সন্দীপন ধর
খামে মোড়া নীরবতা
রমেশচন্দ্র বসু বসে আছেন জানালার ধারে রাখা সেই পুরনো বেতের চেয়ারে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের আলো তার রুপোলি চুলে খেলে যাচ্ছে। মাথার ঠিক পাশেই একটা ছোট কাঠের তাক, সেখানে রাখা তার স্ত্রীর একটা ছবি — মেঘলা শাড়ি, মৃদু হাসি, কপালে ছোট্ট টিপ। নাম ছিল তার — কাবেরী।
আজ অনেকদিন পর আবার পোস্টম্যান এসেছিল। লাল-হলুদ ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ। সে বলল, “বসুবাবু, আপনার পেনশনের শেষ চেকটা এসেছে।”
রমেশচন্দ্র ধীরে হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। যেন মৃদু এক স্নেহে ছুঁলেন। এই খামে শুধু টাকা নেই, আছে একটা দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা। অফিসের শেষ বেতন মাসেরও বেশি সময় আগে পাওয়া গেছে, কিন্তু এই পেনশনের শেষ চেক যেন বুঝিয়ে দিল — “তোমার কর্মজীবন শেষ, আর কিছু করার নেই।”
চোখে চশমা তুলে চেকটা ভালো করে দেখলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রতি মাসের এই চেকটাই ছিল তার ভরসা, একরকম সহচর। আজ সেটা শেষ।
চুপচাপ খামটা খুলে পাশের টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। কাবেরীর ছবির দিকে তাকালেন।
“তুই থাকলে হয়তো বলতি— কোথায় খরচ করবি বল তো?” — মৃদু হাসলেন।
ছেলে, অমিত, থাকে আমেরিকায়। বছরে একবার ফোন করে। সে জানে বাবা বেঁচে আছেন। রমেশবাবু জানেন, ছেলে ভালো আছে। এটুকু সম্পর্কটুকুই টিকে আছে হোয়াটসঅ্যাপের ‘Seen’ স্ট্যাটাসে।
পাড়ার লোকজন মাঝেমধ্যে খবর নেয়। তবে সেটা প্রতিবেশীর কর্তব্যের জায়গা থেকে, হৃদয়ের জায়গা থেকে নয়। রমেশচন্দ্র এমন একজন, যিনি সারা জীবন রুটিনে চলেছেন, কারো উপর নির্ভর না করে, নিজের জগতে ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন। কিন্তু এই একাকীত্বের কুয়াশা এখন ঘনিয়ে আসছে।
চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এলেন। গেটের সামনে ছোট একটা ছেলে ভিক্ষে করছে — ধুলোমাখা গা, ছেঁড়া জামা, চোখে অভাবের সারল্য। রাস্তার একপাশে ফুচকার দোকান, স্কুল শেষ করে হাসতে হাসতে ফিরছে কিছু বাচ্চা। তাদের কাঁধে ব্যাগ, পায়ে জুতো, চোখে আগামী দিনের আলো।
আর ঠিক পাশেই এই ছেলেটা। দুটো জগৎ, একটা রাস্তায় দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে।
রমেশচন্দ্রের মনে হল — “এই ছেলেটার কোনও চেক আসে না, কোনও মাসে, কোনও দপ্তর থেকে। অথচ বাঁচতে হয় তাকেই।”
সন্ধ্যা নামতে না নামতেই খামটা আবার হাতে নিলেন। সোজা হেঁটে গেলেন আলমারির কাছে, যেখানে স্ত্রীর শাড়ি, পুরনো কাগজ, কাবেরীর চিঠিগুলো রাখা। তার পাশে ছিল একটা ছোট্ট খাতা — “আমার খরচের হিসেব” নামে লেখা। তিনি লিখলেন,
“এই মাসের চেক — ২২,৬০০ টাকা। পেনশনের শেষ। তবে এই শেষ দিয়ে যেন কিছু শুরু হয়।”
পরের দিন সকালবেলা, রমেশচন্দ্র প্রথমবার পাড়ার সেই সরকারি স্কুলে ঢুকলেন, যেটার পাশ দিয়ে এত বছর শুধু হেঁটে গেছেন। হেডস্যার কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, “আপনি কি পড়াতে চান?”
রমেশচন্দ্র মৃদু হাসলেন — “না, খাওয়াতে চাই।”
“মানে?”
“দুপুরবেলা যে সব বাচ্চারা টিফিন আনতে পারে না, তাদের জন্য কিছু খাবার কিনে দিতে চাই মাসে একবার — এই পেনশনের শেষ টাকাটা দিয়ে।”
সেইদিন থেকেই স্কুলের পেছনের বারান্দায় রোজ দুপুরে পাঁচ-দশজন শিশুর মুখে বসে হেসে উঠল এক নতুন অধ্যায়। রমেশচন্দ্র প্রতিদিন দুপুরে বসেন, প্লেট হাতে দেন, আর শিশুদের সঙ্গে গল্প করেন — আজ তারা কী শিখল, আগামী দিনে তারা কী হতে চায়।
তাদের চোখে তিনি খুঁজে পান অমিতের অনুপস্থিতি, কাবেরীর চুপচাপ হাসি।
চেকটা কবে ব্যাঙ্কে জমা পড়ল, সেটা আর কেউ জানে না। কিন্তু পাড়ার শিশুরা জানে — “রিটায়ারমেন্ট” মানে জীবন শেষ নয়। একেকজন বুড়ো মানুষ আবার জীবন শুরু করতে পারেন — এক কাপড়, এক মন নিয়ে।
মেঘলা দুপুর, মুছে যাওয়া ছবি
স্কুলের পেছনের করিডোরটা একটা শান্ত নির্জনতায় ডুবে থাকত দুপুরবেলা, যখন ক্লাসগুলো বন্ধ, আর খেলাধুলোও শুরু হয়নি। ঠিক সেখানেই রোজ একটা বেঞ্চে বসে থাকতেন রমেশচন্দ্র বসু। সামনে চার-পাঁচটা ছোট মেঘ-ধুলোমাখা মুখ— কেউ টিফিন আনতে ভুলে গেছে, কেউ আনেই না, কেউ জানেই না ‘টিফিন’ কাকে বলে। রমেশচন্দ্র ধীরে ধীরে তাদের নাম মনে রাখেন— দীপু, রাশিদা, রাহুল, ওম, আর একটা ছোট্ট মেয়ের নাম— লাকি।
লাকির বয়স ছয় কি সাত, বেশির ভাগ সময় সে চুপ করে বসে থাকে। চোখ দুটো বড়, কিছুটা ম্লান, কিছুটা বিস্ময়ভরা। বাকিরা যখন হাসে, গল্প করে, সে তখন আড়ালে বসে হালকা করে হেসে ফেলে, যেন নিজেকে খুব সহজে বিশ্বাস করতে পারে না— এই যে তাকে ডাকা হচ্ছে, খেতে দেওয়া হচ্ছে, আদর করা হচ্ছে— সবটাই সত্যি তো?
একদিন, দুপুরবেলা সবাই খেতে বসেছে। বাচ্চারা আজ খাচ্ছে খিচুড়ি আর ডিম। রমেশচন্দ্র প্রতিদিন নিজের হাতে খাওয়ার প্যাকেট তৈরি করান, নিজের চশমা ঘেঁটে প্রত্যেকের প্লেট চেক করেন— যাতে একটুও কম না পড়ে।
লাকি চুপ করে এক কোণায় বসেছিল। রমেশচন্দ্র তার হাতে প্লেট দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর নাম লাকি কেন রে মা?”
মেয়েটি কাঁপা কণ্ঠে বলল, “মা বলত— আমি জন্মালে বাবা কাজ পায়, তাই লাকি নাম রাখে।”
“তাহলে তো তুই অনেক সৌভাগ্য এনেছিস!” — তিনি হাসলেন।
লাকি মাথা নাড়ল, “কিন্তু বাবা চলে গেছে। এখন আমি শুধু মায়ের সঙ্গে থাকি।”
রমেশচন্দ্র থেমে গেলেন। মনে পড়ল— তাঁর নিজের ছেলেও তো চলে গেছে। তবে ঠিক ভিন্নভাবে।
পরের দিন, লাকি স্কুলে এল না। আরও একদিন গেল। রমেশচন্দ্র একটু চিন্তায় পড়লেন। রাহুল বলল, “ওর মা অসুস্থ হয়েছে, হাসপাতাল নিয়ে গেছে।”
তৃতীয় দিন সকালে তিনি নিজের পুরনো একটা ব্যাগে কিছু ফল, বিস্কুট, একটা উষ্ণ কম্বল নিয়ে হেঁটে গেলেন পেছনের বস্তির দিকে। স্কুলের পেছনেই ছিল এই জগতটা— অস্থায়ী ঘর, প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা চাল, ছেঁড়া জামা-কাপড়ে দিন গুজরান।
রাহুল পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। লাকির ঘরের সামনে এসে থামল। দরজায় টোকা দিতেই একটা ম্লান মুখ বেরোল— লাকির মা।
“আপনি…?”
“আমি রমেশ বসু। আপনার মেয়ে লাকি আমার খুব চেনা। স্কুলে খেতে আসে। ওকে তিনদিন দেখি না…”
নারীর চোখ জলে ভিজে গেল, বললেন, “ওর বাবা মারা গেছে তিন মাস আগে। এখন কাজও নেই। আমি জ্বরে ভুগছি। ওকে স্কুল পাঠাতে পারিনি, বাবু।”
রমেশচন্দ্র থেমে গেলেন কিছুক্ষণ। তারপর ঝুঁকে কম্বলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন। আর কাল থেকে ওকে স্কুলে পাঠান। ওর মুখে আমি আমার নাতনির হাসি দেখি। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি কিছু ব্যবস্থা করব।”
ফিরে আসার সময় তার মনে হচ্ছিল, রিটায়ারমেন্টের পরে এই হেঁটে চলাটাই বুঝি জীবনের আসল কাজ। আগে অফিসে যেতেন ছুটতে ছুটতে। এখন হাঁটেন মন দিয়ে, চোখ দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। আগে টাকা উপার্জন ছিল কর্ম, এখন টাকা ব্যয় করাই যেন এক নীরব সাধনা।
সেই সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরে আবার সেই খাতা খুললেন— “আমার খরচের হিসেব”।
লিখলেন—
“লাকির জন্য ১টি কম্বল = ₹৩৫০
বাজার থেকে ফল ও বিস্কুট = ₹১৭০
সন্তোষ অনুভব = অমূল্য“
পাশের তাক থেকে কাবেরীর ছবি নামিয়ে এনে তাঁর পাশে বসালেন। বললেন, “তুই থাকলে বলতিস, এত খরচ করছো কেন? কিন্তু তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারিস, এই খরচটাই এখন আমার সঞ্চয়।”
সন্ধ্যা গাঢ় হলে রেডিও খুললেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছিল— “আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…”
চোখ বুজে থাকলেন কিছুক্ষণ। চারপাশে যেন এক নরম আলো ফুটে উঠছিল— লাকির হাসি, রাশিদার ছোট্ট হাত, দীপুর গল্প, রাহুলের দুষ্টুমি— সব মিলিয়ে তার নতুন সংসার।
পেনশনের শেষ চেকটা ব্যাঙ্কে জমা পড়ে গেছে। কিন্তু তার ভেতরের কিছু টাকা বুঝি জমা পড়ছে এক অনন্ত মানবিক হিসেবের খাতায়।
ছেঁড়া চিঠির খাম
সকালের আলো ধীরে ধীরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল, বারান্দার ফুলের টবগুলো ঝলমল করছিল রোদে। রমেশচন্দ্র বসু আজ একটু আগেই উঠেছিলেন। একটা বিশেষ কাজ ছিল তার — স্কুলে যাওয়ার আগে আজ একটা খাম পোস্ট করতে হবে। নিজের হাতেই লিখেছেন সেই চিঠিটা। প্রাপক? না, কোনো সরকারী দপ্তর নয়। এই চিঠি তিনি লিখেছেন তার ছেলে, অমিতকে।
চিঠির শুরুতে লেখা — “তোর বাবার নমস্কার নিস।”
তাতে কোনো অভিমান নেই, নেই কোনো অভিযোগ। শুধু কিছু কথার হিসেব — “আজ লাকি নামে এক মেয়ের জন্য কম্বল কিনলাম। রাহুল এখন আমাকে দেখে হাসে। আমি খুশি আছি। জানিস, বুড়ো বয়সে এই খুদেদের মুখ দেখেই যেন নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে…”
শেষে লেখা — “তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে রে। তুই না এলেও আমি জানি, তুই ভালো থাকিস — সেটাই আমার শান্তি।”
চিঠিটা হাতে করে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। পোস্টবক্সে ফেললেন ধীরে, যেন মন বলছিল, “যদি না পড়ে… যদি না দেখে…”
তবুও তিনি ফেললেন। একরকম বিশ্বাস নিয়ে — হয়তো কোনো একদিন, কোনো এক বিকেলে অমিত এই চিঠিটা খুলবে।
স্কুলে পৌঁছে তিনি আজ চমকে উঠলেন। পেছনের করিডোরে একটা ভিড়, বাচ্চারা গম্ভীর। লাকি এক কোণে বসে কাঁদছে।
“কী হয়েছে?” — রমেশচন্দ্র দ্রুত এগিয়ে গেলেন।
রাহুল বলল, “লাকির একটা ছবি হারিয়ে গেছে… একটা পুরনো ছবি, ওর মায়ের সঙ্গে তোলা। ওর ব্যাগে ছিল।”
রমেশচন্দ্র কুঁজো হয়ে লাকির চোখে তাকালেন।
“তুই খুব ভালোবাসিস ছবিটা?”
মেয়েটি হ্যাঁ বলল মাথা নেড়ে।
“তাহলে আমরাও খুঁজে বার করব রে মা। কাঁদিস না।”
তিনি ব্যাগ ব্যাগ ঘুরে দেখতে লাগলেন। টিনের ক্লাসরুম, গন্ধমাখা বেঞ্চ, চুলবঁধা কাগজ — সবের মাঝখানে হারিয়ে গেছে একটা স্মৃতি।
ঠিক সেই সময় দীপু দৌড়ে এল — “স্যার, আমি পেয়েছি! জানলার পাশে পড়ে ছিল!”
ছবিটা ছিল ছেঁড়া, ভেজা, কিন্তু তবু পুরোটা আছে। লাকি কাঁদতে কাঁদতে ছবিটা জড়িয়ে ধরল বুকের কাছে।
রমেশচন্দ্র ওর পাশে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। ছবিটা আসলে একটা প্রতীক — ছোটদের জীবনেও কিছু জিনিস থাকে যা হারিয়ে গেলে তাদের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। যেমন তাঁর নিজের কাছে কাবেরীর সেই শেষ চিঠিটা, যা এখনও আলমারির এক কোণে রাখেন।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে চুপ করে বসেছিলেন জানালার ধারে। আজ তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভার জমেছে। সেই পুরনো অনুভব, যা হয়ত প্রথমদিন রিটায়ারমেন্টের পর হয়েছিল — ‘আমি আর প্রয়োজনীয় নই’ — সেই ভয়টা আবার জেগে উঠেছিল লাকির কান্না দেখে।
কিন্তু আজ বুঝলেন, তার প্রয়োজন শেষ হয়নি, বরং নতুন রূপে শুরু হয়েছে।
টেবিলের ওপর খাতা খুলে লিখলেন —
“ছবির খোঁজে একটা মন খুঁজে পেল তার অতীত। আজ আমি বুঝলাম, হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরানোও এক রকম ভালোবাসা।”
চুপচাপ উঠে গিয়ে আলমারির ভেতর থেকে একটা পুরনো ফাইল বের করলেন — তার অফিস জীবনের স্মারক, পদক, নোটিশ, সার্টিফিকেট। তারপর একে একে তা খুলে দেখলেন, কিন্তু এবার আর গর্বে নয়, স্মৃতির মতো।
হঠাৎ শেষ পাতার নিচে থেকে পড়ে গেল একটা পুরনো পোস্টকার্ড — অমিত লিখেছিল, সেই বছরটা যখন সে প্রথম বিদেশে গিয়েছিল।
তাতে লেখা ছিল: “বাবা, ভালো থাকো। তোমার পাঠানো টাকা দিয়ে আজ একটা মাইক্রোওয়েভ কিনেছি। খাবার গরম করবো। তুমি খেয়াল রেখো নিজের খাবারের। আমি জানি, তুমি নিজের মতো থাকবে। তুমি ঠিকই আছো — তুমি তো পিতৃদেব।”
রমেশচন্দ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বললেন — “খাবার গরম রাখিস রে, কিন্তু মন ঠান্ডা হয়ে যাক না।”
সেই রাতে তিনি একটা স্বপ্ন দেখলেন — একটা মেল বন্ধ খাম, যার ওপরে লেখা আছে, “From: Your Son”
তিনি সেটা খুলছেন, আর ভেতরে একটাই লাইন —
“বাবা, আমি ফিরে আসব।”
ফিরে আসার অনুশীলন
রাত তখন প্রায় এগারোটা। বাল্বের ম্লান আলোয় ঘরটা আধা-ঘুম, আধা-জাগরণে ডুবে আছে। রমেশচন্দ্র বসু বিছানায় আধশোয়া। বালিশের পাশে পড়ে আছে সেই পুরনো পোস্টকার্ডটা, যেটা আজ সন্ধ্যায় খুঁজে পেয়েছিলেন— অমিতের হাতের লেখা, ‘তুমি ঠিকই আছো, তুমি তো পিতৃদেব।’
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। অন্ধকার ঘরে সেই আওয়াজ যেন কেঁপে উঠল একা থাকার অভ্যস্ত নিস্তব্ধতা। চোখ মেলে দেখলেন— “Amit – Video Call”।
প্রথমে বিশ্বাস হল না। ভুল করে ডায়াল হয়েছে, এমনটাও মনে হল। কিন্তু শব্দটা থামছে না।
আঁচল খুঁজে মোবাইলটা ধরলেন। স্ক্রিনে মুখ ভেসে উঠল— খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ক্লান্ত চোখ, ঠোঁটে অস্বস্তিকর এক হাসি।
“বাবা… এত রাতে ডিস্টার্ব করলাম না তো?”
রমেশচন্দ্র একটু কেশে বললেন, “না… না রে। ঘুমোইনি এখনো। তুই… হঠাৎ?”
অমিত হাসল, “চিঠিটা পড়লাম আজ… খামটা খুলতেই কেমন যেন বুকের মধ্যে একটা কিছু হল। অনেকদিন তোকে কিছু লিখিনি। তুই লিখলি, লাকি, রাহুল, খিচুড়ি… ভালো লাগল।”
রমেশচন্দ্র হালকা হাসলেন, “তুই তো এখন আর সময় পাই না… তোকে লেখা ছাড়া আমার আর কিছু উপায় ছিল না।”
অমিত কিছু বলল না। কিছু মুহূর্ত চুপচাপ কেটে গেল। মোবাইলের ফ্রেমে বাবার মুখ আর ছেলের মুখ একসঙ্গে ঠায় বসে রইল— সময় আর দূরত্বের মাঝখানে।
“বাবা,” হঠাৎ অমিত বলল, “তুই কখনো রাগ করিসনি তো?”
“রাগ? কেন?”
“এইভাবে রেখে দিলাম তোকে… চলে গেলাম। মা চলে যাওয়ার পর তুই একা, আর আমি শুধু দেখলাম ‘Seen’ আর ব্লু-টিক।”
রমেশচন্দ্র চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন। বাইরে কুয়াশা জমেছে।
“দেখ, অমিত,” তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “প্রত্যেক বাবার একটা সময় আসে, যখন সে ছেলেকে যেতে দেয়। সেটা তোর মায়ের মৃত্যুর পরেই হয়েছিল। আমি তোকে দোষ দিইনি। বরং ভাবতাম, তুই নিজের মতো থাকিস— তাতেই আমার শান্তি।”
অমিত এবার আর মুখ লুকোতে পারল না। ভিডিও কলে তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।
“আমি দেশে আসছি বাবা। সামনের মাসে ছুটি নিয়েছি। তোর সঙ্গে কিছুদিন কাটাব।”
রমেশচন্দ্র যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। এক মুহূর্তের জন্য কিছু বলতে পারলেন না। তারপর বললেন—
“তুই শুধু সময় নিয়ে আয়, আর তোর ছোটবেলার ডায়েরিটা নিয়ে আয়… যেখানে তুই লিখতিস— ‘বড় হয়ে আমি বাবার মতোই হব’।”
অমিত হেসে ফেলল, “সেটা এখনও আমি চাই, জানিস তো?”
ভিডিও কলে ছেলেটা তখন একটানা বলে চলেছে— অফিসের গল্প, বউয়ের কথা, নিউইয়র্কের বরফে হাঁটার অভিজ্ঞতা। কিন্তু রমেশচন্দ্র বসু মন দিয়ে শুনছেন শুধু একটাই শব্দ— “আমি আসছি বাবা।”
কল শেষ হলে রমেশচন্দ্র মোবাইলটা বন্ধ করে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। এবার জানালার বাইরে তাকালেন না। বরং চোখ বুজে মনে মনে দেখলেন— সেই ছোট্ট অমিত, স্কুল ব্যাগ পিঠে করে, তার অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ যেন আবার সেই শব্দ শুনতে পেলেন— “বাবা, তোকে একটা আঁকেছি আজ। তুই তো হিরো!”
পরদিন সকাল। স্কুলে গিয়ে দেখলেন লাকি নেই। অন্যরা বলল— ওর মা গ্রামে গেছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে। রমেশচন্দ্র হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন।
তিনি জানতেন, এই পাড়ার জীবন নদীর স্রোতের মতো— যাকে আজ দেখে, কাল সে নেই। কিন্তু তবুও এই ছোট্ট মেয়েটা তার জীবনের ভেতর একটা জায়গা করে নিয়েছিল।
তিনি স্কুলের পেছনে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সেই বেঞ্চ, সেই জানালার পাশ, সেই ধুলো ধরা বারান্দা— সব যেন একটু বেশি নিঃসঙ্গ।
তবুও মন বলল, “ও ফিরবে… যেমন তোর ছেলেও তো ফিরছে রে।”
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আবার সেই খাতাটা খুললেন।
আজকের তারিখের নিচে লিখলেন—
“ছেলেটা বলেছে ফিরবে। মেয়েটা চলে গেছে।
জীবন এমনই — কে আসে, কে যায়, তার কোনও রসিদ মেলে না।
তবু অপেক্ষা থাকে। এই বয়সেও, অপেক্ষা ভালোবাসার একটা প্রমাণ হয়ে রয়ে যায়।”
তিনি জানতেন, শেষ চেকটা শুধু একবার জমা হয়নি ব্যাঙ্কে। জমা হয়েছে বহু হৃদয়ে— শিশুদের হাসিতে, একটি ছেঁড়া ছবির কোণে, আর এক প্রৌঢ় বাবার অনুশোচনাহীন ভালোবাসায়।
মুখোমুখি দিন
বিমানবন্দরের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসা ছেলেটিকে প্রথমে চিনতেই পারেননি রমেশচন্দ্র বসু। কাঁধে ব্যাগ, চোখে ঘুম-ঘোলাটে ক্লান্তি, গায়ে একটা হালকা জ্যাকেট। এত বছর পরে ছেলেকে সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া, সে অনুভবটা যেন ঠিক বাস্তব না— একটা থমকে থাকা স্বপ্নের মতো।
“বাবা…” — অমিত এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল।
রমেশচন্দ্র কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেকে ছুঁলেন। মনে হচ্ছিল, কোনো প্রাচীন মন্দিরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন— চেনা দেবতাকে চোখের সামনে দেখে গলার শব্দ আটকে গেছে।
ট্যাক্সিতে ফিরতে ফিরতে দুজনেই চুপ। অমিত বাইরের রাস্তা দেখছিল, একেকটা মোড় দেখে বলছিল, “এই রাস্তা এখনও একই রকম আছে… জানিস বাবা, আমি না ভাবতাম, কলকাতা বদলে গেছে। কিন্তু আসলে আমার ভেতরটাই বদলে গেছে।”
বাড়িতে পৌঁছনোর পর কাবেরীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অমিত বলল, “মা থাকলে বুঝতে পারত, আমরা দুজন আসলে কত দূরে চলে গেছিলাম…”
সেই বিকেলটা কেটে গেল কথা বলতে বলতে— পুরনো ডায়েরি, স্কুলজীবনের ছবিগুলো, অমিতের অফিসের গল্প। রমেশচন্দ্র মন দিয়ে শুনছিলেন, কিন্তু তার মুখে খুব বেশি কথা ছিল না। বরং দেখছিলেন— ছেলেটা কেমন করে নিজের অসহায়তা ঢাকার চেষ্টা করছে।
সন্ধ্যায় রমেশচন্দ্র তাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। গেটে ঢুকতেই কিছু বাচ্চা দৌড়ে এসে বলল,
“আজ তো ছুটি, আপনি এসেছেন?”
রমেশচন্দ্র হাসলেন, “আজ আমার ছেলে এসেছে। ওকে তোমাদের স্কুলটা দেখাতে এনেছি।”
অমিত মুগ্ধ হয়ে দেখছিল চারপাশ— সেই টিনের ঘর, রঙচটা দেয়াল, পেছনের বারান্দা, আর ছোট ছোট বেঞ্চ।
“তুই বলেছিলি তো— এত ভালো লাগছিল খিচুড়ি খাওয়াতে! আমি ভাবিনি, বাবা, তুই এভাবে এতটা বদলে যাবি…”
“আসলে কিছুই তো বদলাইনি। শুধু আগে যাদের জন্য কাজ করতাম, তারা বড় ছিল। এখন যারা আমার চারপাশে, তারা ছোট… আর আমিও বুঝেছি, জীবনে বড় হওয়া মানেই দায়িত্ব নেওয়া নয়, কখনও কখনও ছোটদের কাছে নত হওয়াও প্রাপ্তি।”
সেই সময়ই খবর এল— বৃষ্টির কারণে স্কুল বন্ধ থাকবে দু’দিন। আবার সবাই দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে।
রাতে খাওয়ার সময় অমিত বলল, “বাবা, আমি ঠিক করেছি… কিছু দিন থাকব। অফিস থেকে একটা এক্সটেনশন নিয়েছি।”
রমেশচন্দ্র চমকে গেলেন।
“তুই… সত্যিই?”
“হ্যাঁ। আর জানিস, তোর করা কাজটা আমি বড় করে করতে চাই। একটা ফাউন্ডেশন খুলি? যেখানে স্কুলে পড়া, খাওয়া— দুটোই পাওয়া যাবে? তুই থাকবে উপদেষ্টা।”
রমেশচন্দ্র বসু প্রথমবার এতদিন পর হেসে উঠলেন। “আহা… এইটুকু খিচুড়ি থেকেই যদি কিছু গড়ে ওঠে, তাহলে এই শেষ চেকটা সত্যিই জীবনের শুরু হয়ে উঠল।”
তবে পরদিন সকালে সেই শুরুর মাঝেই আচমকা নেমে এল এক অন্ধকার।
রমেশচন্দ্র চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বুকটা যেন ভারি হয়ে এল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। হাতের কাপ পড়ে গেল মাটিতে।
অমিত দৌড়ে এসে বাবাকে ধরে ফেলল।
“বাবা! বাবা! তুমি ঠিক আছ?”
রমেশচন্দ্র চোখ মেলতে পারলেন না। ঠোঁট কাপছিল। কেবল ফিসফিস করে বললেন,
“আমার খাতা… খাতা টা তুলে দে… লাস্ট এন্ট্রিটা লিখিনি…”
অমিত কাঁপা হাতে বাবার লেখা সেই খাতা খুলল। শেষ পৃষ্ঠায় কেবল তারিখ লেখা— বাকিটা ফাঁকা।
চোখের কোণে জল এসে পড়ল তার।
“বাবা… এখন তুই আর কিছু লিখিস না। এবার আমি লিখব তোর হয়ে।”
অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল। রমেশচন্দ্র চোখ বন্ধ করলেন, মুখে এক চিলতে হাসি— যেন ছেলের স্পর্শে, তার শেষ চেকের উপার্জন আজ সম্পূর্ণ অর্থে পূর্ণ হয়ে উঠল।
একটি স্বাক্ষরের অপেক্ষায়
বেলভিউ নার্সিংহোমের কেবিন নম্বর ৩১৪। সাদা চাদরের বিছানায় শুয়ে আছেন রমেশচন্দ্র বসু। চোখ বন্ধ, বুকের ওপর যন্ত্রের তার জড়িয়ে, পাশে ছিপছিপে ধবধবে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে মনিটর, মাঝে মাঝে তার ছন্দে ছেদ পড়ে একটা হালকা শব্দ আসে— বিপ… বিপ…
অমিত চেয়ার টেনে বসে আছেন বাবার মাথার পাশে। দুটো দিন পার হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, মাইল্ড স্ট্রোক। এখন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে, তবে বয়সের কথা মাথায় রেখে সতর্ক থাকতে হবে।
রাতে নার্স কেবিনে ঢুকে ওষুধ দেওয়ার সময় বলল, “উনি মাঝেমাঝে ঘুমের মধ্যেও কিছুর নাম বলেন। আজ সকালেও বলছিলেন— ‘লাকি… খাতা… প্লেট…’ ”
অমিত ম্লান হাসলেন।
“তাদের নামটাই এখন বাবার শরীরের রক্তের মতো বয়ে বেড়াচ্ছে।”
রাতে, সব শান্ত হয়ে গেলে, অমিত ধীরে বাবার খাতা খুললেন। প্রতিটি পাতায় বাবার হাতের লেখা — তার মধ্যে কোনো কোনো লাইন যেন ছোট ছোট কবিতা, কোথাও আবার সংক্ষিপ্ত হিসেব, কোথাও জীবনদর্শন।
এক পৃষ্ঠায় লেখা —
“যারা খেতে পারে না, তাদের একমুঠো খিচুড়ি দেওয়া মানেই ঈশ্বরের কাঁধ ছুঁয়ে ফেলা।”
আরেক পৃষ্ঠায় —
“বৃদ্ধ বয়সে ভালোবাসা মানে কী? যখন কেউ তোমার খবর রাখে না, তখন কাউকে খবর রাখা শুরু করাই ভালোবাসা।”
অমিত গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর জীবনের এতদিনের ব্যস্ততা, অফিস, সাফল্য— এসবের সামনে বাবার এই শূন্য-ভরা দিনগুলো যেন অনেক বেশি মহার্ঘ্য হয়ে উঠল।
তৃতীয় দিন সকালে ডাক্তার বললেন, “উনি চোখ খুলেছেন। ওঁকে ধীরে ধীরে কথা বলান, স্মৃতি ঠিক আছে কি না বুঝে নিন।”
অমিত কেবিনে ঢুকে বাবার পাশে বসল।
“বাবা… আমি অমিত। চিনতে পারছ?”
রমেশচন্দ্র চোখ তুলে তাকালেন। একটা দীর্ঘ, নরম হাসি ফুটে উঠল মুখে।
“চিনলাম… তুই তো ‘Seen’ করেছিলি…”
অমিত হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলল।
“হ্যাঁ বাবা… আর এখন আমি ‘Replied’ করতে এসেছি।”
সপ্তাহখানেক পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন রমেশচন্দ্র বসু। শরীর কিছুটা দুর্বল, হাঁটতে হয় ধীরে, তবে চোখে-মুখে আগের সেই আলোর রেখা আবার জেগে উঠেছে।
তবে এবার অমিত ঠিক করল— আর সময় নষ্ট করবে না। বাবা যেটা শুরু করেছিলেন, সেটা এবার সংগঠিত হবে, স্থায়ী হবে।
একদিন বিকেলে তারা স্কুলে গেল। হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন,
“বসুবাবু, আপনি আমাদের তো আশীর্বাদ। এইখানে আপনাদের মতো একজন মানুষ আমাদের পাশে থাকবেন — ভাবতেই পারি না।”
অমিত বলল, “আমরা চাই, স্কুলের ভেতরে একটা আলাদা ঘর বানাতে, যেখানে বাচ্চারা রোজ দুপুরে খেতে পাবে, আর পড়াশোনা সংক্রান্ত ছোটোখাটো জিনিস পাবে— পেনসিল, খাতা, বই… যেটুকু আমাদের সাধ্য।”
হেডস্যার বললেন, “আপনারা যা ভাবছেন, সেটা শুধু দান নয়… এটা ভবিষ্যতের বীজ রোপণ। আমরা পাশে থাকব।”
পরের এক মাস অমিত কলকাতায় থেকেই পুরো পরিকল্পনা গুছিয়ে ফেলল। নাম রাখা হল — “শেষ চেক ফাউন্ডেশন”। নাম শুনে রমেশচন্দ্র প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে বললেন,
“খুব ঠিক নাম। কারণ ওই শেষ চেকটাই তো আমাকে নতুন জীবনে ঠেলে দিয়েছিল। অনেক সময় শেষটাই আসলে শুরু।”
স্কুলের পেছনে একটা ছোট্ট ঘর তৈরি হতে শুরু করল— চারপাশে রং করা হল, ভিতরে ম্যাট বিছানো, ছোট চেয়ার-টেবিল, দানবাক্স, আর দেওয়ালে এক লাইনের অদ্ভুত সুন্দর লেখা:
“ভালোবাসা হিসেব চায় না।”
লাকি ফিরে এসেছিল কয়েকদিনের মধ্যেই। বাবার মৃত্যুর পর গ্রামে গিয়েছিল মা’র সঙ্গে। আবার স্কুলে এসে সে রমেশচন্দ্রর হাতে ধরে বলল,
“স্যার, আমি আসছি আবার খিচুড়ি খেতে… আর এবার আমি খেতে খেতে আপনাকে একটা গল্পও বলব, ঠিক আছে?”
রমেশচন্দ্র বললেন, “তুই শুধু গল্প বলিস না রে মা… একদিন লিখতেও শিখবি। তখন তোর নিজের খাতা হবে।”
পর্ব শেষ হওয়ার আগেই, অমিত বাবাকে নিয়ে গেল এক জায়গায়— এক নামি নোটারি অফিসে।
“বাবা, এই ফাউন্ডেশনটা এখন তোকে ট্রাস্টির আসনে বসাতে চাই। শুধু একটা সই দরকার। এবার থেকে এটা তোর স্বপ্ন, আমি শুধু তার সহযাত্রী।”
রমেশচন্দ্র কলম হাতে নিয়ে বললেন,
“সারা জীবন যেসব সই করেছি— বেতন বইতে, হিসেবপত্রে, ফর্মে… তার সবটা ভুলে গেলেও আজকের সইটা মনে থাকবে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে জরুরি স্বাক্ষর।”
তিনি লিখলেন—
“Ramesh Chandra Basu
(Founder Trustee)”
চোখে জল নিয়ে অমিত দাঁড়িয়ে থাকল। আর মনে মনে বলল—
“এই সইয়ের নিচেই আমার জীবনটা লিখে শুরু করব।“
সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া হৃদয়
সেই রবিবার সকালটা ছিল অন্যরকম। জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল টুপটাপ করে, আর ঘরের ভিতরে চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছিল ধীর ছন্দে। রমেশচন্দ্র বসু কাঠের দোলনায় বসে হালকা কম্বল মুড়িয়ে ‘আনন্দবাজার’ পড়ছিলেন, হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক হেডলাইনে—
“শেষ চেক দিয়েই শুরু জীবন— এক পেনশনভোগীর অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প”
চোখ কাঁপছিল, চশমার ফ্রেম ধীরে সরিয়ে পাশের পৃষ্ঠায় তাকালেন— একটা বড় ছবি, তার নিচে ছোট ছোট শিশুদের হাসিমুখ, আর একপাশে তার নিজের মুখ— চোখে করুণ আলো, ঠোঁটে নীরব হাসি।
ছবির নিচে নাম লেখা—
সাহানা গুহ, প্রতিবেদক।
সাহানা ছিল এক নামী সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টার, এই শহরে অনেক চেনা চেহারার ছবি তুলে ধরেছেন তিনি, কিন্তু এই প্রথম এমন একটা চরিত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন— যিনি কোনও আন্দোলন করেননি, ব্যানার ধরেননি, পোস্টার ছাপাননি, তবুও একটা নিরব বিপ্লব করে ফেলেছেন নিজের জীবনের শেষ ধাপে।
দুদিন আগে সে এসেছিল ফাউন্ডেশনে। খুদে বাচ্চাদের মাঝে বসে খিচুড়ি খাচ্ছিল লাকি, দীপু, রাহুল। রমেশচন্দ্র তাদের কাছে বসে গল্প বলছিলেন— কিভাবে তার ছোটবেলায় তেলেভাজা এক পয়সা করে পাওয়া যেত, কীভাবে মা বানাতেন চালকুমড়োর চচ্চড়ি।
সাহানা তার সবটা নোট নিচ্ছিল। হঠাৎ সে রমেশচন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলেছিল—
“আপনার গল্প যদি এই শহরের প্রতিটি নাগরিক পড়েন, তবে হয়তো অনেক অবসরের দিন আলোয় ভরে উঠবে। আপনি তো একা নন, কিন্তু আপনার মতো করে কজন ভাবে?”
রমেশচন্দ্র মাথা নেড়ে বলেছিলেন—
“সবাই ভাবে। শুধু সময় পায় না। আমি পেয়েছি… সময়, নিঃশব্দতা, আর কিছু অসমাপ্ত ইচ্ছা।”
সেই ইচ্ছাই আজ ছাপা হয়ে গেছে কাগজে, কালি হয়ে ছুঁয়েছে বহু ঘরের সকালের নাস্তা টেবিল।
সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন এল সাহানার।
“স্যার, খবরের পর অনেক মানুষ যোগাযোগ করছেন। কেউ কেউ টাকা দিতে চাইছেন, কেউ স্কুলে গিয়ে খিচুড়ি বানাতে চান। এক বয়স্ক দম্পতি বলেছেন— আপনার মতো কাজ শুরু করতে চান তাদের শহরেও।”
রমেশচন্দ্র হাসলেন, “আমার কাজটা তো খুব ছোট, সাহানা। আসলে মানুষ খেতে চায়, শোনে না। আর আমি শুধু একটু শুনেছি।”
সাহানা থেমে বলল, “আপনি জানেন না, আপনি কতটা দিয়েছেন আমাদের সমাজকে।”
একদিন বিকেলে সাহানা নিজে এল একটা ছোট ক্যামেরা নিয়ে। বলল, “আপনার ওপর একটা ছোট ডকুমেন্টারি করছি।”
রমেশচন্দ্র একটু হেসে বললেন, “এত কিসের ছবি আমার? আমি তো অভিনেতা নই।”
সাহানা বলল, “আপনি জীবনের মুখ। যেটা সিনেমার হিরোদের থেকেও বাস্তব।”
ভিডিও চলছিল— রমেশচন্দ্র কাঁপা হাতে লাকির প্লেটে ভাত দিচ্ছেন। দীপু হাসতে হাসতে বলছে— “ওই প্লেটেই ভালোবাসা পড়ে যায়।”
ক্যামেরা ধীরে ধীরে বাবার মুখে এসে থেমে যায়।
“আমি শুধু পেনশনের শেষ চেকটা খরচ করেছি কিছু খুদে মুখের হাসিতে। তাতে যদি তারা একবেলা পেটভরে খেতে পারে, তবেই আমি জীবনে সফল।”
সেই সপ্তাহেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমেরিকা থেকে একটা অনলাইন পোর্টাল ভিডিওটা তুলে নিল এবং সেখানে একটা ক্যাম্পেইন শুরু হল— “Adopt a School Meal”। অমিত অবাক হয়ে দেখল, একদিনে কয়েক হাজার ডলার উঠেছে। সেই টাকা কলকাতার এই ছোট ফাউন্ডেশনের নামে এসেছে— শুধু একটি ছোট্ট ভিডিওর ভিত্তিতে।
রাতের খাবার টেবিলে রমেশচন্দ্র একমুঠো ডাল-ভাত মুখে তুলে বললেন,
“তোর মা থাকলে বলত, ‘রংচটা বারান্দায় বসে তুমি আজ বিশ্বজয় করে ফেললে’।”
অমিত বলল, “আর তুমি থাকলে না থাকলে, লাকি হয়তো আজও জানালার পাশে বসে থাকত— না খেয়ে, একলা।”
ডকুমেন্টারির শেষে সাহানার ভয়েসওভার শুনতে পাওয়া যায়—
“এই শহরে এখনও কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজেদের শেষ চেক দিয়ে কারও জীবনের শুরু করতে চান। এই গল্প শুধু রমেশচন্দ্র বসুর নয়, আমাদের প্রত্যেকের। শুধু খাতা ধরতে জানতে হয়, শুধু একটু ভালোবাসা দিতে জানতে হয়।”
রমেশচন্দ্র বসু আজও সেই খাতায় লিখে চলেন।
আজকের এন্ট্রি:
“আমার গল্পটা এখন আর আমার নেই। এটা ওদের… যারা না খেয়ে থেকেও আমার পাশে বসে হাসে।”
ধাক্কা, যা বদলে দেয় ভিতরটা
সেই বিকেলটা শুরু হয়েছিল একেবারেই সাধারণভাবে। আকাশে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি, স্কুলের পেছনের করিডোরে বাচ্চাদের হাঁসফাঁস, আর তার মাঝে রমেশচন্দ্র বসু বসে— এক এক করে ছোট ছোট থালায় খাবার পরিবেশন করছেন।
আজকের মেনু ছিল খিচুড়ি আর বেগুনি। খেতে খেতে লাকি বলছিল, “স্যার, জানেন, আমি এখন অ-অ-অলা পর্যন্ত পড়তে পারি!”
“সত্যি রে?”— রমেশচন্দ্র চোখ বড় করে তাকালেন, “তাহলে তুই তো এবার কবিতা পড়ে শোনাতে পারবি!”
হাসির মাঝেই হঠাৎ এক গণ্ডগোল শুরু হলো। স্কুলের সামনের দিকে দৌড়ে এল দুই শিক্ষক, পেছন পেছন দারোয়ান আর কিছু অভিভাবক। ফাউন্ডেশনের খাবারের বালতির কাছে দাঁড়িয়ে একজন লোক চিৎকার করছে—
“এইসব ভাত খাইয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের পেট নষ্ট করে দিচ্ছে! কাল আমার ছেলের পেটে ব্যথা হয়েছে! আমি কিছুতেই মানছি না!”
রমেশচন্দ্র দাঁড়িয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি একটু শান্ত হোন। কী হয়েছে বুঝি তো…”
লোকটা বলল, “আমি পুলিশে জানাব! কারা কী খাওয়াচ্ছে, কে জানে! এসব ফাউন্ডেশন মানেই এখন লোক দেখানো কাজ!”
চারপাশে হঠাৎ উত্তেজনার হাওয়া। কিছু অভিভাবক রমেশচন্দ্রকে চিনে বললেন, “বসুবাবু এরকম কিছু করবেন না। আমরা জানি উনি কতটা খেয়াল রাখেন।”
কিন্তু লোকটা হুমকি দিতে থাকল, গলা চড়াতে থাকল, আর সবার মাঝে রমেশচন্দ্র দাঁড়িয়ে— নিঃশব্দ, ধৈর্যশীল।
“আপনার ছেলে কী খেয়েছিল?”
“খিচুড়ি আর ডিম।”
“ডিম তো আমরা আজ দিইনি। গতকাল ছিল শুধু খিচুড়ি। আর সব বাচ্চারা তো ঠিক আছে?”
লাকি, দীপু, রাহুল— সবাই বলল, “আমরা তো ঠিক আছি স্যার। কাল তো আমি তিনবার ভাত খেলাম!”
লোকটা কিছুটা থেমে গেল। মুখ গম্ভীর, কিন্তু এখনও ইগোয় ফেটে যাচ্ছে। বলল, “আমার মেয়ে তো বলেছে— গন্ধ ছিল খাবারে!”
এবার রমেশচন্দ্র কাঁপা গলায় বললেন,
“আমি নিজের হাতে ওই খিচুড়ি বানাতে দিই, রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, নিজে চেখে দেখি। আর তবুও যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, আমি ক্ষমা চাই। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন— এখানে কেউ কোনও স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে না। আমি এই জীবনের শেষ সময়টুকু শুধু ভালোবাসার জায়গা বানাতে চেয়েছি।”
চুপ। মুহূর্তখানেক স্তব্ধতা। তারপর স্কুলের হেডস্যার বললেন, “আমরা আপনার পাশে আছি বসুবাবু। ভুল হলে শুধরে নেব, কিন্তু এই কাজ চলবেই।”
লোকটা আর কিছু না বলে চলে গেল, কিন্তু বাকি দিনের ছায়াটা পড়ে গেল সকলের মনেই।
সন্ধ্যায় রমেশচন্দ্র বসু বাড়ি ফিরেই চেয়ার টেনে বসলেন জানালার ধারে। হাতে সেই খাতা, চোখে থমথমে ভাব। অমিত এসে পাশে বসল।
“বাবা, এসব ঝামেলা হবেই। তুমি যেটা করছ, সেটা অনেকের অসহ্য লাগে— কারণ তুমি বিনামূল্যে কিছু দিচ্ছ। আর এই সমাজে বিনামূল্যে ভালোবাসা পাওয়া অনেকের পক্ষে মেনে নেওয়া শক্ত।”
“কিন্তু আমি কাঁপে গেলাম, অমিত,” রমেশচন্দ্র ফিসফিস করে বললেন, “যদি সত্যিই কিছু হয়? যদি আমার খাবারে কারও ক্ষতি হয়?”
“তুমি কি বিশ্বাস করো, তুমি অন্যায় করছ?”
“না।”
“তাহলে তো তুমি জানো, তুমি সঠিক কাজই করছ। আর সঠিক কাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবেই— সেটা আসলে একটা পরীক্ষার মতো। তুমি এই পরীক্ষায় পাশ করেছো।”
রাতের খাতায় সেই রাতে কিছু লেখা হয়নি। রমেশচন্দ্র শুধু পাতাটা খুলে রেখে পেনটা ধরে বসে ছিলেন অনেকক্ষণ।
পরের দিন সকালে স্কুলে পৌঁছেই রমেশচন্দ্র দেখলেন, রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এক দল অভিভাবক। তাঁদের হাতে কাঁচা চাল, ডাল, কেউ কেউ ফল এনেছেন।
একজন বলল, “বসুবাবু, আপনি যা করছেন, আমরা পাশে থাকতে চাই। রান্নার জন্য সাহায্য করব, ঘুরে খাবার দেব, শুধু আপনি যেন হাল না ছাড়েন।”
চোখে জল এসে গেল রমেশচন্দ্রের। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাকি বলল, “স্যার, আমি বড় হয়ে আপনার মতো হব। আমি খাবার দিয়ে গল্প বলব।”
তিনি মাথায় হাত রাখলেন লাকির, “তুই শুধু ভালোবাসা দিতে শিখ। তাতেই গল্প হয়ে যাবে জীবন।”
বিকেলে সাহানা গুহ এল আবার। সঙ্গে একটা কাগজ।
“স্যার, এই ঘটনাটা নিয়ে একটা পরবর্তী প্রতিবেদন করছি। কিন্তু এবার আমি চাই আপনার লেখা একটা বাক্য এই লেখার শিরোনাম হোক। আপনি কি লিখে দেবেন একটা লাইন?”
রমেশচন্দ্র একটা পৃষ্ঠা নিয়ে লিখলেন—
“যারা ভালোবাসে, তাদের ভুল হয়, কিন্তু যারা ভালোবাসে না— তারা চিরকাল অন্ধই থেকে যায়।”
সাহানা মাথা নত করল।
সেই রাতে খাতার পাতায় রমেশচন্দ্র লিখলেন—
“একটা অপবাদ এসে যখন আমার ভিতরটা নাড়িয়ে দিল, তখন কিছু হাত এসে আমাকে তুলে ধরল। হয়তো জীবনের মানে আসলে এটাই— কোনোদিন চুপচাপ পড়ে গেলেও, কেউ একটা হাত বাড়িয়ে দেয়। আর সেই হাতটাই ঈশ্বর।”
শর্তের মুখোমুখি
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। শহরে বৃষ্টির ঘনঘটা, মাঝেমধ্যে জল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে স্কুলের পেছনের রাস্তায়, কিন্তু খিচুড়ির গন্ধে সেই জলকাদা ভেজা দুপুরেও শিশুদের মুখে হাসি থামছে না। রমেশচন্দ্র বসু আজ নতুন করে ভাবছেন ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে— খরচ বাড়ছে, ভালো রান্নাঘর দরকার, আরও অনেক বাচ্চা রোজ যোগ দিচ্ছে।
ঠিক সেই সময় এক ফোন আসে অমিতের কাছে।
“নমস্কার, আমি মীনাক্ষী সেনগুপ্ত, সঞ্জীবন গ্রুপের CSR ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছি। আমরা ‘শেষ চেক ফাউন্ডেশন’-এর কাজ নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে একটা পার্টনারশিপ প্রস্তাব আছে।”
পরদিন মীনাক্ষী নিজে এলেন— গাড়ি থেকে নেমে ফরমাল শাড়ি পরা এক আত্মবিশ্বাসী মহিলা। মুখে স্মিত হেসে বললেন,
“আপনারা যা করছেন, তা শুধু দান নয়— তা এক ধরনের সামাজিক আন্দোলন। আমাদের কোম্পানি এর অংশ হতে চায়।”
অমিত কফি এগিয়ে দিল। রমেশচন্দ্র চুপচাপ বসে শুনছিলেন। মীনাক্ষী ব্যাখ্যা করলেন,
“আমরা স্কুল ফিডিং প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চাই। রান্নাঘর বানাতে চাই, স্বাস্থ্যসম্মত ফুড প্রটোকল দেব, মোবাইল ভ্যানের মাধ্যমে আশপাশের বস্তি এলাকাতেও খাবার পৌঁছে দেওয়া যাবে।”
সব শুনে অমিত বলল, “সুন্দর পরিকল্পনা। তবে এর বিনিময়ে আপনারা কী চান?”
মীনাক্ষী একটু হেসে বললেন,
“ছোট একটা শর্ত আছে। আমাদের কোম্পানির লোগো যেন প্রতিটি খাবারের প্যাকেটে থাকে, কিছু সোশ্যাল মিডিয়া কভারেজে আমাদের ব্র্যান্ডিং থাকে, আর যদি সম্ভব হয়, ফাউন্ডেশনের নামের আগে আমাদের সংস্থার নামটুকু জুড়ে দেওয়া যায়— যেমন ‘সঞ্জীবন-শেষ চেক ফাউন্ডেশন’। এটা পুরোপুরি CSR সহযোগিতা।”
অমিত কিছু বলার আগেই রমেশচন্দ্র মুখ তুললেন।
“আপনারা কি এটা বিশ্বাস করেন, একটা বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর সেই প্লেটেও ব্র্যান্ড থাকা জরুরি?”
মীনাক্ষী থমকে গেলেন।
“আমি বুঝি, টাকাপয়সার হিসেব আছে, কোম্পানির পলিসি আছে। কিন্তু এই নামটা— ‘শেষ চেক’— এটা শুধু একটা গল্প নয়, এটা আমার স্ত্রীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে লেখা প্রথম খরচের খাতার নাম। আপনি যদি এই খাতায় আপনার শর্ত ঢোকাতে চান, তবে হয়তো আমরা আপনাদের সঙ্গে হাঁটতে পারব না।”
ঘরে একটা নীরবতা নেমে এল।
মীনাক্ষী আস্তে করে বললেন, “স্যার, আমি আপনাকে বোঝাতে পারিনি বোধহয়। আমরা শুধুই সাহায্য করতে চাই।”
অমিত কাঁধে হাত রেখে বলল, “আপনার প্রস্তাব দুর্দান্ত। আমাদের প্রয়োজনও আছে। কিন্তু আমাদের শর্ত একটাই— আমাদের কাজটা যেন নিঃস্বার্থ থাকে। নাম না থাকলেও কেউ যদি ভালোবাসতে পারে, সে-ই প্রকৃত সঙ্গী।”
মীনাক্ষী উঠে দাঁড়ালেন, একটু ভিন্ন স্বরে বললেন,
“আপনাদের স্পষ্টতা শ্রদ্ধার যোগ্য। আমি অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আবার যোগাযোগ করব। হয়তো তখন আমাদের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।”
মীনাক্ষী চলে যাওয়ার পর রমেশচন্দ্র বললেন,
“তুই ভাবছিস, আমি অতিরিক্ত আবেগে বুদ্ধিহীন কাজ করে ফেললাম?”
অমিত মাথা নেড়ে বলল, “না বাবা, আমি আজ আরও একবার শিখে গেলাম— সংস্থান আর সম্মান কখনও একসঙ্গে চলে না। তুই সম্মানটাই বেছে নিয়েছিস।”
সেই রাতে রমেশচন্দ্র খাতায় লিখলেন—
“সবচেয়ে বড় দান হয় তখনই, যখন তার পাশে দাতার নাম লেখা থাকে না। ভালোবাসা যদি শর্ত সাপেক্ষ হয়, তবে সেটা ভালোবাসা নয়— সেটা চুক্তি।”
তিনদিন পর ফোন এলো আবার। এবার মীনাক্ষীর গলা একেবারে বদলে গেছে।
“স্যার, আমাদের বোর্ডে আলোচনা হয়েছে। আমরা কোনও ব্র্যান্ডিং ছাড়াই আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আপনার গল্প আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। আমরা শুধু আপনাদের কাজকে বাড়াতে সাহায্য করতে চাই— নিজেকে প্রচার করার জন্য নয়, সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য।”
সেই সন্ধ্যায় রমেশচন্দ্র বসু বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাবেরীর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ।
“দেখলি তো? একটা নাম, একটা পুরনো চেক— এগুলোও মানুষ বদলে দিতে পারে।”
সঞ্জীবন গ্রুপের সহায়তায় ফাউন্ডেশনে তৈরি হল স্টিলের রান্নাঘর, বড় ফ্রিজ, হাইজিন ওয়ার্কস্টেশন। স্কুলে এল আরও শিশু, স্কুলের বাইরে থেকেও অনেকে আসতে শুরু করল।
লাকি একদিন খাওয়ার পর বলল,
“স্যার, এখন আমরা শুধু খাই না, আমরা স্বপ্ন দেখি— বড় হয়ে কী হতে চাই!”
রমেশচন্দ্র বললেন, “স্বপ্নগুলো গরম ভাতের মতো হোক, মা— সোজাসাপ্টা, পেটভরা, আর সুগন্ধী।”
একদিন সন্ধ্যায় অমিত বলল,
“বাবা, তুই জানিস, এই একবছরে তুই আমার সব শিক্ষা নতুন করে বদলে দিয়েছিস। এখন আমি জানি— কীভাবে একটা জীবন শুধু ভালোবাসা দিয়ে গড়া যায়। তোর এই শেষ চেকটাই আসলে আমার জীবনের প্রথম ডিপোজিট।”
রমেশচন্দ্র হেসে বললেন,
“তুই এবার খাতা খুলে লিখে ফেল। আমার লেখাগুলো তো শেষ হয়ে এসেছে।”
অমিত জিজ্ঞেস করল, “শেষে কী লিখবি?”
রমেশচন্দ্র চুপ করে বললেন—
“তুই।”
শেষ চিঠি, এক শুরু
পুজোর আগের সকাল। ঘরের এক কোণে বসে আছেন রমেশচন্দ্র বসু। হাতে তাঁর সেই পুরনো খাতা, সামনে চা আর কাঁচা লঙ্কা দেওয়া মুড়ি। বারান্দা দিয়ে হালকা বাতাস আসছে। আকাশ ঝকঝকে, যেন কলকাতা আজ ধুয়ে-মুছে সেজে উঠেছে নতুন গল্প শোনার জন্য।
আজ তিনি লিখছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। ঠিক নিজের ছেলের জন্য নয়, সমাজের জন্যও নয়—এই চিঠি একজন শিশুর জন্য, যার ছোট্ট মুখ তাঁকে শিখিয়েছে জীবন কীভাবে আবার শুরু করা যায়।
চিঠির উপরে নাম লেখা—
“লাকি’র জন্য“
“প্রিয় লাকি,
যখন তুই এই চিঠিটা পড়বি, তখন আমি হয়তো আর থাকব না। হয়তো তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, হয়তো তুই এই শহর ছেড়ে কোথাও দূরে চলে গেছিস। তবুও মনে রাখিস, তোকে দেখে আমি বুঝেছিলাম— ভালোবাসা মানেই নতুন করে বাঁচা।
আমি তো একটা অবসরপ্রাপ্ত মানুষ ছিলাম— পুরনো ফাইল, বকেয়া হিসেব আর নীরব চেক বই আমার জীবন। তুই এসে যেন সেই সাদা পাতায় প্রথম রঙ তুললি। তোদের খিদের মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম নিজের ক্ষুধা— কিছু দেবার, কিছু বোঝার, কিছু ফিরে পাওয়ার।
আমার পেনশনের শেষ চেক দিয়ে শুরু হয়েছিল এক পথ— সেটার শেষ কোথায়, জানি না। কিন্তু তুই যদি কখনও খাতা খুলে বসিস, যদি কখনও কারও মুখে হাসি ফোটাতে চাস, মনে রাখিস— একটা খালি প্লেটও বদলে দিতে পারে কারও জীবন।
বড় হয়ে যদি ভুলে যাস, তা হলেও ঠিক আছে। কিন্তু মনটা যেন কখনও কুড়ে না যায়। আমি জানি, তুই পারবি।
ভালোবাসা রইল,
তোর ‘খিচুড়ি স্যার‘
রমেশচন্দ্র বসু
চিঠিটা শেষ করে খাতার মধ্যে গুঁজে রাখলেন। অমিত পাশে এসে বলল,
“এটা তুমি সত্যিই ওকে দেবে?”
“না,”— রমেশচন্দ্র বললেন, “এটা ওকে দিয়ে যাব। ওর ভেতরেই রেখে যাব।”
দু’দিন পর এক ভোরে হালকা বৃষ্টি নামল। আকাশ মেঘলা, পাখিরা নীরব। রমেশচন্দ্র বসু নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন গভীর ঘুমে।
সেই ঘুম আর ভাঙেনি।
অমিত যখন ঘরে ঢুকল, তখন জানালার পর্দা হাওয়ায় দুলছে, আর বাবার বুকের ওপর রাখা সেই খাতাটা আধা খোলা— শেষ পাতায় লেখা ছিল একটা লাইন:
“যে বৃষ্টিতে খিচুড়ি রান্না হয়, সেই বৃষ্টিই একদিন মন ভালো করে দেয়।”
শেষকৃত্যের দিন অমিত পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে জল আর ঠোঁটে নীরবতা। ফাউন্ডেশনের শিশুরা এসে দাঁড়িয়েছিল, অনেকেই খালি পায়ে। লাকি কাঁদছিল চুপ করে, দীপুর হাত শক্ত করে ধরে।
সেই দিন স্কুলে একটা স্মারক ফলক বসানো হয়, যাতে লেখা থাকে—
“এই প্রাঙ্গণে এক মানুষ তাঁর শেষ চেক দিয়ে শুরু করেছিলেন অনেক মুখে হাসি ফোটানোর ইতিহাস।”
নিচে খোদাই—
“রমেশচন্দ্র বসু (১৯৪৫–২০২৫)”
কয়েক বছর কেটে যায়।
লাকি তখন কলেজে পড়ে। সমাজকর্মে পড়াশোনা করছে, আর সন্ধ্যায় সময় পেলে এখনও ফাউন্ডেশনে যায়, নতুন বাচ্চাদের সঙ্গে বসে খিচুড়ি খায়, গল্প করে। একদিন সে খোলসা করে সবাইকে বলে—
“আমি ছোটবেলায় ঠিক বুঝতাম না, কেন একজন বৃদ্ধ আমাকে এত ভালোবাসে। এখন বুঝি— ভালোবাসা আসলে বয়স বোঝে না, শর্ত মানে না। স্যারের ওই শেষ চিঠি এখনও আমার কাছে রয়ে গেছে।”
সে ফাউন্ডেশনের অফিসে গিয়ে সেই চিঠিটা একবার পড়ে আবার খামে রাখে।
আকাশে হঠাৎ হালকা বৃষ্টি নামে।
লাকি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে—
“আজ যদি স্যার থাকতেন, আমি বলতাম— আমি এখন লিখতে পারি, স্যার।
আমি এখন আমার নিজের খাতা খুলে ফেলেছি।”
এক শিশু এসে লাকির হাত ধরে বলে,
“তুমি আমাদের নতুন খিচুড়ি দিদি?”
লাকি হেসে বলে,
“না রে… আমি শুধু তোমার পাশে বসতে এসেছি। যেমন করে একসময় এক মানুষ আমার পাশে বসেছিলেন। যাঁর নাম আমি এখনও বলি— ‘খিচুড়ি স্যার’।”
আর একটা গল্প শেষ হয় না— সেটা হেঁটে চলে অন্যদের ভিতর।
রমেশচন্দ্র বসুর শেষ চেক একটা হিসেবের গল্প ছিল না, ছিল এক অফুরন্ত ভালোবাসার খাতা—
যার পাতাগুলো এখনও প্রতিদিন ভরে ওঠে নতুন নাম, নতুন স্বপ্ন, আর কিছু চুপচাপ প্লেট— যেগুলোর ওপর ভালোবাসা গরম ভাতের মতোই স্নিগ্ধ, নির্ভার।
সমাপ্ত




