ঋতুপর্ণা বসু
শীতের দুপুরে
শীত তখন শহরের কাঁধে নেমে বসেছে। কলেজের লাইব্রেরির বাইরের কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল অনিরুদ্ধ। তার পরনে ছিল ধূসর সোয়েটার, গলায় মাফলার, আর হাতে ছিল একটিমাত্র বই—জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সে বইটা যেমন ছিল, তেমনই তার মনটাও—অদ্ভুত নিঃশব্দ, সময়ের গন্ধ মাখানো। বইয়ের পাতায় চোখ ছিল, কিন্তু মন ছিল বইয়ের বাইরের জগতে।
প্রতিদিন বিকেলে লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে যে মেয়েটা নামে, আজও সে ঠিক সময়মতো নামছে। তার নাম প্রভা। ছিমছাম পরিপাটি সাজ, নীল-সাদা শাড়ি, কানে ছোট্ট ঝুমকা। চোখে এক অদ্ভুত আভা, যেন কোনো কথা না বলেই সে অনেক কিছু বলে যেতে পারে।
অনিরুদ্ধ বহু দিন ধরেই তাকে লক্ষ করে, কিন্তু কখনো কথা বলেনি। ছেলেটি চুপচাপ, স্বভাবতই লাজুক। তার কাছে কবিতার লাইন মুখস্থ করাটা যতটা সহজ, কারো সঙ্গে মনের কথা বলা ঠিক ততটাই কঠিন। প্রভা যেন তার কাছে কোনো দূরের তারা, আলো জ্বালায়, কিন্তু ধরা যায় না।
সেদিন হঠাৎ ঘটল এক অদ্ভুত মুহূর্ত। প্রভা সিঁড়ি থেকে নেমে সোজা বেঞ্চের দিকে এলো, এসে দাঁড়াল অনিরুদ্ধের সামনে। ছেলেটি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল, বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটার দিকে।
“আপনি কি কবিতা ভালোবাসেন?”—প্রভা জিজ্ঞেস করল, একরাশ কৌতূহল চোখে।
অনিরুদ্ধ গলার খুসখুসে স্বরটা চেপে বলল, “ভালোবাসি… তবে জীবনে যাকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে, সে এখনো আসেনি।”
প্রভা হেসে উঠল। একটা ছোট্ট হাসি, কিন্তু সেই হাসিতে যেন জানালা খোলে। “তাহলে লিখুন না, যার জন্য কবিতা লেখা যায়, হয়তো সে তখনই এসে পড়ে,”—বলেই সে চলে গেল।
অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল। বুকের ভেতরে একটা অনামা ধ্বনি দোল খাচ্ছিল। মেয়েটির কথাগুলো যেন পাতার ফাঁকে গলে গিয়ে বসে রইল চুপচাপ।
তারপর, সেদিন রাতে, অনিরুদ্ধ নিজের নোটবুক খুলল। তাতে লেখা হল প্রথম পংক্তি:
“কেউ ছিল না, কিন্তু তুমি এসেছিলে।”
তারপর আরও কিছু শব্দ এল—চুপিসারে, কাঁপা হাতে, কবিতার মতো।
সেই দিনের পর, প্রতিটি শীতের দুপুর অনিরুদ্ধের কা
ছে রইল এক অপেক্ষার নাম।
প্রথম সংলাপ
পরের দিন দুপুরে অনিরুদ্ধ একটু আগে এসেছিল। আজ তার ভিতরটা যেন অন্যরকম লাগছিল—চুপচাপ উত্তেজনা, একটা অজানা টান। লাইব্রেরির বেঞ্চে বসে থেকেও মন ছিল অস্থির। কালকের কথা, প্রভার সেই হাসি আর প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসছিল মনের মধ্যে।
তাকে তো কেউ কোনোদিন এভাবে জিজ্ঞেস করেনি, “আপনি কি কবিতা ভালোবাসেন?” এই সাধারণ প্রশ্নটা অনিরুদ্ধের মনে যেন ঢেউ তুলেছিল। সে জানত না মেয়েটা আবার কথা বলবে কি না, কিন্তু একরাশ অদেখা আশা তার ভিতরে বাসা বেঁধেছিল।
প্রভা আজও এল। সিঁড়ি বেয়ে নামার ভঙ্গিতে একরকম ছন্দ ছিল—নির্ভার, নিশ্চিন্ত। কিন্তু আজ সে বেঞ্চের পাশেই দাঁড়াল না। একটু দূরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল। অনিরুদ্ধও তাকিয়ে ছিল, লুকিয়ে নয়, এবার সরাসরি।
মুহূর্ত কয়েক কেটে গেল। তারপর প্রভাই এগিয়ে এল। হাতে ছিল একটা ছোট্ট নোটবুক। এসে বলল, “আজ আপনি কি লিখেছেন কিছু?”
অনিরুদ্ধ একটু লজ্জা পেল। “না… মানে কিছু একটা শুরু করেছিলাম। পুরো হয়নি,”—বলল সে।
“দেখতে পারি?” প্রভা জিজ্ঞেস করল।
এই প্রশ্নে অনিরুদ্ধের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বিধা জন্মাল। সে কি নিজের লেখা কাউকে দেখায়? তার লেখাগুলো তো খুব ব্যক্তিগত, খুব গোপন! কিন্তু প্রভার চোখে ছিল একরকম কোমলতা, কোনো বিচার করার চোখ নয়।
সে ব্যাগ থেকে নোটবুকটা বের করে এগিয়ে দিল।
প্রভা চুপচাপ পড়ল কয়েক পংক্তি। তারপর মৃদু হেসে বলল, “তোমার লেখায় একটা শান্ত নদীর মতো স্রোত আছে। শব্দগুলো জোর করে কিছু বোঝায় না, কিন্তু তবুও বুঝিয়ে দেয়।”
অনিরুদ্ধ মাথা নিচু করে ফেলল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কেমনভাবে সাড়া দেবে। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “তুমি কি কবিতা পড়ো?”
প্রভা বলল, “পড়ি… কিন্তু লিখতে পারি না। তোমার মতো অনুভব করে লিখতে পারা সহজ নয়।”
অনিরুদ্ধের মনে হচ্ছিল, তারা যেন শব্দের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে এগিয়ে আসছে।
সেদিন তারা একসঙ্গে বসে ছিল ঘণ্টাখানেক। খুব বেশি কথা বলেনি কেউই। মাঝে মাঝে প্রভা বইয়ের কিছু লাইন পড়ছিল, অনিরুদ্ধ মন দিয়ে শুনছিল। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো, আর তখন যেন চারপাশের সব শব্দ থেমে যেত।
বিদায়ের সময় প্রভা বলল, “আগামীকালও বসবে তো?”
অনিরুদ্ধ চোখ তুলে বলল, “হ্যাঁ… বসব।”
তারপর প্রভা চলে গেল। আর অনিরুদ্ধ প্রথমবার জানল—কারো সঙ্গে চুপ করে বসে থাকাও একধরনের ঘনিষ্ঠতা, একধরনের কবিতা।
বিকেলের রঙে তারা
শহরের বিকেলগুলো যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। আগে যেসব মুহূর্ত শুধু একা ছিল, এখন তার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে পড়েছিল প্রভার উপস্থিতি। সেদিনের পর থেকে অনিরুদ্ধ আর প্রভা রোজই দেখা করত—কখনও লাইব্রেরির বেঞ্চে, কখনও কলেজ ক্যাম্পাসের পেছনের ফাঁকা মাঠে, কখনও পুরনো সিঁড়িতে বসে থেকে স্রেফ আকাশ দেখা।
তাদের কথা হতো না খুব বেশি। কিন্তু যে কথাগুলো হতো, তা ছিল একান্ত, গভীর আর ধীরে ধীরে জমে ওঠা অনুভূতির মতো। তারা গল্প করত বই নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, মেঘের আকার নিয়ে, এমনকি মৌমাছিদের গুঞ্জনের শব্দ নিয়েও।
একদিন বিকেলে, অনিরুদ্ধ প্রভাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করো?”
প্রভা তাকিয়ে বলল, “করি… কিন্তু সেটা কোনো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে নয়। আমি অপেক্ষা করি অনুভবের জন্য। কখনো কখনো মনে হয় কেউ হয়তো আসবে, কিন্তু তাকে চেনা যাবে না নাম দিয়ে—চেনা যাবে চোখের ভাষায়।”
অনিরুদ্ধ চুপ করে গেল। তার মনটা তখন কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু শব্দ হয়ে উঠছিল না। তার মনে হচ্ছিল, প্রভা তার নিজের কথা বলছে।
সেদিন তারা হাঁটছিল কলেজস্ট্রিটের বুক চিরে, সন্ধ্যার কালি ঢাকতে শুরু করেছে রাস্তা। বইয়ের দোকানগুলোতে আলো জ্বলেছে, কোথাও কোথাও গলির মোড়ে চায়ের কেটলি থেকে ধোঁয়া উঠছে।
প্রভা একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এই কবিতার বইটা আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমি কখনও কিনিনি।”
অনিরুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বইটা কিনে তার হাতে দিল।
প্রভা চমকে গেল। “এটা তো তোমার জন্য ছিল,”—সে বলল মৃদু গলায়।
“না,” অনিরুদ্ধ বলল, “এই বই তোমার নামেই লেখা হয়েছে, আমি শুধু হাতে তুলে দিলাম।”
প্রভা কিছু বলল না। শুধু এক মুহূর্তের জন্য চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
তাদের সম্পর্কটা ঠিক প্রেম নয়—কম করে বলা প্রেম, বেশি করে বোঝা বোঝা খেলা। তারা একে অপরকে ‘তুমি’ করে ডাকে না, তবু মনে মনে জানে, এই উপস্থিতির নামই হয়তো ভালোবাসা।
কলেজ শেষ হওয়ার আগেই অনিরুদ্ধ জানত, এই মুহূর্তগুলো ধরে রাখা যাবে না। কিন্তু তবু সে চাইছিল, যতটা পারা যায় সঞ্চয় করে রাখতে—চুপ করে বসে থাকা, বইয়ের পাতায় আঙুল ঘোরানো, চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, আর বিকেলের আলোয় প্রভার মুখটা।
এইসব ক্ষুদ্র অথচ প্রগাঢ় সময় যেন সঞ্চিত হচ্ছিল অনিরুদ্ধের ভেতর এক অলিখিত কবিতার মতো
একটি চিঠির গল্প
সেদিন সকাল থেকেই অনিরুদ্ধের মন অস্থির ছিল। তার ভেতরে কিছু একটা যেন চাপা পড়ে থাকছিল দিনের পর দিন। যতই সে চুপচাপ থাকে, ততই ভেতরে শব্দ জমে, অক্ষরগুলো কাঁপতে থাকে কাগজের মুখ চেয়ে।
ক্লাস ছিল না, তাই সে সকালেই লাইব্রেরি গিয়েছিল। বসে বসে লেখার খাতা খুলেছিল—সাদা পৃষ্ঠাগুলো তাকিয়ে ছিল তার দিকে। আজ সে কবিতা লেখেনি। আজ সে লিখেছিল একটা চিঠি।
শব্দগুলো ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল। কিছুটা সাহস, কিছুটা ভয়, আর কিছুটা অনিশ্চয়তার মিশ্রণে সে লিখল—
“তোমার চোখে আমি একটা সকাল দেখি, যেটা কোনো ঘড়িতে বাজে না। তুমি আসলে আমার ভাষা পাল্টে যায়, চুপ থাকা হয়ে যায় কথাবার্তা। আমি জানি না, এই চিঠির উত্তর পাওয়া যাবে কি না। তবুও এটা দিলাম, কারণ কিছু অনুভব বললে কমে যায় না, কিন্তু না বললে ভেতরে পুড়ে যায়।”
চিঠিটা শেষ করে অনিরুদ্ধ একবার পড়ে দেখল। নিজের হাতের লেখায় যেন নিজেরই মুখ দেখল সে—একটু কাঁচা, একটু কাঁপা, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যি।
বিকেলে, প্রভা এসেছিল ঠিক সময়ে। সেই একই শাড়ি, সেই একই নরম চোখের দৃষ্টি। অনিরুদ্ধ কিছু বলল না। শুধু ব্যাগ থেকে চিঠিটা বার করে এগিয়ে দিল।
প্রভা একটু চমকে গেল। “এটা কী?”
“চিঠি,”—অনিরুদ্ধ বলল ধীরে। “তোমার জন্য। পড়তে পারো এখন বা পরে।”
প্রভা চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হাসল—একটা স্নিগ্ধ, নিশ্চুপ হাসি।
“তুমি কি জানো, আমি জীবনে প্রথম কাউকে এভাবে কিছু পেয়েছি?”—প্রভা বলল মৃদু গলায়।
অনিরুদ্ধ কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে ছিল, যেন তার বুকের শব্দগুলো শুনে ফেলবে প্রভা।
তারা সেদিন আর কিছু বলেনি। বসেছিল লাইব্রেরির পাশের বেঞ্চে, হাতে ছিল বই, চোখে ছিল নীরবতা। চিঠিটা পড়ে ফেলেছে কি না, অনিরুদ্ধ জানে না। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, উত্তর পেয়ে গেছে।
একটা চিঠি হয়তো সারা জীবন পাল্টে দিতে পারে না। কিন্তু একটা মুহূর্তকে চিরস্থায়ী করে দিতে পারে—সেই মুহূর্ত যখন কেউ কারো দিকে তাকিয়ে চুপচাপ থেকে বুঝে নেয় যা শব্দে বলা যায় না।
সেদিন অনিরুদ্ধ বুঝল, ভালোবাসা বললে হয়তো শেষ হয়, কিন্তু চুপ করে দিলে তা আরও গভীর হয়।
না বলা ভালোবাসা
চিঠি দেওয়ার পরের দিনগুলো যেন অন্যরকম হয়ে উঠল। প্রভা কিছু বলেনি সেই চিঠি নিয়ে, কিন্তু তার চোখে কিছু একটা বদল এসেছিল। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারছিল, কিন্তু জানত না, এ বোঝা ভালো না খারাপ।
তারা প্রতিদিনের মতোই দেখা করছিল—লাইব্রেরির বেঞ্চে বসে, হাতে বই, চারপাশে শীতের নরম হাওয়া। কিন্তু সেই নিঃশব্দে এখন যেন আরও কিছু জেগে উঠছিল। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারছিল, তাদের সম্পর্কটা এক অন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে—যেখানে ভাষা নেই, কিন্তু অনুভব আছে, চোখে কথা আছে, আর চুপ করে বসে থাকার মধ্যেও রয়েছে একরাশ টান।
প্রভা সেদিন একটি কবিতার বই নিয়ে এসেছিল—“নীরবতা ও অন্যান্য কবিতা”। বইয়ের একটি পাতায় আঙুল রেখে অনিরুদ্ধকে পড়তে বলল:
“আমি তোমার পাশে বসে চুপ করে থাকি,
কারণ শব্দ দিয়ে যেটা বলা যায়, সেটা এতটা গভীর নয়।”
অনিরুদ্ধ মাথা নিচু করে পড়ল। মনে হচ্ছিল, কবিতার সেই পংক্তিগুলো যেন ওদের গল্প বলছে।
সেদিন প্রভা হঠাৎ বলল, “তুমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?”
প্রশ্নটা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, নিঃশব্দে।
অনিরুদ্ধ একটু থেমে বলল, “ভেবেছিলাম, ভালোবাসা মানেই বলার মতো কিছু। এখন বুঝি, না বলা ভালোবাসাও আছে।”
প্রভা কিছু বলল না। সে জানত, এই না বলা শব্দগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে ওদের সবটুকু সম্পর্ক—কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো দাবি নেই, শুধু একে অপরের অস্তিত্বের প্রতি গভীর স্বীকৃতি।
অনিরুদ্ধ মাঝে মাঝে ভাবত, এই মুহূর্তগুলো কি চিরকাল থাকবে? নাকি সময় সব কেড়ে নেবে?
কিন্তু সে জানত, প্রভার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি বিকেল, প্রতিটি হাওয়া, প্রতিটি চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কাপ—সবই জমা হয়ে যাচ্ছে মনের এক কোণে।
একদিন সে লিখল—
“ভালোবাসা হয়তো সেই মুহূর্তটা, যখন তুমি কিছু বলো না, তবু আমি সব বুঝে যাই।”
প্রভা সে লেখা পড়েছিল কিনা, জানে না অনিরুদ্ধ।
তারা কখনো ‘ভালোবাসি’ বলেনি। তবু তাদের মাঝে ছিল ভালোবাসার সবচেয়ে নিঃশব্দ, নিঃশর্ত রূপ—চোখে চোখ রাখা, পাশে থাকা, বই ভাগ করে পড়া, আর আলতো হাসি দেওয়া।
তাদের সম্পর্ক ছিল জলছবির মতো—ছুঁলে ভেঙে যেত, কিন্তু না ছুঁয়ে থাকলে রং ছড়িয়ে যেত মনজুড়ে।
সময়ের ছায়া
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না—এ কথা অনিরুদ্ধ জানত। কিন্তু তবু সে আশা করেছিল কিছু মুহূর্ত থেমে থাকবে, কিছু অনুভব জমে থাকবে নির্দিষ্ট কোন এক পৃষ্ঠায়।
কলেজের শেষ বর্ষ চলছিল। পড়াশোনার চাপ, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা—সবকিছু একসাথে এসে যেন চাপ দিচ্ছিল জীবনের ওপর। প্রভাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তার চোখে ছিল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, হাতে ভর্তি ছিল পঠন-পাঠনের ভার।
তাদের দেখা কমে গিয়েছিল। আগের মতো প্রতিদিন আর বেঞ্চে বসা হতো না। কথা হতো শুধু ক্লাসের ফাঁকে কিংবা দৌড়ে বেরোনোর সময়, “আজ আর বসা যাবে না, পড়া আছে”—এই বলে চলে যেত প্রভা।
অনিরুদ্ধ কিছু বলত না। সে বুঝত, সময় বদলাচ্ছে।
একদিন লাইব্রেরির বেঞ্চে একা বসে ছিল সে। হাতে ছিল পুরনো খাতা, কিন্তু আজ কোনো শব্দ আসছিল না। পাতা ফাঁকা, মনও ফাঁকা।
সে হঠাৎ বুঝতে পারল—তাদের সম্পর্কটাও যেন একটু একটু করে পাতার মতো ঝরে পড়ছে। কিছু ছিল না বলার মতো, কিছু ছিল না আঁকড়ে ধরার মতো।
প্রভা কি দূরে চলে যাচ্ছে? নাকি তারা দু’জনেই নিজের মতো করে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, আর সময় তাদের ধীরে ধীরে আলাদা করে দিচ্ছে?
তাদের মধ্যে কোনও ঝগড়া হয়নি, কোনও অপমানও নয়। কিন্তু সম্পর্ক তো সব সময় ভাঙে চিৎকারে না, কখনো ভাঙে নিঃশব্দে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায়, হঠাৎ করে ফোনে প্রভার একটা মেসেজ এল:
“অনিরুদ্ধ, তুমি জানো… সময় আমাদের খুব টানছে। আমি ঠিক জানি না আমরা কী ছিলাম, কিন্তু আমি চাই তোমার জীবনেও যেন কোনো শব্দের অভাব না থাকে।”
অনিরুদ্ধ বারবার সেই লাইনটা পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, প্রভা যেন বিদায় জানাল—কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সেই বিদায়টাও ঠিক ‘বিদায়’ নয়।
সে জবাব দিল না। শুধু একটা পৃষ্ঠায় লিখল—
“তুমি যদি আর না থাকো, তবু তোমার ছায়া থাকবে আমার শব্দে, আমার চুপ থাকা বিকেলে।”
সেই রাতে অনিরুদ্ধ হাঁটছিল একা—কলেজের ক্যাম্পাসে, পুরনো বেঞ্চটার পাশ দিয়ে, যেখানে প্রভা প্রথমবার দাঁড়িয়েছিল।
সব কিছু যেমন ছিল, তেমনই আছে। শুধু কেউ নেই পাশে বসে চুপ করে থাকা, কেউ নেই যার চোখের ভাষা অনিরুদ্ধকে নির্ভরতা দিত।
তবু মন বলছিল—প্রভা হারিয়ে যায়নি। সে আছে… শুধু দূরে। একরকম দূরত্ব, যেখানে স্পর্শ নেই, কথা নেই, তবু স্মৃতি আছে—একটি চুপ থাকা ভালোবাসা হিসেবে।
পুনর্মিলনের স্নায়ু
অনিরুদ্ধর কলেজ শেষ হয়েছে একবছর। এখন সে একটা ছোট প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করে—পাণ্ডুলিপি পড়ে, কবিতার বই সম্পাদনা করে, কখনো নিজের লেখাও লেখে একা বসে।
প্রভা আর তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। শেষবার মেসেজ পাওয়ার পর থেকে আর কথা হয়নি। অনিরুদ্ধ জানে না প্রভা এখন কোথায়, কী করছে, কাকে ভালোবাসছে।
তবে একটা জিনিস সে নিশ্চিতভাবে জানে—প্রভা তার মধ্যে রয়ে গেছে। প্রতিটি কবিতার লাইন, প্রতিটি ছন্দের ভাঁজে যেন তার চোখ, তার হাসি, তার না বলা কথা থেকে যায়।
বইমেলার দিন ছিল সেদিন। অনিরুদ্ধর কবিতার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে—“নিঃশব্দের পাশে”। তাকে ডাকা হয়েছে পাঠে অংশ নিতে। মঞ্চে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ বুক ধকধক করতে লাগল। এমনটা আগে হয়নি।
তার চোখে পড়ল দর্শকদের ভিড়ে একটা মুখ। নীল-সাদা শাড়ি, কানে ঝুমকা, আর সেই চোখ… সেই নিঃশব্দ প্রশ্নবোধক চোখ।
সে কি… প্রভা?
অনিরুদ্ধ দু’বার চোখ মুছল। স্পটলাইটের নিচে দাঁড়িয়ে সে বুঝে গেল—হ্যাঁ, সে-ই। পাঁচ বছর পর, এই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ করে দেখা।
সে হঠাৎ ভুলে গেল তার কবিতার লাইন, ভুলে গেল মঞ্চের সময়সূচি। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মাইক হাতে নিয়ে বলল,
“আজ আমি যে কবিতাটা পড়ব, সেটি সেই একজনের জন্য… যে একদিন বলেছিল, ‘যাকে নিয়ে লেখা যায়, সে এমনিই এসে পড়ে।’”
শব্দ থেমে গেল চারদিকে। ভিড়ের ভিতর থেকে কিছু চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু অনিরুদ্ধ দেখছিল শুধু একজোড়া চোখ—প্রভার চোখ।
সে পড়তে শুরু করল—
“তুমি ছিলে এক নীরবতা,
যার শব্দ নেই, কিন্তু ছায়া আছে।
তুমি ছিলে এক চিঠি,
যেটা কখনো পাঠানো হয়নি, তবু পৌঁছে গেছিল ঠিক ঠিকানায়।”
পাঠ শেষ হলে হাততালি পড়ল, কিন্তু অনিরুদ্ধ কানে শুনছিল না কিছুই। সে শুধু দেখছিল—প্রভা দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে একটুকরো শান্ত হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
মুহূর্তটা সময়ের গায়ে দাগ কেটে গেল।
কেউ কিছু বলল না। তারা শুধু তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে—কোনো অভিযোগ নেই, ব্যাখ্যা নেই, প্রমাণ নেই। শুধু চোখে চোখ রেখে যেন বলা হল—”তুমি ছিলে, আছো, থাকবে।”
শেষ নয়
পাঠ শেষ হওয়ার পরও অনিরুদ্ধ মঞ্চে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে ছিল আলো, বুকের ভেতরে কান্না আর কিছুটা হাসি। মানুষের করতালির শব্দ যেন দূরের সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কানে আসছিল—ধ্বনিময়, অথচ অস্পষ্ট।
তবে যে জিনিস সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল, তা হল প্রভার চোখজোড়া। পাঁচ বছরের শূন্যতা যেন ভরে উঠছিল একটাই দৃষ্টিতে।
অনিরুদ্ধ মঞ্চ থেকে নেমে এলো ধীরে। ভিড়ের মাঝে খুঁজে ফিরল সেই চেনা মুখ। কিন্তু প্রভা আর সেখানে নেই।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভিতরে হঠাৎ করে ঘুরে বেড়াতে লাগল পুরনো সব মুহূর্ত—বেঞ্চে বসে থাকা বিকেল, একটা চিঠি, আর কিছু না বলা শব্দ।
ঠিক তখন, পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর এল—
“তুমি এখনো ঠিক আগের মতোই লিখো।”
অনিরুদ্ধ ঘুরে দাঁড়াল। প্রভা দাঁড়িয়ে ছিল—চোখে শান্তি, কিন্তু মুখে সময়ের ছায়া।
“তুমি তো চলে গিয়েছিলে,” অনিরুদ্ধ বলল।
“সময়ই নিয়ে গিয়েছিল,” প্রভা মৃদু হাসল। “কিন্তু সময়ই তো আবার ফিরিয়ে দেয় কিছু… যদি সেটা হারায় না একেবারে।”
অনিরুদ্ধ কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল তার দিকে। দুজনের মাঝে শূন্যতা ছিল না, তবু কোন কিছু ছুঁয়ে দেখার সাহসও ছিল না।
প্রভা পেছনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি চলে যাব… আবার। কিন্তু আজ এই মুহূর্তটা চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে।”
“তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন লিখেছি?” অনিরুদ্ধ বলল। “তোমাকে নিয়ে, তোমাকে না বলে, কেবল তোমাকে অনুভব করে।”
প্রভা চোখ নামিয়ে ফেলল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা পুরনো খাম বের করল।
“এইটা তোমার দেওয়া চিঠি। এখনো রেখে দিয়েছি।”
অনিরুদ্ধ বিস্মিত হয়ে বলল, “তুমি তো কোনো উত্তর করোনি!”
প্রভা বলল, “কারণ আমি চাইনি উত্তর দিয়ে সেই অনুভবটাকে ছোট করতে। আমরা দুজনেই জানতাম, ভালোবাসা কখনো কখনো উত্তর চায় না—শুধু পাশে থাকার নাম।”
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর প্রভা এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি একদিন বলেছিলে, যাকে নিয়ে লেখা যায়, সে এমনিই চলে আসে। আমি এসেছিলাম… আবার যাচ্ছি। তবে এবার জানিয়ে।”
অনিরুদ্ধ কিছু বলল না। শুধু মাথা নোয়াল। এই না-বলা মুহূর্তেই ছিল তাদের গল্পের সবচেয়ে গাঢ় সত্যি।
প্রভা চলে গেল ভিড়ের দিকে। হারিয়ে গেল মানুষের স্রোতে।
অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে রইল—হাতে প্রভা’র দেওয়া খাম, চোখে একটুকরো নীল-সাদা শাড়ির ছবি।
পাশে থাকা এক পাঠক হঠাৎ বলল, “আপনার গল্পটা কি শেষ?”
অনিরুদ্ধ হেসে বলল, “না… কারণ কিছু ভালোবাসা চুপচাপ থাকে—শেষ হয় না, শুধু থেকে যায়। ঠিক যেমন এই একটা নাম—একটি চুপ থাকা ভালোবাসা।”
শেষ।