অর্ণব গুহ
পর্ব ১: পুরনো পাতার গন্ধে
বৃষ্টির পর বিকেলের আলোটা যেন গড়বেতার আকাশে রূপকথার পর্দা টেনে দিয়েছে। মাটি থেকে ধোঁয়ার মতো জলীয়বাষ্প উঠছে, যেন মাটিও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিমি জানালার পাশে বসে ছুঁয়ে দেখছিল তার ঠাকুরদার পুরনো নোটবুকটা। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর গায়ে ঘামের মতো ছাপ, পুরনো কালি ঝাপসা, কিন্তু কিছু লেখা এখনও পরিষ্কার—
“যদি খুঁজে পাও সেই লাল পাথর, তার নিচে শুয়ে আছে কুড়ি কুড়ি স্বর্ণমুদ্রা—বজ্রসেনের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার। কিন্তু তার আগে পেরোতে হবে বাঘের গুহা, মৃত জলের কুয়া, আর রক্তলাল মহুল গাছ।”
রিমি একগাল হেসে উঠে চিৎকার করে ডাকল, “আকাশ! ঈশান! তুহিন! তোরা একবার দেখ তো!”
আকাশ, যে ইতিহাসে মাস্টার্স করছে, ছুটে এল, চোখে কৌতূহল। ঈশান, তার বরাবরের বিজ্ঞান-মনস্ক বন্ধু, একটু বিরক্ত হলেও এল। তুহিন এল ক্যামেরা হাতে, কারণ ওর কাছে সবকিছুই গল্পের খোরাক।
রিমি পাতা উল্টে মানচিত্রটা খুলে ধরল। একটা অদ্ভুত আঁকা, হাতে টানা রেখা, বাঁকা নদী, কিছু অচেনা প্রতীক। আকাশ বলল, “এটা তো নিশ্চয়ই কোনও স্থানীয় মানচিত্র। এই নদীটা আমাদের গড়বেতার শীলাবতীও হতে পারে!”
ঈশান বলল, “এখনও তো জানি না এ সব সত্যি কি না। এসব তো গল্পেও থাকে।”
তুহিন বলল, “তবু খুঁজে দেখি না! এমনিতেই ছুটিতে এসেছি, একটা অভিযান হোক না। আমাদের নিজেদের গেম!”
রিমি মৃদু হেসে বলল, “তবে কাল সকাল থেকেই শুরু হোক। রক্তলাল মহুল গাছের নিচে যদি স্বর্ণ না-ও পাই, অন্তত কিছু তো পেয়ে যাব—ভেতরের গল্পগুলো।”
চোখাচোখি হলো চারজনে। এই টান, এই উত্তেজনা, এই আগ্রহ—এত বছর বন্ধুত্বের পরেও যেন নতুন করে জেগে উঠল।
সন্ধ্যায় ঠাকুরদার বাড়ির উঠোনে বসে ওরা মানচিত্র নিয়ে আলোচনা করছিল। রিমি মানচিত্রটা রেখে বলল, “প্রথম গন্তব্য: বাঘের গুহা। লোকমুখে শুনেছি, বালিগড়া টিলার পাশে এক গুহা আছে, যেটাকে সবাই ভয় পায়।”
আকাশ বলল, “শুনেছি আগেকার দিনে এক কালো বাঘ ওখানে থাকত। এখন কেউ যায় না।”
ঈশান বলল, “তা হলে কাল সকালেই বেরোবো। তবে প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। টর্চ, দড়ি, ক্যামেরা, জল, আর কিছু শুকনো খাবার।”
তুহিন ছবি তুলছিল, রিমি ক্যাম্পিং ব্যাগ গোছাচ্ছিল, আর আকাশ পুরনো জমিদার বজ্রসেন সম্পর্কে তথ্য পড়ছিল তার মোবাইলে।
রাতটা এক অদ্ভুত উত্তেজনায় কেটেছে। চারজনের চোখে ঘুম নেই। যেন ভেতরে কোথাও কিছু একটা দুলছে—অজানা, অথচ টানতেও থাকা এক রহস্যের কণ্ঠস্বর।
পরদিন ভোরবেলা সব কিছু গুছিয়ে, মানচিত্র হাতে রওনা দিল ওরা বালিগড়া টিলার দিকে। রাস্তা এবড়োখেবড়ো, সাইকেল রেখে হাঁটা শুরু করতে হলো। চারপাশে জঙ্গল ঘন হয়ে উঠছে। পাখিদের ডাক আর পাতা ঝরার শব্দে যেন প্রকৃতি নিজেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
হঠাৎ করেই সামনে দেখা গেল একটা বড় পাথুরে গুহা। তার মুখ ঘিরে বুনো লতা, ঘন জঙ্গল। গুহার মুখে পাথরে খোদাই করা চিহ্ন—একটা বাঘের মুখ। সেই মুখের চোখের জায়গায় ফাঁকা গর্ত।
আকাশ এগিয়ে গিয়ে বলল, “এটাই নিশ্চয় গুহা। আর এই চিহ্নটাই আমাদের প্রথম সূত্র।”
রিমি নিচু হয়ে দেখে বলল, “চোখের গর্তে কিছু বসানো ছিল, হয়তো পাথর বা রত্ন।”
ঈশান বলল, “তাহলে খুঁজে দেখি আশেপাশে।” সবাই মিলে গুহার আশেপাশে খোঁজ শুরু করল। হঠাৎ রিমি এক ঝোপের ভেতর হাত দিয়ে তুলে আনল—দুটি ছোট লাল কাঁচপাথর। দেখে মনে হচ্ছিল বহুদিন ধরে ধুলোয় পড়ে আছে।
পাথর দুটি সেই খোদাই করা গর্তে বসাতেই গুহার ভেতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন এল। একটা পাথরের দেওয়াল সরে গেল ধীরে ধীরে। টর্চের আলোতে দেখা গেল ভেতরে আরেকটা পাথরে খোদাই করা লেখা—
“যদি চাও সত্য, পার করো মৃত জলের কুয়া—যেখানে পানি নেই, কিন্তু প্রতিফলন আছে।”
চারজনে একে অপরের দিকে তাকাল। আর কেউ কিছু বলার আগেই রিমি বলল, “চলো, কুয়ার সন্ধানে।”
পর্ব ২: মৃত জলের কুয়া
সকালটা তুলনামূলক শান্ত। আগের রাতের জঙ্গলের গুঞ্জন এখনও মন থেকে পুরোপুরি কাটেনি। চারজনের চোখে ঘুম ছিল না ঠিক, তবে উত্তেজনার জায়গায় এক ধরণের মনোযোগ জন্ম নিচ্ছিল—যেটা শুধু সত্যিকারের অভিযানে জন্মায়।
আকাশ মানচিত্র খুলে আবার যাচাই করল, “এই অংশটা দেখ—বাঘের গুহা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা গোল বৃত্ত আঁকা আছে। এর নিচে একরকম খালি চিহ্ন। এটা নিশ্চয়ই কুয়া।”
ঈশান মাথা নাড়ল, “কিন্তু ‘মৃত জলের কুয়া’ মানে কী?”
রিমি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, “পানি নেই, অথচ প্রতিফলন আছে—মানে নিচে কিছু আছে, হয়তো এমন কিছু যা আলো পড়লে দেখা যায়, কিন্তু উপরে পানি নেই বলে সবাই অগ্রাহ্য করে।”
তুহিন ক্যামেরার লেন্স চেক করে বলল, “চলো, ক্যামেরায় ধরা পড়ে কিনা দেখি।”
ওরা হাঁটতে লাগল বালিগড়ার জঙ্গল পেরিয়ে, কাঁচা পথ ধরে আরও ভেতরে। রোদটা চড়ে উঠেছে, গায়ে লাগছে মাটির কাঁচা গন্ধ আর শুকনো পাতার গুড়গুড় শব্দ। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর ওরা পৌঁছাল এক পুরনো খোলা জায়গায়। মাঝখানে একটা পাথরের কুয়া—মাথা নিচু, যেন সে-ও নিজেই কিছু লুকিয়ে রেখেছে।
আকাশ আগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে দেখল, “পানি নেই। কিন্তু ভিতরটা অন্ধকার—পুরোটাই ধুলো আর নীচে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।”
রিমি নিচু হয়ে একটা ছোট পাথর ছুঁড়ে দিল ভিতরে। কিছুই বাজলো না—এক অদ্ভুত নিঃসাড় নীরবতা যেন নিচে কিছু শুষে নিল।
ঈশান বলল, “এই নীরবতাই অস্বাভাবিক। আর আমরা জানি, ওখানে কিছু আছে।”
তুহিন বলল, “একটা আইডিয়া আছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চালিয়ে নিচে একবার ছবি তুলে দেখি।”
ও ক্যামেরার ফ্ল্যাশ অন করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। তারপর ব্যাকস্ক্রীনে চেক করতে করতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “দ্যাখ! এটা কী?”
সবাই ঘিরে ধরল তুহিনকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কুয়ার নিচে এক রকম ধাতব কিছু—একটা সিন্দুকের মতো বস্তুর ধূসর রেখা।
রিমি ফিসফিস করে বলল, “ওটা যদি গুপ্তধনের সিন্দুক হয়?”
আকাশ বলল, “তবে আমাদের নামতেই হবে নিচে। তবে সাবধানে। নিচে নামার জন্য দড়ি আর টর্চ দরকার।”
ঈশান ব্যাগ থেকে একটা মোটা রশি বের করল, আর আকাশ ওর পকেট থেকে ছোট একটা টর্চ দিল। সিদ্ধান্ত হলো ঈশান আর রিমি নামবে—বাকি দুজন উপরে থেকে দেখবে আর সাহায্য করবে।
রশি গেঁথে নামতে নামতে রিমি কুয়ার ঠান্ডা দেওয়াল ছুঁয়ে বুঝতে পারল—এটা শুধুই কুয়া নয়, যেন এক পুরনো নির্মাণ, নিচে তৈরি করা হয়েছে কিছু লুকিয়ে রাখার জন্য।
নিচে পৌঁছে রিমি হাঁটু গেড়ে বসে হাত রাখল ধাতব সিন্দুকের গায়ে। পুরনো, ধুলো জমা, জং ধরা—তবু এক অদ্ভুত মহিমা আছে। একটা নকশা খোদাই করা—মহুল ফুলের গড়নের মতো কিছু, যার পাঁপড়ি ছড়ানো।
ঈশান আস্তে আস্তে ঢাকনাটা খুলল। ভিতরে রাখা একটা সোনালি খামে মোড়ানো চিঠি। রিমি সেটা তুলে পড়তে শুরু করল—
“যদি সত্যিই প্রস্তুত হও, পেরোও রক্তলাল মহুল গাছের নিচে সন্ধ্যা ছায়ার পথ। একবার ঢুকলে ফিরতে পারবে না আগের মত। ধন তারাই পায়, যারা চোখের চেয়ে অন্তর দিয়ে দেখে।”
আকাশ ওপরে দাঁড়িয়ে বলল, “কী লেখা আছে?”
রিমি চিৎকার করে বলল, “পরবর্তী গন্তব্য—মহুল গাছ। তবে সন্ধ্যাবেলা যেতে হবে। আর চিঠিটা বলছে, ফিরে আসা সহজ হবে না।”
ওরা সিন্দুকটা হাতে করে ওপরে তুলে আনল। ভিতরে আরও কিছু ছিল—একটা ছোট কাঠের বাক্স, তাতে ছয়টি পুরনো রৌপ্য মুদ্রা, আর একটা দুধারে ধারাল ছুরি। মুদ্রাগুলিতে খোদাই করা আছে বজ্রসেনের নাম।
তুহিন ফিসফিস করে বলল, “এটা সত্যি, রিমি। বজ্রসেনের গুপ্তধনের হদিস আমরা পেয়েছি।”
রিমি বলল, “আরও বাকি আছে। রক্তলাল মহুল গাছের নিচে কী লুকিয়ে আছে, তা না দেখা পর্যন্ত অভিযান শেষ নয়।”
তখনি ঈশান প্রশ্ন করল, “কিন্তু চিঠিটা যে বলছে—‘ফিরতে পারবে না আগের মত’—এটার মানে কি? আমাদের জন্য বিপদ আছে?”
আকাশ মৃদু হেসে বলল, “অভিযানে নামে যারা, তারা আগের মতো থাকেও না। আর তাতেই তো ইতিহাস জন্মায়।”
চারজন আবার ব্যাগ গুছিয়ে চলল নতুন সন্ধানের দিকে। এবার সন্ধের অপেক্ষা। কারণ রক্তলাল মহুল গাছ কেবল ছায়ায়ই তার দরজা খোলে।
পর্ব ৩: রক্তলাল মহুল গাছের নিচে
দিন গড়িয়ে সন্ধে নামছিল ধীরে ধীরে। সূর্য ডুবে যাওয়ার মুখে, আকাশে একটা গাঢ় কমলা আলোর ছায়া পড়েছে। রিমির চোখে এখন আর কোনও দ্বিধা নেই, কেবল আগুনের মতো এক নির্ভুল লক্ষ্যে পৌঁছানোর ইচ্ছে। মানচিত্র অনুযায়ী, গন্তব্য এক পুরনো বনভূমি—যেখানে এখনও মহুল গাছ দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ ধরে, নীরবে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে এক অজানা রহস্যকে।
চারজনের মধ্যে আর কোনও শব্দ ছিল না। শুধু পায়ের আওয়াজ, শুকনো পাতার ওপর চাপ পড়লে সেই কর্কশ মচমচে শব্দ, আর মাথার ওপর কোকিলের ক্লান্ত ডাক। হঠাৎ তুহিন থেমে বলল, “ওই তো সামনে—দেখ, ওই লাল ফুলে ভরা মহুল গাছটা।”
ওরা এগিয়ে গেল। গাছটা বিশাল, এক বিশাল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য শাখা, যেন জালের মতো ছড়িয়ে আছে। গাছের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে লাল মহুল ফুল। একরকম মাদকতা আছে এই গন্ধে—যেটা শুধু সন্ধ্যায় টের পাওয়া যায়।
রিমি গাছটার গা ঘেঁষে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কুয়োর চিঠির নির্দেশ ছিল—”রক্তলাল মহুল গাছের নিচে সন্ধ্যা ছায়ার পথ”—মানে ছায়ার দিকটা খুঁজে বের করতে হবে। সূর্য এখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে, তাই গাছের ছায়া পড়ছে পূর্বদিকে।
আকাশ বলল, “এখানে যদি কিছু লুকানো থাকে, তবে গাছের ছায়ার রেখাটা যেখানে পড়ছে ঠিক সেই দিকেই কিছু একটা হবে।”
ঈশান টর্চ বের করল, আর তুহিন ক্যামেরা অন করে ভিডিও চালু করল। ছায়ার শেষ মাথায় গিয়ে ওরা দেখতে পেল ছোট এক ঢিবির মতো কিছু। খালি হাতে খুঁড়ে দেখা গেল—মাটির নিচে আছে পাথরের দরজার মতো কিছু একটা, যেন মাটির কোলে লুকিয়ে রাখা এক গোপন সিঁড়ি।
রিমি ধীরে ধীরে সেই পাথরের ঢাকনা তুলল। একটা সরু সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে, অন্ধকারের গর্ভে। বাতাসে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। ঈশান বলল, “নিচে নামার আগে পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার, হয়তো অক্সিজেন কম হতে পারে।”
আকাশ বলল, “তাহলে আমি আর রিমি আগে নামি, তুই আর তুহিন ওপরে থাক, যদি কিছু হয়—”
রিমি মাঝখানে থামিয়ে দিল, “না, এবার আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। এটা একার অভিযান নয়।”
চারজন একসঙ্গে পা রাখল সেই পাথরের সিঁড়িতে। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল। কেবল টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে খাঁজ কাটা দেয়াল, যার গায়ে নকশা—যোদ্ধা, রথ, মহুল গাছ, আর একটা বড় মুখ—বজ্রসেনের ছবি কি?
সিঁড়ির শেষে একটা বড় চাতাল ঘর। মেঝেতে পাথরের ফলকে খোদাই করা লেখা—
“এখানে রাখা আছে বজ্রসেনের স্মৃতি। যার হৃদয়ে লোভ নেই, কেবল ইতিহাসের খোঁজ, সেই-ই পারবে খুলতে এই কক্ষ।”
আকাশ একটা পাথরের বাক্সের দিকে ইশারা করল। সে এগিয়ে গিয়ে বাক্সে হাত রাখতেই সেটা নড়ে উঠল। ঢাকনাটা খুলতেই দেখা গেল ভেতরে রাখা একটি পুরনো ধাতব খোল, একটি ঝকঝকে খঞ্জর, আর একরাশ সোনালী মুদ্রা।
রিমি ধীরে ধীরে মুদ্রাগুলো হাতে নিয়ে দেখল—একদিক খোদাই করা বজ্রসেনের মুখাবয়ব, অন্যপাশে রাজপ্রাসাদের ছবি।
তুহিন ফিসফিস করে বলল, “এটাই সেই গুপ্তধন?”
ঈশান ধীরে ধীরে বলল, “হয়তো… কিন্তু এর থেকেও বড় ধন, আমরা যা পেয়েছি—এ এক জীবন্ত ইতিহাস।”
চাতালের দেয়ালে আরও একটি দরজা ছিল, বাঁদিকে। রিমি ধাক্কা দিতেই খোলার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ধুলোর গন্ধ। ভিতরে এক বিশাল চেম্বার—তিনটা বিশাল ধাতব মূর্তি, আর দেয়াল জুড়ে লেখা—
“ধন নয়, উত্তরাধিকার চাইলে নাও ইতিহাস। তোমাদের হাতে থাকল এই গাঁয়ের সত্য, কেউ যদি জানতে চায়, তুমি বলো—এ কেবল গল্প নয়, এ আমাদের মাটি।”
আকাশ মৃদু গলায় বলল, “এই গুপ্তধন প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। এটা কেবল আমাদের ব্যক্তিগত জয় নয়—এটা গড়বেতার গর্ব।”
রিমি মাথা নাড়ল, “ঠিক বলেছিস। তবে যাবার আগে একটা ছবি… যেন মনে থাকে, আমরা এই ইতিহাসের অংশ ছিলাম।”
টর্চের আলোয়, মুদ্রা আর মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে ওরা তুলল একটা ছবি—যে ছবির পেছনে লেখা থাকল—
“বজ্রসেনের পথচলা আমাদের মধ্য দিয়ে চলবে।”
পর্ব ৪: দুঃস্বপ্নের চাবি
চাতালঘর থেকে বেরিয়ে চারজনে চুপচাপ বসে পড়ল মহুল গাছের ছায়ায়। চারদিকে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। যেন গাছেরা জানে, যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ইতিহাস, তারা এখনও সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয় তার ভার বইবার জন্য।
তুহিন জিজ্ঞেস করল, “এতক্ষণ যা দেখলাম, যেটা পেলাম, তার পরেও যেন কিছু একটা বাকি আছে, না?”
রিমি গাছে হেলান দিয়ে বসে বলল, “চিঠির শেষ কথাটা কি খেয়াল করেছিলে—‘কেউ যদি জানতে চায়, তুমি বলো—এ কেবল গল্প নয়, এ আমাদের মাটি।’ মানে এ শুধু ধন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্মৃতি, রক্ত, ইতিহাস। আর ইতিহাস সবসময় পরিষ্কার নয়।”
আকাশ বলল, “তবে কি সামনে আরও কিছু আছে? মানচিত্রে কি আর কিছু চিহ্ন ছিল?”
ঈশান ব্যাগ থেকে সেই পুরনো চামড়ার নোটবুকটা বের করল। একাধিক পাতার মধ্যে একটা পাতায় কালি ছড়িয়ে লেখা কিছু শব্দ দেখা গেল—তবে এখন বোঝা যাচ্ছে যে পাতার নিচে আলোর নিচে কিছু লুকানো আছে।
রিমি মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সেই পাতায় আলো ফেলল। তখনই ভেসে উঠল অদ্ভুত এক লাইন—
“যারা দেখেছে রাত্রির ভেতর চোখ, তারাই জানে কোথায় লুকানো চাবি। বজ্রসেনের দুঃস্বপ্ন এখনও ঘুমিয়ে আছে, খুলবে কি তার দরজা?”
তুহিন ফিসফিস করে বলল, “চাবি? মানে এখনো কিছু খুলতে বাকি?”
আকাশ মাথা নাড়ল, “এই ‘দুঃস্বপ্ন’টা কী? এটা কি কোনও প্রতীক?”
ঈশান বলল, “যদি এটা বাস্তব হয়, তবে হয়তো বজ্রসেনের জীবনের এমন কোনও অধ্যায় ছিল যা সে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেইখানেই হয়তো সবচেয়ে গোপন সত্য লুকিয়ে আছে।”
তিনটে সোনা-মুদ্রার নিচে রাখা বাক্সটা আবার খুলে দেখা গেল একটা ছোট, পিতলের টুকরো—যেটা দেখতে একটা প্রাচীন চাবির মাথা। কিন্তু বডি নেই। শুধু মাথার অংশ। তার গায়ে খোদাই—
“ঐ রাতের দরজা খুলবে ওই চোখে”
এই রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। আকাশ বলল, “একটা দরজা আছে—যেটা এখনও আমরা খুলি নাই। হয়তো মহুল চেম্বারের ভিতরের বামদিকে যে অন্ধকার ঘরটা দেখেছিলাম, ওটাই।”
তুহিন আর ঈশান সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো। চারজন আবার নামল সেই নিচের গোপন কক্ষে।
ঘরটা এইবারে আরও বেশি রহস্যময় লাগছিল। বাতাস ভারী, অদ্ভুত একটা ধাতব গন্ধ। দেয়ালের এক কোণে একটা ভাস্কর্য—একটি মুখ, যার দুটো চোখ খালি, আর চোয়ালের নিচে একটা ক্ষুদ্র তালা বসানো।
রিমি ফিসফিস করে বলল, “এটাই সেই রাতের চোখ। আর এটা খুলবে চাবি দিয়ে।”
আকাশ সেই পিতলের টুকরো নিয়ে তালায় ঢোকাল। মুহূর্তের জন্য কিছুই ঘটল না, তারপর ধীরে ধীরে ভাস্কর্যের চোয়াল সরে গেল, যেন কেউ মুখ খুলে কিছু বলতে চায়।
চোয়ালের ভিতরে ছোট একটা খাঁচার মতো ফাঁক, তার ভেতরে রাখা একটা কাগজ আর একটা মাটির পাত্র।
কাগজটা বের করে দেখা গেল সাদা কালি দিয়ে লেখা—
“আমার সন্তানেরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলেছে। কিন্তু আমি শুধু গোপন করেছি ওদের থেকে সত্য। যদি কেউ আমার ‘অভিশপ্ত উত্তরাধিকার’ জানতে চায়, সে খুঁজুক বনজলধি নদীর ধারে মৃত ইটের ঢিপি।”
ঈশান হতবাক, “বনজলধি? এই নামে তো কোনও নদী নেই আমাদের এলাকায়।”
আকাশ বলল, “হয়তো পুরনো কোনো নাম, অথবা এটা কোনও সাংকেতিক চিহ্ন।”
রিমি তখন মাটির পাত্রটা খুলল। ভিতরে আছে তিনটা ছোট হাড়, একটা কুমোরের চাকায় তৈরি ছোট্ট খেলনা রথ, আর একটা কাঁচের চোখ।
তুহিন সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই চাবি শুধু ধনের নয়—এটা অতৃপ্ত আত্মার দরজা খোলে। বজ্রসেন কেবল ধন লুকিয়ে রাখেননি, তিনি কিছু চাপাও দিয়েছিলেন ইতিহাস থেকে।”
রিমি ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের শুরুতে যা খুঁজছিলাম তা ছিল ধন, কিন্তু যা পেয়েছি তা এক অভিশপ্ত উত্তরাধিকার—এক রাজবংশের শেষ রাজাকে নিয়ে এক অপ্রকাশ্য কাহিনি।”
আকাশ বলল, “এখন দরকার সঠিক দিশা। বনজলধি কোথায়, সেই সন্ধান শুরু করতে হবে।”
চারজন ধীর পায়ে উঠে আসছিল সেই মহুলগাছের নিচে। সন্ধে পেরিয়ে রাত নামছে, গাছের ছায়া আরেকটু দীর্ঘ হচ্ছে। সেই ছায়ার নিচে চারজন দাঁড়িয়ে—তাদের মুখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা অভিমান, আর অনেকটা প্রশ্ন।
এবার তাদের সামনে শুধুই পথ নেই—একটা গভীর অতীত, এক উত্তরাধিকার, আর তার চাবি এখন তাদের হাতে।
পর্ব ৫: বনজলধির স্রোতে
রাত্রি নেমে এসেছে গড়বেতার জঙ্গলে। মহুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চারজন বন্ধু যেন ইতিহাসের জ্যামিতির মাঝখানে—যেখানে বাস্তব আর গল্পের রেখাগুলি একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। বজ্রসেনের চিঠির শেষ বাক্যটি এখন মাথার মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছিল বারবার:
“যদি কেউ আমার ‘অভিশপ্ত উত্তরাধিকার’ জানতে চায়, সে খুঁজুক বনজলধি নদীর ধারে মৃত ইটের ঢিপি।”
তুহিন বলল, “বনজলধি বলে এখন কোনও নদীর নাম তো নেই।”
আকাশ একটু চিন্তিত গলায় বলল, “আমার মনে হয়, এটা হয়তো আজকের শীলাবতীর পুরনো নাম। ইতিহাসে অনেক নদীর নাম কালের সঙ্গে বদলে গেছে।”
রিমি সঙ্গে সঙ্গে তার ফোনে লোকাল ইতিহাস ও মানচিত্র ঘাঁটতে লাগল। একটু পর মাথা তুলে বলল, “একটা পুরনো ফারসি মানচিত্রে মিলছে একটা নাম—‘বানজালধি’। মনে হচ্ছে ফারসি লেখা বাংলা উচ্চারণে হয়ে গেছে বনজলধি। আর অবস্থানটা দেখলে মনে হচ্ছে, সেটা শীলাবতীর এক উপশাখা—ভরতপল্লির কাছে।”
ঈশান বলল, “সেখানে আগে নাকি একটা ইটভাটা ছিল, যা পরে ধ্বংস হয়ে যায়। সেটাই তো হতে পারে সেই ‘মৃত ইটের ঢিপি’।”
রাতটা কাটল উত্তেজনায়, পরিকল্পনায়। সকাল হলেই সবাই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল ভরতপল্লির উদ্দেশে।
ভরতপল্লি কোনও পর্যটন কেন্দ্র নয়। খোলা মাঠ, মাঝেমাঝে বুনো ঘাসে ঢাকা পথ, দূরে খোলা জলাভূমি। কিছুটা হাঁটার পর দূরে দেখা গেল এক ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটভাটার ধ্বংসাবশেষ। মাটির নিচে ইট চাপা পড়ে থাকলেও ঢিবিটার আকার এখনো বোঝা যায়।
তুহিন ক্যামেরা চালু করতেই তার চোখে ধরা পড়ল—ঢিবির উপর কিছু পাথর বসানো আছে বৃত্তাকারে। আকাশ বলল, “এগুলো শুধু জায়গা চিহ্নিত করার জন্য নয়, এদের নিচেই হয়তো কিছু আছে।”
চারজন শুরু করল খোঁড়াখুঁড়ি। গরম রোদ মাথায় পড়ছে, ধুলো উড়ছে বাতাসে, কিন্তু কারও মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। হঠাৎ এক কোণ থেকে ঈশানের কাস্তে মতো হাতে বাজলো কিছু ধাতব আওয়াজ।
সে চেঁচিয়ে উঠল, “পেলাম! এখানেই কিছু আছে!”
মাটি সরাতেই দেখা গেল একটি পাথরের ফলক। তার উপর খোদাই করে লেখা—
“যারা জানে রাজা কী লুকোয়, তারা জানে কীভাবে রাজ্য বাঁচে। খুলতে হলে, রাখো আগুনে তার সত্য।”
রিমি পড়ে উঠে ভাবতে লাগল, “আগুন মানে কি সত্যিই আগুনে কিছু পোড়াতে হবে? নাকি আলো বা উত্তাপ?”
আকাশ বলল, “চলো, একটা ছোট আগুন জ্বালাই। এই ঢিবির সামনে একটা ক্ষুদ্র চুল্লি তৈরি করি।”
ওরা চারজন কিছু শুকনো ডালপালা দিয়ে একটি চুল্লির মতো জায়গা বানিয়ে আগুন জ্বালাল। তারপর সেই পাথরের ফলকটাকে গরম করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তাপের চাপে পাথরের এক অংশ খুলে পড়ল। ভেতরে দেখা গেল একটা কাঠের বাক্স, তার গায়ে কড়া ঘষা লোহা আর তালা। আর পাশে রাখা একটা ছোট্ট পাত্র, যাতে কয়েক ফোঁটা শুকনো রক্তের দাগ এখনো লেগে আছে।
ঈশান ফিসফিস করে বলল, “এটাই বজ্রসেনের দুঃস্বপ্নের প্রতীক—সে যা গোপন রাখতে চেয়েছিল, সেটাই আমাদের সামনে আসতে চলেছে।”
রিমি সেই বাক্স খুলতেই দেখা গেল কিছু কাগজের টুকরো—জীর্ণ, কিন্তু যত্নে রাখা। পড়ার পরে সবাই স্তব্ধ।
সেখানে লেখা ছিল বজ্রসেনের নিজের হাতের লেখা, যেন একটা স্বীকারোক্তি—
“আমি আমার একমাত্র সন্তানকে হত্যা করেছি, কারণ সে বিদ্রোহ করেছিল। তার মা ছিল একজন মল্ল রাজবংশের মহিলা, আমারই পরাধীন রাজ্য। আমি ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু সমাজ সেই প্রেম মানেনি। আর সন্তান সেই অসম প্রেমের ফল। তাকে আমি চেয়েছিলাম রাজা করতে, কিন্তু সভার চাপ, সমাজের বিষ এবং নিজের অহং—সবকিছু মিলে আমি নিজেই তার রক্ত ঝরিয়েছিলাম। আমি তার মৃতদেহ এই মৃত ইটের নিচে পুঁতে রেখেছি।”
পাশে ছোট একটা খোলা চিঠি, যেখানে সেই পুত্র বজ্রদেব লিখেছে—
“বাবা, আমি জানি তুমি ভালোবাসো, তবু সমাজ তোমাকে দুর্বল করে দিয়েছে। যদি কেউ একদিন এই সত্য খুঁজে পায়, জানুক—আমি অভিশপ্ত ছিলাম না, আমি ছিলাম উত্তরাধিকার।”
চারজন যেন মুহূর্তে নীরব হয়ে গেল। ইতিহাসের এই রক্তাক্ত অংশ কেউ পড়েনা পাঠ্যবইয়ে। এটা পড়া যায় শুধু ধুলো মাখা চিঠিতে, যার আড়ালে চোখ ভিজে যায়।
তুহিন ধীরে ধীরে বলল, “এই গল্প যদি সবাই জানে, তাহলে বজ্রসেনের পরিচয় পাল্টে যাবে। আর সেই ছেলের—যে শুধু উত্তরাধিকার চেয়েছিল—তার নাম উঠে আসবে সত্যের আলোর নিচে।”
রিমি বলল, “চলো, ওর জন্য একটা স্মারক রাখি। এই গাছতলায় এক পাথরে তার নাম খোদাই করি—‘বজ্রদেব, যার রক্তে ছিল রাজ্য, আর হৃদয়ে ভালোবাসা।’”
আকাশ মাথা নাড়ল। এই ইতিহাস তারা শুধু খুঁজে পায়নি, তারা এখন তার ধারকও বটে।
পর্ব ৬: নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর
পশ্চিম মেদিনীপুরের বুকে একদল তরুণ চারজন, তাদের হাতে এক রাজবংশের চাপা পড়া ইতিহাস। ভরতপল্লির মৃত ইটের নিচে পুঁতে রাখা সেই পাপ, সেই দুঃখ—বজ্রসেনের নিজের হাতে খুন করা পুত্র বজ্রদেবের স্বীকারোক্তি, যেন ভূগর্ভ থেকে উঠে এসে আবার মানুষকে জিজ্ঞেস করছে—“তোমরা কি ইতিহাস জানো? না শুধু জয়ীদের গল্পই মুখস্থ করো?”
রিমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল পাথরের পাশে। তার সামনে সেই ছোট্ট চিঠি—বজ্রদেবের হাতে লেখা। বাতাস থেমে গেছে যেন, পাতারাও আর শব্দ করছে না। এমন নিস্তব্ধতা খুব কমই আসে, যখন কেউ সত্যির খুব কাছাকাছি চলে যায়।
ঈশান পাশে বসে বলল, “আমরা কী করব এটা নিয়ে? প্রশাসনের কাছে তুলে দেব? নাকি ইতিহাসবিদদের জানাব?”
আকাশ বলল, “হয়তো আমাদের সেটা করাই উচিত। কিন্তু তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সত্য শুধু কোনো ধন বা ইতিহাসের অংশ নয়—এটা একটা কণ্ঠস্বর, যা অনেক বছর চুপ করে ছিল। আজ আমরা তাকে শুনেছি।”
তুহিন মাথা নাড়ল, “এই কণ্ঠস্বর নিঃশব্দ ছিল এতকাল, কিন্তু এখন সে আবার বলছে—‘আমিও ছিলাম, আমিও চাই স্মৃতি।’”
রিমি ব্যাগ থেকে ছোট একটা খাতা বার করল, তাতে লিখে রাখছিল গোটা ঘটনা—একটা ধারাবাহিক নোট, যেন ভবিষ্যতের কেউ যদি জানতে চায়, তার জন্য সব লেখা থাকে।
পাশেই একটা পাথরের উপর ওরা চারজন মিলে খোদাই করল বজ্রদেবের নাম। কোন তারিখ নেই, কোন রাজত্ব নেই—শুধু নাম, আর তার নিচে একটি লাইন—
“সত্যের জন্য যে মরতে পারে, সে কখনো অভিশপ্ত নয়।”
ওরা সেই রাতে আর ফিরে যায়নি। ইটের ঢিপির পাশেই একটা ছোট তাঁবু খাটিয়ে, তারা বসে রইল আগুন জ্বালিয়ে, যেন এই রাতে বজ্রদেবের আত্মা একটু শান্তি খুঁজে পায়।
রিমি বলল, “জানিস, আমার মনে হয় বজ্রদেব নিজে এই চিঠিগুলো রেখে গিয়েছিলেন, জানত একদিন কেউ না কেউ খুঁজে পাবে। আর সেজন্যই এত স্পষ্ট করে সব রেখে গেছে।”
আকাশ বলল, “হয়তো তিনি চেয়েছিলেন কেউ তার হয়ে কথা বলুক। ইতিহাস তার নাম মুছে দিলেও, কেউ তো অন্তত বলবে—সে ছিল।”
ঈশান তাকিয়ে দেখছিল আগুনের দিকে। তার চোখে পড়ছিল এক একটি জ্বলন্ত কাঠের ছাই হয়ে যাওয়া অংশ—যেন ইতিহাসের এক একটা টুকরো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুহিন ক্যামেরায় বন্দি করছিল সেই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত—আগামী প্রজন্মের জন্য, ভবিষ্যতের ইতিহাসের জন্য।
ভোররাতে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল চারজনের। আগুন নিভে গিয়েছে, কিন্তু ছাইয়ে এখনো উষ্ণতা আছে। পাথরের গায়ে লেখা নাম যেন ধীরে ধীরে সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
রিমি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা ফিরে চলি। এবার সময় হয়েছে সত্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার। পত্রিকায়, বইয়ে, কিংবা হয়তো নিজেদের গল্পে। বজ্রদেব কেবল আমাদের নয়, সকলের ইতিহাস।”
চারজন ফিরে চলল গড়বেতার দিকে। কিন্তু এবার তারা আর শুধু একদল কৌতূহলী বন্ধু নয়—তারা চারজন এখন ইতিহাসের সাক্ষী, গল্পের চরিত্র, আর বজ্রদেবের কণ্ঠস্বরের বাহক।
গ্রামে ফিরে রিমির ঠাকুরদার ঘরে আবার সেই পুরনো চামড়ার নোটবুক খুলে দেখল। শেষ পাতায় এক খোলা জায়গায় রিমি লিখল—
“যে ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখে না, সে বারবার ভুল করে। আর যে ইতিহাস হৃদয়ে রাখে, সে কখনো নিঃশব্দ নয়।”
পর্ব ৭: ছায়ার ভেতর আলো
ফিরে আসার পরদিন সকালেই চারজন মিলে বসেছিল রিমির ঠাকুরদার পুরনো ভাঙা ছাদওয়ালা ঘরে। দরজাটা খোলা, জানালায় বাতাস ঢুকছে মেঘলা আকাশের আভা নিয়ে। চারজনে চুপচাপ বসে—নির্বাক, অথচ প্রতিটি চোখে দেখা যাচ্ছে শব্দের চেয়েও বেশি কিছুর ওজন।
তুহিন একবার ছবির ক্যামেরা দেখে বলল, “আমার মনে হয়, এগুলো শুধু ছবি নয়। এগুলো প্রমাণ। ইতিহাসকে রক্ষা করার নথি।”
আকাশ মাথা নাড়ল। “কিন্তু জানিস তুহিন, কিছু সত্য শুধু ক্যামেরায় ধরলে চলে না। ওদের হৃদয়ে গেঁথে রাখতে হয়। আমাদের মধ্যেই বজ্রদেব এখন বেঁচে থাকবেন।”
রিমি সাদা পাতায় কলমের কালো রেখা টেনে লিখছিল এক একটি বাক্য, এক একটি দিন। সে বলল, “আমরা যদি চুপ করে থাকি, এই ইতিহাস আবার চাপা পড়ে যাবে। আমাদের বলতেই হবে। কিন্তু ঠিকভাবে।”
ঈশান বলল, “তবে কীভাবে শুরু করব? কাকে বলব? প্রশাসনকে? পত্রিকাকে? নাকি প্রথমে আমাদের শিক্ষকদের, বিশ্ববিদ্যালয়কে?”
আকাশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমরা শুরু করব নিজের মতো করে। এই ইতিহাসের গল্পটা লিখে ফেলি আগে। যেন একে কেউ চাপা দিতে না পারে। যেন বজ্রদেবের কণ্ঠস্বর ছায়ার ভেতর থেকেও আলো পায়।”
রিমি বলল, “আমরা চারজনে একটা যৌথ পাণ্ডুলিপি বানাই—‘গুপ্তধনের ছায়ায়’। যেখানে রাজ্যের লোভ নয়, বরং উত্তরাধিকার, ইতিহাস আর মানুষের ভুল-ভ্রান্তির গল্প থাকবে। বজ্রসেনের দ্বন্দ্ব, বজ্রদেবের নীরব অভিমান—সব কিছু।”
সেই দিন থেকে শুরু হয় তাদের লেখা। প্রতিদিন দুপুরে সকলে মিলে বসত গল্প সাজাতে। তুহিন তার তোলা ছবিগুলো ক্রমানুসারে সাজিয়ে রাখত। আকাশ পুরনো রেকর্ড খুঁজত বজ্রসেন রাজবংশের। ঈশান খুঁজে বেড়াত ইতিহাসবিদদের প্রবন্ধ, কোথাও কোনও সূত্র আছে কি না তা বোঝার জন্য।
রিমি পুরো গল্পের ভেতর দিয়ে টেনে আনছিল বজ্রদেবের নিঃশব্দ উপস্থিতিকে—যেন তার আত্মা প্রতিটি বাক্যের মধ্যে নিশ্বাস নিচ্ছে।
একদিন, রিমি হঠাৎ বলল, “জানিস, আমাদের অভিযানটা যদি সত্যিই কেউ একদিন পড়ে, ওরা বলবে—এই চারজন সাহসী ছিল। কিন্তু আমি চাই না সাহসের গল্প হোক, আমি চাই বোঝার গল্প হোক।”
তুহিন বলল, “আমরা যেন সেই ছায়ার মতো, যেটা সূর্যের ঠিক পাশেই থাকে। ইতিহাসের ঠিক পাশে।”
সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। খসড়া লেখা শেষ হল, ছবির সংযোজন, মানচিত্রের স্ক্যান, চিঠির প্রতিলিপি, সিন্দুকের বিবরণ—সবই সাজিয়ে তৈরি হল একটা পূর্ণাঙ্গ দলিল, যেটা শুধু এক গুপ্তধনের গল্প নয়, বরং এক ভুলে যাওয়া ছেলের স্মরণে রচিত শ্রদ্ধার্ঘ্য।
তারপর এক বিকেলে, ওরা সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিল জেলা গ্রন্থাগারে, স্থানীয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুনীল বসুর কাছে। তিনি অবাক হয়ে পড়লেন সবকিছু।
সব শুনে তিনি বললেন, “তোমরা কেবল গুপ্তধন খোঁজো নি, তোমরা ইতিহাসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এক নতুন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছো। এই লেখাটা শুধু সংরক্ষণ নয়—এটা প্রজন্মান্তরে বয়ে যাওয়ার মতো এক দলিল।”
তিনি কথা দিলেন, এই পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হবে। নাম থাকবে চারজনের, আর সাথে থাকবে—
“উৎসর্গ: বজ্রদেব, এক রাজপুত্র, যাকে ইতিহাস মনে রাখতে ভুলে গিয়েছিল।”
সেদিন সন্ধ্যায় রিমি আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দেখছিল মেঘের ফাঁকে চাঁদের টুকরোটা, ঠিক যেমন বজ্রদেবের গল্পটা এখন ভেসে উঠছে ইতিহাসের আড়াল থেকে।
সে ফিসফিস করে বলল, “চাঁদটা ঠিক বজ্রদেবের মতো, অর্ধেক ঢাকা, অর্ধেক জেগে—তবু আলো ছড়ায়।”
আকাশ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের কাজ শেষ নয়, রিমি। এখন শুরু। আমরা আরও ছায়া খুঁজে বার করব, যতদিন না সব আলোয় এসে দাঁড়ায়।”
রিমি হাসল। আর চুপচাপ পাণ্ডুলিপির পেছনের পাতায় লিখল—
“এই ইতিহাস কেবল রক্তে লেখা নয়, হৃদয়ের ছায়াতেও লেখা থাকে।”
পর্ব ৮: উত্তরাধিকার
পুস্তকটি প্রকাশিত হওয়ার পর গড়বেতা যেন নিজের ছায়া থেকে বেরিয়ে এল। গল্পটা শহরে ছড়িয়ে পড়ল, তারপর কলকাতার কাগজে, পরে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সেমিনারে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল বজ্রদেব।
এক ইতিহাস, যা এতদিন ছিল না কোনও সিলেবাসে, উঠে এল ছাত্রদের আলোচনার কেন্দ্রে।
রিমি, আকাশ, ঈশান আর তুহিন—চারজন যেন অবাক হয়ে দেখছিল কীভাবে তাদের এক গ্রীষ্মকালীন অভিযান দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছে।
তুহিন একদিন মুচকি হেসে বলল, “আমরা তো ভেবেছিলাম কিছু মুদ্রা আর একখানা সিন্দুকই আমাদের ধন। আসলে এই গল্পটাই ধন ছিল।”
ঈশান বলল, “আর এই গল্প কেবল বজ্রসেন বা বজ্রদেবের নয়, এ আমাদের সকলের—আমরা যারা নিজেদের অতীত ভুলে যাই, অথচ তার ভেতরেই গড়ে উঠি।”
গ্রাম থেকে একদিন এক বৃদ্ধ এসেছিলেন রিমির ঠাকুরদার বাড়িতে। সাদা ধুতি, কাঁধে তোয়ালে, চোখে অনাবিল কৌতূহল। তিনি বইটা হাতে নিয়ে বললেন, “আমি ছোটবেলায় এই গল্পের ছায়া শুনেছিলাম, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করত না। তোদের বইটা পড়ে মনে হল, কেউ যেন আমার বাবার মুখ থেকে শোনা গল্পগুলো তুলে ধরেছে।”
রিমি হেসে বলল, “তাহলে আপনি ইতিহাসের একজন নীরব বাহক ছিলেন। এবার আপনার গল্পটা বইয়ে ছাপা হয়েছে।”
এরপর একদিন সকালে ডাক এল—কলকাতার এক নামকরা প্রকাশনী থেকে অফার পাঠিয়েছে। “গুপ্তধনের ছায়ায়” বইটিকে তারা আরও বৃহৎ আকারে ছাপাতে চায়, অনুবাদ করতে চায় ইংরেজিতে।
রিমি ওদের বলল, “শর্ত একটাই—কোনো রঙিন গল্প নয়, সত্য যা আমরা দেখেছি তাই থাকবে। বজ্রদেবকে উপন্যাসের চরিত্র বানিয়ে ফেলবেন না, তিনি বাস্তব।”
সবাই রাজি হলো।
পরের বছর এক ছোটখাট অনুষ্ঠানে চারজনকে দেওয়া হল ‘ইতিহাস সন্ধানী পুরস্কার’। তারা যখন মঞ্চে দাঁড়াল, তখন পিছনে বড় পর্দায় দেখা যাচ্ছিল সেই পাথরের উপর খোদাই করা নাম—
“বজ্রদেব, উত্তরাধিকারী।”
আকাশ মাইক্রোফোনে বলল, “এই গল্পটা শুরু হয়েছিল এক চামড়ার নোটবুক দিয়ে। কিন্তু শেষ হয়নি আজও। কারণ ইতিহাসের কোনও শেষ নেই, শুধু উত্তরাধিকার থাকে—যে উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যায় নতুন প্রজন্ম।”
তুহিন বলল, “আমরা কারা? কেবল গল্পকার? না, আমরা চারজন সাক্ষী। যারা চোখে দেখেছে, মনে রেখেছে, আর কাগজে লিখেছে। এই সাক্ষ্যই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ।”
ঈশান যোগ করল, “বজ্রসেন হয়তো অপরাধ করেছিল, কিন্তু চিঠিতে যা লিখেছে, তাও এক সাহস। আর বজ্রদেব, যাকে কেউ জানত না, আজ সে এক ইতিহাসের আলো।”
শেষে রিমি বলল, “আমি শুধু একটা কথা বলব—যদি কেউ কখনো বলে, গল্পগুলো শুধু গল্প, সত্য নয়—তবে মনে রেখো, সবচেয়ে গভীর সত্য কখনো কেবল শব্দে নয়, ছায়ায় লেখা থাকে। সেই ছায়ার মধ্যে আমরা চারজন একটু আলো এনেছিলাম মাত্র।”
অনুষ্ঠান শেষে চারজন বেরিয়ে এল হলঘর থেকে।
রাতের আকাশে তারারা স্পষ্ট। গড়বেতা থেকে দূরে, কিন্তু সেই জায়গার প্রতিটি গন্ধ, প্রতিটি শব্দ যেন ওদের মনে জেগে আছে।
হঠাৎ তুহিন বলল, “এবার কোথায় অভিযান?”
রিমি চোখ মেলে চাইল আকাশের দিকে। বলল, “যেখানে ছায়া আছে, সেখানে আলো খুঁজে নিতে হবে—এটাই তো আমাদের উত্তরাধিকার।”
চারজন হাঁটতে লাগল অন্ধকার রাস্তার দিকে। সামনে যতটুকু আলো, তা তাদের যথেষ্ট। কারণ এখন তারা জানে—
গল্প শেষ হয় না, শুধু নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
শেষ




