সৌরদীপ ব্যানার্জী
পর্ব ১ : থেমে যাওয়া সময়
কলকাতার গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। শহরের ব্যস্ততা তখনও ফুরোয়নি। কিন্তু শান্তিনিকেতন লেনের পুরনো তিনতলা বাড়িটা যেন অন্য জগতের মতো নিঃশব্দ। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, আর ভেতরে জমে উঠছে অস্বস্তিকর হাহাকার। সেই বাড়ির দোতলার পড়ার ঘরে নিথর হয়ে পড়ে আছেন অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জী—শহরের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। তাঁর শরীরটা একপাশে হেলে পড়ে আছে, টেবিলের ওপরে কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মাথার কাছে পড়ে আছে একটি হাতঘড়ি—কাঁচ ভাঙা, কাঁটা থেমে আছে রাত ২টা ১৭ মিনিটে।
পুলিশ আসে, চারদিক ঘিরে ফেলে। দারোয়ান অশোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানায়—
“সার, আমি তো বিকেল সাড়ে চারটের সময় ভেতরে ঢুকে লাশ দেখি। দরজা ভেতর থেকে খোলা ছিল না, আধখোলা ছিল।”
ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন, বয়স চল্লিশ পেরনো, মেপে-থেপে কথা বলেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। লাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলেন,
“ঘড়ি থেমেছে ২:১৭-তে… অথচ ডাক্তারের রিপোর্ট বলছে মৃত্যু বিকেল চারটার আশেপাশে। তাহলে এই অদ্ভুত মিল-অমিলটা কেন?”
ঘরের দেয়ালে ঝোলানো বইয়ের তাক, কাগজের গন্ধ, ধুলোমাখা চেয়ার—সব মিলিয়ে যেন এক নিঃশব্দ সাক্ষী। টেবিলের ড্রয়ারে অরিজিৎ পান আধভাঙা একটি চিঠি। সেখানে লেখা—
“সময় যদি থেমে যায়, সত্যি কি বেরোয়? নাকি সময়ই সত্যিকে গিলে খায়?”
অরিজিৎ থমকে যান। এটা কি আত্মহত্যার ইঙ্গিত, নাকি খুনিকে আড়াল করার কৌশল?
পাশেই ঘড়ির ভাঙা কাঁচে ছোট্ট রক্তের দাগ লেগে আছে। কে ভেঙেছে? কেন ভেঙেছে? আর কেনই বা সেই সময়ে কাঁটাকে থামিয়ে রাখা হয়েছে?
বাইরে তখন রাত নেমেছে। বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরা নানা গুজব ছড়াচ্ছে—
“প্রফেসরের শত্রু তো অনেক ছিল…”
“ওনার নতুন বই নাকি কেউ চুরি করতে চাইছিল…”
“একটা ছাত্রীকে নিয়ে ঝামেলা ছিল…”
ইন্সপেক্টর অরিজিৎ বুঝলেন, এই কেস সাধারণ নয়। ভাঙা হাতঘড়ির ভেতরে যে অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটাই পুরো ঘটনার চাবিকাঠি।
তিনি ধীরে ধীরে ঘড়িটাকে হাতে তুলে নিলেন, মনে মনে বললেন—
“যে সময় থেমে গেছে, আসল খুনি ঠিক সেখানেই ফেঁসে আছে।”
পর্ব ২ : ছায়ার সূত্র
অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জীর বাড়ি থেকে লাশ তোলার পর পুরো এলাকা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীদের কৌতূহলী চোখ, পুলিশের গাড়ির লাল আলো, আর গরম হাওয়ার মধ্যে হঠাৎই একটা অজানা শীতলতা নেমে এল।
ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন আবারও ফিরে গেলেন অধ্যাপকের ঘরে। টেবিলের ওপর ছড়ানো কাগজগুলো তিনি মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। বেশিরভাগই ইতিহাসের গবেষণাপত্র—মুঘল আমলের কিছু দলিলের অনুবাদ। কিন্তু একটা খাতা আলাদা করে নজরে পড়ল। সেই খাতার প্রথম পাতায় লেখা ছিল—
“ঘড়ির কাঁটা যদি মিথ্যে বলে, তবে ইতিহাসও সত্যি নয়।”
অরিজিৎ ভ্রু কুঁচকালেন। কে লিখেছে এই লাইন? অধ্যাপক নিজে, নাকি অন্য কেউ?
ঠিক তখনই ফরেনসিক অফিসার সায়ন্তনী চৌধুরী ঘরে ঢুকলেন। হাতে রিপোর্ট—
“স্যার, মৃত্যুর সময় বিকেল চারটা থেকে চারটা কুড়ির মধ্যে। শরীরে কোনও লড়াইয়ের চিহ্ন নেই। বিষক্রিয়ার মতো কিছু মনে হচ্ছে।”
অরিজিৎ অবাক হলেন।
“মানে ওঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?”
সায়ন্তনী মাথা নাড়লেন।
“হ্যাঁ, কিন্তু এখনো পরিষ্কার নয় সেটা জোর করে দেওয়া, না কি স্বেচ্ছায় খাওয়া।”
অরিজিৎ জানালার কাছে গেলেন। বাইরের অন্ধকার গলিতে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো আধো ঝাপসা ছায়া ফেলছে। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল—বারান্দার রেলিংয়ে একটা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে। অধ্যাপক তো ধূমপান করতেন না।
তিনি সেটি তুলে নিলেন। ঠান্ডা, কিন্তু আধঘণ্টার বেশি পুরোনো নয়। মানে কেউ সম্প্রতি ঘরে ছিল।
এমন সময় দারোয়ান অশোক আবার এসে কাঁপা গলায় বলল,
“স্যার, বিকেলের দিকে একটা ছাত্রী এসেছিল। নাম শুনেছি মেঘলা। প্রায়ই আসত ওনার কাছে।”
অরিজিৎ চমকে উঠলেন।
“মেঘলা? পুরো নাম জানো?”
“না, তবে শ্যামলাপাড়ার দিকের নাকি। আজ প্রফেসরের ঘরে ঢুকেছিল, কিন্তু কতক্ষণ ছিল সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।”
ঘড়ি তখনও অরিজিতের হাতে। ভাঙা কাঁচে শুকনো রক্তের দাগ যেন ইঙ্গিত করছে—এই ঘড়ির ভেতরেই লুকিয়ে আছে খুনির ছায়া।
অরিজিৎ ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললেন—
“প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে মেঘলাকে। আর এই সিগারেট… যেই ধরেছে, সে-ই খুনিকে চেনে।”
পর্ব ৩ : মেঘলার ছায়া
পরদিন সকাল। অরিজিৎ সেনের গাড়ি গড়গড় শব্দ করে ঢুকে গেল শ্যামলাপাড়ার সরু রাস্তায়। পাড়াটা পুরনো কলকাতার মতো—অর্ধেক ভাঙা দোতলা বাড়ি, বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কাপড়, আর অলস ভোরের চা-বাসনা ভাসছে।
দারোয়ান অশোক যে নাম বলেছিল, সেই মেঘলাকে খুঁজতেই তিনি এসেছেন। বাড়ির নম্বর ঠিকই পাওয়া গেছে—একতলা ছিমছাম বাড়ি। দরজা খুলল এক মধ্যবয়সী মহিলা।
“আপনি?”
“আমি পুলিশ। ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন। মেঘলা আছেন?”
মহিলা একটু থেমে বললেন,
“ও তো কলেজে গেছে। দুপুরের আগে ফেরে না। কিন্তু ব্যাপারটা কী?”
অরিজিৎ ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“ও অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জীর ছাত্রী ছিলেন?”
মহিলা একদম থমকে গেলেন।
“হ্যাঁ… ওখানেই পড়ত। কেন?”
অরিজিৎ শুধু বললেন,
“আমি পরে আবার আসব।”
বেরিয়ে এসে তিনি গাড়িতে বসে সিগারেট ধরালেন। সেদিন রাতে অধ্যাপকের বারান্দায় যে সিগারেট খুঁজে পেয়েছিলেন, তার ব্র্যান্ড ছিল গোল্ড লিফ। আর মেঘলার বাড়ির সামনের রাস্তায় ময়লার পাশে পড়ে থাকা একটা খালি প্যাকেট—সেটাও ঠিক সেই একই ব্র্যান্ড।
অরিজিৎ নোটবুকে লিখলেন—
মেঘলা : প্রধান সন্দেহভাজন।
কিন্তু মাথার ভেতরে আরও বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কেন তাঁকে ঘরে ঢুকতে দিলেন? এমন কী সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে, যেটা তাঁকে প্রতিবারই নির্ভয়ে মেঘলাকে স্বাগত জানাতে বাধ্য করত?
অফিসে ফেরার পর সায়ন্তনী ফরেনসিক রিপোর্টের নতুন কপি এনে দিলেন।
“স্যার, শরীরে সায়ানাইডের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সেটা খাওয়ার পর প্রায় চল্লিশ মিনিট পর্যন্ত ভিকটিম টের পাননি। ধীরে ধীরে স্নায়ু অবশ হয়ে মৃত্যু হয়েছে।”
অরিজিৎ কপালে হাত ঠেকালেন।
“তাহলে যেদিন মারা যান, বিকেল চারটার আগে তাঁকে সায়ানাইড দেওয়া হয়েছে। আর ঘড়ি থেমে আছে রাত ২:১৭-তে। এর মানে—ঘড়ির সঙ্গে মৃত্যুর সরাসরি সম্পর্ক নেই। খুনি ইচ্ছে করে সময়কে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে।”
তিনি টেবিলে ঘড়িটা রাখলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন, ঘড়ির ভেতরে কাঁটার নীচে একটা খোদাই করা চিহ্ন—অক্ষর ‘M’।
“এম… মানে মেঘলা? নাকি অন্য কেউ?”
সন্দেহ যেন আরও ঘনীভূত হলো।
পর্ব ৪ : ঘড়ির অভিশাপ
বিকেল নামছে ধীরে ধীরে। কলকাতার আকাশে গুমোট মেঘ জমেছে। অরিজিৎ সেন তাঁর অফিস রুমে বসে আছেন, টেবিলের উপর রাখা সেই ভাঙা হাতঘড়িটা একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছেন। ঘড়ির কাঁটা যেন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত গহ্বরে—এক সময়ের গহ্বরে, যেখানে সত্যি আর মিথ্যার মাঝের রেখাটা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে।
সায়ন্তনী ঘরে ঢুকল ফাইল হাতে নিয়ে।
“স্যার, অধ্যাপকের ঘরে পাওয়া হাতঘড়িটা আমি ফরেনসিক ল্যাবে টেস্ট করিয়েছি। আশ্চর্য জিনিস মিলেছে—ঘড়ির কাঁটায় অতি ক্ষুদ্র মাত্রায় সায়ানাইডের ধুলো লেগে আছে। কারও ঘাম বা রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেটা ওখানে জমেছে।”
অরিজিৎ চমকে উঠলেন।
“মানে খুনি ঘড়িটা ধরেছিল। আর তখনই বিষের কণা লেগেছে। ঘড়িটা ভাঙাও হয়েছে সম্ভবত তখনই।”
সায়ন্তনী মাথা নাড়ল।
“আর একটা কথা, ঘড়িটার ভিতরের কাঁটায় খুব ছোট করে খোদাই করা একটা অক্ষর ‘M’। সেটা খোদাই করার জন্য ম্যাগনিফাইং গ্লাস দরকার হয়।”
অরিজিৎ ঠোঁট কামড়ে ধরলেন।
“যে এত নিখুঁতভাবে কাজ করেছে, সে যে কেবল উত্তেজনায় খুন করেনি—সে আগেই পরিকল্পনা করেছিল।”
এই সময়েই ফোন বেজে উঠল। শ্যামলাপাড়ার সেই বাড়ি থেকে—মেঘলার মা।
“স্যার, আজ মেঘলা কলেজ থেকে ফেরেনি। দুপুরে বেরিয়েছিল, তারপর আর আসেনি।”
অরিজিৎ ফোন রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন।
মেঘলা নিখোঁজ।
তাঁর মাথায় ঝনঝন করে উঠল সেই ভাঙা ঘড়ির কাঁটা—২:১৭।
রাত দুটো সতেরো—এটা কি শুধু একটা এলোমেলো সময়? না কি ওটা আসলে পরবর্তী খুনের সময়সীমা?
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে তিনি সায়ন্তনীকে বললেন,
“যদি মেঘলাকে না খুঁজে পাই, তাহলে পরের লাশও আমরা সময়মতো খুঁজে পাব না।”
বাইরে তখন ঝড়ের হাওয়া উঠছে। গাছের পাতা ছিঁড়ে উড়ছে আকাশে। আর কোথাও, হয়তো খুব কাছেই, কেউ ঘড়ির কাঁটা নতুন করে সেট করছে—মৃত্যুর সময় গোনার জন্য।
পর্ব ৫ : অদৃশ্য কাঁটা
রাত ন’টা। শ্যামলাপাড়ার গলির শেষপ্রান্তে অরিজিৎ সেনের গাড়ির হেডলাইট কুয়াশার মতো আলো ছড়িয়ে থেমে গেল। চারদিকে নিস্তব্ধতা, দূরে কেবল একবার কুকুর ডেকে উঠল। মেঘলার বাড়ি তালাবন্ধ। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা গেল অন্ধকার ঘরের ভেতর শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই।
অরিজিৎ দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর ফোনে থানার অফিসারকে নির্দেশ দিলেন—
“শ্যামলাপাড়ার চারপাশে সব সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজে বার করো। দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত। মেয়েটা কখন কোথায় গেছে জানতে হবে।”
ফেরার সময় তাঁর চোখ পড়ল গলির কোণের এক চায়ের দোকানে। দোকানটা তখন বন্ধ হওয়ার মুখে।
“দাদা, আজ দুপুরে এই মেয়েটাকে দেখেছেন?” — অরিজিৎ মেঘলার ছবি ফোনে দেখালেন।
চায়েবালা চোখ কুঁচকে বলল,
“হ্যাঁ… দুপুর দুটো নাগাদ একা একাই গিয়েছিল ওই দিকের পুরনো ঘড়ির দোকানের দিকে। একটা কাগজে কিছু লিখছিল, তারপর চলে গেল।”
ঘড়ির দোকান।
অরিজিৎ স্তব্ধ। ঠিক তখনই তাঁর ফোনে মেসেজ আসে—সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে মেঘলা বিকেল তিনটের সময় কলেজ থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে গিয়েছে স্টার্লিং ঘড়ি ঘর নামের এক দোকানের দিকে।
তিনি সোজা গিয়ে ঢুকলেন সেই দোকানে। দোকানের বাতাসে পুরনো লোহার গন্ধ। তাকজোড়া ঝুলছে শত শত ঘড়ি, কাঁটা ঘুরছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। কাউন্টারের পেছনে এক বৃদ্ধ দোকানি বসে আছেন।
“আমি পুলিশ,” অরিজিৎ বললেন, “আজ দুপুরে এক মেয়ে এসেছিল—মেঘলা নামে। কী করেছিল ও এখানে?”
দোকানি চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন,
“ও একটা পুরনো হাতঘড়ি মেরামত করাতে এসেছিল। ঘড়িটা একদম অধ্যাপক মুখার্জীর মতো দেখতে। আর ও বলেছিল, ঘড়িটা যেন ঠিক ২টা ১৭ মিনিটে থেমে থাকে।”
অরিজিৎ-এর বুকের ভেতর রক্ত যেন জমে গেল।
“থেমে থাকে? মানে ওর ইচ্ছে ছিল ঘড়িটা চলবে না?”
“হ্যাঁ,” বৃদ্ধ শান্ত স্বরে বললেন, “ও বলেছিল, সময় থামিয়ে রাখলে সত্যি ফাঁস হয় না।”
অরিজিৎ বাইরে বেরিয়ে এলেন ধীরে ধীরে। মাথার মধ্যে ঘুরছে কেবল একটাই বাক্য —
মেঘলা সময়কে থামাতে চায়। আর থেমে যাওয়া সময়েই লুকিয়ে আছে খুনির চিহ্ন।
পর্ব ৬ : সময়ের কবর
রাত তখন সাড়ে দশটা। থানার ঘরের আলো নিভু নিভু করছে, আর টেবিলের ওপর ছড়ানো ফরেনসিক রিপোর্ট, সিসিটিভি প্রিন্টআউট আর সেই ভাঙা হাতঘড়িটা যেন একসাথে একটা অদ্ভুত ছক তৈরি করছে। অরিজিৎ সেন চুপচাপ বসে আছেন, চোখ লাল হয়ে আছে ক্লান্তিতে—তবুও ঘুম আসছে না।
তিনি বারবার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন—
মেঘলা যখন অধ্যাপকের ঘড়ির অনুরূপ ঘড়ি বানিয়ে সেটাকে ঠিক ২:১৭-তে থামিয়ে রাখতে চেয়েছিল, সেটা নিছক কাকতাল নয়। এটা একটা সংকেত। হয়তো অধ্যাপকের ঘড়িটাও সে-ই থামিয়েছিল।
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ল সায়ন্তনী।
“স্যার, একটা জিনিস পেয়েছি।”
সে টেবিলে একটা ছবি রাখল—অধ্যাপকের ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক থেকে উদ্ধার করা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে অধ্যাপক মুখার্জী এবং মেঘলা—দু’জন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, একটা প্রাচীন ঘড়ি হাতে ধরে আছে। পেছনে একটা বড় ব্যানার:
“Time Is the First Murderer — Seminar on Temporal Paradox.”
অরিজিৎ ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“ওরা দু’জন একসাথে কাজ করছিল সময় নিয়ে। হয়তো ইতিহাস বদলানোর ধারণা, হয়তো সময় থামিয়ে সত্যি লুকোনোর প্রয়াস।”
সায়ন্তনী বলল,
“আরেকটা কথা—মেঘলার কলেজের বন্ধুরা জানিয়েছে, ও প্রায়ই বলত: সময়কেই মেরে ফেলতে পারলে অপরাধ ধরা পড়ে না।”
ঘরের নিস্তব্ধতায় হঠাৎই মোবাইল বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর।
“ইন্সপেক্টর সেন?” — অপর প্রান্তে এক কাঁপা গলা, নারীকণ্ঠ।
“আমি মেঘলা বলছি।”
অরিজিৎ সোজা হয়ে বসলেন।
“তুমি কোথায়? সবাই তোমাকে খুঁজছে।”
“আমি দোষী নই,” মেঘলার গলা ভেঙে যাচ্ছিল, “কিন্তু ও মারা গেছে আমার জন্যই… আমি শুধু ওকে বলতে গিয়েছিলাম ঘড়িটা থামিয়ে দিতে। যেন সময় না এগোয়। যেন সত্যি চিরকাল লুকিয়ে থাকে। কিন্তু কেউ… কেউ ওর ঘরে ঢুকে পড়েছিল যখন আমি বেরিয়ে আসি…”
“কে?” অরিজিৎ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি জানি না। আমি শুধু জানি ঘড়িটার কাঁটায় ‘M’ খোদাই করেছিলাম আমি। যেন জানি আমি-ই সময় থামিয়েছি… কিন্তু আমি খুন করিনি।”
কল কেটে গেল।
ঘরে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। অরিজিৎ টেবিলের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন ধীরে ধীরে—
“তুমি সময় থামিয়েছিলে, মেঘলা… কিন্তু কেউ সেই থেমে যাওয়া সময়ের ভেতর খুন ঢুকিয়ে দিয়েছে।”
পর্ব ৭ : অদৃশ্য খুনি
রাত প্রায় বারোটা। থানার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মিহি পর্দার মতো, আর অরিজিৎ সেন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একমনে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন। মেঘলার কল রেকর্ড বারবার প্লে করছেন—তার কাঁপা গলা, দমবন্ধ কান্না, আর সেই বাক্য—
“আমি সময় থামিয়েছিলাম… কিন্তু খুন করিনি।”
তাঁর মনে হচ্ছিল, এই কেসটা খুনের চেয়েও বেশি কিছু—এটা যেন সময়ের মধ্যে খুন লুকোনোর এক অদ্ভুত খেলা।
এই সময় সায়ন্তনী তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকল।
“স্যার, একটা নতুন সূত্র। ল্যাপটপের ব্রাউজার হিস্ট্রিতে দেখা গেছে অধ্যাপক মৃত্যুর আগের দিন এক সাইট ঘেঁটেছিলেন—‘Horologia Obscura’। এটা একধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড ঘড়ি-সংক্রান্ত ফোরাম, যেখানে বিরল এবং অভিশপ্ত ঘড়ি বিক্রি হয়।”
অরিজিৎ চোখ কুঁচকালেন।
“অভিশপ্ত?”
“হ্যাঁ, ওখানেই একটা থ্রেডে লেখা ছিল—একটা নির্দিষ্ট মডেলের ঘড়ি আছে যেটা যেদিন থামে, সেদিন তার মালিক মারা যায়।”
অরিজিৎ টেবিলের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। থেমে আছে ২:১৭-তে।
“মানে কেউ অধ্যাপকের ঘড়িকে ইচ্ছা করে থামিয়ে দিয়েছিল। যেন ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়।”
তাঁর মাথার মধ্যে তড়িঘড়ি এক সমীকরণ গড়ে উঠল—
- মেঘলা ঘড়ি থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু খুন করেনি।
- অধ্যাপক সেই ঘড়ি নিয়ে গোপন গবেষণা করছিলেন।
- আর কেউ এই গবেষণা জানত, এবং জানত ঘড়ি থামলে মৃত্যু আসবে।
অরিজিৎ চেয়ারে হেলান দিলেন।
“তাহলে খুনি শুধু মানুষ নয়… বিশ্বাসেরও খুনি।”
ঠিক তখনই থানার রিসেপশনে ফোন বেজে উঠল। ডিউটি কনস্টেবল ছুটে এসে বলল,
“স্যার, শান্তিনিকেতন লেনের সেই বাড়িটায় তালা ভেঙে কেউ ঢুকেছে। প্রতিবেশীরা আওয়াজ পেয়েছে।”
অরিজিৎ উঠে দাঁড়ালেন।
“চলো।”
গাড়ি ঝড়ের বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ছুটে চলল। তাঁর মনে হচ্ছিল—
খুনি আবার সেই ঘরে ফিরেছে। হয়তো প্রমাণ লুকোতে।
অথবা… হয়তো সময়কে আবার চালু করতে।
পর্ব ৮ : থেমে যাওয়া ঘর
বৃষ্টিভেজা অন্ধকার রাত। শান্তিনিকেতন লেনের পুরনো তিনতলা বাড়িটার সামনে পুলিশ গাড়ি থামতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল আলো। গলির নিস্তব্ধতায় হঠাৎ সাইরেনের শব্দ যেন ছুরি কেটে দিল বাতাসকে।
অরিজিৎ সেন ও সায়ন্তনী দৌড়ে ঢুকলেন দোতলায় অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জীর পড়ার ঘরে। দরজার তালা ভাঙা, কাঠের টুকরো ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। ঘরের ভেতর হালকা গ্যাসোলিনের গন্ধ।
টেবিলের ওপরের সব কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে, অনেকগুলো কুঁচকে গেছে যেন কেউ তাড়াহুড়ো করে খুঁজছিল কিছু। আর ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে একটা নতুন ঘড়ি — দেখতে হুবহু অধ্যাপকের ভাঙা হাতঘড়ির মতো, শুধু কাঁচ অক্ষত।
ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে — ২:১৭।
সায়ন্তনী বিস্ময়ে বলল,
“স্যার… এটা তো অন্য একটা ঘড়ি। কেউ আবার এখানে রেখে গেছে।”
অরিজিৎ ধীরে ধীরে ঘরের চারদিকে হাঁটলেন। মেঝেতে ভেজা কাদা পায়ের দাগ—হালকা, কিন্তু স্পষ্ট। জানালা আধখোলা। বাইরে বৃষ্টির জলে বারান্দার গ্রিল চকচক করছে।
তিনি কাগজগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে খেয়াল করলেন—একটা কাগজের প্রান্তে লেখা আছে পেন্সিলে:
“Time stops where truth begins.”
ঠিক তখনই বারান্দা থেকে একটা শব্দ—কেউ দৌড়ে পালাল।
অরিজিৎ বন্দুক হাতে দৌড়ে গেলেন। বারান্দার রেলিংয়ে একটা সাদা রুমাল ঝুলছে—ভিজে, কিন্তু রক্তের ক্ষীণ দাগ লেগে আছে।
সায়ন্তনী বলল,
“স্যার, এই খুনি শুধু খুন করতে আসেনি… সে ফিরে এসেছে সময় থামাতে আবারও।”
অরিজিৎ নতুন ঘড়িটা হাতে তুলে নিলেন। চোখের সামনে এক ঝলক দেখা গেল—প্রথম ঘড়ির কাঁচে শুকনো রক্ত, আর এই ঘড়ির কাঁচ একদম স্বচ্ছ… যেন খুনি জানিয়ে গেছে,
“খেলা আবার শুরু হলো।”
বাইরে বজ্রপাতের আলোয় বাড়িটার ছায়া এক মুহূর্তের জন্য দপ করে জ্বলে উঠল। অরিজিৎ অনুভব করলেন—এই খুনি বাস্তবের থেকেও বেশি ধারণার খুনি।
সে মানুষ মারে না, সে সময় মারে।
পর্ব ৯ : সময়ের খুনি
রাত তখন প্রায় একটা। থানার ফরেনসিক ল্যাবে বসে আছেন অরিজিৎ সেন—চোখ লাল, মুখে ক্লান্তির রেখা, কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। টেবিলের ওপর রাখা দুইটি ঘড়ি—একটি অধ্যাপকের, অন্যটি গতরাতে ঘরে রেখে যাওয়া—দুটোর কাঁটাই থেমে আছে ঠিক ২:১৭-এ।
সায়ন্তনী কম্পিউটারে লুপের নিচে ঘড়ির কাঁটা পরীক্ষা করছিল।
“স্যার, দুই ঘড়ির ধাতু আলাদা। প্রথম ঘড়িটা তামা মিশ্রিত পিতলের, আর দ্বিতীয়টা একধরনের বিরল স্টিল অ্যালয়—যেটা কেবল ‘স্টার্লিং ঘড়ি ঘর’-এ বানানো হয়। এবং…”
সে থেমে গেল।
“এবং?” — অরিজিৎ জিজ্ঞেস করলেন।
“দ্বিতীয় ঘড়ির কাঁটায় খুব ক্ষীণ এক আঙুলের ছাপ মিলেছে—অধ্যাপক মুখার্জীর নিজের।”
অরিজিৎ থমকে গেলেন।
“মানে খুনি ঘড়িটা বানিয়ে রেখে গিয়েছিল অধ্যাপকের ঘরে, আর অধ্যাপক সেটাকে ছুঁয়েও ছিলেন? তাহলে এটা কি আত্মহত্যা?”
“না,” সায়ন্তনী মাথা নাড়ল, “কারণ ঘড়িটা অধ্যাপক ছুঁয়েছিলেন মৃত্যুর অন্তত একদিন আগে। তার মানে কেউ জানত যে তিনি মারা যাবেন, আর সেই ভবিষ্যৎ জানার পরেই ঘড়িটা বানিয়েছিল।”
অরিজিৎ ধীরে ধীরে বললেন,
“মানে খুনি কেবল মানুষ নয়… সে ভবিষ্যৎও জানত।”
তিনি মনে মনে সমস্ত ঘটনার চক্র গেঁথে দেখতে লাগলেন—
- অধ্যাপক সময় থামানোর তত্ত্বে কাজ করছিলেন।
- মেঘলা ঘড়ি থামাতে চেয়েছিল সত্যি লুকোতে।
- আর কেউ জানত ঘড়ি থামলে মৃত্যু আসবে… এবং সেটাই ঘটিয়ে দিয়েছে।
ঠিক তখনই দরজা খুলে এক কনস্টেবল দৌড়ে ঢুকল।
“স্যার, মেঘলাকে পাওয়া গেছে! হাওড়া ব্রিজের নিচে অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিল। ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
অরিজিৎ উঠে দাঁড়ালেন।
“আমি যাচ্ছি। ও হয়তো খুনিকে দেখেছে।”
গাড়ি ছুটতে ছুটতে তাঁর মাথায় একটাই বাক্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—
“খুনি মানুষ নয়, সময়েরই এক রূপ… এবং আমি তাকে থামাতে যাচ্ছি।”
পর্ব ১০ : থেমে যাওয়া সত্যি
ভোরের প্রথম আলো তখন হাসপাতালের সাদা করিডোরে পড়ছে। অরিজিৎ সেন নিঃশব্দ পায়ে হাঁটছেন—মেঘলার কেবিনের দিকে। তার গায়ে স্যালাইনের পাইপ, মুখ ফ্যাকাশে, চোখ আধখোলা।
মেঘলা ফিসফিস করে বলল,
“আমি… খুনি নই… আমি শুধু ওকে বলেছিলাম ঘড়িটা থামিয়ে দিতে… যেন সত্যি না বেরোয়… ও খুব ভয় পেত… কারও হাতে পড়ে যাবে বলে।”
“কেউ? কে?” — অরিজিৎ সামনে ঝুঁকলেন।
মেঘলা কাঁপা গলায় বলল,
“অধ্যাপকের গবেষণার সঙ্গী… ড. রোহন বাগচী… ও-ই সব জানত… ও বলেছিল অধ্যাপকের বই প্রকাশ হলে ওর নাম থাকবে না… তাই ও সব দখল করতে চেয়েছিল…”
তারপর চোখ বুজে গেল।
অরিজিৎ থানায় ফিরে রোহনের খোঁজ দিলেন। খবর এল—রোহন বাগচী গতকাল রাতেই দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু এয়ারপোর্টে তাকে আটকানো হয়েছে।
বিকেলে রোহনকে থানায় আনা হলো। শান্ত গলায় বলল,
“আমি ওকে মেরেছি না… আমি শুধু ঘড়িটা বদলে দিয়েছিলাম… জানতাম, ও বিশ্বাস করে যে ঘড়ি থামলে মৃত্যু আসবে… আমি সেই বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েছি… ওর পানীয়তে বিষ মিশিয়ে ঘড়িটা ২:১৭-তে থামিয়ে রেখে এসেছিলাম… যেন মনে হয় সময়ই তাকে মেরেছে… আর আমিই ওর গবেষণা নিয়ে বই বের করতাম।”
অরিজিৎ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
“তুমি মানুষকে করোনি… কিন্তু ওর বিশ্বাসকে খুন করেছ। আর বিশ্বাসই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।”
রোহনকে নিয়ে যাওয়া হলো।
অরিজিৎ একা বসে রইলেন টেবিলে। সামনে রাখা সেই ভাঙা হাতঘড়ি। কাঁটা থেমে আছে ২:১৭-তে, নিঃশব্দ, নির্বিকার।
তিনি আস্তে বললেন—
“সময় থামে না। থামে শুধু যারা সময়কে থামাতে চায়।”
ঘড়িটা কাগজে মুড়ে লকারে রেখে দিলেন। বাইরে জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে—এক নতুন দিনের আলো, যেখানে সময় আবার চলতে শুরু করেছে।
***