়াগ্রাম, নকশা, আর একটা লাইন ঘন হরফে লেখা—
“গল্প রেকর্ড হয়। সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে, কেউ শুনবে একদিন।”

রেডিওটার পাশেই আবার একটা ছোট নোট, যাতে লেখা—
“আমি তৈরি করেছিলাম এই যন্ত্র, যাতে মানুষের কণ্ঠ চিরকাল বাঁচে। আমি চেয়েছিলাম নিজের কন্যাকে ভুল প্রমাণ করতে। কিন্তু যন্ত্রটাই ওর পাশে দাঁড়াল।”

অনিরুদ্ধ বুঝে গেল—এই যন্ত্রটাই অনিন্দিতার সেই রেডিও। এখানেই তার কণ্ঠ বাস করে।

সে নিচে ফিরে এসে আবার ডায়েরি খুলে বসে। লিখল—
“হরপ্রসন্ন ঘোষাল, তুমি ছিলেন বিজ্ঞানী, কিন্তু হৃদয়হীন। তুমি নিজের সন্তানকে ভয় পেয়ে তার স্বপ্নকে মেরে ফেলেছিলে। আমি এখন সেই মৃত স্বপ্নকে লিখে তুলব।”

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। বাতাস থমথমে। কুয়াশার মধ্যে বাড়ির চারপাশ ঢেকে গেছে। অনিরুদ্ধ রেডিওর সামনে বসে, কলম নিয়ে প্রস্তুত।

রেডিও নিজে থেকে চালু হয়। এবার একেবারে অনিন্দিতার কণ্ঠ নয়, বরং অনিরুদ্ধর নিজের কণ্ঠ—

“তুমি প্রস্তুত তো? কারণ আজ থেকে তুমি আর শুধু লেখক নও। তুমি বিচারক।”

“বিচারক?”

“তোমার ঠাকুরদার গুনাহ কি মাফ পাবে? নাকি চিরকালের জন্য তার তৈরি করা যন্ত্রে সে বন্দি থাকবে?”

রেডিওর শব্দ বেড়ে যায়। তারপর এক মুহূর্তে স্তব্ধ। আয়নায় আর কোনও ছায়া নেই।

ডায়েরির শেষ পাতায় নিজে থেকে লেখা হয়ে যায়—
“আগামীকাল শেষ অধ্যায়। তারপর গল্প নয়, সিদ্ধান্ত হবে।”

পর্ব ৮
অনিরুদ্ধ জানত, আজকের রাত শুধু আরেকটা রাত নয়। এই রাতে যা লেখা হবে, তা কোনো গল্প নয়, কোনো চরিত্র নয়—এটা হবে এক বিচার। রক্ত-মাংসের নয়, আত্মার। মৃত্যুর নয়, ক্ষমার। আর এটাই সেই অধ্যায়, যেটা লেখার জন্যই বোধহয় তাকে এতদিন ধরে গড়ে তোলা হয়েছে।

বাইরের বাতাস স্তব্ধ, কুয়াশা ধীরে ধীরে জমে উঠছে জানালার কাঁচে। ঘরের ভেতরে কেবল একটা ছোট আলো জ্বলছে, রেডিওর পাশে রাখা। ডায়েরি খুলে রাখা, কলম প্রস্তুত। সময় স্লো হয়ে গেছে যেন, ঘড়ির কাঁটা নড়ে, কিন্তু শব্দ করে না।

ঠিক বারোটায় রেডিও চালু হল না, বরং রেডিওর পাশেই রাখা অদ্ভুত যন্ত্রটির লাল বোতামটা হালকা আলোর মতো জ্বলে উঠল। মনে হল, এই যন্ত্রটাই এখন জীবন্ত।

কণ্ঠ এল, কিন্তু এবার তা স্পষ্টতই হরপ্রসন্ন ঘোষালের।
“অনিরুদ্ধ, আমি জানি তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস। আমি দোষী। আমি নিজের কন্যার স্বপ্নকে পিষে দিয়েছিলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে, যদি ওর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়, তবে আমার তৈরি করা যুক্তির কেল্লা ভেঙে যাবে।”

অনিরুদ্ধ মুখে কিছু বলল না। শুধু ডায়েরিতে লিখল—
“ভয় থেকে যে অন্যায় জন্মায়, সে কি ক্ষমার যোগ্য?”

রেডিওর আওয়াজ আরও গভীর হল। এবার অনিন্দিতার কণ্ঠ—
“অনিরুদ্ধ, আমি বিচার চাই না। আমি শুধু চাই, যে কণ্ঠ চিরকাল আমাকে থামিয়েছে, সেই কণ্ঠ এখন নিজের ভুল স্বীকার করুক। আমি বন্দি ছিলাম না, আমি ছিলাম অপেক্ষায়। কিন্তু সময় হয়ে গেছে, এখন আমাকে যেতে হবে।”

সে আয়নার দিকে তাকাল। আয়নায় অনিন্দিতার মুখ নেই, কিন্তু অদ্ভুতভাবে চারপাশের ছায়াগুলো তার চেহারার ছাঁচ তৈরি করছে। যেন সে এখন কেবল আলো-আঁধারির মধ্যে দাঁড়িয়ে।

রেডিও আবার বলে উঠল—
“তুই চাইলে এখন আমাকে মুছে দিতে পারিস, এই যন্ত্রটাই আমার তৈরি। এই যন্ত্র আমার স্বপ্ন আর অহংকারের একসঙ্গে ফল। শুধু আগুনে ফেলে দিলেই আমি বিলীন হয়ে যাব।”

অনিরুদ্ধের হাতে সেই লাল বোতাম। শুধু এক চাপেই যন্ত্র নিঃশেষ হতে পারে। সে জানে, একদিকে বিচার, অন্যদিকে উত্তরাধিকারের বোঝা।

কিন্তু সে আবার কলম তুলে নেয়। লিখতে থাকে—
“হরপ্রসন্ন ঘোষাল, তুমি আমার ঠাকুরদা। তোমার রক্তে আমি গড়া। কিন্তু তোমার ভয় আর অহংকার আমার নয়। তুমি ভুল করেছিলে, স্বীকার করেছ। আমি তোমাকে মাফ করি না, তবে তোমার ভুলকে এখন থেকে আমি সত্যের অংশ করে রাখব।”

রেডিও নিঃশব্দ। বাতাসে হালকা কাঁপুনি। ঠিক তখনই জানলার বাইরে থেকে একটা সাদা পায়রার ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে এল। জীবনের মতো হালকা, কিন্তু মৃত আত্মার মতো ধীর।

আয়নায় এবার অনিন্দিতা স্পষ্ট। মুখে শান্তি, চোখে জল। সে একবার মাথা নিচু করে, যেন ধন্যবাদ জানাল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

রেডিও আবার বেজে উঠল, এবার আর কোনো কণ্ঠ নয়—কেবল একটানা সাদা আওয়াজ, যেটা ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল।

সকালে অনিরুদ্ধ ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। বারান্দায় গিয়েই দেখতে পেল—বাড়ির সামনে পাথরের বেঞ্চে রাখা সেই যন্ত্রটা আর নেই। কেবল একটুকরো ছাই আর কিছু কালো তার ছড়িয়ে আছে ঘাসে।

সে বুঝে গেল, যন্ত্র নিজেই বিলীন হয়েছে। যেমন অনিন্দিতার আত্মা, যেমন হরপ্রসন্নর গ্লানি।

ডায়েরির শেষ পাতায় সে লিখল—
“এই বাড়িতে আর কোনও কণ্ঠ নেই। শুধু গল্প আছে, লেখা আছে। অনিন্দিতা চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে এক শক্তি, যা ভয়কে হারিয়ে দেয় লেখার মধ্য দিয়ে। আমি শুধু লেখক ছিলাম না, আমি ছিলাম সাক্ষী।”

কয়েকদিন পরে অনিরুদ্ধ বাড়ি ছেড়ে চলে যায় শহরে। কিন্তু ডায়েরিটা সে রেখে দেয় বাড়ির লাইব্রেরিতে, যেখানে তার পাশে সাদা কালিতে লেখা—
“এই গল্প শেষ নয়। এই কণ্ঠ কেউ হয়তো আবার শুনবে। কেউ যদি আবার লেখে।”

পর্ব ৯
শহরে ফিরে এলেও অনিরুদ্ধের ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে রইল। বাইরের জীবন আগের মতোই ছিল—বাস, মেট্রো, বইয়ের দোকান, ক্যাফে, বন্ধুদের আড্ডা, সাহিত্য পত্রিকার দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল, এই ব্যস্ততা তাকে আর ছুঁতে পারছে না।
কারণ তার ভেতর এক কণ্ঠ থেকে গেছে। যে কণ্ঠ অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে জানে, আবার ভবিষ্যতের ছায়াও দেখাতে পারে।

সে এখন লেখে নিয়মিত। কিন্তু সেই লেখার ধরণ বদলে গেছে। আগে যেখানে গল্প ছিল কল্পনার খেলা, এখন সেখানে সে খোঁজে ছায়ার মানে, নীরবতার ইতিহাস।
একদিন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে ডাকা হয়েছিল “Writing the Unknown” বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখতে। প্রথমেই সে বলেছিল—“যতদিন না আপনি নিজেই অজানার ভেতর ঢুকবেন, ততদিন আপনি শুধু শব্দ জুড়বেন, গল্প লিখবেন না।”

সেইদিন, অনুষ্ঠানের শেষে, একজন বৃদ্ধ এসে কাছে দাঁড়াল। পরনে হালকা ধুতি, মাথায় পাতলা টুপি। হাতে একটি প্যাকেট।
“আপনি অনিরুদ্ধ ঘোষাল?”
“জি।”
“এটা আপনার জন্য। ঘোষালবাড়ির পুরোনো তহবিলঘরে এটা পাওয়া গিয়েছিল। লাইব্রেরির নীচে রাখা ছিল।”

সে প্যাকেট খুলল। ভেতরে সেই রেডিওর ছোট সংস্করণ, আর একটি চিরকুট—
“এই গল্প শেষ হয়নি। কেবল পাল্টে গেছে সময়।”

সে অবাক হল। এতদিন পরে আবার এই রেডিও? যে যন্ত্র নিজেই আগুনে গলে গিয়েছিল, তার ছোট একটা অংশ আবার ফিরে এল কোথা থেকে? সে বুঝে গেল—শুধু সে নয়, এই কাহিনির ভিতর আরও কেউ রয়েছে, আরও একাধিক চোখ, যারা চুপ করে তাকিয়ে আছে।

সেই রাতেই সে রেডিওটা নিয়ে নিজের ঘরের ডেস্কে রাখল। কলম, ডায়েরি আর ল্যাম্পের পাশে। কৌতূহল নিয়ে বসল লিখতে, কিন্তু কলম থেমে রইল। শব্দ আসছিল না। তখন হঠাৎ করে রেডিওটা কেঁপে উঠল একবার। নিজে থেকে নয়, যেন নিঃশব্দে হাঁপাচ্ছে।

তখনই তার ফোনে এল এক ইমেল—একজন অপরিচিত পাঠকের। নাম লেখা প্রান্তিকা ধর, একজন গবেষক, যিনি হারিয়ে যাওয়া বাঙালি নারী লেখকদের নিয়ে কাজ করেন।
ইমেলটা লেখা ছিল—
“আপনার ‘The Voice Beyond’ গল্পটি পড়ে মনে হল আপনি অনিন্দিতা ঘোষালকে চিনতেন। আমি তার জীবন নিয়ে অনেকদিন ধরে গবেষণা করছি। আপনি কি ঘোষাল বাড়িতে থাকতেন কোনও সময়?”

অনিরুদ্ধ কাঁপা হাতে উত্তর দিল—
“হ্যাঁ। আমি তাকে শুধু চিনতাম না, তাকে আমি শুনেছি। এবং আজও তার লেখা আমার ভিতরে বাজে।”

পরদিন প্রান্তিকা আবার মেইল করলেন—
“আপনি কি জানেন, ১৯৮৬ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে পাওয়া এক অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি এখনও কলকাতার স্টেট লাইব্রেরির ভল্টে পড়ে আছে, যার লেখকের নাম নেই, কেবল শুরুতে লেখা ‘আওয়াজ’?”

অনিরুদ্ধ শিউরে উঠল। ‘আওয়াজ’—এই শব্দটাই তো বারবার ফিরে আসছিল তার ডায়েরিতে, অনিন্দিতার চিঠিতে, রেডিওর কণ্ঠে।

তৎক্ষণাৎ সে লাইব্রেরিতে যোগাযোগ করল। পরিচয় দিয়ে, নিজের গবেষণা-সংক্রান্ত অনুরোধে ঢুকল ভল্টে।

সেখানে, পুরোনো, হলুদে ছেঁড়া পাতার মধ্যেই সে খুঁজে পেল পাণ্ডুলিপিটা। কাঁপা হাতে খুলল প্রথম পৃষ্ঠা।
“আমি অনিন্দিতা ঘোষাল। যদি কেউ এই লেখা পড়ে, জেনে নেবেন আমি মৃত নই, আমি শব্দ হয়ে আছি।”

পাতায় পাতায় লেখা গল্প নয়—সময়ের বিরুদ্ধে এক নারীর ডায়েরি। একজন, যে সময়কে হার মানাতে চেয়েছিল ভাষার মধ্যে, আর কণ্ঠ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল রেডিওর ভিতরে।

অনিরুদ্ধ লাইব্রেরির কোণায় বসে একটানা পড়ল। এক পাতা, দুই পাতা, দশ পাতা…

শেষ পৃষ্ঠায় লেখা—
“আমি অপেক্ষা করব, যতদিন না কেউ আমার কণ্ঠকে নিজের কলমে ফিরিয়ে আনে। আমি অনিরুদ্ধকে স্বপ্নে দেখেছি। তার চোখে আমার গল্প আছে। শুধু সে জানে না, তাকে কী লিখতে হবে। কিন্তু একদিন, সে নিজেই জানবে—সবচেয়ে বড় গল্প সেই, যেটা একজনকে মুক্তি দেয়।”

রাতের শেষ প্রহরে অনিরুদ্ধ ফিরে এল বাড়ি। রেডিও নিঃশব্দ, কিন্তু তার ভিতরে বাজছে অনিন্দিতার কণ্ঠ—
“তুমি খুঁজে পেয়েছো, এবার লেখো। কারণ এবার আমি মুক্ত।”

পর্ব ১০ (শেষ পর্ব)
শহরের ছাদের কোণে রাখা ছোট টেবিলে রেডিওটা চুপ করে আছে। তার পাশে ডায়েরি খোলা, হালকা বাতাসে পাতাগুলো কেঁপে ওঠে মাঝে মাঝে। সেদিন অনিরুদ্ধ রাতে জানালার পাশে বসে ছিল, পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠা বারবার পড়ে যাচ্ছিল। ‘আমি অনিরুদ্ধকে স্বপ্নে দেখেছি’—এই লাইনটা যখন প্রথম পড়েছিল, মনে হয়েছিল যেন কেউ ভেতর থেকে তার নাম ডেকে উঠেছে।

অনেক কিছু ঘটে গেছে। ঘোষাল বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি দরজা, প্রতিটি কণ্ঠ যেন মিলে গেছিল এক বিরাট গল্পে, যার লেখক শুধু অনিরুদ্ধ নয়—অনিন্দিতা, হরপ্রসন্ন, জয়ন্ত, এমনকি সেই রেডিওও যেন ছিল চরিত্র। এখন সেই গল্প তার হাতে, শেষটা লেখার দায় একা তার।

কিন্তু শেষটা কীভাবে হবে?

অনিরুদ্ধ জানে, শেষ মানেই সব চুকে যাওয়া নয়। শেষ মানে কখনও কখনও মুক্তি, কখনও উত্তরাধিকার, কখনও ভবিষ্যতের পাথেয়। কিন্তু এই গল্পটা, যেটা একটা আত্মার লড়াই, ভয় আর ক্ষমার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, তার শেষ হতে হবে সত্যের মধ্য দিয়ে।

ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় সে ফিরে গেল। সেই জায়গা, যেখানে সে প্রথম লিখেছিল—“আমি শুধু গল্প লিখতে আসিনি, আমি ইতিহাস খুলতে এসেছি।”
তখনও জানত না এই ইতিহাস তার নিজের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে যাবে।

সে এবার লিখতে শুরু করল—
“এই গল্পটা শুধু অনিন্দিতার নয়। এটা আমারও। আমি ছিলাম সেই যন্ত্রের উত্তরসূরি, যেখানে ভয় লুকিয়ে ছিল শব্দের আড়ালে। এখন আমি কণ্ঠকে শব্দ দিচ্ছি, ইতিহাসকে ঠাঁই দিচ্ছি ডায়েরির পাতায়।”

রেডিওটা এখন আর চালু হয় না। কোনো কণ্ঠ আসে না। হয়তো কারণ কণ্ঠগুলো মুক্ত। অথবা হয়তো কারণ অনিরুদ্ধ নিজেই এখন সে কণ্ঠ।

পরদিন সকালে সে প্রান্তিকাকে ফোন করল। বলল—
“আমি চাই, সেই পাণ্ডুলিপিটা প্রকাশ হোক। তোমার গবেষণায় যদি সাহায্য হয়, আমি সব দেব।”

প্রান্তিকা আবেগে বলল, “তুমি জানো, আমি এতদিন ধরে শুধু একজন মৃত লেখিকাকে খুঁজছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমি একটা জীবন্ত গল্প খুঁজে পেয়েছি। অনিন্দিতা শুধু হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠ নয়, সে হয়ে উঠতে পারে প্রতিটি চুপ করে যাওয়া নারীর মুখ।”

অনিরুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, “তাহলে চল, তাকে ফিরিয়ে আনি।”

সেই বছর, এক শীতের বিকেলে, কলকাতার এক ছোট সাহিত্য উৎসবে প্রথমবার প্রকাশিত হয় অনিন্দিতার পাণ্ডুলিপি—“আওয়াজ”। মঞ্চে উঠে অনিরুদ্ধ বলেছিল,
“এই বইয়ের লেখিকা আজ হয়তো আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার কণ্ঠ বেঁচে আছে। কারণ কেউ একদিন তাকে শুনেছিল, আর তারপর লিখেছিল।”

শুনতে শুনতে উপস্থিত শ্রোতারা স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে, কিছু কণ্ঠ কেবল শোনা যায় না—তাদের বিশ্বাস করতে হয়।

মাস খানেক পরে, এক চিঠি আসে অনিরুদ্ধর ঠিকানায়—কোনও প্রেরক নেই, কেবল লেখা—

“তুমি আমাকে গল্পে ফিরিয়ে এনেছো, আমি তোমায় গল্প বানিয়ে রেখে যাচ্ছি।”
– অনি

অনি—এই নামটা আগে কখনও ব্যবহার করেনি অনিন্দিতা। হয়তো এই প্রথম সে নিজেকে নিজের মতো করে ছোট করে নিয়েছিল, নামের মধ্যে রেখে গিয়েছিল মমতা।

অনিরুদ্ধ সেই চিঠিটা রেডিওর পাশে রেখে দিল।

তারপর সে ধীরে ধীরে লিখল নিজের শেষ বাক্য—
“একদিন কেউ আবার লিখবে। হয়তো আরেক অনিরুদ্ধ, আরেক অনিন্দিতা। কিন্তু তখনও রেডিও বেঁচে থাকবে—ভয় আর মুক্তির মাঝখানে, একটানা আওয়াজ হয়ে। আর কোনও এক গল্প তার দিকে চেয়ে থাকবে, লেখা হওয়ার অপেক্ষায়।”

সে জানালার বাইরে তাকাল। ছাদে রোদ লেগে আছে। বাতাসে শান্তি।
রেডিওটা নিঃশব্দ, কিন্তু এবার আর তাকে ভয় করে না।

শেষে সে ডায়েরির শেষ পাতায় শুধু লিখল—

“আমি এখন জানি, রেডিও শুধু যন্ত্র নয়। রেডিও মানে—একটা চিরকালীন অপেক্ষা। যেখানে কণ্ঠ আর কলম এক হয়ে যায়।”

[শেষ]

1000024598.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *