Bangla - কল্পবিজ্ঞান

চাঁদের পাড়ায় বাঙালি মহল্লা

Spread the love

সৌরদীপ মুখোপাধ্যায়


পর্ব ১ – চাঁদের আড্ডা

চাঁদের বুকে প্রথম সূর্যোদয় দেখা মানেই এক অদ্ভুত বিস্ময়। পৃথিবী থেকে তিরিশ লাখ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এই মহল্লার প্রতিটি বাসিন্দার কাছে সেটাই যেন প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নেওয়া। ২০৮০ সালের শারদীয় পূজোর আগের সপ্তাহে ভারতের প্রথম চন্দ্র-নিবাসে তৈরি হলো বাঙালি মহল্লা—যেখানে কাঁচের গম্বুজের নিচে রাস্তায় টং দোকান, মশলা-ভাজা টেলিভারি, বাঙালি দাদু-ঠাকুমাদের কণ্ঠে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সন্ধের আড্ডায় ফুটবল নিয়ে উত্তেজনা। কেউ বিশ্বাস করতে পারত না যে এমন দিন একদিন আসবে, কিন্তু বিজ্ঞান ও স্বপ্ন একসাথে পথ দেখিয়েছে।

পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ নানা কারণে চাঁদে এসেছে—খনন শিল্প, গবেষণা, পর্যটন, বসতি গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা। কিন্তু বাঙালিরা অন্যরকম। তারা শুধু কাজ করতে আসেনি, তারা এসেছিল তাদের সংস্কৃতির নিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে। তাই মহল্লার প্রথম দিনেই একদল তরুণী সাদা-লাল তাঁতের শাড়ি পরে গিয়েছিল কাঁচের গম্বুজের নিচের ছোট্ট চত্বরে, যেখানে ধুনুচি নাচ আর ঢাকের রিহার্সাল চলছিল। “চাঁদের মাটিতে দুর্গাপূজা হবে না?”—এই প্রশ্নটা যেন বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।

মহল্লার কেন্দ্রীয় চত্বরে ঝুলছিল এক বিশাল ডিজিটাল ব্যানার—শারদীয়া শুভেচ্ছা, চন্দ্রনিবাস মহল্লা কমিটি”। পাশে কাচঘেরা টং দোকানে কুমড়ো-চপ, মোচার ঘন্ট, ফুচকা—সবই পরিবেশন করা হচ্ছে বিশেষভাবে চাঁদের জন্য প্রক্রিয়াজাত খাবার দিয়ে। মহাকাশে খাওয়াদাওয়া জটিল, তাই রান্না হয় প্রেশার-সেফ কন্টেনারে, কিন্তু স্বাদে যেন কোনো কমতি না থাকে। ফুচকার মশলার ঝাঁঝ যে এতদূরে মহাকাশেও পাওয়া যায়, সেটা কেউ ভাবেনি।

বিকেলের আড্ডায় চায়ের কাপে ভেসে আসত চেনা হাসির স্রোত। একদল তরুণ কবিগানের মহড়া করছিল, শূন্য-মাধ্যাকর্ষণে তাদের গলায় সুর যেন অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। একজন শুরু করল—“চাঁদে বসে কবিতা গাই, মাটির গন্ধ পাই না তাই…” অন্যজন তাতে খেপে উঠল—“মাটির গন্ধ না পেলে ফুচকার খোসা কে খাচ্ছে ভাই?” হাসির রোল উঠল মহল্লাজুড়ে।

মহল্লার প্রথম দিনগুলো ছিল অদ্ভুত আনন্দে ভরা। সকালবেলা বাচ্চারা স্কুলে যেত স্পেস-ট্রামে চেপে, যার জানালায় পৃথিবীকে ছোট্ট নীল গোলকের মতো দেখা যেত। ক্লাসে পড়ানো হতো বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান—কিন্তু শিক্ষকরা সবসময় বলে দিতেন, “আমরা মানুষ, পৃথিবী আমাদের মা। চাঁদ আমাদের নতুন বাড়ি, কিন্তু পৃথিবী ভুলে যেও না।”

সন্ধেবেলা গম্বুজের কাচ দিয়ে দেখা যেত কালো আকাশে ঝলমলে পৃথিবী। সেই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে এক তরুণ ডাক্তার, অনিন্দ্য, বলেছিল তার সঙ্গিনীকে—“দেখো, ওই যে পৃথিবীটা—আমাদের সব গান, সব কবিতা, সব প্রেম ওই ছোট্ট বলটার ভেতরে। কিন্তু আজ আমরা অন্য গ্রহে দাঁড়িয়ে থেকেও একে ভুলতে পারছি না। এটা কি বাঙালির চিরন্তন টান?” মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল হাসি দিয়ে, কাচের ওপারে হাত রেখে—“চাঁদের মহল্লা আসলে পৃথিবীরই এক টুকরো।”

তবু আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও ছিল। চাঁদের মাটিতে বসতি গড়া সহজ নয়। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস একশো ডিগ্রি, ভেতরে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ, জলের যোগান পৃথিবী থেকে আনা হয়। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, আর এক মুহূর্তেই পুরো মহল্লা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই ভয়ও বাঙালির হাসি-ঠাট্টার সামনে চাপা পড়ে যেত। আড্ডায় কেউ বলত—“পৃথিবীতে তো লোডশেডিংয়ে দিন কেটেছে, এখানে এক মিনিট অক্সিজেন গেলেই চিরকাল রাত। তবুও বেঁচে আছি, এটাই বড় কথা।”

চাঁদের মহল্লায় সেদিন রাতে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠল, যদিও তারা চাঁদের মাটিতেই দাঁড়িয়ে। কাঁচের গম্বুজের ওপরে প্রতিফলিত আলো যেন পুরো চত্বরকে ভাসিয়ে দিলো রূপালি জ্যোতিতে। মানুষজন দাঁড়িয়ে গান ধরল—“এই পথ যদি না শেষ হয়…”। কেউ কেউ চোখ মুছছিল। পৃথিবী থেকে এতদূরে থেকেও বাঙালি মনে করল, তারা যেন আবারো নিজেদের শহরে, নিজেদের পাড়ায় আছে।

তবুও অদ্ভুত এক অস্বস্তি ঢুকে গিয়েছিল বাতাসে। পূর্ণিমার আলোয় কাচের গম্বুজের ঠিক বাইরে দূরে দেখা গেল অচেনা আলোকরেখা—মাটির ভেতর থেকে যেন উঠে আসছে কোনো নীলাভ আভা। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা হয়তো খনিজ খননের আলো। কিন্তু কেউ নিশ্চিত ছিল না। বাচ্চারা থেমে গিয়ে অবাক হয়ে তাকাল, আর বয়স্করা চোখ ফিরিয়ে নিল। এই মহল্লার শুরুতেই কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?

চায়ের কাপের শব্দ, হাসির আড্ডা, ঢাকের বাজনা—সবকিছুর আড়ালে যেন চুপিসারে ঢুকে পড়ছিল অদ্ভুত প্রশ্নের ছায়া। কিন্তু তবুও মানুষ ঠিক করল—আজ শুধু আনন্দ থাকবে। আগামীকাল কী হবে, সেটা পরে ভাবা যাবে। আর তাই প্রথম দিন শেষ হলো গান, গল্প আর পূর্ণিমার আলোয় ভেসে থাকা এক অদ্ভুত বাঙালি আড্ডায়।

পর্ব ২ – পূর্ণিমার প্রতিশ্রুতি

চাঁদের মহল্লার দ্বিতীয় সপ্তাহ মানেই প্রস্তুতির ব্যস্ততা। দুর্গাপূজা আসছে বলে সবাই যেন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিল। পৃথিবী থেকে বিশেষ কার্গো-শিপে আনা হয়েছিল কাশফুলের শুকনো গুচ্ছ, কুমড়ো, পাঁঠার মাংস আর কয়েকটা আসল ঢাক। মহাকাশে এ ধরনের জিনিস আনা খুব ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু মহল্লার বাঙালিরা বলেছিল—“ঢাক ছাড়া পূজা মানে শরীর ছাড়া প্রাণ।” তাই সরকারের অনুমতিও মিলেছিল। গম্বুজের ভেতরেই এক বিশাল জায়গা খালি করে তৈরি হলো অস্থায়ী মণ্ডপ, যেটা কৃত্রিম বাতাসে ঝুলে থাকা রঙিন আলোয় যেন আকাশের মতো ঝলমল করছিল।

মহল্লার মণ্ডপ সাজানো হচ্ছিল অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি কাঠামো দিয়ে, কিন্তু চোখ বন্ধ করলে যেন উত্তর কলকাতার কোনো পুরনো বাড়ির উঠোন। প্রতিমা বানানো হচ্ছিল বিশেষ 3D প্রিন্টারে—পৃথিবী থেকে আনা মাটি আর চাঁদের খনিজ গুঁড়ো মিশিয়ে। মূর্তির চোখ আঁকতে যখন শিল্পী কলম ধরলেন, আশেপাশের সবাই নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছিল মায়ের চোখের দৃষ্টিতেই বেঁচে থাকবে এই পুরো মহল্লা।

বিকেলের দিকে আড্ডা জমে উঠল। দোকানে পাওয়া যাচ্ছিল প্রেশার-কুকড খিচুড়ি, শুকনো লাউ-ঘন্ট আর রসগোল্লার ভ্যাকুয়াম-প্যাকেট। সবাই বলছিল—“স্বাদটা ঠিক আগের মতো নয়, কিন্তু তবুও পূজো মানেই পূজো।” বাচ্চারা দৌড়ে বেড়াচ্ছিল স্পেস-স্যুট পরে, যেন এটা তাদেরই পাড়ার মেলা।

সন্ধে নামতেই শুরু হলো মহল্লার প্রথম ধুনুচি নাচ। সাদা-লাল শাড়ি পরা মহিলারা ভেসে যাচ্ছিল শূন্য-মাধ্যাকর্ষণের আবেশে, ধোঁয়া কাচের গম্বুজের ভেতর ভেসে আকার নিচ্ছিল অদ্ভুত প্রতীকী রেখার মতো। ঢাকের তালে মহল্লার কিশোররা পাগলের মতো নেচে উঠল, আর সবাই একসঙ্গে গাইল—“জয় মা দুর্গা।” এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, পৃথিবী আর চাঁদের দূরত্ব মুছে গেছে।

কিন্তু ঠিক তখনই ঘটল অদ্ভুত ব্যাপার। গম্বুজের বাইরের কালো আকাশে হঠাৎ দেখা গেল এক নীল আলোকরেখা। কেউ ভেবেছিল এটা হয়তো কোনো খনিজ-খননের আলো। কিন্তু আলোটা নড়ছিল, যেন মাটির নিচ থেকে ধীরে ধীরে উঠছে। মানুষ থেমে তাকিয়ে রইল। ঢাকের শব্দ থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য, তারপর আবার বাজতে শুরু করল, যেন ভয় ঢাকতে চাচ্ছে।

তরুণ গবেষক অনিন্দ্য তাকিয়ে বলল—“এটা আলো নয়, এটা হয়তো কোনো প্রতিফলন।” কিন্তু তার চোখে কৌতূহল আর আতঙ্ক মিশে গিয়েছিল। কয়েকজন বিজ্ঞানী ফিসফিস করে বলছিল—“গত সপ্তাহে খননের সময় নাকি একটা অদ্ভুত গুহা দেখা গিয়েছিল। হয়তো এর সঙ্গে সেই গুহার সম্পর্ক আছে।”

মহল্লার বয়স্করা অবশ্য এসব পাত্তা দিতে চাইল না। তারা বলল—“আজ পূজো, আজ আনন্দের দিন। ভয় দেখিয়ো না।” বাচ্চারা আবার খেলায় মেতে উঠল, আর গম্বুজের ভেতর গান শুরু হলো—“আলো আমার আলো…”। তবুও সবার মনে কোথাও একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছিল।

পূজোর রাতে অঞ্জলি দেওয়ার সময় সবাই একসঙ্গে হাত জোড় করল। মা দুর্গার মূর্তির চোখে তখন কৃত্রিম আলোর প্রতিফলনে যেন এক অদ্ভুত দীপ্তি দেখা যাচ্ছিল। কেউ কেউ শপথ নিল—“আমরা চাঁদে থেকেও আমাদের সংস্কৃতি বাঁচাবো, আমাদের বিশ্বাস অটুট রাখব।” সেই প্রতিশ্রুতি যেন গুমরে উঠল মহল্লার প্রতিটি গৃহে, প্রতিটি গানে।

কিন্তু বাইরে, কাচের ওপারে, পূর্ণিমার আলোয় নীলাভ রেখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। যেন কেউ চাঁদের মাটির নিচ থেকে সংকেত পাঠাচ্ছে। মানুষ তখনও জানত না, এই আলো একদিন পুরো মহল্লার ভাগ্য উলটে দেবে।

পর্ব ৩ – অদ্ভুত গুহার খবর

চাঁদের মহল্লার দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে মাত্র কয়েকদিন, গম্বুজের আলোয় এখনো শাড়ির রঙিন কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আনন্দের আবেশ কাটতেই আলোচনায় উঠে এল সেই অদ্ভুত নীল রেখা। পূজোর রাতে যে আলো মাটির তলা থেকে উঁকি দিয়েছিল, সেটি আর একেবারেই কাকতালীয় বলে মনে হচ্ছিল না। বিজ্ঞানীদের একটি দল তখনই ঘোষণা করল—চাঁদের দক্ষিণ দিকের একটি গহ্বরে নতুন সুড়ঙ্গ মিলেছে, যেটির ভেতর থেকে আসছে অস্বাভাবিক শক্তির কম্পন।

পৃথিবীতে খবর পৌঁছাতেই হইচই পড়ে গেল। সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম—“Moon Colony Bengali Zone Near Alien Cave?” কেউ মজা করে বলল—“চাঁদের বুকে ভিনগ্রহীরা থাকলেও তারা প্রথমে বাঙালিদের সঙ্গেই দেখা করবে।” মহল্লার লোকেরা অবশ্য এই খবরে গর্বও পেল, আবার ভয়ে কাঁপলও। কেউ বলল—“এটা আমাদের কাছে সুযোগ, বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।” আবার কেউ বলল—“যদি এটাই সর্বনাশ ডেকে আনে?”

বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ছিলেন ড. সুশোভন মিত্র, যিনি আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। তিনি মহল্লার মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন—“এই গুহার ভেতরে এমন কিছু আছে যা আমরা আগে কখনও দেখিনি। শিলার গায়ে অচেনা প্রতীক খোদাই করা আছে, সেগুলো পৃথিবীর কোনো ভাষার সঙ্গে মেলে না। আমরা সন্দেহ করছি, এটা প্রাচীন ভিনগ্রহী সভ্যতার নিদর্শন।”

গল্পের মতো শোনালেও মহল্লার ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। সন্ধেবেলায় আড্ডায় চায়ের কাপে কেউ ফিসফিস করে বলল—“যদি ভিনগ্রহীরা সত্যিই থাকে, তারা কি আমাদের ক্ষতি করবে?” পাশেরজন উত্তর দিল—“বাঙালিরা কি কখনও কাউকে কষ্ট দিয়েছে? হয়তো তারা আমাদের সঙ্গেই আড্ডা দিতে চাইবে।” হাসির ঝলক উঠলেও ভেতরে ভেতরে ভয় জমছিল।

সেদিন রাতে কয়েকজন খনি শ্রমিক গুহার ভেতরে নেমে পড়েছিল। তারা ফিরে এসে জানাল, ভেতরে এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেন কেউ কথা বলছে অচেনা ভাষায়। তারা বলল—“আমরা লাইট জ্বালাতেই শিলার গায়ে ঝিকমিক করে উঠল এক ধরনের লিপি। মনে হচ্ছিল আমাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। তারপর হঠাৎই বাতাস কাঁপতে লাগল।” এই বর্ণনা শুনে সবাই শিউরে উঠল, যদিও জানত, গুহার ভেতর বাতাস থাকার কথা নয়।

গুহার খবরে মহল্লার তরুণরা চঞ্চল হয়ে উঠল। কেউ চাইছিল অভিযানে যেতে, কেউ আবার প্রতিবাদ করল। পাড়ার প্রবীণরা বলল—“অতিরিক্ত কৌতূহল সর্বনাশ ডেকে আনে।” কিন্তু কিশোর-কিশোরীরা কান দিল না, তারা গোপনে প্ল্যান করছিল গুহায় যাওয়ার।

এক সন্ধ্যায় কাঁচের গম্বুজের ভেতর থেকে দেখা গেল গুহার দিকের মাটি থেকে আবার আলো বের হচ্ছে। এ বার তা সোজা আকাশের দিকে উঠে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ছোট্ট বাচ্চারা খুশি হয়ে হাততালি দিল—“আতসবাজি!” কিন্তু বড়রা জানল—এটা আতসবাজি নয়, এ অন্য কিছু।

অনিন্দ্য, তরুণ ডাক্তার, একা বসে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল—“আমরা এত দূরে এসেছি নিজেদের জন্য নতুন জীবন খুঁজতে। কিন্তু যদি এই আলো আমাদের পরীক্ষা নেয়? হয়তো মহল্লার অস্তিত্বই প্রশ্নে পড়ে যাবে।” তার পাশে বসা সঙ্গিনী মৃদু গলায় বলল—“তুমি কি মনে করো, আমরা বিপদে পড়ব?” অনিন্দ্য উত্তর দিল না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, যেখানে পৃথিবী নীলাভ গোলকের মতো ঝুলে ছিল, আর নিচে চাঁদের বুক জুড়ে লুকিয়ে ছিল সেই অদ্ভুত গুহা।

গুহার খবর এখন পুরো মহল্লার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ঢাক-আড্ডা-ফুচকার ফাঁকেও মানুষ ফিসফিস করে শুধু গুহার কথা বলছে। সবাই জানত, যেদিন গুহার রহস্য উন্মোচন হবে, সেদিন থেকে আর আগের মতো চাঁদের মহল্লা থাকবে না।

পর্ব ৪ – নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি

চাঁদের মহল্লায় সেই দিনটা শুরু হয়েছিল একেবারে স্বাভাবিকভাবে—বাচ্চারা স্পেস-ট্রামে চেপে স্কুলে গেছে, দোকানে ভেজা চায়ের গন্ধ ভেসে আসছে, ঢাউস স্ক্রিনে কেউ আবার পৃথিবীর পুরনো ফুটবল ম্যাচ চালাচ্ছে। কিন্তু দিনের শেষে এমন কিছু ঘটল, যা মহল্লার মানুষ অনেক বছর মনে রাখবে। কারণ সেদিন এক কিশোর প্রথমবার গুহার ভেতরে পা রাখল, আর ফিরল অন্যরকম হয়ে।

তার নাম তন্ময়। বয়স বারো। সে ছিল অদ্ভুত রকম দুষ্টু আর কৌতূহলী। যখন সবাই আলো-রেখা আর গুহার কথা ভেবে ভয়ে কাঁপছিল, তখন ওর মনে হয়েছিল—“এমন সুযোগ আবার কবে আসবে? যদি সত্যিই ভিনগ্রহী কিছু থাকে, আমি কেন প্রথম সেটা দেখব না?” সে তার বন্ধুকে বলেছিল—“চলো, যাই।” কিন্তু কেউ সাহস করেনি। শেষমেশ একাই বেরিয়ে পড়ল।

সন্ধেবেলা গম্বুজের কাচে পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে নীল আলো ছড়াচ্ছিল, তন্ময় চুপিসারে সিকিউরিটি বেড়িয়ে দক্ষিণের খনির দিকে গেল। গুহার প্রবেশপথ তখন সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল, কিন্তু বাচ্চার সরু শরীর দিয়ে একটা ফাঁক গলে ঢুকে পড়ল। ভেতরে আলো কম, কিন্তু দেয়ালের প্রতিফলন থেকে সবকিছু নীলাভ আভায় ঝিকমিক করছিল। সে যতই ভেতরে যাচ্ছিল, কানে একটা অদ্ভুত গুঞ্জন ভেসে আসছিল—যেন খুব দূর থেকে কেউ মন্ত্র পড়ছে।

তন্ময় হাত বাড়িয়ে শিলার ওপর স্পর্শ করল। হঠাৎই তার চোখের সামনে ঝলসে উঠল অসংখ্য প্রতীক। সেগুলো নড়ছিল, মিশে যাচ্ছিল, আবার ভেঙে পড়ছিল। সে বুঝল না, এগুলো ছবি নাকি ভাষা। কেবল মাথার ভেতর তীব্র চাপ অনুভব করল। গুহার ভেতর তখন নিস্তব্ধতা, কিন্তু তার কান ভরে যাচ্ছিল শব্দে। তন্ময় হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, তারপর কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ওকে খুঁজে পাওয়া গেল অনেক রাতের পর। মহল্লার সিকিউরিটি টিম একটা ড্রোন পাঠিয়ে তাকে গুহার বাইরে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেল। সবাই দৌড়ে এলো। ডাক্তার অনিন্দ্য তার চিকিৎসা শুরু করল। কয়েক ঘণ্টা পর তন্ময় চোখ মেলল। কিন্তু সে যে ভাষায় কথা বলতে শুরু করল, সেটা কেউ বুঝতে পারল না। তার মুখ থেকে ভেসে আসছিল গড়গড় শব্দ, অচেনা প্রতীক-সদৃশ উচ্চারণ, যেগুলো কারও কাছে অর্থহীন।

মা ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল—“ওকে কী হলো?” কিন্তু তন্ময় শুধু অদ্ভুত শব্দ করে যাচ্ছিল। তার চোখে যেন এক অদ্ভুত আলো, যা এই মহল্লায় কেউ আগে দেখেনি। ডাক্তার বলল—“এটা কোনো মানসিক ট্রমা হতে পারে। কিন্তু তার স্নায়ুতন্ত্রে কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছি না।”

বিজ্ঞানীরা দৌড়ে এলেন। ড. সুশোভন মিত্র বললেন—“আমি ওর উচ্চারণ রেকর্ড করছি। এগুলো কোনো কোডেড ভাষা হতে পারে।” তিনি সিস্টেমে শব্দগুলো ঢুকিয়ে বিশ্লেষণ করলেন, আর ফলাফলে দেখা গেল—এই শব্দগুলোর গঠন পৃথিবীর কোনো ভাষার সঙ্গে মেলে না। কিন্তু তবুও এগুলোতে এক ধরনের গণিতের সাদৃশ্য আছে, যেন প্যাটার্নের মধ্যে কোনো বার্তা লুকানো।

মহল্লায় তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বলল—“ওর মধ্যে ভিনগ্রহীর আত্মা ঢুকেছে।” কেউ আবার বলল—“এটা শুধুই অসুখ।” কিন্তু তন্ময়ের আচরণ যেন অন্য কিছু বলছিল। সে মাঝে মাঝে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে শূন্যে আঙুল চালাত, যেন কিছু আঁকছে। দেয়ালে সে প্রতীক আঁকতে চাইত, কিন্তু আঁকার আগেই থেমে যেত।

রাতে তন্ময় হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। সে কাচের গম্বুজের দিকে তাকিয়ে একটানা সেই অচেনা ভাষায় বলতে লাগল। তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে গোটা মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ আতঙ্কে জানলা-দরজা বন্ধ করে দিল, কেউ কেউ ভয়ে প্রার্থনা শুরু করল। তবুও তন্ময়ের গলা যেন গম্বুজ ভেদ করে বাইরে ছড়িয়ে পড়ল, আর দূরের গুহা থেকে মৃদু নীল আলো জ্বলে উঠল।

ড. মিত্র বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললেন—“এটা প্রতিধ্বনি নয়, এ সংযোগ। ছেলেটা গুহার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।” অনিন্দ্য চমকে তাকালেন—“কিন্তু এটা কি আমাদের জন্য বিপদজনক নয়?”

সেই রাতে মহল্লার আকাশে কোনো তারা দেখা যাচ্ছিল না, শুধু পৃথিবী ঝুলছিল নীলাভ আলোয়। অথচ গম্বুজের ভেতর মানুষ দাঁড়িয়ে বুঝে যাচ্ছিল—আজ থেকে তাদের জীবন আর আগের মতো থাকবে না। কারণ চাঁদের মাটিতে এক বাঙালি কিশোর নিজের অজান্তেই ভিনগ্রহী ভাষার প্রথম দূত হয়ে গেছে।

পর্ব ৫ – ভিনগ্রহী সঙ্কেত

তন্ময়ের সেই অচেনা ভাষা মহল্লার প্রত্যেকের হৃদয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। ভোরে যখন আলো ফুটল, তখনও কিশোরের চোখে জ্বলছিল সেই অদ্ভুত দীপ্তি। সে যেন এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে কথা বলছিল, কারও দিকে তাকাচ্ছিল না, কিন্তু শব্দগুলো ভেসে যাচ্ছিল চারপাশে। বিজ্ঞানীরা তার পাশে বসে রেকর্ড করছিলেন, অথচ বারবার অনুভব করছিলেন—এ যেন কেবল মানুষের গলা নয়, বরং কোনো অন্য জায়গা থেকে প্রতিধ্বনিত হওয়া বার্তা।

ড. সুশোভন মিত্র রাতে তৈরি করা অডিওফাইল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে চমকে উঠলেন। তন্ময়ের উচ্চারণে প্রতি তৃতীয় সিলেবলের পর নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি উঠে আসছিল, যা স্পষ্টতই প্রাকৃতিক নয়। তিনি বুঝলেন, এটা কেবল ভাষা নয়, এটা এক ধরনের কডেড সিগন্যাল। তিনি মাইক্রোফোনে সেই ফ্রিকোয়েন্সি পাঠালেন, আর পরের মুহূর্তেই গুহার ভেতর থেকে জ্বলে উঠল নীলাভ আলো। যেন কোনো দূরবর্তী দরজা খুলে যাচ্ছে।

মহল্লায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ ভিড় জমাল আড্ডার চত্বরে। কেউ চিৎকার করে বলল—“এই ছেলেকে গুহার কাছে রাখা যাবে না।” আরেকজন প্রতিবাদ করল—“ও তো আমাদেরই ছেলে, যদি ভিনগ্রহীরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তবে ও-ই বাঁচাবে।” দ্বন্দ্ব ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল।

অনিন্দ্য ডাক্তার হিসেবে তন্ময়কে পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেও দ্বিধায় ভুগছিল। রাতে যখন একা বসে সঙ্গিনীর সঙ্গে কথা বলল, তখন বলল—“আমরা হয়তো এক বিশাল বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এটাও তো হতে পারে, এ সঙ্কেত কোনো সতর্কবার্তা, হয়তো ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদ।” মেয়েটি ধীরে বলল—“তুমি কি মনে করো, তারা শত্রু নাকি বন্ধু?” অনিন্দ্য উত্তর দিতে পারল না।

পরদিন দুপুরে মহল্লার ওপর অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেল। গম্বুজের বাইরে শূন্য আকাশে হঠাৎ ভেসে উঠল আলো-রেখার নকশা। এটা যেন শিলালিপির প্রতিরূপ। মানুষ ছুটে এসে তাকাল, বাচ্চারা চিৎকার করে বলল—“ওই দেখো, আকাশে ছবি আঁকছে।” কিন্তু ড. মিত্র বুঝলেন—এটা ভিজ্যুয়াল সিগন্যাল, এক ধরনের উত্তর। গুহা থেকে পাঠানো সঙ্কেত এখন আকাশে রূপ নিচ্ছে।

তিনি ঘোষণা করলেন—“এটা স্পষ্টতই কোনো বেস, হয়তো হাজার বছর আগে এখানে ভিনগ্রহীরা এসে রেখেছিল। আমরা তাদের প্রযুক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে। ভুল করলে পুরো মহল্লাই ধ্বংস হতে পারে।”

কথাগুলো শুনে মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল বলল—“আমরা বিজ্ঞানী, রহস্য উদঘাটন আমাদের দায়িত্ব। এই বেস হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের শক্তি। চাঁদের মহল্লা পৃথিবীর জন্য গৌরব বয়ে আনবে।” অন্যদল ভয়ে কাঁপল—“না, এটা সর্বনাশ। ভিনগ্রহীরা যদি ফিরে আসে, আমরা তাদের রোষ সামলাতে পারব না। গুহা বন্ধ করে দাও।”

তন্ময় তখনও নিজের অচেনা ভাষায় বলে যাচ্ছিল। তার ঠোঁটের শব্দ মিলছিল আকাশের প্রতীকগুলোর সঙ্গে। হঠাৎ একসময় সে থেমে গেল, তারপর স্বাভাবিক বাংলায় ফিসফিস করে বলল—“তারা আসবে। তারা অনেক দূর থেকে আমাদের ডাক শুনেছে।”

সেই মুহূর্তে গম্বুজের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। মানুষের বুকের ভেতর ভয় আর বিস্ময় মিশে গেল। বাঙালি মহল্লা বুঝল—এ কেবল গুহার রহস্য নয়, এটা এক মহাজাগতিক সংযোগ, যার হাতছানি তাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে।

পর্ব ৬ – মহল্লার দ্বন্দ্ব

চাঁদের মহল্লায় এখন বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সকালবেলায় গম্বুজের ভেতর সূর্যের কৃত্রিম আলো ঝলমল করে ওঠে, মানুষজন দোকানে যায়, বাচ্চারা স্কুলে যায়, কিন্তু প্রতিটি আড্ডার টেবিলে, প্রতিটি ফুচকার লাইনে, প্রতিটি চায়ের কাপে এখন কেবল একটাই আলোচনা—গুহা, তন্ময় আর সেই ভিনগ্রহী সঙ্কেত। যেন হঠাৎ করেই মহল্লা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একপাশে কৌতূহল আর অন্যপাশে ভয়।

ড. সুশোভন মিত্রের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের একদল প্রতিদিন গুহার ভেতর ঢুকছে, প্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করছে, ফ্রিকোয়েন্সি রেকর্ড করছে। তারা বলছে—“এটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। যদি আমরা এই সঙ্কেত বুঝতে পারি, তবে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস পাল্টে যাবে। এটা আমাদের প্রজন্মের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও আশীর্বাদ।” তাদের যুক্তি, মহাকাশে বসতি গড়তে গেলে এই প্রযুক্তি অপরিহার্য।

কিন্তু মহল্লার প্রবীণরা ও অন্য একদল মানুষ একেবারেই রাজি নয়। তারা বলছে—“বাঙালি মহল্লা মানে আড্ডা, গান, পূজো, উৎসব—আমরা তো এখানে এসেছি বাঁচার জন্য, অচেনা ভয় ডেকে আনার জন্য নয়। এই গুহা আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।” মহল্লার বৃদ্ধ অরুণবাবু এক সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—“তোমরা কি ভুলে গেছ, বাঙালি সবসময় অন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে? কিন্তু লড়াই মানে সবসময় সামনে গিয়ে ধাক্কা দেওয়া নয়। কখনও পিছিয়ে আসাটাও বুদ্ধিমানের কাজ।” তার কথায় অনেকে হাততালি দিয়েছিল।

দ্বন্দ্ব প্রতিদিন তীব্র হচ্ছিল। একদল দাবি করল, মহল্লা কমিটি যেন গুহার প্রবেশপথ চিরতরে সিল করে দেয়। অন্যদল প্রতিবাদে গলা চড়াল—“না, এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। এ তো আমাদের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান মিলিয়ে নতুন ইতিহাসের পথ।”

তন্ময় তখনও প্রতিদিন অচেনা ভাষায় কথা বলছে। ডাক্তার অনিন্দ্য তাকে পাহারা দিচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেও বুঝতে পারছে—ছেলেটি কেবল বাহক, তার ভেতর দিয়ে অন্য কেউ কথা বলছে। রাতে অনিন্দ্য সঙ্গিনীর সঙ্গে আলোচনা করছিল—“আমরা কি ঠিক করছি? হয়তো মহল্লা ভেঙে পড়বে এই দ্বন্দ্বে।” মেয়েটি বলল—“কিন্তু আমরা যদি ভয়ে চুপ করি, তবে হয়তো এই সুযোগ আর আসবে না। ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ মানে তো আমাদের অজানার দ্বার খুলে দেওয়া।”

এক সন্ধ্যায় মহল্লার কেন্দ্রে কমিটি মিটিং ডাকা হলো। গম্বুজের নিচে শত শত মানুষ জড়ো হলো। ঢাক-আড্ডার বদলে এবার মাইক্রোফোনে উচ্চ স্বরে তর্ক শুরু হলো। বিজ্ঞানীরা স্লাইডে দেখালেন প্রতীক, বললেন—“এগুলো বারবার একই প্যাটার্ন তৈরি করছে। হয়তো এটা এনার্জি টেকনোলজি। হয়তো জল বা অক্সিজেন তৈরির নতুন উপায়। ভাবুন, চাঁদে আমাদের জীবন কত সহজ হবে।”

কিন্তু বিরোধীরা চিৎকার করে উঠল—“এটা ফাঁদও হতে পারে। ভিনগ্রহীরা যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়? যদি তন্ময়ের মাধ্যমে তারা আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে?” একজন মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল—“আমার ছেলেকে আর বাইরে যেতে দেব না। গুহা যদি আলো ছড়ায়, সেটা সর্বনাশ ডেকে আনবে।”

তর্ক এতটাই বেড়ে গেল যে শেষমেশ ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। গোপন ব্যালটে মানুষ জানাবে—গুহা খোলা থাকবে, নাকি বন্ধ করা হবে। মহল্লার ইতিহাসে এটাই প্রথম গণভোট।

কিন্তু ভোটের আগের রাতেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। তন্ময় হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল—“সময় নেই। তারা আসছে। আমাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে না।” তার চোখ যেন অন্য আলোয় ভরে গেল। মহল্লার চারপাশে নীলাভ ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল, গুহা থেকে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল।

সেই মুহূর্তে মানুষ বুঝল—তর্ক যতই চলুক না কেন, আসল সিদ্ধান্ত হয়তো তাদের হাতে নেই। মহল্লার দ্বন্দ্ব এখন শুধু মানুষের ভেতরে নয়, চাঁদের বুকের গভীরেও গড়াচ্ছে।

পর্ব ৭ – অশরীরী আগমন

চাঁদের মহল্লার আকাশ সেদিন অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠেছিল। পৃথিবী নীলাভ আলো ছড়িয়ে দূরে ঝুলছিল, অথচ গম্বুজের বাইরে যেন এক অদৃশ্য ঢেউ এসে পড়ল। মানুষ প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো কোনো সোলার স্টর্ম। কিন্তু তন্ময়ের চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠতেই সবাই বুঝল—এটা অন্য কিছু।

গুহার ভেতর থেকে গুঞ্জন তখন বেড়ে চলেছে। যেন হাজার কণ্ঠ একসাথে অচেনা ভাষায় ফিসফিস করছে। হঠাৎ মহল্লার বাতি টিমটিম করে নিভে গেল। অন্ধকারে মানুষের শরীর কেঁপে উঠল। শিশুদের কান্না, বয়স্কদের প্রার্থনা, আর সেই ফিসফিস ধ্বনি মিলেমিশে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করল। ডাক্তার অনিন্দ্য দৌড়ে গিয়ে তন্ময়ের হাত ধরল, কিন্তু অনুভব করল—তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে, যেন ভেতরে আর রক্ত নেই।

ঠিক তখনই গম্বুজের ভেতর অদৃশ্য আলোকছায়া ভেসে উঠল। প্রথমে কুয়াশার মতো, পরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট আকার। কোনো দেহ নেই, শুধু আলোর রেখা। তারা মানুষের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ টের পাচ্ছিল না কোনো ওজন। শিশুদের কণ্ঠ থেমে গেল, মানুষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

একটি ছায়া হঠাৎ তন্ময়ের কাছে এসে থামল। তার ঠোঁট নড়ল, আর তন্ময়ের মুখ দিয়ে ভেসে এল সেই অচেনা ভাষা। শব্দগুলো গম্বুজের ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন আকাশ ভরিয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে বাংলার মতো ভাঙা ভাঙা শব্দ শোনা গেল—“আমরা… ফিরে এসেছি।”

শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝল—এই সত্তাগুলো দেহী নয়, অশরীরী। হয়তো হাজার বছর আগে তারা চাঁদে এসেছিল, তাদের বেস ছেড়ে গিয়েছিল। আজ তারা আলো আর প্রতিধ্বনির মাধ্যমে ফিরে এসেছে।

কেউ চিৎকার করে উঠল—“ওরা আমাদের দখল করছে!” আরেকজন বলল—“না, এরা বার্তা দিচ্ছে।” কিন্তু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন দৌড়ে গম্বুজের দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করল, যদিও জানত, অশরীরী শক্তিকে দরজা আটকাতে পারে না।

তন্ময় তখন উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। ছায়াগুলো তার চারপাশে ঘুরে তাকে ঘিরে ধরল। হঠাৎ তার গলা দিয়ে বেরোল এক স্পষ্ট বাক্য—“তোমাদের ভয় নেই। আমরা জীবন চাই, ধ্বংস নয়।”

ড. সুশোভন মিত্র কেঁপে উঠলেন। তিনি বললেন—“তারা এনার্জি সত্তা, দেহহীন প্রাণ। তারা আমাদের ভয় দেখাতে আসেনি, বরং যোগাযোগ করতে চাইছে।” কিন্তু প্রশ্ন রইল—কোনো দেহহীন প্রাণ যদি মানুষের ভেতর ঢুকে পড়ে, তবে মানুষ আর মানুষ থাকে কি না?

সেই রাতে অশরীরী সত্তাগুলো মহল্লায় ঘুরে বেড়াল। কেউ কেউ অনুভব করল, তাদের মনে অদ্ভুত ছবি ভেসে উঠছে—তারাভরা মহাকাশ, ধ্বংস হওয়া গ্রহ, জল খুঁজতে ছুটে চলা সভ্যতা। আবার কেউ বলল, তাদের মাথায় অদ্ভুত সুর বাজছে, যেন এক প্রাচীন গান।

কিন্তু সবাই একই অনুভব করছিল না। কারও মনে হলো তারা বন্ধু, কারও মনে হলো তারা শত্রু। মহল্লা আবার ভাগ হয়ে গেল। শিশুরা তন্ময়ের চারপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপল, কিন্তু তন্ময় শুধু ফিসফিস করে বলল—“তারা আমাদের বাঁচাতে এসেছে, যদি আমরা শুনি।”

ভোর হওয়ার আগেই ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। শুধু গুহার ভেতর থেকে আসছিল হালকা নীল আলো, আর মহল্লার মানুষরা দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। তারা জানল, এবার আর গোপন রাখা যাবে না। অশরীরী সত্তারা এসেছে, আর তারা মহল্লার জীবনকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে।

পর্ব ৮ – চাঁদের মহল্লার সিদ্ধান্ত

চাঁদের মহল্লায় সেই সকালটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতায় ভেসে এসেছিল। গম্বুজের ভেতর বাতি জ্বললেও মানুষের চোখে তখনও রাতের আতঙ্ক জমাট বেঁধে আছে। অশরীরী সত্তারা চলে গেছে, কিন্তু তাদের ছায়া যেন সবার মনের ভেতরে থেকে গেছে। প্রতিটি মুখে ভয়ের রেখা, প্রতিটি কথায় দ্বিধার ছায়া—এখন কী হবে?

কমিটি আবার সভা ডাকল। শত শত মানুষ ভিড় করল কাচঘেরা চত্বরে। কেউই আর আগের মতো হাসিমুখে এলো না। বাচ্চারা চুপচাপ বাবা-মায়ের কোলে বসে থাকল, তরুণরা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করছিল। ঢাক-আড্ডার জায়গায় এবার গুঞ্জন, চাপা কান্না আর উত্তেজনা।

ড. সুশোভন মিত্র প্রথমে দাঁড়িয়ে বললেন—“আমরা যা দেখেছি, তা ইতিহাসে প্রথম। তারা দেহী নয়, কিন্তু বুদ্ধিমান। তারা আমাদের শত্রু নয়—এটাই আমি বিশ্বাস করি। তাদের বার্তা পরিষ্কার—তারা ধ্বংস থেকে বাঁচতে চাইছে, আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হয়তো আশ্রয় খুঁজছে।”

তারপরই প্রবীণ অরুণবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তার গলা কাঁপছিল—“আপনারা কি ভুলে গেছেন? আমরা মানুষ, আমাদের বাঁচতে হলে শান্তি চাই। অচেনা শক্তিকে আহ্বান করলে আমরা শেষ হয়ে যাব। এই গুহা বন্ধ করতে হবে। আমাদের মহল্লা বাঁচাতে হলে ভয় থেকে দূরে থাকতে হবে।”

মানুষ দ্বিধায় পড়ে গেল। কেউ বিজ্ঞানীর পাশে দাঁড়াল, কেউ বৃদ্ধের পাশে। মহল্লা যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। তখন হঠাৎ তন্ময় উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এখন শান্ত আলো, ঠোঁটে মৃদু হাসি। সে স্পষ্ট বাংলায় বলল—“তারা বলেছে, তোমরা যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা মেনে নেবে। ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করতে পারো, তবুও তারা তোমাদের আঘাত করবে না। আবার যদি শোনার চেষ্টা করো, তবে তোমাদের সঙ্গে পথ ভাগ করে নেবে।”

মহল্লার ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সবার দৃষ্টি তন্ময়ের দিকে। ডাক্তার অনিন্দ্য ধীরে বললেন—“তাহলে আমাদের হাতেই সিদ্ধান্ত।”

গণভোট হলো আবার। কিন্তু এবার মানুষ আগের চেয়ে গভীর ভাবে ভেবেছিল। তারা জানত, ভয় নিয়েও চিরকাল বাঁচা যায় না, আবার কৌতূহল নিয়েও ধ্বংস ডেকে আনা যায়। শেষমেশ ফলাফল ঘোষণা হলো—গুহা খোলা থাকবে, কিন্তু সাবধানতার সঙ্গে। মহল্লার সবাই মিলে ঠিক করল, বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাবেন, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ পুরো মহল্লার চোখের সামনে হবে। অন্ধকারে আর কোনো গোপন অভিযান নয়।

ভোটের ফল শোনার পর তন্ময় শুধু বলল—“ওরা খুশি।” যেন তার ভেতর দিয়ে অন্য কারও স্বর ভেসে এলো। বাইরে গুহার আলো ম্লান হলো, কিন্তু পুরো গম্বুজজুড়ে ভেসে উঠল নরম নীল আভা—শান্ত, মৃদু, আশ্বাসদায়ী।

সেই রাতে প্রথমবার মানুষ আবার গান ধরল। কারও হাতে ঢোল, কারও হাতে বাঁশি। বাচ্চারা হাসল, বড়রা নিশ্বাস ফেলল স্বস্তিতে। মহল্লা বুঝল—অজানার মুখোমুখি হয়েও তারা একসঙ্গে থাকতে পারে। ভয় আর ভবিষ্যত, দুটোই বেছে নেওয়া যায়, যদি মানুষের হাত এক থাকে।

চাঁদের আকাশে তখনো ঝুলছে নীলাভ পৃথিবী। গম্বুজের ভেতর এক বাঙালি মহল্লা তার সংস্কৃতি, সাহস আর কৌতূহল নিয়ে ঠিক করে নিল—তারা অজানাকে ভয় করবে না, বরং শুনবে, বুঝবে, শেখার চেষ্টা করবে। এই মহল্লা কেবল মানুষ নয়, হয়তো ভিনগ্রহীদেরও আশ্রয় হয়ে উঠবে একদিন।

আর সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই চাঁদের মহল্লা নতুন ইতিহাসের পথে হাঁটতে শুরু করল—যেখানে ভয় আর ভবিষ্যতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার একতা।

WhatsApp-Image-2025-09-05-at-5.53.41-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *