ঋধিমান বসু
মাঝরাতে সেই ডাকটা আবার এল।
“সু-র-জ…”
নরম, স্নিগ্ধ অথচ ভয়ানকভাবে গভীর সেই আওয়াজ যেন কানে নয়, সোজা মগজে ঢুকে পড়ে। গায়ের রোম খাড়া করে দেয় এমন এক সুরে, যেন হাজার বছর আগের কোনো প্রতিজ্ঞার স্মৃতিচিহ্ন বাজছে।
তিন মাস হলো সূরজ সাঁতরাগাছির এই পুরোনো ভাড়াবাড়িতে উঠেছে। চাকরির কারণে কলকাতা থেকে দূরে, একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিল। বাড়িটা পছন্দ হয়েছিল শুধু একটাই কারণে—ভাড়া খুব কম। আর যেটা কম, সেটা সবসময় সন্দেহজনক হয়।
সূরজ একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তার মনে আজীবন একটা ফাঁকা জায়গা ছিল। সম্পর্কের ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতা, মনের মতো কাউকে না পাওয়া, একাকীত্ব তাকে নীরব করে তুলেছিল। সে ভাবত, “যদি সত্যিই কেউ ভালোবাসত, সব শূন্যতা ভরিয়ে দিত…” এই ভাবনা নিয়েই প্রথম দিন সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হয়েছিল।
প্রথম মাস কিছু হয়নি। দ্বিতীয় মাসের মাঝামাঝি রাতেই প্রথম ডাকটা আসে। “সূরজ…”
সে ভেবেছিল হয়তো পাশের বাড়ি থেকে আসছে, হয়তো কল্পনা। কিন্তু তারপর সেই ডাক নিয়মিত হতে লাগল—প্রতিদিন রাত ২:৩৫ মিনিটে। ঠিক তখনই।
প্রথমে ডাকটা শুধু নাম ধরে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে কিছু যুক্ত হলো।
“সূরজ… জানো আমি কে?”
“আমাকে কেন ডেকেছিলে?”
“তুমি কথা দাওনি?”
সূরজ কিছুই বোঝে না। সে কাউকে ডাকেনি। কাউকে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। শুধু একটা বাড়িতে এসেছে থাকতে। কিন্তু সেই অদৃশ্য কণ্ঠ, যেন তার কোনো পুরোনো অপরাধ মনে করিয়ে দিতে চাইছে।
বাড়িটার ভিতরের গঠন অদ্ভুত। কাঠের মেঝে, পুরোনো জানালার পাল্লা খসে পড়া, ঘরদোরে ধুলো-মাকড়সার জাল, আর একটামাত্র আয়না—ড্রয়িং রুমের এক কোণে লাগানো, কালো কাঠের ফ্রেমে। সেই আয়নায় সূরজ বারবার অদ্ভুত কিছু দেখেছে—নিজের প্রতিবিম্ব তাকিয়ে থাকে, কিন্তু মুখে একটাই পার্থক্য—হাসে। সে হাসি ঠান্ডা, খালি চোখে দেখা যায় না, শুধু মনে হয় কিছু ভুল।
চতুর্থ সপ্তাহে সে সিদ্ধান্ত নেয়—আর থাকা যাবে না। বাসা বদলাবে। কিন্তু তখনই আসল সমস্যা শুরু হয়। অফিসে তার ভুল হতে শুরু করে। পেনড্রাইভে ফাইল থাকে না, রিপোর্ট হঠাৎই হারিয়ে যায়। একদিন এক কলিগ বলে—“তুমি তো বলেছিলে কাল তোমার মা মারা গেছেন, অফিসে আসতে পারবে না। অথচ তুমি তো এসেছ?”
সূরজ হতবাক। সে তো এমন কিছু বলেনি।
রাতগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠল। ঘরের ভিতরে দেওয়াল বেয়ে কারা যেন হাঁটে, দরজার বাইরে ছায়া নড়ে। হঠাৎ একদিন রাতে সে দেখে তার ঘড়ি ২:৩৫ বাজায় আর দরজা আপনা থেকেই খুলে যায়। ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে, সাথে সেই আওয়াজ—”তুমি ভুলে গেলে সূরজ? আমি কিন্তু পারিনি…”
সে ঠিক করে ক্যামেরা বসাবে। রাত ২:৩৫-এ সে ঘরে ক্যামেরা সেট করে রাখে।
সকালে ক্যামেরা চেক করতে গিয়ে তার হাত ঠান্ডা হয়ে গেল। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে—সে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ তার শরীর শক্ত হয়ে যায়, চোখ খোলে। কিন্তু তার চোখের তারা নেই—কেবল সাদা। সে উঠে বসে, তাকিয়ে বলে, “আমি এসেছি। তুমি ডেকেছিলে, ভুলেছ?”
সেই গলায়—একটা মেয়ে—জবাব দেয়, “তুমি কথা দিয়েছিলে সূরজ, আগের জন্মে… আমায় বিয়ে করবে। ভুলে গেলে?”
সূরজ সেই ভিডিও বন্ধ করে দেয়। মাথার মধ্যে ছুটে চলা প্রশ্ন—“কী জন্ম? কী প্রতিশ্রুতি? আমি তো কারো সঙ্গে কিছু বলিনি!”
সে পুরনো বাড়ির মালিকের কাছে যায়। বৃদ্ধ লোকটা অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর বলে, “এই বাড়ির ড্রয়িং রুমে যে আয়নাটা আছে, সেটা এই বাড়ির প্রথম মালিক রেখেছিলেন। ওনার মেয়ে ছিল, রমিতা। মেয়েটা অল্প বয়সেই পাগল হয়ে গিয়েছিল। সবাই বলত, সে আয়নায় কারো সঙ্গে কথা বলত। একদিন নিজেই ঘরের মধ্যে দড়িতে ঝুলে পড়ল।”
সূরজের মনে পড়ে—আয়নার সামনে দাঁড়ালে মাঝেমাঝে হালকা গন্ধ পেত, ল্যাভেন্ডারের মতো।
সেদিন রাতে সে ঠিক করল, আয়নাটা সরাবে। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক, আয়নাটা দেয়াল থেকে খুলে না। গাঁইটিগুলো যেন জং ধরলেও শক্ত।
রাগে সে একটা হাতুড়ি নিয়ে আয়নার উপর মারল।
চিৎকার!
আয়নার মধ্য থেকে তীব্র এক চিৎকার বেরিয়ে এল, আর সূরজ ছিটকে পড়ে গেল। আয়না ভাঙল না, বরং সে নিজেকে আয়নার মধ্যে দেখল—নিজের মুখ, কিন্তু আবার সেই সাদা চোখ, ঠান্ডা হাসি।
আর তখনই সেই প্রতিবিম্ব বলে উঠল—”তুমি ফিরে আসলে সূরজ। এবার আমিও আসব।”
এরপর থেকে সূরজ আয়নার সামনে গেলে সে আর নিজের চেহারা দেখে না। দেখে রমিতাকে—দীর্ঘ চুল, সাদা শাড়ি, লাল টিপ, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। সে বলে, “এই জন্মে তুমি পালাতে পারবে না। কথা দিয়েছিলে, মনে নেই?”
সূরজ সিদ্ধান্ত নেয়, এক ওঝার কাছে যাবে। পুরুলিয়ার এক প্রাচীন মন্দিরে থাকা ওঝা ভোলানাথ তাকে বলে, “এই আয়নাটা আসলে এক পুরনো ব্রাহ্মণ পরিবারের তৈলমন্ত্রিত কাঁচের তৈরি। আত্মা এর মধ্যে আটকে যায়, যদি কেউ একান্ত প্রার্থনায় তাকিয়ে কিছু চায়।”
ভোলানাথ সূরজকে প্রশ্ন করে, “তুই কি একবার প্রার্থনা করেছিলি, যেন কেউ তোকে ভালোবাসে?”
সূরজ থমকে যায়। হ্যাঁ, প্রথমবার এই বাড়িতে ঢুকে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “যদি কেউ থাকিস, যে আমায় সত্যি ভালোবাসবে… দেখা দে।”
ভোলানাথ কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই নিজেই ডেকেছিলি, বুঝলি না? এখন মুক্তি চাইলে তোকে আগের জন্মের কাহিনি দেখতে হবে। আয়নার মধ্যে ডুব দিতে হবে।”
সূরজ সেই রাতে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কুয়াশা ঘন হয়। হঠাৎ আয়নার কাঁচ তরল হয়ে ওঠে, সে ভেতরে টেনে নেয় সূরজকে।
সে দেখতে পায় একটি পুরনো বাংলো, ব্রিটিশ আমলের। সেখানে সে একজন জমিদার, নাম শশাঙ্ক। রমিতা তখন এক দাসীর মেয়ে, কিন্তু দু’জনের মধ্যে ভালোবাসা জন্মায়। কিন্তু সমাজ মানে না। শশাঙ্ক প্রতিজ্ঞা করে—পরজন্মে সে রমিতাকে স্ত্রীরূপে পাবে। কিন্তু একদিন ভুলবশত সে তাকে হত্যা করে, অপমানজনকভাবে।
রমিতা মৃত্যুর আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শপথ নেয়, “আমি ফিরে আসব, আর তোকেও ফিরিয়ে আনব। পরজন্মে আমি তোর প্রতিশ্রুতি আদায় করব।”
আবার চোখ খুললে সূরজ দেখে সে নিজেকে চিনতে পারছে না। আয়নায় সে এখন শশাঙ্কের মতো দেখতে। রমিতা তাকে ছুঁয়ে বলে, “এবার পালাবার পথ নেই।”
তৃতীয় দিনের মাথায় ওঝা ভোলানাথ বাড়িতে আসে সূরজকে বাঁচাতে। সে আয়নার সামনে তান্ত্রিক মন্ত্র পড়ে, লাল সিন্দুর আর ধুনোর ধোঁয়ায় ঘর ভরে ওঠে। কিন্তু আয়না ফেটে যায়, আর ভেতর থেকে এক অশরীরী হাসি বেরিয়ে আসে। ভোলানাথ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যান। শেষ শব্দটি তার মুখে, “তিন রক্তপিপাসু আত্মা একত্র হয়েছে… সূরজ আর মানুষ নেই।”
তিন আত্মা? হ্যাঁ, সূরজের শরীরে এখন তিন সত্তা—সূরজ, শশাঙ্ক, আর রমিতা। তারা সবাই মিলে একটি নতুন সত্তা তৈরি করেছে—অশরীরী, অথচ দেহধারী। এক অদ্ভুত আত্মা, যার ইচ্ছা প্রেম নয়, প্রতিশোধ। সে রাতেই সূরজ রাস্তায় বের হয়। পরদিন পত্রিকায় খবর—এক মহিলা, এক শিশু, ও এক ওঝা—তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, চোখ দুটো সাদা, মুখে হাসি আঁকা।
সেই রাতে পাড়ার লোক শুনতে পায়, বাড়ির জানালা দিয়ে এক পুরুষ গলায় মেয়েলি হাসি। সকালে গিয়ে দেখা যায়, আয়নার মধ্যে রমিতা আর সূরজ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দু’জনেই হাসছে। আর আয়নার কাঁচে নতুন একটা রেখা আঁকা—একটা বিয়ের সিঁদুর দাগ।
আজও রাতে ২:৩৫ বাজলে, পাশের বাড়ির লোক শুনতে পায়, “আজও তোকে ভালোবাসি সূরজ… চিরকাল…”
আর কেউ এই বাড়িতে থাকতে চায় না। কিন্তু ভাড়াটে আসে, আবার যায়। প্রতিবার নতুন কেউ এলে আয়না ধীরে ধীরে কুয়াশায় ঢেকে যায়। আর তখনই ভিতর থেকে ভেসে আসে, “তুমি কি চাও ভালোবাসা? তাহলে তাকাও… তাকাও আয়নার দিকে…”




