সায়ন্তন কর
সন্ধ্যার পর যখন ছায়া গাঢ় হতে থাকে, আর শহরের ধূলোমাখা রাস্তায় একের পর এক বাতাসের সোঁদা স্পর্শ হয়, তখন মা বারান্দায় বসে থাকেন। তাঁর চেহারা যেন শূন্য এক আর্তনাদ, চোখে জল নেই, শুধু একটি অভ্যাস গড়ে উঠেছে—অর্ণবের জন্য অপেক্ষা।
দশ বছর আগে, অর্ণব ছোট্ট ছেলে, মা’কে বলেছিল,
“বড় হবো মা, শহরে গিয়ে চাকরি করব। তোমার কষ্ট আর সহ্য হয় না।”
তার মুখে ছিল প্রত্যয়ের ঝিলিক, মায়ের চোখে ছিল আশীর্বাদের মায়া।
মা হাসি দিয়ে শুধু বলেছিলেন,
“ঠিক আছে, কিন্তু দরজাটা খোলা রাখব রে। তুই ফিরবি একদিন।”
এই কথাটা অর্ণব আজও মনে রেখেছে, মনে রেখেছে মা’র সেই দরজার কথা, যা সেদিন থেকেই খোলা রাখা হয়েছে।
দিন কেটেছে বছরের পর বছর। অর্ণব চলে গেছে শহরে। শুরু হয়েছে এক নতুন জীবন, যেখানে কাজের চাপে তিনি তেমন সময় পান না বাড়ি আসার। মা’র সেই অপেক্ষার দিনগুলো বাড়িতে সবার নজর কাড়ে। পাড়ায় কেউ বলে,
“পাগলি বুড়ি! এত বছর অপেক্ষা কেন?”
কেউ হাসে, কেউ কথা কম বলে। মা শুধু হাসেন, যেন সে হাসিটা তারই শক্তি।
অর্ণবের জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই এসেছে। শহরের কঠোর জীবন, প্রতিযোগিতা, চাপ—সবই ছিল ভিন্ন। কিন্তু সবসময় মনে হতো, মা’র সেই দরজা খোলা রেখেছে তার জন্য এক আশ্রয়।
এক রাতে, অর্ণব ক্লান্ত মনে বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি তার কাঁধে পড়ে, চোখে অনুতাপ ও আফসোস।
“মা…” কণ্ঠে গলদিয়ে উঠলো।
মা চোখ তুলে তাকালেন। মুখে ছিল মৃদু হাসি, সেই আগের মতো মমতা।
“তুই ফিরলি রে?”
অর্ণব হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন, মাথা নিচু করে।
মা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোর জন্যই তো দরজাটা খোলা ছিল…”
এই মুহূর্তটাই যেন ছিল দশ বছরের সব অপেক্ষার প্রতিফলন। মা জানতেন ভালোবাসা কোনো হিসেব চায় না। সে শুধু অপেক্ষা করতে জানে, শুধু ভরসা দিতে পারে।
শহরের রোদের তাপ, মেঘের ছায়া, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো এখন যেন নতুন করে জীবন্ত। অর্ণব বুঝল, সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল মা’র সেই দরজা, যা সবসময় তার জন্য খোলা ছিল।
				
	

	


