Bangla - ভূতের গল্প

ছায়ার নিচে বাড়ি

Spread the love

শুভ্রনীল দত্ত


পর্ব ১: ফিরে আসা

বাড়িটার নাম মধুবন কোঠি হলেও সেখানে এখন আর মধু নেই, নেই কোঠির আভিজাত্য। কয়েক দশক আগেও যেখানে চিত্রশিল্পীরা আসতেন রং তুলিতে ধরতে তার সৌন্দর্য, এখন সেখানে কেবল ধুলো, ঝোপঝাড় আর খালি জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া সময়।

ঋদ্ধি মেট্রো থেকে নেমে টোটো ধরে পৌঁছাল গ্রামের মোড় পর্যন্ত। বাকিটা হেঁটেই যেতে হবে। এই বাড়িতে সে শেষ এসেছিল আট বছর বয়সে, দাদুর শ্রাদ্ধে। তারপর বাবা-মা বিদেশে চলে গেলে কলকাতায় মামাবাড়িতেই মানুষ হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ের এক কোণে এই বাড়িটা যেন মায়ার মতন আটকে ছিল।

“আপনি ওখানে যাচ্ছেন?”—টোটোচালক একটু থেমে বলেছিল, নাম শুনেই মুখ অন্ধকার।

“হ্যাঁ, মধুবন কোঠি। আমার দাদুর বাড়ি,”—ঋদ্ধি বলেছিল আত্মবিশ্বাসে।

চালক কিছু বলেনি, শুধু গুনগুন করে বারে বারে বলছিল, “বাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে কে থাকে সেটা কে জানে…”

ঋদ্ধির ঝোলা ব্যাগে কিছু পুরোনো চাবি, একটা নোটবুক, আর তার থিসিস প্রজেক্ট—কলকাতার প্রাচীন জমিদার ইতিহাস।

বাড়িটার ফটক আজও আগের মতোই, লোহার তৈরি, কাঁপলে শব্দ করে। ঢুকতেই কেমন একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন গায়ে এসে লাগল, যদিও বাইরে জুন মাসের গরমে তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি।

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই প্রথম চোখে পড়ল—আয়না।

এটা সেই পুরোনো বিশাল আয়না, যেখানে এককালে নাকি দিদিমা সাজতেন। অথচ এবার আয়নায় নিজের ছায়া দেখল না ঋদ্ধি।

সে একটু চমকে উঠে আবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত নাড়াল, কিছুই নেই। আয়নাটা ঝাপসা, ধুলো জমা। সে জামার আঁচলে মুছে নিতে নিতে দেখল—হঠাৎ করেই নিজের প্রতিবিম্ব ফিরে এসেছে।

“হ্যালুসিনেশন,”—ঋদ্ধি নিজেই নিজেকে বলল। “মন মানতে চাইছে না শুধু।”

কিন্তু এরপরই শুরু হয় অদ্ভুত সব ঘটনা।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে যখন সে ঘুমোতে যাচ্ছে, তখন শুনতে পেল দোতলা থেকে ধাপে ধাপে নামার আওয়াজ—ধীর, ভারী পা।

এই বাড়িতে তো আর কেউ নেই! সে এক ঝটকায় দরজার পাশে রাখা টর্চটা নিয়ে বেরোল, কিন্তু উপরের ঘরগুলো খালি। খালি… অথচ মেঝেতে ধুলোর উপর দেখা যাচ্ছে এক জোড়া পায়ের ছাপ।

আর সেই ছাপগুলো সোজা গিয়ে থেমেছে… আয়নার সামনে।

ঋদ্ধি টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠে গেল—আয়নায় এবার দেখা যাচ্ছে না কিছুই। না সে, না পেছনের দেয়াল, কিছুই না। শুধু ঘোলাটে অন্ধকার। আর সেখানে কার যেন মুখ দেখা যাচ্ছে, ভেসে আছে নিঃশব্দে।

“কে?”—সে চিৎকার করল। কেউ উত্তর দিল না। কিন্তু সেই আয়নার ভেতর থেকে যেন একটা নিঃশ্বাস ভেসে এল, ফিসফিস করে বলল—

“ফিরেছিস… ঠিক সময় মতোই।”

ঋদ্ধি ছুটে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার পাশে বসে দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিতে লাগল। ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক ১২:০৫।

পরদিন সকাল। সে ঠিক করল এসব ভয়কে পাত্তা দেবে না। বাড়ির পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে কিছু ছবি, কিছু চিঠি খুঁজতে হবে তার থিসিসের জন্য। একচিলতে লাল রঙের পুরোনো কাপড় মোড়ানো একটা কাঠের বাক্স পেল একটা ঘরের কোণায়।

তাতে লেখা, “রাখালবাবু, ১৯৩১”।

সে খুলে দেখল, ভিতরে কিছু কবিতা, এক নারীর ছবি… আর একটা চিঠি।

চিঠিতে লেখা—

“তুমি যদি ফিরে আ

সো, জানবে আমি এখনও অপেক্ষায়… আয়নার ওপারে।”

পর্ব ২: আয়নার ওপারে

চিঠিটা পড়ার পর ঋদ্ধির গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। কাগজটা পুরোনো, হলদে, তবু কালির দাগ এখনো স্পষ্ট। “তুমি যদি ফিরে আসো, জানবে আমি এখনও অপেক্ষায়… আয়নার ওপারে।”

কে এই চিঠি লিখেছে? কার জন্য? আর ‘আয়নার ওপারে’ বলার মানে কী?

ঋদ্ধি জানত, ওর দাদু, রাখাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আশির দশকের একজন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে পরিবারের ভেতর সবসময় একটা অদ্ভুত নীরবতা ছিল। নাকি গুজব ছিল—শেষ জীবনে উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কেউ কেউ বলত, ওঁর আঁকা শেষ ছবিটা কোনোদিন কেউ দেখতে পায়নি।

ঋদ্ধি সেই বাক্সে থাকা ছবিটার দিকে তাকাল—একটা নারীর মুখ, অসম্ভব সুন্দর কিন্তু চোখে ভয়। সে ছবিটার পেছনে লিখে রেখেছে কেউ একজন, “বনলতা—আমার ছায়া, আমার শাস্তি।”

ঋদ্ধির মাথা ঘুরতে লাগল। কে এই বনলতা? তার দাদুর প্রেমিকা? না কি সেই ‘আয়নার ওপারে’র প্রেত?

সে ঠিক করল—সব কিছু বোঝার আগে বাড়ি ছাড়বে না। ভয় পাওয়ার মানে নেই। সে তো একজন ইতিহাসের গবেষক। অতীতের খণ্ড খণ্ড গল্প জুড়ে দিয়ে তৈরি করতে হবে সত্যি।

সন্ধে নামল। পাখির ডাক কমে এল, আর অন্ধকারের হাতছানি যেন চারপাশ ঘিরে ফেলল। ঠিক তখনই বাড়ির বাইরের বাঁশবনের দিক থেকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে এল। সূক্ষ্ম, নারীকণ্ঠ। যেন কেউ নিঃশব্দে কাঁদছে।

ঋদ্ধি প্রথমে ভাবল ভুল শুনেছে। কিন্তু পরপর তিনবার শোনার পর আর বসে থাকতে পারল না। টর্চ হাতে সে এগোল বাঁশবনের দিকে।

বাঁশবনটা বাড়ির পেছন দিকে, প্রায় পঁচিশ তিরিশটা বাঁশের গাছ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে, যেন প্রাচীন কোনো প্রহরী। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল, বাতাস নেই, অথচ বাঁশগুলো দুলছে। কান্নার আওয়াজটা এখন একেবারে কাছে—ঠিক যেন তার কানের পাশেই।

তখনই তার পেছনে কিছু একটা খসখস করে উঠল। সে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখা গেল—কেউ নেই। শুধু একটা লাল ওড়নার কোণা পড়ে আছে মাটিতে। সেই রকম লাল কাপড়, যেটা ছিল বাক্সটার ভেতরে।

হঠাৎই সে দেখল বাঁশের গুঁড়ির ফাঁকে একটা মুখ—সেই নারীমুখ, যেটা ছবিতে দেখেছিল। কিন্তু এবার সেটা সজীব। মুখটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক পলক। তারপর আবার অন্ধকার।

ঋদ্ধি দৌড়ে বাড়ির ভেতর ফিরল। দরজা বন্ধ করে, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হৃদস্পন্দন যেন কানে শোনা যাচ্ছে।

এতদিন সে ভূতের গল্প পড়েছে, শুনেছে, বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এখন?

রাত বারোটা বেজে পাঁচ। আবার সেই পায়ের আওয়াজ। আবার আয়নার দিক থেকে একটা নিঃশ্বাস। সে এবার সাহস করে গিয়েই দাঁড়াল আয়নার সামনে।

কিন্তু এবার সে নিজেকে দেখতে পেল না। আয়নার ভেতর দেখা যাচ্ছে একটা ঘর—একই এই ঘর, কিন্তু সময় যেন অন্য। পুরোনো কাঠের পালঙ্ক, দেয়ালে তেলচিত্র, জানালার পাশে একজন নারী দাঁড়িয়ে।

ঋদ্ধি চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল—কারণ সেই নারী মুখ ঘুরিয়ে তাকালো, আর সেটা… তারই মুখ!

সে কেঁপে উঠল। আয়নার ভেতরের ঋদ্ধি ধীরে ধীরে মুখে হাত রাখল, ঠোঁটে রক্ত, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা।

“তুই জানিস না, কে আমি… আমি তুই!”—আয়নার ভেতর থেকে সেই মুখটা বলল। “আমি বনলতা… আর তুই আমার শরীর!”

ঋদ্ধি পেছনে হটে গেল, টেবিলের ধাক্কায় কাঁধে আঘাত লাগল। আয়নাটা কেঁপে উঠল। ভেতরের মুখ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।

সে বুঝল, এটা আর শুধু ইতিহাস নয়। এটা তার নিজের গল্প, নিজের শরীর, নিজের পূর্বজন্ম… অথবা কিছু তার ভেতরে জায়গা নিচ্ছে।

চিঠিটা আবার পড়ল। তাতে আরও একটা বাক্য লেখা ছিল, যেটা চোখে পড়েনি—

“যদি ফিরে আসিস, তবে সাবধান—ছায়া কখনো ছেড়ে যায় না। সে শুধু জায়গা খুঁজে বেড়ায়।”

সেই রাতে সে ঘুমোতে পারেনি। ঘুমে চোখ এলেও ঘুমের মধ্যে সেই মুখ, সেই রক্তাক্ত ঠোঁট, সেই নিঃশব্দ ফিসফাস।

আর আয়নার পাশে, ঘরের কোণে, একটা ছায়া সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। একটুও নড়েনি।

পর্ব ৩: যাকে কেউ দেখতে পায় না

সকালে ঋদ্ধি ঘুম থেকে উঠল দেরিতে। দরজা আধখোলা ছিল। জানলার বাইরের আলোয় ঘরটা কেমন বিবর্ণ মনে হচ্ছিল। রাতের সেই ঘটনার পর ঘুমটা ঘুম ছিল না, যেন একটা ধোঁয়ায় ঢাকা তন্দ্রা—কিন্তু সেই ধোঁয়ার ভিতরেই যেন কারা সবসময় তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

ঘড়িতে তখন দশটা। আয়নার দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠল সে। এবার নিজেকে দেখতে পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার পেছনে…

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়া—লম্বা, নারীমূর্তি, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সে ঘুরে দাঁড়াল—কেউ নেই। আবার আয়নার দিকে—ছায়াও নেই।

এই খেলা যেন তার সঙ্গেই হচ্ছে, আবার সবার অলক্ষ্যে।

ঋদ্ধি ঠিক করল—তাকে খুঁজে বের করতেই হবে বনলতা কে ছিল। দাদুর ছবির নারী কি এই ছায়া? আর কেনই বা তার নামের পাশে লেখা ছিল “আমার শাস্তি”?

ঘরের পুরোনো তাক ঘেঁটে সে বের করল একটা পুরাতন ডায়েরি—পাতাগুলো নরম হয়ে গেছে সময়ের ভারে। প্রথম পাতায় লেখা ছিলঃ

“রাখাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা—আঁকা শব্দে।”

তারপরেই শুরু হয়েছিল একের পর এক এঁকে যাওয়া দিন, রাত, ভালোবাসা… এবং গোপন এক সম্পর্কের কথা।

“১৯৩১। বনলতা, তুমি যখন আমার সামনে দাঁড়ালে, আমি আঁকতে শুরু করলাম তোমাকে। কিন্তু প্রতিটি রেখায় যেন আমার নিজের ছায়া ঢুকে পড়ল। তুমি শুধু মডেল নও—তুমি আমার অপরাধ, আমার ভয়… আর সেই ভয় থেকেই আমি তোমায় আঁকতে চাই।”

ঋদ্ধির বুক ধড়াস করে উঠল। একটা অপরাধ? কী অপরাধ?

সে আরও পড়তে লাগল। প্রতি পাতায় ছড়িয়ে আছে এক অজানা ভালোবাসার আবেশ, কিন্তু পাতার শেষদিকে যেন আঁচড় কাটা কোনো ভয়।

“আমি আয়নাটা ভেঙে ফেলতে পারিনি। তাতে যে তুমিই আছো। প্রতিবার তাকালে দেখি, আমার পিছনে দাঁড়িয়ে তুমিই। আমি আলো জ্বালালেও তুমার ছায়া যায় না। তুমি বলেছিলে, ‘একদিন এই আয়নার ভেতরই আমি থেকে যাবো, আর কেউ একজন এসে আমার শরীর হবে।’

আমি ভয় পাই। ভয় পাই তোমায় আর নিজেকেও।”

ঋদ্ধির মুখ শুকিয়ে গেল। তাহলে কি বনলতা নিজেই আত্মহত্যা করেছিল? না কি তাকে কেউ ঠেলে দিয়েছিল?

ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।

সে চমকে উঠে দরজা খুলল। দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের একজন বয়স্ক মানুষ, পরিচিত মুখ না, কিন্তু গলায় একটা পরিচিতি ঝুলছে—ভবানী মণ্ডল, গ্রাম ইতিহাস সংগ্রাহক।

“আপনি ঋদ্ধিদেবী?”

“হ্যাঁ,”

“আপনার দাদু আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন। আমি তার অনেক কাজ সংরক্ষণ করেছি। শুনলাম আপনি এসেছেন… তাই কিছু জিনিস নিয়ে এলাম।”

তিনি একটা খাম দিলেন। খামের ভেতরে একজোড়া পুরোনো ছবি। তাতে রাখালবাবু এবং এক নারী—লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা, চোখে ঘন কাজল।

আর একটা ছবি… তাতে ছেঁড়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছে এক অর্ধেক মুখ—অদ্ভুতভাবে সেই মুখ ঋদ্ধির মতোই দেখতে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ছবি নামিয়ে রাখল।

ভবানী মণ্ডল বললেন, “বাড়িটা নিয়ে লোকের অনেক কথা। বলে, এখানে নাকি একজন মহিলা থাকতেন, যাকে কেউ দেখতে পেত না, কিন্তু আয়নায় দেখা যেত।”

ঋদ্ধি মাথা তুলল।

“আপনি বলছেন—এই বনলতা?”

“হুম। শুনেছি উনি আত্মহত্যা করেনি। একটা ঘর থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় এক রাতে, আয়নার সামনে থেকে। পরদিন আয়নার মধ্যে দেখা যায় তার ছায়া—কিন্তু বাস্তবে আর কিছুই ছিল না।”

ঋদ্ধির ঠোঁট শুকিয়ে এল।

“তাহলে তিনি আজও…?”

ভবানী মণ্ডল কাঁধ ঝাঁকালেন। “আমি বিশ্বাস করি না এসব। কিন্তু আপনার দাদু তখন থেকেই আঁকেন না। সেই শেষ ছবি—তিনি কারোকে দেখাননি।”

ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল, “ছবিটা কোথায়?”

“জানি না। শুধু শুনেছি, ঘরের এক গোপন দেয়ালের পেছনে রেখে দিয়েছেন। যদি কখনও সত্যিই দেখতে চান… খুঁজুন দোতলার দক্ষিণ দিকের দেয়াল।”

ঋদ্ধি আর দেরি করল না। সোজা উঠে গেল দোতলায়। দক্ষিণের ঘর—একটা ভাঙাচোরা বিছানা, ধুলো আর তেলচিটে মেঝে। সে হাত দিয়ে দেয়াল চাপড়াতে লাগল।

এক জায়গায় টুং করে শব্দ হল। ফাঁপা!

সে একটা কাঠের দিক ঠেলে দিল—একটা গোপন খোপ খুলে গেল।

তার ভেতর থেকে বের হল একটা কাপড়ে মোড়ানো কাঠের ফ্রেম। কাপড়টা খুলতেই…

চোখের সামনে ভেসে উঠল এক নারীমূর্তি। মুখটা অদ্ভুত চেনা। ঋদ্ধির মুখের ছায়া যেন মিশে আছে সেই চিত্রে। চোখ দুটো সরাসরি তাকিয়ে আছে, যেন জীবন্ত।

আর নিচে লেখা—

“শেষ চিত্র: বনলতা—যার ছায়া এখনও বেঁচে আছে।”

পর্ব ৪: ছায়ার শরীর

ছবিটা যতক্ষণ হাতে ধরে রাখল ঋদ্ধি, মনে হল কারও চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। সেই চিত্র যেন হাওয়ায় দুলছে না, বরং হাওয়াকেও নিজের ছায়ায় আটকে রাখছে। পেছন থেকে জানলার পর্দা ওড়ছে, কিন্তু সেই নারীমুখের চোখ স্থির, তাকিয়েই আছে।

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে ফ্রেমটা নামিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। একটা চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। চোখের সামনে ভেসে উঠল চিঠির সেই লাইন—“ছায়া কখনও ছেড়ে যায় না, সে শুধু জায়গা খুঁজে বেড়ায়।”

তবে কি এই ছবিটার মধ্যেই বনলতা বন্দী? না কি আরও গভীরে লুকিয়ে আছে তার গল্পের শেষ অধ্যায়?

সে রাতে সে আর নিজের ঘরে ঘুমোল না। লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকল বারান্দার চেয়ারে। রাত একটা নাগাদ আবার কানে এল সেই পরিচিত পায়ের শব্দ। ধাপে ধাপে, খুব ধীরে নামছে কেউ, যেন ছায়া হলেও তার ওজন আছে।

ঋদ্ধি বুক শক্ত করে উঠে দাঁড়াল। এবার পালাবে না, এবার মুখোমুখি হবে। হাতে টর্চ, অন্য হাতে ছোট্ট রড।

ধাপে ধাপে সে এগোতে লাগল নিচের ঘরের আয়নার দিকে। কিন্তু এবার আয়নাটা কেমন ফেটে আছে মাঝখান দিয়ে, হালকা হালকা চিড় দেখা যাচ্ছে। তবে তাও… সেই চিড়ের ফাঁকেই দেখা যাচ্ছে অন্য একটা ঘর।

সে ঘরটা এই বাড়ির নয়—বোধহয় অন্য কোনো সময়, অন্য কোনো স্তরে অবস্থিত। সেই ঘরে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে লাল ওড়না, কপালে সিঁদুরের টিপ, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। সে যেন অনেকটা সময় ধরে তাকিয়ে ছিল, অপেক্ষা করছিল।

এই প্রথমবার, ঋদ্ধি তার নাম জিজ্ঞেস করল।

“তুমি কে?”

নারীটি ঠোঁট নাড়াল—কিন্তু কোনো শব্দ এল না। এরপর সে ধীরে ধীরে আঙুল তুলল, দেখাল… আয়নার গায়ে লেখা একটা লাইন:

“তুইই আমি… তুই যদি মনে রাখিস, আমি ফিরে আসব। যদি ভুলে যাস, আমি তোকে হয়ে যাব।”

ঋদ্ধির মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। তাহলে সে যদি নিজেকে ভুলে যায়… যদি অতীতে গড়িয়ে পড়ে, যদি নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে—তবে বনলতা তার শরীর নিয়ে নেবে?

তখনই পিছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল।

“তুই ফিরে এসেছিস ঠিকই… কিন্তু ভুল জায়গায়।”

সে ঘুরে দাঁড়াল। সামনে সেই মুখ—ছবির বনলতা, কিন্তু এবার সে আর আয়নার ভিতরে নেই। বাস্তবের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে, হালকা ম্লান আলোর মধ্যে। আর তার পায়ের নিচে ছায়া নেই।

ঋদ্ধির পা জমে গেল। সে কিছু বলতে পারছিল না। শুধু জিজ্ঞেস করল—

“তুমি কী চাও?”

বনলতা বলল, “আমি শরীর চাই না। আমি চাই আমার গল্পটা কেউ জানুক। যে ভুলটা করেছিলাম, সেটা কেউ যেন আবার না করে।”

“তুমি কী করেছিলে?”—স্বর কম্পিত।

“আমি ভালোবেসেছিলাম একজনকে—তোমার দাদু, রাখাল। ওর ছবির ভেতরে নিজেকে খুঁজতে গিয়েই আমি নিজেকে হারিয়েছি। আমি ওর আঁকা ছবির মধ্যে বন্দী হয়ে গেছিলাম। যেদিন আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল, সেদিন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম—‘আমায় মনে রাখিস, নইলে আমি তোকেই হয়ে যাবো।’ আর তারপর থেকেই আমি শুধু ছায়া। ঘরটা আমার, আয়নাটা আমার, ছায়াটাও আমার। শুধু শরীরটা… সেটা তোদের।”

বনলতা ধীরে ধীরে আয়নার দিকে এগোল, বলল, “এই আয়নার ভেতরে আমি সময় থামিয়ে রেখেছি। তুই যদি আমার গল্প শুনিস, লিখিস, জানাস—আমি মুক্তি পাব। কিন্তু তুই যদি পালিয়ে যাস… যদি অস্বীকার করিস… আমি তোকে ছায়া করে দেবো।”

ঋদ্ধির হাত ঠাণ্ডা হয়ে এল। তবু সে মাথা ঝাঁকাল।

“ঠিক আছে। বলো। আমি লিখব। আমি শুনব।”

বনলতা একটা ফিসফিসে হাসি হেসে বলল,

“তাহলে আয় আমার সঙ্গে—আয়নার ওপারে।”

আর পর মুহূর্তেই ঋদ্ধি দেখল—নিজের ছায়া ভেঙে গেল। এবং তার শরীর… আর সে বুঝতে পারল না, আয়নার কোন পাশে দাঁড়িয়ে আছে এখন।

পর্ব ৫: বনলতার গল্প

আলো নেই, শব্দ নেই। যেন একটা নরম গন্ধ—পুরোনো কাগজ, ভিজে চুল আর জ্বেলে দেওয়া মোমবাতির ঘ্রাণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। চোখ খুলতেই ঋদ্ধি বুঝল, সে আয়নার অপর পাশে। আর এই জায়গাটা ঠিক বাড়ির মতো হলেও… নয়। এ যেন কোনো প্রতিধ্বনির ঘর, যেখানে প্রতিটি জিনিস অতীতের ছায়া।

একটা চেয়ার, একটুখানি কাঠের টেবিল, জানালার বাইরে চাঁদের আলো, আর তার সামনে বসে আছে বনলতা। সেই লাল পাড় সাদা শাড়ি, খোলা চুল, মুখটা স্থির, কিন্তু চোখ দুটো কাঁপছে—অভিমান আর অসমাপ্ত কথার ভারে।

“বসে পড়ো,”—সে বলল।

ঋদ্ধি বসে গেল। তার শরীর কেমন হালকা লাগছে, যেন ছায়া হয়েও অস্তিত্ব আছে।

“তুমি বলেছিলে, তুমি শরীর চাও না। শুধু গল্পটা কেউ জানুক। আমি শুনছি।”

বনলতা একটু হাঁপ ছাড়ল, তারপর শুরু করল—একটা কফির দাগ মাখা পুরোনো দিনের মত করে।

“১৯৩০ সাল। এই বাড়িটা তখন ছিল আলোয় ভরা। নাটকের মহড়া চলত এখানে। গানের ক্লাস, কবিতা পাঠ, ছবি আঁকা—সবই ছিল। আর আমি ছিলাম এই সব কিছুর মাঝখানে—একজন মডেল, নৃত্যশিল্পী, আর রাখালের… প্রেমিকা।”

ঋদ্ধি চুপচাপ শুনছে।

“রাখাল তখন বয়সে বড়, কিন্তু মনে খুব কোমল। তার তুলির মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম। প্রতিটি ছবিতে আমি ছিলাম অন্য রকম—কখনও রানী, কখনও বালিকা, কখনও বিষাদগ্রস্ত এক প্রেতা।”

“প্রেতা?”—ঋদ্ধি বাধা দিল।

“হ্যাঁ,” বনলতা হাসল, “সে এক ছবির কথা। আমাকে একটা আয়নার সামনে বসিয়ে রেখেছিল। বলল, ‘তুমি নিজেকে না দেখে দেখো, কী হতে পারতে।’ আমি তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, আর একসময় আমি নিজেকে আর চিনতে পারিনি। তারপর সে ছবি আঁকল… আর আমি যেন তাতে ঢুকে গেলাম। বলল, ‘এই ছবিটা কারওর সামনে আনবো না, কারণ এতে আমার ভয় ঢুকে গেছে।’”

“এরপর কী হল?”

“এরপর,” বনলতার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “রাখাল শহরে ফিরে গেল। বলল, তার আর ছবি আঁকতে ভালো লাগে না। আমি বুঝে গিয়েছিলাম—ও কারো প্রেমে পড়েছে, অন্য এক মেয়ের। আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি। শুধু একটা কথা বলেছিলাম—‘আমায় মনে রাখিস।’ সে বলেছিল, ‘ভুলব না।’”

“কিন্তু?”

“সে ভুলে গিয়েছিল। আর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—যদি কেউ আমাকে ভুলে যায়, আমি তাকে ছায়া হয়ে ফিরে ধরব। ও যখন শেষবার বাড়িতে এলো, তখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই আয়না, যেখানে নিজেকে না দেখে আমি অন্য বনলতা হয়ে উঠেছিলাম। সে আমাকে আর চিনতে পারেনি। আমি তখন বুঝলাম—আমার শরীর আছে, আমার নাম আছে, তবু আমি কেউ নই। আমি শুধু একটা ছায়া।”

ঋদ্ধির চোখে জল এসে গেল।

“তুমি কি আত্মহত্যা করেছিলে?”

“না,”—বনলতা কাঁপা গলায় বলল, “আমি শুধু আয়নার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই। আর তখন থেকে এই বাড়ির সমস্ত আয়নাতেই আমি থেকে গেছি। কারণ কেউ মনে রাখেনি আমাকে।”

“আর সেই থেকে তুমি ফিরে আসতে চেয়েছ?”

“না… আমি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম কেউ একজন আমাকে লিখে যাক। আমার গল্পটা, আমার প্রেমটা, আমার ভুলটুকু। তুমি সেই মানুষ।”

ঋদ্ধি স্তব্ধ হয়ে রইল। এই দায়িত্ব, এই সময়ের ওপার থেকে ডেকে আনা কাহিনি—তার কাঁধে যেন ছায়ার ভার হয়ে পড়ল।

“তোমার এখন কী চাওয়া?”

“লিখে ফেলো,”—বনলতা বলল, “একটা খাতা খোলো, নাম দাও—ছায়ার নিচে বাড়ি। আর লিখে যাও—তুমি কে, আমি কে, এই আয়নাটা কী, রাখাল কেন আমাকে ভুলেছিল। যদি গল্পটা শেষ হয়… আমি মুক্ত হবো। আর তুই ফিরতে পারবি।”

“আর যদি না পারি?”

“তাহলে তুই এখানেই থেকে যাবি। আয়নার ছায়া হয়ে। আর তোর শরীরে আমি ফিরব।”

ঋদ্ধি মাথা নাড়ল।

“আমি লিখব। আজই শুরু করব।”

বনলতা তখন উঠে দাঁড়াল। তার মুখটা একটু নরম, চোখে একটু আশ্বাস। সে বলল, “তবে মনে রেখো… লিখতে গিয়ে তুই যদি আমার মতোই ভুল করিস… যদি তুইও প্রেমে পড়ে যাও… তাহলে গল্পটা আবার নতুন করে শুরু হবে।”

আলো ঝাপসা হয়ে এল। সময় পেছিয়ে যেতে লাগল।

ঋদ্ধি চোখ খুলল—সে আবার নিজের ঘরে, নিজের শরীরে। পাশে খোলা খাতা, আর প্রথম লাইনে লেখা—

“ছায়ার নিচে বাড়ি – লেখিকা ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়”

পর্ব ৬: নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি

রাতের ঘুম যেন আর ঘুম ছিল না। এক অদ্ভুত ভার নিয়ে ঋদ্ধি জেগে উঠল। পাশেই খোলা খাতা, প্রথম পাতায় সেই শিরোনাম—

“ছায়ার নিচে বাড়ি – লেখিকা ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়”

আর নীচে একটা লাইন, যেটা সে লেখেনি—

“প্রথম খণ্ড: আমি বনলতা ছিলাম না, আমি হতে হয়েছিলাম।”

সে চমকে উঠল। কলমটা ঠিক জায়গায় আছে, খাতা খুলে রাখা, কিন্তু হাত তো ওরই ছিল—তবে কি বনলতা তার ভেতর দিয়ে লিখে যাচ্ছে?

ঘরটা তখন কুয়াশায় ঢাকা, জানলার কাঁচ ঘামে ভেজা। টেবিলের কোণে রাখা আঠালো মোমবাতির মতোই একটা গন্ধ ঘুরছে—ভিজে ছাই, পুরনো ধূপ আর রক্তমাখা কমলা ফুলের মালা।

সে লিখতে বসল। প্রথম প্যারাগ্রাফ শুরু করল—

“মধুবন কোঠি’র দেওয়ালের রং যত না ফিকে, তার চেয়ে বেশি ঘোলা এই বাড়ির ইতিহাস। যত ঘাঁটা যায়, তত কাদামাটি উঠে আসে।”

তার কলম যেন চলতে লাগল নিজের ইচ্ছায়। শব্দরা ভেসে এল মাথার ভেতর, তার গলা দিয়ে নয়, বরং বনলতার গলা দিয়ে।

“রাখাল আমাকে যে আয়নার সামনে বসিয়েছিল, তার পেছনে নিজেই দাঁড়াতে ভয় পেত। বলত, এই আয়নায় সে নিজেকে চেনেনা। আমি বলতাম—আমার প্রতিচ্ছবি তো তুমি, রাখাল। তুমি আমাকে যেভাবে আঁকো, আমি সেভাবেই বাঁচি।

সে হেসে বলেছিল—তাহলে তুমি চিত্র নয়, তুমি অভিশাপ।”

ঋদ্ধি থেমে গেল। হাত কাঁপছে। পৃষ্ঠার মাঝখানে হঠাৎ কলম থেমে গিয়ে একটা রেখা টেনেছে—ঠিক আয়নার মতো ফাটল। সে আবার শুরু করল।

“সেই রাতে আমি জানালার গলায় দড়ি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দড়ির থেকে বেশি জোরালো ছিল প্রতিশোধের ইচ্ছে। আমি চাইনি নিজেকে মেরে ফেলতে—আমি চাইছিলাম তাকে জানাতে, আমি থাকব। তবে শরীর নয়, ছায়া হয়ে।”

হঠাৎ জানালার কাচে টোকা পড়ল। একবার, তারপর আবার। সে উঠে গিয়ে পর্দা সরাল। কেউ নেই। শুধু বাঁশবনের দিকে হালকা দুলুনি—জুনের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ তার চোখ পড়ল জানালার কাচে—সেখানে একটা হাতের ছাপ। ভেতর দিক থেকে নয়, বাইরের দিক থেকে।

সে ধীরে ধীরে ফিরে এল। কিন্তু খেয়াল করল—খাতা এখন বন্ধ, কলমটা উপুড় হয়ে টেবিলের নীচে পড়ে আছে।

খাতা খুলতেই একটা নতুন লেখা দেখা গেল—

“তোর লেখা বন্ধ কর। এই গল্প অন্য কারো। যদি তোকে জানে, তুইও আর নিজে থাকবি না।”

এই লেখাটা বনলতার হাতে নয়, অন্য কোনো একের।

ছায়ার ছায়া। ঋদ্ধি থমকে গেল। তবে কি বনলতা একা নয়? তবে কি অন্য কেউ, কোনো শক্তি—যে চায় না এই সত্য বাইরে আসুক?

সে ভাবল, এবার তাকে নামতে হবে নিচের ঘরে। সেই আয়নার সামনে আবার যেতে হবে, যেখানে সব শুরু হয়েছিল।

আয়নার ঘরে ঢোকার আগেই মনে হল, বাতাসটা ভারী। আয়নার ঠিক পাশে দেওয়ালে একটা রেখা—ফাটল দেখা যাচ্ছে। আয়নাটা ফ্রেম থেকে খুলে রাখা, যেন কেউ সেটা উপড়ে ফেলতে চেয়েছে।

সে আয়নার দিকে এগোল।নিজেকে দেখতে পেল না। আয়নার ভিতরে এবার সেই ঘর নেই। শুধু কালো। নিঃশব্দ। আর সেই কালোর ভেতর থেকে ভেসে এল একটা গলা—কিন্তু এটা বনলতার নয়। গম্ভীর, পুরুষকণ্ঠ, ফিসফিস করে বলল—

“গল্প লিখবি, ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখিস, সব চরিত্র নায়ক নয়। কেউ কেউ কেবল অপেক্ষা করে, শেষ পৃষ্ঠায় ছায়া হয়ে নাম লেখাতে।”

ঋদ্ধি কেঁপে উঠল। সে জানত না, তার দাদুর আঁকা সেই ছবি শুধু বনলতার নয়। আরও কেউ সেখানে ছিল—আর সেই কেউ, এখনো আছে।

সে ফিরল নিজের ঘরে, খাতার সামনে বসে আবার লিখল—

“এই কাহিনি শুধু প্রেমের নয়, প্রতিশোধেরও নয়। এটা একটা প্রেতাত্মার ইতিহাস নয়, বরং শরীরহীন ছায়াদের সেই অধিকার যা তারা কেড়ে নিতে চায় তাদের ভুলে যাওয়া শরীর থেকে। আর আমি… আমি এখন জানি, মধুবন কোঠির গল্প আমি লিখব না। আমি সেই গল্পের ভেতরেই বাস করি।”

সেই রাতে ঘড়ির কাঁটা থেমে গেল বারোটা পাঁচে।

আর আয়নার মধ্যে দেখা গেল দুটি মুখ—একজন বনলতা।

আর একজন… এখনো নামহীন।

পর্ব ৭: শেষ ছবির সীমানায়

ঋদ্ধি আগের রাতে ঘুমোয়নি। আবার সকালে উঠেও মনে হচ্ছিল, সে আর ঠিকঠাক মানুষ নেই। আয়নায় দেখলে এখন নিজের প্রতিচ্ছবি এলোমেলো মনে হয়—কখনও চোখে বনলতার ছায়া, কখনও ঠোঁটে অন্য কারও হাসি।

সে বুঝে গিয়েছিল—এ কেবল অতীত লেখা নয়, বরং লেখার মধ্যে দিয়ে সে ঢুকে পড়ছে সেই সময়ের ভিতর। শব্দেরা এখন আর কাগজে আটকে থাকে না, তারা জীবন্ত হয়ে উঠছে। আর কেউ একজন, বনলতার থেকেও অন্ধকার, সেই ছায়া হয়ে পাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

সকালবেলায় ভবানী মণ্ডল আবার এসে দাঁড়াল দরজায়। মুখে চিন্তার রেখা।

“মা, আমি একটা জিনিস আপনাকে দিতে চাই। অনেকদিন আগে আপনাদের বাড়ির একজন কাজের লোক আমার হাতে এটা দিয়ে বলেছিল, জমিদারবাবু নাকি খুব কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন—এই বাক্স যেন কেউ না খোলে।”

ঋদ্ধি কৌতূহলী হয়ে বাক্সটা হাতে নিল। কাঠের তৈরি, তালা পড়ানো। সে আগের সেই পুরোনো চাবির গোছা নিয়ে খুলে ফেলল। ভেতরে একটা রোল করা ক্যানভাস, খুব যত্নে মোড়ানো।

সে ধীরে ধীরে খুলল…

এবং স্তব্ধ হয়ে গেল।

ছবিটা যেন বেঁচে আছে। এক বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক নারী—বনলতা। কিন্তু আয়নায় দেখা যাচ্ছে অন্য একজন নারী—অদ্ভুতভাবে ঋদ্ধির মতো মুখ।

আর আয়নার কাঁচে আঁকা আছে রক্তমাখা লাল অক্ষরে—“শেষ প্রতিচ্ছবি”

ছবির মধ্যে সময় গলে গলে পড়ছে। ঠোঁটের কোণে ক্লান্তি, কাঁধে ভয়, চোখে এক অসীম শূন্যতা। কিন্তু যেটা সবচেয়ে ভয়াবহ—ছবির কোণায় দেখা যাচ্ছে এক পুরুষছায়া, যার মুখ নেই, শুধু চোখদুটি গর্তের মতো কালো।

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে ছবি স্পর্শ করল।

এক ঝটকায় তার শরীর শীতল হয়ে গেল।

ভেতর থেকে যেন একটা স্পন্দন উঠল—

“আমি রেখেছিলাম তোমায় ছবির মধ্যে। তুমি মুক্তি চেয়েছো, এবার আমি ফিরব।”

এটা বনলতা নয়। এটা সেই পুরুষছায়া। সেই অনিচ্ছুক শিল্পী—রাখাল নিজেই?

না। এটা রাখালের সেই দিক, যেটা ছবি আঁকার সময়ে তার ছায়া হয়ে উঠেছিল। যেমন কিছু শিল্পীর হাতে জীবন্ত রং থাকে, তেমনই কিছু ছবির মধ্যে জন্ম নেয় ছায়া-মানব। তারা রং থেকে তৈরি হলেও তাদের চাওয়া থাকে—তাদের শরীর চাই না, তারা চাইতে চায় অন্যের ভিতর ঢুকে থাকতে।

ঋদ্ধি জানত, এবার শেষ সময়ে পৌঁছে গেছে।

তার ঘরের আয়নায় আজ আর নিজের মুখ নেই। শুধু একটা পেছন ফিরে থাকা নারীমূর্তি, কাঁধে খোলা চুল, ঠোঁটে রক্তের রেখা।

রাত ১২:০৫ বাজে।

সে আবার খাতায় লিখতে বসে।

“এই ছবির ভিতর যে মানুষ, সে রাখাল নয়। সে কোনো শিল্পীর জন্ম দেওয়া ছায়া। যে প্রতিটা ক্যানভাসে মিশে থেকে যায়, যে তার মডেলকে গ্রাস করে, যে জানে, ভালোবাসা আসলে সৃষ্টি নয়, দখল। বনলতা সেই দখলের শিকার, আর আমি… আমি এখন জানি, আমার গল্পের শেষে নাম লেখা থাকবে, লেখিকা ঋদ্ধি নয়, বরং – ছায়া, অজ্ঞাতনামা।”

ঘরের ভেতর বাতি জ্বলে উঠল নিজে থেকেই।

ছবিটা আবার রোল হয়ে গেল, যেন তা আর কেউ দেখতে না পায়। আর আয়নার মধ্যে এবার দেখা গেল শুধুই একটা ফাঁকা চেয়ার।

পর্ব ৮: ছায়ার শেষ রাত

বাড়িটার ভিতরটা এখন আর ঋদ্ধির মতো মানুষদের জন্য নয়। এখানে শব্দেরা থামে না, আয়নাগুলো বন্ধ চোখে দেখে ফেলে সত্যি, আর প্রতিটি কোণার ছায়া একটু বেশি দীর্ঘ হয় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

ঋদ্ধি জানে, আজ রাতই শেষ। এই বাড়ির, এই গল্পের, আর হয়তো তার নিজেরও।

টেবিলের সামনে বসে থাকা খাতাটা আজ নিজেই খোলে যাচ্ছে পাতা পাতা। লেখার শব্দ হচ্ছে, অথচ সে কলম ছোঁয়ায়নি। প্রতিটি বাক্যে কালি পড়ছে, যেন বনলতার নিঃশ্বাস ঢুকে যাচ্ছে শব্দে শব্দে।

ঘড়ির কাঁটা পৌঁছেছে ১২:০৪—এক মিনিট বাকি।

ঋদ্ধি আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার সে ভয় পাচ্ছে না। এখন তার গলা থেকে বেরোচ্ছে শুধু একটাই প্রশ্ন—“কে ছিলে তুমি বনলতা? মানুষ, না প্রতিচ্ছবি?”

আয়নার ভিতর এবার এক ঝলকে দেখা গেল পুরোনো সেই ঘর, যেখানে এক শিল্পী ছবি আঁকছিল, সামনে বনলতা বসে আছে, আর পিছন থেকে একটা ছায়া সেই আয়নার দিকে এগোচ্ছে।

ছায়াটা এইবার মুখ তুলল।

না, এটা রাখাল নয়।

এটা সেই ছায়া—যেটা রাখালের ভিতর থেকে জন্ম নিয়েছিল। শিল্পীর দমন করা বাসনা, অসমাপ্ত ভালোবাসা, অসমাপ্ত সৃষ্টি—সবকিছুর জ্যান্ত প্রতিচ্ছবি।

ছায়া কখনও নিজের নাম চায় না। ও চায় নামহীন থেকে অন্যের নাম নিয়ে বাঁচতে।

রাত ১২:০৫ বাজল।

একটা জানলার কাঁচ ফেটে গেল শব্দ করে।

ঋদ্ধি বুঝল, এবার সে ভিতর থেকে ডাকা শুনতে পাচ্ছে। এইবার, তাকে বেছে নিতে হবে—সে নিজের শরীর রক্ষা করবে, নাকি বনলতার গল্পকে শেষ করবে?

সে খাতার শেষ পাতায় লিখল—

“এই কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারে। যদি কেউ পড়ে, জেনে রাখো—ছায়া যেখানেই থাকে, সেখানেই থাকে এক নামহীন গল্প, এক অপূর্ণ প্রেম, এক ছবির অসমাপ্ত রেখা। আর যদি তোমার আয়নায় কোনোদিন নিজের বদলে কাউকে দেখো—মনে রেখো, তাকে কেউ ভুলে গিয়েছিল।”

লেখা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসটা ভারী হয়ে এল।

আয়নার মধ্যে একসঙ্গে দেখা গেল তিনটি মুখ—ঋদ্ধি, বনলতা, আর সেই ছায়া-শিল্পী। তারপর ধীরে ধীরে তারা মিশে যেতে লাগল এক আলোকবৃত্তে।

বাতি নিভে গেল।সকালে বাড়ির লোক এসে দেখল—ঘরের দরজা খোলা, খাতাটা খোলা আছে, আর খালি চেয়ারে কেউ নেই। আয়নাটা আছে, কিন্তু তাতে কারও প্রতিচ্ছবি পড়ে না আর।

কিন্তু খাতার শেষ পাতায় কেউ এক পেন্সিল দিয়ে লিখে গেছে একটা লাইন—

“গল্প শেষ হয়নি। এখন তোমার পালা।”

শেষ

Lipighor_1750927767154.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *