Bangla - ভূতের গল্প

নির্বাক ঘড়ি

Spread the love

সৌরভ ভৌমিক


দোতলা বাংলোটির রং ছিল ছাই ধূসর, যেন রোদে পোড়া কোনও পুরোনো অ্যালবাম থেকে উঠে এসেছে। জানালার কাচগুলো ঘোলাটে, কাঠের পাল্লায় পোকায় ধরা ক্ষতচিহ্ন। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে গাড়ির শব্দ থেমে গেলে মৃদু হাওয়া বইছিল পুরনো বাগানের ঘাসের গায়ে। গাড়ির দরজা খুলে নামলেন সায়ন আর রীতা। নবদম্পতি, শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে খানিক দূরে এক নিঃসঙ্গ বাংলোয় নতুন শুরু করতে এসেছেন।

“এমন একটা জায়গা তুমি ঠিক করো কীভাবে?”—রীতার গলায় মৃদু অসন্তোষ।

সায়নের হাসিটা ধীর, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত প্রশান্তি—”শান্তি চেয়েছিলে, না? এখানে ট্রাফিক নেই, শব্দ নেই, কিচ্ছু নেই।”

রীতা মুখ ফেরালেও বাড়ির দিকে চাইল—তাদের নতুন বাসা। ব্রোকার বলেছিল, বাড়িটা আগে এক ইংরেজ পরিবার তৈরি করেছিল ১৯২০ সালে। এরপর বহু বছর ধরে খালি। মালিক বিদেশে, বিক্রি করতে চায়নি। ভাড়া দিচ্ছে অল্প টাকায়, শর্ত একটাই—দোতলায় রাখা জিনিসপত্র না নাড়ানো।

তারা ঢুকল। কাঠের সিঁড়িতে ধুলো জমেছে। নিচতলার ঘরগুলো পরিষ্কার, যদিও দেয়ালে ছত্রাকের ছোপ ছোপ দাগ। রান্নাঘর সরল, বারান্দার পাশে বসার ঘরে একটি লম্বা বুকশেলফ। রীতা জানালার পর্দা খুলে আলো ঢুকিয়ে বলল, “দেখো না, ঠিকঠাক করলে খারাপ হবে না।”

রাত গড়িয়ে এল দ্রুত। তারা বিছানায় শুতে গেল। ঘুম আসছিল ধীরে ধীরে। হঠাৎ সায়ন চোখ মেলে চমকে উঠল।

টিক… টিক… টিক…

কোনও এক অজানা ঘড়ির শব্দ। নিঃস্তব্ধ ঘরে খুব মৃদু, তবু কানে বিঁধে যাচ্ছে। রীতা পাশ ফিরে শুয়ে ছিল, তার নিঃশ্বাস ধীর, ঘুমে ঢেকে গেছে। সায়ন উঠে বসল। শব্দটা আসছে যেন ওপরে থেকে। দোতলা?

তিনি আলো জ্বালিয়ে নিচু স্বরে হাঁটতে হাঁটতে দরজার কাছে এলেন। সিঁড়ির দিকে তাকালেন। পা ফেলতেই যেন কাঠ কেঁদে উঠল। উপরে উঠলেন ধীরে ধীরে। শব্দটা পরিষ্কার হচ্ছিল—টিক… টিক… যেন কারও নিঃশ্বাসের মতো জীবন্ত।

দোতলার হলঘরে ঢুকে তিনি থমকে গেলেন। দেয়ালের মাঝখানে এক বিশাল প্রাচীন ঘড়ি। কাঠের কাজ, কালচে বাদামি রঙ, কাচ ঢাকা ডায়ালে রোমান হরফ। ঘড়ির কাঁটা চলছে, কিন্তু ঘড়িতে কোনও আলো নেই, ব্যাটারি নেই, আর বিদ্যুৎও নেই।

তিনি সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সময় দেখায়—রাত ১২টা ১ মিনিট। আর কাঁটা ঘুরছে, মিনিটের কাঁটা ঠিক উত্তর-পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। সায়নের গা শিউরে উঠল। এত পুরনো ঘড়ি… হঠাৎ চলতে শুরু করল?

পরদিন সকালে রীতা জানালার পাশে বসে কফি খাচ্ছিল। সায়ন পাশ থেকে বলল, “কাল রাতে তুমি কিছু শুনেছিলে?”

“কীসের শব্দ?”—রীতা অবাক।

“ঘড়ির টিক টিক শব্দ। দোতলায় একটা প্রাচীন ঘড়ি আছে। চলছিল ঠিক রাত বারোটায়।”

রীতা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কিছু শুনিনি। ঘুমিয়ে গেছিলাম। ঘড়ি কোথায়?”

সায়ন তাকে নিয়ে গেল। ঘড়ি তখন স্তব্ধ। একেবারে নীরব। কাঁটা থেমে আছে। সময়—১২টা ৩ মিনিট। রীতা বলল, “এই ঘড়ি চলছিল? নাকি তুমি কল্পনা করেছ?”

সায়ন কিছু বলল না। তিনি জানতেন—ঘড়ি চলছিল। শব্দটা তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু এখন যেন ঘড়ি আবার নিঃশব্দ। যেন কিছুই হয়নি।

দিন কয়েক কেটে গেল। বাংলোতে সময় কাটছিল ধীরে ধীরে। রীতা বারান্দায় বাগান গোছাত, সায়ন বই পড়ত। কিন্তু প্রতিদিন ঠিক রাত ১২টায়, সেই শব্দ ফের আসত—টিক… টিক… টিক। প্রথমে মৃদু, তারপর ঘন। সায়ন চোখ মেলে জেগে উঠত, আর প্রতিবারই সে দেখত ঘড়ির কাঁটা অন্য দিকে ঘোরে। কখনও দক্ষিণ, কখনও পূর্ব, কখনও উত্তর।

এবং প্রতিদিন সকালে, বাড়ির আশপাশে কেউ একজন থাকত। অচেনা মানুষ। কেউ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত কিছুক্ষণ, কেউ পেছনের বাগানে বসে থাকত। সায়ন জানত—এরা কেউ জীবিত নয়।

চতুর্থ রাতে, টিক টিক শব্দের পর সায়ন উঠে গেল আবার। ঘড়ির কাঁটা ছিল পশ্চিম দিকে। ঘরে নেমে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে দেখল—এক বৃদ্ধ, সাদা ধুতি, সাদা চুল, বাঁ হাতে এক লাঠি—চুপ করে তাকিয়ে আছেন ঘরের দিকে। কিছুক্ষণ পর তিনি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

সায়নের কাঁধ ঠান্ডা হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা যেদিকে, সেদিকেই কেউ আসে। কিন্তু কেন? আর সে ছাড়া কেউ শুনতে পাচ্ছে না?

রীতা এসব জানে না। সে হাসে, রান্না করে, গান গায়। মাঝে মাঝে সায়ন কিছু বলতে চায়, কিন্তু থেমে যায়। সে জানে—এই বাংলোয় কেবল একটি কানই শুনতে পায় নির্বাক ঘড়ির ডাক।

অদৃশ্য ছায়া

ঘড়ির শব্দটা এখন সায়নের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেছে। টিক টিক… যেন তার হৃদপিণ্ডের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে চলছে। প্রতিরাত বারোটায় সে উঠে পড়ে, দোতলায় চলে যায়, ঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখে কাঁটা কোনদিকে ঘোরে। আর পরদিন সকালে সেই দিকেই সে দেখে এক অচেনা মুখ, এক অনাহুত ছায়া, কেউ যেন সেই ঘড়ির নির্দেশ মেনে হাজির হয়।

চতুর্থ রাতের পর দিনভর একটা অস্বস্তি চেপে ছিল তার ঘাড়ে। ব্রাশ করতে করতে আয়নায় চোখ পড়ে আর এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, আয়নায় তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কেউ। এক সাদা কাপড়ে মোড়া মুখ, গলার কাছে একটা ফাঁসির দাগ। সায়ন চোখ বন্ধ করে ফের তাকায়—কেউ নেই।

রীতা তখন রান্নাঘরে, চায়ের কেটলিতে জল বসিয়েছে। সায়ন পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়, বলে, “তুমি কি কখনও বিশ্বাস করো অতৃপ্ত আত্মা বলে কিছু আছে?”
রীতা হাসে। “তুমি ভূতের গল্প পড়া বন্ধ করো। ঘরটা এমনিতেই পুরনো, তার ওপর তুমি নিজেই নিজের ভয় বাড়াচ্ছ।”

“কিন্তু রীতা,” সায়নের গলা কাঁপে, “প্রতিদিন রাতে ঘড়ি চলতে শুরু করে। শুধু আমি শুনতে পাই। আর কাঁটা যেদিকে ঘোরে, পরদিন সেই দিকেই কেউ আসে।”

রীতা চুপ করে যায়। মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, সে হয়ত ভাবছে এটা নিছক ক্লান্তির ফল। বা নিছক কল্পনা। সে কিছু বলে না, শুধু একটা পলকা হাত সায়নের পিঠে রাখে।

সেদিন রাতে, সায়ন সিদ্ধান্ত নেয়—ঘড়ির সামনে বসে থাকবে। অপেক্ষা করবে শব্দটা শুরু হওয়ার আগেই। ঘুম নািয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখে, একখানা খাতা ও কলম নিয়ে বসে পড়ে। ঘড়ির সামনেই এক কাঠের চেয়ার। ঘরটা নিস্তব্ধ, বাইরের কুকুরগুলোও থেমে গেছে যেন।

ঘড়ির কাঁটা তখন স্থির—১১টা ৫৯। সায়নের হাত কাঁপে। মিনিট কেটে যায়, আর ঠিক যখন রাত ১২টা বাজে—

টিক…
টিক…
টিক…

সে থমকে যায়। কাঁটা ঘুরছে, এবারে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। খাতায় লিখে রাখে—Day 5 – 12:00 AM – SE Direction।

ঘড়ির গায়ে এক ঝাপসা ছায়া খেলা করে। যেন কাচের ভেতর দিয়ে কেউ তাকাচ্ছে। সায়ন চেয়ার থেকে উঠে সোজা জানালার পাশে দাঁড়ায়, ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়। বাইরে ঘন অন্ধকার। কেবল বাগানের প্রান্তে এক ছায়ামূর্তি—চুড়িদার পরা এক নারী, মুখটা ঝুঁকে আছে, চুলগুলো ঢেকে দিয়েছে পুরো চেহারা।

সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ নড়ে নাড়াচড়া না করেই মাটি থেকে যেন হাওয়ার মতো সরে যায়। নেই। অদৃশ্য।

পরদিন সকালে সায়ন রীতাকে নিয়ে সেই জায়গায় যায়। “তুমি কি দেখেছো এখানে কিছু?”

রীতা বিরক্ত, “সায়ন, এখানে কিচ্ছু নেই। তুমি যা দেখছো, শুনছো—সব তোমার ভিতর থেকে আসছে। হয়তো আমাদের এখানে না থাকাই ভালো।”

সায়নের মুখে ধোঁয়া। “তুমি বোঝো না রীতা। ঘড়িটা জীবন্ত। ওটা একটা ডাক। একটা সংকেত।”

রীতা কিছু বলে না। শুধু দরজার দিকে ফিরে যায়। তবে তার চোখেও একটা অস্বস্তি জমে ছিল, সে সায়নের পেছনে তাকায়নি, কিন্তু তার ছায়া পড়ছিল না মাটিতে।

সেদিন সন্ধ্যেয় সায়ন বইয়ের তাক ঘেঁটে ঘেঁটে ঘরের পুরনো নথি খোঁজে। একটি কাঠের বাক্সে একখানা বিবর্ণ কাগজের দল পাওয়া গেল। ইংরেজিতে লেখা, তারিখ ১৯৪৩—লেখকের নাম Major David S. Wright

“The clock in the upper hallway no longer obeys time. At every midnight, it ticks without being wound. And each time the hands point in a new direction, a soul comes back—not always visible, but present. Mary saw her mother last Tuesday. I saw my brother yesterday. They don’t speak. But they stare. We’ve decided to leave the bungalow. Time no longer moves forward here.”

সায়নের হাত কেঁপে ওঠে। সে জানে এটা কেবল কল্পনা নয়। ইতিহাস নিজেই স্বীকার করেছে ঘড়ির রহস্য।

রাত নামল। এবার ঘড়ির সামনে বসে সে আগের দিনের নোটগুলো দেখে। প্রতিদিন আলাদা দিক, আর প্রতিদিন এক নতুন আত্মা।

এবং ঠিক রাত ১২টা বাজতেই—

টিক…
টিক…

এবার কাঁটা ঘোরে উত্তর দিকে।

সায়ন উঠে জানালার কাছে যায়, কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু দরজায় হঠাৎ টোকা পড়ে—টক… টক…
সে দরজা খোলে না। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে শোনে—কেউ যেন ধীরে ধীরে নেমে আসছে। প্রতিটি পা চাপা, কিন্তু কাঠ কেঁপে ওঠে।

সে দরজা খুলে তাকায়। কেউ নেই।

কিন্তু বাতাসে গন্ধ—সুগন্ধী আতরের মতো, সঙ্গে এক অচেনা সোঁদা ঘামের গন্ধ। সে আবার উপরে ওঠে, ঘড়ির পাশে দাঁড়ায়। হঠাৎ ঘড়ির কাচে তার মুখ ছাড়া আরেকটি মুখ ভেসে ওঠে—সাদা চোখ, বিবর্ণ ঠোঁট।

সে পিছিয়ে যায়। কিন্তু মুখটা এখনও ভাসছে, কাঁচের ওপারে।

ঘড়ির শব্দ থেমে যায়।

নীরবতা নামে আবার। আর তখনই সায়নের মনে হয়—এই ঘড়ি শুধু সময় নয়, আত্মার দিকনির্দেশক। প্রতিদিন রাত বারোটায় সে শুধু ঘড়ির শব্দ শুনছে না, শুনছে মৃত্যুর পদধ্বনি।

ঘড়ির কাঁচে ভেসে থাকা সেই মুখটা যেন হঠাৎ কোনও শব্দ না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সায়নের দিকে। কিন্তু তার শরীরে কিছু লাগল না, কেবল একটা হিম শ্বাস যেন বুকে এসে ধাক্কা দিল। সায়ন পড়ে গেল পিছনে, চেয়ারের পায়ে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে। বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে দ্রুত, কিন্তু চিৎকার করতে পারছে না—গলার স্বর আটকে গেছে।

ঘড়ির কাঁটা আবার স্তব্ধ। ডায়ালটা নীরব, সেই অচেনা মুখ নেই, কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে ভেতরে। সায়ন উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। সিঁড়ির নিচ থেকে ভেসে আসছে রীতার গলা, “ঘুমোতে গেলে না এখনো?”

সে জবাব দেয় না। ধীরে নেমে আসে নিচে। রীতা তখন রান্নাঘরের আলো নিভিয়ে বেরোচ্ছে। তার মুখে ক্লান্তির রেখা, কিন্তু চোখে চিন্তার ছায়া নেই।

“তুমি ঠিক আছো তো?”—রীতা এবার থেমে তাকায়।

“তুমি আজকে…,” সায়নের গলা শুকিয়ে আসে, “ঘড়ির কাছেই ছিলে না? কেউ কি… কেউ কি উঠেছিল উপরে?”

রীতা ভ্রু কুঁচকে হাসে, “না তো। আমি তো রান্নাঘরেই ছিলাম। কেমন অদ্ভুত কথা বলছো তুমি সায়ন।”

সায়ন জানে, কিছু বললেও লাভ নেই। এ বাড়িতে ঘড়ি যেন শুধু তাকে দেখে, আর কাউকে নয়। রাত পেরিয়ে গেল নীরবতায়।

পরদিন সকালে বাড়ির পেছনের গাছপালা ঘেঁটে রীতা কয়েকটা চারা বসাচ্ছিল। হঠাৎ একটা জায়গায় মাটি খুঁড়ে খুঁজে পেল অর্ধেক পচা একটা চুল বাঁধার কাঠের কাঁটা। লাল রঙের দাগ, শুকিয়ে গাঢ় খয়েরি হয়ে আছে। সে কাঁটাটা তুলতেই মাটি থেকে উঠে এল একটা ধাতব বোতাম—পুরোনো জামার বোতাম, যাতে ইংরেজি হরফে খোদাই—D.S.W.

সে গুগল করে দেখে—David S. Wright—এই নামটাই লেখা ছিল সেই ইংরেজ কাগজে, যেটা সায়ন আগের রাতে খুঁজে পেয়েছিল।

রীতা সেদিন বিকেলে সায়নকে কিছু না বলে গেল স্থানীয় পোস্ট অফিসের পাশে থাকা পুরনো লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরির বৃদ্ধ কর্মচারী বলল, “এই বাংলোটার নাম আগে ছিল ‘Wright Villa’। ইংরেজ বড় সাহেব থাকতেন একসময়। যুদ্ধের সময় তার স্ত্রী আর ছোট ভাই নাকি এই বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন।”

রীতার মুখ শুকিয়ে আসে। “কারণ?”

“বলার মতো নয়। শোনা যায়, ঘরের উত্তর দেওয়ালে একটা ঘড়ি ছিল। সেই ঘড়ির কাঁটা তাদের আত্মহত্যার রাতে বন্ধ হয়নি একটানা তিন ঘণ্টা। তারপর থেকে নাকি মাঝরাতে আবার চলত। কেউ কেউ বলতো, ঘড়ি চললেই আত্মারা ফিরে আসে।”

রীতা ভেতরে ভেতরে থরথর করে কেঁপে ওঠে। সায়নের সব কথাগুলো মনে পড়ে—কাঁটা ঘোরে, আত্মা আসে। আর সে ছাড়া কেউ দেখতে পায় না।

সেদিন রাতে, রীতা চুপ করে সায়নের পাশেই ঘুমাল। কিন্তু তার ঘুম এল না। সে উঠে গিয়ে নিচ থেকে ফোনটা এনে দোতলার ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। সারা শরীর ঠান্ডায় কাঁপছে। সে জানে ঠিক বারোটা বাজবে, আর কিছু একটা ঘটবে।

টিক…
টিক…
টিক…

সে শব্দ প্রথমবার শুনতে পেল। এতদিন শুধু সায়ন শুনত। এবার সেই শব্দ তার কানে কাঁটার মতো বিঁধল। ঘরের ভিতর আলো জ্বলে উঠল যেন নিজে থেকে। দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল আস্তে আস্তে।

সে ভিতরে পা রাখে।

ঘড়ির কাঁটা তখন উত্তর-পশ্চিমে। কাঁচের ভিতরে প্রতিফলন—নিজের মুখের পাশে আরেকটা মুখ। একটা মেয়ের মুখ, যার চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। মুখের এক পাশে ক্ষতচিহ্ন, চুল খোলা, ঠোঁট নীলচে।

রীতা চিৎকার করে উঠতে চাইছিল, কিন্তু পারল না। তার গলা যেন কেউ চেপে ধরেছে। ভয়ের তীব্রতায় সে চেয়ারে বসে পড়ল। ঘড়ির শব্দ চলছে—টিক টিক টিক—আর মেঝেতে একটা ছায়া ঘুরছে ঘরের মধ্যে।

তখনি পেছন থেকে সায়নের কণ্ঠ—”তুমিও শুনতে পাচ্ছো এবার?”

রীতা তাকিয়ে দেখে সায়ন দাঁড়িয়ে আছে ঘরের কোণায়। চোখে ক্লান্তি, তীব্রতা।

“আমি ভাবতাম, এটা শুধু আমি কল্পনা করছি। কিন্তু এখন তুমি শুনতে পাচ্ছো… মানে, ওরা আমাদের দু’জনকেই ডাকছে।”

“ওরা কারা?”—রীতার ঠোঁট কাঁপে।

“যারা ফিরে আসতে চায়, কিন্তু সময় থেমে গেছে তাদের জন্য। ঘড়িটা ওদের জন্য একমাত্র পথ… সময়কে ছেদ করে ফিরে আসার।”

ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ থেমে যায়। কাচে কেউ যেন হাত রাখে ভেতর থেকে। ঠাণ্ডা শ্বাসের দাগ জমে কাচে লেখা হয়ে যায়—

“Come Downstairs.”

দুজনে নিচে নামে। ঘরের আলো নিভে যায় নিজে থেকে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়—সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে একজন, স্পষ্ট সাদা চুড়িদার, কাঁধে লাল দাগ। মুখ ঝুঁকে আছে, মাথা নাড়ছে আস্তে আস্তে, যেন কিছু বলতে চাইছে।

রীতা দরজা খুলতে চাইলে সায়ন হাত ধরে। “দাঁড়াও। এরা বাইরে থাকতে চায় না। এরা ভিতরে আসতে চায়।”

“কিন্তু কেন?”—রীতার গলা ভাঙা।

সায়ন তাকিয়ে থাকে সেই অবয়বের দিকে। তারপর ধীরে বলে—“কারণ, আমরা ওদের সময় চুরি করে এখানে বাস করছি। এই বাংলো এখন আর আমাদের নয়।”

ঘড়ির কাঁচে লেখা সেই বাক্যটা—“Come Downstairs.”—তাদের ভিতরে নামিয়ে এনেছিল আরও গভীর এক স্তরজুড়ে বিস্ময় আর আতঙ্ক। বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা চুড়িদার পরা মেয়েটি এখন কিছুটা স্পষ্ট। তার মুখ ঝুঁকে আছে, যেন সে কিছু খুঁজছে মাটির ফাঁকে, আবার যেন নিজেই নিজের মুখ লুকোচ্ছে। তার অস্তিত্ব কোনও ছায়ার মতো নয়—সে বাস্তব, অথচ তাকে ছুঁতে গেলে বাতাসে মিলিয়ে যাবে।

সায়ন আর রীতা দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধ দরজার ওপাশে। দরজার কাচের মধ্যে দিয়ে তারা দেখতে পায় মেয়েটি ধীরে ধীরে বারান্দার এক কোণে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। সেখানে এক টব ছিল, যার মধ্যে রীতা সেদিন তুলসি গাছ বসিয়েছিল। মেয়েটি তার আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে।

“সে কিছু খুঁজছে?”—রীতার কণ্ঠে অস্থিরতা।

সায়ন চুপ। তার মনে পড়ে সেই কাঠের চিরুনি, সেই ধাতব বোতাম—সব কিছু যেন একটা গল্পের অংশ, যেটার মূল চরিত্ররা এখনও হারিয়ে আছে ইতিহাসের অন্ধকারে। সে জানে, মেয়েটি খুঁজছে তার ফেলে যাওয়া সময়কে।

রীতা কাঁপা গলায় বলে, “দরজা খুলব?”

সায়ন মাথা নাড়ে, “না। ওরা ভিতরে এলে সময় আর স্বাভাবিক থাকবে না। ঘড়ির বাইরে গেলে ওরা চলে যেতে বাধ্য—ঘড়ি ওদের বেঁধে রাখে।”

তখনই তারা দেখে, মেয়েটি তার আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বের করে আনছে এক ঝকঝকে রুপোর চুড়ি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, চুড়িটা বার করেই সে নিজে যেন মাটি হয়ে যাচ্ছে। তার শরীরের সীমারেখা মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এবং ঠিক পরের মুহূর্তে, মেয়েটি আর নেই।

নিরবতা। বারান্দায় কেবল পড়ে আছে সেই চুড়িটা।

রীতা দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। টবের পাশে পড়ে থাকা চুড়িটা হাতে নেয়—ঠান্ডা ধাতব, তবু গায়ে অদ্ভুত এক তাপ। “এটা সত্যি,” সে ফিসফিস করে, “তারা কিছু রেখে যাচ্ছে। কিছু ফিরিয়ে নিতে চায়।”

সায়ন তার কাঁধে হাত রাখে। “আমরা একটা ভুলের মধ্যে আছি রীতা। আমরা এই বাড়িতে থাকতে পারি না। ঘড়ি চললে সময়ের সীমা খুলে যায়। জীবিত আর মৃতের মাঝখানে যে দেওয়াল, তা টলে ওঠে।”

কিন্তু তারা চাইলেই কি বেরিয়ে যেতে পারে? সেই রাতে সায়ন আবার ঘড়ির সামনে বসে। তার সামনে খাতা, কলম, আর সেই পুরনো চিঠির কপি।

রাত ১২টা।

টিক… টিক… টিক…

এবার ঘড়ির কাঁটা পশ্চিম দিকে। কিন্তু আজকের কাঁটা শুধু ঘোরে না, প্রতি এক সেকেন্ডে যেন থেমে যায়, কেঁপে ওঠে। সময় যেন নিজে দ্বিধায়।

সায়ন খাতায় লিখে রাখে—Day 6 – West – Vibration Noted।

ঠিক তখনই ঘড়ির নীচে রাখা কাঠের তাক থেকে একটি পুরনো চিঠি পড়ে যায় নিজে থেকেই। চিঠিটা কেউ হয়ত বহু বছর আগে রেখে গিয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা:

“David, if the clock ticks again, know that the seal is broken. We were fools to use the ritual. The souls do not sleep. They wait. And the directions—those are their doors. Each night, one more door opens.”
—M.

সায়নের ঠোঁট শুকিয়ে আসে। ঘড়ি কোনও সাধারণ প্রাচীন যন্ত্র নয়। এটা ছিল এক প্রবেশপথ, বা বলা ভালো, এক অন্তর্দ্বার—যার মাধ্যমে কিছু আত্মা নিজেকে সময়ের বাইরে রেখে দিতে পারে। Ritual? কোন রীতির কথা বলেছে চিঠিটা?

সে জানে, কাল তাকে পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে এই বাংলোর পুরনো দলিলপত্র।

পরদিন সকালে, রীতা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে, তাদের বৈঠকখানার এক কোণে দেওয়ালে আঁকা ছোট্ট এক চিহ্ন—একটি বৃত্ত, যার ভেতরে চারটি তীর—চার দিকের প্রতীক। অদ্ভুতভাবে সেই প্রতীকই ঘড়ির কাঁটার দিকের সঙ্গে মিলে যায়।

“সায়ন, তুমি বলেছিলে ঘড়ির কাঁটা প্রতিদিন এক নতুন দিকে ঘোরে?”

“হ্যাঁ। দক্ষিণ, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব, পশ্চিম…”

রীতা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে এ বাড়ির ভিতরেই কেউ আগে থেকেই জানত কী হতে চলেছে। এটা তো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।”

সায়নের মনে পড়ে যায় চিঠির কথা—“They wait. The directions are their doors.”
অর্থাৎ এই বাংলোতেই কখনো এক বিশেষ তান্ত্রিক রীতি করা হয়েছিল, যার ফলে ঘড়িটা শুধু সময়ের গতি নয়, আত্মার গতিপথও নির্দেশ করে।

আর যাদের পথ খুলে যায়, তারা ফিরে আসে—প্রতিরাতে, এক এক করে।

ঠিক তখনই জানালার বাইরে, দিনের আলোয়, তারা দেখতে পায় একজন বৃদ্ধ, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে চশমা, হাতে একটি মদের বোতল।

সায়ন দৌড়ে বারান্দায় যায়—কেউ নেই।

রীতা দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, “আজ দিনে দিনে কেন ওরা আসছে?”

সায়নের কণ্ঠে গম্ভীরতা, “কারণ রাত এখন আর থেমে নেই। ঘড়ি প্রতিদিন বাড়ছে, সময় ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের বাইরে। আমরা এখন ওদের সময়ের মধ্যে রয়েছি।”

রীতা ফিসফিস করে, “তাহলে আমরা কী করব?”

সায়ন বলে, “ঘড়িটা থামাতে হবে। নাহলে, ফিরে আসবে… যারা আর কখনও চলে যায়নি। যারা থেমে গিয়েছিল কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে।”

সায়ন জানে—ঘড়িটা কেবল একটা যন্ত্র নয়। ওটা একটা পথ, একধরনের ফাটল—যেখান থেকে অতীত নিজেদের আকারে ফিরে আসে। আর এই ঘড়ির শব্দ যতক্ষণ চলবে, ততক্ষণ মৃতেরা তাদের অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে পারবে না।

সেদিন সকালেই সে বেরিয়ে যায় স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে। নীল ফাইলের ভেতরে পেল সেই পুরোনো দলিল—১৯২3 সালে Wright Villa নামের এই বাংলো তৈরি হয়েছিল একজন ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার, মেজর ডেভিড এস. রাইটের উদ্যোগে। কিন্তু ১৯৪৪ সালের শেষ দিকে স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ ছিল—এই বাড়ি থেকে মাঝরাতে কুকুরের আর্তনাদ, কাঁটার আওয়াজ আর অদ্ভুত হিন্দি সংস্কৃত মিশ্র মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসে।

তারপর একদিন বাড়ির ভিতরে আগুন লাগে। স্ত্রী মারা যায়। ছোট ভাই নিখোঁজ। মেজর নিজে বিলেত ফিরে যান, আর কখনো ফিরে আসেননি।

কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত তথ্য ছিল শেষের পাতায়—“বাড়ির ভিতরে পাওয়া গিয়েছিল একটি ‘চক্র’ খোদাই করা ঘড়ি, যার কাঠামো ঘড়ির হলেও, তার চলার জন্য কোনও যান্ত্রিক অংশ ছিল না। সময় চলত তার নিজের নিয়মে।”

সায়ন ফাইলটা বন্ধ করে গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসে। বাড়ির বাইরে রীতা দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে, চোখে উদ্বেগ। “তুমি বলেছিলে, ঘড়ি বন্ধ করতে হবে। কীভাবে?”

সে ধীরে বলে, “ঘড়িটা আসলে একটা সিল। সেটা যদি আমরা ভাঙি, আত্মারা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তাতে আমাদেরও এখানে থাকার অধিকার শেষ হয়ে যাবে। কারণ আমরা এই সময়ের মানুষ—ওদের মধ্যে নয়, আমাদের মধ্যে না। আমরা এখন এক ফাঁকা জায়গায় আছি।”

রীতা কিছু না বলে তার হাত ধরে। “তাহলে যা করতে হবে করো। আমি আছি।”

রাত নামে, ঘন নীরবতা চারপাশে। বাংলোর জানালাগুলো বাতাসে দুলছে, জানলার কাচে যেন ছায়া খেলে যায়। ঘড়ির ঘরটায় তারা দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। ঘড়ির কাঁটা তখনও স্তব্ধ। ১১টা ৫৯।

সায়ন পকেট থেকে বার করে একটি ছোট্ট ধাতব হাতুড়ি। ঘড়ির নিচে রাখা এক কাঠের তাক খুলতেই বেরিয়ে আসে মাটি ভর্তি একটি লাল কাপড়, তার ভেতরে তিনটি জিনিস—একটি রক্তমাখা পাথর, একটি মৃত পাখির পালক, আর একটি চিঠি।

চিঠিটায় লেখা:

“To break the seal, let the clock see itself. Mirror time. Destroy the hand. And burn what remains.”

“ঘড়িকে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখাও… মানে?”—রীতা প্রশ্ন করে।

সায়ন একটি ছোট আয়না নিয়ে আসে। আয়নাটা ঘড়ির কাঁচের সামনে ধরে রাখতেই হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা গড়গড়িয়ে ঘুরতে শুরু করে—মিনিট কাঁটা ঘোরে দক্ষিণে, তারপর পশ্চিমে, তারপর আবার দক্ষিণে। সারা ঘর কাঁপে। বাতাস ঘুরে আসে সাইক্লোনের মতো, আলো নিভে যায়।

ঘরের কাচে মুখ ভেসে ওঠে—সেই সাদা চুড়িদার পরা নারী, সেই বৃদ্ধ, সেই ছোট ছেলে… একের পর এক মুখ ভেসে উঠছে কাচে। যেন ঘড়ি নিজের ভেতরের সব গল্প বের করে আনছে।

সায়ন তখন হাতুড়ি তুলে এক চিৎকারে ঘড়ির কাঁটায় আঘাত করে। কাঁটা ভেঙে যায়। কাঁচ চূর্ণবিচূর্ণ। সেই মুহূর্তেই পুরো ঘরটা থমকে যায়। বাতাস থেমে যায়, আলো আবার জ্বলে ওঠে।

কিন্তু কিছুই আগের মতো নেই।

ঘড়ির কাঁচে এখন শুধু তাদের দু’জনের প্রতিচ্ছবি। আর কিছু না।

“এটা কি শেষ?”—রীতা ধীরে জিজ্ঞাসা করে।

সায়ন ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা পালক আর পাথরগুলো কুড়িয়ে নেয়। তারপর বাইরে গিয়ে সেই কাপড়ের পোটলাটা আগুনে ফেলে দেয়। পেছনে তাকায় না।

সেই রাতে, কোনও ঘড়ির টিক টিক শব্দ শোনা যায়নি।

সকালে উঠেও চারদিক ছিল নীরব, স্বাভাবিক। পাখির ডাক, শিশির পড়া ঘাস, জানালায় রোদের রেখা—সব কিছু যেন ধোয়া ধুয়ে এক নতুন সকাল।

তারা জানত, ঘড়ি হয়তো আর কোনও সময়ের পথ খুলবে না।

কিন্তু যাওয়ার আগে, রীতা ঘরের এক কোণে ঝোলানো আয়নাটার দিকে তাকায়। আয়নার ভিতর সায়নের প্রতিচ্ছবি… একটু ধীর, একটু কাঁপা… আর তার পেছনে, এক মুহূর্তের জন্য, যেন দাঁড়িয়ে থাকে সাদা পোশাকের সেই ছায়া।

(প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি)
(চলবে দ্বিতীয় অধ্যায়ে)

আপনি যদি চান, এখনই শুরু করতে পারি দ্বিতীয় অধ্যায়—নতুন রহস্য, নতুন ছায়া, কিন্তু ঘড়ি কি সত্যিই থেমে গেছে?

সকালটা যেন কিছুটা অন্যরকম। বাংলোর জানালায় রোদের তীক্ষ্ণ রেখা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে, গালিচার ওপর সোনালি ছায়া ফেলে। পাখির ডাক শোনা যায়—নিয়মিত, পরিচিত, নির্দোষ। কিন্তু রীতা বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই বুঝে যায়—সবকিছু ঠিক থাকলেও, কিছু একটা কোথাও ভুল।

আয়নার মধ্যে তার মুখ—চেনা মুখ, ক্লান্ত চোখ, আলগা চুল—সব ঠিকই আছে। কিন্তু প্রতিফলনের পেছনের দেয়ালে থাকা দেয়ালঘড়িটা… সেটা তো আগের রাতে ভেঙে গেছে। অথচ আয়নায় ঘড়িটা অক্ষত। নিঃশব্দ, কিন্তু অক্ষত। কাঁটা নেই, কাচ নেই, কিন্তু কাঠের অবয়ব ঠিকঠাক।

সে চোখ কুঁচকে আয়নার দিকে এগিয়ে যায়। আয়না নিঃশব্দ। হাত দিয়ে ছুঁতে চায়, কিন্তু আয়নার কাচ যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে যায়। একটানা কাঁপতে থাকে। সে ভয় পায় না, কেবল ফিসফিস করে বলে, “তুমি ফিরেছো?”

তার পেছনে সায়নের গলা—“কাকে বলছো?”

রীতা ফিরে তাকায়। “ঘড়িটা… আয়নায় আবার এসেছে।”

সায়ন এগিয়ে আসে, আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু তার চোখে কিছুই ধরা পড়ে না। “তুমি ঠিক দেখেছ তো?”

“আমি জানি, তুমি যা দেখেছিলে এতদিন—সেটা আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন… আমি বুঝতে পারছি। এই ঘড়ি সময়কে থামায় না। এটা সময়কে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়। আয়নার মধ্যে সময় আটকে আছে।”

সায়ন কিছু বলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘড়ি যাকে ডাকত, সে সায়ন। কিন্তু আয়নার ঘড়ি ডাকছে রীতাকে।

সেই দুপুরে, তারা বাংলোর পুরনো স্টোররুমটা খোলে। সেই ঘরটা, যেটা শুরু থেকেই তালাবন্ধ ছিল। মালিক বলেছিল—এই ঘরের ভিতরের কিছু নাড়ানো যাবে না।

তারা দরজার তালা ভাঙে। ভেতরে গন্ধ—পুরনো কাঠ, পচা বই, ধুলো আর যেন কোথাও পুড়ে যাওয়া কাপড়ের গন্ধ। কোণের এক তাকের ওপরে তারা খুঁজে পায় একটা মোটা রেজিস্টার, খয়েরি কভার। ভেতরে নাম লেখা—“Journal of M.”

সায়ন পড়ে শোনায়—

“We thought the clock was a mistake. But it was a vessel. A container of echoes. The mirror was the only way to trap the echoes when they bled through time. But one day, someone will break the seal. The reflections will shift. And the ones who waited will step through… not from the clock… but from the glass.”

রীতা ধীরে ফিসফিস করে—“ঘড়ি ভাঙা মানেই আয়না খুলে দেওয়া।”

সেদিন রাতটা ছিল অদ্ভুত নীরব। বাতাসে কোনও শব্দ নেই, পাখিরাও নীরব। বাংলোর ঘর ঘর করে জানালার কাচ দুলছে না, এমনকি পোকা-মাকড়ের চলাফেরাও থেমে আছে। যেন গোটা বাড়িটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে।

ঠিক রাত ১২টা ১ মিনিট। আয়নার কাচে দাগ পড়ে—ফুটো ফুটো জলীয় বাষ্পের রেখা। রীতা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, কপাল ছুঁইয়ে দেয় আয়নায়। আর ঠিক তখনই তার শরীর হিম হয়ে যায়।

আয়নার ভিতরে সে দেখে… নিজেকে। কিন্তু মুখটা অন্যরকম। চোখ গাঢ়, ঠোঁট ফ্যাকাশে, আর কপালের মাঝখানে এক লম্বা ফাটল। সেই ‘রীতা’ তাকিয়ে আছে তার দিকেই, নিঃশব্দে।

সায়ন পেছন থেকে টান দেয়। “দূরে এসো! তুমি জানো না সে কে।”

“সে আমি… অথবা আমি নই। কিন্তু সে জানে কী হচ্ছে। ঘড়ির চেয়ে বেশি সে জানে।”

সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “তুমি কে?”

আয়নার ‘রীতা’ ঠোঁট নাড়ায়, কিন্তু কোনও শব্দ শোনা যায় না। কেবল ঠোঁটের গঠন—তিনটি শব্দ:

“She never left.”

রীতা পিছিয়ে আসে। “সে কে? কে কখনও যায়নি?”

সায়ন তৎক্ষণাৎ বলে, “আয়নাটা ঢেকে দাও! ওকে বাইরে আসতে দিও না!”

তারা আয়নার ওপর চাদর ফেলে দেয়। কিন্তু আয়নার ভিতর থেকে সেই ঘড়ির টিক টিক শব্দ ফের ভেসে আসে, ধীরে, যেন এক নতুন পর্বের শুরু।

চাদরের নিচে আয়নাটা নড়ছিল। যেন কাঁচের নিচে কেউ নিশ্বাস নিচ্ছে—ধীরে, ভারী করে। কাচের ভিতর আটকে থাকা সেই রীতার মুখ এখন দৃশ্যমান নয়, কিন্তু তার অস্তিত্ব ঘরের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে হালকা পারফিউমের গন্ধ, সেই পুরনো আতরের মতো, যেটা তারা কখনও ব্যবহার করেনি।

রীতা চুপ করে বসে ছিল বিছানার ধারে। তার হাতে সেই পুরোনো চুড়িটা—যেটা সেই সাদা পোশাকের মেয়েটি টবের পাশে রেখে গিয়েছিল। চুড়ির ধাতু ঠান্ডা হলেও, আজ তার গায়ে অদ্ভুত এক ধক ধক করছে—একটা স্পন্দন, যেন কারও হৃদপিণ্ডের গতি এতে আটকে আছে।

“সে কখনও যায়নি”—এই তিনটি শব্দ তার মাথায় গুঞ্জন তুলছিল।

সে তাকায় আয়নার দিকে। “তাহলে… আমি কি… সেই ‘সে’?”

সায়ন পাশে এসে বসে। “না। তুমি তুমি। কিন্তু কেউ একজন তোমার ভেতর দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিচ্ছে। আয়না শুধু প্রতিফলন নয়, এটা একধরনের দরজা। হয়তো সেই মেয়েটি—যাকে তুমি প্রথম দেখেছিলে—সে তোমার দেহ, তোমার অস্তিত্ব, এমনকি তোমার সময় চায়।”

রীতা ধীরে চুড়িটা মুঠোয় ধরে। “আমি তো কাউকে ডাকিনি। আমি তো কিছু করিনি…”

“কিন্তু ঘড়িটা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই আয়না জেগে উঠেছে। আর তুমি প্রথম যে তাকে দেখেছ, সেও একজন নারী। তাদের মধ্যে কিছু আছে। হয়তো সময়ের ভেতর আটকে পড়া কোনও প্রতিরূপ।”

রীতা উঠে দাঁড়ায়। “আমি আর পালিয়ে থাকতে চাই না। আমি ওর সঙ্গে মুখোমুখি হতে চাই।”

সায়ন চমকে ওঠে। “তুমি পাগল হয়েছো?”

“না। আমি জানি, যদি আমি ভয় পেয়ে থাকি, ও আরও গভীরে যাবে। আয়নার ভিতর শুধু একটা মুখ নয়—স্মৃতি আটকে আছে। আমি যদি আয়নার সামনে দাঁড়াই, হয়তো আমি জানতে পারব সে কে… হয়তো সে আমিই।”

রাতে, ঠিক ১২টা। চাদর সরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রীতা।

কিছুই দেখা যায় না প্রথমে। তার নিজের মুখই ফিরে আসে, একটু অনিয়মিত, একটু ঘোলাটে। তারপর ধীরে ধীরে পেছনের আবছা প্রতিচ্ছবির মধ্যে উঠে আসে সেই সাদা পোশাক, সেই কালো চুল, সেই চোখ—যেখানে দুঃখ জমেছে প্রাচীন ছাইয়ের মতো।

রীতা বলে, “তুমি কে?”

মেয়েটি এবার ঠোঁট নাড়িয়ে বলে, “Anamika.”

এই প্রথমবার রীতা শব্দটা শুনতে পায়। কণ্ঠটা যেন জলপড়া ঘন্টার মতো—আলতো, ভাঙা, তবু দৃঢ়।

“তুমি কখন এসেছিলে?”

“তুমি যখন এসেছো, তখনই আমি ফিরেছি। কারণ আমার চলে যাওয়ার কথা ছিল এই বাড়ি থেকেই। কিন্তু আমি পারিনি। আমার দেহ পুড়েছিল এই ঘরের নিচে… আমার সময় থেমে ছিল ঘড়ির কাঁটায়। আমি শুধু অপেক্ষা করেছি… কারও জন্য… যে আমাকে দেখতে পাবে।”

“তুমি আমাকে কেন বেছে নিলে?”

আনামিকা চুপ থাকে। তারপর বলে, “তুমি আমার মতো। তোমার চোখেও সেই একই ক্লান্তি, একই প্রশ্ন—’আমি আসলে কে?’ তুমি জানো না, কিন্তু সময় জানে। আর আমি… আমি সময়েরই ছায়া।”

তখনই ঘরের বাতি নিভে যায়। আয়নার ভিতর আঁধার ঘনীভূত হয়। সায়ন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল—সে দেখতে পায়, রীতার ছায়া আর আয়নার ছায়া মিলে যাচ্ছে। একই ভঙ্গি, একই দৃষ্টি, একই মুখ।

সে ছুটে এসে রীতাকে টানে। “আর নয়! তুমি বেশি গভীরে যাচ্ছো!”

রীতা টলতে টলতে ফিরে আসে। তার ঠোঁট রক্তশূন্য, চোখে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

“সে বলেছে, আমার ভিতর দিয়ে সে বাইরে আসবে না। বরং আমি… আমি যদি চাই, ওর ভিতর দিয়ে ফিরে যেতে পারি।”

সায়নের মুখ ফ্যাকাশে। “মানে?”

“মানে, এই আয়নাটা একমাত্র পথ… যেখানে আমি জানতে পারব, কে আমি ছিলাম… কে ছিল আনামিকা… আর কেন সে কখনও এই বাড়ি থেকে যেতে পারেনি।”

সায়ন কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ আটকে যায়। ঘরের দেয়াল তখন হালকা কেঁপে উঠছে। আয়না আবার নিজের প্রতিফলন ফেরাতে শুরু করেছে—কিন্তু এবার শুধু মুখ নয়, একটা ঘর দেখা যাচ্ছে ভিতরে… সেই পুরোনো স্টোররুম… আর একটা মৃতদেহ… সাদা কাপড়ে মোড়া, যার এক হাতে সেই চুড়িটা।

রীতা ফিসফিস করে, “সে আমায় দেখিয়েছে তার মৃত্যু।”

সায়ন এবার চিৎকার করে ওঠে, “তুমি কিছুই জানো না এই আত্মাদের সম্পর্কে! তারা মৃত, তারা প্রতিশোধ চায়!”

রীতা তাকায়। “সে শুধু চায়… কেউ যেন জানে সে কে ছিল। সে কখনও খুন হয়েছিল কি না… সে প্রেম করেছিল কি না… তার নামে কেউ একটিবার কাঁদেছিল কি না।”

ঘড়ি তো থেমেছে। কিন্তু আয়না? সে তো এখনও চালু।

আয়নার ভিতরে সেই মুখটা আজ স্থির। চোখের দৃষ্টিতে আর কোনও রাগ নেই, নেই আতঙ্ক বা অভিশাপের ছায়া। যেন অপেক্ষা করছিল কোনও শোনার মতো কানে, কোনও এমন হৃদয়ে, যেখানে সে তার অসমাপ্ত গল্প রাখতে পারে—বিনা প্রতিশোধে, বিনা আর্তনাদে, কেবল জানার আকাঙ্ক্ষায়।

রীতা মেঝেতে বসে পড়েছিল আয়নার সামনে। তার হাতের তালুতে রাখা চুড়িটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন কারও শরীরের উষ্ণতা ফেরত এসেছে ধাতব গায়ে। রীতা চোখ বন্ধ করে বলে, “আমাকে দেখাও—তোমার শেষ দিনটা। আমি জানতে চাই। আমি শুনতে চাই।”

আয়নার কাচ কুয়াশার মতো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। তারপর স্পষ্ট হতে থাকে এক দৃশ্য—পুরোনো ঘর, জানালায় হলদে পর্দা, কাঠের আলমারির পাশেই বসে আছে এক তরুণী। তার পরনে সাদা চুড়িদার, কাঁধে খোলা চুল। সে লেখে—ডায়েরির পাতায়, দ্রুত, থেমে থেমে।

তোমার জন্য লিখছি, অরিন্দম। আমি জানি, তুমি আসবে না। চিঠি যাবে না। এই ঘরের ভিতরেই তোমার প্রতিশ্রুতি মরে গেছে। কিন্তু আমি লিখছি, কারণ আমার শব্দগুলো আমায় একা হতে দেয় না। আমার প্রতিটি শব্দ একেকটা কাঁটা, যা আমি নিজেই গায়ে পুঁতে রেখেছি।

তারপর দরজায় টোকা। একজন পুরুষ, সাদা পাঞ্জাবি পরা, চোখে রাগ।
“আবার লিখছিস? এইসব চিঠিপত্র বন্ধ করেছিস না এখনও?”

“ও আমার থেকে কিছু নিতে চায়নি। আমি শুধু তাকে যা দিয়েছি, তাই রেখে গেছে। আপনি যা নিয়েছেন, তা চিরকাল আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন।”

এক চড় পড়ে আনামিকার গালে।

তারপর… ছুরি। ছুরি তার বুকের পাশে। রক্ত পড়ছে মেঝেতে। চুড়িটা খুলে সে জানালার পাশে রাখে। শরীরটা ধীরে ধীরে পড়ে যায় মাটিতে। দরজা বন্ধ হয়। বাইরের আলো নিভে যায়।

ঘরের ভিতর কেউ ঢোকে না। কেউ খোঁজে না। রক্ত শুকিয়ে যায়। আর ঘড়ির কাঁটা তখনও ঘুরছিল—এক দিক থেকে আরেক দিকে—যেন বলছিল, সে ফিরে আসবে।

আয়নার দৃশ্য থেমে যায়।

রীতা চোখ মেলে তাকায়। “তুমি খুন হয়েছো… কিন্তু কেউ তোমার গল্প বলেনি। কেউ তোমার নাম জানে না। আনামিকা—নামহীন।”

সায়ন ধীরে বলে, “তাই সে ফিরে এসেছে। তার হত্যাকারী ধরা পড়েনি। আর তার প্রিয়জন—অরিন্দম—কখনও ফিরেও তাকায়নি। আনামিকা শুধু অপেক্ষা করেছিল, কেউ তাকে তার নামে ডাকবে।”

রীতা উঠে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারো না। কিন্তু আমি তোমার ভেতর দিয়ে যেতে পারি—তোমার হয়ে একটা সত্যি খুঁজতে।”

সায়নের কণ্ঠ কাঁপে, “তুমি কী বলছো?”

“আমি বাংলোর পুরনো নথিপত্র খুঁজব। আমি দেখব, অরিন্দম নামে কেউ ছিল কি না, কোথায় থাকত, আজও আছে কি না। আমি চাই, আনামিকা যেন কেবল আয়নার প্রতিচ্ছবি না হয়—সে যেন ফিরে পায় তার সত্যি, তার পরিণতি।”

সেদিন দুপুরে, রীতা পুরনো টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে খুঁজে পায়—অরিন্দম সেন, বয়স আনুমানিক ৭৫, দক্ষিণ কলকাতার একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। পেশা—সাবেকি লাইব্রেরিয়ান।

রীতা ফোন করে না। সরাসরি চলে যায় সেখানে। বৃদ্ধাশ্রমের একজন কর্মী বলেন, “ওই ভদ্রলোক সারাদিন এক চেয়ারে বসে থাকেন, কিছু লেখেন না, কথা বলেন না। কারও সঙ্গে মেশেন না। কেবল একটা পুরোনো চিঠি নিয়ে বসে থাকেন।”

রীতা ধীরে গিয়ে দাঁড়ায়। চেয়ারে বসে থাকা মানুষটির চোখে ফ্যাকাশে অভিমান। তার হাতে ভাঁজ করা একখানা কাগজ—চিঠি, তির্যক হাতে লেখা কিছু শব্দ। সে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কিছু চিনতে পারে না।

রীতা তার সামনে বসে বলে, “আমি আনামিকার কথা বলতে এসেছি।”

ভদ্রলোকের হাত থেমে যায়। চোখে এক ঝলক আলো।

“তুমি… তাকে চিনো?”

“সে ফিরে এসেছিল। কিন্তু শুধু এই কথাটুকু বলেই ফিরে যেতে চায়নি। সে চায়, আপনি তাকে একবার মনে করুন। তার নামে একবার দুঃখ করুন। কারণ… সে আপনাকে ভেঙে পড়তে দেখেনি।”

অরিন্দমের চোখে জল আসে। “সে একদিন একটা চিঠি লিখেছিল। আমি তা পাইনি। আমার বাবা চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। আমি তাকে খুঁজিনি। আমি coward ছিলাম। আমি জানতাম না, সে মারা গেছে… আমি জানতাম না…”

তার কাঁপা হাতে থাকা কাগজটা এগিয়ে দেয় রীতার দিকে।

“এটা আমি তার জন্য লিখেছিলাম… কিন্তু কখনো পাঠাইনি।”

রীতা কাগজটা হাতে নেয়।

আনামিকা,
তুমি যদি কোনওদিন ফিরে আসো, জেনে নিও, আমি কখনও তোমায় ভোলার চেষ্টা করিনি। আমি শুধু সাহস হারিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ছিলে আমার প্রতিটি বইয়ের পৃষ্ঠা, প্রতিটি নিঃশব্দ লাইব্রেরির নিঃশ্বাসে। এখন, আমি জানি, মৃত্যুর পর যদি কেউ পড়ে থাকে, সে শুধু ভালোবাসা।

রীতা মাথা নিচু করে। “আমি ওকে দিয়ে দেব।”

সে ফিরে আসে বাংলোতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই চিঠিটা কাঁচে রাখে। তারপর বলে, “তুমি এখন যেতে পারো। তুমি শোনা গেছো, জানা গেছো, ভালোবাসা পেয়েছো।”

ঘরের বাতাস হালকা হয়ে আসে। আয়নায় আর কোনও মুখ থাকে না। শুধু তাদের নিজেদের প্রতিবিম্ব—চেনা, নিরাপদ।

ঘড়ি নেই। কাঁটা নেই। আয়নাও নীরব।

আয়নার কাচে এখন আর কোনও প্রতিচ্ছবি তাড়া করে না। সেই মুখ, যার গল্প শেষ করা হয়েছিল, এখন ছায়াহীন। ঘড়িও স্তব্ধ। বাংলো যেন আবার ফিরে পেয়েছে তার প্রাত্যহিক, নিস্তরঙ্গ ছন্দ। পাখিরা আবার বাসা বাঁধছে জানালার কার্নিশে, রোদ ঝরে পড়ছে পুরনো পর্দার ফাঁক দিয়ে। কিন্তু এই নীরবতা অনেকটা কৃত্রিম—যেন ঠিক যেন ঢেউ থেমে গেলেও জলে তলার স্রোত চলতেই থাকে।

রীতা বারান্দায় বসে বই পড়ছিল, সায়নের হাতে তখনো সেই পুরোনো রেজিস্টার, যেটার শেষ দিকের পৃষ্ঠাগুলো সে খুলেই দেখেনি। আনামিকার কাহিনি শেষ হওয়ার পরেও তার মনে হচ্ছিল—এই ঘরটা আরও অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

রেজিস্টারের একেবারে শেষের দিকে ছোট ছোট লেখায় লেখা এক তালিকা—তারিখ, সময়, দিক নির্দেশনা, আর একটা নাম। বেশির ভাগ নাম ইংরেজি হরফে, বেশ কিছু বাংলা নামও আছে। একেকটা নামের পাশে একটি দিক লেখা—East, West, North-East, South-West। সবমিলিয়ে প্রায় চল্লিশটির মতো নাম।

“রীতা, এই নামগুলো দেখেছো তুমি?”—সায়ন টেবিলের ওপর তালিকাটা রাখে।

রীতা তাকায়। “এগুলো কি ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে মিলিয়ে লেখা হয়েছে?”

“ঠিক তাই। প্রতিটি রাতের সময়, প্রতিটি দিক, আর একটা করে নাম—যেন এটা কোনও টানা রেকর্ড, কে কখন ফিরে এসেছে তার হিসাব। কিছু নামের পাশে ছোট করে লেখা—‘Seen on verandah’, ‘Appeared in mirror’, ‘Heard near attic’.

রীতার গলা শুকিয়ে আসে। “মানে, আনামিকার মতো আরও অনেকে ছিল… যাদের কথা কেউ জানত না। যাদের মৃত্যু, ফিরে আসা—সবই এই ঘড়ির সময়চক্রে আটকে ছিল।”

সায়ন ধীরে বলে, “তালিকাটার প্রথম নাম—Hem Chandra Basu, তারিখ ১৮ জুন ১৯৩৫, দিক—North. শেষ নাম—T. Roy, তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮, দিক—South-West। আর তারপর তালিকায় শূন্যতা।”

“মানে এরপর আর কেউ ফেরেনি?”—রীতা জিজ্ঞাসা করে।

“হয়তো রেকর্ড রাখা বন্ধ হয়েছে, বা… কেউ ছিল না লিখে রাখার মতো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—এই তালিকায় একটা নাম আছে, যেটা খুব চেনা। R. Sinha – East – 12 Sept 1961।”

রীতা চমকে ওঠে। “R. Sinha? এটা কি…”

“তোমার ঠাকুরদার নাম না এটা?”

রীতার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। “হ্যাঁ। রতন সিনহা। উনি নিখোঁজ হয়েছিলেন কলকাতার বাইরে একটা কাজে গিয়ে। কেউ কোনওদিন খুঁজে পায়নি… শুধু একটা ব্যাগ ফিরে এসেছিল, তাও ছিন্নভিন্ন অবস্থায়।”

সায়ন কাঁপা গলায় বলে, “তুমি কি ভেবেছো… সে… এই বাংলোতেই এসেছিলেন?”

রীতা চুপ করে যায়। তালিকাটার দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। যেন নামটা তার জীবনের এক হারিয়ে যাওয়া ছায়া—আবার ফিরে এসেছে কেবল টিক টিক শব্দ আর কাগজের কালিতে।

সে ধীরে বলে, “এইবার আমি ওকে খুঁজব। আনামিকার মতো যদি তারও গল্প থেকে যায়, যদি তারও আত্মা কোথাও আটকে থাকে, তাহলে আমাকেই জানতে হবে। আমি প্রস্তুত।”

সেদিন রাত ১২টার দিকে, আয়নার কাচ আবার একটু ঘোলাটে হয়। রীতা সজাগ। সে জানে—এই আয়না এখন সময়ের এক পুলিন্দা, যেখানে শুধু মুখ নয়, শব্দও জমে থাকে। সে আয়নার সামনে বসে।

টিক…
টিক…
টিক…

ঘড়ি ভাঙা। তবু শব্দটা আসে—আর এবার শব্দের সঙ্গে একটি কণ্ঠস্বর।

“Rita… amar jonne kichu korbi?”

রীতার পেছনে কেউ নেই, কিন্তু কণ্ঠটা পরিচিত। যেন শৈশবের অ্যালবাম থেকে ভেসে আসা কোনও মৃদু স্মৃতি।

সে ধীরে জিজ্ঞেস করে, “ঠাকুরদা? আপনি এখানে?”

আয়নার কাচে দেখা যায় একটা অন্ধকার ঘর। একটা কাঠের টেবিল, তার ওপরে রাখা চিঠির বান্ডিল, একটা লাল ফাইল। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ, পাঞ্জাবি পরা, চশমা, কপালে চিন্তার ভাঁজ।

তিনি কিছু বলেন না। কেবল একটা ফাইল খোলেন—তার ভেতরে একটা রেকর্ড, একটা নথি, যেখানে লেখা: Wright Villa – Interview with Indian Intelligence – 1961 – Missing.

রীতা বুঝতে পারে—তার ঠাকুরদা হয়তো এই বাংলোর ইতিহাস জানতে এসেছিলেন। হয়তো কাউকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যান। হয়তো এই বাংলোর অতিপ্রাকৃত ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তিনিও।

সে ফিসফিস করে বলে, “আমি খুঁজব… আপনার চিঠিগুলো, আপনার তথ্য… আপনি যে হারিয়ে যাননি, কেউ সেটা জানবে।”

আয়নার ভিতরের মানুষটা হাসে। এক মুহূর্তের জন্য, রীতার চোখে জল আসে। কিন্তু কণ্ঠস্বর আবার বলে—

“But not all are waiting. Some… are hiding.”

রীতা শিউরে ওঠে। “মানে?”

কাচে এবার এক নতুন মুখ ভেসে ওঠে। সম্পূর্ণ অজানা, হালকা গোঁফ, চোখে কঠিন ছায়া।

“সে কে?”—সায়ন ঘরে ঢুকে পড়ে।

রীতা বলে, “আমি জানি না। কিন্তু তালিকায় তার নাম নেই। হয়তো সে… সেই মানুষদের একজন, যাদের নাম লেখা হয়নি। যারা ফিরে এসেছে ভুলভাবে। যারা এখনও লুকিয়ে আছে।”

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

আয়নার কাচে যে মুখটা ভেসে উঠল, তা ছিল পরিচিত নয়, কিন্তু তার চোখের গভীরতা কেমন যেন কাঁপিয়ে দেয় রীতাকে। তাতে কোনও করুণা নেই, নয় কোনও প্রশ্ন—ছিল কেবল নিঃশব্দ হুমকি। যেন সে জানে, সে কোথায় এসেছে এবং কারা তাকে দেখতে পাচ্ছে।

“তালিকায় নাম নেই,”—সায়ন ধীরে বলে, “মানে সে কখনই ডাক পায়নি। সে নিজে এসেছে। নিজের ইচ্ছায়।”

রীতা ফিসফিস করে, “সে যদি লুকিয়ে থেকেও ফিরে আসে, তাহলে… এই বাংলো কি এখনও মুক্ত হয়নি?”

তারা জানত, আনামিকার গল্প শেষ, রতন সিনহার আত্মা মীমাংসা পেয়েছে, কিন্তু এই নতুন মুখ—এটা ছিল বাইরে থেকে আসা, তালিকার বাইরে, নিয়মের বাইরে। হয়তো এমন কেউ, যে এই ঘড়ির প্রাচীন তান্ত্রিক রীতিকে ব্যবহার করেছিল তার নিজস্ব প্রবেশপথ বানাতে।

রাত্রি বাড়ে। বাতাস থেমে যায়। ঘরের মধ্যে যেন একটি চাপা শব্দ জেগে ওঠে—কোনও চাবির ঘর্ষণ, হয়তো কোনও বন্ধ ঘরের কড়চাড়া।

সায়ন পুরনো রেজিস্টার খুলে দেখে, তালিকার এক পাশে লেখা—

“If anyone ever appears without direction, without time, without name—close the house. Do not speak. Do not look twice.”

কিন্তু তারা তো দেখে ফেলেছে।

সেই রাতে, বাংলোর বারান্দার সামনের ঝুলন্ত আলোটা দুলতে শুরু করে। জানালার কাচে হাতের ছাপ। বাইরের গাছের ফাঁক গলে একটা ছায়া ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। দরজার নিচে কারা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে—এক সঙ্গে, এক সময়, যেন বহুজনের শ্বাস এক জায়গায় মিশে যাচ্ছে।

রীতা জানে, এবার পালানোর সময় নেই। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি কে? তুমি চাইছো কী?”

আয়নার ভেতর সেই মুখ ধীরে ঠোঁট নাড়ায়—কোনও শব্দ নেই, কিন্তু ঠোঁটের গঠন পরিষ্কার:

“You broke the clock, but not the cycle.”

ঘড়ি ভাঙা মানেই মুক্তি নয়। সে ছিল কেবল একটা ফ্রেম, কিন্তু সময়ের বন্ধন একবার ছিন্ন হলে, তার ভেতর দিয়ে যা চলে আসে, তা আর নিয়ম মানে না।

রীতার মনে পড়ে যায় ঘড়ির পেছনের কাঠামোতে থাকা গোল চিহ্ন—চক্রের ভেতরে দিকচিহ্ন। আর এবার সে বুঝতে পারে—চক্রের বাইরে ছিল আরও এক রেখা, ছোট, দুর্বল, যা তারা উপেক্ষা করেছিল। সেই রেখাটাই ছিল unnamed souls—যাদের নাম কেউ কোনওদিন লেখেনি। তাদের দরজা ছিল না, কিন্তু ফাটল ছিল।

সায়ন বলে, “এই আয়নাটা আর রাখা যাবে না। এখন এটা শুধুই একটা প্রতিফলক নয়, এটা একটা উৎস। একবারেই বন্ধ করতে হবে।”

তারা আয়নাটা খুলে ফেলে দেয় বারান্দার মেঝেতে। কাঁচ ভেঙে যায়। কিন্তু কাঁচের ভাঙা প্রতিটি টুকরোয় ভেসে উঠে সেই মুখ—ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে, শত প্রতিফলনে ছড়িয়ে পড়া একই চাহনি।

তারা জানে, এই আত্মা ফিরে যাবে না। কারণ সে আসেনি ডাকে, এসেছে তার নিজের ইচ্ছায়।

সায়ন চিৎকার করে, “তুমি কী চাও?”

একটা কাঁচের টুকরোয় জবাব উঠে আসে রক্তমাখা হরফে—“A house. A body. A name.”

সে আশ্রয় চায়।

তারা বুঝে যায়, এই আত্মাকে তাড়ানো যাবে না পুরনো নিয়মে। কারণ সে নিয়মবহির্ভূত। তাকে কেবল একটাই উপায়ে থামানো সম্ভব—নিজের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে। বাংলোকে বন্ধ করতে হবে। ইতিহাসকে মুছে ফেলতে হবে।

রীতা ফিসফিস করে, “এই ঘরটা—এই জমিটা, এই দেয়াল, এই আয়না, এই প্রতিটি নাম—সব পুড়িয়ে দিতে হবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাস থেকে কেউ বাদ পড়ে, সে ফিরে আসবেই। সে আসবে দেহ নিতে, নাম নিতে, সময় নিতে।”

পরদিন ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগেই, তারা পুরো ঘর খালি করে দেয়। তালিকা, নথি, আয়নার কাঁচের টুকরো, আনামিকার চিঠি, রতনের রেকর্ড—সব।

ঘরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রীতা বলে, “আমরা শুধু চলে যাচ্ছি না, আমরা এই ঘরটাকেই শেষ করছি। যেন আর কেউ কখনও ভুল করে এখানে না আসে। যেন আর কেউ ফিরে না আসে নাম ছাড়া।”

আগুন জ্বলে ওঠে। প্রাচীন কাঠের সিঁড়ি চিৎকার করে, দেওয়াল থেকে গড়িয়ে পড়ে ছোপ ছোপ সময়। আয়নার ছায়াগুলো একবার থেমে তাকায়, তারপর মিলিয়ে যায়।

পেছনে দাঁড়িয়ে, সায়ন দেখে—দোতলার সেই ঘড়ির স্থান খালি। শুধু একটা কাঠের দাগ, যেন সেখানে কিছু ছিল—যেটা এখন আর নেই।

আগুনের লেলিহান শিখা গিলে নেয় বাংলোকে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যায় সেই সময়চক্র, যেটা টিক টিক করে ডেকে আনত হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোকে।

পেছন ফিরে না তাকিয়ে তারা হাঁটে—হাঁটে এমন একটা ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে ঘড়ি নেই, আয়না নেই, শুধুই বাস্তব।

কিন্তু বহু দূরে, পুরনো এক দোতলা বাংলোর ধ্বংসস্তূপের নিচে, ছাইয়ের ভিতরে, একটা চুড়ি ধীরে ধীরে গড়াতে শুরু করে।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-08-05-at-3.24.44-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *