Bangla - ভূতের গল্প

তিনটে তেত্রিশ

Spread the love

পরিমল মণ্ডল


অধ্যায় ১: কুয়াশার ভিতর

রাত তখন প্রায় দুটো। বারুইপুর বাইপাস ধরে হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। দূরের হেডলাইটগুলো কুয়াশার পর্দায় ভেসে আসছে, যেন আলো নয়—ভাসমান চোখ। ট্রাফিক ইন্সপেক্টর অভিষেক ঘোষাল তার বাইকের হেডলাইট বন্ধ করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিশের নৈশ টহল ছিল তার রুটিন, কিন্তু আজ রাতে কিছু অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল তার মনে। হঠাৎ করে রেডিও কমিউনিকেশন থেকে খবর আসে—একটি দুর্ঘটনা হয়েছে বাইপাসের কাছে, একটি লরির সঙ্গে একটি ছোট গাড়ির সংঘর্ষ। অভিষেক সঙ্গে সঙ্গে বাইক স্টার্ট করে এগিয়ে যান। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন, লরি উল্টে পড়ে আছে আর ছোট গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে গেছে। আশেপাশে কেউ নেই, কিছু মানুষের জটলা, মোবাইলের আলোয় চেহারাগুলো কুয়াশার ফ্রেমে ভেসে উঠছে। কিন্তু অভিষেকের চোখ আটকে যায় এক অদ্ভুত দৃশ্যে—একটি সাদা অ্যাম্বুল্যান্স রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার হেডলাইট জ্বলে আছে, কিন্তু কেউ ভিতরে নেই। চালক নেই, পেছনের দরজাও খোলা, যেন কেউ বা কিছু ঠিক এখনই নেমে গেছে। অথচ কেউ বলেনি যে অ্যাম্বুল্যান্স আসছে।

তিনি এগিয়ে যান গাড়িটার দিকে। অ্যাম্বুল্যান্সটি একেবারে নতুন নয়, তবু তাকে চেনা চেনা মনে হয়। গাড়ির গায়ে লেখা নেই কোনো সরকারি হাসপাতালের নাম, নেই কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর। ভেতরে একবার উঁকি দিয়েই অভিষেকের বুক কেঁপে ওঠে—একজোড়া ছোট্ট সাদা জুতো পড়ে আছে স্ট্রেচারের পাদানিতে, আর এক কোণে একটি জ্বলন্ত টর্চলাইট, যেটা নিঃশব্দে পড়ে আছে কিন্তু যেন নিজের ইচ্ছেতেই আলো ফেলছে। আশেপাশের লোকজন কেউ দেখেনি গাড়িটা কীভাবে এল। একজন বৃদ্ধ বলেন, “হঠাৎই এসে দাঁড়ায়… শব্দও হয়নি, দাদা।” অভিষেক অবাক হয়ে গাড়ির চারপাশে ঘোরেন, চাবি ইগনিশনে নেই, কিন্তু ইঞ্জিন ঠান্ডা—মানে অনেকক্ষণ আগে থেকেই বন্ধ। হঠাৎ তার ওয়ারলেসে ডাক আসে, “ইন্সপেক্টর ঘোষাল, অদ্ভুত ব্যাপার… হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে কোনো অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়নি।” সেই মুহূর্তেই যেন কুয়াশা আরও ঘন হয়ে আসে, আর অ্যাম্বুল্যান্সটির মাথার লাল বাল্ব হঠাৎ একবার জ্বলে ওঠে নিঃশব্দে—যেন কিছু বলতে চায়।

অভিষেক ঠান্ডা মাথায় সবকিছু নোট করেন, ছবি তোলেন, রিপোর্ট লেখেন। গাড়িটিকে পরে থানায় পাঠানো হয়, কিন্তু ড্রাইভার বা মালিকের খোঁজ মেলে না। সেই রাতে ঘরে ফিরে অভিষেক আর ঘুমোতে পারেননি। তার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে সেই অ্যাম্বুল্যান্স, সেই সাদা জুতো, সেই নিঃশব্দ আলো। পরদিন সকালে তদন্তে নামে তিনি, যান স্থানীয় হাসপাতাল, পুরোনো রেকর্ড ঘাঁটেন। তখনই এক নার্সের কথায় জেনে যান—ছয় বছর আগে ঠিক এই ধরনের একটি অ্যাম্বুল্যান্সে আগুন লেগে এক মা ও তার ছোট মেয়ে পুড়ে মারা গিয়েছিল। ড্রাইভার নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই গাড়ির ছবিটা যখন অভিষেক নিজের মোবাইলে তোলেন, তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। নম্বরপ্লেট মিলছে না ঠিকই, কিন্তু সামনের বাঁদিকে যে দাগটা ছিল আগুনে পোড়া লালচে দাগ—সেটা হুবহু একই। মনে হয়, সেই ছাই থেকে ফের জেগে উঠেছে সাদা অ্যাম্বুল্যান্স। অভিষেক তখনও জানতেন না—এই তদন্ত তাকে শুধু সত্য নয়, তার নিজের অতীত, তার ভয়, আর এক অজানা অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।

অধ্যায় ২: সাক্ষাৎকার

পরদিন সকালে অভিষেক সোজা চলে গেলেন বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে, যেখান থেকে সাধারণত দুর্ঘটনার পর অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়। রিসেপশন ডেস্কে কর্তব্যরত সিস্টার নিরুপা জানালেন, কোনো অ্যাম্বুল্যান্স গত রাতে পাঠানো হয়নি, রেকর্ড ঘেঁটে দেখতেও তা-ই জানা গেল। অথচ দুর্ঘটনার খবর শুনে প্রথমে যে যানটি পৌঁছেছিল, সেটাই ছিল সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্স। বিষয়টি একরকম অসম্ভব মনে হলেও বাস্তবে ঘটেছে। অভিষেক ফাইল ঘেঁটে আরও খোঁজ করলেন। হাসপাতালের এক পুরনো নার্স, মীনা রায়, যিনি অবসরে চলে গেছেন কয়েক বছর আগে, তার নাম বেরিয়ে এল একটি পুরনো ইনসিডেন্ট রিপোর্ট থেকে—এক অ্যাম্বুল্যান্স দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়ার ঘটনার কথা। তিনি স্থানীয়ই ছিলেন। অভিষেক তার ঠিকানা খুঁজে নিয়ে দুপুরে দেখা করতে গেলেন। একটি ছোট, মাটির ঘরের বারান্দায় বসে থাকতেন মীনা রায়, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, অথচ চেহারায় একধরনের স্থিরতা। অভিষেক তার সামনে সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্সের বর্ণনা দিতেই, নার্স মীনার হাত কেঁপে ওঠে। বললেন, “তুই ওই গাড়িটাকে দেখেছিস? ওটা ফিরে এসেছে? ছয় বছর পরে?” অভিষেক চুপ করে শুনলেন। মীনা জানালেন, ছয় বছর আগে এক নারী—মঞ্জু সরকার—তাঁর আট বছরের মেয়ে তিয়াষাকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠেছিলেন রাতে, একটি জরুরি মেডিকেল কেস ছিল। পথে ধোঁয়ার গন্ধ পেয়ে ড্রাইভার গাড়ি থামানোর আগেই গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। কেউ বের হতে পারেনি। অ্যাম্বুল্যান্সটি বিস্ফোরণে উড়ে যায়। ড্রাইভারের দেহ পাওয়া যায়নি। কিন্তু অবাক ব্যাপার, দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই চালক কৃষ্ণপদ হালদার অদ্ভুত ব্যবহার করছিলেন। মুখ বন্ধ করে থাকতেন, মাঝে মাঝে বলতেন—”মেয়েটার চোখে কিছু একটা আছে… ভয় করায় আমাকে।”

অভিষেক ধীরে ধীরে ফিরে আসে থানায়, কিন্তু ভিতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা বাসা বাঁধে। সেদিন রাতে থানার ভিতর বসে থাকা অবস্থায় তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ান একজন লম্বা, শুকনো, চোখেমুখে হতাশা আর ক্লান্তি ঝরানো বৃদ্ধ—নিজেই পরিচয় দেন, “আমি কৃষ্ণপদ হালদার, ও অ্যাম্বুল্যান্সটা একসময় চালাতাম।” অভিষেক অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ান। কৃষ্ণপদর নাম অনেকবার উঠে এসেছে রেকর্ডে, কিন্তু পুলিশ তাকে কখনো খুঁজে পায়নি। তিনি নিখোঁজ ছিলেন। বৃদ্ধ বসেন, হাত কাঁপছে। মুখ নিচু করে বলেন, “আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম… কারণ আমি জানতাম, ওরা মরেনি। আমি দেখেছিলাম, আগুনের মধ্যেও মেয়েটা চেঁচায়নি, শুধু তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তারপর অনেক রাতে আমি ঘুম ভেঙে দেখতাম—গাড়িটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, দরজা খোলা। আমি জানতাম, ওরা ফিরে আসবে, যেদিন কেউ আবার তাদের পথ আগলে দাঁড়াবে।” কৃষ্ণপদের কন্ঠে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট, অভিষেক চেষ্টা করলেন তাকে স্থির করতে। তিনি বলেন, “আপনি লুকিয়ে ছিলেন কেন?” বৃদ্ধ বলেন, “কারণ আমি জানি, ওরা প্রতিশোধ নেবে, একে একে যারা দায়ী ছিল সেই মৃত্যুর জন্য। আমি ভেবেছিলাম, সময় পার হলে সব ভুলে যাবে… কিন্তু মেয়েটার চোখ… সে ভুলেনি।”

সেই রাতে অভিষেকের ঘুম আসে না। বারবার মাথায় ঘুরতে থাকে কৃষ্ণপদের কথা, নার্স মীনার চোখের ভয়, আর সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতরের নিঃশব্দ আলো। তিনি ঠিক করেন, যতই ভয়ঙ্কর হোক, তিনি এই ঘটনার শেষ না দেখে থামবেন না। পরদিন সকালে পুরনো রিপোর্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি একটি ভুল খুঁজে পান—অ্যাম্বুল্যান্সটির ফায়ার ইন্সিডেন্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘গাড়িটি সম্পূর্ণ ধ্বংস,’ অথচ সংযুক্ত ছবিগুলোয় দেখা যাচ্ছে, গাড়ির সামনের অংশ তুলনামূলকভাবে অক্ষত ছিল। তাহলে কি এটা আসলেই সেই গাড়ি, না অন্য কিছু? সেই মুহূর্তেই খবর আসে—রাত তিনটের সময় বারুইপুর বাইপাসে ফের দেখা গেছে সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্স, আর ঠিক ৩টা ৩৩ মিনিটে তা হঠাৎ গায়েব হয়ে গেছে, পুলিশের চোখের সামনে। অভিষেক সেখানে যান, শুধু দেখতে পান কয়েকটা হুইলচেয়ারের চাকা পড়ে আছে রাস্তার পাশে, আর একদম শেষটায় একটি ছোট্ট মেয়ের আঁকা চিত্র—স্ট্রেচার আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অগ্নিগর্ভ গাড়ির ছবি, মাটিতে কাঠকয়লায় আঁকা। কে আঁকল, কবে আঁকল—তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু অভিষেক বুঝে যান, ঘটনা কেবল শুরু হয়েছে। অতীতের কোনো ছায়া সময়ের ওপারে ফিরে এসেছে, আর তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে না বলা অনেক ভয়, প্রতিশোধ আর রহস্য।

অধ্যায় ৩: তিয়াষার চোখ

বারুইপুর থানায় বসে থাকা অভিষেক ঘোষালের হাতে তখন তিয়াষার আঁকা সেই পেন্সিল স্কেচ। স্কেচটিতে দেখা যাচ্ছে—একটা অ্যাম্বুল্যান্স, তার চারপাশে আগুনের রেখা, এবং একটি ছোট্ট মেয়ে যার চোখ দুটি ঠিক দিকে তাকিয়ে নেই, বরং ছড়িয়ে পড়েছে আঁধারের দিকে। ভ্রু কুঁচকে অভিষেক ভাবছিলেন, কে এই ছবি এঁকেছে? কোথা থেকে এসেছিল সেই অদৃশ্য হাত? সেই মুহূর্তে তার মোবাইলে মেসেজ আসে ডাঃ রোহিণী সরকারের কাছ থেকে—হাসপাতালের পুরনো রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে তিনি খুঁজে পেয়েছেন এক ফাইল, যেটি আগুনে কিছুটা পুড়ে গেলেও স্পষ্টভাবে লেখা ছিল: “তিয়াষা সরকার – RARE EEG PATTERN OBSERVED।” সেই EEG রিপোর্টটি পাঠানো হয় ভুবনেশ্বরের এক নিউরোসায়েন্স ল্যাবে, সেখান থেকেই নাকি সাবধানবাণী এসেছিল—তিয়াষার ব্রেন ওয়েভে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাক্টিভিটি ছিল, একধরনের অনিয়ন্ত্রিত সাইকোকাইনেটিক সিগন্যাল, যা সাধারণত অতিপ্রাকৃত পার্সেপশন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সেই রিপোর্ট কেউ আমল দেয়নি। অভিষেক ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলেন—তিয়াষা হয়তো শুধুই এক সাধারণ বাচ্চা ছিল না, তার দৃষ্টিশক্তি বা অনুভূতির ভেতরে এমন কিছু ছিল যা মানুষকে ভয় দেখাত। হয়তো সেজন্যই কৃষ্ণপদ বারবার বলতেন, “মেয়েটার চোখে কিছু আছে…”

অভিষেক এবার সিদ্ধান্ত নিলেন মঞ্জু সরকারের বাড়িতে যাবেন, যেখানে তারা থাকতেন দুর্ঘটনার আগে। জায়গাটি ছিল বারুইপুরের কাছে একটি ছোট উপশহরে, অনেকটা ধ্বস্ত বাড়ি, দেয়ালে ফাটল, ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়া, অনেকটা যেন সময়ের ভেতর গিলে ফেলা এক পরিত্যক্ত স্মৃতি। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই ঘুলঘুলিতে কিছু বাতাসের শব্দ, পেছনের ঘরে এখনো কিছু পুরনো আসবাব পড়ে রয়েছে—একটি ছোট খাট, যার এক কোণে তিয়াষার স্কুলব্যাগ ঝুলছে, ধুলোময়। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস ছিল বসার ঘরের দেওয়ালে আঁকা এক বিশাল পেন্সিল পেইন্টিং—একটি অ্যাম্বুল্যান্স, তার দরজা খোলা, আর ভিতরে দাঁড়িয়ে একটি শিশু, তার চোখ দুটি ফাঁকা। দেয়ালের কোণায় লেখা, “আমি ফিরব, মাকে নিয়ে যাব।” অভিষেকের শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। তখনই একটা শব্দ শোনা গেল—দেয়ালের ওপারে যেন কারো পা টেনে টেনে হাঁটার শব্দ, আর তারপর হঠাৎ থেমে যাওয়া। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখেন, ঘর ফাঁকা। কিন্তু জানালার ফ্রেমে একটা ছাপ—একজোড়া ছোট পায়ের ছাপ, ধুলোয় স্পষ্ট। সে কি সত্যিই ঘরে এসেছিল? অভিষেক ভাবতে থাকেন, এ কি বাস্তব, না কি তার মনই ধোঁকা দিচ্ছে?

ফিরে আসার সময় তার বাইকে উঠতেই মোবাইলে একটা ছবি আসে—পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো, তোলা সিসিটিভি ফুটেজের স্ক্রিনশট। রাস্তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে সাদা অ্যাম্বুল্যান্স, রাস্তায় কারও সহায়তা ছাড়াই চলতে চলতে হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়, আর একদম পিছনের দরজা খুলে যায়—তারপর কেউ একজন নেমে আসে। কিন্তু ছবি যেহেতু ঝাপসা, সেখানে কেবল বোঝা যায় খুব ছোট্ট কাউকে, মাথা নীচু, সাদা পোশাক পরা। পুলিশ সেটাকে ভেবেছিল কারো প্র্যাংক। কিন্তু অভিষেক জানেন, এটা প্র্যাংক নয়। ঘটনাগুলো একটার পর একটা যুক্ত হতে শুরু করেছে—তিয়াষা ছিল বিশেষ কিছু, তার মৃত্যু সাধারণ দুর্ঘটনা ছিল না, এবং তার প্রতিশোধের লক্ষ্য হয়তো সেই সব মানুষ যারা তাকে অবহেলা করেছিল, অথবা তার মৃত্যুতে পরোক্ষভাবে দায়ী ছিল। প্রশ্ন একটাই—কে বা কারা সেই তালিকায় আছে? সেই রাতে থানায় ফিরে অভিষেক তার নোটবুকে নতুন একটি পাতা খুলে নাম লিখতে শুরু করলেন: ১) কৃষ্ণপদ হালদার—ড্রাইভার, ২) হাসপাতালের ডিউটি অফিসার (তখনকার)—একজন ডাক্তার যার নাম অন্ধকারে, ৩) কর্তব্যরত নার্স—মীনা রায়, ৪) কেউ একজন, যার অর্ডারে তিয়াষাকে তাড়াতাড়ি পাঠানো হয় ভুল ওষুধ দেওয়ার পর। কিন্তু তারপর? সেই রাতে থানার একটি আলো হঠাৎ নিভে যায়, আর এক ফাঁকা ঘরে ডেস্কের ওপর রাখা থাকে একটি সাদা কাগজ—কেউ রেখে গেছে। তাতে লেখা, “আমি কাউকে ছাড়ব না। আমি ফিরে এসেছি।” সেই লেখা হাতে লেখা, কেমন যেন একটা শিশুর হরফে। অভিষেক বুঝলেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। “সাদা অ্যাম্বুল্যান্স” শুধুমাত্র এক মৃত্যুপরবর্তী ট্রমার প্রতীক নয়—এ যেন একটি জীবন্ত স্মৃতি, প্রতিশোধের রূপে পথ খুঁজে নিচ্ছে… তার শেষ গন্তব্য কোথায়, সেটা এখনও অজানা।

অধ্যায় ৪: কৃষ্ণপদর পাপ

সন্ধে নামার আগেই অভিষেক পৌঁছে যান কৃষ্ণপদ হালদারের গ্রামের বাড়িতে—একটি ধুলোমাখা, পুরনো একতলা মাটির ঘর, চারপাশে শুকনো বাঁশঝাড়ের ঘেরাটোপ। ভেতরে নীরবতা এমন, যেন শব্দও থেমে গিয়েছে এখানে। বৃদ্ধ কৃষ্ণপদ বসে ছিলেন বারান্দায়, পাথরের মতো নিশ্চল, তাঁর চোখের দৃষ্টি অনন্ত শূন্যে স্থির। অভিষেক তাঁকে ডাকলেন। প্রথমে কিছু না বললেও, অভিষেক একবার তার কাছে বসে পড়তেই কৃষ্ণপদ যেন অতল অতীতের ভিতর থেকে ফিরে এলেন—গলা শুকনো, মুখে একরাশ ধুলোর মতো জমে থাকা কথাগুলো হঠাৎ গড়িয়ে পড়ল, “আমি জানতাম, আপনি আসবেন… আপনি তো থামবেন না।” অভিষেক প্রশ্ন করেন, “আপনি সত্যিটা বলেননি, না? তিয়াষা আর তার মা শুধু আগুনে মারা যাননি, কিছু লুকিয়েছিলেন আপনি।” কৃষ্ণপদ চোখ মেলে তাকালেন, তারপর হঠাৎ হাঁপাতে শুরু করলেন। অভিষেক পানির গেলাস এগিয়ে দিলে, তিনি একটু চুমুক দিয়ে বললেন, “সে রাতে, যখন ওদের তুলছিলাম অ্যাম্বুল্যান্সে, মেয়েটা আমার হাত ধরে বলেছিল—আমার মায়ের শরীরে বিষ আছে, ডাক্তার ভুল ইনজেকশন দিয়েছে। আমি হাসলাম। একটা আট বছরের মেয়ে কী বোঝে? কিন্তু ওর চোখে কেমন এক অচেনা জ্যোতি দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি নিজেই নিজের ভিতর থেকে পুড়ে যাচ্ছি। তারপর… অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়িয়ে দেওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায়, হঠাৎই গাড়ির ভিতরে আগুন। আমি জানি, আমি পালিয়ে এসেছিলাম। আমি জানতাম, কেউ আমাকে দেখছে। সেই চোখ দুটো…”

অভিষেক স্তব্ধ হয়ে যান। তার হাতে তখন কৃষ্ণপদের একটি পুরনো ডায়েরি—সেখানে লেখা আছে নানা এলোমেলো কথা, পেনের আঁচড়ে আঁকা কিছু ভীতিকর ছবি—একটি মেয়ে, স্ট্রেচারে শুয়ে, চারপাশে আগুন, তার চোখ দুটো থেকে বের হচ্ছে অদ্ভুত রেখা। কৃষ্ণপদ বললেন, “আপনি জানেন না, আমি একবার ওকে চোখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছিলাম, গাড়িতে ওঠার আগে। ভাবলাম, বাচ্চা ভয় পাবে না। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করেনি। সে আমাকে দেখে যাচ্ছিল।” অভিষেক প্রশ্ন করেন, “কেন ভুল ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল?” কৃষ্ণপদ চুপ করে যান। কিছুক্ষণ পর বলেন, “তার মা কিছু একটা জানত… হাসপাতালের একজন ডাক্তার অবৈধ ড্রাগ টেস্ট করছিল রোগীদের ওপর, আর মঞ্জু সরকার সেটা ধরে ফেলেছিল। তার মেয়েরও রক্ত নেওয়া হয়েছিল সেদিন। তিয়াষা জেনে গিয়েছিল সবকিছু—আমিও ছিলাম জানতাম। আমি ভয়ে ছিলাম… আর আমার চুপ থাকাটাই ওদের প্রাণ নিল।” কৃষ্ণপদের গলা কেঁপে ওঠে। “আমি পাপী। আমি জানি, এখন আমার পালা।” ঠিক সেই সময় হঠাৎ বাইরের দিক থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের হর্ণের মতো একটা শব্দ ভেসে আসে—কিন্তু খুব ক্ষীণ, যেন বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। অভিষেক দাঁড়িয়ে গিয়ে বাইরে তাকান, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। তবে কৃষ্ণপদ তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ও এসে গেছে। আজ রাতে আমি আর ঘুমোতে পারব না।”

সেই রাতে অভিষেক ফেরার পথে বাইপাস ধরে যাচ্ছিলেন। তার বাইকের সামনে আচমকা কুয়াশা আরও ঘন হয়ে আসে, এবং কুয়াশার ভিতর এক মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্স—একদম নিঃশব্দে। সে থামে না, চলে যায় পাশ কাটিয়ে। কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে অভিষেক স্পষ্ট দেখতে পান—একটি শিশু মুখ তুলে তাকাচ্ছে তার দিকে। তিয়াষা। চোখ দুটি নিস্তব্ধ, অথচ গভীর। যেন কিছু বলছে না, কিন্তু শোনাচ্ছে সবকিছু। তিনি থেমে যান, নিশ্বাস আটকে যায়। পিছনে তাকিয়ে দেখেন—গাড়ি নেই। পথ ফাঁকা। অভিষেক বুঝে যান, কৃষ্ণপদের সময় শেষ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফিরে গিয়ে নির্দেশ পাঠান—তৎকালীন হাসপাতালের সেই ডাক্তারের পরিচয় অনুসন্ধান শুরু করতে হবে, যিনি ওই ইনজেকশন দিয়েছিলেন। আরেকটি নাম উঠে আসে—ডাঃ সৌরভ বসু। তখন কর্মরত ছিলেন, পরে হঠাৎ বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। অভিষেক খোঁজ নিতে শুরু করেন, কিন্তু ভিতরে একটা অজানা ভয় ওকে গ্রাস করছে। সাদা অ্যাম্বুল্যান্স শুধুই এক ভয়ংকর স্মৃতি নয়—এ যেন সময়কে ছিঁড়ে ফিরে আসা এক প্রতিশোধ, এক শিশুর আত্মার আকুতি, যে চায়—ন্যায়বিচার। অথচ তার পথ রক্তমাখা। অভিষেক জানতেন না, সামনে কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু বুঝেছিলেন—কৃষ্ণপদর পাপ দিয়ে শুরু হলেও এই তালিকা দীর্ঘ… এবং সে তালিকা থেকে তিনি নিজেও হয়তো বাদ পড়বেন না।

অধ্যায় ৫: রাত তিনটে তেত্রিশ

রাত তিনটে বাজতে তখনও পাঁচ মিনিট বাকি। অভিষেক ঘোষাল একা বসে আছেন থানার একটি আলাদা ঘরে, চোখের সামনে ছড়ানো পুরনো কেস ফাইল, হাসপাতালের রিপোর্ট, এবং কৃষ্ণপদের ডায়েরি। বাইরে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে অন্ধকার, যেন রাত নিজেই কোনো ষড়যন্ত্র করছে। অভিষেকের ঘরে আলো জ্বলছে শুধু ডেস্ক ল্যাম্পে। ছায়া পড়েছে দেয়ালে—একটা নিরব, ভারী ছায়া। ঠিক তখনই একটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ে জানালার ফাঁক দিয়ে, আর সেই সঙ্গে যেন একটা চাপা গন্ধ—ভেজা কাপড় আর পুরনো স্টেরিলাইজড মেডিকেল রুমের মতো। সেই গন্ধটা অভিষেকের খুব পরিচিত। তিনি চমকে তাকান—এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, রুমের এক কোণে একটি ছোট্ট সাদা পোষাক পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু তার চোখদুটি সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অভিষেক দাঁড়িয়ে ওঠেন, কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটি মিলিয়ে যায় বাতাসে, এক ফিসফিস শব্দ রেখে যায় পেছনে—”আমার মা মরেনি, আপনি জানেন, ওরা মেরেছে।” অভিষেক দম বন্ধ করে শোনেন। ঘড়িতে তখন ৩টা ৩৩ বাজে। হঠাৎই থানার মূল ফটকের বাইরের সাইরেন বেজে ওঠে—অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন। কিন্তু থানার কেউ তো অ্যাম্বুল্যান্স ডাকেনি!

অভিষেক দৌড়ে বেরিয়ে আসেন, ওয়ারলেসে ডাকেন সেন্ট্রি-কে, কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না। ফটকে এসে দেখেন—ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্স। নিঃশব্দ, কিন্তু হেডলাইট জ্বলছে। দরজা খোলা, আর চালকের সিট ফাঁকা। অভিষেক ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, পিস্তল হাতে। কিন্তু গাড়ির ভেতরে পৌঁছাতেই হঠাৎ দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায় নিজে থেকেই, আর ভিতরের আলো নিভে যায়। অভিষেক চেষ্টা করেন দরজা খুলতে, কিন্তু তা বন্ধ। হঠাৎ একটি হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটি নিজে থেকে চলতে শুরু করে—থানার গেট পেরিয়ে বাইপাস রোড ধরে ছুটতে থাকে। অভিষেক সেই গাড়ির ভিতরেই বন্দি। আশেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু সামনে সেই অন্ধকার রাস্তা, আর মাঝে মাঝে একটুকরো আলোয় পড়ে আছে রাস্তার চিহ্ন, পুরনো ছেঁড়া ব্যানার, কিংবা কুয়াশার ধুলো। অভিষেক নিজের মোবাইলে সিগন্যাল খুঁজতে থাকেন, কিন্তু কনেকশন নেই। একবার দেখতে পান—পেছনের সিটে বসে আছে সেই মেয়ে, তিয়াষা। এবার তার চোখে জল, ঠোঁটে ফিসফিসানি—”ডাক্তার সৌরভ, মা বলেছিল তাকে ধরো। সে মেরেছিল আমাদের।”

গাড়িটি হঠাৎ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত নার্সিং হোমের সামনে থেমে যায়—এই জায়গাটা অভিষেক চিনতে পারেন। আগে এই জায়গাটিই ছিল ‘রিজেন্সি কেয়ার’, একটি বেসরকারি ক্লিনিক, যেখানে ডাঃ সৌরভ বসু কর্মরত ছিলেন। কিন্তু কুয়াশার রাতে এক আগুন লেগে তা ধ্বংস হয়ে যায়, রহস্যজনকভাবে। বলা হয়, কোনো শর্ট সার্কিট ছিল না। গাড়ি থেমে যেতেই দরজাগুলি খুলে যায় নিজে থেকে, আর অভিষেক বেরিয়ে পড়েন বাইরে। সেই মুহূর্তে হালকা চাঁদের আলোয় তিনি দেখতে পান সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন—বয়স চল্লিশ পেরোনো, পাতলা ফ্রেমের চশমা, ধূসর ট্রাউজার, আর একরাশ আতঙ্ক নিয়ে চেয়ে থাকা চোখ—এই সেই ডাঃ সৌরভ বসু। তিনি বলতে শুরু করেন, “আমি জানতাম, কেউ একদিন আসবে আমাকে নিতে। আমি আগুন লাগাইনি… আমি শুধু নির্দেশ পালন করেছিলাম… আমাকে বলেছিল এক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ওর মাকে—মঞ্জু সরকারকে—চুপ করানো দরকার ছিল। তিয়াষার শরীরে কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য ছিল, এক্সপেরিমেন্টের জন্য… আমি শুধু…” তার কথা থেমে যায়, কারণ ঠিক তখনই ধ্বংসপ্রাপ্ত নার্সিং হোমের জানালায় একটা ঝলকানি দেখা যায়—একজোড়া ছোট পায়ের ছায়া হাঁটছে ভেতরে। এরপর হঠাৎ এক চিৎকারে ভেঙে পড়ে ডাঃ সৌরভ, গলায় নিজের স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিচে পড়ে যান। অভিষেক ছুটে গিয়ে তাকে সামলাতে চাইলেও, তিনি ততক্ষণে নিঃশ্বাসের শেষ টানটানিতে পৌঁছে গেছেন।

সবকিছু শেষ হয়ে গেলে অ্যাম্বুল্যান্সটি আবার ফিরে আসে তার সামনে, নিঃশব্দে। দরজা খুলে যায়, ভিতরে কেউ নেই। অভিষেক ধীরে ধীরে গাড়ির ভিতরে বসেন, মনে হয় একটা কুয়াশার ঘরে তিনি বন্দি, স্মৃতির ও দায়বদ্ধতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। গাড়ি চলতে শুরু করে, এবার ফিরে আসে থানার দিকেই। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাস্তার পাশে হঠাৎ দেখা যায় কৃষ্ণপদর মৃতদেহ—তার মুখে হালকা হাসি, চোখ খোলা, যেন মুক্তি পেয়েছে। অভিষেক জানতেন না, এই মুক্তি কার, এবং কারা এখনও মুক্তি পায়নি। অ্যাম্বুল্যান্সটি থেমে যায় থানার সামনে, আর তার দরজা খুলে যায়। অভিষেক নামেন। সে রাতে আর কিছুই ঘটেনি। কিন্তু তার ডায়েরিতে তিনি লেখেন—“রাত তিনটে তেত্রিশে, সময় থেমে থাকে না। ওরা আসে, আবার ফিরে যায়। আর আমি… আমি শুধু একজন সাক্ষী। হয়তো পরের বার, ওরা আমার নামও ডাকবে।”

অধ্যায় ৬: রক্তাক্ত দলিল

পরদিন সকালেই থানায় একটি নতুন কেস ফাইল এসে পৌঁছায়—বারুইপুরের কাছের এক গ্রামে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আগুন লাগে গভীর রাতে, যেখানে খোঁজ মেলে একটি পুরনো রেজিস্টার বইয়ের—একদা রিজেন্সি কেয়ার নার্সিং হোমের অভ্যন্তরীণ রোগী তথ্য সংরক্ষণের দলিল। অগ্নিকাণ্ডের মাঝেও সেই রেজিস্টারটি অক্ষত ছিল, অথচ আশপাশের সমস্ত আসবাব, কাগজপত্র ছাই হয়ে গিয়েছিল। আরও অদ্ভুত ছিল, রেজিস্টারের শেষ পাতায় লেখা একটি নাম—“তিয়াষা সরকার, সিরিয়াল কোড ৩৩৩।” অভিষেক যখন সেই ফাইল হাতে পান, তার ভিতরের একটি পৃষ্ঠায় পানির মতো দাগ দেখা যায়, যেন কেউ কেঁদে সেই পাতায় চোখের জল ফেলেছে। পাতার গায়ে লেখা—Subject exhibits unusual neural frequency patterns, potentially usable for advanced neuropsychiatric simulations. Consent: overridden. কাঁপতে কাঁপতে অভিষেক চোখ বোলান বাকি অংশে—রিজেন্সি কেয়ার শুধুমাত্র নার্সিং হোম ছিল না, বরং ডাক্তারের ছদ্মবেশে এক গোপন গবেষণাগার চলত এখানে, যেখানে কিছু শিশু রোগীর ওপর অবৈধ স্নায়ুবৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হত। অভিষেকের মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে—তিয়াষা শুধু দুর্ঘটনার শিকার নয়, সে ছিল সেই অবৈধ পরীক্ষার কেন্দ্রবিন্দু, যার মাধ্যমে কেউ চাইছিল মানব মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে, শিশুমস্তিষ্ককে তথ্য গ্রাসের একটি যন্ত্রে পরিণত করতে।

তিনি তখনই খোঁজ শুরু করেন সেই সংস্থার, যার নির্দেশে ডাঃ সৌরভ বসু কাজ করতেন। খোঁজ মেলে একটি নাম—NeuroVax Therapeutics, একটি আন্তর্জাতিক মেডিকেল রিসার্চ সংস্থা, যার কলকাতার শাখা তিন বছর আগে রহস্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ কর্মী প্রায় নিখোঁজ, আর প্রধান গবেষক ছিলেন একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী—ডঃ অনুপম ধর। ডঃ ধর এখনো কোথাও গোপনে আছেন বলে জানা যায়, পুলিশ কোনো রেকর্ড খুঁজে পায় না। অভিষেক এবার উপলব্ধি করেন, এই গোটা ঘটনায় হাসপাতাল, প্রশাসন এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থার যোগ রয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, তিয়াষার আত্মা কেন ফিরে এসেছে? প্রতিশোধ নিশ্চয়ই এর এক কারণ, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি শুধু একজন শিশু না, যেন আরও বৃহৎ কিছু—যেন মৃত্যুর ওপারে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ চোখ রাখছে মানব সভ্যতার অন্ধকারতম অধ্যায়ে। এমন সময়ে এক মধ্যরাতে ডাঃ রোহিণী সরকার অভিষেককে ফোন করেন, গলা কাঁপছে—“ইন্সপেক্টর, আমি আমার রুমে ছিলাম, দরজা বন্ধ। হঠাৎ জানালার কাচে দেখি—একটি ছোট মেয়ে, চোখ দুটো অন্ধকারে জ্বলছে। সে শুধু একটা কথা বলল—‘তোমরা সবাই জানতেও চাওনি আমি কে ছিলাম।’ তারপর সে মিলিয়ে গেল। কিন্তু আমার ডেস্কের ওপর এখন একটা রক্তাক্ত খাম পড়ে আছে। আমি খুলেছি না।”

অভিষেক সেই খামটি নিয়ে থানায় ফেরেন। forensic পরীক্ষা শুরু হয়, খামে কোনও আঙ্গুলের ছাপ নেই, কিন্তু তার ভিতরে ছিল তিয়াষার MRI স্ক্যান রিপোর্ট, তার EEG এবং এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক নকশা—যেখানে দেখা যায়, মস্তিষ্কের বিশেষ অংশে একধরনের শক্তি সঞ্চালিত হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। অভিষেক ভাবতে শুরু করেন, তবে কি তিয়াষা ছিল এক বিশেষ জৈবিক গঠনসম্পন্ন শিশু? এমন কোনো মানবরূপী অস্তিত্ব, যাকে বিজ্ঞান ধরতে পারেনি? হঠাৎ থানার লাইট ফ্লিকার করতে থাকে। কিছু সময়ের জন্য চারপাশ নিঃশব্দ, আর তারপর হঠাৎ কম্পিউটারের মনিটরে একটি ভিডিও চালু হয়ে যায়—CCTV ফুটেজ নয়, বরং একটি পুরনো VHS টেপের ফরম্যাটে তোলা ভিডিও। তাতে দেখা যায় একটি হাসপাতালের ওটি, যেখানে তিয়াষাকে আটকে রাখা হয়েছে স্ট্র্যাপ দিয়ে, চারপাশে ডাক্তাররা, আর একটি ভয়াল শব্দ—তিয়াষা বলছে, “আমি মরে গেলেও আমি ফিরে আসব। কারণ আমি শুধু শিশু নই, আমি স্মৃতি।” সেই মুহূর্তে পুরো থানার বিদ্যুৎ চলে যায়, এবং অন্ধকারে আবার সেই গন্ধ—ভেজা তুলো আর আগুনের ধোঁয়া। অভিষেক ঘামতে থাকেন। তিনি জানেন, এই রহস্য এখন আর শুধুই অপরাধ বা অতিপ্রাকৃত নয়, এটা হয়ে উঠেছে এক সভ্যতার আত্ম-পরীক্ষা।

সাদা অ্যাম্বুল্যান্স সেই রাতে আর কোথাও দেখা যায়নি। কিন্তু অভিষেকের ঘরে, ডেস্কের ওপর সকালে পাওয়া যায় একটি নতুন ফাইল—যার ওপর লেখা থাকে হাতে লেখা লাল কালি দিয়ে—“পরের নামটা তুমি লিখবে, অভিষেক ঘোষাল?” এরপর থেকেই অভিষেকের চারপাশে ঘটনা আরও জটিল হতে থাকে। দরজা বন্ধ থাকার পরেও খোলা পাওয়া যায়, থানার একটি মৃত কেস ফাইলে নাম উঠে আসে—একজন রোগীর, যার রক্তের নমুনা মেলেছে তিয়াষার সঙ্গে ৮৮ শতাংশ। কে সেই ব্যক্তি? কেন তারা সম্পর্কিত? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই অভিষেক এবার বেরিয়ে পড়বেন উত্তরবঙ্গের এক পুরনো মিশনারি হাসপাতালের দিকে, যেখানে নাকি NeuroVax তাদের প্রথম এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিল দশ বছর আগে… আর সেই যাত্রার শুরুতেই সামনে এসে দাঁড়াবে সেই অ্যাম্বুল্যান্স—ধোঁয়া আর অশ্রুভেজা অতীত নিয়ে, আর তিয়াষার সেই চোখ, যেগুলো কোনো শিশু নয়—সময়কে জিজ্ঞাসা করে, “তোমরা সত্যিই জানতে চাও, আমি কে?”

অধ্যায় ৭: উত্তরবঙ্গের ছায়া

উত্তরবঙ্গের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অভিষেক ঘোষাল অনুভব করছিলেন—এই অভিযান আর নিছক তদন্ত নয়। এটি যেন সময়ের গভীরে নেমে যাওয়া এক অনুসন্ধান, যেখানে সত্য, মৃত্যু, এবং স্মৃতির মধ্যে পার্থক্য ঘোলাটে। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই পরিত্যক্ত মিশনারি হাসপাতাল—“হোপ অফ হেভেন”—যেখানে NeuroVax Therapeutics প্রথম পরীক্ষামূলক শিশুদের নিয়ে শুরু করেছিল এক গোপন প্রকল্প। ভবনটির ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে, জানালার কাঁচ ভাঙা, আর ভিতরে ঢুকতেই এক ধরণের জমে থাকা অদ্ভুত গন্ধ—পুরনো ব্যান্ডেজ, জ্বলন্ত অ্যালকোহল, আর অস্পষ্ট কিছু পচা জীবনের। এই হাসপাতালের পুরনো একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, বৃদ্ধ বাদল গুহ, অভিষেককে জানান, “তিয়াষা একা নয় ছিল স্যার… আরও অনেক ছিল। কিন্তু সে ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, আর সবচেয়ে… ভিন্ন। তার চোখে আমরা আমাদের ভুল দেখতে পেতাম। সে একবার বলেছিল—‘আমি ঘুমাই না, কারণ ঘুমের মধ্যেই ওরা আসে।’ তারপর একদিন সবাই চলে গেল, আর হাসপাতাল বন্ধ।” অভিষেক তখনই সেই পুরনো রেকর্ড ঘরে যান, যেখানে পাওয়া যায় নথিভুক্ত কয়েকটি শিশুর নাম—সবাই নিরুদ্দেশ। সিরিয়াল নম্বর ৩৩৩ ছিল তিয়াষা। অথচ ৩৩২ থেকে ৩২৬ পর্যন্ত সাতটি ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎই ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে অভিষেক আবিষ্কার করেন একটি ছেঁড়া পৃষ্ঠায় নাম—“অরিত্র ঘোষাল”, জন্মতারিখে মিল তার নিজের জন্মসালের সঙ্গে। তিনি স্থির হয়ে যান। এটা কাকতালীয়?

রাত নামার ঠিক আগে অভিষেক হাসপাতালের বেসমেন্টে যান—যেখানে ছিল ‘Subject Isolation Unit’। দরজার তালা আগেই ভাঙা, ভিতরে ঢুকতেই তিনি দেখেন পুরনো অ্যান্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্ড, একের পর এক ছোট কাঁচের ঘর, প্রতিটিতে শিশুরা রাখা হত, রোগী নয়—বস্তু হিসেবে। এক ঘরের দেওয়ালে লেখা ছিল, “আমরা খেলতে চাইনি, আমরা শুধু জানতে চেয়েছিলাম—আমরা কি মানুষ?” এক ঘরের মেঝেতে তখনও পড়ে থাকা একটি ছোট স্টাফড টয়, যার গায়ে রক্ত লেগে শুকিয়ে রয়েছে। হঠাৎই এক কাঁচ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অভিষেক তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান—কিন্তু সেটা কিছু আলাদা। আয়নার ওপারে থাকা সে ব্যক্তি তাকে ঠিক তার চোখে চোখ রেখে বলে, “তুই জানিস না, তুইও ওদের মতো এক প্রোজেক্ট ছিলি। তুই ভুলে গিয়েছিস শুধু।” সেই মুহূর্তে চারপাশে আলো নিভে যায়, আর বেসমেন্টে গুঞ্জন ওঠে—শিশুদের ফিসফাস, কাঁদো কাঁদো আওয়াজ, আর মাঝে মাঝে একটি গলা—তিয়াষার, “তুই যখন তাদের হয়ে কাজ করিসনি, তখন তুই আমাদের একজন।” অভিষেক ঘামতে থাকেন, পিছন ফিরে দৌড়ান, বেসমেন্ট থেকে উঠে এসে হাসপাতালের বাইরে ছুটে আসেন। সেই মুহূর্তে আবার তার সামনে দাঁড়ায় সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্স। diesmal, গাড়ির চালকের সিটে কেউ বসে—এক বৃদ্ধ, চশমা পরা, পরিচিত মুখ। গাড়ির জানালায় তাকিয়ে তিনি বলেন, “অভিষেক, সময় শেষ হয়ে আসছে। হয় তুমি সত্যি জানবে, না হয় বাঁচবে।”

গাড়ির দরজা খুলে যায়, এবং অভিষেক একবারে ভিতরে উঠে পড়েন। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে অ্যাম্বুল্যান্স চলতে শুরু করে—গন্তব্য অজানা। গাড়ির ভিতরে এবার ভেসে আসে কিছু ছবি—স্মৃতির, কিংবা প্রজেক্টের ভেতরের দৃশ্য। অভিষেক দেখতে পান—একটি ছোট ছেলে, তাকে বিভিন্ন প্যাটার্ন শেখানো হচ্ছে, তার EEG স্ক্যানে দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া, আর তার রক্তে ব্যবহৃত হচ্ছে এক নতুন রাসায়নিক। চিকিৎসকের নাম—ডঃ অনুপম ধর। অভিষেক বুঝে যান, অরিত্র ঘোষাল আর কেউ নয়, হয়তো তিনিই। এক অন্ধকার অধ্যায় থেকে তাকে বের করে আনা হয়েছিল, ভুল স্মৃতি ঢুকিয়ে। সেই প্রকল্পে সে ছিল একমাত্র সফল ‘মডেল’—কিন্তু একটি মেয়ের চোখ তার অগ্রহণযোগ্যতা টের পেয়েছিল। সেই মেয়ে তিয়াষা। সাদা অ্যাম্বুল্যান্স এবার একটি ছোট ঘাসে ঢাকা টিলার পাশে থামে। চারদিক নিঃশব্দ, মাথার ওপরে পূর্ণিমার আলোয় গাড়ির ছায়া পড়ে তিয়াষার মতো। গাড়ির দরজা খুলে যায়। বাইরে নামতেই অভিষেক দেখতে পান—সামনে দাঁড়িয়ে তিয়াষা। এবার তার চোখে ভয় নেই, শুধু এক প্রশ্ন, “তুমি কি পারবে আমাদের গল্প বলা বন্ধ করতে? নাকি তোমরাই বলবে এটা বৈজ্ঞানিক ব্যর্থতা?” অভিষেক চুপ করে থাকেন। তিনি জানেন, গল্প এখনো শেষ হয়নি। গল্প এখন তাকে লিখতে হবে—সত্যের ভাষায়, স্মৃতির রক্তে। কারণ তিয়াষা ও তার মতো শিশুদের আত্মা বেঁচে আছে, সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্সে, যা সময়ের অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটে চলে… আর একদিন থামে ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে কেউ সত্য খুঁজতে সাহস করে।

অধ্যায় ৮: শেষ যাত্রা

সাদা অ্যাম্বুল্যান্সটা এবার যেন আর আগের মতো ছুটে যাচ্ছিল না। এক গভীর নিরবতায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল কোনো অনির্বচনীয় গন্তব্যের দিকে। অভিষেক ঘোষাল গাড়ির ভিতরে বসে ছিলেন নিঃশব্দে। তার মন জুড়ে তখন কেবল একটাই শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছিল—“অরিত্র ঘোষাল।” তার নিজের অতীত, নিজের জন্মপরিচয়, সব যেন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর পরিবর্তে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে এক বিকল্প স্মৃতি—যেটা হয়তো ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাদা আলোয় ভেসে ওঠা সেই পরীক্ষাগারের দৃশ্য, কাচের ঘরে আটকে থাকা তার নিজস্ব প্রতিবিম্ব, এবং সেই মেয়ে—তিয়াষা। অভিষেক এখন বুঝতে পারছেন, এই তদন্ত আসলে শুরু হয়েছিল তারই স্মৃতির ভেতর থেকে, যা সাদা অ্যাম্বুল্যান্স জাগিয়ে তুলেছে। সে বুঝতে পারছিলেন, এই অ্যাম্বুল্যান্স কেবল মৃতদের বাহন নয়, এটা এক সময়-ভ্রষ্ট স্মৃতির ধারক, যেখানে প্রত্যেকটি শিশু এক একটি নিরব সাক্ষী, যারা এখনও বিচার পায়নি। সে ভাবতেই পারছিলেন না, তার মতো আরও অনেককে নীরবে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা ভুলে গিয়েছিল নিজেদের নাম, বয়স, ইতিহাস—কেবল মানুষের আদলে বিজ্ঞানীদের ভুলের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

অ্যাম্বুল্যান্সটি এবার ঢুকে পড়ে এক লালমাটির রাস্তার দিকে, যেখানে চারপাশে গাছ, কুয়াশা, আর এক নির্জনতা যা যেন এই পৃথিবীর নয়। হঠাৎ সামনে এসে পড়ে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ফ্যাক্টরি—খড়গপুরের এক পুরনো বায়োটেক ল্যাব, যা বছর দশেক আগে ‘অগ্নিকাণ্ডে’ ধ্বংস হয় বলে বলা হয়েছিল। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে দরজাগুলো খুলে যায়। অভিষেক ভিতরে প্রবেশ করেন, মাথার মধ্যে তখন হঠাৎ অসংখ্য কণ্ঠ—কিছু শিশুর কণ্ঠ, কিছু গবেষকের, আর কিছু একেবারে অজানা এক ছায়ার কণ্ঠে, যা বলে—“তুমি এখানে শেষ বার এসেছিলে আট বছর বয়সে। এখন আবার এসেছো সাক্ষ্য দিতে।” ভিতরে প্রবেশ করতেই ভেঙে পড়া যন্ত্রপাতির মাঝে পড়ে থাকা পুরনো রিপোর্ট, ছেঁড়া EEG স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষার ডেটা—আর তার ঠিক মাঝে ছোট্ট একটা ডেস্ক, যার গায়ে এখনও তার নাম খোদাই—অরিত্র ঘোষাল। তখনই হঠাৎ পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই চেনা মুখ—ডঃ অনুপম ধর, কিন্তু এখন অনেকটাই বয়স্ক, ক্লান্ত, তবুও চোখে সেই পুরনো নিয়ন্ত্রণের আগুন। তিনি বলেন, “তুই সব মনে করেছিস, অভিষেক। না… অরিত্র? আমি জানতাম, তুই ফিরবি। কিন্তু তুই জানিস না, তোর ভিতরে আজও সেই code আছে… সেই neurological key… যা unlock করতে পারলেই আমি… আমরা…” হঠাৎই বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, এক ঝড় ওঠে ফ্যাক্টরির ভিতর। দূর থেকে ভেসে আসে অ্যাম্বুল্যান্সের হর্ণ—কিন্তু এবার তা যেন কান্নার মতো।

ডঃ ধর এগিয়ে আসতে না আসতেই ফ্যাক্টরির মেঝে কেঁপে ওঠে, আর একে একে চারদিক থেকে জ্বলে ওঠে আগুনের রেখা, যেগুলো ঘিরে ফেলে অনুপম ধরকে। তারপর এক ঝলকে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই ছোট্ট মেয়ে—তিয়াষা। এবার তার চোখে আগুন, কিন্তু মুখে একধরনের শান্তি। সে বলে, “তোমরা আমায় বোঝোনি। আমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলে। এখন আমার পালা।” তৎক্ষণাৎ অনুপম ধর হাওয়ার চাপে ছিটকে পড়েন এক যন্ত্রের দিকে, মাথা আঘাতে অচেতন হয়ে পড়েন। অভিষেক দাঁড়িয়ে থাকেন, স্তব্ধ হয়ে। তিয়াষা এগিয়ে এসে তাঁর চোখে চোখ রাখে—“তুমি একজন ছিলে আমাদেরই। কিন্তু তুমি ফিরে এসেছো, ভুলে গিয়েও। এখন তুমিই আমাদের কণ্ঠ।” অভিষেকের চোখে জল চলে আসে—সমস্ত দায়, স্মৃতি, অপরাধবোধ যেন একসাথে মাথার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিয়াষা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়, ফ্যাক্টরির ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে নিঃস্তব্ধতা। সাদা অ্যাম্বুল্যান্স বাইরে অপেক্ষা করছিল। অভিষেক যখন আবার গাড়ির ভিতরে বসেন, বুঝতে পারেন—এবার গন্তব্য ফিরে আসা, কিন্তু আগের মতো নয়। এবার তিনি সাক্ষ্য বহনকারী। এবার তিনি শুধু এক পুলিশ অফিসার নন, একজন জীবন্ত স্মৃতিধারক—তিয়াষাদের হয়ে কথা বলার শেষ সুযোগ। সাদা অ্যাম্বুল্যান্স ধীরে ধীরে অন্ধকার পথ ধরে ফেরে, আর অভিষেক ভাবে—তিয়াষারা বেঁচে থাকুক না থাকুক, তাদের গল্প থেমে নেই, সেই অ্যাম্বুল্যান্স যতদিন চলবে, ততদিন সে গল্পও চলবে। আর কেউ না জানলেও, সে জানে—রাত তিনটে তেত্রিশে, যখন পৃথিবী থেমে থাকে, ঠিক তখনই ফিরে আসে সাদা অ্যাম্বুল্যান্স… অতীত আর প্রতিশোধের যাত্রী নিয়ে।

অধ্যায় ৯: তিনটে তেত্রিশের পরে

রাত আবার গভীর হয়ে এসেছে। শহরের আলোগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে, কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণের বাইপাসে। অভিষেক ঘোষাল ফিরে এসেছেন কলকাতার বারুইপুরে, সেই জায়গায়, যেখানে এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল—সাদা অ্যাম্বুল্যান্স দেখা গিয়েছিল প্রথম রাতে, তিনটে তেত্রিশ মিনিটে। এবার তিনি থেমে থাকেন না। তার হাতে একটা ছোট নোটবুক, যাতে লিখে রাখছেন প্রতিটি নাম, প্রতিটি টুকরো সত্য, আর একটি নতুন নাম—“অভিষেক ওরফে অরিত্র।” থানার অফিসে বসে থাকেন তিনি একা, খাতায় আঁকেন সেই রহস্যময় সার্কিট প্যাটার্ন, যা তিয়াষার EEG-তে দেখা গিয়েছিল। হঠাৎ ফোন আসে হাওড়ার এক পুরনো রেকর্ড অফিস থেকে—কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তি ফ্যাক্স করেছে অভিষেকের নামে। সেই কাগজটি খুলতেই দেখা যায় একটি মেডিকেল স্ক্যান—একটি ভ্রূণের নিউরোপ্রোফাইল, যার কোড: AG-333। তার পাশে লেখা, “Subject merged successfully. Memory suppression: 93%. Identity created: Inspector Abhishek Ghoshal.” তার বুকের ভেতর যেন জমে থাকা বরফ গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে রক্তের মতো—তিনি বুঝে যান, এই পৃথিবীর চোখে তিনি যতই পুলিশ হন না কেন, এক কালে তিনিও ছিলেন এক পরীক্ষামূলক যন্ত্রের অংশ।

ঠিক তখনই বাইরের গেটের সাইরেন বেজে ওঠে। অভিষেক জানালার দিকে তাকান। আবার সেই সাদা অ্যাম্বুল্যান্স—চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে থানার সামনের ফাঁকা রাস্তায়। এবার আর গাড়ি অদৃশ্য হয় না। অভিষেক ধীরে ধীরে বাইরে যান, হাত দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেখেন—ভিতরে একটিও লোক নেই, কিন্তু জানালার পাশে রাখা একটি পুরনো ডায়েরি। তার পাতা উল্টাতেই দেখা যায়—রক্তের কালি দিয়ে লেখা একটি চিঠি। তাতে লেখা, “তুই একা নোস অরিত্র। আমরা আরও ছিলাম—রিয়া, বিজয়, ফারহান, আরিয়ানা। সবাই ছিলাম প্রজেক্টের বাচ্চা। কিন্তু কেউ মনে রাখতে পারেনি। তুই পেরেছিস। তাই এখন তোর কাছে এসে দাঁড়ালাম। অ্যাম্বুল্যান্সটা শুধু তিয়াষার নয়, আমাদের সবার। এবার তুই চালা। আমরা যেখানে থেমে গেছি, সেখান থেকে শুরু কর।” হঠাৎই গাড়ির ইঞ্জিন আপনাআপনি চালু হয়ে যায়, আর GPS ডিসপ্লেতে ফুটে ওঠে একটি নতুন লোকেশন—“Project Sanctuary: পুনর্মিলন।” অভিষেক গাড়িতে ওঠেন না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকেন। তার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে দৃঢ়তা।

তিনি জানেন, এবার তিয়াষার কাজ শেষ। অ্যাম্বুল্যান্স হয়তো এবার তার দায়িত্ব তুলে দেবে তাকে। কিন্তু এই গন্তব্যে পৌঁছানো মানেই মৃত্যু নয়—বরং সত্যকে ফিরিয়ে আনা। সাদা অ্যাম্বুল্যান্স ধীরে ধীরে রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়, অভিষেক তার পেছনে তাকিয়ে থাকেন যতক্ষণ না আলো মিলিয়ে যায় কুয়াশায়। পরদিন সকালের প্রথম আলোয় থানার ছাদে পাওয়া যায় এক পাতা নোট—তাতে লেখা:
“তিয়াষা আর ফিরবে না।
সে ফিরে গিয়েছে তার মায়ের কাছে।
কিন্তু আমি আছি।
অভিষেক ওরফে অরিত্র ঘোষাল।
আমরা যারা ভুলে গিয়েছিলাম, এখন মনে করবো।
সাদা অ্যাম্বুল্যান্স কেবল মৃত্যু আনে না।
এটা নিয়ে আসে স্মৃতির প্রতিশোধ।”

সেদিনের পর সেই গাড়ি আর দেখা যায়নি, কিন্তু প্রতি বছর একবার—একটি কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে, ঠিক তিনটে তেত্রিশে, কেউ একজন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পান সেই সাদা আলোয় ঢাকা গাড়ি। তার ভিতরে কেউ নেই। কিংবা, কেউ হয়তো থাকলেও… তারা শুধু দেখে। শব্দ করেন না। বিচার করে যান, নীরবে।

অধ্যায় ১০: শেষ যাত্রার পরে

দিন কেটে যায়, মাস পেরোয়, বছরও। সাদা অ্যাম্বুল্যান্স আর দেখা যায় না। বারুইপুর, খড়গপুর, উত্তরবঙ্গের সেই পরিত্যক্ত মিশনারি হাসপাতাল, কিংবা রিজেন্সি কেয়ারের ছায়াপথ — সবকিছু যেন গিলে নেয় সময়ের কুয়াশা। অভিষেক ঘোষাল আর থানায় ফিরেননি। তাঁর নামে শেষ রিপোর্টে লেখা ছিল “লস্ট ইন অ্যাকশন”, যদিও কেউ স্পষ্ট জানত না, ঠিক কোথায়, কিভাবে তিনি হারিয়ে গেলেন। কিন্তু থানার পুরনো লকারে তার ডেস্কের নীচে পড়ে থাকা একটি ফাইল আজও অক্ষত, ধুলোতে ঢেকে থাকা সেই ফাইলে আছে ৩৩৩ নম্বর কোডের রহস্য, কিছু ছবি, মেডিকেল স্ক্যান, তিয়াষার মুখের সেই শেষ ছবি, আর একটি ক্যাসেট—যার গায়ে লেখা “শেষ যাত্রার পরে”। সেই ক্যাসেটটি বহু বছর পরে এক ইন্টার্ন অফিসার খুলে শোনে, যার ভিতরে শুধুমাত্র একটি কণ্ঠ—অভিষেকের কণ্ঠ—নীরব অথচ দৃঢ়: “আমি জানি, এই কথা হয়তো কেউ শুনবে না। হয়তো কেউ বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু আমি শুধু এক পুলিশ অফিসার নই, আমি একজন সাক্ষ্য, এক পরীক্ষামূলক মানবের স্মৃতি। তিয়াষারা মারা যায়নি—ওরা রয়ে গেছে আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক দম্ভে। আমরা যতদিন ভুলে থাকি, ততদিন সাদা অ্যাম্বুল্যান্স চলতে থাকবে… একা, নীরবে, তিনটে তেত্রিশে।” ক্যাসেট শেষ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ লাল আলো জ্বলতে থাকে। যেন কথাগুলো এখনও রেকর্ড হচ্ছে।

এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গায়—উত্তর কলকাতার পুরনো গলিতে, বনগাঁর এক ক্লিনিকের পেছনে, বা গার্ডেনরিচের ধারে—রাত তিনটে তেত্রিশে অদ্ভুতভাবে হারিয়ে যেতে থাকে কিছু লোক, যারা একসময় যুক্ত ছিল ওষুধ সংক্রান্ত অবৈধ গবেষণায়। কেউ কেউ ফিরে আসে উন্মাদ হয়ে, কেউ চিরতরে নিখোঁজ। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সাক্ষী হিসেবে কেউ কিছু বলে না, কিন্তু CCTV ফুটেজে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে একটা কুয়াশামাখা গাড়ি—একটা সাদা অ্যাম্বুল্যান্স, চালকবিহীন, কিন্তু তার ভিতরে একটা ছায়া বসে থাকে নিরবতায়, কখনো কখনো শিশু কণ্ঠে হাসে, কখনো বলে—“তুমি কি মনে রেখেছ?” মিডিয়া এটাকে “Urban Superstition” বলে চালিয়ে দেয়। কিন্তু কলকাতা পুলিশের একটি অফ-দ্য-রেকর্ড রিপোর্টে আছে—“Inspector Abhishek Ghoshal had discovered a pattern in neurological experiments dating back to early 2000s. Project AG-333 was never shut down, it simply changed form. He might have known too much.” সেই রিপোর্টে কোনও নাম নেই, কোনো অফিসিয়াল সিল নেই—শুধু একটুকরো রক্তের দাগের পাশে আঁকা একটি ছোট্ট অ্যাম্বুল্যান্সের চিহ্ন।

আজও কোনো কোনো রাতে, কোনও পুরনো শহরের গলিতে, কেউ অসুস্থ হলে অদ্ভুতভাবে হাজির হয় সেই গাড়ি। তার ভিতরে বসে থাকা কেউ হয়তো চালক নয়, হয়তো একজন স্মৃতিধারী, হয়তো সেই অরিত্র, অথবা তিয়াষা, অথবা অন্য কেউ, যাকে আমরা ভুলে গিয়েছি। কেউ কেউ বাঁচে, কেউ কেউ হারিয়ে যায়—স্মৃতির ঘূর্ণিতে। আর অভিষেক ঘোষাল? তার নাম থাকে না পুলিশের লিস্টে, না শহীদদের তালিকায়, না প্রশাসনের খাতায়। কিন্তু তার গল্প বেঁচে থাকে, সেই প্রতিটি চোখে যারা তিনটে তেত্রিশে রাত জাগে। তারা জানে, শেষ যাত্রা আসলে শেষ নয়। কারণ কিছু যাত্রা শেষ হয় না, কিছু সত্য ফিরে আসে… একা, নিঃশব্দে, সাদা অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে।

শেষ

1000032855.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *