সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতার শহরে শেষ বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে। একটা ছেঁড়া ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখটা দেখল শুভ্র। ২০শে জুলাই। বিখ্যাত অ্যাপোলো ১১-র মিশনের দিন। এই দিনটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য। নাসা থেকে নিয়ে আসা আসল ‘মুন রক’, অর্থাৎ চাঁদের পাথর। শুভ্র হাতের ক্যামেরাটা ভালোভাবে চেপে ধরল। সাংবাদিকতার জীবনে এমন দিন খুব কম আসে। কলকাতায় চাঁদের পাথর দেখতে এত মানুষের ভিড় দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। সিকিউরিটির বিশাল ব্যবস্থা। পুলিশের উঁচু অফিসার থেকে সাধারণ দর্শনার্থী—সবাই আসছে দেখতে। “দেখে নে শুভ্র, এই পাথরের জন্য ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছিস তুই,” পেছন থেকে শুভ্রর বন্ধু অর্ণব এসে চাপা গলায় বলল। অর্ণব গোয়েন্দা বিভাগের তরুণ অফিসার। আজকের নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব তার ওপরেই। “সব ঠিক আছে তো?” শুভ্র প্রশ্ন করল। “ঠিক থাকতেই হবে,” বলে দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল অর্ণব। শুভ্র বাইরে দাঁড়িয়েই দর্শকদের লাইন আর পাথরের প্রদর্শনীর ছবি তুলতে থাকল। প্রদর্শনী হলে তখন চরম উত্তেজনা। গ্লাস বক্সের ভেতরে রাখা সেই ছোট্ট পাথরটা। নীলচে ধূসর, অদ্ভুত উজ্জ্বল এক টুকরো রহস্য। হাজার হাজার চোখ তার ওপর স্থির। দর্শনার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। “সত্যিই কি এই পাথরটা চাঁদের?” শুভ্রর পাশে দাঁড়ানো একজন দর্শক প্রশ্ন তুলল। “নিশ্চয়ই,” হাসিমুখে উত্তর দিল শুভ্র। এই সময় হঠাৎ হলের সব আলো নিভে গেল। কয়েক মুহূর্তের অন্ধকার। তারপরে আবার আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু এবার সেই আলোর মধ্যে সবাই দেখল গ্লাস বক্সটা খোলা। চাঁদের পাথর গায়েব। মুহূর্তেই হলটা কোলাহলে ফেটে পড়ল। দর্শনার্থীদের ভিড়ে আতঙ্ক। শুভ্রও নিজের ক্যামেরাটা শক্ত করে ধরে রেখেছে, আর ভাবছে—কীভাবে সম্ভব? এই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে থেকে একটা মহামূল্যবান পাথর কীভাবে উধাও হতে পারে? পুলিশ এসে পৌঁছেছে। অর্ণব ছুটে এসে শুভ্রর পাশে দাঁড়াল। মুখে আতঙ্কের ছায়া। “কীভাবে সম্ভব এটা?” অর্ণব হতবুদ্ধি হয়ে বলল। “আমিও সেটাই ভাবছি,” শুভ্র বলল। “কেউ কি গ্লাসটা ভেঙেছে?” অর্ণব প্রশ্ন করল পাশে থাকা একজন কর্মচারীকে। “না স্যার,” সে উত্তরে বলল। “গ্লাস একেবারেই ঠিক আছে। লকও ভাঙেনি। কিন্তু পাথরটা নেই!” শুভ্র মনোযোগ দিয়ে ক্যামেরার ছবি দেখতে থাকল। অন্ধকার হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে তোলা ছবিগুলো দেখছে। হঠাৎ একটা ছবিতে তার চোখ আটকে গেল। সেই ছবিটা জুম করে দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। একজন মানুষের হাতের ছায়া পড়েছে কাচের ওপর। খুবই সূক্ষ্ম ছায়া, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই মানুষটিই নিশ্চয়ই পাথরটা নিয়েছে। “অর্ণব, এটা দেখ!” শুভ্র ফোনের স্ক্রিনটা বাড়িয়ে দিল। অর্ণব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল। “এটা কি…?” “হ্যাঁ,” শুভ্র বলল। “পাথরটা যে নিয়েছে, এটা তারই হাতের ছায়া।” অর্ণব দ্রুত ফোনটা নিজের কাছে নিয়ে অফিসারদের নির্দেশ দিল। চারদিকে চাঞ্চল্য বেড়ে গেল। সবাই দ্রুত বেরোতে গিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেছে। শুভ্র ভাবল, এই চাঁদের পাথরের রহস্যের শেষ কোথায়? কে নিল, কেন নিল, কীভাবে নিল? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছে তার। এই একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেন জীবনটাই বদলে গেল। এতদিন সাধারণ খবরের পেছনে ছুটেছে সে, এবার যেন ইতিহাসের পেছনে ছুটতে হবে। বেরিয়ে আসতেই দেখল, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পরিচিত একটা মুখ। সদানন্দ পাল। বিখ্যাত কসমিক সায়েন্টিস্ট। আজকের প্রদর্শনীর বিশেষ অতিথি। কিন্তু তার মুখে কোনো আতঙ্কের ছাপ নেই। বরং হালকা এক হাসি যেন লুকিয়ে আছে ঠোঁটের কোণে। শুভ্র চুপ করে তাকে দেখতে লাগল। এক মুহূর্ত চোখাচোখি হতেই সদানন্দ মুখ ফিরিয়ে নিলেন। শুভ্র মনে মনে একটা সন্দেহের চিহ্ন তৈরি করল। এতবড় একটা দুর্ঘটনার মধ্যে সদানন্দের নির্লিপ্ততা সন্দেহজনক। এর মধ্যেই অর্ণব শুভ্রর কাছে এসে বলল, “সাথে থাক শুভ্র, তোকে লাগবে এই তদন্তে।” শুভ্র মাথা নেড়ে সায় দিল। আজকের রাতটা লম্বা হবে। কলকাতার বুকের গভীরে যে রহস্যটা আজ জন্ম নিল, তা সহজে ফুরোবে না। আজকের রাতেই শুরু হবে এক দীর্ঘ অভিযানের। যেখানে বিজ্ঞানের সাথে জড়িয়ে আছে অপরাধ। ইতিহাসের গহ্বর থেকে উঠে আসবে এমন কিছু সত্য, যা কলকাতার সবাইকে অবাক করে দেবে। অন্ধকারের বুক চিরে জেগে উঠবে চাঁদের পাথরের চুরির রহস্য।
প্রদর্শনী হলে বিশৃঙ্খলা তখন তুঙ্গে। শুভ্র এক কোণে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। পুলিশ একের পর এক দর্শনার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তাদের মধ্যে কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না। এমন নিখুঁতভাবে চুরিটা হলো কীভাবে? পুলিশ এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই ব্যস্ত। কিন্তু শুভ্রের মনের মধ্যে তখন সদানন্দ পালের নির্লিপ্ত মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। সদানন্দ পাল একজন প্রখ্যাত কসমিক সায়েন্টিস্ট। বিশ্বের বহু বড় বড় গবেষণার সঙ্গে যুক্ত মানুষটি। এমন একজন মানুষ কি সত্যিই একটা ছোট্ট পাথরের জন্য এত বড় ঝুঁকি নেবেন? “তুই কিছু ভাবছিস?” পাশে এসে দাঁড়াল অর্ণব। “সদানন্দ পালকে দেখে কিছু একটা যেন খটকা লাগল।” শুভ্র সতর্ক গলায় বলল। “তাঁকে সন্দেহ করছিস? তিনি তো আমাদের দেশের গর্ব,” বলল অর্ণব। “হয়তো। কিন্তু তার অদ্ভুত ব্যবহারটা…” শুভ্র দ্বিধান্বিত স্বরে বলে চুপ করল। “ঠিক আছে, তাঁর ওপরও নজর রাখা যাবে,” অর্ণব দ্রুত কিছু নোট করল। রাত গভীর হয়ে আসছে। দর্শনার্থীদের ভিড় ধীরে ধীরে কমছে। সাংবাদিকদের ভিড় বাড়ছে। সবাই জানতে চায়, চাঁদের পাথরের মতো দুর্লভ জিনিস এই শহর থেকে কোথায় গেল? শুভ্র নিজের ক্যামেরার ছবিগুলো আবার ভালো করে দেখতে শুরু করল। সেই হাতের ছায়াটার দিকে বিশেষ নজর দিল। খুব সাধারণ, কোনও বিশেষত্ব নেই। তবুও, কীভাবে এত দ্রুত? হঠাৎই পেছনে একটা কণ্ঠস্বর শুনে শুভ্র চমকে উঠল। “আপনিই কি শুভ্র সেন?” শুভ্র ঘুরে দাঁড়াল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। চোখে ভারী চশমা, মাথার চুল প্রায় পেকে এসেছে। হাতে একটা কালো ব্যাগ। “হ্যাঁ, আমি। কিন্তু আপনি…?” “আমি নীলাদ্রি বোস। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করি। সদানন্দ স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি অনেকদিন। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।” শুভ্র একটু অবাক হয়ে বলল, “আমার সঙ্গে?” “হ্যাঁ, কিন্তু এখানে নয়। নিরাপদ জায়গায় চলুন।” শুভ্র সামান্য ইতস্তত করল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “চলুন।” প্রদর্শনী হল থেকে বেরিয়ে তারা একটা ছোট কফি শপে গিয়ে বসলো। নীলাদ্রি চারদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বললেন, “আপনি সদানন্দ স্যারকে সন্দেহ করেছেন, তাই না?” শুভ্র একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। “না, মানে আমি ঠিক…,” সে গুছিয়ে কিছু বলার আগেই নীলাদ্রি হাত তুলে বললেন, “না, আপনার সন্দেহ করা স্বাভাবিক। কিন্তু জানেন কি, চাঁদের পাথর নিয়ে স্যারের দীর্ঘদিনের একটা অবসেশন ছিল।” “অবসেশন?” “হ্যাঁ। নাসার অ্যাপোলো মিশনে স্যার কাজ করেছেন। চাঁদের পাথরের ওপর গবেষণা ছিল তাঁর প্রধান বিষয়। হঠাৎ একদিন নাসা তাঁকে বাদ দেয়। স্যার খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। চাঁদের পাথরটা নিজের কাছে রাখতে পারলে তাঁর গবেষণাটা সম্পূর্ণ হত।” শুভ্র স্তব্ধ হয়ে শুনল কথাগুলো। “আপনার মনে হয়, তিনিই চুরি করেছেন?” “আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু স্যারের হঠাৎ এই প্রদর্শনীতে আগ্রহ দেখানো আর আজকের ঘটনার পর তাঁর হাসিটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছে।” “আপনি কেন এসব আমাকে বলছেন?” “কারণ আপনিই প্রথম এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। পুলিশ হয়তো বুঝবে না, কিন্তু আপনি পারেন সত্যিটা বের করতে।” “সদানন্দ পাল ছাড়া আর কারও প্রতি আপনার সন্দেহ আছে?” নীলাদ্রি চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “আছে। প্রদীপ সরকার। স্যারের প্রাক্তন ছাত্র। অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু উগ্র। বছর কয়েক আগে ল্যাব থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ওকে। এই প্রদর্শনীতে তাকেও দেখেছি।” শুভ্র দ্রুত নোট করে নিল। “আপনি কি স্যারের সাথে কথা বলতে পারবেন?” শুভ্র জানতে চাইল। “কঠিন, কিন্তু চেষ্টা করব। তবে সাবধানে থাকবেন। এই রহস্য গভীর, এবং যাঁরা জড়িত তাঁরা বিপজ্জনক।” নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ালেন। “আপনার সাথে পরে আবার দেখা হবে।” শুভ্রও উঠে দাঁড়াল। ঘড়িতে দেখল রাত একটা বাজতে চলেছে। বাড়ি ফিরতে গিয়েও ভাবল, আগে অর্ণবকে সব জানিয়ে দেবে। কফি শপ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্ণবকে ফোন করল সে। ফোন রিসিভ হতেই অর্ণব তাড়াহুড়ো করে বলল, “শুভ্র, তুই কোথায়?” “একটা জরুরি তথ্য পেয়েছি।” “এখনই থানায় চলে আয়। বড় ঘটনা ঘটে গেছে।” “কী হয়েছে আবার?” “সদানন্দ পালকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” শুভ্রর বুক ধক করে উঠল। ফোন রেখে দ্রুত থানার দিকে ছুটল। থানায় পৌঁছে দেখল অর্ণব তখনও উদ্বিগ্ন। “কী হয়েছে?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল। “সদানন্দ পাল বাড়ি ফেরেননি। ফোন সুইচড অফ। তাঁর বাড়িতে একটা নোট পাওয়া গেছে।” “কী লেখা তাতে?” “শুধু লেখা, ‘সত্য চিরকাল গোপন থাকে না’।” শুভ্র থমকে গেল। এত বড় একজন বিজ্ঞানী হঠাৎ গায়েব হয়ে যাবেন? “তুই কী তথ্য পেয়েছিস?” অর্ণবের প্রশ্নে শুভ্র নীলাদ্রি বোসের কথাগুলো জানাল। অর্ণব গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। “এটা সত্যিই খুব জটিল। আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে।” শুভ্র মাথা নাড়ল। রাতের কলকাতা তখন গভীর রহস্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। যে চাঁদের পাথর এই শহরের ইতিহাসকে বদলে দিল, তার রহস্যের গভীরে এখন তারা দুজন দাঁড়িয়ে। সামনে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর সত্য।
সদানন্দ পালের নিখোঁজ হওয়ার খবরে কলকাতার বিজ্ঞান মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সকাল থেকেই সংবাদমাধ্যমের ভিড় তাঁর বাড়ির সামনে। শুভ্র ও অর্ণব দুজনেই পৌঁছেছে সদানন্দের সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে। বিশাল বড়ো দোতলা বাড়ি, চমৎকার লন, কিন্তু চারদিকে কেমন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। বাড়ির ভেতরে পুলিশ তখন তল্লাশি চালাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই শুভ্রের চোখে পড়ল—বুকশেলফ ভর্তি বই, বেশিরভাগই জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণার ওপর। দেওয়ালে অ্যাপোলো ১১ মিশনের পুরোনো কিছু ছবি। সদানন্দের গবেষণার টেবিলের ওপর তখনও খোলা নোটবই, কিছু খসড়া কাগজ ছড়িয়ে। শুভ্র মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা বিশেষ কাগজের দিকে তার চোখ আটকে গেল। সেখানে ইংরেজিতে লেখা—”It’s closer than you think.” শুভ্র অবাক হয়ে কাগজটা তুলে নিল। “কী পেলে কিছু?” অর্ণব কাছে এসে জানতে চাইল। “দেখ এই কাগজটা। খুব অদ্ভুত কথা লেখা আছে।” অর্ণব দেখে কপাল কুঁচকে বলল, “Closer than you think? কী বোঝাতে চেয়েছেন উনি?” “হয়তো চাঁদের পাথরের ব্যাপারে কিছু বলছেন,” শুভ্র চিন্তিত মুখে বলল। বাড়ির কেয়ারটেকার, হরিশচন্দ্র গাঙ্গুলি, একজন প্রবীণ ভদ্রলোক, এতক্ষণ এক কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। শুভ্র তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি শেষ কখন দেখেছেন সদানন্দ বাবুকে?” বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন, “কাল সন্ধ্যায় প্রদর্শনী থেকে ফিরে এসেছিলেন। বেশ খানিকটা উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। বললেন, ‘হরিশ, আমার জীবনের গবেষণা আজ সম্পূর্ণ হবে।’ এরপর রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।” “তারপর?” “তারপর রাতে একবার ফোনে কারও সঙ্গে খুব জোরে কথা বলছিলেন। কার সঙ্গে তা বুঝিনি। ভেবেছিলাম, সকালে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু ভোরবেলা উঠে দেখি উনি নেই।” শুভ্র দ্রুত নোট নিল। ফোন কলটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অর্ণব পুলিশ অফিসারদের ফোন রেকর্ডস বের করার নির্দেশ দিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে শুভ্র চিন্তা করতে লাগল—সদানন্দ পাল যদি সত্যিই নির্দোষ হন, তবে পালালেন কেন? আর যদি তিনিই এই রহস্যের কেন্দ্রে থাকেন, তাহলে তাঁর উদ্দেশ্য কী? সদানন্দ কি একাই কাজ করছেন, নাকি তাঁর সাথে অন্য কেউ জড়িত? ভাবতে ভাবতেই শুভ্রের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে অচেনা একটা নম্বর। “হ্যালো?” শুভ্র ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে একটা গভীর, ভারী গলা বলে উঠল, “মিস্টার শুভ্র সেন?” “হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?” “আমার পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনার সাথে একটা জরুরি আলোচনা আছে। এক ঘণ্টার মধ্যে ইকো পার্কে আসুন।” “কেন? কী ব্যাপারে?” “চাঁদের পাথরের ব্যাপারে। সদানন্দ পাল সম্পর্কে কিছু তথ্য পাবেন।” ফোন কেটে গেল। শুভ্র দ্রুত অর্ণবকে বিষয়টা জানাল। অর্ণব সতর্ক করল, “সাবধান, এটা ফাঁদও হতে পারে।” “কিন্তু তথ্য তো দরকার,” শুভ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। “আমি যাব।” “ঠিক আছে, তবে আমিও কাছাকাছি থাকব।” এক ঘণ্টার মধ্যে শুভ্র পৌঁছল ইকো পার্কে। বিকেলের আলোয় পার্কে ভিড় কম। চারদিকে গাছপালা, দূরে কিছু লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। শুভ্র অপেক্ষা করছিল, হঠাৎ তার কাঁধে হাত দিয়ে কেউ একজন বলল, “আমার সঙ্গে আসুন।” শুভ্র চমকে তাকিয়ে দেখল, কালো জ্যাকেট পরা একজন দীর্ঘদেহী যুবক। মুখে হালকা দাড়ি। চোখে গাঢ় চশমা। শুভ্র কিছু বলার আগেই যুবকটি তাকে নিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায় চলে এল। “কে আপনি?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল। “আমি প্রদীপ সরকার। সদানন্দ পালের ছাত্র ছিলাম।” নাম শুনে শুভ্র চমকে উঠল। “আপনাকেই তো সন্দেহ করা হচ্ছে।” প্রদীপ ম্লান হেসে বলল, “জানি। কিন্তু আমি নির্দোষ। আসল ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন না। সদানন্দ স্যারও নির্দোষ।” “তাহলে দোষী কে?” “যারা সত্যিটা লুকিয়ে রাখতে চায়।” “কী সত্যি?” “চাঁদের পাথর শুধু গবেষণার জন্য নয়, এর মধ্যে এমন একটা উপাদান আছে, যা নিয়ে পৃথিবীর বড় শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। সদানন্দ স্যার এই রহস্যটা জেনে গিয়েছিলেন।” শুভ্রর মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। “আপনি কীভাবে জানলেন এসব?” “স্যার নিজেই আমাকে বলেছিলেন। গতকাল রাতে তিনিই ফোন করেছিলেন আমাকে। বললেন, ওরা তাঁর পেছনে লেগেছে। পালাতে হবে।” “কাদের কথা বলছেন?” “বিদেশি একটা সংস্থা। এই পাথর থেকে বিপুল শক্তির উৎস বের করতে চায়। স্যার তা হতে দিতে চাননি। এই কারণেই তাঁকে সরানো হয়েছে।” “সরানো হয়েছে?” শুভ্র আঁতকে উঠল। “আপনি কি বলতে চাইছেন স্যারকে অপহরণ করা হয়েছে?” প্রদীপ গম্ভীর মুখে বলল, “হ্যাঁ, তাঁর জীবন এখন বিপদে।” “তাহলে এখন কী করবেন?” “আপনার সাহায্য দরকার। স্যার বলেছিলেন, যদি তাঁর কিছু হয়, তবে আপনাকে যেন বলি—’সমাধান কাছাকাছি, খুঁজলেই পাবে।'” শুভ্র মাথা ঘুরিয়ে নিল। সদানন্দের ঘরে পাওয়া কাগজটার কথা তার মনে পড়ল—’Closer than you think’। এই বার্তার সঙ্গে কি কোনও সম্পর্ক আছে? “আর একটা কথা,” প্রদীপ বলল, “স্যার শেষবার আমাকে একটা বিশেষ জায়গার কথা বলেছিলেন।” “কোথায়?” “শ্যামবাজারের পুরোনো লাইব্রেরি।” প্রদীপ দ্রুত উঠে দাঁড়াল। “আমাদেরকে দ্রুত সেখানে যেতে হবে। সময় কম। ওরাও সেখানে পৌঁছে যাবে।” শুভ্র দ্বিধায় পড়ল না। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে প্রদীপের সাথে এগোতে লাগল। পিছনে তখন ছায়ার মতো অনুসরণ করছে অর্ণব। ইকো পার্কের বিকেলের আলো মুছে আসছে ধীরে ধীরে। সামনে রহস্য, পেছনে বিপদ। তাদের পথ এখন অনিশ্চয়তার দিকে।
শ্যামবাজারের পুরোনো লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়াল শুভ্র ও প্রদীপ। সন্ধ্যার আলো ততক্ষণে কলকাতার রাস্তায় হালকা অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছে। ধুলোমাখা এই লাইব্রেরিটা বহুদিন ধরেই বন্ধ। গেটের তালায় মোটা একটা জং পড়েছে। “এখানে কী পাবেন মনে হয়?” শুভ্র উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল। “স্যার বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরির গোপন ঘর’। আমি নিশ্চিত এখানে কিছু একটা পাওয়া যাবে,” প্রদীপ দৃঢ়স্বরে বলল। তালাটা দেখে প্রদীপ একটু ভেবে পকেট থেকে ছোট্ট একটা পেনের মতো বস্তু বার করল। শুভ্র অবাক চোখে দেখল, পেনের মতো বস্তুটা তালায় ঢোকাতেই তালাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। “কী ছিল এটা?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল। “ইলেকট্রনিক লক পিক,” প্রদীপ সংক্ষেপে বলল। ভেতরে ঢুকে দুজনেই লাইব্রেরির হাল দেখে স্তম্ভিত। চারদিকে ছেঁড়া বই, ধুলো আর মাকড়সার জাল। বইয়ের গন্ধ আর পুরোনো কাঠের গন্ধ মিলিয়ে ভারী একটা বাতাস। প্রদীপ চারপাশটা ভালো করে দেখে হঠাৎ একটা দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে একটা বিশাল বুকশেলফ, কিছু বই এখনও রাখা। প্রদীপ দ্রুত বইগুলোর শিরোনাম লক্ষ্য করতে থাকল। “কিছু পেলেন?” শুভ্র জিজ্ঞাসু হয়ে বলল। প্রদীপ একটা মোটা বইয়ের দিকে ইশারা করল। “দেখুন, এখানে লেখা ‘The Moon and Beyond’।” বইটা হাতে তুলে টানতেই একটা ধাতব শব্দ হলো। মুহূর্তেই শেলফটা সরে গিয়ে ভেতরে একটা ছোট্ট ঘরের প্রবেশপথ উন্মুক্ত করল। শুভ্র বিস্ময়ে হতবাক। “গোপন ঘর!” প্রদীপ তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে পড়ল। ছোট্ট ঘরটা খুব সরু, ভেতরে একটা ছোট টেবিল আর তার ওপর একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কটা খুলতেই ভেতরে পেল কয়েকটা হলুদ কাগজ, একটা পুরোনো ফটোগ্রাফ, আর একটা ছোট্ট ধাতব বাক্স। শুভ্র কাগজগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করল। ইংরেজিতে লেখা কিছু গবেষণাপত্র—সবগুলোই চাঁদের পাথর নিয়ে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল ছবিটাতে। সেখানে সদানন্দ পাল এবং আরও তিনজন বিদেশি গবেষক। ছবির পেছনে তারিখ লেখা—১৯৬৯। “অ্যাপোলো ১১-র বছর!” শুভ্র বলল। “স্যার তখন নাসায় ছিলেন,” প্রদীপ যোগ করল। “এই বিদেশিদের চেনেন?” “না, এদের আগে দেখিনি।” শুভ্র এবার ধাতব বাক্সটা খুলল। ভেতরে একটা ছোট কাচের টিউব, যার মধ্যে রাখা অদ্ভুত উজ্জ্বল এক টুকরো পাথর। দুজনেই মুহূর্তে বুঝল—এটা চাঁদের পাথরের একটা অংশ। “এটা কীভাবে এখানে এল?” শুভ্র অবাক গলায় বলল। “স্যার নিশ্চয়ই বহু আগেই লুকিয়ে রেখেছিলেন,” প্রদীপ বলল। ঠিক তখনই বাইরে থেকে হালকা শব্দ শোনা গেল। দুজনেই চমকে উঠল। “কেউ এসেছে,” শুভ্র ফিসফিস করে বলল। দ্রুত তারা গোপন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু সামনে এসে দেখল, লাইব্রেরির ভেতরে তখন কয়েকজন মুখোশ পরা লোক। তাদের হাতে বন্দুক। “টিউবটা আমাদের দিয়ে দিন,” একজন গম্ভীর স্বরে আদেশ দিল। “কেন দেব?” প্রদীপ শক্তভাবে বলল। “কারণ, আপনাদের আর কোথাও যাওয়ার রাস্তা নেই,” মুখোশধারী লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল। শুভ্র পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত বলল, “এটা নিয়ে আপনারা কী করবেন?” “তা আপনার না জানলেও চলবে,” লোকটা বন্দুকটা তুলে ধরল। “এখনি দিন!” ঠিক তখনই হঠাৎ বাইরে থেকে একটা তীব্র সাইরেনের শব্দ ভেসে এল। পুলিশ এসে গেছে! মুখোশধারীরা হঠাৎ ঘাবড়ে গেল। সুযোগ বুঝে শুভ্র দ্রুত একপাশে লুকিয়ে পড়ল। প্রদীপও অন্যদিকে। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশের পদশব্দ ও আলোয় ভরে গেল লাইব্রেরি। মুখোশধারীরা দ্রুত পালিয়ে গেল। “শুভ্র! তুই ঠিক আছিস?” অর্ণবের কণ্ঠ শুনে শুভ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “হ্যাঁ, আমরা ঠিক আছি,” শুভ্র উঠে দাঁড়াল। “ওরা কারা ছিল?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল। “বিদেশি এজেন্ট মনে হচ্ছে,” প্রদীপ বলল। “টিউবটা নিয়ে গেছে?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল। “না,” প্রদীপ হাসল। “আমার কাছেই আছে।” “এটা এখানে নিরাপদ নয়,” অর্ণব বলল। “আমাদের থানায় নিয়ে যেতে হবে।” “না,” প্রদীপ বলল। “স্যার চেয়েছিলেন পাথরটা জনসমক্ষে আনার আগে আমরা সত্যিটা জানি।” “কী সত্যি?” অর্ণব বিস্মিত। “এই পাথরের মধ্যে যে উপাদান আছে, সেটা এমন শক্তির উৎস যা গোটা পৃথিবী বদলে দিতে পারে। স্যার চেয়েছিলেন এর অপব্যবহার বন্ধ করতে।” শুভ্র গভীর চিন্তায় পড়ল। “তাহলে এখন কী করবেন?” “আমাদের পাথরটা নিরাপদে রাখতে হবে। কিন্তু স্যারের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারব না,” প্রদীপ বলল। “স্যার বেঁচে আছেন তো?” শুভ্র উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল। “বেঁচে থাকতেই হবে। কারণ তিনিই একমাত্র জানেন এই রহস্যের চাবিকাঠি কোথায়।” “এখন কোথায় যাবেন?” অর্ণব প্রশ্ন করল। “একটা নিরাপদ জায়গায়,” প্রদীপ বলল। “কলকাতার বাইরে।” “আমিও যাব,” শুভ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। অর্ণব বুঝল, শুভ্রকে আটকানো যাবে না। এই মুহূর্ত থেকে তারা তিনজনই জড়িয়ে পড়েছে চাঁদের পাথরের গভীর রহস্যে। এই রহস্য যতদিন না সমাধান হচ্ছে, তাদের পিছু ছাড়বে না।
কলকাতার বাইরে একটি ছোট শহর কৃষ্ণনগরের নিরিবিলি হোটেলের ঘরে এসে থামল তিনজন। শুভ্র, অর্ণব আর প্রদীপ। রাত গভীর তখন। হোটেলের ঘরটা ছোট হলেও পরিষ্কার। তারা নিশ্চিত করেছে কেউ তাদের অনুসরণ করেনি। দরজা বন্ধ করে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল শুভ্র। প্রদীপ জানালা দিয়ে সতর্ক চোখে বাইরে দেখছে। অর্ণব নিজের ফোনে থানায় নির্দেশ দিচ্ছে। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এখন কী করব?” সে প্রশ্ন করল। প্রদীপ মুখ ফেরাল। “আগে স্যারের খোঁজ দরকার। উনি ছাড়া আমরা এই রহস্য সমাধান করতে পারব না।” “স্যার কি আপনাকে আর কিছু বলেছিলেন?” শুভ্রের গলায় আশা জাগল। “হ্যাঁ। একটা কথা সেদিন বুঝিনি। উনি বলেছিলেন, ‘পুরোনো গবেষণার ফাইলগুলো আবার দেখো, উত্তর সেখানেই লুকানো’।” “ফাইল কোথায়?” অর্ণব জানতে চাইল। “কলকাতার বাড়িতে আছে। খুব সম্ভবত পুলিশ সেগুলো বাজেয়াপ্ত করেছে,” প্রদীপ চিন্তিত মুখে বলল। “আমি ব্যবস্থা করছি,” অর্ণব বলল। “ফাইলগুলো থানায় আছে নিশ্চয়ই। কাল ভোরেই আমি কলকাতা ফিরে সেগুলো নিয়ে আসব।” শুভ্র মাথা নাড়ল। “এখন একটাই কাজ বাকি, এই পাথরটা নিরাপদ রাখা।” “এখানে নিরাপদ তো?” অর্ণব উদ্বিগ্ন। “আমার ধারণা, এখানেও ওরা পৌঁছে যাবে,” প্রদীপ বলল। “ওরা কারা?” শুভ্র আরও স্পষ্ট জানতে চাইল। প্রদীপ ধীরে ধীরে বলল, “স্যারের পুরোনো সহকর্মী কয়েকজন আমেরিকান বিজ্ঞানী। অনেকদিন ধরেই চাঁদের পাথরের এই গোপন শক্তিটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী কিছু দেশ এই শক্তির মাধ্যমে অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছে। স্যার তা হতে দিতে চাননি। সেই কারণেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।” শুভ্র বিস্মিত হয়ে বলল, “সত্যি কি এই পাথরের এত ক্ষমতা?” প্রদীপ বলল, “হ্যাঁ। চাঁদের পাথরের মধ্যে এমন একটা বিরল খনিজ আছে, যেটা পৃথিবীতে নেই। সেটা দিয়ে তৈরি অস্ত্র এতটাই শক্তিশালী হবে যে পুরো পৃথিবীর ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাবে।” শুভ্র মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ। এমন ভয়ঙ্কর এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার শরীরটা শিরশির করল। “স্যারের কাছে নিশ্চয়ই এই খনিজের ফর্মুলা ছিল?” “হ্যাঁ। নাসায় থাকার সময় উনি সেটা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু নাসার কিছু উর্ধ্বতন ব্যক্তি এটা চাপা দিতে চেয়েছিল। পরে স্যারকে সরিয়ে দেয়। তারপর থেকেই উনি এই তথ্যটা নিজের কাছে রেখেছিলেন,” প্রদীপ বলল। “এখন প্রশ্ন হলো, স্যার কোথায়?” অর্ণব উদ্বিগ্ন মুখে বলল। “স্যার হয়তো কোনও বার্তা রেখে গেছেন,” শুভ্র চিন্তিত হয়ে বলল। “ওই ফাইলগুলোতে এমন কোনও সূত্র থাকতে পারে, যা আমাদেরকে স্যারের কাছে পৌঁছে দেবে।” ঘড়িতে তখন ভোর চারটে বাজে। তাদের চোখে ঘুম নেই। প্রদীপ ছোট ব্যাগটা খুলে টিউবটা বের করে আবার ভালো করে দেখল। ছোট্ট একটা পাথর, কিন্তু কী অদ্ভুত উজ্জ্বলতা! শুভ্র দেখল, পাথরটার ভেতর হালকা নীলচে একটা আভা আছে। “দেখেছেন?” প্রদীপ বলল। “এটাই সেই বিরল খনিজ।” শুভ্র পাথরটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুরক্ষিত করা দরকার।” হঠাৎ হোটেলের বাইরে গাড়ির শব্দ শুনে তিনজনেই সতর্ক হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে তাকাতেই প্রদীপ ফিসফিস করে বলল, “ওরা এসে গেছে!” বাইরে তিনটে কালো এসইউভি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে দ্রুত হোটেলের দিকে এগোচ্ছে। তাদের পোশাক কালো, মুখে মুখোশ। “এখন কী করব?” শুভ্র উদ্বিগ্ন স্বরে বলল। প্রদীপ দ্রুত ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। “পেছনের দরজা দিয়ে বেরোতে হবে।” অর্ণব বন্দুকটা বের করে সতর্ক হয়ে এগোল। “আমার পেছনে থাকো। সাবধানে!” তারা হোটেলের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এল। পিছনের সরু গলিটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তেই বুঝল, পিছু ধাওয়া শুরু হয়েছে। “তোমরা এগোও, আমি দেখছি!” অর্ণব পিছন দিকে তাকিয়ে বলল। শুভ্র আর প্রদীপ দ্রুত গলিটা পেরিয়ে মূল রাস্তায় এসে একটা ছোট দোকানের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর অর্ণব ছুটে এসে বলল, “চলো, ওদের একটু বিভ্রান্ত করেছি।” দ্রুত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুরোনো ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল তারা। চালককে বলল দ্রুত শহরের বাইরে নিয়ে যেতে। ট্যাক্সিটা কৃষ্ণনগরের শহরতলি পেরিয়ে একটা নির্জন গ্রামের রাস্তা ধরল। তিনজনের বুকের ধড়ফড়ানি তখনও কমেনি। কিছুক্ষণ পর চালক জিজ্ঞেস করল, “আর কত দূর যাব বাবু?” প্রদীপ চিন্তিত মুখে বলল, “একটু দূরে কোনও নিরাপদ জায়গা হলেই নামিয়ে দেবেন।” কিছুক্ষণ পর গাড়িটা একটা পুরোনো মন্দিরের সামনে এসে থামল। চারপাশে নিঃশব্দ, ফাঁকা মাঠ। শুভ্র ট্যাক্সি থেকে নেমে চারপাশ দেখল। “এখানে কিছুক্ষণ থাকা যাবে?” “আমার মনে হয় এখানেই অপেক্ষা করি,” প্রদীপ বলল। “অর্ণব, তুমি এবার কলকাতা যাও। ওই ফাইলগুলো দরকার।” অর্ণব মাথা নাড়ল। “আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। তোমরা সাবধানে থেকো।” ট্যাক্সি নিয়ে অর্ণব চলে গেল। শুভ্র ও প্রদীপ দাঁড়িয়ে রইল নির্জন মাঠের মাঝে পুরোনো মন্দিরটার সামনে। সূর্য উঠছে, আকাশে আলোর রেখা। কিন্তু তারা জানে, এই আলোয় এখনও অনেক অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই লুকিয়ে আছে চাঁদের পাথরের রহস্য।
পুরনো মন্দিরের ভাঙা ইটের আড়ালে বসে আছে শুভ্র আর প্রদীপ। ভোরের আলোয় ঘাসে শিশির ঝলমল করছে, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ তৈরি করেছে চারপাশে, কিন্তু সেই শান্তির নিচে ঢেকে আছে অদৃশ্য আতঙ্ক। প্রদীপ পাথরভর্তি ধাতব টিউবটা শক্ত করে ধরে রেখেছে, যেন মুহূর্তে কেউ এসে ছিনিয়ে নিতে পারে। শুভ্র হালকা গলায় বলল, “তুমি কি নিশ্চিত, এই পাথরটা নিয়ে আমাদের এভাবে পালিয়ে বেড়ানো ঠিক?”
প্রদীপ বলল, “সত্যকে রক্ষা করার জন্য যদি পালাতেও হয়, তা হলেও করব। সদানন্দ স্যার বিশ্বাস করতেন, এই শক্তি যদি ভুল মানুষের হাতে যায়, তবে সেটা একটা নতুন যুদ্ধের সূচনা করবে। ওঁর শেষ কথাগুলো আমার কানে এখনও বাজে—‘জ্ঞান শেয়ার করতে হয়, দখল করতে নয়।’”
শুভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে, কোনও নেটওয়ার্ক নেই। “এখানে থেকে যোগাযোগ করা যাবে না। অর্ণব যদি কোনও বিপদে পড়ে…”
প্রদীপ মাথা নেড়ে বলল, “ওর অভিজ্ঞতা আছে, সে ফিরবেই।”
এই সময় হঠাৎ মন্দিরের ভেতর থেকে একটা শব্দ শোনা গেল। যেন কেউ ভারী পায়ে হাঁটছে। শুভ্র আর প্রদীপ দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রদীপ ফিসফিস করে বলল, “তুই বাইরে গিয়ে দেখ, আমি টিউবটা লুকিয়ে রাখছি।”
শুভ্র সাবধানে মন্দিরের গা ঘেঁষে সামনের উঠানে এসে দাঁড়াল। চারপাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর পেছনের দরজার পাশের গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এল একজন লম্বা গড়নের মানুষ। মাথায় কাপড় বাঁধা, চোখে গভীর দৃষ্টি। মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গলায় যেন পরিচিত গম্ভীরতা।
“আপনারা সত্যিই সাহস দেখিয়েছেন,” লোকটা বলল।
“আপনি কে?” শুভ্র সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
লোকটা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল। মুখের কাপড়টা খুলে ফেলল। শুভ্র হতভম্ব হয়ে গেল। সদানন্দ পাল।
“স্যার!” শুভ্র দৌড়ে এগিয়ে এল, কিন্তু প্রদীপ তাকে থামিয়ে বলল, “শুভ্র, সাবধান!”
সদানন্দ হেসে বললেন, “আমি ঠিক আছি। এটা আমারই প্ল্যান ছিল।”
“কী?” শুভ্র আর প্রদীপ একসাথে চেঁচিয়ে উঠল।
সদানন্দ বসে পড়লেন মন্দিরের পাথরের সিঁড়িতে। “শোনো, আমার বহুদিনের গবেষণা এই পাথর ঘিরে। আমি জানতাম, বিদেশি সংগঠনগুলো আমার পেছনে আছে। যখন দেখলাম ওরা প্রদর্শনীর আগে কলকাতায় পা রেখেছে, আমি নিজেই একটা পরিকল্পনা করি। আমি পাথরটাকে সরিয়ে ফেলি, আলো নিভিয়ে রাখি, যেন ওরা ভাবুক, এটা চুরি হয়েছে। ওরা চুরি করবে, এই বিশ্বাস থেকেই ওরা আক্রমণ করে। কিন্তু আমি তাদের আগে থেকে ফাঁদ পাতি।”
“তবে আপনি নিজেই পাথর লুকিয়ে রেখেছেন?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল।
“না। প্রদীপ জানত না, কিন্তু ওর সাহায্য আমি নিয়েছি যাতে সত্যিটা আড়াল করা যায়। আমি নিজেই পাথরের প্রতিলিপি বানিয়েছিলাম, ওটা রাখি প্রদর্শনীতে। আসল পাথরটা বহু আগেই আমি ওই ধাতব টিউবে রেখে এই লাইব্রেরির গোপন ঘরে লুকিয়ে রাখি। আজ থেকে ছয় মাস আগে।”
প্রদীপ বলল, “তাহলে যেটা এখন আমার কাছে আছে সেটা…?”
“হ্যাঁ, ওটাই আসল পাথর,” সদানন্দ মাথা নাড়লেন। “আর তুমি জানো না, সেই পাথরের ভেতর একটা কোড লুকিয়ে আছে।”
“কোড?” শুভ্র চমকে উঠল।
“হ্যাঁ,” সদানন্দ বললেন, “এই খনিজের মধ্যে একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্যাটার্ন রয়েছে, যেটা পুরোপুরি কৃত্রিম। মানে এটা হয়তো চাঁদে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়নি। সম্ভবত এটা মহাকাশের আরও গভীর কোনও উৎস থেকে এসেছে।”
“আপনি বলতে চাইছেন এটা এলিয়েন উৎস?” শুভ্রর গলায় স্পষ্ট উত্তেজনা।
সদানন্দ কাঁধ ঝাঁকালেন। “আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি এই কোডটা ডিকোড করতে পারলে অনেক দূর পৌঁছতে পারি। আমি চেয়েছিলাম, কোনও রাজনীতি, কোনও সামরিক সংগঠন যেন এটাকে আগে না পায়। এই কারণে নিজেই নিজেকে নিখোঁজ করেছিলাম। তোমরা তিনজন আমার প্ল্যানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলে।”
“তাহলে আপনি এখন ফিরছেন?” প্রদীপ জানতে চাইল।
“না। এখনও না। আমার কাজ বাকি। আমি চেয়েছিলাম এই গবেষণা সম্পূর্ণ করার জন্য সময় এবং গোপনতা। এখন তুমি, প্রদীপ, পাথরটা নিয়ে যাবে হরিদ্বারে, এক বিশেষ আশ্রমে। ওখানে আমার এক পুরনো ছাত্র আছে—অরুণাভ। ওকে আমি আগেই সব বলে রেখেছি। ওর ল্যাব আছে পাহাড়ের মধ্যে। ওখানে নিরাপদ থাকবে এটা। আমি অন্য রাস্তা ধরে যাব।”
“আর আমি?” শুভ্র জিজ্ঞাসু গলায় বলল।
“তুই আমাদের সবচেয়ে বড় কাহিনিকার। তোর উপরেই নির্ভর করছে সত্যিটা কীভাবে দুনিয়ার সামনে আসবে। তবে এখনই কিছু প্রকাশ করিস না। সময় হলে আমি তোকে নিজেই সব পাঠাবো,” সদানন্দ চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি নিয়ে বললেন।
শুভ্র চুপ করে গেল। এই একজন বিজ্ঞানী, যিনি গোটা পৃথিবীর ভারসাম্য বদলে দেওয়ার মতো একটা তথ্য সামনে এনে দিলেন, কিন্তু তাঁর দরকার শুধু নিঃশব্দে, গোপনে কাজ করে যাওয়া।
সদানন্দ উঠে দাঁড়ালেন। “আমাকে এখনই রওনা দিতে হবে। তোমাদের উপর আমার আস্থা আছে।”
সেই অচেনা, দার্শনিক আলোয় ভরা সকালটা—মন্দিরের পেছনের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন সদানন্দ পাল। শুভ্র আর প্রদীপ তাঁকে অনেকক্ষণ অবধি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে রইল। মনে হচ্ছিল, একজন মানুষ নয়, একটা যুগ চলে গেল।
সদানন্দ পাল চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলল না। মন্দিরের ছায়া পড়ে আছে শুভ্র আর প্রদীপের মুখে, কিন্তু সেই ছায়ার আড়ালে মাথার ভেতরে অগণিত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা বিষ্ময়, আর অনেকটা দায়িত্ব—সব মিলিয়ে যেন বাতাস ভারী হয়ে আছে।
প্রদীপ শেষমেশ ধীরে ধীরে বলল, “তুই বুঝতে পারিস, শুভ্র? উনি এত কিছু জানতেন, অথচ কাউকে বলেননি! এমনকী আমাকে পর্যন্ত না…”
শুভ্র উত্তর দিল না। তার চোখ মাটিতে, কিন্তু মন সদানন্দের শেষ কথাগুলোয় আটকে। “তুই আমাদের সবচেয়ে বড় কাহিনিকার… তোর উপরেই নির্ভর করছে সত্যিটা কীভাবে দুনিয়ার সামনে আসবে।” এই লাইনটা ওর মনের মধ্যে যেন কোনও এক কম্পনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
“আমার মনে হয়, এখনই রওনা দেওয়া উচিত,” বলল প্রদীপ। “হরিদ্বার পর্যন্ত ট্রেনে গেলে রাতই লাগবে। সকাল নাগাদ পৌঁছানো যাবে। অরুণাভের ল্যাবে রাখলে ওর প্রযুক্তি দিয়ে পাথরটা আমরা ভালোভাবে স্ক্যান করতে পারব।”
শুভ্র মাথা নাড়ল, “আমি কলকাতায় ফিরে যাব। অর্ণবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এখন আমাদের কাছে সদানন্দ পালের ফিরে আসা, তাঁর পরিকল্পনার ব্যাখ্যা—এসব কিছু রেকর্ড করা দরকার। না হলে আমরা যত কিছু জানলাম, সেগুলো নিছক ‘গল্প’ হয়ে যাবে।”
“তুই কি এটার ওপর রিপোর্ট লিখবি?” প্রদীপ জিজ্ঞেস করল।
“না,” শুভ্র মুচকি হাসল, “রিপোর্ট না, একটা পূর্ণ বই। যেখানে থাকবে বিজ্ঞান, রাজনীতি, নৈতিকতা আর আমাদের ব্যক্তিগত যাত্রাপথ—সব। সত্যিটা শুধু তথ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে মানুষ বোঝে না। সেটাকে অনুভব করার মতো করে বললে তবেই সেটা চিরকাল থেকে যায়।”
প্রদীপ সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। “ঠিক বলেছিস। তুই বললে মানুষ শুনবে।” একটু থেমে সে আরও বলল, “শুভ্র, মনে রাখিস, এই পাথরের গায়ে শুধু খনিজ নয়, একটা বিপ্লব লুকিয়ে আছে।”
শুভ্র হেসে বলল, “ঠিক তাই। আর বিপ্লব সবসময় বন্দুক দিয়ে হয় না, কখনও কখনও কলমই বড় অস্ত্র।”
দুজনেই তখন ট্রেনের সময় খুঁজছে মোবাইলে, ঠিক সেই সময় শুভ্রর ফোনে একটা ইনকামিং মেসেজ এল—অর্ণবের। “ফাইলগুলো পেয়ে গেছি। আজ রাতেই কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। তুমি কোথায়?”
শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিল, “আমি কলকাতায় ফিরছি। দেখা হলেই সব বলব।”
তারপর দুজনেই গাড়ি ডাকল। প্রদীপ রওনা দিল হরিদ্বারগামী ট্রেন ধরতে, আর শুভ্র ফিরে এল হাওড়াগামী লোকালে। দিনের আলো তখন তীব্র হয়ে উঠেছে। শহরের দিকে যেতে যেতে শুভ্রের মনে হচ্ছিল, যেন গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা বাস্তব না—একটা বিজ্ঞানভিত্তিক থ্রিলারে ঢুকে পড়েছিল সে।
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে শুভ্র যখন মেট্রো ধরে তার অফিসের দিকে রওনা দিল, তখনই মনে পড়ে গেল—তাকে আজ সন্ধ্যায় তার নিউজ চ্যানেলে লাইভে আসতে হবে। কলকাতাবাসী এখনো জানে না, সদানন্দ পাল নিখোঁজ, পাথর চুরি গেছে, আর তার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। কেউ জানে না সেই পাথর আদৌ আছে কিনা।
চ্যানেল অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সহকর্মীরা ঘিরে ধরল শুভ্রকে। “শুভ্র, তুই সেই রাতে ছিলিস তো? কী হয়েছে, একটু বল!”
“আজ সন্ধ্যার লাইভ দেখো,” শুভ্র রহস্যময় মুখে বলল।
ক্যামেরা রেডি হচ্ছে। নিউজ রুমের বাতাসে উত্তেজনা। সাড়ে সাতটায় অ্যাঙ্কর শুভ্র সেন নিজেই স্টুডিওয় বসে পড়ল। চোখে ক্যামেরার আলো, পাশে কাগজ, কিন্তু তার মুখে অভাবনীয় নিশ্চয়তা।
“আজকের প্রতিবেদনে আমি বলব এমন একটি চুরি সম্পর্কে, যার পেছনে রয়েছে শুধু চোর নয়, গোটা এক ইতিহাস… এক ভবিষ্যতের লড়াই।”
চ্যানেল লাইভে যাচ্ছে। শুভ্র বলছে, “গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে চাঁদের পাথর গায়েব হওয়ার ঘটনা সবাই জানেন। কিন্তু জানেন না এর পিছনে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা। আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি সেই সত্য—এই চুরি ছিল না, ছিল এক পরিকল্পনা। পরিকল্পনা একজন বিজ্ঞানীর, যিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে।”
শুভ্র তখন টিভি স্ক্রিনে কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে—সদানন্দ পালের পুরোনো বক্তৃতা, প্রদর্শনীর ছবি, অন্ধকারে গ্লাস কেস ফাঁকা হয়ে যাওয়া, তারপর এক অজানা গাড়ি চলে যাওয়া…
আর দর্শকরা টিভির সামনে বসে শোনে এক সাহসী কাহিনি—একজন বিজ্ঞানী, যিনি নিজের আবিষ্কারকে অস্ত্রে পরিণত হতে দেননি, বরং তাকে নিরাপদে রেখেছেন। তিনি এমন পাথর পেয়েছেন, যার ভেতরে রয়েছে মহাজাগতিক তথ্য, যার মাধ্যমে পৃথিবীর শক্তি কাঠামোই বদলে যেতে পারে।
প্রচারের শেষে শুভ্র শুধু বলল, “এই কাহিনির শেষ এখানেই নয়। এটা তো শুরু। আগামী সপ্তাহে আমরা দেখব, সেই খনিজ কিভাবে আসলেই আমাদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। তখন পর্যন্ত, ভাবুন—আপনি যদি এমন কিছু আবিষ্কার করতেন, যা দিয়ে যুদ্ধ থামাতে পারতেন, কী করতেন?”
লাইভ শেষ হতেই চ্যানেল অফিসের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিল। একজন সিনিয়র বলল, “তুই শুধু সাংবাদিক নস, ইতিহাসের সাক্ষী। শুভ কামনা, শুভ্র।”
বাড়ি ফেরার পথে শুভ্রর মনে হচ্ছিল, সত্যি কি ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠছে সে? সেই মধ্যবিত্ত ছেলে, যে কেবল ভালো গল্প খুঁজতে চেয়েছিল, আজ এমন এক রহস্যের দায়িত্ব নিয়ে ফিরছে যা কল্পনার চেয়েও বড়।
বাসের জানালার পাশে বসে শুভ্র মনে মনে একটাই কথা বলল—“সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু চিরকাল নয়। সত্য ফিরে আসে… কখনও একজন বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশে, কখনও এক সাংবাদিকের চোখে।”
রাত ন’টা। কলকাতার আকাশে হালকা গর্জন উঠেছে। শুভ্র তার ছোট্ট ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশে কেমন একটা ছায়াময় নির্জনতা, গলির মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো টিম টিম করে জ্বলছে। আজ তার হৃদয়টা যেন ভারমুক্ত। সংবাদমাধ্যমের সেই বিশেষ লাইভ সেগমেন্টের পর শহর জুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে একটা প্রশংসা, একটা সমীহ, আর একটা গভীর জিজ্ঞাসাও জন্ম নিয়েছে—সত্যিই কি আমাদের শহরে এমন কিছু ঘটে যেতে পারে?
শুভ্রর ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠল—অর্ণব।
“হ্যাঁ বল,” শুভ্র বলল।
“ফাইলগুলো বিশ্লেষণ করলাম। একটার মধ্যে একটা কাগজের পিছনে লেখা কিছু পয়েন্ট পেয়েছি। মনে হচ্ছে সদানন্দ স্যারের হাতের লেখা। ঠিকানা আছে—‘নর্থ বেঙ্গল, চ্যাংথুং ভ্যালি’। শুনেছিস?”
“না,” শুভ্র বলল, “কিন্তু তুই তো শুনেছিস বলেই জানাচ্ছিস।”
অর্ণব হেসে বলল, “হ্যাঁ। এটা একটা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা ছোট একটা উপত্যকা। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ওখানে সদানন্দ স্যারের নামেই একটা পুরনো আশ্রম আছে।”
শুভ্র চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। “তুই বলতে চাস ওখানে উনি থাকতে পারেন?”
“হয়তো। বা ওটাই হতে পারে তাঁর ‘লাস্ট ল্যাব’। এই খনিজের গভীর রহস্য, যে কোডটার কথা উনি বলেছিলেন, সেটা সম্ভবত ওখানেই উনি বিশ্লেষণ করতেন। আমরা যদি জানতে চাই এই পাথর কী, কোথা থেকে এসেছে, এর মধ্যে আসলেই কোনও এলিয়েন প্যাটার্ন আছে কিনা, তবে আমাদের ওখানেই যেতে হবে।”
“আমি প্রস্তুত,” শুভ্র বলল।
“তুই একা যাবি?” অর্ণব প্রশ্ন করল।
“প্রদীপ হরিদ্বার পৌঁছে গিয়েছে। ও পাথরটার যত্ন নিচ্ছে। আমরা ওখানে গিয়ে স্যারকে খুঁজে বার করতে পারলে ওকে খবর দেব।”
“ঠিক আছে,” অর্ণব বলল, “আমি ট্রেনের টিকিট বুক করছি। কাল রাতের ট্রেনে চেপে নিউ জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে পাহাড়ি পথে গাড়ি করে চ্যাংথুং ভ্যালি।”
শুভ্র ফোন রেখে ঘরের ভেতর এল। পকেট থেকে ছোট্ট একটা পেনড্রাইভ বার করল। সদানন্দ স্যারের ঘর থেকে পাওয়া আরেকটি ফাইলের ছবি সে স্ক্যান করে রাখছিল। পেনড্রাইভটা খুলে মনিটরে ফাইলটা ওপেন করল।
ফাইলের প্রথম পাতায় ছিল একটা ডায়াগ্রাম—চাঁদের কক্ষপথে একটি নির্দিষ্ট জায়গা, আর সেই জায়গার ওপরে একটি রেখাচিত্র। নিচে লেখা ছিল, “Pattern Alpha-7B: Repeating Signal Points. Unknown Origin.”
তার নিচে স্যারের হাতের লেখা—“এটি এলোমেলো নয়। কোডটি কোনও আদিম গাণিতিক বিন্যাস অনুসরণ করছে। পৃথিবীর বাইরের কোনও বুদ্ধিদীপ্ত সত্তার তৈরি বলেই ধারণা।”
শুভ্র শিউরে উঠল। আজ পর্যন্ত সে যত সায়েন্স ফিকশন পড়েছে, সব যেন হঠাৎ বাস্তব হয়ে উঠছে। একটা অচেনা পৃথিবীর দরজা খুলে যাচ্ছে তার সামনে। শুধু সাহসই যথেষ্ট নয়, দরকার ধৈর্য, বোঝার ইচ্ছা, আর বিশ্বাস।
পরদিন রাত।
নিউ জলপাইগুড়িগামী ট্রেনে বসে আছে শুভ্র আর অর্ণব। জানালার ধারে বসে শুভ্র পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। রাত যত গাঢ় হচ্ছে, ততই তার মনে পড়ছে সদানন্দ পালের চোখের সেই তীব্র দীপ্তি—যা বলছিল, “আমি শুধু বিজ্ঞানী নই, আমি একজন দার্শনিকও।”
ট্রেনের মধ্যে অর্ণব একটি ল্যাপটপ খুলে কিছু ডেটা দেখতে শুরু করেছে। ফাইলগুলো বিশ্লেষণ করে সে একধরনের ধারাবাহিক প্যাটার্ন পেয়েছে। “দেখ,” সে শুভ্রকে দেখাল, “এই পাথর থেকে যে বিকিরণ বেরোচ্ছে, সেটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট তরঙ্গে ওঠানামা করে। ৩১ মিনিট অন্তর একই রকম ‘স্পাইক’ আসছে। এটা কাকতালীয় হতে পারে না।”
“মানে?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল।
“মানে এটা যেন কেউ কোথাও থেকে নির্দিষ্ট ইন্টারভালে সংকেত পাঠাচ্ছে,” অর্ণব বলল। “আমরা এতদিন ধরে যা ভেবেছি—চাঁদের পাথর একটা মৃত বস্তু, সেটা ঠিক নয়। এটা একটা মাধ্যম, একটা বাহক। হতে পারে, এটাই আমাদের হাতে আসা প্রথম ‘বুদ্ধিদীপ্ত বস্তু’। যে পাথরের মধ্য দিয়ে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে।”
শুভ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। চাঁদের পাথর? নাকি দূরের কোনও গ্রহের ডাক? কোনও প্রাচীন সভ্যতার প্রেরিত সংকেত? মাথার মধ্যে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় চলছে।
রাত গভীর, ট্রেন চলেছে শীতল বাতাস ভেদ করে পাহাড়ের দিকে। শুভ্র জানে, এই যাত্রা শুধু পাহাড়ি কোনও উপত্যকায় পৌঁছনোর নয়—এ এক মানসিক রূপান্তর, একটা অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। যেখানে বিজ্ঞান আর আধ্যাত্মিকতা হাত ধরাধরি করে হাঁটে, যেখানে ইতিহাস আর ভবিষ্যৎ এক মুহূর্তে মিলেমিশে যায়।
“আমরা যখন ফিরে আসব,” অর্ণব বলল নিচু গলায়, “আমরা আর আগের মতো থাকব না।”
“হয়তো মানুষরাও না,” শুভ্র ফিসফিস করে বলল।
ট্রেন তখন পাহাড়ের কোলে ঢুকেছে। নীচে নদী, ওপরে তারার ভরা আকাশ। এক অলৌকিক নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যাচ্ছে তারা দুজন।
ভোরের প্রথম আলোয় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছল ট্রেনটা। বাতাসে একটা টানটান ঠান্ডা ভাব, আকাশে হালকা কুয়াশার পর্দা। শুভ্র আর অর্ণব স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল। পাথরখচিত প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে শুভ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই আকাশে কি কেউ সত্যিই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে?”
অর্ণব ব্যাগটা পিঠে তুলে বলল, “হয়তো তাকিয়েই আছে। শুধু আমরা বুঝতে শিখিনি ওদের ভাষা।”
চ্যাংথুং ভ্যালি যেতে হলে পথ সহজ নয়। তারা একটা ছোট SUV ভাড়া করল। চালক বয়সে প্রায় পঞ্চাশ, নাম বলল বিজন। “চ্যাংথুং?” নাম শুনেই সে একটু চুপ করল। “ও তো বেশ দূর, বাবু। ওখানে তো লোকজনই যায় না।”
“আমরা একটু গবেষণার কাজে যাচ্ছি,” অর্ণব গম্ভীরভাবে বলল।
বিজন মাথা নেড়ে গাড়ি চালাতে শুরু করল। প্রথমে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে সরু পথ, তারপর ধীরে ধীরে পাহাড়ি পথে ওঠা শুরু। রাস্তার দুই পাশে জঙ্গল ঘন হয়ে উঠছে, মাঝে মাঝে গাছের ছায়ায় সূর্যের আলো পড়ে তৈরি করছে ছোপ ছোপ নিঃসঙ্গতা। শুভ্র গাড়ির জানালার পাশে বসে ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে ভাবছে—চাঁদের পাথর যে তাকে এমন জায়গায় নিয়ে আসবে, সেটা সে কল্পনাও করেনি।
ঘণ্টা তিনেক পর গাড়ি ঢুকল আরও নির্জন অঞ্চলে। মোবাইল নেটওয়ার্ক অদৃশ্য হয়েছে আগেই। চারপাশে নিস্তব্ধতা যেন জমে থাকা পুরনো ধুলো। হঠাৎ বিজন বলল, “এই যে সামনে, ওই ভাঙা কুঁড়েঘরটা দেখছেন? ওখানেই একটা আশ্রম ছিল একসময়। এখন কেউ থাকে না।”
গাড়ি থামিয়ে ওরা নামল। আশ্রম বলতে যা বোঝায়, সেটা আর এখানে নেই—ছাদ ভাঙা, দেয়ালে শ্যাওলা জমা, গেটে মরচে পড়া তালা। কিন্তু আশ্চর্য, তালাটা খোলা।
“দরজা খোলা?” অর্ণব ফিসফিস করে বলল।
“উনি কি… এখানে আছেন?” শুভ্রর গলায় উৎকণ্ঠা।
তারা এগিয়ে গেল ভিতরে। ঘরের ভেতরে সাদা পাথরের মেঝে, একটা টেবিল, কিছু কাঠের তাক, আর একপাশে একটা ছোট ল্যাব সেটআপ। কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি রাখা, যার মধ্যে কিছু এখনো চালু। একটা কম্পিউটারের মনিটরে স্ক্রিনসেভার চলছে—একটা ঘূর্ণায়মান গ্রহ, পেছনে চাঁদের পৃষ্ঠের ছবি।
“স্যার এখানেই কাজ করতেন!” শুভ্র বলল।
হঠাৎ পেছনে কাশি শোনা গেল। তারা ঘুরে তাকিয়ে দেখল, দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে আছেন সদানন্দ পাল। চুল একটু উসকোখুসকো, গায়ে ঢিলা কুর্তা, চোখে সেই চিরচেনা দীপ্তি।
“তোমরা এসেছ? আমি জানতাম,” তিনি বললেন।
শুভ্র আর অর্ণব ছুটে গিয়ে তাঁর পায়ে হাত দিল। সদানন্দ স্নেহভরে হাত রাখলেন তাদের মাথায়।
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?” অর্ণব প্রশ্ন করল।
“ঠিকই আছি। তবে সময় কম। আমি যা পেয়েছি, তা অবিশ্বাস্য,” সদানন্দ বললেন।
তিনি তাদের নিয়ে এলেন ল্যাবের ভিতর। একটি বড় মনিটরের সামনে একটি স্ক্যানার চলছে। “এই চাঁদের খনিজ—এর ভেতরে যা লুকানো আছে, সেটা প্রাকৃতিক নয়। আমি তার তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেছি। এবং আমি পেয়েছি এক ধরনের বিন্যাস, যেটা পৃথিবীর কোনও উপাদানে নেই।”
তিনি একটা বোতাম টিপতেই মনিটরে ভেসে উঠল অদ্ভুত কিছু গাণিতিক বিন্যাস—ছোট ছোট বিন্দু, রেখা, আর তাদের ভেতর সংযোগকারী চিহ্ন। নিচে লেখা—
SYNCHRONIC OSCILLATION DETECTED — INTERVAL 31.03 MINUTES — REPEAT PATTERN.
“এই সংকেতের উৎস কোথা থেকে আসছে বলতে পারবেন?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
“না। কিন্তু আমি এটুকু নিশ্চিত, এই সংকেত চলে আসছে বহুকাল ধরে। হয়তো হাজার বছর। হয়তো তার চেয়েও বেশি,” সদানন্দ ধীরে ধীরে বললেন।
“কিন্তু কেন? এই সংকেত আমাদের বলছে কী?” শুভ্র জিজ্ঞেস করল।
“আমরা পৃথিবীর বুদ্ধিদীপ্ত একমাত্র প্রজাতি নই—এই বার্তাই সম্ভবত সেটা বোঝাতে চায়,” সদানন্দ বললেন। “এই সংকেত বুঝতে পারা মানে, আমাদের বিবর্তনের নতুন ধাপে পৌঁছে যাওয়া। শুধু প্রযুক্তি নয়, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাই আমি চাই না, এই শক্তি প্রথমে যাক কোনও রাষ্ট্র বা যুদ্ধবাজ শক্তির হাতে। আমি চাই, এই তথ্য মানুষের হোক, বিজ্ঞানীর হোক, কবির হোক।”
হঠাৎ অর্ণব পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, “কেউ বাইরে আছে।”
তারা বেরিয়ে এল সামনের উঠোনে। তিনজন মুখোশধারী লোক সোজা বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তিন মিনিট। আমাদের সঙ্গে পাথরটা নিয়ে চুপচাপ চলুন।” একজন বলল।
সদানন্দ শান্তভাবে বললেন, “তোমরা জানো না, তোমরা কী চাও। এই শক্তি সামলাতে গেলে আগে নিজের ভিতরটা সামলাতে হয়।”
“চুপ! সেন্টিমেন্টাল কথায় কিছু হবে না। চলুন!” লোকগুলো এগিয়ে এল।
ঠিক সেই মুহূর্তে, পাশের গাছের আড়াল থেকে গুলির শব্দ শোনা গেল। অর্ণব এক হাতে বন্দুক বার করে ডানদিকে ঢুকে পড়ল। পাহাড়ে গুলি চলতে লাগল। মুখোশধারীরা হতচকিত। এক মুহূর্তের মধ্যে দুজন দৌড়ে পালাল। একজন পড়ে গেল মাটিতে।
সদানন্দ বললেন, “তোমরা পাথর নিয়ে পালাও। এখান থেকে বেরিয়ে যাও।”
“আপনি?” শুভ্র হতভম্ব।
“আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমাকে ঠেকানো সহজ নয়,” তিনি বললেন। “পথ সবসময় খোলা থাকে তাদের জন্য, যারা সত্য নিয়ে চলে। এই পাথরটাকে সুরক্ষিত করো। আর তার মর্মটা বোঝো।”
শুভ্র আর অর্ণব ব্যাগে পাথর ভরে পাহাড়ি গলি ধরে নেমে গেল। পেছনে গুলির শব্দ কমে এল। আকাশে তখন ঘন মেঘ, আর সেই মেঘের আড়ালে কোথাও—একটা বার্তা বারবার ফিরে আসছে। হয়তো কোনও তারার পিঠ থেকে। হয়তো চাঁদের ফাঁকে।
পাহাড়ি গলি ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে শুভ্রর ফুসফুস যেন জ্বলে যাচ্ছিল। পিঠে ঝোলানো ব্যাগে রাখা সেই পাথরের ওজন যেন দশগুণ বেড়ে গেছে। পিছন ফিরে তাকানোর সাহস তার নেই, অথচ বারবার মনে হচ্ছে, সদানন্দ স্যারের দিকে ফিরে না তাকিয়ে সে এক অসম্পূর্ণ বিদায় নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। অর্ণব তাকে টেনে বলল, “এই রাস্তা ধরে চল। সামনেই পুরনো টেলিফোন টাওয়ার আছে, ওখানে পৌঁছাতে পারলে আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।”
শুভ্র কিছু না বলে মাথা নাড়ল। ঘন কুয়াশা নামছে পাহাড়ের গায়ে। পথের দুধারে উঁচু গাছগুলো হঠাৎ যেন অতিপ্রাকৃত ছায়ার মতো ঠেকছে—নীরব, অথচ প্রত্যক্ষদর্শী। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তারা পৌঁছল একটা পরিত্যক্ত টাওয়ারের কাছে। লোহার কাঠামোটা জং ধরে গেছে, নিচে ভাঙা ছাউনি, তবু এক কোণে একটা পুরোনো জেনারেটর আর ছোট রেডিও ঘর এখনো অক্ষত।
অর্ণব তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা পুরোনো ট্রান্সমিটার চালু করল। “এই আর্মি ফ্রিকোয়েন্সি, দয়া করে শুনতে পারলে যোগাযোগ করুন। জরুরি অবস্থা। কোড 16B-Zeta। পুনরায় বলছি, 16B-Zeta।”
দুই মিনিটের মাথায় ঘড়ঘড় করে একটা ভাঙা ভয়েস ভেসে এল, “This is Eastern Command. Identify yourself.”
অর্ণব দ্রুত পরিচয় দিল। “We are with a high-priority subject. Request immediate extraction from coordinates—Chyangthung Valley, Sector 42, old relay point.”
ভেতর থেকে আবার ভেসে এল উত্তর, “Helicopter dispatched. ETA 20 minutes. Stay low. Over and out.”
অর্ণব ঘরের দরজার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ল। শুভ্র এখনও নিঃশ্বাস ঠিক করতে পারেনি। কিন্তু তার চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ব্যাগটার দিকে। “ওর ভেতরে কী আছে আমরা জানি না, কিন্তু ও আমাদের জীবন আমূল বদলে দিয়েছে,” শুভ্র বলল।
“তুই ঠিক বলেছিস,” অর্ণব ধীরে বলল। “এই পাথরটা হয়তো কোনও প্রাচীন সভ্যতার হাতছানি। হয়তো দূরের কোনও জীবনের বার্তা। হয়তো এমনও হতে পারে, ওরা আমাদের পরীক্ষার মধ্যে রেখেছে—আমরা সত্যিই উন্নত তো?”
শুভ্র চুপ করে গেল। এরপরের কুড়ি মিনিট যেন চিরন্তন। তারা জানে, যদি হেলিকপ্টার না আসে, তবে হয় তাদের মৃত্যু নিশ্চিত, নয়তো আরও গভীর অজানা ষড়যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও জানে—এই মুহূর্তে তারা ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক সময়মতো পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে ভেসে এল হেলিকপ্টারের আওয়াজ। ঘন কুয়াশা ভেদ করে আকাশে ছোট একটা কালো ছায়া, তারপর আরও স্পষ্ট—ভারতীয় সেনার এক ছোট চপার।
“ওই যে!” শুভ্র উঠে দাঁড়াল। হেলিকপ্টার নিচে নামছে, বাতাসের প্রচণ্ড ঝাপটায় ধুলো উড়ছে। দুই সেনা অফিসার নামল দড়ির মই বেয়ে।
“দ্রুত উঠে পড়ুন!” একজন বলল।
অর্ণব আগে উঠল, তারপর শুভ্র। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে আছে সে, যেন পৃথিবীর সমস্ত উত্তর ওই ব্যাগের ভিতরে। দড়ির মই বেয়ে উঠে পড়ল চপার। মাটি থেকে আকাশে উঠে এল তারা।
পাহাড় ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে, চ্যাংথুং উপত্যকা রূপকথার মতন পেছনে পড়ে যাচ্ছে। শুভ্র নিচে তাকিয়ে দেখল—একটা অদৃশ্য ছায়া যেন বিদায় জানাল তাকে।
দুই ঘন্টা পর—
সেনা ঘাঁটির নিরাপত্তা কক্ষে বসে রয়েছে শুভ্র আর অর্ণব। সামনের কাচের ঘরের ভিতর পাথরটা রাখা হয়েছে—আধুনিক স্ক্যানারে পরীক্ষা চলছে। পাশে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল।
“আপনারা যা করেছেন, তা কল্পনার বাইরে,” কর্নেল বললেন। “এই পাথরের ভিতরে পাওয়া সিগন্যালটি আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। এটা পৃথিবীর কোনও তরঙ্গ-প্যাটার্নের সঙ্গে মেলে না। আপনাদের অনুমতি থাকলে আমরা এটা আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে শেয়ার করব।”
“আমরা চাই শুধু এটুকুই নিশ্চিত হোক—এই শক্তি কোনও একদেশের সম্পদ না হয়ে গোটা মানবজাতির হোক,” অর্ণব বলল।
“ঠিক সেই চাওয়াই ছিল সদানন্দ স্যারের,” শুভ্র যোগ করল।
কর্নেল মাথা নাড়লেন, “আমরা ওঁকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করছি। পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান পাঠানো হয়েছে। ওঁর মতো একজন বিজ্ঞানী হারিয়ে যেতে পারেন না।”
শুভ্র একটু দূরে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। আকাশ তখন হালকা আকাশি, মেঘ সরে গিয়ে তারার দল দেখা যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল সদানন্দের শেষ কথাগুলো—“মানুষ একা নয়। শুধু তা বোঝার সময় আসেনি।”
দিন পেরিয়ে যাবে, তদন্ত চলবে, রিপোর্ট জমা হবে, আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন পড়বে। কিন্তু শুভ্র জানে, সে যা দেখেছে, যা জানে—তা আর শুধুই বিজ্ঞান নয়। তা এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণ, যেখানে গল্প আর সত্যি, বিজ্ঞান আর দর্শন, পৃথিবী আর মহাকাশ—সব মিলেমিশে যায়।
হয়তো একদিন সে সত্যিই বই লিখবে। হয়তো বইয়ের নাম হবে “The Moon Rock and the Message”।
আর হয়তো, সেই বই কোনওদিন পৌঁছবে সেই দূর গ্রহে, যেখান থেকে এই পাথর এসেছিল।
[শেষ]




