মেঘলা রায়
শিমুলডাঙা গ্রামের আকাশ যেন চিরকাল হালকা সীসের রঙে ঢেকে থাকে। গা ছমছমে নীরবতা এখানে শব্দের চেয়েও বেশি জোরালো। সেই নীরবতার বুক চিরে যে ঘরটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম—রায়চৌধুরী বাড়ি। টালির ছাদ ভেঙে পড়েছে অনেকখানি, জানালার পাল্লাগুলো খসে পড়ে আছে মাটিতে, কিন্তু তবুও সে একটা জীবন্ত শরীরের মতো মনে হয়—চুপচাপ শ্বাস নিচ্ছে, তাকিয়ে আছে।
তিন বছর আগের কথা। অর্ক মিত্র, কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র, গবেষণার খোঁজে এসেছিল এই গ্রামে। বিষয়: ১৯৪০ সালের শেষদিকে গায়েব হয়ে যাওয়া রায়চৌধুরী পরিবারের কাহিনি। কেউ বলে জমিজমা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, কেউ বলে অভিশাপ, কেউ বা বলে—ওই বাড়ির ভেতর একটা পুকুর আছে, যার নিচে নাকি আত্মা ঘুমিয়ে থাকে। অর্ক এসব কাহিনি বিশ্বাস করত না। তার চোখে এসব শুধুই লোককথা, অতিরঞ্জন।
প্রথম দিন গ্রামের বাঁশঝাড় ঘেরা পথ দিয়ে হেঁটে সে পৌঁছেছিল রায়চৌধুরী বাড়ির সামনে। চুন ওঠা দেওয়াল, ঢুকে পড়া আগাছা আর একটা ভাঙা নামফলক—‘রায়চৌধুরী ভবন’। পায়ে পায়ে সে ঢুকেছিল ভেতরে। দরজাটা যেন নিজে থেকেই খুলে গিয়েছিল, কারও অনন্ত ক্লান্তির মত। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘন ঠান্ডা অন্ধকার অর্ককে ঢেকে দিয়েছিল। আলো থাকার কথা নয়, অথচ পেছনের দালানে একফালি হলুদাভ আলো ছায়ার মতো নড়ছিল।
সে সময় অর্ক ভেবেছিল সূর্যের আলো হবে কোনও ছিদ্র দিয়ে ঢুকে আসা। কিন্তু পরে বুঝেছিল—রাত্রে যখন সে বাড়িটা দেখতে গেল, সেই একই আলো দেখা যায়।
একটি হলুদ কাঠবিড়ালির চোখের মত আলো। এক জোড়া।
প্রথম রাতেই অর্ক থাকছিল গ্রামের একটি পুরনো অতিথিশালায়। সেই রাত ছিল কাঁপুনি ধরানো শীতের রাত। লোডশেডিং চলছিল, জেনারেটর চলত শুধু সন্ধ্যে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত। ঠিক সাড়ে দশটার সময়, মশারির ভিতরে বসে লেখালিখি করছিল সে, এমন সময় জানলার বাইরে থেকে একটা আওয়াজ এলো—টিনের ছাদের ওপর কারও নখের আঁচড়!
“চররর… চরররর…”
প্রথমে সে ভেবেছিল বিড়াল হবে। কিন্তু আবার…
“চুড়াং…”
কাচের মত কিছু একটা ভাঙল। এবার অর্ক উঠে দাঁড়াল। হালকা জ্বর ভাব হচ্ছিল, শরীর কাঁপছিল, কিন্তু কৌতূহল তাকে বসিয়ে রাখেনি। দরজাটা খুলে বারান্দায় পা রাখতেই সে অনুভব করল কুয়াশার ভিতর থেকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে। অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছিল না।
পরদিন সকালে সে গেল দয়মণি দেবীর কাছে। প্রায় নব্বই বছর বয়স, চোখে ঝাপসা চশমা, পুকুরপাড়ে একটা খুপরি ঘরে থাকেন। গ্রামে অনেকে বলে ওনার মনে আছে আগের যুগের অনেক কথা। অর্ক প্রশ্ন করল—“আপনি কি রায়চৌধুরী পরিবারকে চিনতেন?”
দয়মণি একটু হাসলেন। সেই হাসি ছিল না স্পষ্ট, যেন মুখে একটা অদৃশ্য পর্দা টেনে রেখেছেন তিনি।
“চিনতুম? উফ্… সেই বাড়ি তো ছিল এক সময় রাজবাড়ি। হেমেন রায়চৌধুরী ছিল দারুণ পাষাণ এক লোক। তবে তার স্ত্রী… মাধবীলতা… অমন সুন্দরী আমি জীবনে দেখিনি। চোখ ছিল কাঠবিড়ালির মতো। একবার তাকালে ভুলতে পারত না কেউ।”
অর্ক চমকে উঠল। কাঠবিড়ালির চোখ?
দয়মণি গলা নামিয়ে বললেন, “শোনো বাবা, সেই বাড়িতে আজও আলো জ্বলে রাতে। লালপাড় সাদা শাড়ি পরে মাধবীলতা হাঁটে, যেই সন্ধ্যে নামে। তবে কেউ তাকালে সে আর মানুষ থাকে না।”
“তাহলে কি আপনি বলছেন, সে এখনও… আছে?”
“আছে, না থাকলে তুমি কুয়াশার ভেতরে এমন করে কাঁপতে পারতে না,” দয়মণি বললেন চোখ বন্ধ করে। “তুমি তো এখন গল্প লেখো, খোঁজ করো। কিন্তু যাদের লেখা হয় না, তারা শুধু থেকে যায় ছায়া হয়ে। বোঝা যায় না, তারা আলো নাকি অন্ধকার।”
সেদিন সন্ধ্যেবেলা অর্ক আবার গেল রায়চৌধুরী বাড়ির দিকে। এইবার সে একটা টর্চ নিয়েছিল সঙ্গে। কিন্তু বাড়ির সামনে পৌঁছেই সে থমকে গেল।
দালানের মাথায়—ভাঙা রেলিংয়ের ধারে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে। নারীর মতো, লম্বা চুল পিঠ ছাপিয়ে নিচে নামছে, লালপাড় সাদা শাড়ি, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল, সেই ছায়া তাকিয়ে আছে তার দিকে।
অর্কর হাত ঠান্ডা হয়ে গেল।
হঠাৎ সেই অবয়ব ঘুরে ভিতরে চলে গেল—কোনও শব্দ ছাড়া।
অর্ক ভাবল, এ যদি হ্যালুসিনেশন হয়, তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তার বুকের ভেতর যেভাবে কেঁপে উঠল, সে বুঝল—এটা কল্পনা না।
সে ঢুকল বাড়ির ভিতরে।
দরজাটা খোলা ছিল। অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ—পুরনো কাঠ, ধুলো, আর যেন সামান্য মেহেদি পাতার। ভিতরের দেয়ালে আগের সময়ের ছবি, কুয়াশায় ঢাকা মুখগুলো দেখলেই মনে হয়, কারা যেন চুপচাপ তাকিয়ে আছে পেছন থেকে।
সে যখন ডান দিকের ঘরে ঢুকল, তখনই আবার সেই আলো!
একজোড়া হলুদ আলো—আবার সেই কাঠবিড়ালির চোখ!
এবার কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে নয়—সামনেই দাঁড়িয়ে!
তার ঠিক সামনে।
যে আলোটা অর্কর চোখের সামনে জ্বলে উঠেছিল, সেটা নিছক একপ্রকার আলো ছিল না। সেটা ছিল একজোড়া চোখ—নির্বাক, পীতাভ, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে জ্বলে ওঠা দুই বিন্দু আগুন। ঘরের মধ্যে ঢুকে দাঁড়াতেই সে বুঝল, চারপাশ নিস্তব্ধ নয়, বরং নিঃশব্দের মতো শব্দে গুনগুন করছে কিছু—দূরে কোথাও যেন গজলের মতো গলা বেজে চলেছে, অথচ কোনও ভাষা নেই, কোনও সুর চেনা নয়।
অর্কর হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল মেঝেতে। আলো নিভে গেল।
সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে চাইল, কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ। পেছনে ঘুরে সে দরজার দিকে দৌড়তে যাবে—ঠিক তখনই, এক মুহূর্তের জন্য, ঘরের ডানদিকের জানলাটা খুলে গেল নিজে থেকেই। ভেতরে ঢুকল ঠান্ডা বাতাস আর সেই মহিলার গলা—স্পষ্ট নয়, ধোঁয়ার মতো…
“ও… কে… তুমি…?”
অর্ক এক লাফে পেছন ফিরে তাকাল।
কেউ নেই।
কিন্তু জানলা খোলা। বাতাস হাওয়ায় তার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে, আর জানলার পাশে একটা আয়না। ভাঙা, ফাটল ধরা, মরচে পড়া কাঁঠালের কাঠের ফ্রেম। আয়নার মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে গিয়ে সে খেয়াল করল, তার পেছনে যেন একটা মুখ—একটা মহিলা মুখ ভেসে আছে। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়াতেই আবার কেউ নেই।
ভয়, কৌতূহল, গা-চুলকানো সন্দেহ—সব মিলিয়ে মাথার ভেতরটা যেন চাপা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। সে কোনওভাবে দরজাটা গলিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল।
গ্রামের বাতাসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে দাঁড়িয়ে পড়ল গাছের নিচে। এক জোড়া চশমা পড়া মাঝবয়সী লোক দাঁড়িয়েছিলেন পাশের বাড়ির বারান্দায়। তিনি দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি অর্ক মিত্র? কলকাতা থেকে এসেছেন, তাই তো?”
অর্ক ধন্যবাদ জানিয়ে মাথা নাড়ল। লোকটা বলল, “আমি নরেন ভট্টাচার্য। স্কুলের শিক্ষক। শুনেছি আপনি রায়চৌধুরী বাড়ি নিয়ে কিছু গবেষণা করছেন।”
অর্ক এবার বলল, “আপনি কিছু জানেন মাধবীলতা রায়চৌধুরী সম্পর্কে?”
নরেনবাবু একটু থেমে বললেন, “জানতাম না, তবে শুনেছি অনেক। কথিত আছে তিনি গোপনে কবিতা লিখতেন, জানালার ধারে বসে। কেউ তাঁকে দেখেনি, শুধু শব্দ শুনত—কলমের খসখস, কখনও পায়রার ডানার শব্দ, আর এক ধরনের হাসি।”
অর্ক বলল, “আমি জানলায় একটা মুখ দেখেছিলাম। একজন নারী। মুখটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু চোখে কিছু একটা ছিল… বোঝাতে পারছি না।”
নরেনবাবু ঠান্ডা গলায় বললেন, “আপনি জানেন, মাধবীলতা বেঁচে ছিলেন মাত্র একুশ বছর। তারপর একরাতে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। তার আগে শেষবার, বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব ঘরের জানলায় তাকে দেখা গিয়েছিল। ওই ঘরটাকেই বলে ‘মাধবীলতার জানলা’।”
অর্ক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মাথার ভেতর ঘুরছিল সেই চোখদুটো—জ্বলজ্বলে, কাঠবিড়ালির মত। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা তার নাম ধরে ডাকছে। অর্ক কি কোনওভাবে সেই ছায়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে? তার শরীরের রক্ত কি বুঝতে পেরেছে কিছু?
পরদিন সকালে অর্ক গ্রামপ্রধানের কাছে গিয়ে রাজবাড়ির পুরনো খতিয়ান চাইল। চায়ের কাপ হাতে তিনি বললেন, “তুমি কি রেকর্ড খুঁজে মানুষ খুঁজতে এসেছো? শোনো, এখানে যারা ছিল, তারা সবাই নিজেদের মতো করে হারিয়ে গেছে। আর রাজবাড়ি? সেটা এখন আর বাড়ি নয়, একটা ধ্বংসস্তূপ, যার ভেতর ইতিহাস মিশে আছে মাটির নিচে। তবে একটা কথা—রাত দশটার পর তুমি আর সেখানে যেও না। ও বাড়ির জানলাগুলো রাতে নিঃশ্বাস নেয়।”
অর্ক অবাক হয়ে বলল, “জানলা কি নিঃশ্বাস নেয়?”
গ্রামপ্রধান বললেন, “জানলা খুললে ভেতর থেকে হাওয়া আসে, আর জানলা বন্ধ করলে সে হাওয়া ফেরে না। মাধবীলতার ঘরের জানলাটা তো সেই কবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লোকজন বলে, সে জানলা নাকি মাঝরাতে নিজে থেকেই খুলে যায়।”
সে রাতেও অর্ক গেল বাড়িটিতে। এবার তার পকেটে ছিল ক্যামেরা আর রেকর্ডার। পা টিপে টিপে সে ঢুকল সেই ঘরটায়, যেটাকে বলে ‘মাধবীলতার জানলা’।
ঘরটা যেন নিজের মধ্যে কুঁকড়ে বসে ছিল। মেঝের উপরে ধুলো জমে সাদা আস্তরণ হয়ে গেছে। কাচের জানলা সেদিন খোলা ছিল না। কিন্তু মেঝেতে পড়ে ছিল একটা পুরনো কলম, শুকনো মেহেদি পাতার গুঁড়ো, আর একটা ছেঁড়া চিঠি।
চিঠিটা অর্ক তুলে পড়তে লাগল।
“আমি আলোকে ছুঁতে পারি না, আমার শরীরে জ্বালা ধরে। কিন্তু যদি কেউ ভালোবাসে, সত্যি ভালোবাসে, তাহলে হয়তো আমি ফিরে আসতে পারি, জানলার এপারে।”
চিঠিতে কোনও নাম ছিল না। শুধু নিচে লেখা—
“রাত্রি একটায়, যদি জানলাটা খুলে রাখো… আমি আসব।
— ম”
অর্ক জানলা খুলে রাখল।
তারপর সে জানল, অপেক্ষা কাকে বলে।
রাত ঠিক একটা। জানলার পাল্লা খোলা। বাইরের আকাশ চাঁদহীন, তারাগুলো নিভে গেছে যেন, হাওয়ায় হঠাৎ গন্ধ আসে—চন্দনের, ধূপের, কিংবা শরীরের ঘামের। অর্ক বসে আছে কাঠের এক পুরনো চেয়ারে, মাধবীলতার ঘরের ঠিক জানলার মুখোমুখি। চিঠি, কলম, ক্যামেরা আর একটি টেপ রেকর্ডার রেখে দিয়েছে পাশে। বাতাস নিঃশব্দ নয়—তাতে আছে একধরনের গুঞ্জন, যেটা কান দিয়ে ঢুকে মনে জমে।
সেই গুঞ্জনে অর্ক শুনতে পায় পদচিহ্ন। বারান্দার ফাটল ধরে কেউ হেঁটে আসছে। ধীর লয়ে। খয়েরি কাঠের পাটাতনের শব্দ উঠছে—“টুক টুক টুক…” আর সেই শব্দে এক অদ্ভুত নারীত্ব মিশে আছে। যেন কেউ শতাব্দী পেরিয়ে হাঁটছে সময়ের ওপর দিয়ে, বৃষ্টি না পড়লেও শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়ছে ভেজা একটা উপস্থিতি।
অর্কের হাত কাঁপছিল। কিন্তু সে দৃষ্টি সরাল না জানলা থেকে।
এবং, ঠিক সেই সময়… জানলার ওপারে এক জোড়া চোখ।
কাঠবিড়ালির মতো।
জ্বলজ্বলে।
স্থির।
নির্বাক।
অর্ক চেঁচাতে চাইল না। তার ভয় হচ্ছিল শব্দ করলেই সব মিলিয়ে যাবে। সে বসেই থাকল। এবং এবার, সেই চোখদুটো কাছে এগিয়ে এল। খুব ধীরে। যেন জানলা নয়, সেটা জল—আর সে চোখ, জল ভেদ করে সাঁতরে আসছে।
আলো পড়ল মুখে।
একটি মুখ—ধোঁয়ার মতো, অথচ স্পষ্ট।
একটা ঠোঁট—নরম, কিন্তু কঠিন। তার কোণে একটুখানি হাসি, অথচ সে হাসি যেন রক্ত মেশানো শোক। কপালে ছোট্ট টিপ, কপালের ওপরে একটা ছেঁড়া ফুল। চুল গুটানো, শাড়ির আঁচল ভেসে উঠছে হাওয়ায়।
অর্ক দেখল সেই মুখ।
সেই নারী।
মাধবীলতা?
সে জানে না।
কিন্তু সে নারী মুখ তুলে তাকিয়ে বলল—
“আমি একশো বছর ধরে অপেক্ষা করছি।”
শব্দ নয়, মুখে শব্দ ছিল না। কিন্তু অর্ক শুনল। মনে হল বুকের ভিতর থেকে কেউ বলছে কথাগুলো।
“আমার গল্প কেউ লেখেনি। কেউ জানেনি আমি কেন গিয়েছিলাম। তুমি কি লিখবে?”
অর্ক কিছু বলল না।
সে মাথা নাড়ল।
“তবে শোনো,” সেই ছায়ামূর্তি বলল, “তুমি যে জানলা খুলে বসেছো, সেটা শুধু জানলা নয়, এটা আমার শেষ দরজা। তুমি যদি লিখো, তাহলে আমি ফিরে আসব। কিন্তু যদি থেমে যাও… আমি অর্ধেক শরীর নিয়ে কাঁটা হয়ে থেকে যাবো।”
“তুমি কে?” অর্ক এবার জিজ্ঞেস করল গলা শুকিয়ে।
“আমি কেউ নই,” মুখে যেন ঠান্ডা হাওয়া, “আমি সেই, যাকে সবাই ভুলে গেছে।”
সেই মুহূর্তে হাওয়ার তোড়ে জানলার পাল্লা জোরে ভেঙে পড়ল! অর্ক লাফিয়ে উঠল। আলো নিভে গেল টর্চের। চারপাশে একটা শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকার। সে টেবিল থেকে ক্যামেরা তুলে চট করে একবার ফ্ল্যাশ মারল।
চকচক করে উঠল জানলার ধারে একটা চুল এলানো অবয়ব।
আর… মেঝেতে ভেসে উঠল একটা হাতের ছাপ—চুনে লেপা মেঝেতে আঙুলের টান, যেন কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসেছে।
তিন সেকেন্ডের মাথায় সব নিঃশব্দ। আবার নিস্তব্ধ।
অর্ক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গা ঘামছিল, চোখ জ্বলছিল, কিন্তু তার মধ্যে একটা মোহ জমে বসে গেছে।
সে কি ভয় পেয়েছে?
নাকি প্রেমে পড়েছে?
পরদিন সকালে সে ছবিটা ডেভেলপ করল নরেনবাবুর সাহায্যে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট—জানলার ফ্রেম, অন্ধকার পেছনে, আর মাঝখানে মুখের মতো কিছু একটা। অস্পষ্ট, কিন্তু লাবণ্যময়। একটুখানি ঠোঁট দেখা যাচ্ছে—আর যেন এক বিন্দু জল টলমল করছে চোখের নিচে।
নরেনবাবু ছবিটা দেখেই বললেন, “এই… এই তো! এই তো সেই চেহারা! এই ছবি আমি আমার ঠাকুরদার অ্যালবামে দেখেছি। এই মেয়েটা… এ তো মাধবীলতা রায়চৌধুরী!”
অর্ক কিছু বলল না।
সে জানে এখন রাত নামলে সেই জানলা তাকে আবার ডাকবে।
আর তার সামনে দুটো পথ—একটা ইতিহাসের, আরেকটা ধ্বংসের।
অর্কের হাতে যে ছবিটা ছিল, সেটা পুরনো কাগজে ছাপানো মুখের মতো ধোঁয়াল, তবুও চোয়ালের রেখা আর চোখের শূন্য দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল—এই মুখের সঙ্গে কোনো রক্তমাংসের সম্পর্ক নেই, এটা এক শতাব্দী আগের বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া এক আত্মার মুখ।
মাধবীলতা।
নামটা উচ্চারণ করলে গলার ভেতর শুকনো পাতা গড়িয়ে পড়ে যেন। সেই নাম নিয়েই অর্ক গেল গ্রামের পুরনো লাইব্রেরিতে। ভাঙা কাঠের আলমারির ভেতর পুরনো রেজিস্টার খুঁজতে খুঁজতে সে একটি পাতলা খাতা পেল। ধুলো ঝেড়ে খুলতেই, প্রথম পাতায় লেখা—
“এই ডায়েরি যদি কেউ পড়ে, জেনো, আমি আর আমি নই।”
— মাধবীলতা রায়চৌধুরী
অর্কর হাত জমে গেল।
ডায়েরির পাতাগুলো খুব স্পষ্ট নয়। কয়েকটা ছিঁড়ে গেছে, কয়েকটা পাতায় কালি মিশে ছায়ার মতো দাগ। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় শব্দগুলো টিকে আছে, আগুনে পোড়া রেখার মতন—
“হেমেন আমাকে ভালোবাসে না। ওর কাছে আমি একটি কুন্ডলিনী মাত্র—জ্ঞানচর্চার দাসী। আমি তার চোখে নারী নই, একজন ব্যবহারযোগ্য শরীর মাত্র। প্রতিদিন রাতে সে দরজা বন্ধ করে, কিন্তু জানালা খোলা রাখে। আমি সেই জানলা দিয়ে পালাতে চাই।”
অর্ক চোখ বন্ধ করল।
এই মেয়েটি—যে শত বছর আগে লিখেছিল এমন কথা, সে এখনও যেন জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে। গলা শুকিয়ে আসা স্বরে অর্ক ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি আমায় খুঁজছিলে?”
আর তখনই হাওয়ার ঘূর্ণি তুলে একটি কাগজ উড়ে এসে পড়ল তার পায়ের কাছে।
একটা পুরনো চিঠি।
চিঠির খামটা পোকায় কাটা, কিন্তু কালি এখনও ম্লান হয়নি।
**“প্রিয় অচেনা,
তুমি যদি আমার শব্দ শোনো, দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দিও। আমি জানি, কেউ একদিন আসবে, যে কেবল ইতিহাস খুঁজবে না, আমাকে দেখবে—আমার মুখ, আমার দুঃখ, আমার লুকিয়ে রাখা কবিতা। আমি মরিনি, শুধু আটকে গেছি এক বন্ধ জানলার ঠিক পেছনে। যদি তুমি সেই জানলা খুলতে পারো, আমি আবার লিখব, আবার হাঁটব, আবার ভালোবাসব।
— মাধবীলতা”**
অর্ক এই চিঠির নিচে লেখা তার নিজের নাম দেখতে পেল না, কিন্তু মনে হল চিঠিটা ঠিক তাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা।
সেই রাতে আবার সে গেল রাজবাড়িতে।
পকেটে একখানা নতুন খাতা। এইবার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে লিখবে মাধবীলতার গল্প।
ঘরের মধ্যে বসে সে কলম চালানো শুরু করল। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলার ওপারে শালগাছের ছায়া লেগে আছে কাচে। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
“মাধবীলতা,” সে লিখল, “আমি জানি তুমি এখানে আছ। তোমার নামের প্রতিটি বর্ণ আমার ঘাড়ের পাশে নিশ্বাস ফেলে। আমি লিখব, যতক্ষণ না তুমি বলো, ‘থেমো।’”
হঠাৎই এক মুহূর্তের জন্য জানলার ওপারে বিদ্যুৎ চমকাল। অর্ক চোখ তুলে তাকাতেই দেখল—জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী।
চুল ভেজা, শাড়ির আঁচল কাঁধে ঠেসে ধরা, চোখে ধোঁয়ার মতো বিস্তার। কাঁচের ওপারে সে হাত রাখল।
একটা নীলাভ, অস্বাভাবিক হাত।
অর্ক ধীরে ধীরে গিয়ে নিজের হাত রাখল সেই কাচের এপারে। ঠান্ডা, কাঁচের ওপার থেকে যেন ছড়িয়ে আসছে মৃত্যুর হিম।
আর সেই মুহূর্তে কানের কাছে গুনগুন করে উঠল এক স্বর—
“আমার কবিতা পুড়িয়ে দিয়েছিল ওরা। কিন্তু আমার প্রতিটা শব্দ বেঁচে আছে। তুমি যদি সত্যিই লেখো… আমি মুক্ত হব।”
হঠাৎ জানলার কাচে একটা চিড় ধরল।
অর্ক পিছিয়ে গেল।
জানলার ছিটকিনি খুলে গেল নিজে থেকে। জানলার ওপার থেকে ঢুকে পড়ল মাদারির মতন বাতাস, সঙ্গে নিয়ে এল একটা ভাঙা বই—মাধবীলতার কবিতার খাতা!
অর্ক কাঁপা হাতে খুলে দেখল—
প্রথম পাতায় লেখা:
“আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম, সে আমায় লিখেছিল।
আর যে আমায় লিখবে,
সে-ই আমায় মুক্তি দেবে।”
হঠাৎ পেছনে ঘরের দরজা ভেঙে গেল।
অর্ক ঘুরে দাঁড়াতে সাহস পেল না।
তবু সে জানত—পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
মাধবীলতা।
দরজার হুড়মুড় শব্দে অর্কর শরীর জমে গেল। ভেতরের বাতাস যেন জমে উঠেছে, কান পাতলে শোনা যায় তার শিরা দিয়ে রক্ত বইছে না, বরং সময়। সেই সময়, যেটা থেমে গেছে এক শতাব্দী আগে। দরজার ছায়া লম্বা হয়ে ঘরের মেঝে পেরিয়ে এসে থেমেছে তার পায়ের কাছে।
আর ঠিক সেই ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন তিনি।
না, এটা প্রবেশ নয়, যেন সেই ঘরটাই তাকে নিজের ভেতর থেকে জন্ম দিচ্ছে। পুরনো দেওয়ালের ভেতরকার হাওয়ার শিরায় লুকিয়ে থাকা এক নারীর ছায়া—চুপচাপ, ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছেন। প্রথমে পায়ের নুপুরের শব্দ, তারপর শাড়ির ঘসঘস, তারপর হঠাৎ করেই সামনে একটা চেনা অচেনা মুখ।
মাধবীলতা।
চোখে যেন শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা, মুখে সেই লাবণ্য যার আড়ালে চাপা পড়ে আছে অসমাপ্ত পংক্তি, অতৃপ্ত আত্মা। ঠোঁট হালকা নড়ে উঠল, কিন্তু শব্দ বেরোল না। বরং একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে—আতর, পোড়া কাগজ, মেহেদির পুরনো গন্ধ।
অর্ক দাঁড়িয়ে পড়ল, তার হাতে কবিতার খাতা।
“তুমি ফিরেছো?” তার গলা কেঁপে উঠল।
নারীটি চুপ। কেবল ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন অর্কের দিকে।
“তুমি কি মাধবীলতা?” সে আবার জিজ্ঞেস করল।
নারীটি এবার মাথা নাড়লেন।
কিন্তু তার মুখে তখনও কোনও কথা নেই।
অর্ক খেয়াল করল—নারীর ঠোঁটে যেন রক্তের রেখা। চোখের নিচে ম্লান দাগ, যেন বহু রাত না ঘুমোনো মানুষের অভিশাপ। তবু তার সৌন্দর্য, তার ভঙ্গিমা, তার চোখের গভীরতা অর্কর মনে এমন এক আর্তি তুলল, যা কোনও মানুষের নয়—যা একটা সময়ের।
“তুমি চাইছো আমি লিখি?” অর্ক ফিসফিস করে বলল।
নারীটি ধীরে মাথা হেঁট করলেন।
তারপর তিনি এগিয়ে এলেন মাধবীলতার সেই পুরনো জানলার পাশে, যেখান থেকে কবিতার খাতা এসে পড়েছিল আগের রাতে। জানলার গায়ে হাত রাখলেন তিনি। আর সেই মুহূর্তে কাঁচের গায়ে দাগ কাটল তার আঙুল—অদৃশ্য এক লেখার মতো।
অর্ক এগিয়ে এসে পড়তে চেষ্টা করল।
“যাকে তুমি ভালোবাসো, তাকে লেখো না—তাকে বোঝো।”
অর্ক চমকে উঠল। সে জানে, এই নারী মৃত। তবু সে এত স্পষ্ট, এত জীবন্ত, এত বর্ণময়—যেন কোনো সত্ত্বা মৃত্যুকে অস্বীকার করে ঠিক তার অনুভূতির মধ্যেই বসবাস করছে।
“তুমি কি বেঁচে যেতে চাও?” অর্ক প্রশ্ন করল।
মাধবীলতা প্রথমবার কথা বললেন।
“না। আমি শুধু চাই, কেউ আমাকে সত্য করে তোলে। আমি ছিলাম, আমি আছি—এই প্রমাণ নয়। আমি চাই কেউ বলুক, আমি ভুল ছিলাম না।”
তার কণ্ঠে জল ঝরে পড়ার মতো শব্দ।
“হেমেন কি তোমার—”
“প্রশ্ন করো না,” তিনি থামিয়ে দিলেন, “প্রেম ছিল না ওর মধ্যে, ছিল মালিকানা। আমি জানলার পাশে বসে রাতভর লিখতাম, আর সে জানত না আমি কবি। তার কাছে আমি ছিলাম স্ত্রীর শরীর। আমি নিজেকে চিঠিতে লিখে রাখতাম—নিজের কাছে, যেন আমি অন্তত আমাকে ভুলে না যাই।”
অর্কর চোখে জল এসে গেল। সে বলল, “আমি লিখব তোমার কথা। তোমার সমস্তটা। তোমার কবিতা, তোমার ভয়, তোমার জানলা।”
মাধবীলতা এগিয়ে এসে তার গালে হাত রাখলেন।
আর সেই মুহূর্তে, ঘরের দেয়াল কেঁপে উঠল।
জানলা খট করে বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকে।
ঘর নিস্তব্ধ।
মাধবীলতা চলে গেছেন।
অর্ক চুপচাপ বসে রইল কাঠের টেবিলে, তার সামনে খোলা খাতা।
একটি পাতা উড়ে এসে থেমেছে তার হাতে।
মাথা নিচু করে অর্ক দেখল পাতাটায় লেখা আছে:
“যে আমাকে মুক্তি দেবে,
সে নিজেও কখনও মুক্ত হবে না।”
রাত পেরিয়ে ভোর। অর্ক এখনও ঘরের কোণে বসে, চোখের নিচে কালি, ঠোঁট শুকিয়ে ধূসর, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলছে। ঠিক যেমন মাধবীলতার চোখ দেখেছিল—এক জোড়া কাঠবিড়ালির মতো পীতাভ, আগুন জ্বলা চোখ।
তার সামনে খোলা খাতা। কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে সে লিখে চলেছে—মাধবীলতার নাম, তার কণ্ঠস্বর, জানলার গল্প, ছিঁড়ে ফেলা চিঠি, পুরনো পঙ্ক্তি। শব্দগুলো যেন অর্ক নিজে লিখছে না, বরং তার আঙুলে কারও ছায়া বসে গেছে, কারও নিঃশ্বাস গলে পড়ছে কালি হয়ে।
“সে রাতে, আমি জানলাম—আমি আর আমি নই।”
এই বাক্যটা সে লিখে থামল।
তার ডান হাত থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে।
প্রথমে সে ভেবেছিল ধুলো বা ঘষা লেগেছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে টের পেল—তার আঙুলের ডগা হালকা লালচে হয়ে উঠেছে, যেন ভেতর থেকে উত্তাপ আসছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ হুহু করে জ্বলে উঠল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কাঁধের পেছনে একটা শীতল স্পর্শ, অথচ বুকের মাঝখানে জ্বলন্ত তপ্ত পেরেকের মতো কিছু ঠুকে যাচ্ছে।
সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
নিজের চোখে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল—এই চোখ তার নয়।
এ যেন অন্য কারও দৃষ্টি—ধ্বংস, শোক, আর প্রবল এক আকাঙ্ক্ষার।
সে গলায় জল ঢালতে গিয়ে দেখল, কণ্ঠনালিতে একটা দাগ। যেন কেউ চেপে ধরেছিল একদা, অথবা কোনও আগুনের রেখা চিরকালীন দাগ কেটে গেছে।
অর্ক কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কি আমার শরীরে ঢুকছো?”
আর ঠিক তখনই, আকাশের গা দিয়ে আগুনের গন্ধ এলো।
গ্রামের উত্তরে আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়ল।
গ্রামবাসী দৌড়ে গেল দেখবে—একটি পুরনো পুঁথির ঘর, যেটায় বলা হত রায়চৌধুরীদের সংস্কৃত তন্ত্রের কাগজ রাখা ছিল, হঠাৎ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন নেভানোর আগেই ভস্ম।
অর্ক বুঝল, এটা দুর্ঘটনা নয়।
সে লিখছে বলে ইতিহাস জেগে উঠছে।
তবে তার লেখায় যে আগুন আছে, সে আগুন শুধু আলো জ্বালায় না, পোড়ায়ও।
সে আবার গিয়ে বসল তার লেখার টেবিলে। এইবার পৃষ্ঠা খুলতেই চোখে পড়ল—একটা ছেঁড়া বাক্য, যা সে লেখেনি।
“তুমি যত লিখবে, আমি তত ফিরে আসব।
তুমি থামলে, তুমি পুড়ে যাবে।”
অর্ক আতঙ্কে পেছনে তাকাল। কেউ নেই। তবু ঘরে একটা গন্ধ—মাধবীলতার শাড়ির আতর আর পোড়া তামার গন্ধ মেশানো।
তার হাত এবার সত্যিই জ্বলছে। আঙুলের মাথায় তাপ—তবে ব্যথা নেই। বরং একটা অদ্ভুত তৃপ্তি, যেন শরীরের ভিতর থেকে কেউ লিখছে, কেউ কাঁপছে, কেউ আনন্দ পাচ্ছে প্রতিটি শব্দে।
নরেনবাবু দেখতে এলেন বিকেলে। দরজা খুলতেই অর্ক চমকে উঠলেন।
“তোমার গায়ে গন্ধটা কী অর্ক?” তিনি বললেন, নাক কুঁচকে। “এত ধূপধুনো কেউ দেয় নাকি লেখার সময়?”
অর্ক চুপ।
নরেন এগিয়ে এসে খাতাটা দেখলেন।
একটি পৃষ্ঠা খুলে হঠাৎ থমকে গেলেন। তাঁর চোখ স্থির হয়ে গেছে।
তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “এই ভাষা তো সংস্কৃত নয়… কিন্তু এই ছন্দটা… আমি তো এটা পড়েছি পুরনো কাগজে… একবার গ্রন্থাগারে… এ তো মাধবীলতার গদ্য-কবিতা!”
অর্ক হাসল। ঠোঁটে শুকনো কুয়াশার মতো হাসি।
সে বলল, “আমি তো লিখিনি এসব। সে-ই লিখেছে, আমি শুধু হাত দিয়েছি।”
নরেনবাবু চুপ করে গেলেন।
তারপর আস্তে বললেন, “অর্ক… তুমি কতটা গভীরে ঢুকছো জানো?”
অর্ক বলল, “গভীরতায় ভয় নেই। ভয় হল থেমে যাওয়া।”
তার গলা থমথম করছে।
তার দেহের ভিতর এখন আগুন, তার লেখায় আগুন।
সে জানে, সে থামতে পারবে না।
আর হয়তো… সে নিজের মধ্যেই মাধবীলতার হয়ে উঠছে।
সকাল আর রাতের মধ্যে পার্থক্যটা ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল অর্কর চোখে। আলো মানেই এখন আর সূর্যের আলোকচ্ছটা নয়, বরং তার ভেতরের সেই পীতাভ জ্যোতি—যেটা আসছে ভিতর থেকে, যেন মাধবীলতার আত্মার এক টুকরো আলো তার শরীরের গভীরে জ্বলে উঠেছে।
একদিন ঘুম ভেঙে সে দেখল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু সেই চোখ—সে তার নিজের নয়।
দুটি চোখ যেন অতল কোনও অভিশাপ বয়ে নিয়ে এসেছে। ঠোঁট শুকনো, কণ্ঠ স্বর পাল্টে গেছে। এবং সবচেয়ে ভয়ানক, তার লেখার হাতটি যেন আর তার অনুগত নয়। সেই হাত নিজে নিজেই কলম চালাচ্ছে, যেন কেউ অর্কর শরীর ব্যবহার করছে, নিজের ফেলে যাওয়া জীবন আবার জাগিয়ে তোলার জন্য।
সে যেসব পংক্তি লিখছে, সেগুলো তার নিজের নয়। কিন্তু সে বাধাও দিতে পারছে না।
“আমি মরে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি ভুলিনি কীভাবে হাঁটা যায়, কীভাবে লেখা যায়, কীভাবে প্রেম করতে হয়।”
সেই রাতে অর্ক আর নিজে একা ছিল না।
সে যেভাবে বিছানায় বসে থাকল, মাধবীলতার গন্ধ তার ঘরে ছড়িয়ে গেল। সে যেন শাড়ির ভাঁজে আস্তে করে ঢুকে পড়েছে অর্কর বুকের উপর, নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার স্নায়ু।
“তুমি কি আমাকে নিতে চাও?” অর্ক ফিসফিস করে বলল।
জবাব এলো বাতাসে—
“আমি তোমাকে নই, আমার লেখা চাই। তুমি আমাকে গড়ে দাও, আর আমি তোমাকে গড়ে দেব। ততক্ষণ, যতক্ষণ তুমি আমি হয়ে উঠো।”
তারপর সেই চিরচেনা শব্দ—চুড়ির টুংটাং, জানলার খসখস, আর মাধবীলতার পদচিহ্ন বারান্দার ফাটলে।
অর্ক বুঝল, সে এখন শুধুমাত্র লেখক নয়।
সে এখন কাগজ।
তাকে ব্যবহার করে মাধবীলতা নিজেকে ফের নির্মাণ করছে।
গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে—“কলকাতার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। সে রাতদিন একা একা কথা বলে, জানলার দিকে তাকিয়ে হাসে, আবার কাঁদে। রায়চৌধুরী বাড়ির মধ্যে নাকি আলো জ্বলে উঠেছে। আবার!”
নরেনবাবু এসে একদিন বললেন, “তুমি এখানে আর থাকো না, অর্ক। এই বাড়ি তোমার শরীর খাচ্ছে। তুমি লিখতে গিয়ে নিজের ভেতরেই হারিয়ে যাচ্ছো।”
অর্ক হাসল, শুকনো পাতার মতো।
সে বলল, “আমি হারিয়ে যাচ্ছি না, বরং নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। আমি বুঝেছি—মাধবীলতা আমাকে শুধু ব্যবহার করছে না। ও আমাকে নিজের মতো করে গড়ে নিচ্ছে।”
“তুমি কি তাহলে এখন দু’জন?” নরেন জিজ্ঞেস করলেন।
অর্ক এবার মুখ তুলল।
তার চোখ দুটি এক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হল—অথচ সেই অন্ধকারে ছায়া নয়, আলো ফুটে উঠল।
সে বলল, “আমি এখন ছায়ার ভেতর আলো। এবং সেই ছায়া, আমি নিজে।”
রাত্রে সে আবার লিখতে বসে।
এবার সে লেখে নতুন পংক্তি—
“আমি অর্ক নই। আমি মাধবীলতার লেখা দ্বিতীয় জীবন। আমার আঙুলে ওর ভাষা, আমার নিঃশ্বাসে ওর আগুন। আমি পুরুষ নই, নারী নই, আমি শুধু শরীর হয়ে উঠেছি, যার মধ্যে কবিতা ভর করেছে।”
আর তখনই, জানলার ফাঁক দিয়ে ছায়ার মতো ঢুকে পড়ে এক নারীর অবয়ব।
সে অর্কর কাঁধে হাত রাখে।
তবু ঠান্ডা নয়।
গরম।
জ্বলন্ত।
অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, নিজেই নিজের মতো দাঁড়িয়ে আছে অন্যরূপে—সে, অথচ নারীর পোশাকে, চোখে সেই কাঠবিড়ালির মতন দীপ্তি।
দুটো অর্ক।
একটা রক্তমাংসের, অন্যটা ছায়ার শরীর।
কিন্তু কে কাকে গড়ে তুলছে?
কে আর কে নয়?
অর্ক এখন আর রাতদিনে পার্থক্য করে না। সময় যেন তাকে ঘিরে এক গোল পাকানো রেখা, যার শুরু ও শেষ দুটোই এক বিন্দুতে থমকে আছে। সে শুধু লিখছে, লিখে চলেছে এমন সব শব্দ যা সে কখনও জানত না, অথচ প্রতিটা অক্ষর যেন তার জন্মের আগে থেকেই তার ভেতরে ছিল।
তবু কিছু প্রশ্ন তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে—মাধবীলতা সত্যিই কীভাবে মারা গিয়েছিল? কেউ তাকে খুন করেছিল, না কি সে নিজেই…? আর সেই বাড়ির মধ্যে এমন কী আছে, যা শতবর্ষ পরেও তাকে আটকে রেখেছে?
নরেনবাবু একদিন সন্ধ্যায় এসে বললেন, “তুমি রায়চৌধুরী বাড়ির কুয়োর কথা জানো?”
“কুয়ো?” অর্ক ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“হ্যাঁ,” নরেন নিচু গলায় বললেন। “বাড়ির পেছনের বাগানে একটা পাথরের ঘেরা কুয়ো আছে। পুরনো ইতিহাসে বলা হয়, একরাতে সেই কুয়ো থেকে চিৎকার শোনা গিয়েছিল। তারপরই গায়েব হয়েছিল মাধবীলতা।”
অর্ক চুপ করে গেল।
সেদিনই রাত একটায়, হাতে ছোট টর্চ নিয়ে সে গেল সেই কুয়োর দিকে। ঝোপঝাড় পেরিয়ে, শিরশিরে বাতাসের মধ্যে, একটা গোল পাথরের ঘের, যার ওপর শ্যাওলা, আর কিছু ছেঁড়া কাচের টুকরো ছড়িয়ে। যেন কেউ একদিন একসঙ্গে সব ভেঙে ফেলে পালিয়েছিল।
কুয়োর মুখে দাঁড়িয়ে সে নিচে তাকাল।
কোনও আলো নেই। কিন্তু সেই অন্ধকার থেকেও যেন তাকিয়ে আছে কেউ। কোনও গন্ধ নেই, কিন্তু হাওয়ায় একটা চাপা কান্নার ধ্বনি। অর্ক হালকা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কি এখানে পড়েছিলে?”
কুয়োর ভেতর থেকে সাড়া এল না।
কিন্তু হঠাৎ টর্চের আলো নিচে ফেলতেই, সে দেখতে পেল—একটা সাদা কাপড়ের টুকরো, নিচে পাথরের পাশে আটকে আছে। আর তার পাশে… একটা ছোট বাক্স।
অর্ক গলা নিচু করে বলল, “তুমি যদি চাও আমি সেটা পাই, তবে ইশারা দাও।”
আর ঠিক তখনই, এক শীতল হাওয়া কুয়োর মুখ ছুঁয়ে তার কানের কাছে ফিসফিস করল—
“আয়…”
অর্ক বুঝল, এটা ডাক নয়, আদেশ।
সে পেছনে তাকাল। কেউ নেই।
তবুও সে দড়ি বেঁধে নামতে শুরু করল। মাটির গায়ে জল, ঠান্ডা ছোঁয়া, দেওয়ালের মাঝে পুরনো কানের দাগের মত চুলের গোছা, নখের আঁচড়। আর একসময় সে নিচে পৌঁছে গেল।
বাক্সটা সত্যিই ছিল। মেটালের ছোট কেস। অর্ক সেটা হাতে নিল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনে একটা শব্দ!
কারও নিঃশ্বাস।
সে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও পারল না। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল, ঘাড়ের নিচে বরফের মতো স্পর্শ।
“তুমি নামলে,” এক কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ল অনন্ত দীর্ঘশ্বাস, “তুমি লিখলে, তাই আমি খুললাম নিজেকে।”
অর্ক তাকিয়ে দেখল—একটা ছায়া, এক জোড়া চোখ, মাধবীলতার মুখ—আবার, কিন্তু এবার যেন আরও গভীর, আরও ঘন।
“এই বাক্সে কী আছে?” অর্ক কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
“আমার মৃত্যুর মুহূর্ত। আমার শেষ কবিতা। আমার কণ্ঠস্বর।”
অর্ক বাক্স খুলে দেখল—একটি চিঠি, একটি পোড়া শাড়ির টুকরো, এবং একটি ছোট হাড়ের খণ্ড।
“এটা কী?” সে ফিসফিস করল।
“আমার জিভ। ওরা কেটে নিয়েছিল। আমি যাতে কথা না বলতে পারি।”
অর্ক চমকে উঠল।
তার হাতে ধরা জিনিসগুলো এখন হালকা কাঁপছে।
“তুমি কি চাও আমি এগুলো নিয়ে বাইরে যাই?”
মাধবীলতা কিছু বললেন না।
তবে কুয়োর দেয়ালে যেন দাগ উঠল—
“যা বলিনি, সেটা এবার লিখে দাও।”
অর্ক মাথা নিচু করে বলল, “আমি লিখব।”
কিন্তু তখনও সে জানত না, সে শুধু মাধবীলতার হয়ে লিখছে না।
সে নিজের মাংস দিয়ে তার ইতিহাস লিখছে।
রাত তখন দেড়টা পেরিয়েছে। কুয়োর ভেজা পাথরের গা থেকে উঠে এল অর্ক, হাতে সেই পুরনো বাক্স। কাঁধ, হাত, হাঁটু ভিজে কাদায় সাদা। পা টিপে টিপে সে রায়চৌধুরী বাড়ির দোতলায় উঠল। মাধবীলতার ঘরে ফেরার সময় তার মনে হচ্ছিল, সে ফিরে আসছে না—বরং যাচ্ছিল সেইখানে, যেখানে সে কখনও ছিল না, তবু তার আত্মা বারবার ফিরে গিয়েছিল।
ঘরের বাতাস ভারী, দরজা বন্ধ। জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে, অথচ চাঁদ নেই। বাতাস নিঃশব্দে কাঁপছে। টেবিলের ওপরে খোলা খাতা, পাশে রাখা কলম—নিজের হাতে নয়, যেন কারও আঙুল ওতে বসে আছে।
অর্ক ধীরে ধীরে বাক্সটা খুলল।
মাধবীলতার পোড়া শাড়ির টুকরো, হাড়ের খণ্ড আর চিঠি।
চিঠিটা এবার সে খুলে পড়ল—
“তুমি কি জানো, শরীর কেবল রক্ত-মাংস নয়?
তুমি কি জানো, স্পর্শেরও ভাষা আছে?
আমার শরীর বলেছিল—‘থামো’।
কিন্তু কেউ শুনেনি।
আমি সেই শরীরকে ফিরিয়ে আনতে চাই।
তুমি কি আমার হয়ে ছুঁতে পারো নিজেকে?”
অর্ক বুঝতে পারল, এই লেখার কাজ এখন আর শব্দ দিয়ে সম্ভব নয়। মাধবীলতা চাইছেন তার ছেঁড়া শরীরের প্রতিটি কোষ ফিরে পাক মানুষের মতো স্পর্শ, চেতন, ভাষা। অর্কর শরীরই এখন সেই পাত্র, যেখানে মাধবীলতা নিজের শরীর গড়ে তুলছেন।
সে আয়নার সামনে দাঁড়াল।
চোখের নিচে কালি। ঠোঁট ফেটে আছে। গলা শুকনো। কিন্তু শরীরের মধ্যে একটা আলো জ্বলছে—অন্ধকারে দগদগে এক আগুন।
হঠাৎ আয়নার কাচ কুয়াশায় ঢেকে গেল।
কুয়াশার মধ্যে আঙুল দিয়ে কেউ লিখছে।
“আমার পেট চিরে রক্ত বেরিয়েছিল।
আমি হাসিনি।
আমি শব্দ করিনি।
কিন্তু আমার শরীর বলেছিল—‘আমি আছি।’”
অর্ক আয়নার সামনে হাত রাখল। আর তখনই আয়নার ওপার থেকে একটা হাত উঠে এল, ছুঁয়ে দিল তার বুক।
সে চোখ বন্ধ করল।
তার শিরদাঁড়ায় হিম নামল। আর সেই ঠান্ডার মধ্যেও সে অনুভব করল—কারও ঠোঁট তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করছে।
“তুমি আমার লেখা লেখো না।
আমার শরীর লেখো।
কীভাবে আমি ছেঁড়েছি, কীভাবে আমি আটকে থেকেছি।
কীভাবে আমার যোনি হয়ে উঠেছিল মৃত্তিকা, আর আমার স্তন ছিল শুধুই ভোগের প্রতীক।
তুমি লিখবে কি, কেমন করে আমার শরীর ‘না’ বলেছিল?”
অর্কর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
সে জানে, সে এখন শুধুই লেখক নয়।
সে এখন শরীর।
সে এখন সেই নারী, যার শরীর মুছে দেওয়া হয়েছিল নামের নিচে, কাব্যিকতার ছদ্মনামে।
সে লিখতে শুরু করল।
“তার স্তন দুটি কোমল নয়, ছিল জ্বরের মতো।
তার যোনি ছিল আত্মরক্ষার গুহা, যেখানে ঢুকে কেউ কেবল ফিরে যেতে চেয়েছে—শরীর হয়ে নয়, আগুন হয়ে।
সে বলেছিল—আমাকে রেখো না।
আমাকে লেখো।”
ঘরের বাতাস জ্বলতে শুরু করল।
টেবিলের ওপর রাখা কলম নিজে থেকে কাঁপছে।
একটি শাড়ির খণ্ড ধীরে ধীরে উড়তে উড়তে এসে জড়িয়ে গেল অর্কর গলায়।
আর তখন, জানলার ফাঁকে এক শরীর—মাধবীলতা। নগ্ন নয়, অথচ উলঙ্গ।
লজ্জাহীন নয়, অথচ বিদ্রোহী।
তার চোখে লাল রেখা, ঠোঁটে উল্কি, আর স্তনের ওপরে লেখা—
“আমি কথা বলি শরীর দিয়ে।
আমাকে লিখো।”
অর্ক জানে, পরের পাতায় আর শব্দ থাকবে না।
থাকবে শুধুই জ্বলন্ত ছোঁয়া।
ঘরের দরজাটা হালকা খোলা। মাধবীলতার ঘর এখন আর শুধুই এক পুরনো ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপ নয়—এটা এখন এক জীবন্ত শরীর, যার হাড়ে শব্দ জমে থাকে, আর যার গায়ে রক্তের বদলে কালি বয়ে যায়। অর্ক টেবিলের সামনে বসে আছে, সামনে সেই খাতা—পুড়ে যাওয়া পাতা, শরীরের পুঞ্জ, কবিতা আর আতঙ্কে জর্জরিত এক ভাষা। তার আঙুল এখন কলমে নয়, আগুনে। প্রতিটি শব্দ মানেই এক জ্বালা, এক প্রলেপ, এক বিদ্রোহ।
সে যখন প্রথম এসেছিল, ভাবেনি তার শরীরেই ইতিহাস লেখা হবে। এখন তার কণ্ঠ স্বর, দৃষ্টি, এমনকি হাঁটার ভঙ্গিমাও বদলে গেছে। আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ভয় লাগে তার, কারণ সে জানে—সে আর কেবল অর্ক নয়।
সেই রাতে জানলা খুলে ছিল। জানলার ওপার থেকে জোছনার আলো নয়, এসেছিল এক স্তব্ধতা, যেটা কান দিয়ে নয়, হাড়ের মধ্য দিয়ে শোনা যায়।
মাধবীলতা দাঁড়িয়ে ছিলেন জানলার গায়ে হেলান দিয়ে। লালপাড় সাদা শাড়ি, ন্যাড়া চুলের পাশে জ্বলছিল ছোট্ট একটা প্রদীপ। তার মুখে কোনও রক্ত ছিল না, তবু সেই মুখ যেন দগ্ধ যৌবনের মুখ।
অর্ক বলল, “তুমি কি এবার যেতে চাও?”
মাধবীলতা কিছু বললেন না। তিনি হাঁটলেন ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে, প্রতিটি পায়ে যেন এক একটা কবিতার পঙ্ক্তি। ঘরের দেয়াল থেকে খসে পড়ল কিছু ধুলো, যেন বাড়িটাও বলছে—তোমার পালা শেষ।
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, “তুমি লিখেছো আমার শরীর, আমার কান্না, আমার চিৎকার। কেউ কোনওদিন লেখেনি এগুলো। তুমি লিখেছো। আমি এখন যেতে পারি। কিন্তু তুমি পারবে তো?”
“পারব না,” অর্ক ফিসফিস করে বলল। “তুমি চলে গেলে, আমি শুনব কাকে?”
মাধবীলতা এগিয়ে এলেন। তার ডান হাতটা অর্কর বাম গাল ছুঁয়ে গেল। ঠান্ডা নয়, গরম নয়, যেন এক স্মৃতি।
তিনি বললেন, “শুনবে তোমার শরীরকে। এখন থেকে তুমিই সেই জানলা—যার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মাধবীলতা, যাদের কেউ কোনওদিন লেখেনি। তোমার কাজ শেষ হয়নি। আমার ইতিহাস তো শুধু আমার ছিল না—ওই কুয়োতে আরও অনেক কণ্ঠস্বর ঘুমিয়ে আছে।”
অর্ক কিছু বলল না।
তিনি একটু ঝুঁকে এলেন। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, চোখে একধরনের স্বস্তি। তিনি বললেন “জানলার ওপারেই জীবন। যতক্ষণ জানলা খোলা থাকে, আমি আছি। জানলা বন্ধ হলেই আমি শুধুই ভূত হয়ে যাব। আমারা চাই না, আমাদের আবার ভূত বানানো হোক।”
সেই মুহূর্তে বাতাস থেমে গেল। মাধবীলতা এক পা এক পা করে হেঁটে গেলেন জানলার দিকে। এবং তারপর, কোনও শব্দ না করে, তিনি কেবল হাওয়ার মতো ভেসে গেলেন… ওপারে।
অর্ক জানে, আর কোনওদিন তিনি ফিরবেন না।
তবু সে জানে, এই ঘরে তিনি থেকে যাবেন।
তার শরীরে।
তার লেখায়।
তার শিরায়।
সকালে, নরেনবাবু এলেন।
দেখলেন, অর্ক আর নেই।
একটা খালি ঘর, জানলা খোলা, বাতাসে একধরনের গন্ধ—শুকনো মেহেদি, পোড়া কালি, আর শরীরের ভেজা ঘ্রাণ।
টেবিলের ওপরে খোলা খাতা।
প্রথম পাতায় লেখা—
**“আমি জানলার পাশে বসে ছিলাম।
আমায় কেউ লেখেনি।
তাই আমি নিজেই লিখতে শুরু করলাম।
জানলার ওপারেই জীবন।”**
নরেনবাবু খাতা বন্ধ করে ফেললেন।
আর জানলা?
সেটা রয়ে গেল খুলে।
যেমন মাধবীলতা চেয়েছিলেন।
যেমন অর্ক লিখে গিয়েছিল।
শেষ