রুদ্রনীল মুখোপাধ্যায়
পর্ব ১: শীতের ধোঁয়ায় ঢাকা গ্রাম
পূর্ব মেদিনীপুরের এক ছোট্ট গ্রাম। শীতকালের ভোর। মাঠে ঘন কুয়াশা নেমে এসেছে। শীতল হাওয়ায় নারকেল গাছের পাতা কাঁপছে। দূর থেকে হেঁটে আসছে কৃষকরা, কাঁধে লাঙল, মাথায় উলের টুপি। পুকুরপাড়ে বসে রয়েছে বুড়ো গোপাল—গাঁয়ের লোক তাকে ডাকে “গোপাল-ঠাকুর” নামে। বয়স আশির কোঠায়। মুখভরা সাদা দাড়ি, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
গ্রামের নতুন প্রজন্ম ভাবে তিনি কেবলই বুড়ো। কিন্তু বয়স্করা জানে—এই মানুষ একসময় ছিলেন লোককথার ভাণ্ডার। নদীর ধারে, বটতলার আড্ডায়, মেলা-পার্বণে—তার গল্পে জমে উঠত রাত।
আজও তিনি একা বসে বটগাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই বটগাছ গ্রামে এক রহস্য। লোকেরা বলে—গাছটার শিকড়ের নিচে লুকিয়ে আছে কোনো পুরনো আত্মা। রাতে যদি কেউ সাহস করে কাছাকাছি যায়, অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়—কখনো বাঁশির সুর, কখনো কান্না।
শীতের সকালের কুয়াশায় গোপাল-ঠাকুর গম্ভীর স্বরে ফিসফিস করে বললেন,
—“আবার শুরু হলো… বটতলার ছায়া নড়ছে। এ বছর হয়তো গল্পটা ফের ফিরে আসবে।”
গ্রামের বাচ্চারা ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরল। তারা চায় আবার সেই পুরনো গল্প শুনতে। গোপাল-ঠাকুর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—
“অনেক বছর আগে, এই গ্রামেই থাকত কাঞ্চি নামের এক যুবতী। সুন্দরী, কিন্তু অদ্ভুত স্বভাবের মেয়ে। সে নাকি চাঁদের আলোয় গান গাইত, আর তার গলায় যে গান উঠত, তা শুনে গাছের পাতাও কেঁপে উঠত। সবাই বলত—তার গানের মধ্যে অন্য জগতের ডাক আছে। কিন্তু একদিন সে হঠাৎ মিলিয়ে গেল। আর সেই থেকে এই বটতলার ছায়া বদলে গেল।”
বাচ্চাদের চোখ বিস্ফারিত। দূরে আবার কাক ডেকে উঠল। গ্রামের নিস্তব্ধতায় বটগাছের ঝুরি নড়ল হাওয়ার সাথে। যেন হালকা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
গোপাল-ঠাকুর চুপ করে গেলেন। ঠান্ডা কাঁপুনি তাকে ছুঁয়ে গেল। বাচ্চারা ভয়ে একে অপরের হাত ধরল।
কেউ জানে না, এই গল্পের শুরুটা কোথায়, শেষটাই বা কেমন।
পর্ব ২: হারিয়ে যাওয়া কাঞ্চির কথা
গ্রামের লোকেরা বলে—এই বটগাছের বয়স অন্তত তিনশো বছর। তার ঝুরি ঝরে পড়েছে মাটিতে, অনেক ঝুরি আবার নীচের মাটিকে আঁকড়ে নতুন গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাছটার চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা, এমনকি দুপুরবেলা, যখন গ্রামমাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলে আর মাঠময় গরু চরতে থাকে, তখনও এখানে দাঁড়ালে মনে হয় যেন আলাদা একটা জগতের মধ্যে ঢুকে পড়া গেল।
গোপাল-ঠাকুর যখন কাঞ্চির গল্প শুরু করেছিলেন, বাচ্চারা তখন হাঁ করে শুনছিল। কিন্তু শুধু বাচ্চারা নয়, গ্রামের কিছু বয়স্ক মানুষও আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। কারণ কাঞ্চির নাম নিলেই এখনও গাঁয়ের মাটির বুক কেঁপে ওঠে।
কাঞ্চি ছিল এই গ্রামেই জন্মানো। বাবা ছিলেন মৃৎশিল্পী। মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানাতেন। মা বেঁচে থাকতে অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। কাঞ্চি ছিল তাদের একমাত্র সন্তান। ছোট থেকেই গান গাইতে ভালোবাসত। নদীর ধারে বসে গান ধরলে জেলে, মাঝি, কৃষক, এমনকি পাশের গ্রাম থেকে আসা লোকেরা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে শুনত। তার গলায় যে সুর ছিল, তাতে একধরনের বেদনামাখা ডাকে ভেসে আসত।
বলা হয়, কাঞ্চির কণ্ঠস্বর নাকি স্রেফ মানুষের জন্য ছিল না। তার গানে অদৃশ্য জগতের প্রাণীরাও টান পেত। রাতের বেলা সে একা একা গিয়ে বসত বটতলায়, আর তখনই তার গান যেন ভেসে যেত চারদিকে।
গ্রামের মহিলারা কানাঘুষো করে বলত—
“ও মেয়ে মানুষ নয়, অন্য কিছু। তার গান শুনলেই বুকের ভেতর শিরশির করে।”
আর পুরুষেরা গোপনে মুগ্ধ হলেও ভয় পেত।
কাঞ্চির বয়স যখন সতেরো, তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। পূর্ণিমার রাতে, মেঘহীন আকাশ, গ্রাম ছিল কেমন শান্ত। সবাই ঘরে। হঠাৎ কেউ শুনল—কাঞ্চির গানের সুর উঠেছে বটতলা থেকে। অনেকেই জানত, সে রাতে কাঞ্চির শরীর ভালো ছিল না। তবুও কণ্ঠ ভেসে এলো।
লোকজন কৌতূহল সামলাতে না পেরে দূর থেকে এগিয়ে গেল। তারা দেখল, বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চি। তার সাদা শাড়ি চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে, চুল উড়ছে হাওয়ায়। কিন্তু তার পায়ের নীচে যেন মাটি ছায়ার মতো ভেসে আছে—যেন সে পুরোপুরি মানুষের দেহ নয়।
সেই রাতে কাঞ্চিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল। পরদিন সকালে তার বাবা-মা আর্তনাদ করে জানালেন—মেয়ে নিখোঁজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। কেবল বটতলার কাছে কিছু মাটির হাঁড়ি ভাঙা অবস্থায় পড়ে ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি সেগুলো ছুঁড়ে ফেলেছে।
তারপর থেকে গ্রাম জুড়ে নানা ঘটনা ঘটতে লাগল। কখনো রাতে ভেসে আসত কাঞ্চির গানের মতো শব্দ, কখনো দেখা যেত সাদা ছায়ামূর্তি গাছের চারপাশে ঘুরছে।
কিছু সাহসী যুবক একদিন রাতে গিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিল। তারা সবাই ফিরে এসেছিল কাঁপতে কাঁপতে। কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল—
“ওখানে দাঁড়াতেই হঠাৎ বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যেন কেউ নিঃশ্বাস চেপে ধরল। আর কানে বাজতে থাকল কান্নার মতো সুর।”
তারপর থেকে লোকেরা বটগাছটার দিকে যেতে ভয় পেত। গাঁয়ের বয়স্করা একে মানতে লাগল অভিশাপ হিসেবে। আর ছোটদের কড়া করে শাসন দেওয়া হলো—সন্ধের পর কেউ বটতলার কাছে যাবে না।
গোপাল-ঠাকুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গল্প শেষ করলেন। বাচ্চারা আর বয়স্করা একসঙ্গে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কিছু বলল না। কেবল শীতল বাতাস বয়ে গেল বটপাতার ফাঁক দিয়ে।
ঠিক তখনই হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ এলো—“খস্খস্।”
সকলের চোখ ঘুরে গেল সেইদিকে। কিন্তু ঝোপে কেউ নেই। শুধু শুকনো পাতাগুলো যেন নিজেরাই কেঁপে উঠল।
এক মুহূর্তে লোকেদের বুকের ভেতর অকারণ ভয় ঢুকে পড়ল। সবাই ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগল। বাচ্চারা মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরল।
গোপাল-ঠাকুর শান্ত স্বরে বললেন,
—“ভয় পেও না। ওরা কেবল জানাচ্ছে—আমরা আবার তাদের কথা তুলেছি।”
গ্রামের লোকেরা আর দাঁড়াতে পারল না। দল বেঁধে চলে গেল নিজের নিজের ঘরে। কিন্তু সেদিন রাতটাতে কেউই ভালো করে ঘুমোতে পারল না।
কারণ, চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসার পর, ভোররাতের দিকে, যেন আবার ভেসে এলো এক হাহাকারমাখা সুর।
কেউ হয়তো কল্পনা করেছিল, কেউ হয়তো সত্যিই শুনেছিল—কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে সকলের মন এক হলো—কাঞ্চির ছায়া এখনও এই গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।
পর্ব ৩: শিকড়ে আটকে থাকা সুর
গ্রামের শীত যেন হাড়ে কাঁটা দিয়ে হাওয়া চালিয়ে দেয়; মাঠের মাটিতে শিশির জমে থাকে দুপুর অবধি, আর দুপুর পেরোলে গরুর ঘাড়ে ঝোলানো ঘণ্টার শব্দের ভেতর দিয়ে দিনটা গোধূলির দিকে ঢলে পড়ে। এরই মধ্যে গ্রামে এলো নতুন স্কুলশিক্ষক—ঈশান। শহরে বড় হওয়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, গলায় সদা বাঁধা মাফলার, কথাবার্তায় যুক্তির ঝিলিক। নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে যখন প্রথমবার প্রধানশিক্ষকের ঘরে বসেছিলেন, বাইরের জানালা দিয়ে বটগাছটার মাথা দেখা যাচ্ছিল। বড়দের কেউ একজন বলেছিল—“মাস্টারমশাই, সন্ধের পর ওইদিকে না হলেই ভালো।” ঈশান হেসেছিল, বলেছিল, “ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই।” সবাইও হেসেছিল বটে, কিন্তু হাসির ভেতর একটা অপরাজেয় ভয় লেগে ছিল; সে ভয় এই গ্রামে কেউ জোরে বলে না, শুধু দড়ির মতো শক্ত করে কষে বেঁধে রাখে বুকের ভেতর।
ঈশান স্কুলের কাজ সামলে বিকেলবেলা পুকুরঘাটে নামল। কুয়াশা নামতে নামতে জল জ্যোৎস্নার মতো হয়ে আছে। ঘাটের ধারে বসে ছিল কমলা কাকিমা—গা ঘেঁষে বাসন মাজছেন, মুখে দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ। ঈশান ছুঁয়ে কথা তুলতেই কাকিমা তাকালেন—“আপনি নতুন মাস্টার তো? শুনেছি লোকে আপনাকে ভুতের ভয় দেখায়।” ঈশান হেসে বলল, “ভয় দেখানোর জিনিসটা নিজেই ভয় পায়, কাকিমা। আমি বরং শুনতে চাই—কাঞ্চি কে ছিলেন?” কমলা কাকিমা জলটল ঝেড়ে হাতে শাঁখার কড়া ঠিক করলেন, তারপর যে কণ্ঠে বললেন, সেখানে গ্রামের পুরোনো দিনের ধুলো, চৈত্রের লু-হাওয়া, আর কপালের সিঁদুরে লেগে থাকা ঘামের ধারা মিশে ছিল—“কাঞ্চি ছিল বটতলার গান। ও গাইত, গাছের পাতা কাঁপত। যে কান দিয়ে শুনেছে, সে ভুলতে পারেনি। এক রাতে গেছে—তারপর থেকে বটতলার বাতাসে কেমন একটা শো-শো সুর বাজে। ওই সুরে যে নাম শোনা যায়, তা সবাই শোনে না। যার কাছে ওর দেনা-পাওনা আছে, তার কানে পৌঁছে। আমি নিজে শুনেছি—কিন্তু বলব না। ও সব কথা বললে ঘরে ছায়া লাগে।” কাকিমা ফিরতি পথ ধরলেন, ঈশান একা রইল, আর বটপাতার ফাঁকে পাখির বাসা থেকে খুটখুট শব্দ ভেসে এসে ছিল—যেন ভিতরে কেউ সুঁই-সুতো চালিয়ে পুরোনো কাপড় বুনছে।
সেই রাতেই একটা ঘটনা হল। হারাধন পালিতের গরুটা সন্ধের পর থেকে খোঁপায় ফিরল না। ছেলেপেলেরা টর্চ নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে বটগাছের ধার ঘেঁষে গেল। দূর থেকে দেখা গেল—গরুটার শিংয়ে লাল সুতোর ফোঁড়, গলায় ভাঙা ঘন্টা, আর সামনেই মাটির ওপর আধখানা ভাঙা শাঁখ, হাত ধরাধরি করে বুড়োদের চোখে জল এনে দিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলল—“এটা মানিকেশ্বরীর শাঁখ, বিয়ের আগের মেয়ে মান্নত বেঁধে রেখে যায়। কে উসকে দিল?” কেউ আবার ফিসফাস করে কাঞ্চির নাম তুলল। গরুটা বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল, কিন্তু ভাঙা শাঁখটা কেউ তুলল না; তবু সকাল হলে দেখা গেল সেটা আর নেই—মাটিতে কেবল শাঁখের ধুলো আর ধূলোয় জড়িয়ে থাকা লাল আলতার লালচে দাগ, যেন পায়ের পাতায় দাগ রেখে কেউ ভেসে গেছে।
ঈশান সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে গোপাল-ঠাকুরের আড্ডায় গিয়ে বসল। বুড়োর চোখে রাত জেগে থাকা জ্যোৎস্না জমে আছে। ঈশান নম্র গলায় বলল, “দাদু, আপনি যা জানেন, আমায় বলুন। কুসংস্কার ভাঙতে হলে জানা দরকার।” গোপাল-ঠাকুর চট করে হাসলেন না। অনেকক্ষণ বটপাতার দুলুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন; তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “কুসংস্কার আর কুসংহার এক জিনিস নয়, মাস্টার। যা ভুল, তা ভাঙতে হবে—কিন্তু যা মাটির ভেতর রেখে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, তা ভাঙলে মাটি রেগে যায়। কাঞ্চি বাঁচত গান দিয়ে। তার গান যে শুধু প্রেমের ছিল, তা নয়—তার গানে নদী ডেকে আনবার তাবিজ ছিল। খরার সময়ে গ্রামের মহিলারা, কুমোরদের মেয়েরা, বউঝিরা বটতলায় শাঁখ পুঁতে মান্নত দিত—‘পানির পথ খোল, নদীর মুখ ফেরাও।’ কাঞ্চি সে শাঁখে ফুঁ দিত। শোনা যায়, এক বছর বর্ষা না-হওয়ার মুখে সে রাতে শাঁখ বাজিয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিল। সেই থেকেই বটতলা তার কাছে দোলনা হয়েছিল, আবার খাঁড়িও। যে দোলনায় সে গান বুনত, যে খাঁড়িতে সে ঢেউ ঠেলত, সেইখানেই একদিন সে থমকে গেল—যেন শিকড়ে আটকে গেল তার পায়ের নীচের সুর।”
ঈশানের শরীরের ভেতরে কৌতূহল আর যুক্তি একসঙ্গে ধাক্কা মারল। সে একা বটতলায় গেল দুপুরবেলা, যখন আলো এমন পাতলা থাকে যে ছায়ার রং বোঝা যায় না। ঝুরিগুলোর নিচে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে থাকা শিকড়গুলোর ফাঁকে মাটি নরম। হাঁটু গেড়ে বসে সে মুঠো মুঠো মাটি সরাতে লাগল। আঙুলে প্রথমে লাগল পুরোনো কাঁসার গন্ধ, তারপর মিলল একটি ভাঙা কর্ণফুলের নক্ষত্রাকৃতি টুকরো, পোকা খাওয়া লাল রঙের সুতো, আর একখানা মাটির হাঁড়ির মুখ। ছেনি-হাতুড়ি তো ছিল না, হাতের নখ দিয়ে যতটা ওঠে, ততটাই তুলল; কিন্তু যেই হাঁড়ির মুখটা বেরোল, ছায়ার মতো ঠাণ্ডা একটা বাতাস শিরদাঁড়ায় উঠে বসল। দূরে যে ছেলেটা ক্রিকেট খেলছিল, সে বল থামিয়ে তাকাল—“মাস্টারমশাই!” ঈশান অন্যমনে বলল, “কিছু না, তুমি খেলো।” হঠাৎ যেন কারও হাঁটার শব্দ—একা, ধীর পায়ে পাতা ভাঙার ‘খস্ খস্’, তারপর খুব মৃদু একটা সুর, শাঁখ না বাশি, বোঝা গেল না; তবু সেই সুরে একটা নাম লুকিয়ে যে আছে, তা ঈশানের কান বলল। সে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। নামটা যেন তাকে টানছে—“ঈ-শা-ন…” সে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। কে ডাকে? কেন ডাকে?
সন্ধে নামার আগে সে গোপাল-ঠাকুরের কাছে ফিরে গেল। “আমার নাম কে জানত?” ঈশানের কণ্ঠে অচেনা কাঁপুনির রেখা। গোপাল-ঠাকুর এদিক-ওদিক দেখে নিলেন, তারপর টুপিটা নামিয়ে বললেন, “তোমার মা কে?” “লাবণ্য।” “লাবণ্য… সে তোমার ছোটবেলায় কি এই গ্রামে থাকত?” “থাকত। আমরা কয়েক বছর ছিলাম, তারপর বাবার বদলি।” গোপাল-ঠাকুর ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “লাবণ্য আর কাঞ্চি ছিল আখরের মতো জোড়া। কাঞ্চির গানের কথা যে ক’জন লিখে রাখতে পারত, লাবণ্য তাদের একজন। এক পূর্ণিমায় তারা বটতলায় শাঁখ পুঁতে মান্নত দিয়েছিল—যদি গানকে মানুষ হতে দেওয়া যায়, তবে নদী এই গ্রাম ছেড়ে যাবে না। তারপর বছর খানেকের মধ্যে তোমাদের চলে যাওয়া। আর তার ক’মাস পর কাঞ্চির হারিয়ে যাওয়া। তোমার নাম ও জানত, আর তোমাদের বন্ধনের কথা বটগাছও জানত। তাই তোমাকে ডাকে—যা তলায় রাখা ছিল, তা ফেরত চাইছে।”
ঈশান রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখল ডাকপিয়ন রেখে গেছে একখানা চিঠি—মায়ের হস্তাক্ষর। শহর থেকে পাঠানো, কদিনের পুরোনো। খাম ছিঁড়তেই কাগজের গায়ে আলতার হালকা আভা লেগে গেল, যেন দূর থেকে লাল পায়ের ছাপ এসে বসে আছে। চিঠিতে মা লিখেছেন—“বাবু, গ্রামে গিয়েছ শুনেছি। বটতলার কথা উঠলে ভয় পাস না। আমরা ছোটবেলায় যা মাটিতে রেখেছিলাম তা যার, তার করে দিয়ে দিস। কাঞ্চির গানের কথা আমি লিখে রেখেছিলাম একটা খাতায়, তোর কাছে নেই, বোধহয় ওর কাছে গেছে। যদি কিছু খুঁজে পাস, মাটিকে কেঁদে ফেলিস না। শান্ত করে ফেরত দিস, তবেই মাটির ক্রোধ থামবে।” ঈশান চিঠি বুকে চেপে বসে থাকল অনেকক্ষণ। বাইরে তখন বাতাসে শালে-শিমুলের পাতা মুখর। দূরে কারও উঠোনে খড়ি পড়ার শব্দ। কানে বাজছে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ, মোরগের ব্যাকুল ডাক। কিন্তু তার কানে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে বাজল একটি গানের ছায়া—যেন কেউ শিকড় ধরে টানতে টানতে সুরটাকে ওপরে তুলছে, মাটির ভেতর থেকে খুঁজে আনছে এক নারীকণ্ঠ।
রাত গাঢ় হলে ঈশান নিজেকে থামাতে পারল না। কেয়ারটেকারের রাখা পুরোনো লণ্ঠন জ্বালিয়ে বটতলার দিকে হাঁটল। চাঁদের আলো নেই, তবু কুয়াশার ছাপ সাদা। ঝুরিগুলো অন্ধকারে কালো সাপের মতো ঝুলছে। লণ্ঠনের আলোয় ধরা পড়ল কিছু অদ্ভুত দাগ—মাটিতে গোল বৃত্ত, বৃত্তের মধ্যে আঁকা তিনটে ছোট রেখা, যেন কারও পায়ের আঙুলের ছাপ, আর তার পারেন্নে ভাঙা মাটির ঢাকনা। ঈশান অজান্তেই বৃত্তের ভেতর পা রাখল। সঙ্গে সঙ্গে বাতাস কেঁপে উঠল। লণ্ঠনের শিখা লম্বা হয়ে ছাইরঙা হলো। খুব কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে হাসল—না, হাসি নয়, কান্না? ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে দেখা গেল চুলের গোছা নড়ছে, কারও চুল? সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “যে-ই হও, বেরিয়ে এসো। ভয় দেখিয়ে কী হবে?” সেই মুহূর্তে পায়ের গোড়ালিতে ঠান্ডা শেকলের মতো কিছু একটা জড়িয়ে গেল—বটের শিকড়? না, শ্যাওলা? ঈশান আৎ, বলে উঠে লণ্ঠনটা উঁচু করতেই দেখল—শিকড়ের সঙ্গে লাল সুতো বাঁধা। সেই সুতোর মাথায় এক কাঁকুজুরির বীজতলার মতো ছোট থলি ঝুলছে। হাত কাঁপতে কাঁপতে থলিটা ছুঁতেই ভিতর থেকে খসে পড়ল একটি কাগজের টুকরো আর আধমলিন মাটির দুল—পাশাপাশি তামার ক্ষীণ চিহ্নে লেখা—“ক-ঞ্-চি।”
শিকড় আঁকড়ানো আলগা হলো না। ঈশান কাগজটা লণ্ঠনের আলোয় ধরল। তাতে ছড়ানো ক’টি লাইন, লাবণ্যর হাত, নাকি কাঞ্চির? বোঝা গেল না। লেখা—“জল ডাকলে আমরা গান গাই, গান ডাকলে আমরা নাম উচ্চারণ করি। নাম যখন মাটিতে রেখে দিয়েছি, নামের ধারদেনা শোধ না করলে নদী মুখ ফেরাবে। যে আমার নাম লেখে, সে আমার কণ্ঠ ধার নেয়; যে আমার কণ্ঠ নেয়, সে আমার জীবনও একদিন নেবে। তবু ভয় নেই—দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন।” কাগজ কাঁপছে, লণ্ঠনের ছায়া লম্বা হচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাশিঁর সুর উঠল—এই সুর মানুষ বাজায়, গ্রামের দুষ্টু দেবু ছেলেটা—তাই তো! ঈশান সোজা হল, “কে? দেবু?” অন্ধকারে হাসির আওয়াজ এল, কিন্তু পরমুহূর্তেই বাঁশির সুরকে ছাপিয়ে আরেক সুর, ওই যে, শিকড়ে আটকে থাকা নারীকণ্ঠ, একেবারে কাছে, কান ঘেঁষে—“ঈশান…”
শিকড় আলগা হয়ে গেল; থলিটি ঈশানের হাতে থেকে মাটিতে পড়ে আবার দাঁত বসাল। লণ্ঠনের আলো হঠাৎ স্থির হয়ে এল। দেবুর পায়ের শব্দ দূরে সরল, ছেলেটা হয়তো ভয় পেয়ে পালাল। ঈশান ধীরে ধীরে বৃত্তের বাইরে পা রাখল, বুকের ভেতর ঢাক। সে বুঝল—এখানে কারও সাথে ঠাট্টা করা যায় না; এখানে কথার ওজন আছে; এখানে যে নাম উচ্চারণ হয়, তা কেবল ডাক নয়, শপথও। সে থলিটি আবার শিকড়ে বেঁধে দিল, দুলটি কোটের পকেটে রাখল, আর কাগজটা বুকে চেপে দীর্ঘ শ্বাস নিল। তারপর পা টিপে টিপে ফিরে আসতে আসতে মনে হলো—পেছনে কেউ, খুব হালকা পায়ে, তার ছায়ার ধার ধরে হাঁটছে, আর খুব আড়ষ্ট, খুব সাবধানে, একটা গান বাঁধছে—যেন মাটির গলা দিয়ে উঠে আসছে জল।
পর্ব ৪: গোপন খাতার দাগ
ভোররাতের ঠাণ্ডা বাতাসে ঈশানের শরীরটা হিম হয়ে আসছিল। আগের রাতের সেই ঘটনাটা এখনও বুকের ভেতর ধকধক করছে। শিকড়ের বাঁধা লাল সুতো, মাটির দুল, আর সেই নারীকণ্ঠে তার নাম উচ্চারণ—সব যেন এক অলিখিত চুক্তির মতো তার কানে বেজে চলেছে। ঘুম ভাঙার পরও যেন মনে হচ্ছিল, দূরে কোথাও গানের মৃদু প্রতিধ্বনি বাজছে।
সকালে স্কুলে গিয়েও মন বসছিল না। ব্ল্যাকবোর্ডে গাণিতিক অঙ্ক লিখতে লিখতে তার কানে আসছিল কান্নার সুর, অথবা হয়তো বায়ুর শোঁ শোঁ শব্দের সঙ্গে মিশে থাকা অদ্ভুত এক গলা। ছাত্রছাত্রীরা কেমন থমথমে হয়ে গিয়েছিল, যেন তার ভেতরের অস্থিরতা তারা টের পাচ্ছে।
ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে এসে ঈশান খুঁজে বার করল তার মায়ের পাঠানো পুরোনো ট্রাঙ্ক। ভেতরে কাপড়চোপড়, কিছু পুরোনো বই আর কয়েকটা খাতা রাখা ছিল। খাতাগুলোর মধ্যে একটাতে ধুলো জমে আছে, পাতার কিনারে পোকায় কাটা দাগ। খাতাটা খুলতেই দেখা গেল, অদ্ভুত সব গান লেখা—বঙ্গানুবাদ, ছড়া, আর মাঝেমধ্যে টানাটানি করা অক্ষরে এক নাম বারবার ফুটে উঠেছে—কাঞ্চি।
খাতার প্রথম পাতায় লেখা—
“এই সব গানের সুর আমার বন্ধু কাঞ্চির মুখে শোনা। একদিন যদি ওর কণ্ঠ হারিয়ে যায়, এই খাতা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
স্বাক্ষর—লাবণ্য।
ঈশানের বুকের ভেতর ধক্ করে উঠল। মা সত্যিই লিখে রেখেছিল। তাহলে যে কাগজটা শিকড় থেকে বেরিয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই এই খাতার কোনো ছেঁড়া অংশ। কিন্তু কার হাতে পৌঁছল সেটা? আর কেনই বা বটতলার শিকড়ে রাখা হয়েছিল?
খাতার ভেতরের গানগুলো সাধারণ মনে হলেও পড়তে পড়তে ঈশানের চোখে ঝাপসা লাগতে শুরু করল। কিছু গানের লাইন বারবার এক নামকে টেনে আনছে—
“নদী ডাকিল, কাঞ্চি গান গাইল
চাঁদ নামিল, কাঞ্চি দাঁড়াল…”
আরও কিছু গান যেন মন্ত্রের মতো—
“শাঁখ বাজিলে বৃষ্টি আসিবে,
নদীর মুখ খুলিবে,
যার নাম উচ্চারিবে,
তার জীবনও বাঁধিবে।”
ঈশান বারবার চোখ মুছল। সত্যিই কি মা এইসব লিখেছিল? নাকি সময়ের সঙ্গে খাতাটা বদলে গেছে?
হঠাৎ করেই দরজায় ঠকঠক শব্দ। ঈশান চমকে উঠল। বাইরে দাঁড়িয়ে গোপাল-ঠাকুর। সাদা দাড়িতে ভোরের শিশির লেগে আছে। ভিতরে এসে খাতাটা দেখে অনেকক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর বললেন,
“এটা লাবণ্যের হাত। কিন্তু মনে রাখো, মাস্টার—শুধু গান নয়, এ খাতা আসলে দায়ের খাতা। যার নাম এর মধ্যে ধরা পড়েছে, সে গ্রাম ছাড়তে পারে না। কাঞ্চির নাম এখানে আছে, তাই সে চলে যায়নি। মাটির শিকড়ে আটকে আছে।”
ঈশান হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“তাহলে কি কাঞ্চি বেঁচে আছে?”
গোপাল-ঠাকুর ধীরে মাথা নেড়ে বললেন,
“বেঁচে থাকার মানে কেবল শরীর নয়। কেউ যদি গানের মধ্যে আটকে যায়, সে মৃত্যুর পরও সুর হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তুমি শুনছ কারণ তোমার মা সেই বন্ধনের অংশ। তোমার রক্তে সেই দায় আছে।”
ঈশানের বুকের ভেতর শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। দায়? দায় মানে কী?
সন্ধের পর গ্রামে হঠাৎ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। শিবু নামের এক কৃষক গরুর গাড়ি নিয়ে ফিরছিল, তখন বটতলার পাশ দিয়ে আসতেই গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়। শিবু বলে উঠেছিল—“চল রে, চল।” কিন্তু গরু দুটো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যায়। তখন শিবু শুনতে পায় এক মেয়েলি গলা—“শিবু… শিবু…” সে আঁতকে উঠে লাঠি ঘোরাতেই বাতাস ফুঁসে ওঠে। পরে শিবু জানাল, সে চোখের সামনে সাদা শাড়ি পরা এক মেয়েকে দেখেছিল—যেন ভেসে বেড়াচ্ছে, মাটিতে পা নেই।
এই ঘটনার পর গ্রাম উত্তেজিত। কেউ বলছে কাঞ্চির আত্মা ফের বেরিয়েছে, কেউ বলছে নতুন মাস্টারের কারণে বটগাছ অশান্ত হয়ে উঠেছে। কয়েকজন তো সরাসরি ঈশানের দিকেই আঙুল তুলল।
ঈশান এবার আর চুপ করে থাকল না। সে বলল,
“আমি সত্য খুঁজতে চাই। কুসংস্কার ভাঙতে চাই।”
কিন্তু গোপাল-ঠাকুর চেপে ধরলেন তার হাত,
“সত্য কখনো সহজ নয়। যা মাটির তলায়, তা খুঁড়তে গেলে মাটিও রক্ত চাইতে পারে।”
রাত গভীর হলে ঈশান আবার খাতাটা খুলল। পাতার ফাঁকে একটি শুকনো শালপাতা গুঁজে রাখা ছিল। পাতার ওপরে আলতার দাগ, যেন কোনো বিয়ের আচার থেকে কেটে রাখা। দাগের নিচে লেখা একটি লাইন—
“যদি আমি ফিরে না আসি, তবে গানটা শেষ করবে তুমি।”
ঈশানের বুক কেঁপে উঠল। এই লাইন কার উদ্দেশ্যে লেখা ছিল? লাবণ্যর জন্য, নাকি কারও অদৃশ্য উত্তরাধিকারের জন্য?
বাইরে তখন বাতাসে অদ্ভুত শব্দ। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, বটগাছের দিকের আকাশে কুয়াশার মধ্যে যেন একটা ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে।
ঈশান টের পেল, খাতাটা কেবল কাগজ নয়—এ যেন একটি চাবি। আর এই চাবি এখন তার হাতে।
সে জানে, সামনে যে পথ খুলছে, তাতে ভয় আছে, মৃত্যু আছে—তবু কোনো অজানা শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বটতলার দিকে।
কারণ বটতলার গানে এখন কেবল এক নাম বাজছে—ঈশান।
পর্ব ৫: পূর্ণিমার আহ্বান
গ্রামজুড়ে তখন হাহাকার। শিবুর দেখা সেই সাদা ছায়ার কথা লোকেরা মুখে মুখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে। দুপুরের হাটে চায়ের দোকানে বসে কৃষক থেকে শুরু করে গৃহস্থ সবাই ভয়ে-সন্দেহে আচ্ছন্ন। কারও গলা কাঁপছে—“নতুন মাস্টার এলে গিয়েই তো এসব শুরু হলো।” আবার কারও গলা ফিসফিস—“না রে, কাঞ্চির দিন গুনে আসছে, পূর্ণিমা আসছে তো।”
ঈশান এসব গুজব শুনে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু তার বুকের ভেতর কাঁপন যেন লুকোনো আগুনের মতো জ্বলছে। খাতার পাতা খুললেই চোখে পড়ছে কাঞ্চির নাম, মায়ের হাতের লেখা, আর সেই অদ্ভুত মন্ত্রমাখা গান।
সন্ধ্যা নামতেই গোপাল-ঠাকুর তাকে ডেকে পাঠালেন। পুরোনো কুঁড়েঘরে বসে আছেন তিনি, সামনে ধুপকাঠি জ্বলছে। ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে আছে হলুদ-লাল রঙের আলো। ঈশান বসতেই বুড়ো গম্ভীর গলায় বললেন—
“পূর্ণিমার রাত আসছে। ওই রাতেই কাঞ্চির আত্মা সবচেয়ে জোরে ডাকে। আর ওই রাতেই হয় তার মুক্তি, নয়তো অভিশাপের পুনর্জন্ম। তুমি এড়িয়ে যেতে পারবে না।”
ঈশান কণ্ঠে প্রতিবাদ আনার চেষ্টা করল—“কিন্তু আমি এসব মানি না দাদু। আমি যুক্তি দিয়ে…”
গোপাল-ঠাকুর বাধা দিলেন,
“যুক্তি আর অভিজ্ঞতা এক নয়, মাস্টার। তুমি মায়ের রক্ত বহন করছ। লাবণ্য কাঞ্চির শপথের অংশ। তাই বটতলা তোমাকেই ডাকছে।”
কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঈশানের বুক কেঁপে উঠল। মনে পড়ল আগের রাতের সেই ফিসফিসে ডাক—“ঈশান…”
সেই রাতেই সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল।
সে দেখল—বটগাছের শিকড়গুলো সাপের মতো নড়ে উঠছে, আর মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসছে এক সাদা ছায়ামূর্তি। তার চোখ নেই, মুখ নেই, কেবল দীর্ঘ কেশ বাতাসে উড়ছে। সেই মূর্তি দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে—“ফিরে দাও… গান ফিরিয়ে দাও…” হঠাৎ মূর্তিটা তার দিকে এগোতেই সে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। বুক কাঁপছে, শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
ভোরে স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে সে লক্ষ্য করল, ওদের চোখেও ভয়। এক বাচ্চা মেয়ের খাতায় আঁকিবুকি করা ছবিতে দেখা গেল—একটা বড় বটগাছ, আর তার নিচে সাদা শাড়ি পরা এক মেয়ে। ঈশান আঁতকে জিজ্ঞেস করল, “এ ছবি কে শিখিয়েছে তোমাকে?” মেয়েটি নিরীহ চোখে বলল—“কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি মাস্টারমশাই। কাঞ্চিদিদি গান গাইছিল।”
এবার ঈশান আর নিশ্চুপ থাকতে পারল না। রাতে সে আবার খাতাটা নিয়ে বসল। পাতার মাঝখান থেকে বেরিয়ে এল ভাঁজ করা এক টুকরো পত্র। তাতে লেখা—
“পূর্ণিমার রাতে শাঁখ বাজবে। শাঁখের সুরে গান ফিরে আসবে। যদি ভুলে যাও, তবে নদী মুখ ঘুরিয়ে নেবে।”
ঈশান বুঝল—সবকিছুর উত্তর লুকিয়ে আছে পূর্ণিমার রাতে।
পূর্ণিমার আগের দিন বিকেলে গ্রামে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করে পুকুরের জল কালো হয়ে উঠল, মাছ ভেসে উঠল, আর কয়েকজন বলল—“বটতলার দিক থেকে কান্নার শব্দ আসছে।” মহিলারা ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়তে লাগল। কিন্তু পুরুষরা স্পষ্ট জানিয়ে দিল—পূর্ণিমার রাতে কেউ বটগাছের কাছে যাবে না।
ঈশান একা জানত—সে যাবে। কারণ খাতাটা, দায়, আর কাঞ্চির ডাক তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে এলো সেই রাত। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, সাদা আলোয় গ্রাম ঝলমল করছে। কুকুরেরা একসঙ্গে ডাকছে, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা। হাতে লণ্ঠন আর খাতা নিয়ে ঈশান ধীরে ধীরে এগোল বটতলার দিকে। দূরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা কাঁপতে কাঁপতে দেখছিল, কিন্তু কেউ সাহস করে এগোল না।
বটগাছের নিচে পৌঁছেই ঈশান টের পেল বাতাস থেমে গেছে। গাছের ঝুরি যেন স্থির হয়ে আছে। হঠাৎ করেই কানে ভেসে এলো শাঁখের সুর। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। সুরটা যেন শিকড়ের ভেতর থেকে উঠছে।
সে খাতার প্রথম গানটা পড়তে শুরু করল—
“নদী ডাকিলে, কাঞ্চি গান গাইল
চাঁদ নামিলে, কাঞ্চি দাঁড়াল…”
কণ্ঠে কাঁপুনি থাকলেও শব্দগুলো বেরোতেই বাতাসে আলোড়ন উঠল। শিকড়গুলো নড়ল, পাতাগুলো কাঁপল, আর সামনে এক আলোকছায়া তৈরি হলো। সাদা কেশরাশি উড়ছে, শরীর নেই, কেবল কণ্ঠ।
“ঈশান…”
ছায়াটা ডাকল।
ঈশান বুক চেপে দাঁড়িয়ে রইল। কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। সে শুধু বলতে পারল—“কাঞ্চি… তুমি কি গান ফিরে চাইছ?”
ছায়াটা দুহাত বাড়াল। কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে এলো—“আমার গান মাটিতে বেঁধে রাখা। ফিরিয়ে দাও… মুক্তি দাও।”
ঈশান বুঝল, খাতার গানের মধ্যে বাঁধা আছে কাঞ্চির আত্মা। যদি সে খাতার গান পূর্ণ করে গেয়ে শোনাতে পারে, তবে হয়তো মুক্তি মিলবে। কিন্তু যদি ব্যর্থ হয়—গ্রামের ওপর নেমে আসবে নতুন অভিশাপ।
চাঁদের আলো তখন গাছের শিকড়ে ঢালছে। আশেপাশের লোকেরা দূর থেকে দেখছিল—মাস্টার দাঁড়িয়ে আছে, হাতে লণ্ঠন, সামনে সাদা ছায়া।
ঈশান খাতার শেষ গানটা পড়তে শুরু করল। কিন্তু শব্দগুলো জিভে আটকে গেল। বুক ভারী হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে কেউ তার কণ্ঠ চেপে ধরছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।
ঠিক তখনই মনে পড়ল মায়ের চিঠির লাইন—“মাটিকে কেঁদে ফেলিস না। শান্ত করে ফেরত দিস।”
ঈশান গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে গাইতে শুরু করল, খাতার শব্দ নয়—নিজের সুরে। গলা কাঁপছিল, তবু সুর উঠল—
“যা ছিল বাঁধা, তা মুক্ত হোক,
যা ছিল শিকড়ে, তা নদীর জলে ভাসুক…”
হঠাৎ বাতাস ফুঁসে উঠল। শিকড়গুলো কাঁপল, পাতাগুলো ঝরতে লাগল। আর সাদা ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কণ্ঠস্বরের শেষে শোনা গেল এক দীর্ঘশ্বাস—যেন কেউ মুক্তি পেল।
গ্রামজুড়ে তখন অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো। পুকুরের কালো জল স্বাভাবিক হলো, দূরের কুকুরগুলো থেমে গেল। সবাই চমকে উঠল।
ঈশান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল—খাতার শেষ পাতাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কোনো লেখা নেই।
সে জানল—কাঞ্চির গান হয়তো শেষ হয়েছে। নাকি এ শুধু শুরু?
পর্ব ৬: মুক্তির পরে বাঁধন
পূর্ণিমার রাতের সেই দৃশ্যের পর গ্রাম যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পরদিন ভোরে মাঠের গরুগুলো নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে, পুকুরের জল আবার স্বচ্ছ, আর আকাশে পাখিদের ডাক। গ্রামের লোকেরা বলতে শুরু করল—“কাঞ্চি মুক্তি পেয়েছে।” কেউ কেউ ঈশানকে প্রণাম করে বলল—“আপনি তো আমাদের দুঃখ ঘোচালেন।”
কিন্তু ঈশান জানত, বিষয়টা এত সরল নয়।
সে যখন খাতার দিকে তাকাল, দেখতে পেল—শেষ পাতাটা ফাঁকা হলেও মাঝের পাতাগুলোর কালির দাগগুলো যেন ছড়িয়ে গেছে। শব্দগুলো আর স্পষ্ট নেই, কিছু অক্ষর ঝাপসা হয়ে গেছে, আবার কিছু অক্ষর যেন নতুন করে ফুটে উঠছে। বিশেষ করে এক নাম—ঈশান।
বুকের ভেতর আবারও কেঁপে উঠল। কেন তার নাম? মুক্তি যদি হয়ে থাকে, তবে কেন এই বাঁধন?
দিন কয়েক শান্তভাবে কাটল। কিন্তু পঞ্চম দিনে গ্রামে নতুন সমস্যা দেখা দিল। নদীর ধারে মাছ ধরতে গিয়ে দুজন মাঝি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। তাদের নৌকাটা ভেসে উঠল, কিন্তু মানুষ নেই। লোকজন বলল—“কাঞ্চি তো মুক্তি পেল, তবে এ কিসের অঘটন?”
ঈশান গিয়ে নৌকাটা দেখল। ভেতরে একটা অদ্ভুত দাগ—লাল রঙের রেখা, যেন আলতার ছাপ। নৌকার তলায় একটা অচেনা গান আঁকা ছিল, কারও হাতের লেখা, বাঁকানো অক্ষরে—
“জল যদি গিলে নেয়,
গান যদি থেমে যায়,
তবে নামই ফের ভেসে ওঠে।”
ঈশান স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, মুক্তি আসলে অর্ধেক। কাঞ্চির কণ্ঠ হয়তো মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু তার নাম এখনও মাটির সঙ্গে বাঁধা। আর সেই নামের দায় এখন তার নিজের কাঁধে।
রাত নামতেই সে গেল গোপাল-ঠাকুরের কাছে। বুড়ো তখন আগুন পোহাচ্ছিলেন। ঈশান সব কথা খুলে বলল। গোপাল-ঠাকুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
“মাস্টার, গানকে মুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু নামকে নয়। নাম মানে আত্মার শিকল। কাঞ্চির নাম এই গ্রামে লিখে রেখেছিল লাবণ্য। তোমার মা-ই দায় বেঁধেছিল। তাই এখন তার ছেলেকে সেই দায় শোধ করতে হবে।”
ঈশান ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল।
“দায় শোধ মানে কী?”
বুড়ো বললেন,
“যতদিন না কাঞ্চির নাম খাতার ভেতর থেকে মুছে যায়, ততদিন সে গ্রাম ছাড়তে পারবে না। আর নাম মুছতে গেলে চাই উৎসর্গ।”
ঈশান আঁতকে উঠল—“উৎসর্গ? মানে কাউকে প্রাণ দিতে হবে?”
বুড়ো চোখ নামালেন, কিছু বললেন না। শুধু আগুনে শুকনো কাঠ ছুঁড়ে দিলেন। কাঠটা চট করে ফেটে গিয়ে ঝলকে উঠল লাল আগুন।
পরের দিন থেকে গ্রামে কানাঘুষো শুরু হলো। কেউ বলছে, নতুন মাস্টারই দায়ী, কেউ বলছে, সে নিজেই কাঞ্চির নাম লিখে ডেকে এনেছে। কিছু যুবক রাগে-ক্ষোভে ঈশানকে গ্রাম ছাড়তে বলল।
ঈশান মনের জোর হারাল না। সে রাতে আবার খাতা খুলল। চোখের সামনে হঠাৎ অক্ষরগুলো ভেসে উঠল—
“ঈশান, পূর্ণিমার রাত শেষ হয়নি। পরের পূর্ণিমা আসবে, তখন দায় চাইবে। প্রস্তুত থেকো।”
শব্দগুলো ঝাপসা হলেও স্পষ্টভাবে তার নাম ফুটে উঠল। বুকের ভেতর হিম কাঁপুনি নামল।
ঠিক সেই সময় দরজায় ঠকঠক শব্দ। ঈশান খুলে দেখল—একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স আঠারো-উনিশ, সাদা শাড়ি, চুলে জট, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। মেয়েটি ধীরে বলল—
“আমি মান্দারপুকুরের সীতা। সবাই বলে আমি অদ্ভুত, কারণ আমি স্বপ্নে কাঞ্চিকে দেখি। গতরাতে সে আমাকে বলল—মাস্টারমশাইকে খুঁজে বেরাও।”
ঈশান হতভম্ব হয়ে মেয়েটিকে বসতে দিল। সীতা ফিসফিস করে বলল—
“কাঞ্চি গান ফিরে চায়নি, সে নাম ফেরত চেয়েছে। যদি নাম খাতার ভেতরে আটকে থাকে, তবে মুক্তি অসম্ভব। আর নাম ভাঙতে গেলে চাই আত্মীয় রক্ত।”
ঈশানের গলা শুকিয়ে গেল। “আত্মীয় রক্ত? কিন্তু আমি তো…”
সীতা শান্ত গলায় বলল—“তুমি লাবণ্যের ছেলে। তুমি-ই কাঞ্চির দায়ের উত্তরাধিকারী। তুমি ছাড়া এই গ্রাম শান্ত হবে না।”
সেদিন রাতে ঈশান ঘুমোতে পারল না। জানলার বাইরে বটগাছের ছায়া যেন আরও লম্বা হয়ে উঠেছে। বাতাসে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—
“ঈশান… আমার নাম ফেরত দাও…”
সে বুক চেপে বসে রইল। বুঝল, সময় গোনা শুরু হয়ে গেছে।
পরদিন সকালে খবর এলো—আবার একজন নিখোঁজ। এবার গোপাল-ঠাকুর নিজেই গিয়ে দেখলেন নদীর ধারে, বালির ওপর লাল আলতার দাগ। তিনি চুপচাপ ফিরে এসে ঈশানকে বললেন—
“এখন আর সময় নেই। পূর্ণিমার আগে সত্যি জানতে হবে—লাবণ্য কীভাবে কাঞ্চির নাম খাতায় বেঁধেছিল।”
ঈশান সিদ্ধান্ত নিল—সে শহরে যাবে, মায়ের কাছে সত্য জেনে আসবে। কিন্তু গ্রাম তাকে আটকাতে চাইছিল। কারণ সবাই জানত—গ্রাম ছেড়ে মাস্টার চলে গেলে অভিশাপ ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
ঈশান সবকিছু উপেক্ষা করে রওনা দিল।
শহরে পৌঁছে মাকে পেল এক অন্ধকার ঘরে। মা তখন শয্যাশায়ী, চোখে অদ্ভুত আলো। ঈশান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল—
“মা, তুমি কেন কাঞ্চির নাম খাতায় লিখেছিলে?”
লাবণ্য মৃদু হেসে বললেন—
“কারণ ও আমার বোনের মতো ছিল। কাঞ্চি আমাকে বলেছিল—যদি কখনও সে হারিয়ে যায়, তবে তার গান যেন না মরে। আমি নাম লিখে রেখেছিলাম যাতে ও বেঁচে থাকে। কিন্তু বুঝিনি, নাম মানেই শিকল। এখন সেই দায় তোমার হাতে।”
ঈশান কাঁপতে কাঁপতে বলল—“তাহলে আমাকে কী করতে হবে?”
মা চোখ বন্ধ করে বললেন—
“পূর্ণিমার রাতে শিকড়ে খাতাটা পুঁতে দিও। কিন্তু সাবধান—মাটি শুধু কাগজ নেবে না, রক্তও চাইবে।”
এই বলে মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
ঈশান গ্রামে ফিরে এলো। পরের পূর্ণিমা এগিয়ে আসছে। গ্রামবাসীরা সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে, কিন্তু কেউ আর মুখ খুলছে না।
রাতে সে খাতাটা বুকে চেপে বসে রইল। বাইরের বাতাসে আবার সেই কণ্ঠ ভেসে এলো—
“ঈশান… পূর্ণিমা… নাম ফেরত দাও…”
বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে বুঝল—আসন্ন পূর্ণিমা গ্রামকে হয়তো মুক্তি দেবে, নয়তো শেষ করবে।
পর্ব ৭: পূর্ণিমার আগের অস্থিরতা
গ্রামে অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। পূর্ণিমা যত এগিয়ে আসছে, মানুষজনের মুখে ততই অদ্ভুত চাপা ভয় জমে উঠছে। দিনের বেলায় মাঠে হালচাষের সময় হঠাৎ লাঙল ভেঙে যাচ্ছে, গরুগুলো অকারণ ছুটে পালাচ্ছে, আর রাতে কুকুরেরা একসঙ্গে হুক্কা-হুয়া ডাক দিচ্ছে। মহিলারা বলছে—“এবার বোধহয় গ্রামটা রক্ষা পাবে না।”
ঈশান স্কুলে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না। বাচ্চাদের চোখে ভয়, খাতায় আঁকিবুকি, কেউ লিখছে—“কাঞ্চি”, কেউ আবার বটগাছ এঁকে রাখছে। সে বুঝতে পারল, আতঙ্ক মানুষের রক্তে ঢুকে গেছে।
গোপাল-ঠাকুরকে ডেকে বলল—
“দাদু, এটা থামাতে হলে কী করতে হবে?”
বুড়ো ধীরে ধীরে বললেন—
“পূর্ণিমার রাতে খাতাকে মাটির হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মনে রেখো, মাটি শুধু কাগজ নেবে না। সে চাইবে রক্ত।”
ঈশান কাঁপা গলায় বলল—
“কিসের রক্ত?”
গোপাল-ঠাকুর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—
“যে দায়ের উত্তরাধিকারী, তার রক্ত।”
ঈশান স্তব্ধ হয়ে গেল।
সেই রাতে গ্রামের মানুষ হঠাৎ জেগে উঠল। কারণ নদীর ঘাট থেকে হাহাকার শোনা গেল। ছুটে গিয়ে দেখা গেল, জলের ওপর ভেসে উঠেছে অসংখ্য পদচিহ্ন—আলতার লালচে দাগে আঁকা। কিন্তু আশ্চর্য, পদচিহ্নগুলো নদীর দিকে যাচ্ছে না, বরং নদী থেকে গ্রামমুখী। যেন কোনো অদৃশ্য মিছিল গ্রামে ঢুকে পড়েছে।
মানুষজন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল—“কাঞ্চি ফিরছে! কাঞ্চি আসছে!”
ঈশান সব শুনে নিজের ঘরে বসে কাঁপছিল। খাতাটা খুলতেই দেখল, পাতাগুলো কাঁপছে, আর শব্দ ফুটে উঠছে—
“পূর্ণিমার আগের রাত হল প্রবেশদ্বার। তুমি যদি সাহস দেখাও, তবে গান থামবে, না হলে নদী গ্রাম গিলে নেবে।”
পরদিন ভোরে সীতা এল ঈশানের কাছে। মুখ ফ্যাকাশে, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। সে ফিসফিস করে বলল—
“গত রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি। কাঞ্চি দাঁড়িয়ে আছে বটগাছের তলায়। সে বলছে—‘আমার নাম ফেরত দাও।’ কিন্তু সে রাগান্বিত ছিল। যদি তুমি না দাও, তবে সে পুরো গ্রাম নিয়ে যাবে।”
ঈশান ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল।
“কীভাবে ফেরত দেব আমি?”
সীতা চোখ নামিয়ে বলল—
“খাতাকে শিকড়ে পুঁতে দিতে হবে। কিন্তু খাতা খুলে নাম মুছতে গেলে চাইবে আত্মীয় রক্ত।”
ঈশান ভেবেছিল হয়তো এটা কুসংস্কার। কিন্তু যখন দেখল সীতার হাত কেটে গেছে, অথচ সে নিজে বুঝতেই পারেনি কীভাবে, তখন বুঝল—এটা নিছক ভয়ের কথা নয়।
গ্রামজুড়ে উত্তেজনা বাড়ল। কেউ বলছে মাস্টারই দায়ী, কেউ বলছে ওর মা লাবণ্যই অভিশাপ বেঁধেছিল। কয়েকজন যুবক রাতের অন্ধকারে এসে ঈশানের ঘর ঘিরে ধরল। তারা চিৎকার করে বলল—
“তুই খাতাটা ফেলে দে! না হলে তোকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেব।”
ঈশান বুক চেপে দাঁড়াল।
“খাতা ফেললে কিছু হবে না। দায় আমার উপরেই আছে। আমি না মেটালে গ্রামও বাঁচবে না।”
ওরা কিছু না বলে পিছিয়ে গেল। কিন্তু তাদের চোখে ভয় আর ঘৃণা একসঙ্গে জ্বলছিল।
পূর্ণিমার আগের রাত নেমে এলো। আকাশে মেঘ জমে উঠেছে, কিন্তু মাঝে মাঝে চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে। বাতাসে কেমন একটা হাহাকার, শিস বাজানো শব্দ। বটগাছের ঝুরিগুলো কেঁপে উঠছে।
ঈশান খাতাটা বুকে নিয়ে এগোল বটতলার দিকে। সীতা তার সঙ্গে গেল।
গাছের নিচে পৌঁছতেই বাতাস থেমে গেল। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। হঠাৎ শোনা গেল মৃদু গান—
“শাঁখ বাজিল, নদী ডাকিল, নাম যদি না ফেরে, রক্ত চাইবে…”
সীতা কাঁপতে কাঁপতে বলল—“সে এসেছে।”
অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল এক ছায়া। সাদা শাড়ি, চুল বাতাসে উড়ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।
“ঈশান… আমার নাম ফেরত দাও…”
গলা শোনা মাত্রই ঈশানের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। খাতার পাতাগুলো হাওয়ায় উল্টে যেতে লাগল। হঠাৎ শেষ পাতায় দেখা গেল রক্তের মতো দাগে লেখা অক্ষর—ঈশান।
সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কণ্ঠ শুকিয়ে গেল।
সীতা হঠাৎ কেঁপে উঠল। তার কপাল থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে, অথচ কোনো আঘাত নেই। সে ধীরে বলল—“হয়তো আমিই উৎসর্গ। কাঞ্চি আমাকে বেছে নিয়েছে।”
ঈশান চিৎকার করে উঠল—“না! এটা অন্যায়।”
ছায়াটা কাছে এসে ফিসফিস করল—“দায় শোধ হবে না রক্ত ছাড়া।”
ঈশান বুকের ভেতর শেষ সাহস জোগাড় করল। খাতা মাটিতে রাখল, নিজের আঙুল কামড়ে রক্ত ঝরাল, আর সেই রক্ত খাতার পাতায় ছুঁইয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ফুঁসে উঠল। শিকড়গুলো নড়ে উঠল, গাছ কাঁপল। ছায়াটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলিয়ে গেল।
মাটিতে পড়ে রইল খাতা, আর ঈশানের রক্তের দাগ।
কিন্তু আশ্চর্য, সীতা তখনো দাঁড়িয়ে। তার চোখে জল, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। সে ধীরে বলল—
“তুমি দায় শোধ করলে। কিন্তু মনে রেখো, নাম কখনো পুরোপুরি মুছে যায় না। নাম যদি একবার মাটিতে লেখা হয়, সে থেকে যায় চিরকাল।”
ঈশান স্তব্ধ হয়ে গেল।
পূর্ণিমার আগের রাত এভাবেই শেষ হলো। কিন্তু সে জানত—আসন্ন পূর্ণিমা আরও ভয়ংকর হবে।
পর্ব ৮: পূর্ণিমার রাত্রির হাহাকার
গ্রামে যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। কুকুরেরা কুঁইকুঁই করে উঠছে, গরুগুলো গোয়ালঘরে ছটফট করছে। বৃদ্ধরা শ্বাস ফেলছে ভারি হয়ে, যেন তারা জানে—আজকের পূর্ণিমা কোনো সাধারণ পূর্ণিমা নয়।
ঈশান সারা দিন বটগাছের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। তার বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা। গত রাতের অভিজ্ঞতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে—অভিশাপ পুরোপুরি থামেনি। রক্ত দেওয়ার পরও খাতার পাতায় লাল অক্ষরে নাম থেকে গেছে। সেদিকে তাকালেই মনে হয়, কেউ ফিসফিস করছে, কারও শ্বাস ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের প্রস্তুতি
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের মাঝপথে মশাল জ্বালানো হলো। কুমোরপাড়ার লোকেরা শাঁখ বাজাল, যেন মন্দ শক্তি দূরে থাকে। কিন্তু শাঁখের শব্দেই যেন বটগাছের ডালপালা কেঁপে উঠল। গোপাল-ঠাকুর, যিনি এতদিন শুধু সতর্ক করছিলেন, এবার নিজেই মশাল হাতে বেরোলেন।
তিনি বললেন—
“আজকের রাতেই সব শেষ করতে হবে। নয়তো নদী গ্রাম গিলে নেবে। তোমরা যে যা পারো সঙ্গে নাও—শাঁখ, ঘণ্টা, ধূপ, আগরবাতি।”
মহিলারা কেঁদে ফেলল। কেউ বলল—“আমরা কীভাবে লড়ব আত্মার সঙ্গে?”
গোপাল-ঠাকুর উত্তর দিলেন—
“লড়াই নয়। এটা দায় শোধের রাত। যার কাছে নাম বন্দী, সে-ই উত্তর দেবে।”
সবাই একসঙ্গে ঈশানের দিকে তাকাল।
সীতার অদ্ভুত আচরণ
সেই সন্ধ্যা থেকেই সীতা অদ্ভুত আচরণ করছে। সে একা একা নদীর ঘাটে চলে যাচ্ছিল, আর হঠাৎ গান গাইছিল কাঞ্চির মতো। তার কণ্ঠে এমন বেদনা, এমন টান, যেন চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। মহিলারা ছুটে গিয়ে তাকে টেনে ঘরে আনল। কিন্তু সীতা বলল—
“ও আমাকে ডাকছে। বটগাছের নিচে যেতে হবে।”
ঈশান আতঙ্কিত হয়ে তার হাত ধরে ফেলল।
“না সীতা, তুমি যাবে না। এটা ফাঁদ।”
কিন্তু সীতার চোখ তখন অদ্ভুত শূন্য। সে শুধু ফিসফিস করে বলল—
“আমার শরীরই তার দরকার।”
পূর্ণিমার উদয়
রাত বাড়ল। আকাশে গোল চাঁদ উঠল, চারদিক সাদা আলোয় ভরে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, গ্রামে সেই আলো পৌঁছাল না। বটগাছের চারপাশে ঘন কালো ছায়া জমে উঠল, যেন আলো সেখানে ঢুকতেই ভয় পাচ্ছে।
হঠাৎ বাতাসে বাঁশির মতো শব্দ ভেসে এলো। তারপরই গানের সুর—
“ফিরে দাও নাম, না হলে ডুবে যাক গ্রাম।”
মানুষজন চিৎকার করে উঠল। কুকুরেরা হুংকার দিতে লাগল। নদীর দিক থেকে জল ফুলে ফুলে গর্জন করছে, যেন ঢেউ তীর ছাপিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়বে।
খাতার রূপান্তর
ঈশান খাতা খুলল। প্রতিটি পাতায় রক্তের দাগ ছড়িয়ে পড়েছে, অক্ষরগুলো জীবন্ত হয়ে নড়ছে। একেকটা অক্ষর যেন বেরিয়ে এসে শিকড়ের মতো মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে।
হঠাৎ খাতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক বিকট কণ্ঠ—
“ঈশান! দায় শোধ হয়নি। রক্ত মাটি পেলেও নাম মুছে যায়নি। এবার চাই আত্মা।”
খাতার পাতায় তখন স্পষ্ট দেখা গেল—সীতা।
ঈশান স্তব্ধ হয়ে গেল।
“না! আমি কাউকে দেব না।”
আত্মার আবির্ভাব
বটগাছের নিচে ধোঁয়া উঠল। সেই ধোঁয়া থেকে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হলো এক নারীর অবয়ব। সাদা শাড়ি, লম্বা চুল, মুখে অস্পষ্ট ছায়া। কিন্তু চোখদুটো লাল আগুনের মতো জ্বলছে।
সে হাত বাড়িয়ে বলল—
“আমার নাম ফিরিয়ে দাও। নইলে এই মেয়েটিকে নিয়ে যাব।”
সে সরাসরি সীতার দিকে তাকাল। সীতা যেন সম্মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার ঠোঁটে আবার কাঞ্চির গান বেজে উঠল।
গ্রামের প্রতিরোধ
গ্রামের পুরুষরা মশাল উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শাঁখ বাজল, ঘণ্টা বাজল। ধোঁয়ার মধ্যে আলোর রেখা ছুটে গেল। কিন্তু আত্মা হেসে উঠল।
“এতে কিছু হবে না। নামের দায় কেবল রক্তে শোধ হয়।”
বাতাসে ঝড় উঠল। মশাল নিভে গেল একে একে। মানুষ মাটিতে পড়ে গেল, যেন অদৃশ্য শক্তি তাদের চেপে ধরছে।
ঈশানের ত্যাগ
ঈশান বুকের ভেতর সাহস জোগাড় করল। সে সীতার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল—
“না! তাকে নেবে না। যদি আত্মা চাই, তবে আমাকে নাও।”
আত্মা থমকে গেল।
“তুই দায়ভার নেবি?”
ঈশান খাতাটা তুলে ধরল।
“হ্যাঁ। নাম আমার রক্তে লেখা, দায়ও আমার।”
সে নিজের বুক চিরে রক্ত ঝরাল খাতার পাতায়।
বিস্ফোরণ
সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফেটে গেল বজ্রের শব্দে। চাঁদের আলো সরাসরি খাতার ওপর পড়ল। পাতাগুলো জ্বলতে শুরু করল, একে একে আগুন ধরে গেল। আত্মার চিৎকার চারদিকে কেঁপে উঠল—
“না… নাম মুছে গেলে আমি অস্তিত্ব হারাব!”
কিন্তু আগুনে খাতা ভস্ম হয়ে গেল। আত্মার শরীর টলতে লাগল, তারপর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল।
নদীর গর্জন থেমে গেল, বাতাস শান্ত হলো।
পরিণতি
সবাই হাঁপ ছাড়ল। কিন্তু ঈশান তখন মাটিতে পড়ে আছে, বুক থেকে রক্ত ঝরছে। সীতা তাকে কোলে তুলে কাঁদছে। গোপাল-ঠাকুর ছুটে এসে বললেন—
“সে গ্রামকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এর মূল্য চড়া।”
গ্রামবাসীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারা জানত, এক যুবকের আত্মত্যাগে আজ তারা বেঁচে গেছে।
চাঁদের আলো এবার গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বটগাছের ছায়া তখনও ঘন অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গোপাল-ঠাকুর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন—
“নাম মুছে গেলেও ছায়া থেকে যায়। এ গাছের কাহিনি শেষ হয়নি।”
পর্ব ৯: ছায়ার প্রত্যাবর্তন
ঈশানের আত্মত্যাগের পর গ্রাম যেন নতুন করে নিশ্বাস ফেলল। অনেক দিন পর নদীর ধারে মাছ ধরা শুরু হলো, মাঠে কৃষকরা স্বাভাবিক ছন্দে হাল ধরল, আর হাটে-ঘাটে হাসির শব্দ ভেসে উঠল। লোকেরা বলল—“অভিশাপ শেষ হয়েছে। মাস্টার আমাদের রক্ষা করেছে।”
কিন্তু গোপাল-ঠাকুর নীরব থাকলেন। তার চোখে যে আশঙ্কা জমে উঠেছে, তা কেউ বুঝতে পারল না।
অশান্তি ফিরে আসে
ঈশানের মৃত্যুর পর খাতার ছাই বটগাছের তলায় চাপা দেওয়া হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল, সব শেষ। কিন্তু একদিন ভোরে দেখা গেল, ছাই যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে নতুন কচি শিকড় বেরিয়ে এসেছে। আশ্চর্য, ওই শিকড়গুলো সাদা নয়, রক্তলাল।
শিশুরা প্রথমে খেলার ছলে এগিয়ে গিয়ে শিকড় ছুঁয়ে দেয়। তারপর তাদের গলায় অদ্ভুত সুর উঠল, যেন তারা না চাইতেও কাঞ্চির গান গাইছে। মায়েরা ছুটে এসে সন্তানদের আঁকড়ে ধরল। শিশুদের চোখে তখন অচেনা আলো, আর কণ্ঠে সেই পুরোনো ডাক—
“ফিরে দাও নাম…”
গ্রামে আবার ভয়ের ঢেউ বয়ে গেল।
সীতার পরিবর্তন
ঈশানের মৃত্যুর পর থেকেই সীতা চুপচাপ হয়ে গেছে। সে প্রায়ই বটগাছের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে। মহিলারা বলছে, সীতার মধ্যে কাঞ্চির ছায়া ঢুকে গেছে।
একদিন সন্ধ্যায় সীতাকে দেখা গেল বটগাছের শিকড়ের কাছে বসে গান গাইতে। তার কণ্ঠে সেই একই সুর—
“নদী ডাকিল, কাঞ্চি গান গাইল…”
লোকেরা দৌড়ে গিয়ে তাকে টেনে আনল। কিন্তু সীতা হাসল মৃদু কণ্ঠে।
“ভয় পেও না। আমি কাঞ্চি নই। কিন্তু কাঞ্চির নাম এখনও মাটির ভেতরে। ঈশান তার জীবন দিয়ে গানকে মুক্তি দিয়েছে, নামকে নয়।”
গ্রামের লোকেরা স্তম্ভিত হয়ে গেল।
গোপাল-ঠাকুরের স্বীকারোক্তি
রাতের আড্ডায় গোপাল-ঠাকুর অবশেষে মুখ খুললেন।
“শোনো সবাই, নামকে মুছে ফেলা যায় না। কারণ নাম মানেই অস্তিত্ব। কাঞ্চির নাম খাতায় লেখা হয়েছিল, সেই নাম বংশানুক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঈশানের মৃত্যুর পর দায় থেমে যায়নি। বরং আরও গভীরে গিয়েছে।”
লোকেরা ভয়ে প্রশ্ন করল—“তাহলে এবার কী হবে?”
বুড়ো গম্ভীর গলায় বললেন—
“যতদিন না কাঞ্চির নাম অন্য কোনো নামে মিলিয়ে যায়, ততদিন গ্রাম শান্তি পাবে না। নামকে বাঁচাতে হলে চাই আরেক নাম, আরেক গান। হয়তো সীতা সেই সেতু।”
রাতের রহস্য
সেই রাতে গ্রাম নিস্তব্ধ। সবাই ঘরে তালা দিয়ে বসে আছে। কিন্তু বটগাছের তলায় আবার অদ্ভুত শব্দ। কুকুরেরা হাউমাউ করে উঠল। হঠাৎ মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়তেই দেখা গেল—শিকড়ের ওপর অক্ষর ভেসে উঠছে।
সাদা আলোয় ফুটে উঠল লাল দাগ—ঈশান।
যেন মৃত মানুষও ফিরে আসতে চাইছে।
সীতা ঘুম ভেঙে বাইরে বেরোল। তার চোখে ঘোর, ঠোঁটে গান। সে বটগাছের দিকে হাঁটতে শুরু করল। লোকেরা জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইল।
সে গাছের শিকড়ে হাত রেখে বলল—
“ঈশান তোমার রক্ত দিয়েছে। আমি দেব গান। যদি তা গ্রহণ করো, তবে গ্রাম বেঁচে যাবে।”
হঠাৎ বাতাস ফুঁসে উঠল। শিকড়গুলো নড়ল, পাতাগুলো ঝরতে লাগল। দূরে কোথাও নারীকণ্ঠের হাসি ভেসে এলো।
গ্রামের আতঙ্ক
পরদিন সকালে দেখা গেল, বটগাছের চারপাশে অসংখ্য লাল ফুল ফুটে উঠেছে। আগে কেউ দেখেনি। গন্ধে অদ্ভুত মাদকতা। কিন্তু আশ্চর্য, ফুলগুলো কেবল গাছের শিকড়ে ফুটেছে, আর তাদের পাপড়িতে লেখা যেন নাম—কাঞ্চি।
লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে বলল—“এ তো অশুভ লক্ষণ।” কেউ বলল—“ফুল মানেই আত্মার পুনর্জন্ম।”
কিন্তু সীতা শান্ত গলায় বলল—
“না, এ নতুন পথের শুরু। কাঞ্চির নাম মুছে যায়নি। কিন্তু গান এখনো মুক্ত। যদি আমি গান ধরে রাখতে পারি, তবে হয়তো নাম ধীরে ধীরে বিলীন হবে।”
ঈশানের ছায়া
রাতে সীতা আবার স্বপ্ন দেখল। ঈশান দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঘাটে। তার মুখে অদ্ভুত হাসি। সে বলছে—
“আমি দায় শোধ করেছি। এখন তুমি গান শোধ করো। মনে রেখো, ছায়া মাটির সঙ্গে থাকে, কিন্তু গান আকাশে উড়ে যায়।”
সীতা চমকে উঠল। বুঝল, ঈশান তাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে।
শেষ প্রস্তুতি
গোপাল-ঠাকুর ঘোষণা করলেন—
“আসন্ন অমাবস্যায় আমরা সবাই মিলে গান গাইব। সীতা গান ধরবে, আমরা সুরে সুর মিলিয়ে দেব। যদি কাঞ্চির নাম গানেই মিশে যায়, তবে ছায়া মিলিয়ে যাবে।”
গ্রামের লোকেরা ভয়ে হলেও রাজি হলো। তারা জানত, না করলে সর্বনাশ।
কিন্তু গাছের নিচে শিকড় তখনও লাল রঙে রক্তাক্ত হয়ে ঝুলছে। বাতাসে ভেসে আসছে অদ্ভুত ফিসফিসানি—
“ফিরে দাও নাম… ফিরিয়ে দাও…”
এইভাবে পূর্ণিমার পরের দিনগুলো কাটতে লাগল অস্থিরতায়। মানুষ বুঝতে পারল—ঈশানের মৃত্যু অভিশাপ ভাঙেনি, বরং নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
গ্রামের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে সীতার কণ্ঠে, আর সেই গানের শক্তিতে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল—বটতলার ছায়া কি এত সহজে বিদায় নেবে? নাকি নতুন রূপে আবারও ফিরে আসবে?
পর্ব ১০: শেষ সুরের অবসান
অমাবস্যার আগের দিনেই গ্রাম যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বসেছিল। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, বাতাসে ধুলো উড়ছে। নদীর জল ফুলে উঠেছে অকারণে, যেন চাঁদহীন রাতের আগেই ভয় দেখাচ্ছে। গ্রামবাসীরা জানে—এবারই হয়তো সব শেষ, নইলে নতুন শুরু।
গোপাল-ঠাকুর ঘোষণা করলেন—
“অমাবস্যার রাতে আমরা সবাই মিলে গান গাইব। সীতা গানের সূচনা করবে। এটাই শেষ চেষ্টা। যদি গান ব্যর্থ হয়, তবে গ্রাম বাঁচবে না।”
লোকেরা ভয়ে ভয়ে প্রস্তুতি নিল। শাঁখ, ঘণ্টা, ধূপ, প্রদীপ সাজানো হলো। কিন্তু তাদের মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক—কারণ তারা জানত, আত্মার সঙ্গে গান গাওয়া মানেই মৃত্যু ডেকে আনা।
সীতার সংকল্প
সীতা সারা দিন চুপচাপ বসে রইল। ঈশানের স্বপ্ন তার মনে বাজছে। সেই স্বপ্নে ঈশান বলেছিল—“ছায়া মাটির সঙ্গে থাকে, কিন্তু গান আকাশে উড়ে যায়।” সে বুঝেছে, গানই শেষ চাবি।
সে ফিসফিস করে বলল—
“ঈশান, আমি তোমার কথা রাখব। আমি গান দিয়ে নাম মুছে দেব।”
তার চোখে জল এল, কিন্তু ঠোঁটে এক দৃঢ়তা।
অমাবস্যার রাত
রাত নামতেই গ্রাম অন্ধকারে ডুবে গেল। আকাশে একটাও তারা নেই। বাতাস থমথমে, যেন শ্বাস আটকে আছে। সবাই মিলে বটগাছের নিচে জমল। প্রদীপ জ্বালানো হলো, ধূপের ধোঁয়া উঠল।
গোপাল-ঠাকুর গম্ভীর গলায় বললেন—
“মনে রেখো, ভয় পেলে হবে না। গানই অস্ত্র।”
সীতা এগিয়ে এল। সে বটগাছের শিকড়ে হাত রাখল। লাল রঙের শিকড়গুলো অদ্ভুতভাবে নড়ে উঠল। বাতাসে হঠাৎ ফিসফিস শোনা গেল—
“ফিরে দাও নাম…”
মানুষ কেঁপে উঠল, কিন্তু গোপাল-ঠাকুর চিৎকার করে বললেন—“গাও!”
গানের সূচনা
সীতা চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করল—
“নদী ডাকিল, আলো ডাকিল,
নাম যদি মাটিতে পড়ে,
গান তাকে আকাশে তুলে নেবে…”
তার গলায় সুর উঠতেই গ্রাম কেঁপে উঠল। শিকড়গুলো লাফিয়ে উঠল, পাতাগুলো ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। ধোঁয়ার মধ্যে দেখা গেল সাদা শাড়ি পরা এক ছায়া—কাঞ্চির আত্মা।
সে চিৎকার করে উঠল—
“গান আমার নয়! নাম আমার! ফেরত দাও!”
মানুষের সঙ্গতি
কিন্তু এবার গ্রামবাসীরা ভাঙল না। সবাই একসঙ্গে সীতার সঙ্গে সুর মেলাল। শাঁখ বাজল, ঘণ্টা বাজল। মহিলারা কান্নাভেজা কণ্ঠে সুর ধরল, পুরুষরা গলা মিলিয়ে উঠল।
সুরে-সুরে যেন ঢেউ উঠল আকাশে। ছায়া কাঁপতে লাগল। তার চোখ থেকে আগুনের আলো ঝরছে, কিন্তু সে শক্তি হারাচ্ছে।
সীতা গাইতে থাকল—
“যা ছিল বাঁধা, মুক্ত হোক আজ,
যা ছিল শিকড়ে, ভেসে যাক নদীর মাঝে…”
শেষ সংঘর্ষ
আত্মা হাহাকার করে উঠল।
“না! আমার নাম মুছে গেলে আমি বিলীন হব। আমি বাঁচতে চাই!”
সে সীতার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হঠাৎ ঝড় উঠল, মশাল নিভে গেল, মানুষ মাটিতে পড়ে গেল। মনে হলো, পুরো গ্রাম ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
কিন্তু সেই মুহূর্তে সীতা ঈশানের নাম ধরে গান ধরল—
“ঈশান, তুই আলো, তুই মুক্তি,
তোর রক্তে নাম মুছে যাক…”
আশ্চর্য! বাতাস থেমে গেল। আত্মার শরীর থমকে দাঁড়াল। তার চোখে জল ভেসে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল—
“ঈশান… তুমি আমাকে মুক্তি দিলে।”
তারপর ধীরে ধীরে ছায়াটা মিলিয়ে গেল। শিকড়গুলো মাটির ভেতরে ঢুকে গেল, পাতাগুলো স্থির হলো।
শান্তির ভোর
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম যেন নতুন রূপ পেল। নদীর জল শান্ত, পাখির ডাক ভেসে আসছে, বাতাসে আর কোনো কান্না নেই। বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ, কিন্তু তার শিকড়ে আর লাল দাগ নেই।
মানুষজন অবিশ্বাসের চোখে তাকাল। গোপাল-ঠাকুর চোখ মুছলেন।
“শেষ হলো। অভিশাপ মুছে গেল।”
সীতা নিঃশব্দে বসে রইল। তার ঠোঁটে শেষবারের মতো সুর ভেসে এলো—
“যা ছিল ছায়া, তা মিলল আলোয়,
যা ছিল নাম, তা ভেসে গেল গান হয়ে।”
পরিণতি
গ্রাম আবার স্বাভাবিক হলো। মানুষ কাজকর্মে ফিরে গেল, মাঠে হাসি ফিরল। কিন্তু সবাই জানে, এই ইতিহাস কোনোদিন মুছে যাবে না।
গোপাল-ঠাকুর বললেন—
“এ গল্প শুধু ভয় নয়, দায়েরও গল্প। নাম মানে দায়, গান মানে মুক্তি। মনে রেখো, যে গানকে বাঁচায়, সে-ই গ্রামকে বাঁচায়।”
সীতা এরপর থেকে গ্রামের গায়িকা হয়ে উঠল। তার কণ্ঠে মানুষ শুধু গান শোনেনি, মুক্তির স্বরও শুনেছে।
বটগাছ এখনও দাঁড়িয়ে আছে, বিশাল ছায়া ফেলে। কিন্তু আর কোনো কান্না শোনা যায় না, আর কোনো ছায়া ভেসে ওঠে না।
তবু গ্রামের লোকেরা জানে—এ গাছ একদিন এক কাহিনি বহন করেছিল, এক দায়, এক আত্মত্যাগ। আর সে কাহিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লোককথা হয়ে বেঁচে থাকবে।
“বটতলার ছায়া” আর নেই। কিন্তু তার গল্প থেকে গেছে।
শিশুরা এখনো বটতলায় খেলা করতে গিয়ে গোপাল-ঠাকুরের মুখে শোনে—
“একদিন ছিল এক মেয়ে, নাম কাঞ্চি… যার গান নদীকে ডাকত, আর নাম শিকড়ে বাঁধা ছিল।”
গ্রামের আকাশে আজও যখন মেঘ জমে, মানুষ মনে মনে গান গায়—
“যা ছিল শিকড়ে, তা আকাশে মিলুক…”
কারণ তারা জানে, গানই শেষমেশ মুক্তি দেয়।
সমাপ্ত