রুক্মিণী ভট্টাচার্য
পর্ব ১: মেঘ জমেছে
হাজরা মোড়ের সেই পুরোনো বাস স্টপটায় দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। তার পরনে একটা সাদা-লাল ছাপার কুর্তি, হাতে একটা বই, মুখটা মেঘলা আকাশের মতো ভাবনায় ঢাকা। বৃষ্টি নামবে বুঝে ছাতাটা খুলে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু জানত না, এই ছাতাটাই একদিন একটা গল্প হয়ে উঠবে।
পাঁচ মিনিট আগেই ট্রামলাইন বরাবর হাঁটছিল একটা ছেলেও। নাম তন্ময়। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ, আর কানে হেডফোন। ট্রামটা চলে গেছে, কিন্তু ছেলেটা থেমে দাঁড়ায়—বৃষ্টি তার চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে, অথচ সে নড়ছে না।
বৃষ্টি বাড়তেই দুজনেই একটু করে সরে আসে স্টপের ছাউনির নীচে। হঠাৎ একটা ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় মেয়েটির কাঁধটা। ছেলেটি একটু এগিয়ে এসে বলে, “ছাতাটা ধরবেন?”
মেয়েটা একটু চমকে উঠে তাকায়। তারপর হালকা মাথা নেড়ে বলে, “ধরতে পারি।”
দুজনেই একটা ছোটো ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে যায়। তেমন কিছু বলা হয়নি, শুধু চোখাচোখি আর মাঝে মাঝে হালকা হাসি। সেই হাসিগুলো ছাতার ভেতরে একরকম শব্দহীন বৃষ্টির মতো, যা পড়ে আর কেউ শুনতে পায় না।
তন্ময় কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু মেয়েটির চোখে একটা অব্যক্ত ক্লান্তি দেখে থেমে যায়। তারপর বলে, “আপনি কি বইটা শেষ করেছেন?”
মেয়েটি চমকে তাকায়—তার হাতে ধরা ছিল হুমায়ুন আহমেদের ঘনঘটা। সে হেসে বলে, “না, শেষের তিনটে অধ্যায় বাকি। আপনি পড়েছেন?”
তন্ময় মাথা নাড়ে। “পড়েছি অনেক আগে। কিন্তু কিছু কিছু বই শেষ করলেই ফুরিয়ে যায় না, তাই মনে থাকে।”
মেয়েটির নাম মৃণালিনী। সে জানে না, কেন ছেলেটির কথায় এমন করে কান দিচ্ছে। সাধারণত অচেনা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে না, কিন্তু আজকের এই মেঘলা দুপুরটা যেন ভিন্ন।
বৃষ্টির ফোঁটা আর ছাতার কানায় লেগে টুপটাপ শব্দ করছে। সময় থেমে আছে বলেই মনে হচ্ছে।
“আপনি এখানে রোজ আসেন?” তন্ময় জানতে চায়।
“না,” মৃণালিনী বলে, “আজ একটা ইন্টারভিউ ছিল পাশেই।”
“আর আমি এলাম একটা পুরোনো সিনেমার পোস্টার খুঁজতে। কলেজ স্ট্রিটে বলল এখানেই আছে নাকি একটা দোকান,” তন্ময় হেসে বলে।
বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে একটি ছোট ছাগল হঠাৎ ছুটে যায়। তারা দুজনেই হেসে ওঠে। এই হাসি একটু বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকে।
বাস এসে দাঁড়ায়। মৃণালিনী উঠে দাঁড়ায়, ছাতাটা তন্ময়ের হাতে দিয়ে বলে, “আপনারটা, ধন্যবাদ।”
তন্ময় ছাতাটা ধরে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “আপনার নামটা জানতে পারি?”
মেয়েটি একটু থেমে বলে, “বললে কি মনে রাখবেন?”
“হয়তো না,” তন্ময় হাসে, “কিন্তু হয়তো হুট করে কোথাও আবার দেখা হয়ে গেলে, বলবো—এই ছাতাটার নিচেই তো শুরু হয়েছিল…”
মৃণালিনী কিছু না বলে হালকা হেসে ওঠে। তারপর বাসে উঠে যায়। তন্ময় দাঁড়িয়ে থাকে ছাতাটা হাতে নিয়ে।
মেঘলা দুপুরটা কেমন ধোঁয়াটে হয়ে যায়। কিন্তু সেই ছাতার নিচের মুহূর্তটা থেকে যায়—একটা দিনের মতো, যা কখনো শেষ হয় না, শুধু অপেক্ষা করে, কোনো আরেক বৃষ্টির।
পর্ব ২: একটা ছাতা, দুটো গল্প
মৃণালিনীর বাসটা যখন চৌরঙ্গি পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, তখন সে জানলার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বাইরে ছাতার বন—প্রতিটা মানুষ আলাদা, কিন্তু বৃষ্টির নিচে সবাই একসাথে। তার কানে তখনো বাজছিল সেই কথাটা—“এই ছাতাটার নিচেই তো শুরু হয়েছিল…”
সে একটুও জানে না ছেলেটির নাম। জানে না, কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে। কিন্তু আজকের দিনে এমন কিছু মুহূর্ত ছিল, যা এক কাপ চায়ের মতো—হালকা গরম, কিন্তু একটু দেরি করলেই ঠান্ডা। তবু, স্মৃতিতে তার গন্ধ থেকে যায়।
বাসটা গোলপার্ক আসতেই সে নেমে পড়ে। বাড়ি মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মা দরজা খুলে দেয়, বলে, “ভিজে গেছিস?”
“না, কেউ একটা ছাতা ধরেছিল,” সে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে দেয়।
মা চোখ সরু করে তাকিয়ে বলে, “কে?”
“অচেনা,” মৃণালিনী হেসে ফেলে। “তেমন কিছু না। রাস্তায় দেখা, ছাতা ভাগ করা। এরকম হয় মাঝে মাঝে।”
“না রে মা, হয় না,” মা গম্ভীর গলায় বলে। “সিনেমায় হয়। তোর মতো মেয়েদের সঙ্গে হয় না। সাবধান থাকিস।”
মৃণালিনী কিছু বলে না। মাথা ঝুঁকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়, কিন্তু মাথার ভিতরে সেই ছেলেটির চশমা, হাসি আর চোখের দৃষ্টিটা আটকে থাকে।
অন্যদিকে, তন্ময় কালীঘাটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। ছাতাটা এখনো তার হাতে। আসলে ছাতাটা তো তার নয়, কিন্তু মনে হচ্ছিল এটা ফেরত দেওয়ার কোনো তাড়া নেই। ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে যেটুকু গল্প হয়েছিল, সেটুকুই যথেষ্ট নয়। তার অনেক কথা বলা বাকি।
তন্ময় একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে যায়। দোকানটা রাস্তার ধারে, মোড়ে মোড়ে ঝোলানো ছেঁড়াফাটা বল্লাল সেনের পুরোনো সিনেমার পোস্টার।
“দাদা, এক কাপ কড়া লাল চা,” সে বলে। তারপর ছাতাটা বন্ধ করে দেয়।
চা আসতে আসতেই সে ফোনে একটা নোট খোলে। সেখানে সে লিখে রাখে কিছু টুকরো সংলাপ, চরিত্র, ভাবনা। তন্ময় সিনেমার গল্প লেখে। বা বলা যায়, লেখার চেষ্টা করে।
সেই নোটে সে আজ একটা লাইন লেখে—
“ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই কি দুজনের ভিজে যাওয়া ঠেকানো? না, সেটা একটা অস্থায়ী ঘর, যেখানে অচেনা অনুভবগুলো চুপিচুপি বসবাস করে।”
চা শেষ করে সে উঠে পড়ে। এবার যেতে হবে লেক মার্কেটের দিকটায়—একটা পুরোনো বইয়ের দোকানে তাকে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎই মনে হয়—এই যে মেয়েটি, যার নাম সে জানে না, যাকে সে আর হয়তো কোনোদিন দেখবেও না—তার গল্প কি এখানেই থেমে গেল?
তন্ময় চশমা ঠিক করে নেয়। ছাতাটা ব্যাগে গুঁজে ফেলে। তারপর নিজের মনেই বলে, “না, এটা একটা শুরু ছিল। শুধু মেঘে ঢাকা সূর্যটা এখনও দেখা যায়নি।”
আর ঠিক তখনই, মোবাইলটা বাজে। অচেনা নম্বর।
সে একটু দ্বিধা নিয়ে ধরলে ওপাশ থেকে ভেসে আসে, “হ্যালো… আপনি হয়তো ছাতাটা নিয়ে গেছেন। মনে হয় সেটা আমার। ভুল করে দিয়ে গেছি।”
তন্ময় চুপ করে থাকে এক মুহূর্ত। তারপর হেসে বলে, “হ্যাঁ, ছাতাটা আছে। কিন্তু আপনি কি শুধু ছাতা ফেরত নিতে চান, না গল্পটাও?”
ওপাশ থেকে এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর সেই চেনা কণ্ঠ—“দেখা করে বলি?”
পর্ব ৩: চোখের ভাষা
দেখা করার জায়গাটা বেছে নেয় মৃণালিনী। ওর মতে নিউ আলিপুর লাইব্রেরির ঠিক পাশের সেই পুরোনো লাল ইটের চায়ের দোকানটা—যেখানে দাঁড়ালে পাশ দিয়ে ছুঁয়ে যায় ট্রেনের আওয়াজ, আর বইয়ের পাতা ওড়ে হাওয়ায় হাওয়ায়—সেটাই যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য একটা মধ্যবর্তী স্থান। খুব বেশি প্রকাশ্য নয়, আবার খুব গোপনও নয়। ঠিক যেমন অচেনা কারও সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা করা উচিত।
তন্ময় নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই এসে দাঁড়ায়। তার পরনে নীল পাঞ্জাবি, হাতে সেই ছাতাটা, আর মুখে সেই পুরোনো, কৌতূহলী হাসি।
মৃণালিনী এসে দাঁড়ালে, তন্ময় বলল, “এই যে, আপনার ছাতা।”
সে ছাতাটা নেয়, তারপর বলে, “ছাতাটা ফেরত পেলাম ঠিকই, কিন্তু কিছু কথা রেখে গেছিলাম যেদিন… হয়তো সেগুলোকেও ফেরত নিতে এলাম।”
চায়ের কাপ দুটো আসে। আজ বৃষ্টি নেই, কিন্তু বাতাসটা ঠান্ডা, কেমন একটা কুয়াশামাখা দুপুর।
তন্ময় চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার ইন্টারভিউটা কেমন হল সেদিন?”
মৃণালিনী মাথা দোলায়, “মন্দ না। কিন্তু চাকরি হয়নি। এখন ভাবছি হয়তো ভাগ্যই এমন ছিল।”
“ভাগ্য তো মাঝে মাঝে এক ছাতার নিচেও দেখা দেয়,” তন্ময় বলে, “যদি তাকে চিনি, তার গল্পটা না বুঝে কখনো ছেড়ে দিই না।”
মৃণালিনী একটু হেসে ফেলে, তারপর বলে, “আপনি কি সবসময় এমন কথা বলেন, নাকি আজকের দিনটা স্পেশাল?”
“আমি আসলে স্ক্রিপ্ট লিখি,” তন্ময় মৃদু হেসে বলে। “সিনেমার চিত্রনাট্য। কথাগুলো একটু ছবির মতো হয়ে যায় মাথায়।”
“তাই তো বলি, আপনার চোখে গল্পের ভঙ্গিমা ছিল,” মৃণালিনী বলে।
তন্ময় তাকায় মেয়েটির চোখের দিকে। কিছু একটা আছে সেখানে—ক্লান্তির পাশে একটা অনুচ্চারিত কৌতূহল। যেন সে জানতে চায়, এই মানুষটা কতটা গল্পের, আর কতটা বাস্তবের।
“আপনার বইয়ের শেষ তিনটি অধ্যায় পড়া হয়ে গেল?”
“হ্যাঁ,” মৃণালিনী বলে। “শেষ অধ্যায়ে একটা লাইন ছিল—‘কিছু মানুষ আসে, শুধু একদিনের জন্য, কিন্তু রেখে যায় এমন ছায়া, যা জীবনের সব আলোয় পড়ে।’ সেটা মনে আছে?”
তন্ময় চমকে তাকায়। বলে, “মনে আছে। এবং আমি এখনও ভাবি, আপনি সে রকম একজন নন—যিনি একদিনেই শেষ হয়ে যাবেন।”
দুজনেই চুপ করে যায় কিছুক্ষণ। দোকানের পাশে একটা বিড়াল এসে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। একটা বাচ্চা ছেলে তার পাশে বসে বিস্কুট ভাঙে, আর বিড়ালটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
এই ছোট ছোট দৃশ্যগুলো যেন আজকের কথা না, যেন তারা আগে কখনো এখানে এসেছে, বসেছে, চা খেয়েছে, কথা বলেছে।
মৃণালিনী হঠাৎ বলল, “জানেন, জীবনে প্রথমবার মনে হচ্ছে, কোনো অচেনা মানুষের পাশে দাঁড়ালে নিজের কিছু পুরোনো চিন্তাগুলো নতুন করে ভেঙে গড়তে ইচ্ছে করছে।”
তন্ময় বলে, “তাহলে ভাঙুন। আমি আছি সেই গড়ার কাজে।”
চায়ের কাপ খালি হয়। ছাতা হাতবদল হয় না আর। এবার সেটা তন্ময়েরই থেকে যায়, যদিও বৃষ্টি নেই।
চলে যাওয়ার আগে মৃণালিনী শুধু বলে, “ছাতা এবার থাকুক আপনার কাছে। যদি আবার একদিন বৃষ্টি নামে, তাহলে আমাকে ডেকে নিয়েন।”
তন্ময় বলে, “বৃষ্টি নামবেই।”
পর্ব ৪: চায়ের দোকানের গন্ধ
পরের কয়েকদিনে বৃষ্টি পড়েনি। কিন্তু মৃণালিনীর ভিতরে ঠিক যেন মেঘ জমে ছিল। একটা অদ্ভুত অনুভব বুকের মধ্যে গুমরে উঠত—হালকা, অথচ জোরালো। যেন কোথাও কেউ অপেক্ষা করছে, আর সেই অপেক্ষার শব্দ তার প্রতিদিনের শব্দহীনতার মধ্যে ঢেউ তোলে।
কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির অলিগলিতে বর্ষার পর কাঠফাটা রোদ। কিন্তু সে জানে, কোনো কোনো সম্পর্ক রোদের মধ্যেও ছায়া খোঁজে। ছাতাটা সে ফিরিয়ে দেয়নি—ইচ্ছে করেই। কারণ ছাতাটা ছিল বাহানা, যার ভেতরে লুকানো ছিল কিছু অপ্রকাশিত বাক্য, কিছু দৃষ্টি বিনিময়ের অধিকার।
অন্যদিকে, তন্ময় এই ক’দিনে লিখে ফেলে একটা নতুন স্ক্রিপ্ট। নাম দিয়েছে—“Under the Umbrella”। গল্পটা দুই অচেনা মানুষের, যারা একদিন বৃষ্টিতে ছাতা ভাগ করে দাঁড়ায়, আর তারপর সেই একটি দিনের মধ্যেই গড়ে ওঠে এক সমান্তরাল জীবন।
তন্ময় বুঝতে পারে, সে গল্প লিখছে না—সে একটা মানুষকে মনে রাখছে। কাগজে কলমে, সংলাপে সংলাপে, ছায়া থেকে আলোয়। মৃণালিনী নামটা না লিখেও গল্পে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার চোখের ভাষা, দাঁড়িয়ে থাকা ভঙ্গি, সেই হালকা হাসিটা।
অবশেষে একদিন আবার দেখা হয়—অবধারিতভাবে, হঠাৎ নয়।
চায়ের দোকানটা একই। লাইব্রেরির পাশের সেই লাল ইটের দেয়াল। বিকেলের ছায়ায় দুজনেই বসে। এইবার তাদের মাঝে ছাতা নেই, আছে শুধু এক কাপ করে চা আর দুইটা বিস্কুট।
“তুমি কি আমায় একটা গল্পে লিখে ফেলেছ?” মৃণালিনী একদৃষ্টে চেয়ে বলে।
তন্ময় চমকে না, বরং হালকা হেসে ফেলে। “হয়তো। কিন্তু আমি গল্পে কাউকে লিখি না, আমি শুধু তার ছায়া টানি। বাস্তব থাকে তার বাইরে, আর সেইটুকুই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সত্যি।”
“তোমার গল্পে আমার নাম কী রেখেছ?” সে জিজ্ঞেস করে।
তন্ময় এক মুহূর্ত থেমে বলে, “নন্দিনী।”
মৃণালিনী মাথা নাড়ায়। “খারাপ না। তবে আমি চাই, তুমি আমাকে নন্দিনী না বানাও। আমি চাই, মৃণালিনীই থাকি—একটু ধোঁয়াটে, একটু সহজ, একটু দূরে।”
তন্ময় এবার চুপ করে যায়। তার মনে হয়, এই মেয়েটির সমস্ত জটিলতা আর সাদামাটার ভেতরেই আসলে সবচেয়ে গভীর রহস্য লুকিয়ে। সে রহস্য সমাধান করার জন্য না, কেবল মুগ্ধ হয়ে পাশে বসে থাকার জন্য।
একটা বাচ্চা ছেলে হঠাৎ চায়ের দোকানে এসে বলে, “দাদা, একটা পাউরুটি আর লাল চা দিন।” দোকানদার হেসে বলে, “চিনির কম, না বেশি?” ছেলেটা বলে, “আজ বেশি।”
তন্ময় আর মৃণালিনী হাসে। ছোট ছোট ঘটনাগুলো যেন তাদের কথাবার্তার মাঝে ঢুকে পড়ে নিজের মতো করে গল্প তৈরি করে নেয়।
“তুমি কি জানো,” তন্ময় বলে, “তোমার সঙ্গে কথা বললে আমার মনে হয় আমি কোনো গানের মধ্যে হাঁটছি। কোনো ক্লাসিক রাগ, যার প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে রচে যাচ্ছে।”
মৃণালিনী চায়ের কাপটা একটু সামনে এগিয়ে বলে, “আর আমি ভাবি, তুমি কথা না বললেও তোমার চোখ গল্প বলে। যেন চোখ দিয়ে কেউ পৃষ্ঠা উলটে দিচ্ছে।”
তন্ময় এবার বলে, “তাহলে একটা প্রশ্ন—এই গল্পটা কী একদিনেই শেষ হবে? না, এটা চলবে বর্ষার পরেও?”
মৃণালিনী উত্তর দেয় না। শুধু বলে, “আগামী শনিবার আমার জন্মদিন। সকাল বেলা… বৃষ্টি নামবে বলেছে আবহাওয়ার দপ্তর।”
তন্ময় চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদু গলায় বলে, “ছাতা আনব, ঠিক সকাল আটটায়।”
আর মৃণালিনী শুধু একবার হেসে বলে, “সেদিন ছাতা আমার সঙ্গে থাকবে না।”
পর্ব ৫: ভিজে যাওয়া নামগুলো
শনিবার সকালে কলকাতা যেন পুরোনো দিনের কোনো সাদা-কালো সিনেমার ভেতর ঢুকে পড়ে। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে, পাখিরা নিরুত্তর, আর রাস্তাগুলো জনশূন্য। একটা নিঃশব্দ ভালোবাসা যেন শহরটাকে জড়িয়ে রেখেছে।
তন্ময় ঠিক সকাল আটটায় হাজির হয়। গায়ে কুর্তা, হাতে ছাতা, চোখে সেই পরিচিত উদ্দীপনা। কিন্তু আজ তার চোখে একটু কাঁপা কাঁপা আলো। বৃষ্টি থেমে নেই, ছাতা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন সেই ছায়াটার জন্য অপেক্ষা করে।
অবশেষে মৃণালিনী এসে দাঁড়ায়। তার পরনে হালকা হলুদ কুর্তি, চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে কোনো রঙ নেই—তবু সে যেন অন্য রকম লাগে। জন্মদিনের মেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, বরং সে যতটা সাধারণ থাকে, ততটাই সে তন্ময়ের চোখে অসাধারণ হয়ে ওঠে।
তন্ময় বলে, “তুমি তো বলেছিলে ছাতা থাকবে না তোমার কাছে। আজ ভিজবে?”
“হ্যাঁ,” মৃণালিনী হালকা হেসে বলে। “কখনো কখনো ভিজে যাওয়াটাই দরকার হয়। নিজের ভিতরের কষ্টগুলো ধুয়ে ফেলতে।”
তন্ময় ছাতাটা এগিয়ে দেয় না। সে বুঝে গেছে, আজ মৃণালিনী কোনো আশ্রয় চাইছে না। সে চায় বৃষ্টির সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত বোঝাপড়া।
ওরা দুজন রাস্তার এক কোনায় হেঁটে যায়—নেই কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য। শুধু পা ফেলার শব্দ, মাঝে মাঝে চোখাচোখি, আর খুব হালকা কিছু কথাবার্তা।
“তোমার ছোটবেলার জন্মদিনগুলো কেমন ছিল?” তন্ময় জিজ্ঞেস করে।
“ছোট ছিলাম,” মৃণালিনী বলে। “কিন্তু একটা বছর মনে আছে—বৃষ্টির দিনে বাবা আমাকে ছাতা না দিয়ে বলেছিল, ‘আজ ভিজে আস। মনে থাকবে।’ সেই ভেজা দিনটাই সবচেয়ে মনে আছে।”
তন্ময় চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তাহলে আজকের দিনটা মনে রাখার মতো হবেই।”
একটা পার্কের পাশে এসে দুজনে দাঁড়ায়। ভিতরে ভিজছে ঘাস, পাতা, বেঞ্চ। তারা ভিজতে ভিজতে একটা লোহার বেঞ্চে বসে পড়ে। তন্ময় পকেট থেকে একটা ছোট্ট চকোলেট বের করে দেয়।
“জন্মদিনে কেক না হোক, একটা মিষ্টি তো থাকা দরকার,” সে হেসে বলে।
মৃণালিনী চকোলেট নেয়, কিন্তু খায় না। শুধু তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, “তুমি জানো, নামগুলোও একসময় ভিজে যায়? যেমন এই ছাতার নিচে তুমি আমাকে ‘নন্দিনী’ বলেছিলে, আমি সেটা মনে রেখেছি। কিন্তু হয়তো সেটা আমার মধ্যেই কোথাও গলে গেছে।”
তন্ময় একটু থেমে বলে, “তাহলে বলো, তোমার মনে আমার নাম কী রেখেছ?”
“তন্ময় নয়,” মৃণালিনী বলে। “তুমি আমার গল্পে আছো ‘বর্ষ’ হয়ে—যে সবসময় আসে, সব ধুয়ে দেয়, আবার হারিয়েও যায়।”
তন্ময় মাথা নিচু করে হাসে। “বর্ষ… নামটা শুনে মনে হচ্ছে, আমি কোনো ঋতু, কোনো সময়, কোনো আবহাওয়া।”
“তাই তো,” মৃণালিনী বলে। “তুমি তো আমার জীবনে কোনো বিশেষ পরিচয়ে আসোনি। এসেছো একদিন, এক ছাতার নিচে। তাই তুমি সময়, তুমি বর্ষ।”
বৃষ্টি একটু কমে আসে। হালকা মেঘের পর্দা উঠছে, আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু বেঞ্চের নিচে জমে থাকা জলটা এখনো চুপচাপ।
তন্ময় তখন বলে, “আজ যদি বলি, আমি থাকতে চাই… এই বর্ষা শেষ হয়ে গেলে, ছাতা গুটিয়ে গেলে, শুকনো রোদ্দুরে… তখন?”
মৃণালিনী তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তার চোখে জল নেই, কিন্তু কণ্ঠটা কাঁপে, “থাকো। কিন্তু শর্ত একটাই—তুমি কোনো গল্প লিখবে না আমার নামে। শুধু থেকো, নিঃশব্দে। যেমন ছায়া থাকে গাছের নিচে।”
তন্ময় মাথা নাড়ে। এই মেয়েটির সমস্ত অস্তিত্ব যেন কবিতার মতো—উচ্চারণ না করলেও বোঝা যায়।
দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। এবার ছাতা খোলে তন্ময়। কিন্তু হঠাৎই সে থেমে যায়। ছাতাটা মাটিতে রাখে।
এইবার, তারা দুজনেই ভিজে হাঁটে—নামহীন হয়ে, গল্পহীন হয়ে, শুধু এক জন্মদিনের সকালকে নিজের মতো করে বয়ে নিয়ে।
পর্ব ৬: বৃষ্টির শব্দ, নীরবতার গান
মৃণালিনী আর তন্ময় এখন নিয়মিত দেখা করে। কিন্তু ‘ডেট’ বলে কিছু নেই। কফি শপে নয়, মাল্টিপ্লেক্সেও নয়—তাদের দেখা হয় হরিশ মুখার্জি রোডের বইয়ের দোকানের পাশের সিঁড়িতে বসে, বা গঙ্গার ঘাটে ভিজে কাঠের বেঞ্চে। তারা কথা বলে না খুব একটা, অথচ সেই নীরবতাও যেন গানে ভরে ওঠে।
এক বিকেলে তারা যায় নন্দন চত্বরের পিছনে, যেখানে থিয়েটারের কিছু পোস্টার আর রিহার্সালের শব্দ মিশে থাকে বাতাসে। সেখানে বসে তন্ময় বলল, “আজ একটা শব্দ শুনলাম—‘অভিমান’। এটা আসলে ঠিক কীরকম অনুভব জানো?”
মৃণালিনী হালকা হেসে বলল, “অভিমান মানে হল—কাউকে যতটা ভালোবাসো, ঠিক ততটাই চুপ করে থাকো তার সামনে। কথাগুলো মনে মনে বলো, মুখে না বলাই অভিমান।”
তন্ময় বলে, “তাহলে আমরা কি একে অপরের প্রতি অভিমান করবো কোনোদিন?”
“আমরা?” মৃণালিনী চায়ের কাপটা ঘুরিয়ে বলল, “আমরা তো কিছু নই… অথচ সব। আমাদের মাঝে নাম নেই, সম্পর্ক নেই। তবু একটা ছাতার নিচে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটা মুছে যায় না।”
সেদিন তারা আলাদা হল অদ্ভুত এক নিরবতায়। তন্ময় কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। মৃণালিনী তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।
তন্ময় বাড়ি ফিরে লেখে, “তোমার নীরবতা আমার কানে বৃষ্টির মতো ঝরে, আমি জানি না তুমি কী বলো, তবু শুনতে থাকি।”
এরপর কয়েকদিন দেখা হয় না। না কোনো অভিমান, না কোনো সমস্যা—শুধু সময়ের ফাঁকে একটুখানি দূরত্ব জমে। সেই জমে থাকা সময়ের মধ্যে তন্ময় অনুভব করে, মৃণালিনী একটা ধাঁধা—যাকে যতই চেনার চেষ্টা করো, সে ততটাই নতুন হয়ে ওঠে।
অবশেষে এক রবিবার দুপুরে, আবার দেখা হয়। আজ আর বৃষ্টি নেই। মেঘও নেই।
তারা দুজনেই বসল গঙ্গার ধারে। সামনে জল বয়ে যাচ্ছে, আর মাঝেমাঝে হাওয়ায় উড়ছে পাতাঝরা গাছের ছায়া।
তন্ময় বলে, “আজ খুব সাধারণ দিন। কোনো বিশেষ অনুভব নেই, কোনো বিশেষ আবহাওয়া নয়।”
মৃণালিনী হাসে। “সবসময় নাটকীয় হতে নেই। কিছু কিছু দিন থাকে, যারা গল্প নয়—শুধু সঙ্গী। তাদের পাশে বসে থাকা যায়।”
তন্ময় জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এই দিনটা আমাদের জন্য কী?”
“একটা অপেক্ষা,” মৃণালিনী বলে। “বৃষ্টিহীন অপেক্ষা। যেমন ছাতা ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা—জানি আজ বৃষ্টি হবে না, তবু ছাতা সঙ্গে আনি, যদি হঠাৎ নামে।”
তন্ময় এবার চুপ করে যায়। তার মনে হয়, সে একটা অসমাপ্ত কবিতার মাঝে বসে আছে, যেখানে প্রতিটি শব্দ আসছে, কিন্তু শেষ লাইনে এসে থেমে যাচ্ছে।
তারা দুজনেই জানে, গল্পটা চলবে না হয়তো চিরকাল, কিন্তু আজকের এই নিরীহ দিনটাও একটা সোনালি পাতার মতো—জমে থাকবে স্মৃতির খাতায়।
তন্ময় মৃদু গলায় বলে, “তুমি জানো, আমি গল্প লিখতে গিয়ে ভুলে গেছি শেষ লিখতে। কারণ মনে হয়, কিছু গল্প শেষ হওয়ার জন্য নয়। তারা শুধু থেমে থাকে, অপেক্ষা করে, আবার হাঁটে।”
মৃণালিনী তাকায়। তারপর শুধু বলে, “আমরা যদি থেমেও যাই কোনো একদিন, আজকের মতো এমন একটা দিন মনে রেখো—যেখানে আমরা কেবল নীরব ছিলাম, কিন্তু একসাথে।”
গঙ্গার ঢেউ ছোট্ট শব্দ তোলে। পেছনে থিয়েটারের গান ভেসে আসে—একটা পুরোনো নাটকের রিহার্সাল চলছে।
তারা চুপ করে থাকে। আজ কোনো ছাতা নেই। শুধু একটানা, শব্দহীন বৃষ্টির মতো অনুভব, যা ভিতর থেকে ভিজিয়ে দেয়—জল ছাড়াও।
পর্ব ৭: ছায়ার নিচে রোদ
পুজোর ঠিক আগের সন্ধে। শহরটা কেমন উৎসবের গন্ধে ভরে উঠছে—আলোর ঝালর, গানের রিহার্সাল, চায়ের দোকানে আলু চপের সাথে গল্পের গরম ভাপ। অথচ এই সবকিছুর মাঝেও তন্ময়ের ভিতরে যেন কোনো উৎসব নেই।
মৃণালিনীর ফোন আসা বন্ধ। মেসেজে রিপ্লাই নেই। একদিন, দুই দিন, চার দিন। তন্ময় শুরুতে ভাবছিল হয়তো ব্যস্ত—তারপর ধীরে ধীরে সেই অজানা ভয় এসে গলায় আটকে বসে।
শেষবার তারা দেখা করেছিল গঙ্গার ধারে—চুপ করে বসে ছিল। তারপরও কিছু বাক্য অপ্রকাশিত রয়ে গেছিল।
তন্ময় ঠিক করে, অপেক্ষা না করে এবার খুঁজে বের করবেই। সে একদিন হঠাৎ চলে যায় সেই চাকরি-ইন্টারভিউর বিল্ডিংয়ের সামনে, যেখানে প্রথম মৃণালিনীর সঙ্গে ছাতা ভাগ করেছিল।
কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কেবল বৃষ্টি পড়ে হালকা, ঝিরঝিরে। একটা অটো দাঁড়িয়ে থাকে মোড়ে—ড্রাইভার হুট করে বলে, “ওই মেয়ে তো সেদিন ছাতাটা ফেলে রেখে চলে গেছিল। মনে আছে আমার।”
তন্ময় চমকে যায়। ছাতা? তার তো ছাতাটা তার কাছেই। তবে কি…
সে অস্থির হয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখে, মৃণালিনীর প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভ। হোয়াটসঅ্যাপেও শেষ দেখা ‘two weeks ago’।
পুজো আসে, চলে যায়। শহর আলোয় ভরে যায়, কিন্তু তন্ময়ের ভেতরে ছায়া জমে।
অবশেষে দশমীর পরদিন এক বইমেলায়, হঠাৎ করেই মুখোমুখি হয় দুজন।
মৃণালিনীর চোখে অবাকি নেই। যেন জানত দেখা হবে। পরনে সাদা জামদানি, গলায় একটা কালো পুঁতির মালা, চোখে সেই পুরোনো শান্ত ক্লান্তি।
তন্ময় বলে, “তুমি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে কেন?”
মৃণালিনী হালকা হেসে বলে, “কিছু অদৃশ্যতা প্রয়োজন হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে সে আদৌ দেখছিল কি না। আমি যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখছিলে তো?”
তন্ময় গলা নিচু করে বলে, “আমি শুধু দেখিনি, আমি গল্প হয়ে গেছি।”
“আর আমি,” মৃণালিনী বলে, “গল্প থেকে বেরিয়ে এসেছি। বুঝেছো তন্ময়, সব গল্পে থাকা যায় না। কিছু গল্প শুরু হয় ঠিকভাবে, কিন্তু শেষটা খালি রাখলে সেটাই সবচেয়ে সত্যি থাকে।”
তন্ময় চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “তাহলে এবার গল্পটা আমিই শেষ করব। ছাতা আমার কাছে, মনে রাখার দায়ও আমার।”
মৃণালিনী হাসে। তারপর হঠাৎ বলেই ফেলে, “আমি বিয়েটা ঠিক করেছি। ছেলেটা আমার ছোটবেলার বন্ধু। খুব সাধারণ, খুব বাস্তব। কিন্তু তাতে একধরনের শান্তি আছে।”
তন্ময় মাথা নাড়ে। মৃদু গলায় বলে, “তাহলে এই ছাতার নিচে একদিনটাই রইল। একদিন, একটা দুপুর, একটা গল্প। যা আসলে বৃষ্টি না, রোদ ছিল। কিন্তু আমরা তখন বুঝিনি।”
মৃণালিনী এবার কিছু বলে না। শুধু একবার তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে ভিড়ের ভেতর মিশে যায়।
তন্ময় একা দাঁড়িয়ে থাকে বইয়ের স্টলে। চারপাশে উৎসব, আলো, শব্দ। তার হাতে একটা পুরোনো ছাতা। হয়তো ভিজবে না আর কোনোদিন, তবু সেই ছাতার নিচে একদিন ছিল—সবকিছু।
পর্ব ৮: শেষ বৃষ্টি, নাকি শুরু?
তন্ময় ঠিক জানে না, কতদিন কেটে গেছে। সময় এখন ক্যালেন্ডারের পাতায় নয়, স্মৃতির ঘন ছায়ায় গুনতে হয়। মৃণালিনী আর ফিরে আসেনি। আর কোনো ফোন, কোনো মেসেজ, কোনো হঠাৎ দেখা নয়। কিন্তু ছাতাটা সে রেখে দিয়েছে, এক কোণে—মাথার উপর তুলে নয়, বুকের ভিতরে টেনে।
জানুয়ারির এক বিকেল। কলকাতার আকাশে মেঘ নেই, কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে। তন্ময় আজ অনেকদিন পর ফিরে এসেছে সেই প্রথম দেখা হওয়া বাস স্টপটায়। পাশেই চায়ের দোকান, সামনে ট্রামলাইন, আর পেছনে ধুলো জমা ধোঁয়াটে শহর।
সে এক কাপ লাল চা নেয়। কাগজের কাপটা হাতে নিয়ে হঠাৎ সেই দিনের কথাটা মনে পড়ে যায়—যেদিন এক অচেনা মেয়ে বলেছিল, “ধরতে পারি।” আর সেই ধরার মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক অনুভূতির ছায়াঘর।
তন্ময় আর নতুন কোনো গল্প লিখতে পারে না। বহু চেষ্টা করে, কলমে শব্দ আসে না। চরিত্রেরা জেগে ওঠে, কিন্তু মৃণালিনীর চোখের মতো নিরুত্তাপ আর গভীর কেউ আর তৈরি হয় না।
তবে একদিন…
একদিন, বসন্তের হালকা গরম হাওয়া বইছে যখন, এক লাল রঙের ট্রামে সে চোখে পড়ে—একটা মুখ। দূর থেকে কিছুটা অস্পষ্ট, তবু ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে রঙ নেই, কিন্তু মুখটা আগের মতোই—একটা ধোঁয়াটে নির্ভরতার ছবি।
মৃণালিনী।
তন্ময় হেঁটে যায় ট্রামের দিকে, ছুটে নয়, ধীরে। ট্রাম তখন চলতে শুরু করেছে। কিন্তু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়ে তাকিয়ে থাকে।
এইবার ছাতা নেই কারো হাতে। বৃষ্টি নেই। এমনকি কোনো শব্দও নেই।
তন্ময় শুধু চোখে বলে ফেলে, “তুমি ভালো আছ তো?”
আর মৃণালিনী, একটুও না হেসে, না কেঁদে, শুধু মাথা নাড়ে—একটা হালকা হ্যাঁ।
ট্রাম দূরে চলে যায়।
তন্ময় দাঁড়িয়ে থাকে। এবার বুকের ভিতরটা হালকা লাগে।
না, সে আর খুঁজবে না। অপেক্ষা করবে না। শুধু জানে—একটা গল্প যেমন হঠাৎ এক ছাতার নিচে শুরু হয়, তেমনই একদিন বৃষ্টি ছাড়াই শেষও হয়ে যায়। কিন্তু শেষ মানেই তো সবসময় বিদায় নয়।
কখনো কখনো, একদিনের ছায়ায় সারা জীবনের রোদ লুকিয়ে থাকে।
শেষ




