Bangla - রহস্য গল্প

ঘড়ির কাঁটা

Spread the love
এক
ড. অমিতাভ সেনগুপ্ত ছিলেন দেশের অন্যতম খ্যাতিমান পদার্থবিদ, যিনি সময় ও শক্তি-সম্পর্কিত গবেষণায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি, উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ি, যেন বিজ্ঞান আর প্রাচীনতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন—একদিকে আধুনিক ল্যাবরেটরি, অন্যদিকে কাঠের আসবাব, পুরনো বইয়ের তাক, আর দেয়ালে টাঙানো বিরল ঘড়ি। সেই বাড়ির স্টাডি রুমে, এক শীতল নভেম্বরের রাত, পুলিশ এসে দেখতে পেলেন—ড. সেনগুপ্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর ডান হাত ছড়ানো, মুখে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। চোখ আধখোলা, যেন মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি কিছু দেখেছিলেন যা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঘরের বাতাসে ভাসছে পুরনো কাঠের গন্ধ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা হাওয়া, আর দেয়ালে টাঙানো একটি প্রাচীন ফরাসি তৈরি দেয়ালঘড়ি, যার কাঁটা থেমে আছে রাত ১০টা ৩৪ মিনিটে। সেই সময়টিই পুলিশের নথিতে মৃত্যুর আনুমানিক সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়, কিন্তু এই সমাপতন কি নিছকই কাকতালীয়? নাকি ঘড়ির সঙ্গে মৃত্যুর অদৃশ্য যোগসূত্র আছে?
কেয়ারটেকার গোবিন্দ দাস, সত্তরের কাছাকাছি বয়সের, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ, ঘটনাটি প্রথম দেখতে পান। তিনি পুলিশকে জানান, সেদিন রাতেও তিনি স্বাভাবিক মতোই বাড়ির সামনের ছোট্ট ঘরে বসে ছিলেন, হাতে কাপে চা। তখন হঠাৎ তিনি শুনতে পান, স্টাডি রুমের ঘড়ির টিকটিক শব্দ থেমে গেছে। গোবিন্দ এই বাড়িতে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছেন; তিনি বলেন, “বাবু, ওই ঘড়ি আমি যতদিন জানি, একদিনও থামেনি। ঘড়িটা যেন নিজের মতো চলত।” তিনি উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে এগোতেই ভেতর থেকে একটা চাপা ধাক্কার শব্দ আসে—যেন কেউ পড়ে গেছে। দরজা আধখোলা ছিল, ভিতরে ঢুকে তিনি দেখেন, ড. সেনগুপ্ত মেঝেতে পড়ে আছেন, আর ঘড়ির কাঁটা নিস্তব্ধ। তাঁর ভয় পাওয়া চোখ, কাঁপা হাতের আঙ্গুল দিয়ে তিনি পুলিশকে ঘটনাস্থল দেখান, যেন নিজের চোখের সামনে ঘটতে থাকা অসম্ভব ঘটনার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই খুঁজে পাচ্ছেন না।
পুলিশ ঘরে ঢুকেই দেখে, কোনও জোরপূর্বক প্রবেশের চিহ্ন নেই। জানলার কপাট ভেতর থেকে বন্ধ, দরজার লক অক্ষত। ডেস্কের উপর ছড়ানো কিছু কাগজ, কলম, এবং একটি খোলা নোটবই—যেখানে শেষ লেখা কয়েকটি সমীকরণ যেন হঠাৎ থেমে গেছে, মাঝপথে অসমাপ্ত। কাগজের এক পাশে একটি পুরনো চাবি রাখা, যা সম্ভবত দেয়ালঘড়ির জন্যই ব্যবহার হয়। অফিসার বিবেক মুখার্জি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন—এর কাঠের বডি, সোনালি ব্রাসের পেন্ডুলাম, আর নিখুঁতভাবে খোদাই করা ফুলের নকশা যেন সময়ের ইতিহাস বলছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি একেবারে স্থির—যেন জীবন হারানো এক দেহ। বিবেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ঘড়ির কাঁটা কেন ঠিক মৃত্যুর মুহূর্তেই থেমে গেল? আর যদি ঘড়ি কেবল একটি যান্ত্রিক বস্তু হয়, তবে তার এই নিখুঁত সমাপতন ব্যাখ্যা করা যাবে কীভাবে? গোবিন্দের বিবৃতির সঙ্গে ঘড়ির অবস্থার অদ্ভুত মিল দেখে অফিসার আরও বেশি সতর্ক হয়ে ওঠেন।
রাত গড়িয়ে মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে, পুলিশের ফরেনসিক দল এসে মৃতদেহ পরীক্ষা শুরু করে। প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা যায়, ড. সেনগুপ্তর মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন আছে, যা সম্ভবত শক্ত কোনও কিছুর ধাক্কায় হয়েছে। কিন্তু ঘরে এমন কোনও বস্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি যা ওই আঘাতের জন্য দায়ী হতে পারে। আরও বিস্ময়ের বিষয়, মৃত্যুর প্রায় একই মুহূর্তে পুরো বাড়ির বিদ্যুৎপ্রবাহে এক সেকেন্ডের জন্য অদ্ভুত এক ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশন রেকর্ড হয়েছে—যা পরে বিদ্যুৎ বিভাগও নিশ্চিত করে। তবে বাড়ির বাকি অংশে আলো স্বাভাবিক ছিল, কেবল স্টাডি রুমেই সেই এক সেকেন্ডের জন্য মৃদু অন্ধকার নেমে এসেছিল। ঘড়িটি খুলে পরীক্ষা করার কথা ভাবলেও, ড. সেনগুপ্তর স্ত্রী ইন্দ্রাণী পুলিশের কাছে অনুরোধ করেন সেটি যেন না খোলা হয়, কারণ স্বামীর কথামতো—“এই ঘড়ি একবার থেমে গেলে, শুধু সময় নয়, অন্য কিছু থেমে যায়… যা আবার চালু হলে থামবে কিছু আরেকটা।” তাঁর এই রহস্যময় সতর্কবার্তা রাতের শীতল হাওয়ার মতোই উপস্থিত সকলের মেরুদণ্ডে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। এইভাবেই প্রথম অধ্যায়ের শেষে দাঁড়িয়ে থাকে অমীমাংসিত প্রশ্ন—ঘড়ির কাঁটা থামার পেছনে কি নিছক কাকতালীয় ঘটনাই দায়ী, নাকি শুরু হয়েছে এক ভয়ঙ্কর খেলার প্রস্তাবনা?
দুই
ড. অমিতাভ সেনগুপ্তর মৃত্যুর পরের দিন সকালে, অফিসার বিবেক মুখার্জি তাঁর ল্যাবরেটরি ঘরে প্রবেশ করেন। ল্যাবটি ছিল মূল ভবনের পেছনের অংশে, একটি আলাদা কংক্রিটের ঘর—যেখানে জানালা নেই, কেবল একটি ভারী ধাতব দরজা। দরজার কোড লক ভেঙে খোলা হয় ফরেনসিক টিমের উপস্থিতিতে। ভেতরে ঢুকেই তাদের চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য—সারা ঘর জুড়ে ছড়ানো রয়েছে জটিল যন্ত্রপাতি, কিছু আধুনিক, কিছু আবার অস্বাভাবিকভাবে পুরনো কিন্তু পরিবর্তিত আকারে। মাঝখানে বড় একটি পরীক্ষাগার টেবিল, তার ওপর খোলা নোটবই, বিভিন্ন নীলনকশা, এবং গ্লাসের জারে রাখা অজানা রঙের স্ফটিক পদার্থ। ঘরের কোণে একটি উঁচু ধাতব ফ্রেমে বাঁধা বিশাল চৌম্বক কুণ্ডলী রাখা, যা দেখে বোঝা যায়—এটি কোনও উচ্চ-শক্তির পরীক্ষার অংশ। বাতাসে এক ধরনের ধাতব গন্ধ ভাসছে, যেন এখানে সম্প্রতি প্রবল বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়েছে। ল্যাবের দেয়ালে ঝুলছে একটি বড় সাদা বোর্ড, যেখানে খড়ির দাগে অসমাপ্ত সমীকরণ, তরঙ্গ চিত্র, আর সময়ের প্রতীক দিয়ে আঁকা একটি ঘড়ির স্কেচ—যার কাঁটা এক স্থানে আটকে আছে।
বিবেক মুখার্জি নোটবই হাতে তুলে নিতেই তাঁর ভ্রু কুঁচকে যায়। পাতাগুলোতে একের পর এক জটিল গাণিতিক সূত্র, যেগুলির কিছু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা পড়ার সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পারেন, কিন্তু বাকি অংশ একেবারেই অপরিচিত—যেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বাইরে কোনও নিষিদ্ধ জ্ঞান। সূত্রগুলির পাশে হাতের লেখা ইংরেজি ও বাংলায় মিলেমিশে, যেমন—“Time Field Resonance—critical at 10:34 PM” বা “Magnetic Pulse Lock → Chrono Energy Freeze”। এসব দেখে বিবেকের মনে প্রশ্ন জাগে—ড. সেনগুপ্ত কি সত্যিই সময় থামানোর মতো কোনও প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন? ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ড. রানা, যিনি তার সঙ্গে ছিলেন, বলেন—“এগুলো সাধারণ চৌম্বকীয় বা ইলেকট্রিক্যাল সমীকরণ নয়, এগুলো পরীক্ষামূলক ‘ক্রোনো-ফিজিক্স’—যা নিয়ে সাধারণ বিজ্ঞানী কাজই করেন না, কারণ সামান্য ভুলে বিপর্যয় ঘটতে পারে।” বিবেকের মনে তখনই মৃত্যুর সময়ের সঙ্গে দেয়ালঘড়ির থেমে যাওয়ার মিল মনে পড়ে যায়। ১০টা ৩৪ মিনিট—ঠিক সেই সময়ের উল্লেখ নোটে কেন আছে?
ডেস্কের ড্রয়ারের ভেতর থেকে বিবেক একটি ফাইল পান, যার কভার জীর্ণ এবং বাদামি রঙে দাগ পড়া। ভেতরে হাতে আঁকা কিছু ডায়াগ্রাম, যেখানে একটি প্রাচীন দেয়ালঘড়ির কাঠামোকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্র হিসেবে রূপান্তর করার নকশা আছে। পেন্ডুলামের জায়গায় একটি স্ফটিক কোর বসানো হয়েছে, যার চারপাশে রয়েছে চৌম্বক কুণ্ডলী ও ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ সংযোগ। ফাইলের প্রথম পাতায় লেখা—“Project Kaalchakra — Phase 3”। এর নিচে লাল কালিতে লেখা সতর্কবার্তা—“Activation beyond 3 seconds may cause irreversible temporal lock.” এই কথাগুলোর অর্থ স্পষ্ট না হলেও, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে বিবেকের। যদি এই পরীক্ষাটি সত্যি কাজ করে, তবে এটি মানুষের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। বিবেক বুঝতে পারেন, এই গবেষণা প্রকাশ্যে এলে শুধু বৈজ্ঞানিক জগত নয়, রাজনৈতিক দুনিয়াতেও তোলপাড় হবে। এরই মধ্যে তিনি লক্ষ্য করেন, ঘরের একপাশে রাখা একটি ধাতব বাক্সে ছোট্ট লক—যেটি ভাঙা। বাক্সের ভেতর কিছু নেই, কেবল কয়েকটি খালি ফোমের স্লট—যেখানে কিছু রাখার কথা ছিল। কী ছিল সেখানে? আর কে নিয়ে গেল?
বিবেক বাইরে বেরিয়ে গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলে, বৃদ্ধ কেয়ারটেকার দ্বিধা নিয়ে বলেন—“সেদিন বিকেলে অরিন্দমবাবু (গবেষণা সহকারী) ল্যাবে ঢুকেছিলেন। কিছু কাগজপত্র আর একটা ছোট বাক্স হাতে নিয়ে তিনি বেরিয়ে যান। বাবুকে (ড. সেনগুপ্ত) তখন বেশ রাগান্বিত মনে হয়েছিল।” বিবেক তখন মনে মনে মিলিয়ে দেখেন—মৃত্যুর সময়, ঘড়ির থেমে যাওয়া, ১০:৩৪-এর সমীকরণ, আর ল্যাবের খালি বাক্স—সব এক সূক্ষ্ম সুতায় বাঁধা। তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়, ড. সেনগুপ্তর মৃত্যু নিছক খুন নয়, বরং একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফল, যার উদ্দেশ্য বা পরিণতি তিনি এখনও পুরোপুরি বোঝেননি। এই ল্যাব যেন মৃত্যুর পূর্বাভাস রেখে গেছে—বিপজ্জনক সত্য উন্মোচনের জন্য। বিবেক জানেন, যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে “Project Kaalchakra”র বাকি অংশ উদ্ধার করতে হবে, কারণ এই রহস্য যতদিন অমীমাংসিত থাকবে, ততদিন কেউ না কেউ এর মারাত্মক শক্তির লোভে আবারও সময় থামানোর চেষ্টা করবে।
তিন
অরিন্দম চক্রবর্তী, ড. সেনগুপ্তর গবেষণা সহকারী, বয়স তিরিশের কাছাকাছি, পাতলা চেহারা, চোখে সবসময় এক ধরনের তীক্ষ্ণ কৌতূহল। পুলিশের প্রথম জিজ্ঞাসাবাদে সে দাবি করে, খুনের রাতে সে মোটেও বাড়িতে ছিল না—বরং কলেজ স্ট্রিটের এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে বইপত্র সাজাতে সাহায্য করছিল। সে নির্দিষ্টভাবে বলে, “আমি সন্ধ্যা সাতটার পরে স্যারকে দেখিনি। ওনার সঙ্গে সেদিন সকালে কিছু ডেটা শেয়ার করেছিলাম, তারপর আমি বেরিয়ে যাই।” তার কণ্ঠস্বর শান্ত, তবে বিবেক মুখার্জি লক্ষ্য করেন, প্রশ্নের উত্তরে সে প্রায়ই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে, টেবিলে আঙুল ঠুকছে—যা একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দার চোখে স্পষ্ট নার্ভাসনেসের লক্ষণ। বিবেক তাকে তখনই ছেড়ে দেন, কিন্তু মনে মনে ঠিক করেন, অরিন্দমের দেওয়া তথ্য যাচাই করবেন, কারণ মৃত্যুর সময় আর ল্যাবের অদ্ভুত অবস্থা—সব কিছুতেই অরিন্দমের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
পরের দিন বিবেক স্থানীয় একটি দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন, যা ড. সেনগুপ্তর বাড়ির ঠিক বিপরীতে। ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১০টা ৩১ মিনিটে অরিন্দম বাড়ির দিকে হাঁটছে, হাতে একটি কাগজে মোড়ানো লম্বাটে জিনিস—যা দেখতে যন্ত্রাংশ বা কোনও কন্টেইনারের মতো। তিন মিনিট পরে, ১০টা ৩৪ মিনিটে, স্টাডি রুমের জানালার পাশের আলো ক্ষণিকের জন্য নিভে যায়—যে সময়ে গোবিন্দর মতে ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছিল। এবং প্রায় এক মিনিট পরে, অরিন্দমকে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়, মুখে উদ্বিগ্ন অভিব্যক্তি। এই প্রমাণ হাতে নিয়ে বিবেক আবার অরিন্দমকে ডেকে পাঠান। এবার তার সামনে ফুটেজ চালিয়ে দেন, এবং ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেন—“তুমি বলেছিলে, সাড়ে সাতটার পর তুমি এখানে আসোনি। তাহলে এটা কাকে দেখাচ্ছে?” ফুটেজে নিজের ছবি দেখে অরিন্দমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। প্রথমে সে কিছু বলতে চায় না, তারপর হঠাৎ বলে ওঠে—“আমি… আমি শুধু কিছু ডেটা নিতে এসেছিলাম। স্যার চাইছিলেন না আমি প্রজেক্টের কিছু ফাইল হাতে রাখি। আমি লুকিয়ে ঢুকেছিলাম।”
বিবেক লক্ষ্য করেন, অরিন্দমের স্বীকারোক্তি আংশিক সত্য হলেও পুরো নয়। কারণ যদি সে কেবল ফাইল নিতে এসে থাকে, তবে এত রাতে লুকিয়ে ঢোকার প্রয়োজন কেন? আর হাতে থাকা কাগজে মোড়ানো জিনিসটি কী ছিল? আরও চাপ দিলে অরিন্দম বলে, খুনের রাতের কয়েকদিন আগে থেকেই ড. সেনগুপ্ত অত্যন্ত নার্ভাস ছিলেন। তিনি কয়েকবার বলেছিলেন, “কেউ আমাদের গবেষণা চুরি করতে চাইছে।” সেদিন রাতে ড. সেনগুপ্ত তাঁকে ফোন করে বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ অবিলম্বে ল্যাব থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, কারণ সেটি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কিন্তু যখন অরিন্দম পৌঁছান, তখন স্টাডি রুমের ভেতর থেকে হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ শোনেন—যেন ধাতব ঘর্ষণ আর সঙ্গে বৈদ্যুতিক ক্র্যাকলিং মিশে গেছে। দরজা আধখোলা থাকায় তিনি ভেতরে তাকাতেই দেখেন, স্যার মেঝেতে পড়ে আছেন আর দেয়ালঘড়ি নিস্তব্ধ। আতঙ্কে তিনি যন্ত্রাংশটি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যান। অরিন্দম দাবি করে, স্যার তখনই মারা গিয়েছিলেন, আর সে কাউকে হত্যা করেনি।
তবে বিবেকের সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। যদি সত্যিই ড. সেনগুপ্ত মৃত্যুর আগে যন্ত্রাংশটি সরিয়ে নিতে বলেন, তবে সেটি এখন কোথায়? অরিন্দম সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে এড়িয়ে যায়, বলে—“আমি সেটা নিরাপদে রেখেছি, পরে দেব।” তার কণ্ঠে দ্বিধা, চোখে অনিশ্চয়তা—যেন সে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে, সত্য বলবে নাকি গোপন রাখবে। বিবেক বুঝতে পারেন, অরিন্দমের ভয় কেবল পুলিশের নয়—সে যেন আরেকজন বা আরেক কিছুর ভয়ে আতঙ্কিত। অধ্যায়ের শেষে বিবেক মনে মনে ঠিক করেন, অরিন্দমকে শুধু সন্দেহভাজন হিসেবে নয়, বরং এই রহস্যের একমাত্র জীবিত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে নজরে রাখতে হবে। কারণ তার অর্ধেক সত্য ও অর্ধেক মিথ্যা কথার আড়ালে হয়তো লুকিয়ে আছে সেই চাবি, যা দিয়ে “Project Kaalchakra”-র রহস্য উন্মোচন হবে।
চার
বিকেলের দিকে, যখন বিবেক মুখার্জি ল্যাব থেকে স্টাডি রুমের নথি পরীক্ষা করছেন, বাইরে হঠাৎ ক্যামেরার শাটারের শব্দ শোনা যায়। তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখেন, এক তরুণী, গলায় প্রেস কার্ড ঝুলানো, লম্বা চুলে হালকা হাওয়ার খেলা, হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে। তিনি আর কেউ নন—শ্রেয়া মিত্র, কলকাতার একটি বড় দৈনিকের খ্যাতনামা ক্রাইম রিপোর্টার। শ্রেয়া সবসময়ই তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর অদ্ভুত তথ্যসূত্রের জন্য পরিচিত, এবং পুলিশের মধ্যে তার খ্যাতি মিশ্র—কেউ তাকে পছন্দ করে, কেউ বা বিরক্ত হয় তার অবাঞ্ছিত উপস্থিতিতে। বিবেক দরজা খুলে তাকে ভিতরে ডাকেন, যদিও চোখে এক ধরনের সতর্কতার রেখা ফুটে ওঠে। শ্রেয়া ভিতরে এসে সরাসরি স্টাডি রুমের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়, এবং এক মুহূর্তে যেন সবকিছু পরিমাপ করে নেয়।
“আপনি কি জানেন, এই ঘড়ি আসলে একটি যন্ত্রের আড়াল?”—শ্রেয়া হঠাৎ বলল। বিবেক প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, তারপর চুপচাপ অপেক্ষা করলেন তার ব্যাখ্যার জন্য। শ্রেয়া ব্যাগ থেকে একটি পুরনো নোটবুক বের করল, যা ড. সেনগুপ্তর পুরনো গবেষণার একটি ফটোকপি। তাতে একটি পেন্ডুলাম-ভিত্তিক ডিভাইসের স্কেচ আছে, যা দেখতে হুবহু এই দেয়ালঘড়ির ভেতরের কাঠামোর মতো। স্কেচের নিচে ইংরেজিতে লেখা—“Chrono-Stop Prototype, Mark I”. শ্রেয়া বলল, “আমার ধারণা, ড. সেনগুপ্ত বহু বছর আগে থেকেই এই প্রোটোটাইপ নিয়ে কাজ করছিলেন। এই যন্ত্র চৌম্বক ক্ষেত্র ও সময় তরঙ্গের উপর প্রভাব ফেলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সময় থামাতে সক্ষম। কিন্তু তিনি কখনও এটি প্রকাশ্যে আনেননি—কারণ এর ক্ষমতা ভুল হাতে পড়লে বিপর্যয় ঘটতে পারে।” বিবেক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কারণ ঠিক এই মুহূর্তে শ্রেয়ার কথা তার ল্যাবে পাওয়া নোট ও ১০:৩৪-এর সমীকরণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
শ্রেয়া আরও বলে, তার এক সূত্র জানিয়েছে—সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রাইভেট সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টর ও বিদেশি প্রযুক্তি সংস্থা ড. সেনগুপ্তর উপর নজর রাখছিল। তারা হয়তো জানতে পেরেছিল যে “Chrono-Stop” ঘড়ির মধ্যে লুকানো আছে, আর সেটি চুরি করার জন্যই খুন হয়েছে। “আপনি ভাবুন,”—শ্রেয়ার কণ্ঠ গম্ভীর—“যদি কেউ এই যন্ত্রের মাধ্যমে সময় থামাতে পারে, সে যেকোনও জায়গায় ঢুকে খুন, ডাকাতি বা তথ্য চুরি করতে পারবে—প্রমাণ ছাড়াই।” বিবেক মনে মনে অরিন্দমের হাতে ধরা রহস্যময় বস্তুটির কথা ভাবেন, যা সে খুনের রাতে নিয়ে বেরিয়েছিল। সেটা কি এই প্রোটোটাইপ, নাকি এর কোনও গুরুত্বপূর্ণ অংশ? শ্রেয়া বলেন, “আমার মনে হয়, হত্যাকারী ঘড়ি খুলে প্রোটোটাইপ বের করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছু গণ্ডগোল হয়েছিল—যার ফলেই এই মৃত্যু।”
বিবেক জানেন, সাংবাদিকদের তথ্য অনেক সময় সহায়ক হলেও, তারা নিজের সূত্র রক্ষা করতে গিয়ে সত্যের অর্ধেকই প্রকাশ করে। শ্রেয়ার হঠাৎ আগমন, তার হাতে ড. সেনগুপ্তর গবেষণার নকল, এবং ঘড়ির ভেতরে যন্ত্র থাকার সুনির্দিষ্ট ধারণা—সবই তাকে সন্দেহজনক করে তুলছে। তবু বিবেক চুপ করে তার কথা শোনেন, কারণ শ্রেয়ার কাছে এমন কিছু তথ্য থাকতে পারে যা এখনও পুলিশের হাতে নেই। শ্রেয়া শেষমেশ বলে ওঠে, “দেখুন, অফিসার মুখার্জি, আমি এই কেস কভার করব, এবং যদি সত্যিই এখানে একটি টাইম-স্টপ ডিভাইস থাকে, তবে সেটি এখনো বিপদে। খুনি সেটি না পেয়ে ফিরে আসবে।” তার কণ্ঠে কোনও আতঙ্ক নেই, বরং এক ধরনের দৃঢ়তা—যেন সে এই বিপজ্জনক খেলায় নিজের ভূমিকা ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে। বিবেক জানেন, এর পর থেকে তাকে শুধু অরিন্দম নয়, শ্রেয়াকেও নিবিড়ভাবে নজরে রাখতে হবে, কারণ এই কেসে এখন প্রতিটি খেলোয়াড়ের উদ্দেশ্য আলাদা এবং রহস্য আরও গভীর হচ্ছে।
পাঁচ
ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত, শান্ত মুখের কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টির এক নারী, পুলিশ স্টেশনে আসার বদলে সরাসরি ঘটনাস্থলে বিবেক মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কালো শাড়িতে মোড়ানো তাঁর গড়ন যেন এক অদ্ভুত স্থিরতা প্রকাশ করছিল, কিন্তু চোখের গভীরে ছিল অস্থিরতার ছায়া। ঘরে প্রবেশ করেই তিনি প্রথমে তাকালেন দেয়ালে ঝোলানো ফরাসি ঘড়িটির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “অফিসার, আমি চাই এই ঘড়ি যেন কেউ না খোলে, অন্তত এখনই নয়।” বিবেক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি জানেন, এই ঘড়ির ভেতরে কিছু আছে?” ইন্দ্রাণী কিছুক্ষণ নীরব রইলেন, যেন শব্দ খুঁজছিলেন, তারপর বললেন, “আমি শুধু জানি, অমিতাভ মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে আমাকে ফোনে বলেছিলেন—‘এই ঘড়ির কাঁটা থেমে গেলে, শুধু সময় নয়… আরেকটা জিনিসও থেমে যাবে।’” তাঁর কণ্ঠে ছিল ভয় আর শোকের মিশ্রণ। বিবেকের মনে সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রশ্ন জাগল—“আরেকটা জিনিস” বলতে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? মানুষের জীবন? কোনও প্রক্রিয়া? নাকি কোনও অদৃশ্য শক্তি?
ইন্দ্রাণী চুপচাপ একটি খাম বের করলেন তাঁর ব্যাগ থেকে। ভিতরে ছিল কয়েকটি হাতে লেখা নোট—অমিতাভের অদ্ভুত সব বাক্য: “সময়ের প্রবাহ কেবল ঘড়ির সূচকে নয়, স্থানেও বাঁধা”, “থেমে যাওয়া মানেই স্থিরতা নয়, বরং এক ধরনের স্থবিরতা।” বিবেক নোটগুলো পড়ে বুঝতে পারলেন, এগুলো সাধারণ বৈজ্ঞানিক মন্তব্য নয়, বরং ব্যক্তিগত সতর্কবার্তা। ইন্দ্রাণী ব্যাখ্যা করলেন, “শেষ কয়েক মাস ধরে অমিতাভ ঘুমোতে পারতেন না। মাঝরাতে উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন—‘এটা কেবল ঘড়ি নয়, ইন্দ্রাণী, এটা একটি রক্ষাকবচ।’” তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল, ঘড়িটি অমিতাভের কাছে শুধুমাত্র একটি প্রাচীন শিল্পকর্ম নয়, বরং কোনও বিপজ্জনক রহস্যের পাহারাদার। বিবেক মনে মনে শ্রেয়া মিত্রের বলা ‘Chrono-Stop’ প্রোটোটাইপের কথা মিলিয়ে দেখতে লাগলেন—যদি সত্যিই ঘড়িটি সময় থামাতে পারে, তবে “আরেকটা জিনিস” থেমে যাওয়া মানে হতে পারে এমন কোনও প্রক্রিয়া বা শক্তি, যা সক্রিয় থাকলে পৃথিবী বা অন্তত আশপাশ নিরাপদ থাকে।
ইন্দ্রাণী আরও একটি ঘটনা শেয়ার করলেন—দুই সপ্তাহ আগে এক অচেনা বিদেশি পুরুষ বাড়িতে এসেছিল, নিজেকে একজন গবেষক বলে পরিচয় দেয়। সে দাবি করেছিল, ঘড়িটি নাকি তার পূর্বপুরুষদের তৈরি, এবং সেটি ফেরত দেওয়া উচিত। অমিতাভ তখনই তাকে বিদায় করে দেন, কিন্তু পরে ইন্দ্রাণীকে বলেন, “ওরা জেনে গেছে, এটা কোথায় আছে। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।” সেই রাতেই অমিতাভ প্রথমবারের মতো ‘আরেকটা জিনিস’ কথাটি উচ্চারণ করেন। ইন্দ্রাণীর মতে, খুনের আগের সন্ধ্যাতেও অমিতাভ খুব অস্থির ছিলেন, এবং তিনি একাধিকবার ল্যাব ও স্টাডি রুমে যাতায়াত করছিলেন—যেন কিছু পরীক্ষা করছেন বা কিছু প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু ঠিক কী প্রস্তুতি, সেটা তিনি কাউকে জানাননি। বিবেক লক্ষ্য করলেন, ইন্দ্রাণীর কথায় আবেগ থাকলেও তথ্যের মধ্যে স্পষ্টতা আছে, এবং তিনি চেষ্টা করছেন যেন ঘড়ির প্রকৃত রহস্য কারও হাতে না পড়ে।
বিবেক বুঝতে পারলেন, ইন্দ্রাণীর সতর্কবার্তা অমূলক নয়। যদি সত্যিই ঘড়ি একটি বিপজ্জনক যন্ত্র হয় এবং সেটি খোলার ফলে কোনও অপ্রত্যাশিত প্রক্রিয়া থেমে যায়, তবে তার প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। এই কেসে এখন তিনটি ভিন্ন সতর্কবার্তা রয়েছে—অরিন্দমের আতঙ্ক, শ্রেয়ার তত্ত্ব, আর ইন্দ্রাণীর সাবধানবাণী—যেগুলো ভিন্ন সূত্রে এলেও এক জায়গায় মিলছে: ঘড়িটি স্পর্শ করাই বিপজ্জনক। কিন্তু পুলিশের দায়িত্ব তদন্ত করা, আর তদন্ত মানে অনেক সময় নিষিদ্ধ জিনিসের মুখোমুখি হওয়া। বিবেক স্থির করলেন, আপাতত ঘড়িটি সিল করে রাখা হবে, এবং কেবল তখনই খোলা হবে যখন তার ভিতরের রহস্য বোঝা যাবে। তবে মনের গভীরে তিনি অনুভব করলেন, হয়তো সময় থেমে যাওয়ার আগেই এই রহস্য সমাধান করতে হবে, কারণ কারও না কারও উদ্দেশ্য সেই ‘আরেকটা জিনিস’ থামিয়ে দেওয়া—আর সেটা ঘটলে হয়তো আর ফিরে যাওয়ার পথ থাকবে না।
ছয়
রজত বসু, শহরের নামকরা প্রাচীন জিনিসপত্রের ব্যবসায়ী, বিবেক মুখার্জির সামনে বসে সিগারেট ধরালেন, যদিও তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের ভান করা শান্তি ঝরে পড়ছিল। রজতের দোকানটি কলকাতার এক পুরনো গলিতে, যেখানে কাঠের আলমারি, পিতলের প্রদীপ, রূপার পানপাত্র আর মখমলের পর্দায় ঢাকা প্রাচীন চেয়ার সাজানো থাকে—সবই রাজকীয় আভিজাত্যের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। রজত স্বীকার করলেন, “হ্যাঁ, আমি বহুবার ড. সেনগুপ্তর কাছে সেই ঘড়িটি কেনার চেষ্টা করেছি। এমন নয় যে আমি ওটার ক্ষমতা জানতাম… অন্তত পুরোটা নয়।” বিবেক ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন, “তাহলে কেন বারবার চেষ্টা করেছিলেন?” রজত চোখ সরিয়ে ধোঁয়ার ভেতর তাকালেন, “আমার পেশা পুরনো জিনিস বেচা-কেনা, কিন্তু কিছু কিছু জিনিস শুধু অর্থের জন্য নয়—ওগুলোতে থাকে ক্ষমতা। আর সেই ফরাসি ঘড়ির ভিতরে, আমার মনে হয়েছে, এমন কিছু আছে যা সাধারণ মানুষ বোঝে না।” তাঁর কণ্ঠে এক মুহূর্তের জন্য লোভের শীতল স্রোত বয়ে গেল, যা বিবেক স্পষ্টই অনুভব করলেন।
রজত আরও জানালেন, প্রথমবার তিনি ঘড়িটি দেখেছিলেন প্রায় দশ বছর আগে, যখন এক নিলামে ড. সেনগুপ্ত ঘড়িটি কিনেছিলেন। তখন থেকেই তিনি সেটি পেতে চাইছিলেন। “আমি তিনগুণ দামও দিতে রাজি ছিলাম,”—রজতের ঠোঁটে হালকা হাসি—“কিন্তু ড. সেনগুপ্ত আমাকে সোজাসুজি বলে দেন, ‘এটা বিক্রির জন্য নয়, রজত। এই ঘড়ি কেবল সময় মাপে না—এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।’” রজত বললেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন, বিজ্ঞানীর এই কথাটা কেবল আবেগপ্রবণতার প্রকাশ। কিন্তু কয়েক বছর আগে, যখন ড. সেনগুপ্তর এক বিদেশি সহকর্মী তাঁর দোকানে এসে ঘড়ি নিয়ে খোঁজখবর করেন, তখন তাঁর সন্দেহ হয়, ঘড়িটি আসলেই সাধারণ জিনিস নয়। বিবেক জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি সেই বিদেশির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন?” রজত প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু পরে মাথা নাড়লেন, “ও হঠাৎ উধাও হয়ে গেল… তবে যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘যে ঘড়ি সময় থামাতে পারে, সে জগৎও বদলাতে পারে।’”
বিবেক তখন সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “আপনার কি ঘড়ি চুরি করার কোনও পরিকল্পনা ছিল?” রজত কিছুক্ষণ নীরব রইলেন, যেন উত্তর দেওয়ার আগে নিজের কথা মেপে নিচ্ছেন। “পরিকল্পনা… হ্যাঁ, ছিল। তবে খুন করার পরিকল্পনা নয়,”—রজতের গলায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—“আমি জানতাম, ড. সেনগুপ্ত জীবিত অবস্থায় ঘড়ি দেবেন না, কিন্তু হয়তো কখনও দুর্বল মুহূর্তে বা কোনও আর্থিক চাপে রাজি হয়ে যাবেন। আমি চাইনি তাঁর ক্ষতি হোক, কিন্তু… যদি অন্য কেউ ওটা কেড়ে নিতে আসে, তবে আমি আগেই পেতে চাইতাম।” তাঁর স্বীকারোক্তিতে বিবেক বুঝতে পারলেন, রজত এই খেলায় বহুদিন ধরে আছেন, কিন্তু খুনের ঘটনায় তাঁর জড়িত থাকার সরাসরি প্রমাণ এখনো নেই। তবুও তাঁর এই লোভ এবং দীর্ঘদিনের নজরদারি তাঁকে প্রধান সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখার মতো যথেষ্ট কারণ।
রজতের অফিস থেকে বেরিয়ে বিবেক অনুভব করলেন, এই কেসে লোভ, বিজ্ঞান আর রহস্যের মিশ্রণ এক জটিল জাল বুনেছে। অরিন্দমের মিথ্যে কথা, শ্রেয়ার প্রোটোটাইপ তত্ত্ব, ইন্দ্রাণীর সতর্কবার্তা—সবকিছুতেই ঘড়িটিকে কেন্দ্র করে অদৃশ্য স্রোত বইছে। রজতের দীর্ঘদিনের লালসা শুধু প্রমাণ করছে যে এই ঘড়ি অনেকের চোখে মূল্যবান, কিন্তু এর প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে সবাই সমানভাবে নিশ্চিত নয়। হয়তো ড. সেনগুপ্তের “সবচেয়ে বড় পরীক্ষা” কথাটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটি বিজ্ঞানভিত্তিক বিপ্লব, অথবা এমন কোনও শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ যা মানুষের জীবনধারা বদলে দিতে পারে। বিবেক জানতেন, সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে তাঁকে এখন ঘড়ির অতীত, মালিকানার ইতিহাস, আর তার সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষের সম্পর্ক খুঁটিয়ে দেখতে হবে—কারণ যতক্ষণ না ঘড়ির কাঁটা আবার চলতে শুরু করছে, ততক্ষণ সময়ের এই রহস্যও থেমে থাকবে না।
সাত
দেয়ালঘড়িটি খোলার দিন সকালে গোটা বাড়িতে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত বারবার অনুরোধ করছিলেন, “অফিসার, সাবধানে খুলবেন… এটা কেবল কাঠের আর কাচের জিনিস নয়।” বিবেক মুখার্জি এবং তাঁর টিম, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে, প্রাচীন ফরাসি ঘড়িটির ধুলো মুছে ধীরে ধীরে পিছনের প্যানেল খুলতে শুরু করলেন। কাঠের ভেতর থেকে প্রথমে বেরিয়ে এল কিছু অচেনা পিতলের গিয়ার আর স্প্রিং, যেগুলো স্বাভাবিক ঘড়ির অংশ মনে হলেও, একজন বিশেষজ্ঞ সঙ্গে সঙ্গেই বললেন—“এগুলো ঘড়ি চালানোর জন্য নয়।” গিয়ারের নিচে লুকানো ছিল একটি ছোট্ট ধাতব বাক্স, যার গায়ে সূক্ষ্ম খোদাই—অদ্ভুত সব চিহ্ন, যা ল্যাটিন বা ফরাসি কোনও ভাষার অক্ষর নয়। বাক্সটি তোলার মুহূর্তে ইন্দ্রাণীর মুখ সাদা হয়ে গেল। তিনি প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “ওটা… ওটাই।” বিবেক ধীরে ধীরে বাক্সটি খুললেন, আর ভেতরে যা দেখলেন, তা তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক মস্তিষ্ককেও থমকে দিল—একটি ক্ষুদ্র ক্রিস্টাল ডিস্ক, যা অল্প আলো পড়তেই যেন নিজের ভেতরে রঙিন তরঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে, এবং মৃদু কিন্তু স্পষ্ট এক ধরনের কম্পন তৈরি করছে।
ডিস্কটির এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য সবাইকে বিভ্রান্ত করে দিল। ফরেনসিক অফিসার বললেন, “এটা কোনও সাধারণ ক্রিস্টাল নয়। এতে যেন অভ্যন্তরীণ গঠন বদলাচ্ছে, কিন্তু তাপমাত্রা বা চাপের কারণে নয়… যেন নিজস্ব একটি রিদম আছে।” বিবেক ডিস্কটির দিকে তাকিয়ে অনুভব করলেন, এই বস্তুই হয়তো সময় থামানোর ক্ষমতার মূল উৎস। শ্রেয়া মিত্র, যিনি সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, চোখ বড় করে বললেন, “এটাই সেই প্রোটোটাইপ। Chrono-Stop ডিভাইসের হার্ট।” ইন্দ্রাণী কণ্ঠ কাঁপিয়ে বললেন, “অমিতাভ বলেছিলেন, এটা ভুল হাতে পড়লে শুধু সময় নয়, অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।” তাঁর কণ্ঠে হতাশা আর ভয়ের মিশ্রণ শোনা যাচ্ছিল। রজত বসুর কথাও বিবেকের মনে পড়ল—“যে ঘড়ি সময় থামাতে পারে, সে জগৎও বদলাতে পারে।” এখন মনে হচ্ছে, সেই কথাগুলো শুধু অতিরঞ্জন নয়।
বিবেক সঙ্গে সঙ্গে ডিস্কটিকে একটি সুরক্ষিত কন্টেইনারে রাখার নির্দেশ দিলেন, কিন্তু তাঁর ভেতরে এক চাপা অস্থিরতা কাজ করছিল। তিনি জানতেন, এই ডিস্কের অস্তিত্ব যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ খুনের কেসটি শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নয়—এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের বৈজ্ঞানিক যুদ্ধের অংশ, যেখানে লড়াই হচ্ছে শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য। তিনি ভাবছিলেন, খুনি কি কেবল এই ডিস্কের জন্যই ড. সেনগুপ্তকে হত্যা করেছিল, নাকি এর সঙ্গে যুক্ত আরও গভীর কোনও উদ্দেশ্য ছিল? কারণ এতদিন যা যা সূত্র তিনি পেয়েছেন—অরিন্দমের দ্বিমুখী কথা, শ্রেয়ার সতর্ক তত্ত্ব, ইন্দ্রাণীর রহস্যময় সতর্কবাণী, রজতের দীর্ঘদিনের লোভ—সবই এসে মিলছে এই ক্রিস্টাল ডিস্কের দিকে। আর এখন যেহেতু পুলিশ ডিস্কটি হাতে পেয়েছে, খুনির জন্য এটি পুনরুদ্ধার করা আরও জরুরি হয়ে উঠতে পারে।
ঘড়ির ভেতর থেকে এই গোপন কুঠুরি আর ক্রিস্টাল ডিস্কের আবিষ্কার কেসটিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেল। বিবেকের মনে হচ্ছিল, যেন তিনি এক অদৃশ্য সময়স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছেন—যেখানে এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের গতিপথ বদলে দিতে পারে। এই ডিস্ক এখন পুলিশের কাছে সুরক্ষিত থাকলেও, এর প্রকৃত ক্ষমতা বোঝা এখনও বাকি। আর ততক্ষণ পর্যন্ত, এটি শুধু একটি প্রমাণ নয়, বরং এক সম্ভাব্য বিপদের উৎস। বিবেক জানতেন, তদন্তের পরবর্তী ধাপ হবে এই ডিস্কের উত্স ও প্রযুক্তি খুঁজে বের করা, এবং সেই সঙ্গে খুঁজে বের করা, কার স্বার্থে এবং কেন সময় থামানো প্রয়োজন ছিল। তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—এই ডিস্ক কি সত্যিই সময় থামাতে পারে, নাকি এর ক্ষমতা আরও ভয়ঙ্কর, যা এখনো কেউ কল্পনাও করতে পারছে না?
আট
ল্যাবের সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া মাত্র বিবেক মুখার্জি জানতেন, এটা কেসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বাঁক। ড. সেনগুপ্তর ব্যক্তিগত ল্যাবে বসানো ক্যামেরাগুলো ছিল সর্বাধুনিক, নাইট ভিশন ক্ষমতাসহ, কিন্তু ১০টা ৩৪ মিনিটের সেই মুহূর্ত যেন পুরো প্রযুক্তিকেই ব্যর্থ করে দিয়েছে। ফুটেজে দেখা গেল—ঘড়ির কাঁটা থামার ঠিক মুহূর্তে ল্যাবের ভেতরকার আলো হঠাৎ নিভে গেল। পুরো ল্যাব এক সেকেন্ডের জন্য কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল, যেন কেউ ইচ্ছে করেই বিদ্যুৎ সরবরাহ কেটে দিয়েছে। কিন্তু সেই অন্ধকার এতটাই অস্বাভাবিক ছিল যে, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও বললেন, “এটা স্বাভাবিক পাওয়ার আউটেজ নয়। সমস্ত আলো একসঙ্গে বন্ধ হওয়া আর ঠিক এক সেকেন্ড পর ফের জ্বলে ওঠা—এটা অনেকটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালসের মতো।” আলো ফিরে আসার পর দৃশ্যপটে কিছুটা এলোমেলোতা ধরা পড়ল—একটি চেয়ার কয়েক ইঞ্চি সরে গেছে, টেবিলের উপর একটি কাগজ মেঝেতে পড়ে আছে, এবং ড. সেনগুপ্তর কাঁধ তখন নিথরভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল সেই এক সেকেন্ডের ভেতর কে ঢুকল বা বেরোল, তা নির্ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বিবেক ফুটেজ বারবার দেখলেন—অন্ধকারের আগে এবং পরে কয়েকটি অস্পষ্ট ছায়া দেখা গেলেও, সেগুলো ঠিক কোন মানব আকৃতির, নাকি ক্যামেরার সেন্সর বিকৃতির কারণে তৈরি হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে তিনি লক্ষ্য করলেন, অন্ধকার কাটার পর দরজার কাছে যেন এক মুহূর্তের জন্য হালকা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে, যা দ্রুত মিলিয়ে যায়। ফরেনসিক দলের একজন বললেন, “যদি এটা তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাব হয়, তবে ওই সময় ল্যাবে প্রবল শক্তির স্থানান্তর ঘটেছিল।” বিবেকের মনে হল, হয়তো এই শক্তিই ঘড়ির কাঁটা থামিয়েছে, এবং সেই সঙ্গে ল্যাবের পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তা প্রমাণ করার জন্য ফুটেজের এই অন্ধকার এক অবিশ্বাস্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ফুটেজ প্রকাশ পাওয়ার পর সন্দেহভাজনদের আচরণ আরও তীক্ষ্ণ নজরে ধরা পড়ল। অরিন্দম, যিনি দাবি করেছিলেন খুনের সময় তিনি ল্যাবের কাছে ছিলেন না, ফুটেজের আগের কয়েক মিনিটে বাইরে করিডোরে হাঁটতে দেখা গেল—যদিও তাঁর মুখ স্পষ্ট নয়। রজত বসু দাবি করলেন, তিনি তখন নিজের দোকানে ছিলেন, কিন্তু বিবেকের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল—রজতের মতো কেউ জানলে যে ঘড়ির ভেতরে এমন কিছু আছে, তবে তিনি চেষ্টা করতেই পারেন। শ্রেয়া মিত্র সাংবাদিক হলেও, তাঁর তথ্যের উৎস এতটাই নির্ভুল ছিল যে, মনে হচ্ছিল তিনি ঘটনা সম্পর্কে আগেই অনেক কিছু জানতেন। আর ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত? ফুটেজে তাঁকে দেখা যায়নি, কিন্তু তাঁর সতর্কবাণী এই অন্ধকারের ঘটনার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়—যেন তিনি জানতেন, ঘড়ির কাঁটা থামার সঙ্গে সঙ্গেই সময়ে এক ধরনের ফাঁক তৈরি হবে, যেখানে সত্যিই এক সেকেন্ডের জন্য সবকিছু শূন্য হয়ে যাবে।
বিবেক বুঝলেন, এই এক সেকেন্ডের অন্ধকার কেসের কেন্দ্রবিন্দু। এটি কেবল সময়ের একটি ফাঁক নয়, বরং প্রমাণ লোপাটের জন্য নিখুঁত সুযোগ—যেখানে মানুষ, বস্তু, এমনকি প্রমাণও অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে কোনও চিহ্ন ছাড়া। তিনি ভাবছিলেন, ক্রিস্টাল ডিস্ক কি এই ঘটনাটির জন্য দায়ী? আর যদি তা-ই হয়, তবে খুনি কি ইচ্ছাকৃতভাবে ডিস্ক সক্রিয় করে এই এক সেকেন্ডের অদৃশ্য পর্দা তৈরি করেছিল? তদন্তের এই ধাপে এসে বিবেক জানলেন, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এই এক সেকেন্ডের রহস্য ভেদ করা—কারণ যতক্ষণ না তিনি জানতে পারছেন, সেই মুহূর্তে কে কী করেছে, ততক্ষণ খুনের আসল রহস্য এবং সময় থামানোর প্রযুক্তির উৎস উন্মোচন হবে না। এই এক সেকেন্ড যেন গোটা কেসের চাবিকাঠি, আর সেই চাবি এখনো লুকিয়ে আছে অন্ধকারের ভেতরে।
নয়
অরিন্দমের দিকে আঙুল তোলার মুহূর্তটি বিবেক মুখার্জির জন্য একেবারেই হঠাৎ আসেনি। দিনের পর দিন সূত্রগুলো গেঁথে তিনি ধীরে ধীরে বুঝেছিলেন, যে এক সেকেন্ডের অন্ধকার, ঘড়ির থেমে যাওয়া, এবং ক্রিস্টাল ডিস্ক সক্রিয় হওয়া—সবকিছুর পেছনে ছিল একজনই, আর সে হচ্ছে ড. সেনগুপ্তর গবেষণা সহকারী অরিন্দম। তাঁর প্রথম মিথ্যে আলিবাই, করিডোরে উপস্থিত থাকার সিসিটিভি ফুটেজ, এবং ল্যাবের ভিতরে ঘড়ি স্পর্শ করার আঙুলের ছাপ—সব মিলিয়ে এক নিখুঁত ছবির মতো জুড়ে গেল। বিবেক যখন অরিন্দমকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে এলেন, তখন তাঁর মুখে ছিল না ভয়, বরং এক ধরনের অবসাদ। চেয়ারে বসেই অরিন্দম বললেন, “আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্যার… কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়।” বিবেক জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ঘড়ির কাঁটা থামিয়েছ কেন?” অরিন্দম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওটা অমিতাভ স্যারের অসমাপ্ত পরীক্ষা ছিল—আমি ভেবেছিলাম আমি যদি প্রমাণ করতে পারি যে এটা কাজ করে, তবে ওনার স্বপ্ন পূর্ণ হবে।”
অরিন্দমের বয়ান ধীরে ধীরে পরিষ্কার করল সেই রাতের ঘটনাপ্রবাহ। তিনি স্বীকার করলেন যে, তিনি ঘড়ির কাঁটা থামানোর জন্য বিশেষ চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন, যা ক্রিস্টাল ডিস্ক সক্রিয় করে। সেই মুহূর্তেই সারা ল্যাব এক সেকেন্ডের জন্য শক্তির শূন্যতায় ঢুকে পড়ে—যেন সময় সত্যিই থেমে গেছে। কিন্তু সেই সেকেন্ডের ভেতরে সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অন্ধকার কাটার মুহূর্তে ড. সেনগুপ্ত তাঁর দিকে এগিয়ে আসছিলেন, সম্ভবত তাঁকে থামাতে। তখনই, এক অদ্ভুত শক্তির ধাক্কায়, যা অরিন্দমের নিজের তৈরি ক্ষেত্রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, ড. সেনগুপ্ত পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে মাথা আঘাত করেন। “আমি ওনাকে ধাক্কা দিইনি,” অরিন্দম বলল কণ্ঠ কাঁপিয়ে, “শুধু বাতাসের ঢেউয়ের মতো কিছু ওনাকে ছুঁয়ে ফেলেছিল। আমি ওনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
বিবেক জানতেন, আইনের চোখে এই ঘটনা হত্যা হিসেবেই গণ্য হবে, কারণ অরিন্দম জানতেন তাঁর পরীক্ষাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, তবুও তিনি তা চালিয়েছিলেন ড. সেনগুপ্তর অজান্তে। কিন্তু এই বয়ান একটি ভিন্ন চিত্রও তুলে ধরল—এখানে উদ্দেশ্য খুন নয়, বরং এক ধরণের ভুল হিসাব, যা প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে এনেছে। তবুও, বিবেকের মনে হচ্ছিল, অরিন্দম হয়তো পুরো সত্য বলছে না। কারণ ঘড়ি এবং ক্রিস্টাল ডিস্কের ব্যাপারে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা দেখাচ্ছিল, তিনি বহুদিন ধরে গোপনে এর কার্যপ্রণালি পরীক্ষা করছিলেন। “তুমি নিশ্চিত এটা কেবল পরীক্ষার জন্যই ছিল?”—বিবেক চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। অরিন্দম চোখ নামিয়ে বলল, “আমি… আমি শুধু চেয়েছিলাম এটা হারিয়ে না যায়। আপনি জানেন না, বাইরে কতজন এই জিনিসটার জন্য অপেক্ষা করছে।”
অরিন্দমকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিলেও, বিবেকের মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা রয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই কেসের শেষ পর্ব হয়তো আদালতে শেষ হবে, কিন্তু প্রকৃত রহস্য—সময় থামানোর ক্ষমতার—গল্প এখানেই শেষ নয়। অরিন্দমের কথায় বারবার উঠে আসা “বাইরের লোক” কারা? তারা কি রজত বসুর মতো পুরনো লোভী ব্যবসায়ী, নাকি আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি চক্র, যারা এই ডিস্ক দখল করতে চায়? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—ড. সেনগুপ্ত কি জানতেন তাঁর সহকারী এতদূর যাবে? কেসের ফাইল বন্ধ হওয়ার প্রস্তুতি চললেও, বিবেক জানতেন, ক্রিস্টাল ডিস্ক এখনো রয়েছে, এবং যতদিন এটি আছে, ততদিন সময়ের খেলা শেষ হবে না। তিনি চুপচাপ নিজের নোটবুকে লিখলেন—“হত্যাকারী ধরা পড়েছে, কিন্তু শিকার এখনো অদৃশ্য।”
দশ
পুলিশ হেফাজতে আনা প্রাচীন ফরাসি দেয়ালঘড়িটি সযত্নে রাখা হয়েছিল প্রমাণ সংরক্ষণাগারের একটি আলাদা কক্ষে। কাঁচের বাক্সের মধ্যে, ঠান্ডা আলোয়, ঘড়িটি যেন নিথর হয়ে শুয়ে আছে—তার কাঁটা ঠিক যেমন খুনের রাতে থেমে ছিল, রাত ১০টা ৩৪ মিনিটে। বিবেক মুখার্জি মাঝে মাঝে প্রমাণ ঘর দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক তাকাতেন ঘড়িটির দিকে, যেন অদৃশ্যভাবে তা তাকে ডাকছে। অরিন্দমের গ্রেপ্তারের পর কেসটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও, ঘড়িটির চারপাশে এক ধরনের অদ্ভুত অশান্তি লেগেই ছিল। ইন্দ্রাণী সেনগুপ্তের সতর্কবাণী—“এই ঘড়ির কাঁটা থেমে গেলে, শুধু সময় নয়… আরেকটা জিনিসও থেমে যাবে”—বিবেকের মাথায় ঘুরপাক খেত। সেই “আরেকটা জিনিস” কী, তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন না, কিন্তু তার পেছনে এমন কিছু ছিল যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রমাণের কাগজপত্র সই করতে করতে তিনি বুঝতেন, এই ঘড়ি কেবল মৃত বস্তু নয়, যেন কোনো গভীর নিদ্রায় থাকা প্রাণী।
সেই রাতে, থানার সব কাজ শেষ করে বিবেক নিজের অফিসে ফাইল গুছিয়ে রাখছিলেন। বাইরে নীরবতা, শুধু দূরে কুকুরের ডাক আর মাঝে মাঝে গাড়ির শব্দ ভেসে আসছিল। প্রায় মধ্যরাত, হঠাৎ তার কানে এল এক পরিচিত কিন্তু বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া শব্দ—টিক… টিক… টিক…। প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো পাশের অফিসে কারও ডেস্কের ঘড়ি চলছে। কিন্তু শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে বুঝলেন, তা আসছে প্রমাণ ঘর থেকে। দরজা খুলতেই ঠান্ডা বাতাসের হালকা ঝাপটা গায়ে লাগল। কাঁচের বাক্সের ভেতর ঘড়িটি, থেমে থাকা কাঁটা সত্ত্বেও, সেই প্রায়-অদৃশ্য সোনালি দোলকটিকে সামান্য দুলিয়ে টিকটিক শব্দ তুলছে। বিবেকের বুকের ভেতর ঠান্ডা শিরশিরানি নেমে এল—কাঁটা এখনো ১০টা ৩৪ মিনিটে, কিন্তু শব্দ… শব্দ যেন বলছে সময় আবার শ্বাস নিতে শুরু করেছে।
তিনি ধীরে ধীরে ঘড়ির কাছে গিয়ে তাকালেন। মুহূর্তের জন্য মনে হল, কাঠের ফ্রেমের ভেতর কিছু নড়ে উঠল—যেন কোনো ছায়া ভেসে গেল ক্রিস্টাল ডিস্কের উপর দিয়ে। আলো পড়তেই সেই ডিস্ক এক ঝলক মৃদু আলো ছড়িয়ে দিল, ঠিক যেমন ল্যাবের অন্ধকারে দেখা গিয়েছিল। বিবেক হাত বাড়ালেন, কিন্তু ছোঁয়ার আগেই যেন বুকের ভেতর এক তীব্র অস্বস্তি জমে উঠল, যেন কেউ চিৎকার করে বলছে—“থামো!” তিনি হাত সরিয়ে নিলেন, চোখ সরু করে তাকিয়ে রইলেন। টিকটিক শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হতে লাগল, যেন কাঁটার প্রতিটি সম্ভাব্য নড়াচড়া আরেকটি অদৃশ্য যন্ত্রকে সক্রিয় করছে। হঠাৎ ঘড়ির ভেতরের দোলক থেমে গেল—সব নীরব। কিন্তু বিবেক বুঝলেন, এই থেমে যাওয়া স্বস্তির নয়, বরং ঝড়ের আগে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা।
বিবেক সেদিন রাতে থানায়ই থেকে গেলেন। পরদিন সকালে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করার সময় তিনি এক নতুন কেস ফাইলের খসড়া খুলে ফেললেন—“ঘড়ির কাঁটা: পুনঃতদন্ত।” নিজের নোটে লিখলেন, “রাত ১০টা ৩৪ মিনিটে আবারও শব্দ শোনা গেছে। সম্ভাবনা আছে—যন্ত্রটি নিজেই সময় চক্র পুনরায় চালু করছে। পরবর্তী সক্রিয় মুহূর্ত অজানা।” কিন্তু এই নোট লেখার সময়ও তিনি খেয়াল করলেন, দেয়ালের ঘড়ি—যেটি থানার সাধারণ অফিস ঘড়ি—তার কাঁটাও যেন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল। যদিও অন্য কেউ খেয়াল করল না, বিবেক জানলেন, খেলার নিয়ম আবার শুরু হয়েছে। গল্পের শেষ দৃশ্য যেন চুপচাপ ইঙ্গিত দিল—পরের বার যখন সময় থামবে, হয়তো আরেকজনের জীবন থেমে যাবে, আর খুনের তালিকায় যুক্ত হবে নতুন এক নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *