Bangla - রহস্য গল্প

ভার্চুয়াল মৃত্যুর ফাঁদ

Spread the love

তমাল দাস


কলকাতা, ২০২৫ সালের গরমে দম বন্ধ করা এক সন্ধ্যা। সল্টলেকের এক সরু গলির ভেতরে সাজানো আধুনিক গেমিং ক্যাফেতে তখন ভিড় জমেছে একদল কিশোরের। বাহারি নিয়ন আলো, হেডফোন আর ভিআর হেডসেটের ভেতরে ডুবে থাকা তাদের চেহারায় যেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। ওই ভিড়ের মধ্যেই বসে ছিল অর্ণব, বয়স মাত্র ষোলো। হাত ঘামছে, নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা—কারণ সে পৌঁছে গেছে গেমের শেষ স্তরে, যেখানে জেতা মানে শহরের গেমার মহলে নায়ক হয়ে ওঠা। স্ক্রিনে ছুটে চলেছে এক ভয়ঙ্কর দানব, তাকে এড়াতে অর্ণব লাফাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, আঘাত করছে। আশপাশের বন্ধুরা উল্লাসে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে মুহূর্তগুলো। আর ঠিক তখনই, এক অদ্ভুত শব্দ বেরোল হেডসেট থেকে, অর্ণব হঠাৎ থমকে গিয়ে যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল। সে চিৎকারও করতে পারল না, মাথা পিছনে হেলিয়ে এক ধাক্কায় চেয়ারের ওপরে পড়ে গেল। গেমে তার অবতার যেভাবে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, বাস্তবে অর্ণবও নিথর হয়ে গেল মেঝেতে।

কিছুক্ষণ সবাই ভেবেছিল হয়তো এটা অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বা খেলার মজার অভিনয়। কিন্তু যখন দেখা গেল তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, মুখ বেগুনি হয়ে উঠেছে, তখন চারদিক কেঁপে উঠল। কেউ চিৎকার করে ডাকল, কেউ ফোনে অ্যাম্বুলেন্স নাম্বার ডায়াল করল, আর তার বন্ধুরা ভয়ে কেঁপে উঠে হেডসেট খুলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। ক্যাফের মালিক সুব্রত ছুটে এলেন, তিনি প্রথমে গালাগালি দিতে শুরু করলেন—“এতো হট্টগোল কেন?!” কিন্তু মৃতদেহের মতো অচল পড়ে থাকা অর্ণবকে দেখে মুহূর্তেই তার চেহারা সাদা হয়ে গেল। “হার্ট অ্যাটাক… নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক,”—কাঁপা গলায় বলল সে, যেন নিজেকেই বিশ্বাস করাতে চাইছে। অর্ণবের বাবা-মা যখন হাসপাতালে পৌঁছালেন, ডাক্তারও প্রাথমিক পরীক্ষায় তাই বললেন। কিন্তু যে ক’জন বন্ধুরা অর্ণবের শেষ গেমপ্লে লাইভ ভিডিও করেছে, তারা পরে ভিডিও দেখে আঁতকে উঠল। স্ক্রিনে দেখা গেল, ঠিক যেভাবে দানবের ধারালো অস্ত্র তার অবতারকে বিদ্ধ করছে, ঠিক একই মুহূর্তে অর্ণব বাস্তবে বুক চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ছে। কাকতালীয়? না কি এর পেছনে কোনো অশুভ পরিকল্পনা?

শহরে খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেলেটির মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ল—কেউ বলছে, ভিআর হেডসেটের ত্রুটি; কেউ বলছে, গেমের অতিরিক্ত আসক্তি শরীর সহ্য করতে পারেনি। কিন্তু যে ভয়ঙ্কর মিলটা সবাই দেখতে পাচ্ছিল—গেমে মৃত্যুর ধরন আর বাস্তবের মৃত্যু—সেটা যেন এক অস্বস্তিকর প্রশ্নচিহ্ন ছুঁড়ে দিল। বাবা-মায়েরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন, তাঁরা ছেলেমেয়েদের গেমিং ক্যাফে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, কেউ কেউ বাড়ির ভিআর ডিভাইস ভেঙে ফেললেন। সল্টলেকের সেই ক্যাফেতে আর কেউ যেতে চাইল না, কিন্তু গেমের নাম আর অর্ণবের মৃত্যু শহরের প্রতিটি অলিগলিতে ফিসফিস করে ছড়িয়ে পড়ল। রাতে আলো-আঁধারিতে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে লোকজন বলতে লাগল, “এই গেমে নাকি আসলেই মরা যায়… আত্মা আটকে যায় ভেতরে।” কিশোররা মুখে ভয়ের কথা বললেও, গোপনে আবারও লগইন করার লোভ সামলাতে পারল না। শহরের ওপর নেমে এলো এক অদৃশ্য ভীতির ছায়া, যেন প্রত্যেক গেমার এখন নিজের মৃত্যুর সঙ্গেই খেলা করছে।

অর্ণবের পরিবার ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু পুলিশের কাছে মামলা করতে গিয়ে তারা এক অদ্ভুত দেয়ালের মুখোমুখি হল। হাসপাতালের রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা, “হার্ট ফেইলিওর।” আর পুলিশও সেই রিপোর্ট ধরে বলল, “এখানে অপরাধ কোথায়?” কিন্তু অর্ণবের বন্ধুরা যেভাবে শপথ করে বলছিল, “ও গেমে যেমন মরল, বাস্তবেও তেমনই পড়ল,”—সেটা সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। অনেকেই ভেবেছিল ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে, একটি কাকতালীয় মৃত্যু হয়তো শহরের স্মৃতিতে চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু সত্যি হলো, এ তো কেবল শুরু। খুব শিগগিরই আরেকটি মৃত্যুর খবর আসতে চলেছে, আর সেটাই প্রমাণ করবে—এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং কলকাতার অন্ধকারে কেউ একজন ভার্চুয়াল দুনিয়ার ভেতরে বসে বাস্তব মৃত্যুর সুতো টানছে। শহরের বুকে প্রথমবার তখন সত্যিই শোনা গেল—“মৃত্যুর গেম।”

অর্ণবের মৃত্যুর পর দিন কয়েক কেটে গিয়েছিল, কিন্তু আতঙ্ক শহরের বুক থেকে মিলিয়ে যায়নি। একদিকে হাসপাতাল ও পুলিশের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হচ্ছে “হার্ট ফেইলিওর”, অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে তার শেষ খেলার ভিডিও। ভিডিওটাতে দেখা যাচ্ছে, গেমে দানবের আঘাত আর বাস্তবে অর্ণবের বুক চেপে ধরা—এই অদ্ভুত সমাপতন অনেকের মনেই প্রশ্ন তুলেছিল। খবরের কাগজে বড় করে লেখা হলো—“ভার্চুয়াল মৃত্যু নাকি বাস্তব ষড়যন্ত্র?” কলকাতার প্রতিটি পাড়ায় তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে গেমিং। বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের ক্যাফেতে যেতে দিচ্ছেন না, কেউ কেউ স্কুলে পর্যন্ত অভিভাবক-শিক্ষক মিটিং ডাকলেন। এই চাপে পড়ে অবশেষে পুলিশও বাধ্য হলো কেসটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে। মামলাটা পৌঁছালো কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখায়, কারণ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে ঘটনাটার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে প্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম যুক্ত। এ ধরনের কেস সচরাচর পাওয়া যায় না, তাই শাখার ভেতরেও একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই তদন্তের দায়িত্ব এল অফিসার অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের কাঁধে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, শরীরে ভারী গড়ন, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে সর্বদা সামান্য অন্যমনস্কতা। অরিন্দম ছিলেন মূলত গোয়েন্দা ধাঁচের মানুষ—মানুষের মুখভঙ্গি, কথাবার্তার ভেতরের ফাঁকফোকর, অসঙ্গতি ধরা তার প্রধান শক্তি। কিন্তু প্রযুক্তি নিয়ে তার জ্ঞান খুবই সীমিত। ল্যাপটপ বা ফোন ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু ভিআর হেডসেট, সার্ভার, এনক্রিপশন এসব শব্দ শুনলে মাথা ঘুরে যায়। তবে তাঁর ঊর্ধ্বতনরা জানতেন, অরিন্দমের অসাধারণ যুক্তিবোধ আর মানুষ পড়ার ক্ষমতা এই কেসে অমূল্য হতে পারে। তিনি দাপ্তরিক কাগজপত্র হাতে নিয়ে সল্টলেকের সেই গেমিং ক্যাফেতে পৌঁছে প্রথমেই চোখ বুলালেন দেয়ালে ঝোলানো পোস্টারগুলোয়—চোখে ধাঁধানো গ্রাফিক্স, রক্তাক্ত চরিত্র, অস্ত্র, জয়ের উত্তেজনা। অরিন্দম মনে মনে বললেন, “এক অদ্ভুত দুনিয়া, যার ভেতরে কী ঘটে বোঝাই যাচ্ছে না।”

তদন্ত এগিয়ে নিতে গিয়ে অরিন্দম বুঝলেন, এই গেমিং দুনিয়ার অন্ধকারে ঢুকতে হলে তাঁকে একজন বিশেষজ্ঞ চাই। পুলিশের নিজস্ব টেকনোলজি ইউনিটে লোক থাকলেও, তাদের অভিজ্ঞতা মূলত অনলাইন প্রতারণা, ব্যাঙ্কিং ফ্রড, হ্যাকিং জাতীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা অন্য—এখানে মৃত্যুর সঙ্গে মিশে আছে ভার্চুয়াল খেলার ছদ্মবাস। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তিনি খুঁজে বের করলেন একজন স্বাধীন সাইবার বিশেষজ্ঞকে—ঋদ্ধি চক্রবর্তী। বয়স ছাব্বিশ, চেহারায় সবসময় অগোছালো হাসি, কাঁধে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক, গায়ে ঢিলেঢালা টি-শার্ট, আর হাতে শক্ত করে ধরা ল্যাপটপ। কম বয়সে নাম করেছে সে শহরের হ্যাকার মহলে, তবে তার দক্ষতা শুধু হ্যাকিং নয়—ভার্চুয়াল গেমিং প্ল্যাটফর্ম, কোডিং, আর ডার্ক ওয়েব নিয়ে অবিশ্বাস্য জ্ঞান তার। অরিন্দম যখন প্রথম তাকে দেখলেন, মনে হলো যেন একদম ছেলেমানুষ, কিন্তু কয়েক মিনিটের কথোপকথনেই বোঝা গেল, এই ছেলে গেমের ভেতরের ভূতুড়ে গোলকধাঁধা বুঝতে পারবে একমাত্র।

প্রথম বৈঠকেই দুই বিপরীত মেরুর মানুষ যেন এক জায়গায় এসে মিলল। অরিন্দম ধীরস্থির, কথায় সংযত, মানুষের মনস্তত্ত্বে ডুবে থাকা; আর ঋদ্ধি চঞ্চল, রসিক, প্রতি পাঁচ মিনিটে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে হাত চালাচ্ছে ল্যাপটপে। কিন্তু দু’জনের উদ্দেশ্য এক—অর্ণবের মৃত্যু আসলেই হার্ট অ্যাটাক ছিল, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর ষড়যন্ত্র? ঋদ্ধি বলল, “স্যার, আপনারা যতই বলুন হার্ট অ্যাটাক, কিন্তু গেমে যা ঘটছে আর বাস্তবে যা ঘটছে—এটা কাকতালীয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেউ না কেউ সার্ভারের ভেতরে গেম কোড ঘেঁটে এমন একটা ফাঁদ তৈরি করেছে, যা খেলোয়াড়ের শরীরের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।” অরিন্দম চুপচাপ তার কথাগুলো শুনলেন। এ ধরনের টেকনিক্যাল বিষয় তিনি ভালো বুঝলেন না, কিন্তু ঋদ্ধির চোখে যে তীব্র আত্মবিশ্বাস, সেটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। নিজের সিগারেটটা জ্বালাতে জ্বালাতে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “আমি মানুষকে বুঝি, মেশিনকে নয়। তুমি মেশিনটা বোঝো, আমি মানুষগুলোকে বুঝব। চল, দেখা যাক খুনির মাথাটা কোথায় লুকিয়ে আছে।”

সল্টলেকের ভিড়ভাট্টা মিশ্র আধুনিকতা আর অচেনা অন্ধকারের মাঝে গড়ে উঠেছিল ছোট্ট সেই গেমিং ক্যাফে। বাইরে থেকে সাধারণ দোকানঘর—নীয়ন আলোয় ঝলমল করা নামফলক, ভেতরে সারিবদ্ধ কম্পিউটার আর কানে হেডফোন গুঁজে বসা তরুণ-তরুণী। কিন্তু দীপ আর শুভায়নের কাছে এখন এটি নিছক বিনোদনের জায়গা নয়; বরং এক সম্ভাব্য মৃত্যুঘর। তদন্তে যতটা এগিয়েছে, ততই পরিষ্কার হয়েছে—গত কয়েক সপ্তাহে যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সবগুলিই কোনো না কোনোভাবে এই ক্যাফের সার্ভারের সাথে যুক্ত। দীপ সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে ছুঁড়ে দিল, শুভায়ন চুপচাপ তাকিয়ে রইল উজ্জ্বল স্ক্রিনের সারির দিকে। খেলার উন্মাদনায় ডুবে থাকা ছেলেমেয়েদের মুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই, অথচ এখানেই লুকিয়ে আছে কোনো দানবীয় রহস্য। ঘরের ভেতরের কৃত্রিম আলো আর ঠান্ডা এয়ারকন্ডিশনের বাতাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তি দুজনকেই এক অচেনা চাপের মধ্যে ফেলছিল।

ক্যাফের মালিক সুব্রত পাল এক চল্লিশোর্ধ মানুষ, প্রথম দর্শনেই ধরা যায় ওর কাঁধে ভয়ের বোঝা। দীপ যখন ওকে জিজ্ঞেস করল—“এতগুলো মৃত্যু কি সত্যিই কাকতালীয়?”, তখন সুব্রত কেবল শুকনো গলায় বলল—“স্যার, গেমিং ক্যাফেতে হাজার মানুষ আসে যায়, সবাই তো ভালোই আছে। কয়েকজনের দুর্ঘটনাকে আমি কীভাবে সামলাই?” কিন্তু ওর চোখের ভেতর ছিল টলোমলো অনিশ্চয়তা, ঠোঁট কাঁপছিল অনুচ্চারিত আতঙ্কে। শুভায়ন লক্ষ্য করল, সুব্রতের হাতের আঙুলগুলো বারবার ডেস্কে ঠকঠক করছে, যেন অদৃশ্য কারও তাড়া খাচ্ছে। দীপ শান্ত গলায় আরও কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল—সার্ভার কোথায়, কে রক্ষণাবেক্ষণ করে, গেমিং নেটওয়ার্কে কোনো হ্যাকিং বা অস্বাভাবিকতা কি ধরা পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সুব্রত উত্তর দিচ্ছিল এমন ভঙ্গিতে, যেন তার নিজের মুখের কথার ওপর তারই ভরসা নেই। একদিকে ওর আত্মরক্ষার প্রবল চেষ্টা, অন্যদিকে চোখেমুখে ফুটে ওঠা ভয়ের ছাপ—দুটো একসাথে মিলে আরো অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।

রাত বাড়তেই ক্যাফের ভেতরে যেন অদ্ভুত এক আবহ তৈরি হল। দীপ খেয়াল করল, কিছু গেমের চরিত্র হঠাৎ হ্যাং হয়ে যাচ্ছে, সার্ভার লগে অচেনা কিছু কোড ভেসে উঠছে, আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ক্রিনে ঝলসে উঠছে গাঢ় লাল আভা। শুভায়ন একপাশে বসে ফিসফিস করে বলল—“এটা নিছক টেকনিক্যাল গ্লিচ না, কেউ ইচ্ছা করে করছে।” দীপ চোখ ছোট করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। যেসব কিশোরেরা গেম খেলছিল, তারা কেউই বুঝতে পারছে না ওই ক্ষণিকের পরিবর্তন; ওরা ডুবে আছে ভার্চুয়াল হত্যাযজ্ঞ আর প্রতিযোগিতায়। কিন্তু তদন্তকারীরা জানত—এই অল্প সময়ের অস্বাভাবিকতাই হয়তো মৃত্যুর সূত্র। হঠাৎই যেন কোথাও থেকে শীতল বাতাস এসে ক্যাফের ঘরটাকে জমিয়ে দিল। স্ক্রিনের আলোর আভায় সবার মুখ কঠিনভাবে ফুটে উঠছিল—কেউ উত্তেজনায়, কেউ অজান্তেই ভয়ে। শুভায়নের মনে হল, এই ক্যাফেটা শুধু গেমিং স্পেস নয়, বরং একটা অদৃশ্য জালে বাঁধা শিকারক্ষেত্র। আর সেই জালের মালিক কে, তা বুঝতেই তাদের লড়াই শুরু।

সুব্রত পালকে বাইরে বসিয়ে দীপ শুভায়নের সাথে আলোচনা করল। দীপ বলল—“এই মানুষটা অনেক কিছু জানে, কিন্তু বলছে না। হয়তো কারও চাপ আছে, হয়তো সে নিজেই জড়িত।” শুভায়ন সিগারেট ধরিয়ে হালকা ধোঁয়া ছাড়ল—“কিন্তু ভয়টা ওর চোখে সত্যি। কেউ যদি ওকে হুমকি দিয়ে থাকে, তবে সেটা প্রযুক্তির থেকেও ভয়ঙ্কর।” দুজনেই বুঝল, এ খেলায় প্রতিপক্ষ শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষের ভেতরের অন্ধকারও। আর সল্টলেকের এই গেমিং ক্যাফে এখন সেই অন্ধকারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। রাত গভীর হয়ে আসছিল, কিন্তু দীপের মনে হচ্ছিল—এই অন্ধকারের আসল রূপ এখনো তারা দেখতে পায়নি। সামনে আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে, আর প্রতিটি মৃত্যু যেন ক্যাফের ভেতর থেকে তাদের দিকে ঠান্ডা হাওয়ার মতো এগিয়ে আসছে। তদন্তের টেবিলে ছড়িয়ে থাকা প্রমাণপত্রের পাশে দীপ সিগারেটের ছাই ফেলে দিল—আগুন নিভে গেলেও ছাইয়ের নিচে এখনও গোপন শিখা লুকিয়ে আছে। ঠিক সেরকমই, এই ক্যাফের ছদ্ম নিরাপত্তার আড়ালে লুকিয়ে আছে আসল আতঙ্ক।

শহরের প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সেই নির্জন খেলার মাঠে আজ অদ্ভুত নীরবতা। কিছুদিন আগেও যেখানে সন্ধ্যা নামলেই ভিড় জমত, টিনের ছেলেরা ব্যাট-বল হাতে দৌড়াদৌড়ি করত, সেখানেই আজ হঠাৎ করে থমকে গেছে সবকিছু। এক কিশোর খেলোয়াড়, নাম রাহুল, যে প্রতিদিনই অন্য মৃত কিশোরদের সঙ্গে—অন্তত গুজব অনুযায়ী—খেলায় অংশ নিত, সে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। এলাকার বাসিন্দারা চুপচাপ থাকলেও ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে কাঁপছে; কারও সন্তানকে সন্ধ্যার পর মাঠে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, কেউ আবার রাত নামার আগেই দরজা-জানালা বন্ধ করে ফেলছে। সাংবাদিক তৃণা দত্ত যখন খবর সংগ্রহ করতে মাঠে পৌঁছোয়, তখন চারপাশে এক চাপা উত্তেজনা টের পায় সে—মানুষের কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসছে, চোখে মুখে অজানা ভয়ের ছাপ। রাহুল নিখোঁজ হওয়ার দিনটিও ছিল অন্য দিনের মতো, শুধু খেলার পর থেকে আর তার কোনো খোঁজ মেলেনি। অথচ প্রত্যেক সন্ধ্যায় সে যেভাবে হেসে খেলে বাড়ি ফিরত, তাতে মনে হতো একটুও অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না।

তৃণা স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে বুঝল, রাহুলই ছিল একমাত্র যে খেলার সময় প্রায়ই অদ্ভুত কিছু দেখতে পেত। ওরা বলে, রাহুল মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কারও সঙ্গে কথা বলত, অথচ পাশে কেউ থাকত না। কখনও কখনও সে হঠাৎ করে বল ফেলতে ফেলতে মাঠের বাইরে ছুটে যেত, যেন কেউ ডাকছে। অন্যরা ভয়ে কিছু বলত না, কিন্তু রাহুলের চোখে মুখে তখন এক ধরনের অদ্ভুত আলো জ্বলত। তৃণার মনে হচ্ছিল, এখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে রহস্যের সূত্র। আশ্চর্যজনকভাবে, রাহুল হারিয়ে যাওয়ার পর মাঠে আর সেই অদ্ভুত খেলা দেখা যায়নি, যেন তার অন্তর্ধানেই খেলার গোপন তালা বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর কেউ কেউ মনে করে, রাহুলকে ভূতেরা টেনে নিয়ে গেছে; কেউ কেউ আবার ফিসফিস করে বলে, এই ছেলেটি হয়তো আসলে জীবিত মৃতদের খেলার একমাত্র মানব-সাক্ষী, আর সেই কারণেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তৃণা যুক্তিগ্রাহ্য মানুষ, সে এসব কুসংস্কারে ভরসা না করে সত্যি খুঁজে বের করার শপথ নিল।

তৃণা একদিন রাহুলের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করল। বাড়িটি খুব সাধারণ—একতলা ছোট ঘর, সামনে একটা বাগান, কিন্তু ভেতরে ছড়িয়ে আছে অস্বস্তি। রাহুলের মা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এক অবসন্ন নারী, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, “ছেলেটা হঠাৎ একদিন গেল মাঠে, তারপর আর ফেরেনি। আমরা থানায় জানিয়েছি, কিন্তু পুলিশ বলে কিশোররা অনেক সময় পালিয়ে যায়, হয়তো কোনো বন্ধুর বাড়িতে আছে। কিন্তু আমি জানি, ও পালানোর ছেলে নয়।” রাহুলের বাবাও একমত হলেন, বললেন ছেলেটি খুব শান্ত প্রকৃতির, খেলাধুলা ছাড়া অন্য কোনো দুষ্টুমি করত না। তবে তাঁরা এটাও জানালেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাহুল রাতে ঘুমের মধ্যে অস্পষ্ট কথা বলত—কখনও কারও নাম ধরে ডাকত, কখনও হাসতে হাসতে কিছু বলত, যেন অদৃশ্য বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করছে। তৃণা খেয়াল করল, এই তথ্য পুলিশকে তারা বলেননি, কারণ ভয় পেয়েছিলেন—যদি সবাই পাগল ভেবে বসে? এ কথা শোনার পর সাংবাদিকের মনে স্পষ্ট হলো, রাহুল কেবল একজন সাধারণ কিশোর নয়, বরং এমন একমাত্র চরিত্র, যার মধ্যে দিয়ে পুরো রহস্যের পর্দা ফাঁস হতে পারে।

রাতের বেলা মাঠে ফিরে এসে তৃণা দেখল, চারদিকে নিস্তব্ধতা ঘনিয়ে এসেছে। বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, মাঠের ঘাসে অন্ধকারের ছায়া যেন লম্বা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সে এক কোণে দাঁড়িয়ে রাহুলের নাম ধরে ডাকল, কোনো সাড়া এল না। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো, যেন অচেনা দৃষ্টিতে কেউ তাকিয়ে আছে। তৃণা বুঝতে পারল, রাহুলকে কেউ ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রেখেছে, আর সে এখন এক অদৃশ্য খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। হয়তো রাহুলের কাছে ছিল সেই অমূল্য তথ্য—মৃত কিশোরদের খেলার আসল সত্যি। তাই তাকে সরানো হয়েছে, যাতে আর কেউ কিছু জানতে না পারে। সাংবাদিকের অভিজ্ঞ চোখে এ এক অস্বাভাবিক অপরাধের চিহ্ন, যেখানে জীবিত আর মৃতের সীমারেখা ঝাপসা হয়ে গেছে। তৃণা জানে, এই রহস্যের ফাঁস করতে গেলে তাকে আরও গভীরে নামতে হবে, আর সেই গভীরতা হয়তো ভয়ঙ্কর সত্যের দরজা খুলে দেবে। তবুও সে সংকল্প নিল, রাহুলকে খুঁজে বের করতেই হবে—কারণ ওই কিশোরই হয়তো একমাত্র জীবন্ত সূত্র, যাকে কেন্দ্র করেই শহরের এই অদ্ভুত খেলার রহস্য একদিন প্রকাশ্যে আসবে।

ঋদ্ধির চোখে তখনও কম্পিউটার স্ক্রিনের আলো লেগে আছে। সারা রাত জেগে থেকে সে চেষ্টা করছিল গেমিং কোম্পানির সেই পুরোনো ডেটাবেসে প্রবেশ করার, যেটা অনেকদিন ধরেই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে ছিল। তার আগের কয়েক রাত ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল ফায়ারওয়াল ভাঙতে গিয়ে, কিন্তু এবার যেন ভাগ্য তার পাশে ছিল। কোডের গভীরে ঢুকে সে এমন এক আর্কাইভ ফোল্ডার পেল, যেখানে সাধারণ ডেভেলপমেন্ট লগ নয়—বরং অদ্ভুত সংকেত আর এনক্রিপ্টেড ফাইল রাখা। ধীরে ধীরে ডিক্রিপ্ট করতে করতে সে বুঝল, এই গেমটার মূল ডিজাইনারের নাম সামনে চলে আসছে—অতীন্দ্র সেন। নামটা যেন তাকে ধাক্কা দিল, কারণ ঋদ্ধি তার কম্পিউটার সায়েন্সের কোর্সে এই নাম আগে শুনেছিল। একসময় কলকাতার নামকরা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, যার লেখা কোড নিয়ে টেক ব্লগগুলোতে আলোচনা হতো। অথচ ডেটাবেসের নথি বলছে, প্রায় পাঁচ বছর আগে তিনি হঠাৎ করেই চাকরি ছেড়ে গায়েব হয়ে যান। কোনো সংবাদপত্রে, কোনো অনলাইন ফোরামে আর তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই গায়েব হয়ে যাওয়ার মধ্যে এমন এক রহস্য ছিল, যা ঋদ্ধির মস্তিষ্ককে আরও অস্থির করে তুলল। মনে হচ্ছিল, গেমটার ভিতরে লুকোনো এই কোড আর অতীন্দ্র সেনের অন্তর্ধান, দুটো বিষয় এক সুতোয় বাঁধা।

সে জানত, শুধু নাম খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট নয়। তাই সে আরও গভীরে খোঁজ শুরু করল—ডেভেলপারদের মেইল ট্রেইল, পুরোনো প্রোজেক্ট নোটস, আর লগ ফাইলের মধ্যে খুঁজতে লাগল সেই মানুষটার শেষ ছাপ। তখনই সে দেখতে পেল এক ফোল্ডার, নাম দেওয়া আছে “Λmbrosia_Arc”. ভেতরে অদ্ভুত সব টেক্সট ফাইল, যেখানে প্রতিটি লাইনই প্রায় কবিতার মতো লেখা। যেমন—“যখন আলো ম্লান হয়ে যায়, খেলোয়াড় হয়ে যায় খেলনার অংশ।” এই ধরনের লাইন শুধু গেম ডেভেলপমেন্টের নোট হতে পারে না, বরং এগুলো মনে হচ্ছিল কোনো গোপন বার্তা। আরও চমক ছিল, কারণ প্রতিটি নথির মেটাডেটায় ‘Author: A. Sen’ লেখা। ঋদ্ধির মনে প্রশ্ন উঠল—অতীন্দ্র সেন কি ইচ্ছে করেই নিজের তৈরি গেমের ভিতরে বার্তা লুকিয়ে গিয়েছিলেন? আর যদি তাই হয়, তবে কার উদ্দেশ্যে? ধীরে ধীরে তার মাথার ভেতর একটা ধারণা স্পষ্ট হতে লাগল, যে এই গেমটা শুধু বিনোদনের জন্য তৈরি হয়নি; বরং এর ভিতরে লুকোনো আছে এমন কোনো কোড বা সত্য, যেটা হয়তো প্রকাশ্যে আসলে কারও জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

এমন সময় তার চোখে পড়ে একটি ফাইল, যেটা অন্য সব কিছুর থেকে আলাদা। নাম দেওয়া আছে—“ExitProtocol.final”. সেটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই স্ক্রিনে নীল অক্ষরে ভেসে উঠল এক সতর্কবাণী: “যদি তুমি এখানে পৌঁছে থাকো, তবে তুমি এমন এক খেলার অংশ, যেখান থেকে পিছু হটা সম্ভব নয়।” হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল ঋদ্ধির। ফাইলের ভেতর ছিল কিছু কোডের টুকরো, যেগুলো স্পষ্টতই গেমের অফিসিয়াল ভার্সনে নেই। বরং মনে হচ্ছিল এগুলো বিকল্প কোনো ভার্চুয়াল মডিউলের দরজা খুলে দেয়। কোডের প্রতিটি লাইনে যেন মিশে ছিল এক ধরনের পাজল—সংখ্যা, চিহ্ন আর শব্দ মিলে গঠিত অদ্ভুত ধাঁধা। এই ধাঁধা ডিক্রিপ্ট করতে করতে ঋদ্ধি উপলব্ধি করল, অতীন্দ্র সেন হয়তো নিজের হারিয়ে যাওয়ার আগে এই ডিজিটাল চিহ্ন রেখে গেছেন। যেন ভবিষ্যতের কোনো অনুসন্ধানী, তার মতো কারও জন্য দরজা খুলে দিয়েছেন। কিন্তু কেন তিনি তা করেছিলেন? তিনি কি কাউকে কিছু জানাতে চেয়েছিলেন? নাকি গেমের ভেতর এমন কোনো গোপন সত্য চাপা ছিল, যা প্রকাশ পেলে আসল কারণ জানা যেত কেন তিনি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন?

ঋদ্ধির মনে তখন দ্বন্দ্ব চলছে। সে বুঝতে পারছিল, যে পথ ধরে সে এগোচ্ছে তা শুধু প্রোগ্রামিং বা গেম হ্যাকিং-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বাস্তব মানুষের জীবন, তার হারিয়ে যাওয়া, আর সম্ভবত কোনো ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। গেমের কোড ভেদ করে সে যেন প্রবেশ করেছে এক সমান্তরাল বাস্তবতায়, যেখানে ভার্চুয়াল আর বাস্তবের ফারাক ঘুচে যাচ্ছে। ঘরে সিগারেটের ধোঁয়া ভাসছিল, জানলার বাইরের আলো ম্লান হয়ে আসছিল, অথচ ঋদ্ধি পর্দার সামনে বসে অনুভব করছিল তার প্রতিটি ক্লিকের সঙ্গে সঙ্গে সে আরও গভীর রহস্যে ডুবে যাচ্ছে। অতীন্দ্র সেনের নাম এখন তার কাছে শুধু এক ডেভেলপারের পরিচয় নয়, বরং সেই অদৃশ্য হাত, যিনি গেমটার ভিতরে অমোঘভাবে নিজের ছায়া রেখে গেছেন। ঋদ্ধির মনে হচ্ছিল, লুকানো নথির ভেতরে এক মহাসত্য চাপা পড়ে আছে, আর সেটাই তার সামনে খুলে যাবে—কিন্তু সেই সত্য জানার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো তার নিজের জীবনও পাল্টে যেতে পারে, একেবারে চিরকালের জন্য।

অরিন্দম অফিসের গোপন ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই এমন কিছু তথ্য খুঁজে পায়, যা আগে কেউ তাকে জানায়নি। ভেতরের লগবুক ও আর্কাইভ করা কোডের মধ্যে এমন একটি লাইন বারবার ফুটে উঠছিল, যেখানে অতীন্দ্রর নাম লেখা আছে। প্রথমে অরিন্দম ভেবেছিল, হয়তো এটা শুধু পুরনো কোনো অব্যবহৃত কোড—কিন্তু যতই গভীরে যায়, ততই বুঝতে পারে যে এই কোড একেবারে আলাদা স্তরে কাজ করত। এটি শুধু গেমের গ্রাফিক্স বা মুভমেন্ট কন্ট্রোল করত না, বরং সরাসরি প্লেয়ারের মস্তিষ্কের নিউরন সিগন্যালকে আঘাত করার মতোভাবে তৈরি হয়েছিল। সিমুলেশন চালিয়ে অরিন্দম উপলব্ধি করে, খেলোয়াড় যদি এই সিস্টেমের মধ্যে আটকে যায়, তাহলে মস্তিষ্কে প্রবল চাপ তৈরি হবে—চোখ ঝাপসা দেখা, কানে অসহ্য শব্দ, এমনকি হার্টবিট বেড়ে যাওয়া পর্যন্ত হতে পারে। ভেবে সে শিউরে ওঠে, “এটা কোনো সাধারণ গেম ফিচার নয়, এটা তো মানুষের মস্তিষ্কের ওপর আক্রমণের মতো।” অরিন্দম মনে করতে শুরু করে অতীন্দ্রর নামের চারপাশে থাকা অদ্ভুত গুজবগুলো—যে সে নাকি কোম্পানির ভেতরে নতুন প্রজন্মের ‘নিউরো-ইন্টার‌্যাকটিভ টেকনোলজি’ বানানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু শেষে সবাই তাকে ‘বিপজ্জনক’ ভেবে দূরে ঠেলে দেয়।

অতীন্দ্রকে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ছিল একেবারেই লজ্জাজনক। একটি প্রেজেন্টেশনের দিন, যখন সে সবার সামনে তার নতুন ফিচার ডেমো করছিল, তখন হঠাৎ কয়েকজন টেস্টার অসুস্থ হয়ে পড়ে। একজন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, আরেকজন নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। অফিসের সবার আতঙ্ক চরমে পৌঁছায়, আর ম্যানেজমেন্ট সঙ্গে সঙ্গে প্রজেক্টটি বন্ধ করে দেয়। অতীন্দ্রকে অভিযুক্ত করা হয় দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও ইচ্ছাকৃতভাবে বিপজ্জনক প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য। সে যতই বলেছিল, “আমি শুধু মানুষের ইমারসিভ এক্সপেরিয়েন্স বাড়াতে চাইছিলাম,” কেউ শুনতে চায়নি। বরং তাকে ‘ঝুঁকি’ মনে করে কোম্পানি তাকে বহিষ্কার করে দেয়। সেদিনের অপমান অতীন্দ্রকে ভিতর থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। একসময় যে মানুষটিকে জিনিয়াস বলে ডাকা হত, সেই মানুষটিই হঠাৎ সবার চোখে অপরাধী হয়ে গেল। এরপর থেকে তার কোনো খবর কেউ ঠিকঠাক জানে না—কেউ বলে সে বিদেশ চলে গেছে, কেউ বলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। কিন্তু অরিন্দমের এখন মনে হচ্ছে, সে কোথাও অন্ধকারে বসে আছে, নিঃশব্দে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করছে, আর তার তৈরি এই গোপন ফিচারই হয়তো সেই অস্ত্র।

অরিন্দম যখন ফাইলগুলো পড়ে, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—একদিকে প্রযুক্তির অনন্ত সম্ভাবনা, আর অন্যদিকে মানুষের মস্তিষ্কে তার ভয়াবহ প্রভাব। সে নিজের মনে প্রশ্ন তোলে, “অতীন্দ্র কি সত্যিই মন্দ? নাকি সে শুধু নিজের প্রতিভার জন্য ভুল সময়ে ভুল পথে চলে গিয়েছিল?” সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অরিন্দম লক্ষ্য করে, অতীন্দ্রর কোডের ভেতরে একাধিক গোপন স্তর আছে—যেন কেউ ইচ্ছে করে ভিতরে ছায়ার মতো নিজের উপস্থিতি রেখে গেছে। প্রতিটি কোড ব্লকের পাশে ছোট ছোট ট্যাগ লেখা—“Shadow-1”, “Shadow-2”, “Shadow-3”—যেন অতীন্দ্র নিজেই নিজের উপস্থিতিকে ছায়ার আকারে লুকিয়ে রেখেছে। অরিন্দম যত এগোয়, ততই সেই ছায়ার মধ্যে টেনে নিয়ে যায় তাকে। অনেক সময় মনে হয়, এই ফাইলগুলো পড়তে পড়তে সেও এক অদৃশ্য চাপ অনুভব করছে—মাথায় হালকা যন্ত্রণা, চোখের সামনে অস্পষ্ট আলো। সে ভাবে, হয়তো এগুলো কেবল কাকতালীয়, কিন্তু মনের গভীরে সন্দেহ জমে যায়, “অতীন্দ্র কি ইচ্ছে করেই এই কোড এমনভাবে লিখেছিল, যাতে কেউ পড়তে গেলেই তার শরীরে প্রভাব পড়ে?” এক অদৃশ্য আতঙ্ক ধীরে ধীরে অরিন্দমকে গ্রাস করতে থাকে, যেন অতীন্দ্রর ছায়া তার চারপাশে ঘনিয়ে আসছে।

সেদিন রাতে অফিসে একা বসে থাকতে থাকতে অরিন্দম জানালার বাইরে তাকায়। শহরের আলো ঝলমলে, অথচ তার চোখে ভেসে ওঠে এক ছায়ামূর্তি—অতীন্দ্র, যাকে সে কখনো দেখেনি, তবুও যেন খুব চেনা মনে হয়। অপমান, ক্ষোভ, আর প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে ওঠা সেই মানুষটির ছায়া যেন শহরের প্রতিটি অন্ধকার কোণে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অরিন্দম বুঝতে পারে, অতীন্দ্র কেবল একজন প্রাক্তন ডেভেলপার নয়, সে এখন এই গেমের অদৃশ্য ভূতের মতো—যার ছায়া থেকে কেউ পালাতে পারবে না। মস্তিষ্কে আঘাত করার সেই ফিচার শুধু প্রযুক্তির ভয় নয়, বরং মানুষের আত্মায় লেগে থাকা প্রতিহিংসার ছাপ। অরিন্দম ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে, অতীন্দ্রর প্রতিশোধপরায়ণতা হয়তো শুধু কোম্পানির বিরুদ্ধে নয়—বরং সবার বিরুদ্ধে, যারা তাকে একদিন ভুলে গিয়েছিল। সেই রাতে, ধোঁয়ার ভেতর সিগারেট টেনে নিতে নিতে অরিন্দম নিজের মনে এক ভয়ঙ্কর সত্য উপলব্ধি করে—অতীন্দ্রর ছায়া এখন শুধু অতীতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভেতর ঢুকে গেছে, আর এই ছায়া তাকে শেষ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়াবে।

তৃণা অনেক দিন ধরে লক্ষ্য করছিল, শহরের কয়েকজন নামকরা ফুটবল ও ক্রিকেটার প্রায়ই রাতে একই জায়গায় জড়ো হয়। জায়গাটা একটা আড়ম্বরহীন পুরোনো ভিলা, বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে একেবারে অন্য জগৎ—গেমিং কনসোল, বিশাল স্ক্রিন, আর অদ্ভুত ধরনের সার্ভার সেটআপ। সেখানেই নাকি নতুন ধরনের ভার্চুয়াল লেনদেন, অবৈধ বাজি আর তথ্য বিনিময় চলছে। পেশায় ক্রীড়া সাংবাদিক হলেও তৃণা সবসময়ই সন্দেহপ্রবণ, আর তার ধারণা হচ্ছিল—এই গোপন আড্ডাই আসল কেলেঙ্কারির উৎস। এক সন্ধ্যায়, এক খেলোয়াড়ের সূত্র ধরে সে ভিলায় ঢুকতে সক্ষম হয়। শুরুতে সবার সঙ্গে স্বাভাবিক আলাপচারিতা চালালেও ভেতরে ভেতরে তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—এরা আসলে কোন জগতে কাজ করছে? সে লক্ষ্য করছিল, আলাদা এক কক্ষে কম্পিউটার টার্মিনালগুলোর পর্দায় শুধু গেমস বা সাধারণ লেনদেন চলছে না, বরং অদ্ভুত কিছু কোড ভেসে উঠছে। এক খেলোয়াড় হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি নতুন? আগে তো দেখিনি।” তৃণা সামলে নিয়ে বলল, সে শুধু খবর রাখার জন্য এসেছে, তবে এই মুহূর্তে যেন আরেক জগতে ঢুকে গেছে। পরের মুহূর্তে হালকা একটা অন্ধকার ছড়িয়ে গেল ঘরে, তার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে অনুভব করল—সে যেন মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।

জ্ঞান ফেরার পর তৃণা বুঝতে পারল, সে কোথাও অন্য জায়গায় আছে। চারদিক অদ্ভুত রঙের ঝলকানি, তার চারপাশের দেয়াল যেন বাস্তব নয়—বরং কোনো ডিজিটাল নকশা দিয়ে তৈরি। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে সে বুঝল, তাকে জোর করে এক “প্রাইভেট সার্ভার”-এ টেনে আনা হয়েছে। এটা কোনো সাধারণ গেমিং প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং এক ধরণের ভার্চুয়াল কারাগার, যেখানে আটকে ফেলা হয় অপ্রিয় মানুষদের। কানে ভেসে আসছিল অচেনা কিছু কণ্ঠস্বর, কারও হাসি, কারও গম্ভীর নির্দেশ, যেন ভেতরে ভেতরে কেউ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তখনই ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে এক ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল—সে আর কেউ নয়, অতীন্দ্র। তার চোখে ঠাণ্ডা এক দৃষ্টি, ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। অতীন্দ্র স্পষ্ট করেই জানাল, সাংবাদিকরা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে এই জায়গাতেই ফেঁসে যায়। “এখান থেকে বেরোনো সহজ নয়, মিস তৃণা,” বলে সে এগিয়ে এল, তার হাতের আঙুলে ঝিকমিক করছিল অদ্ভুত এক হোলোগ্রাফিক ডিভাইস। তৃণা বুঝতে পারল, এই পুরো ফাঁদটা তার জন্যই পাতা হয়েছিল।

তবে তৃণা ভয়ে ভেঙে পড়ল না। সে জানত, সাংবাদিকতা মানেই ঝুঁকি, আর সত্য খুঁজতে গিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হওয়াই নিয়ম। অতীন্দ্র যখন তার চারপাশে ডিজিটাল দেয়াল ঘন করতে লাগল, তৃণা তখন মাথা ঠাণ্ডা রাখল। সে প্রশ্ন করল—“তুমি এত বড় খেলাটা চালাচ্ছ, কিন্তু এর শেষ কী? তুমি কি ভেবেছো, পুলিশ বা সরকার টের পাবে না?” অতীন্দ্র মৃদু হেসে উত্তর দিল, “সরকারকে আমি নিজের মতো করে চালাই। পুলিশকে আমি আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। তুমি কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না।” কথাগুলো যেন তৃণার বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দিল। ঠিক তখনই হঠাৎ সার্ভারের ভেতরে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল। তৃণা বুঝতে পারল, বাইরে হয়তো পুলিশ খবর পেয়েছে এবং আসছে। অতীন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে চমকে উঠল, কিন্তু খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। এক ঝলকে সে হাতের ডিভাইসের বোতাম চাপল, আর তার শরীর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল সার্ভারের ভিতরেই। তৃণা যতই হাত বাড়াল, কিছুই ধরতে পারল না। অতীন্দ্র অদৃশ্য হয়ে গেছে, রেখে গেল শুধু এক ঠাণ্ডা নীরবতা।

সেই সময় হঠাৎ এক প্রবল আলোয় ঘর ভরে গেল, আর তৃণার চোখ খুলতেই সে নিজেকে আবার সেই ভিলার মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখল। চারপাশে পুলিশের টর্চের আলো, কারও গলা ভেসে আসছে—“ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন?” তৃণা ক্লান্ত চোখে উঠে বসে বলল, অতীন্দ্র এখানেই ছিল, কিন্তু সে পালিয়ে গেছে। পুলিশ অফিসাররা হতবাক, কারণ তারা ভিলার ভেতরে কোনো চিহ্নই খুঁজে পাচ্ছিল না—না কোনো সার্ভার, না কোনো ডিজিটাল যন্ত্রপাতি। সব যেন মূহূর্তের মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে। তৃণা জানত, অতীন্দ্র আবারও তাদের একধাপ পিছনে ফেলে পালিয়েছে। কিন্তু ভয়ের বদলে তার চোখে জেদ আর দৃঢ়তা ফুটে উঠল—এই খেলা এখনো শেষ হয়নি। সে মাথার ভেতরে প্রতিজ্ঞা করল, যত বড় শক্তিই হোক না কেন, অতীন্দ্রকে সে একদিন প্রকাশ্যে টেনে আনবেই। আর তখন হয়তো খেলার মাঠটা হবে শুধু তার লেখা সংবাদপত্রের পাতা, যেখানে সত্যটাই আসল অস্ত্র হয়ে দাঁড়াবে।

সকালের কুয়াশার ভেতর লুকোনো কলকাতার রাস্তাগুলো যেন তদন্তের এই নতুন মোড়কেই প্রতিফলিত করছিল। দীপ আর শুভায়ন সারারাত প্রমাণ ঘেঁটে কাটিয়েছে, তবু অন্তরে তারা জানত, কোনো এক জায়গায় যেন ভুল হচ্ছে। পুলিশের অফিস থেকে পাওয়া লগ রেকর্ড আর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করতে করতে হঠাৎই দীপের চোখে পড়ে কিছু অদ্ভুত প্যাটার্ন। অতীন্দ্রর ডিভাইসের আইপি ট্রেসিং বারবার একই জায়গায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে—সুব্রতের ক্যাফে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল হয়তো হ্যাকার তার লোকেশান ঢাকতে ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করছে। কিন্তু লগ ফাইলের তারিখ আর সময়ে চোখ বোলাতেই বোঝা গেল, বিষয়টা এর চেয়ে গভীর। ওগুলো কেবল এলোমেলো কিছু সেশন নয়, বরং পরিকল্পিত নিয়মিত কার্যকলাপ। শুভায়ন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে উঠেছিল, “মানে তুমি বলতে চাইছো সুব্রত নিজেই ওকে সাহায্য করছিল?” দীপ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, “সব তথ্য সেই দিকেই যাচ্ছে। অন্যথা হলে একই নেটওয়ার্ক থেকে এতবার লগইন সম্ভব নয়।”

পরের দিন বিকেলে তারা ক্যাফেতে ঢোকার সময় সুব্রত যথারীতি বন্ধুত্বপূর্ণ মুখে হাসি ছড়ালো, যেন কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে তার দূরতম সম্পর্ক নেই। কিন্তু দীপের চোখ তখন কড়া—সে সরাসরি বলল, “তোর ক্যাফের সার্ভার কে ব্যবহার করছিল, সব কথা খুলে বল।” প্রথমে সুব্রত নানা অজুহাত দিলো, বললো হয়তো গ্রাহকরা ওয়াই-ফাই হ্যাক করে ব্যবহার করেছে, হয়তো তার কর্মচারীরাই দায়ী। কিন্তু দীপ যখন প্রমাণ হিসেবে লগ ফাইল আর নেটওয়ার্ক অ্যাক্সেসের টাইমস্ট্যাম্প টেবিলে রাখলো, সুব্রতের মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। শুভায়নের কাছে সেই মুহূর্তটা ছিল একেবারে চলচ্চিত্রের দৃশ্য—যেন একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার মুখ অবশেষে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেক চাপের পর অবশেষে সুব্রত স্বীকার করল, অতীন্দ্র নিয়মিত তার ক্যাফের সার্ভার ব্যবহার করেছে, আর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে। সে বলল, “আমি ভেবেছিলাম সামান্য নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কারও ক্ষতি হবে না। টাকা পেলে আমার ক্যাফেটা বাঁচানো যাবে।” তার কণ্ঠে তখন একরাশ ভাঙা গলা, আর চোখে স্পষ্ট অপরাধবোধের ছায়া।

পুলিশ দ্রুত সুব্রতকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল, কিন্তু তদন্তে আসল ধাক্কা তখনই সামনে এলো। সুব্রত যতটা জানায়, তাতে বোঝা গেল অতীন্দ্র বহু আগেই তার জন্য ব্যাকডোর তৈরি করে রেখেছিল। অর্থাৎ সুব্রত ধরা পড়লেও, অতীন্দ্র সহজেই অন্যত্র পালাতে সক্ষম হবে। পুলিশের একাধিক টিম হানা দিল, ল্যাপটপ আর সার্ভার বাজেয়াপ্ত করা হলো, কিন্তু তাতে কেবল কিছু ভাঙা কোড আর এনক্রিপ্টেড ফাইল ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। যেন প্রতিটি পদক্ষেপ আগেভাগেই আন্দাজ করে রেখেছিল অতীন্দ্র। শুভায়নের মনে তখন এক অদ্ভুত হতাশা—এতদিন ধরে যে মানুষটিকে তারা নিজের বলে ভেবেছিল, সে-ই আসলে শত্রুর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আর এর ফলে আসল অপরাধী আবারও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল। দীপ জানত, সুব্রতের গ্রেপ্তার কেবল গল্পের একটি অধ্যায়; আসল রহস্য এখনো গা ঢাকা দিয়ে আছে। সে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মনে মনে বলেছিল, “খেলা এখনো শেষ হয়নি, বরং শুরু হলো নতুন করে।”

তবে এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই তদন্তে নতুন জটিলতা তৈরি হলো। সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম—সবার কাছে যেন পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। লোকেরা বলতে লাগল, যদি একজন সাধারণ ক্যাফে মালিকই গোয়েন্দাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে, তবে তারা আর কীভাবে শহরকে সুরক্ষিত রাখবে? কমিশনারও স্পষ্ট জানালেন, সময় ফুরিয়ে আসছে, অতীন্দ্রকে ধরতেই হবে। অন্যদিকে, দীপের মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল অন্য প্রশ্ন—সুব্রত আসলে কতটা সত্যি বলছে? টাকা আর ব্যবসার টানেই কি সে এই কাজ করেছিল, নাকি এর আড়ালে আরও বড় ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে? সুব্রতের জবানবন্দি যতই নিরুপায় শোনাক, তার চোখের ভেতর দীপ বারবার অস্বস্তিকর দ্বন্দ্ব খুঁজে পাচ্ছিল। শুভায়ন জানতো, এই খেলায় প্রতিটি চালই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, যদিও পুলিশ সুব্রতকে আটক করেছে, তারা বুঝতে পারছিল, ভেতরের বিশ্বাসঘাতক কেবল এক চক্রের অংশ, আর এই চক্রের মূল মস্তিষ্ক—অতীন্দ্র—এখনো ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ কৌতুকের মতো দেখছে। তদন্ত তাই নতুন করে তীব্র হয়ে উঠলো, আর দীপ-শুভায়নের সামনে তৈরি হলো এক ভয়াবহ দৌড়—সময়ের বিরুদ্ধে এক লড়াই।

অতীন্দ্রর ঘোষণা ছিল একেবারে বজ্রপাতের মতো। “যারা আমার তৈরি গেমে ঢুকবে, সবাই মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকবে।” এই একটি বাক্য রাতারাতি শহরের কিশোর-কিশোরীদের মনের ভেতরে তীব্র ভয়ের ছায়া নামিয়ে আনে। সামাজিক মাধ্যমে তার কথার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে; কেউ বলে এ নিছক হুমকি, আবার কেউ বলে এ হুমকির পেছনে প্রকৃত ভয়ঙ্কর শক্তি কাজ করছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়—কিশোররা কেউ থেমে যায়নি। বরং ভয় ও কৌতূহলের এক অদ্ভুত মিশ্রণ তাদের আরও আকৃষ্ট করে তুলেছিল গেমটির দিকে। শহরের গলিপথে, স্কুলে কিংবা টিউশন ক্লাস শেষে গোপনে অনেকেই এখনও খেলতে থাকে, যেন মৃত্যুর প্রলোভনও তাদের টানতে পারছে না এই রহস্যময় জগত থেকে। আর সেই গেমের প্রতিটি স্তরে যেন অদ্ভুত সব ধাঁধা, হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া গ্রাফিক্স, ভয়াল শব্দ আর আকস্মিক ফ্ল্যাশ স্ক্রিন খেলোয়াড়দের মানসিক ভারসাম্য টালমাটাল করে তুলতে থাকে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই আসতে থাকে খবর—কোথাও কেউ খেলার সময় জ্ঞান হারিয়েছে, কোথাও বা কিশোরী ভোররাতে আতঙ্কে চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। পুলিশ ও সাইবার সেলের চোখ এড়িয়ে চলা যায় না, তবুও কোনোভাবে অতীন্দ্রর তৈরি এই গেমটিকে থামানো যাচ্ছে না। শহরের আকাশে যেন এক অদৃশ্য সন্ত্রাস ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে অরিন্দম ও ঋদ্ধির কাছে আসে নতুন চাপ। তদন্তকারী সংস্থা তাদের অনুরোধ জানায়, গেমের ভেতরে প্রবেশ না করলে এর আসল রহস্য কখনোই ধরা যাবে না। কিন্তু জানার সাথেসাথে ঝুঁকিটাও স্পষ্ট—যে প্রবেশ করবে, তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। তবুও অরিন্দমের চোখে ছিল দৃঢ়তা। সে জানত, যদি তারা ভেতরে না ঢোকে তবে শহরের কিশোর প্রজন্মের জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ঋদ্ধি প্রথমে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু অরিন্দমের যুক্তি শুনে রাজি হয়। গেমটি যে সাধারণ ডিজিটাল খেলা নয় তা তাদের খুব ভালোভাবেই বোঝা ছিল। তারা দেখেছে, কীভাবে একটি কিশোর খেলতে খেলতে হঠাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলে। চিকিৎসকেরা একে “হঠাৎ মানসিক শক” বললেও, বাস্তবে এর পেছনে ছিল আরও গভীর অন্ধকার। গেমে প্রবেশ করার আগে দুজনেই প্রস্তুতি নেয়। তাদের সামনে সাজানো হলো হেডসেট, হাই-টেক কম্পিউটার কনসোল, এবং সাইবার সেলের সার্ভারে সরাসরি সংযুক্ত সিস্টেম। নিঃশব্দে তারা একে অপরের দিকে তাকাল—এ যেন যুদ্ধক্ষেত্রে নামার আগে যোদ্ধার চোখাচোখি। বাইরে বিদ্যুতের মতো নীরবতা, আর ভেতরে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল অজানা এক দুনিয়া।

গেমে প্রবেশ করার মুহূর্তে তারা বুঝতে পারল, এ শুধু একটুখানি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি নয়, বরং যেন এক বিকল্প জগত। চোখের সামনে ভেসে উঠল অন্ধকারাচ্ছন্ন শহর, যেখানে আকাশ কালো, রাস্তার ল্যাম্পগুলো নিভে আসছে, আর প্রতিটি গলির মোড়ে যেন মৃত্যুর ছায়া অপেক্ষা করছে। বাতাসে ভেসে আসছে ভাঙা সাইরেনের শব্দ, দূরে কোনো ভগ্নপ্রায় ভবনের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে শিশুর কান্না। অরিন্দম ও ঋদ্ধি একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝল—এখানে কেবল খেলা চলছে না, এ এক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা। প্রতিটি ধাপে খেলোয়াড়কে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয়, যেখানে ভয়, অন্ধকার আর মৃত্যুচিন্তার চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তারা সামনের দিকে এগোতেই দেখতে পেল একটি কালো গেটের ওপরে লেখা আছে—“Level One: Fear of Death.” হঠাৎ চারদিক থেকে উঠে এল ধাতব কণ্ঠস্বর, সম্ভবত অতীন্দ্রর নিজের ডিজাইন করা সিস্টেম ভয়েস—“তোমরা এখানে ঢুকেছ, এর মানে তোমরা জীবন বাজি রেখেছ। এখান থেকে বেরোবার একটাই পথ—শেষ স্তর পর্যন্ত বেঁচে থাকা।” গেমের প্রতিটি অংশ যেন তাদের মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে ভয়কে জাগিয়ে তুলছে। ঋদ্ধি দেখল তার সামনে হঠাৎ প্রিয় ছোট ভাইয়ের ছবি, যে ভীষণ কষ্টে চিৎকার করছে। আর অরিন্দম দেখল মায়ের নিথর দেহ। তারা দুজনেই জানত, এ ভ্রম—তবু মস্তিষ্কের ওপর তার প্রভাব ছিল অবর্ণনীয়।

কিন্তু ভয়ই তাদের থামাতে পারেনি। অরিন্দম দাঁত চেপে এগিয়ে গেল সামনে, ঋদ্ধি তার পাশে। প্রতিটি ধাপে নতুন পরীক্ষা, নতুন ফাঁদ। কোথাও তারা দেখল আগুনে জ্বলন্ত পথ, যেখানে পড়লেই মৃত্যু নিশ্চিত; কোথাও আবার সাপভর্তি অন্ধকার টানেল। অথচ তাদের বাঁচতে হলে এগোতেই হবে। গেমের প্রতিটি স্তরে ছিল একেকটি কোড, যা তারা জোগাড় করতে পারলেই আসল রহস্যের কাছে পৌঁছনো সম্ভব। তারা বুঝতে পারল, অতীন্দ্র কেবল ভয় দেখানোর জন্য এই খেলা তৈরি করেনি, বরং প্রতিটি কোডের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে তথ্য—যেন কেউ সাহস করে সব কোড সংগ্রহ করতে পারে তবে সে অতীন্দ্রর আসল পরিকল্পনা জানতে পারবে। আর এই মুহূর্তে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা—“মৃত্যুর খেলা শুরু”। তারা জানে, এর ভেতরে প্রবেশ মানেই দুঃস্বপ্নের দ্বার খুলে দেওয়া। বাইরে সাইবার সেলের লোকজন নিশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে, কনসোলে ভেসে উঠছে অরিন্দম আর ঋদ্ধির প্রতিটি পদক্ষেপ। শহরের ভাগ্য নির্ভর করছে এই দুই সাহসী অভিযাত্রীর ওপর। মৃত্যুর খেলা শুরু হয়েছে—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই।

১০

অরিন্দম যখন ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জগতে অতীন্দ্রর মুখোমুখি দাঁড়াল, তখন যেন গেমের ভেতরকার পরিবেশ আরও গাঢ় হয়ে উঠল। চারপাশে আলো-অন্ধকারের খেলা, তীক্ষ্ণ সাউন্ড ইফেক্ট, আর ভাসমান কোডের মতো ঝলসে ওঠা অসংখ্য ডাটা লাইনের মাঝখানে অতীন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তার চোখে ভয়ের ছায়া নেই, বরং এক ধরনের শীতল ব্যঙ্গ, যেন সবকিছু আগেই সাজানো ছিল। অরিন্দম শ্বাস ফেলে নিজের শরীরকে স্থির করল। গেমের ভেতরে আসল লড়াই মানে কেবল শক্তির লড়াই নয়, বরং মন, মস্তিষ্ক আর কৌশলেরও পরীক্ষা। হঠাৎ করে অতীন্দ্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, “তুমি ভাবছো, আমাকে থামিয়ে দিতে পারবে? আমি এই শহরের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়েছি, আমি এখানকার আসক্তি।” শব্দগুলো যেন চারদিক থেকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। অরিন্দম উত্তর দিল না, শুধু চোখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা দিয়ে এক লাফে এগিয়ে গেল। শুরু হলো এক চরম সংঘর্ষ—ভার্চুয়াল আর্মারের সঙ্গে আঘাতের ঝনঝন শব্দ, হাতে ধরা ডিজিটাল অস্ত্র একে অপরের সঙ্গে মিশে তৈরি করল আগুনের রেখা। গেমের বাস্তবতা এতটাই তীব্র ছিল যে প্রতিটি আঘাত যেন সত্যি অরিন্দমের শরীরকেই ক্ষত-বিক্ষত করছে। অথচ সে থামল না। একসময় শরীরের ভেতরকার সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে অতীন্দ্রকে মাটিতে ফেলে দিল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে অতীন্দ্র যেন হাসতে লাগল, তার ঠোঁটে ভেসে উঠল সেই শীতল কৌতুকপূর্ণ হাসি।

বাইরে, সার্ভার রুমে ঋদ্ধি তখন সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। চারপাশে মেশিনের লাল আলো জ্বলছে, সার্ভারের শব্দ বাড়ছে ক্রমশ, যেন ভেতরের সমস্ত সিস্টেম প্রতিরোধ করছে তাকে। ঋদ্ধির আঙুল কীবোর্ডে উড়ছে, কোডের পর কোড ভাঙছে, অথচ প্রতিবারই যেন নতুন এক লক খুলে যাচ্ছে সামনে। ঘামের ফোঁটা তার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, মনোযোগের প্রতিটি বিন্দু জড়িয়ে আছে এই অপারেশনে। তার চোখে তখন শুধু একটাই লক্ষ্য—কিশোরদের বাঁচানো। অরিন্দম ভেতরে লড়ছে শারীরিকভাবে, আর ঋদ্ধি বাইরে লড়ছে বুদ্ধি আর প্রযুক্তির মাধ্যমে। দুই যুদ্ধ সমান্তরালে চলছে, কিন্তু ফলাফল নির্ভর করছে উভয়ের সফলতার ওপর। হঠাৎ সার্ভারের মধ্যে একটা তীব্র শব্দ উঠল, যেন ভেতরে কিছু ভেঙে পড়ছে। ঋদ্ধি বুঝল সে সঠিক পথে এগোচ্ছে। কিন্তু তখনই অতীন্দ্রর কণ্ঠ যেন নেটওয়ার্কের ভেতর থেকে ভেসে এল, “তুমি ভেবেছো আমাকে মুছে ফেলতে পারবে? আমি ডাটা হয়ে গেছি, আমাকে মুছতে গেলে শহরের রক্তস্রোতই থেমে যাবে।” ঋদ্ধি এক মুহূর্ত থমকাল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ঠোঁটে দৃঢ় রেখা টেনে দিল। সে জানে, ভয় পেলে চলবে না। তার আঙুল আবার দ্রুত নড়ল, একে একে শেষ লেয়ারের ফায়ারওয়াল ভেঙে ফেলে দিল। ঠিক তখনই গেমের ভেতরে অরিন্দম আর অতীন্দ্রর লড়াই তুঙ্গে উঠল।

অরিন্দম অতীন্দ্রকে চেপে ধরেছে, কাঁধে, হাতে চাপ দিচ্ছে সমস্ত শক্তি দিয়ে। অতীন্দ্র চেষ্টা করছে মুক্ত হওয়ার, কিন্তু অরিন্দমের দৃঢ়তা এবার অটুট। ভার্চুয়াল অস্ত্র মাটিতে ছিটকে পড়ে আছে, এখন লড়াই কেবল দুজন মানুষের—শরীর আর মানসিক শক্তির। অতীন্দ্রর চোখে তখনও সেই বিদ্রূপী ঝিলিক। সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি আমাকে মারলেও, এই শহর গেম খেলা বন্ধ করবে না। আমি না থাকলেও কেউ আবার আসবে, কেউ আবার নতুন নেশা ছড়াবে।” এই কথাগুলো যেন অরিন্দমের বুকের ভেতর বিদ্যুতের মতো বাজল। সত্যিই তো, লড়াইটা কেবল এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং এক পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তবু এই মুহূর্তে অতীন্দ্রকে থামানোই প্রধান লক্ষ্য। অরিন্দম দাঁত চেপে শক্ত করে অতীন্দ্রকে মাটিতে চেপে ধরল, তার নড়াচড়া পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনল। ঠিক সেই সময় বাইরে ঋদ্ধি শেষ কমান্ড টিপে সার্ভার শাটডাউন শুরু করে দিল। এক মুহূর্তের জন্য পুরো সিস্টেম কেঁপে উঠল, আলো নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। গেমের ভেতর আটকে থাকা অসংখ্য কিশোর হঠাৎ মুক্ত হয়ে গেল, যেন শ্বাস নিতে পারল তারা নতুন করে। ভার্চুয়াল অন্ধকার ভেঙে আলো ফুটে উঠল চারপাশে। অতীন্দ্রর শরীর হঠাৎ যেন ভারী হয়ে গেল, তার চেহারায় অস্বাভাবিক বিকৃতি দেখা দিল। তবু তার ঠোঁটে শেষ পর্যন্ত রয়ে গেল সেই রহস্যময়, অদ্ভুত হাসি।

গেম ভেঙে পড়ার শেষ মুহূর্তে অরিন্দম দেখল, অতীন্দ্রর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বাক্য—“তুমি ভেবেছো আমাকে শেষ করলে সব শেষ হয়ে যাবে? না, অরিন্দম। এই শহরের মানুষ গেম খেলা বন্ধ করবে না, তাদের আসক্তি থামবে না। আমি না থাকলেও অন্য কেউ আসবে, হয়তো আরও ভয়ঙ্করভাবে।” কথাগুলো প্রতিধ্বনির মতো ছড়িয়ে পড়ল, তারপর তার শরীর ভেঙে গেল অসংখ্য পিক্সেলে, মিলিয়ে গেল আলোর ভেতর। বাইরে সার্ভারের সব আলো নিভে গেল, কেবল নিস্তব্ধ শব্দ। ঋদ্ধি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, কপাল ভিজে গেছে ঘামে, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তির ছাপ। অরিন্দম বাস্তব জগতে ফিরে এল, ক্লান্ত দেহে মেঝেতে পড়ে গেল, কিন্তু তার মুখে এক চিলতে স্বস্তির হাসি। কিশোররা বেঁচে গেছে, শহর অন্তত আপাতত মুক্ত। কিন্তু দুজনেই জানে, অতীন্দ্রর সেই শেষ কথাগুলো কেবল হুমকি নয়, এক নির্মম সত্যও বটে। আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এখনই শেষ হয়নি, বরং এর আসল যুদ্ধ হয়তো সামনে অপেক্ষা করছে। শহরের অন্ধকারের ভেতর, আবার কেউ নতুন অতীন্দ্র হয়ে ফিরে আসবে—এটাই হয়তো ভবিষ্যতের ভয়।

শেষ

1000055103.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *