দেবায়ুধ পাল
গাড়ি থামল কুঁয়োডাঙায়
কুঁয়োডাঙা গ্রামের নামটা প্রথম শুনে মনে হয়েছিল কোথাও একটা গভীর কুয়ো আছে—শুধু গভীর না, এমন কিছু একটা যার দিকে তাকালেই গা ছমছম করে ওঠে। সুজয় যখন গাড়ি থামাল, তখন সন্ধে নামছে। পুরো গ্রাম যেন অন্ধকারের গায়ে চাদর মুড়িয়ে বসে আছে। অল্প আলোয় দেখে বোঝা গেল চারপাশে মাটির ঘর, তাল-খেজুর গাছ, আর একটাই পাকাবাড়ি—লাল ইটের একতলা, বন্ধ জানালায় কালো কাঁচ। ওটাই নাকি ‘ওদের’ বাড়ি।
সুজয় কলকাতার একজন ছোটখাটো ইউটিউবার। নিজের চ্যানেল ‘ভূতুড়ে বাংলায়’ মাঝেমাঝেই চেনা-অচেনা ভৌতিক জায়গায় গিয়ে ভিডিও তোলে। আজ তার সঙ্গে এসেছে ক্যামেরাম্যান অলোক আর নতুন যুক্ত হওয়া সাউন্ড টেকনিশিয়ান রোহিনী। রোহিনী কিছুটা চুপচাপ স্বভাবের, কিন্তু চোখে মুখে একরকম কৌতূহল—অস্বাভাবিক কিছুর প্রতি এক গভীর আকর্ষণ।
“এই বাড়িটা কবে থেকে ফাঁকা?” সুজয় জিজ্ঞেস করল পাশের দোকানদারকে, যিনি এসময় চা বসাচ্ছিলেন।
“আজ প্রায় চৌদ্দ বছর। অমাবস্যার রাতের পরে কেউ থাকেনা। বারো বছর আগে শেষবার পঁচিশে কার্তিক অমাবস্যার দিন গোটা পরিবারটাই… উবে গেল।”
“উবে গেল মানে?” রোহিনী মুখ তুলল।
দোকানদার মুখ ফিরিয়ে বলল, “বলতে নেই দিদি। অমাবস্যায় যারা ঢোকে, তারা ফেরে না। কেউ কেউ শুধু কুয়োর গলায় কান পাতলে কান্নার শব্দ পায়, আবার কেউ দেখে ছায়ামূর্তি—তবে কেবল তারাই, যারা বিশ্বাস করে। আপনাদের মতো শহরের ছেলেমেয়েরা মজা করতে এসে শুধু বিপদ ডেকে আনে।”
সুজয় হাসল। “আমরাও দেখব কতটা ভয়ানক। আজ রাতটা আমরা ওই বাড়িতেই কাটাব। ক্যামেরা চালু থাকবে সারারাত।”
চা খেয়ে গিয়েই তিনজন ঢুকে পড়ল ওই ‘অমাবস্যার বাড়ি’-তে। ভিতরে ধুলো জমে আছে, জানালা বন্ধ, বাতাসে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। অলোক বলল, “এখানে কেউ থাকলে হাঁপিয়ে যেত। ছাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে বাদুড়।”
সেট আপ করা শুরু হল। তিনটে ক্যামেরা, একটা ট্রাইপড, মাইক্রোফোন আর ইন্টারকম। রোহিনী মেঝের একটা কোণায় বসে স্পর্শ করল পুরনো মাটির ঢিপি—বলল, “এটা কি আগে কেউ পুঁতে রেখেছিল?”
“ওটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না,” অলোক বলল। “অফিস থেকে বলে দিয়েছে শুধু ভিডিও কর, খোঁড়াখুঁড়ি করিস না।”
রাত নামল। দূরে শিয়ালের ডাক, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ, মাঝে মাঝে গাছে বাদুড়ের পাখার শব্দ। সুজয় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে শুরু করল লাইভ ভিডিও—
“এই হচ্ছে কুঁয়োডাঙার সেই কুখ্যাত বাড়ি। আজ আমরা এখানে থাকব, কোনও আলো না জ্বেলে, কোনও রকম তন্ত্রমন্ত্র ছাড়াই। যদি কিছু থাকে, ওরা আমাদের কাছে আসবে। আপনি দেখুন। শুনুন। আর… যদি সাহস থাকে, থাকুন আমাদের সঙ্গে।”
হঠাৎই দপ করে হাওয়া উঠল। দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকল ঠান্ডা বাতাস। ক্যামেরা কিছুক্ষণের জন্য ঝাঁকুনি খেল। স্ক্রিনে কালো একটা ছায়া দেখা গেল—কিন্তু কেউ বলতে পারল না সেটা কার।
রাত বাড়তে থাকল। অলোক বলল, “কিছুই তো হচ্ছে না!”
রোহিনী তখন দ্বিতীয় ঘরে। ওর কানে যেন একটা মিহি আওয়াজ আসছে—একটা মেয়ের গলা। অতি ধীরে, গানের মত করে—
“একবার যদি ফিরে আসিস,
আমি তোর ছায়া হব…”
“এই গানটা কোথায় শুনেছি,” রোহিনী বলল নিজের মনেই।
হঠাৎই বাতাসের ঝাপটা ওকে ধাক্কা মারল, আর দেওয়ালের ধারে রাখা পুরনো আয়নাটা পড়ে ভেঙে গেল। ভিতর থেকে একটা কর্কশ আওয়াজ এল—
“তিনজন ঢুকেছে, কিন্তু একটাই ছায়া পড়ছে…”
রোহিনী পিছিয়ে এল। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল, “সুজয়… অলোক… কেউ আছে?”
কেউ জবাব দিল না।
হঠাৎই ক্যামেরা যেখানে রাখা ছিল, সেখান থেকে একটা সাদা পোশাকে অবয়ব হাঁটতে হাঁটতে দরজার কাছে গেল—তার পা মেঝো ছুঁচ্ছে না। যেন মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়েও ছুঁচ্ছে না।
সুজয় আর অলোক তখন ছাদের ঘরে, বেলকনির দিকে ক্যামেরা ঘোরানো। সুজয় বলল, “আমরা লাইভ-এ কি কিছু ধরতে পারছি?”
অলোক ক্যামেরার স্ক্রিনে তাকিয়ে মুখ সাদা করে বলল, “ভাই… তুই এখানে দাঁড়িয়ে, আমি তো এখানে… তাহলে… তৃতীয় জন কে?”
স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—তিনটি ছায়া।
রাত তখন ঠিক বারোটা। অমাবস্যার গা-ছমছমে নিস্তব্ধতা, আর বাড়ির ভিতর কার যেন নিঃশ্বাস চলাচল—যা মানুষ নয়।
কুয়োর নিচে কিছু আছে
রাত বারোটা পেরোতেই বাড়িটার বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। চারপাশ যেন নিঃশব্দ নয়, কিন্তু শব্দহীন—এমন একটা অনুভূতি যা কেবল গভীর অন্ধকারে অনুভব করা যায়। অলোক মুখ তুলে বলল, “তিনটা ছায়া! কিন্তু আমরা তো কেউ দরজার বাইরে যাইনি!”
সুজয় ঘেমে গেছে, ক্যামেরাটা বারবার স্ক্রিন ঝাঁপসা দেখাচ্ছে। রোহিনী দৌড়ে এল ঘর থেকে, মুখে আতঙ্কের ছাপ। “ওই ঘরটায় একটা গলা শুনছিলাম,” ও বলল, “আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা গান গাইছিল—জ্যোৎস্নার নিচে মৃত মেয়ের গলা।”
সুজয় রোহিনীর চোখে তাকিয়ে রইল। ওর গলার স্বর কাঁপছে, কিন্তু চোখে ছিল একটা অদ্ভুত শীতলতা—যেন ও বুঝেও না বোঝার ভান করছে।
“ওই কুয়োটা কোথায় বলছিল লোকটা?” রোহিনী জিজ্ঞেস করল।
সুজয় ইশারা করল বাড়ির পিছনের দিকে। “ওখানে। চিরকাল নাকি শুকনো, তবু কেউ তাকায় না। নাকি তাকালেই ভিতর থেকে কিছু টেনে নেয়।”
তিনজন মিলে টর্চ নিয়ে গেল বাড়ির পিছনে। একচালা টিনের ঘরের পাশ দিয়ে একটা পথ গেছে, যার শেষে দেখা গেল কুয়োটা—চৌকো, পাথরের তৈরি, চারপাশে লতাগুল্মে ঢাকা। দেখে বোঝা যায় কতদিন কারও হাত পড়েনি।
রোহিনী ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেল। কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে ওর মনে হল ভিতর থেকে ঠান্ডা একটা হাওয়া আসছে—কিন্তু কুয়ো তো শুকনো! এমন ঠান্ডা বাতাস আসবে কোত্থেকে?
টর্চ ফেলে নিচে তাকাতেই দেখা গেল না কিছুই। কেবল অন্ধকার। অতল এক শূন্যতা।
হঠাৎ সুজয় বলল, “তোর কানে কিছু বাজছে?”
রোহিনী বলল, “একটা গলার আওয়াজ। আবার সেই গানটা—‘একবার যদি ফিরে আসিস… আমি তোর ছায়া হব।’”
সেই মুহূর্তে অলোক চেঁচিয়ে উঠল, “পিছনে কে?”
তিনজন একসাথে ঘুরে দাঁড়াল।
কেউ নেই।
কিন্তু কুয়োর চারধারে ধুলোয় এক জোড়া পায়ের ছাপ—খালি পা, নুপুরের দাগ স্পষ্ট। ছাপগুলো এমনভাবে ছড়ানো যেন কেউ কুয়োর ভিতর থেকে উঠে এসে ওদের চারপাশে ঘুরেছে।
রোহিনী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এই গানটা আমি ছোটবেলায় শুনেছি। ঠাকুমা গাইতেন—কিন্তু উনি বলতেন এটা শোনার গান নয়, ডাকের গান। কেউ যদি গানটা শুনে ফেলে, তার ছায়া ধরে কেউ এসে দাঁড়ায়।”
সুজয় ক্যামেরা বের করে আবার লাইভ চালু করল। “আমরা এখন কুঁয়োর ধারে। এখানে কিছু অস্বাভাবিক—শুধু শব্দ নয়, শরীরেও একটা চাপ অনুভব করছি। যদি কিছু থাকে, এবার দেখা দিক।”
তখনই অলোক ক্যামেরার পিছনে চেঁচিয়ে উঠল, “টর্চ নিভে যাচ্ছে! ব্যাটারি তো ছিল পুরো চার্জ!”
হঠাৎ কুয়োর ভিতর থেকে একটা বিকট হাসি শোনা গেল। রুক্ষ, নারীকণ্ঠ, কিন্তু কেমন যেন জং ধরা গলার আওয়াজ—
“তোমরা তিনজন… কিন্তু ছায়া চারটে… কে সেই অতিরিক্ত ছায়া?”
টর্চ নিভে গেল একেবারে। নিঃশব্দ অন্ধকারে শুধু সেই গলার ধ্বনি, আর ওদের নিজেদের দমবন্ধ হওয়া নিঃশ্বাস।
তখনই রোহিনী চিৎকার করে বলল, “আমার গা ঘেঁষে কেউ হাঁটছে! কিন্তু কিছু দেখছি না!”
কুয়োর কোল থেকে একটা দমকা হাওয়া উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে ঝুপ করে একটা শব্দ—কার যেন শরীর কুয়োর ভিতরে পড়ে যাওয়ার মতন।
সুজয় ক্যামেরা ছুঁড়ে ছুটল দিকে, “অলোক! অলোক কোথায়?”
কেউ নেই। শুধু কুয়োর ধারে ক্যামেরার ব্যাগ পড়ে আছে।
কিন্তু তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।
কুয়োর মুখে অলোকের ছায়া দাঁড়িয়ে—কিন্তু তার পা নেই। ছায়াটা শুধু দাঁড়িয়ে আছে, চোখ নেই, মুখ নেই—তবু তাকিয়ে যেন চেনা।
সুজয় ও রোহিনী পেছিয়ে এল, আতঙ্কে জড়িয়ে পড়ল।
রোহিনী বলল, “আমরা আজ রাতটা বাঁচব না। কিছু একটা আমাদের দেখে ফেলেছে। আর ওরা কাউকে ফিরতে দেয় না।”
সেই মুহূর্তে, কুয়োর ভিতর থেকে ভেসে এল সেই গানটা—এইবার অনেক জোরে, অনেক স্পষ্টভাবে—
“একবার যদি ফিরে আসিস,
আমি তোর ছায়া হব…”
যাদের ছায়া থাকে না
সেই গানটা যেন চারপাশে গায়ে মেখে বসে গেছে—হাওয়ায়, মাটিতে, গাছে এমনকি সুজয় আর রোহিনীর শরীরেও। তারা বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে, চোখের সামনে অলোকের পা-ছাড়া ছায়া। যেন অন্ধকারেই গড়া, অথচ সুস্পষ্ট। ছায়াটা স্থির—তবে তার মুখের জায়গায় কুয়োর মতই একটা গহ্বর, যেখান থেকে শুধু নীচের অতল অন্ধকারের গন্ধ আসছে।
“ওটা অলোক নয়,” ফিসফিস করে বলল রোহিনী। “ওটা অলোকের ছায়া, ওর শরীরটা এখন ওখানে কোথাও…”
সুজয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এখান থেকে চলে যেতে হবে। এখনই!”
কিন্তু তখনই এক শীতল হাত রোহিনীর কাঁধে। রোহিনী চমকে পেছনে ঘুরে তাকাল—কেউ নেই। তবু হাতের ছোঁয়া এতটাই জোরালো, মনে হল কেউ দাঁড়িয়েই আছে ওর পিছনে, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের কাছে।
ওরা দৌড়ে ভিতরের ঘরে ফিরল। দরজা বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলতেই রোহিনী দেখল—ঘরের এক কোণে রাখা আয়নাটা আবার জোড়া লেগে গেছে! যেটা আগের রাতে পড়ে ভেঙে গেছিল, সেটা এখন আস্ত।
“এটা সম্ভব না…” সুজয় বলল। “আমি নিজে দেখেছি আয়নাটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছিল!”
রোহিনী ধীরে ধীরে আয়নার দিকে এগোল। সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে তিনটে অবয়ব—তারা দুজন, আর একটা মেয়ে… লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, কপালে রক্তরাঙা টিপ, চুল খোলা, চোখ দুটো অতিরিক্ত বড়।
মেয়েটা মুখ না খুলেও কথা বলছে—ঠিক যেন শব্দহীন উচ্চারণ:
“তোমরা ফিরতে পারো না… কারণ তোমাদের ছায়া এখন আমার কাছে…”
হঠাৎই আয়নাটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। দেওয়ালের এক কোণে পচা গন্ধ ছড়াতে লাগল। রোহিনী দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দেখল বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে, ছায়া দেখা যাচ্ছে দরজার নিচে।
সুজয় ফিসফিস করে বলল, “এখান থেকে পালানো দরকার। জানলা ভেঙে বাইরে যাই।”
ওরা দৌড়ে ছাদ ঘরের দিকে গেল। সেই ঘর যেখান থেকে অলোক বলেছিল, “তৃতীয় ছায়াটা কে?”
তখন ছাদের খোলা দরজার পাশে বসে ছিল অলোক। একদম শান্তভাবে। কিন্তু মুখটা দেখেই বোঝা গেল কিছু একটা ঠিক নেই। চোখদুটো ফাঁকা—কোনও সাদা নেই, শুধু কালো।
“তোমরা দেরি করে ফেলেছ,” বলল অলোক—অথবা যেটা অলোক ছিল।
“তুই ঠিক আছিস?” সুজয় এগিয়ে যেতে যেতে বলল।
“আমি তো ঠিকই আছি,” হাসল সে। “তবে আমার ছায়াটা নিচে রয়ে গেছে। এখন আমি ছায়া ছাড়া—আর তোদের চাই।”
সেই মুহূর্তে অলোকের শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নিঃসাড়। কিন্তু ছায়াটা… ছায়াটা চিৎকার করে উঠল, একটা বিকট শব্দে, যেন কাঁচ ভাঙছে, জানলা ছিঁড়ে যাচ্ছে—আর সেই শব্দেই জানলার কাঁচ গুঁড়িয়ে মেঝেতে পড়ে ছিন্নভিন্ন হল।
সুজয় আর রোহিনী প্রাণপণে নিচে ছুটল। ওরা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আর তখনই দূরে একটা আলো দেখা গেল—গ্রামের দিক থেকে এক বুড়ো লোক লাঠি ঠুকঠুক করে হেঁটে আসছে।
লোকটা কাছে এসেই বলল, “তোমরা ঢুকেছ, অথচ ছায়া রেখে এসেছ। এবার ফিরবে কিভাবে?”
“আপনি কে?” চিৎকার করে উঠল রোহিনী।
“আমি এই কুঁয়োডাঙার শেষ পাহারাদার। আগেও বহু শহুরে এসেছিল—যারা ভয়কে বিশ্বাস করত না। তাদেরও ছায়া ফিরে যায়নি।”
“আমরা যাব কোথায়?” সুজয় বলল।
লোকটা মাটিতে ছুঁয়ে কিছু মাটি হাতে নিল, ছিটিয়ে দিল ওদের দিকে। “যাদের ছায়া থাকে না, তারা মানুষ নয়। তোমরা এখন শুধু চলন্ত শরীর। ফিরে যেতে চাও? তাহলে ওর গান বন্ধ করতে হবে। যে গায়, সে শুধু শোনে না—ছায়াও ধরে রাখে।”
“কিন্তু কে গায়?” রোহিনী বলল।
লোকটা তাকাল পেছনের বাড়িটার দিকে।
“ওই যে জানলায় তাকিয়ে আছে—ওই মেয়েটা। যে এক অমাবস্যায় কুয়োর ভিতর ডুবে গিয়েছিল। তখন গেয়েছিল এই গান—এখনও গাইছে।”
আর তখনই রোহিনীর মনে পড়ল—ছোটবেলায় ওর ঠাকুমা বলেছিলেন, “ভূতের গান যদি শুনতে পাও, সঙ্গে সঙ্গে একটা ছায়া খুঁজি। কারণ ওরা চায় তোমার ছায়া আগে যাক, শরীর পরে।”
সুজয় ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে বলল, “আমরা পালাতে পারব না… ও আমাদের ছায়া চুরি করেছে।”
বৃদ্ধ বলল, “পারবে। কিন্তু ছায়া ফিরে পেতে হলে কুয়োর নিচে নামতে হবে। যেখানে ওর আসল কন্ঠ গাঁথা আছে। কুয়োর তলায়… যেখানে মৃত্যুর গান বাজে এখনও…”
মৃত্যুর গলার নিচে
রাত তখন গভীর। আকাশে চাঁদ নেই, কুয়োডাঙার চারপাশে যেন সময় থমকে আছে। বৃদ্ধ লোকটা তখনও দাঁড়িয়ে—হাতের লাঠিটা জমিতে ঠুকঠুক করছে, যেন তার তালেই মৃত্যুর ছায়ারা চলাফেরা করে।
“তোমরা যদি সত্যিই ফিরে যেতে চাও,” সে বলল, “তবে কুয়োর নিচে নামতে হবে। যেখানে শেষবার গানটা গাওয়া হয়েছিল। যেখানে সেই মেয়েটার গলা থেকে শব্দ আলাদা হয়ে পড়েছিল এক গভীর অতলে।”
রোহিনী বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আপনি জানলেন কী করে আমরা আমাদের ছায়া হারিয়েছি?”
বৃদ্ধ হালকা হেসে বলল, “তোমাদের গায়ে আলো পড়ছে, অথচ মাটিতে কোনও ছায়া নেই। এটা দেখলে বোঝার জন্য তন্ত্র জানার দরকার হয় না। শুধু মৃত্যুর দিকে কয়েকবার তাকালেই হয়।”
সুজয় বলল, “আমাদের একজন বন্ধু… অলোক… ও কোথায়?”
“তার শরীর আছে, আত্মা আছে, কিন্তু ছায়া নেই। সে এখন দ্বিখণ্ডিত। কুয়োর ছায়ারা তার ছায়াটাকে আটকে রেখেছে, আর শরীরটা কেবল একটি খোলস।”
“কিন্তু কুয়োর নিচে নামব কিভাবে?” রোহিনী বলল। “ওটা তো বছরের পর বছর ফাঁকা পড়ে আছে।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। “ওটা কখনও ফাঁকা ছিল না। শুধু যাদের চোখ আছে, তারা দেখে না। ওই কুয়োর তলায় আছে একদল ছায়া—যারা গান শোনে, গান ধরে, আর যখন কেউ গান ভুলে যায়, তখন তাকে মুক্তি দেয়।”
তিনজন আবার গেল বাড়ির পেছনের সেই কুয়োর ধারে। এবার বাতাস অনেক ঠান্ডা, আর অন্ধকার এত ঘন যেন টর্চের আলোও সেখানে পৌঁছচ্ছে না।
বৃদ্ধ একটি ছোট লণ্ঠন বের করল, যার আলো গাঢ় নীল। “এই আলো শুধু ছায়া দেখায়। কুয়োর নিচে গেলে এর সাহায্যেই দেখতে পাবে কোথায় তোমাদের ছায়া আটকে আছে।”
রোহিনী আর সুজয় রশি বেঁধে নামার প্রস্তুতি নিল। বৃদ্ধ বলে দিল, “একসঙ্গে নামো না। আগে একজন যাক। গান শুরু হলে থামানোর চেষ্টা কোরো না—শুধু নিজের ছায়াকে চিনে নাও।”
সুজয় আগে নামল। রশিতে ঝুলে, ধীরে ধীরে সেই অন্ধকার গহ্বরে নামতে লাগল। বাতাস ভারী, আর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
প্রথম কুড়ি ফুট নামার পর চারপাশে একটা ধোঁয়াচ্ছন্ন আলো দেখা গেল—যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু গন্ধটা ধূপের নয়, পচা ফুলের মত।
তখনই একটা মেয়েলি গলার গান শুরু হল—
“তুই এলি বলে আমি ফিরে এলাম
ছায়া হলে আজ ছুঁয়ে যাব…”
সুজয় লণ্ঠনের আলোয় চারপাশে তাকাল। এক একটা ছায়া বাতাসে ভেসে আছে—আলগা চুল, সাদা জামা, উড়ে যাওয়া ওড়না। তারা কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউ শুধু একটা পা তুলে বসে আছে যেন নাচতে যাবে।
আর ঠিক সামনেই—দেখা গেল অলোকের ছায়া। মাথা নিচু, চোখ নেই, কিন্তু মুখে একটা অসহায় আকুতি।
“অলোক!” সুজয় চিৎকার করে উঠল।
ছায়াটা মুখ তুলল। কিন্তু মুখে কোনও শব্দ নেই—শুধু সেই গানটা তার ভিতর থেকেই বারবার বাজছে।
সুজয় লণ্ঠনের আলোটা ছায়ার দিকে ধরতেই সেটা কাঁপতে লাগল। যেন আলো পেলে ওরা দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই চারপাশের অন্য ছায়াগুলো এগিয়ে এল—তারা সবগুলো মেয়ের অবয়ব, কিন্তু মুখ নেই, কেবল গভীর ফাঁকা চোখ। কেউ কেউ হাসছে, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে না।
তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এল। সবার থেকে আলাদা—সে সম্পূর্ণ মানুষ মতন, চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে সেই গান—
“একবার যদি ফিরে আসিস
আমি তোর ছায়া হব…”
সে এগিয়ে এসে বলল, “তুই আমার গান শুনেছিস। এখন আমায় দিতে হবে তোর ছায়া।”
সুজয় ফিসফিস করে বলল, “আমি গান শুনিনি… আমি শুধু রেকর্ড করছিলাম… আমি তোকে ডাকিনি…”
মেয়েটি তখন লণ্ঠনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওটা নিভে গেলে, তুই আমার।”
লণ্ঠনের আলো তখন টিমটিম করছে। হাওয়ার দমকা বাড়ছে। সুজয় অলোকের ছায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “চল… তুই আমার বন্ধু… তুই তো আমারই ছায়া…”
আর তখনই অলোকের ছায়া কেঁপে উঠল, চোখের ফাঁকা গহ্বরে আলো ঢুকে পড়ল, আর সেই মুহূর্তে একটা বিকট আওয়াজে সব ছায়ারা চিৎকার করে পিছিয়ে গেল।
সুজয় অলোকের ছায়াটাকে টেনে ধরল, আর রশি টেনে উপরে উঠে এল।
রোহিনী আর বৃদ্ধ ওদের টেনে তুলল উপরে।
জমিতে পড়ে রইল কুয়োর পাশে—একটা সাদা ওড়না, যার নীচে লাল দাগ, আর সেই অদ্ভুত গানটা, এখন অনেক দূরে, অনেক মৃদু—
“তুই ফিরে গেলে আমি কাঁদব
তোর ছায়া কোথায় রাখব…”
ফিরে আসা মানেই মুক্তি নয়
সুজয় কুয়োর ধার থেকে টেনে তোলা অলোকের ছায়াকে জড়িয়ে বসে আছে। ওর শরীর ঘামে ভিজে, কিন্তু ছায়াটা এখন আবার অলোকের গায়ে ফিরে এসেছে। অলোক ধীরে ধীরে চোখ মেলল—প্রথমে কুঁচকে গেল, তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
“আমি… কোথায় ছিলাম?” ও ফিসফিস করে বলল।
রোহিনী কাঁপা গলায় বলল, “তোর ছায়া আমাদের ছেড়ে গেছিল, অলোক। তুই একটা খোলস হয়ে গেছিলি। আমরা তোকে ফিরিয়ে এনেছি।”
বৃদ্ধ তখন জানাল, “যে নিজের ছায়াকে ফিরিয়ে আনে, সে বাঁচে। কিন্তু ছায়া কখনও এক থাকে না। একবার ছিন্ন হলে, তা আবার নিজস্ব হয়ে ওঠে না। এখন থেকে অলোকের ছায়া ওকে অনুসরণ করবে না—ওকে পর্যবেক্ষণ করবে।”
সুজয় উঠে দাঁড়াল। “এখন কী হবে? আমরা কি এখান থেকে চলে যেতে পারি?”
“পারো,” বলল বৃদ্ধ। “কিন্তু একবার ছায়াহীন হয়ে গেলে, দাগ থেকে যায়। তোমাদের মধ্যে একটা কণ্ঠস্বর ঢুকে পড়েছে। আর সেই গানটা… সেটা তো বন্ধ হয়নি।”
তাদের তিনজনকে নিয়ে বৃদ্ধ ফিরে গেল নিজের কুঁড়ে ঘরের দিকে—গ্রামের শেষপ্রান্তে একটা ধুঁয়ে পড়া টিনের চালা। ভিতরে একটামাত্র খাট, একটা পুরোনো রেডিও, আর মাটির প্রদীপে জ্বলছে সরষের তেল।
“এটা খাও,” বলল বৃদ্ধ, তিনজনকে একটা করে বাটিতে লাল রঙের জল দিল।
“এটা কী?” অলোক প্রশ্ন করল।
“তোমাদের ছায়াকে স্থির রাখার মন্ত্র—পুরোনো তান্ত্রিক পদ্ধতি, যার গন্ধেই ছায়ারা দূরে থাকে কিছুদিন। কিন্তু বেশি দিন না।”
ওরা নিঃশব্দে জল খেয়ে নিল। সুজয় এবার বলল, “আপনি কে? কেন সাহায্য করছেন আমাদের?”
বৃদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। “আমার মেয়েটাও একদিন ওই কুয়োর গানে ডুবে গিয়েছিল। সেই কিশোরী মেয়েটা গানটা গাইতে গাইতে হারিয়ে গেল। আমি তার গলাটাই শুনি আজও, এই রাতে। তাই প্রতিবার কেউ যখন ঢোকে ওই বাড়িতে, আমি তাদের ছায়া খুঁজি। কেউ ফিরলে তাকে বলি, গানটা থামাও।”
“তাহলে কি আমরা ওকে মুক্তি দিতে পারি?” রোহিনী জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধ বলল, “হয়তো। যদি তোমরা চাও, তাহলে গানটা শেষ করতে হবে। ওর শেষ লাইন এখনও কেউ জানে না। যতক্ষণ না গানটা শেষ হচ্ছে, ওর আত্মা এই পৃথিবীতে জড়িয়ে থাকবে, ছায়া খুঁজে বেড়াবে।”
সুজয় ব্যস্ত হয়ে বলল, “তাহলে লাইনটা খুঁজে বার করতে হবে। কোথাও না কোথাও লেখা থাকবে তো?”
“লিখে কেউ রাখেনি,” বৃদ্ধ বলল। “গানটা ছিল মুখে মুখে ছড়ানো। তবে এক জায়গায় তার শেষ স্তবক ছিল—ওই বাড়ির ভিতরেই, আয়নার পেছনে খোদাই করা।”
রোহিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। “আমি যাব। আমি শুনেছি সেই গলার আওয়াজ—আমাকে যেন কিছু বলতে চাইছিল। আমি এখন থেমে থাকলে ও কোনওদিন মুক্তি পাবে না।”
“তুই একা যাবি না,” বলল সুজয়। “আমরা একসাথে গিয়েছিলাম, ফিরবও একসাথে।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। “যাও। কিন্তু মনে রেখো—এবার ও গান গাইবে না, ও এবার কান্না করবে। আর যার কানে ওর কান্না পড়ে, তার ছায়াও কাঁদে… তখন সেটা আর ফেরে না।”
তিনজন আবার বাড়ির দিকে রওনা দিল। রাত তখন গাঢ় হয়েছে, কুয়োর চারপাশ নিঃশব্দ। বাড়ির দরজা এখনও খোলা, জানলার কাঁচে ধুলো জমে।
ওরা ভিতরে ঢুকল।
ঘর নিঃস্তব্ধ। টর্চের আলোয় দেয়ালের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে। সেই পুরোনো আয়নাটা, যেটা একবার ভেঙেছিল, আবার জোড়া লেগেছিল—ওটাই আজ ওদের লক্ষ্য।
রোহিনী কাছে গিয়ে হাত রাখল আয়নার ফ্রেমে। হঠাৎই ওর আঙুল ফ্রেমের একটা ফাঁকে আটকে গেল।
ভিতর থেকে টেনে বের করল একটা কাগজ। পুড়ে যাওয়া, পুরোনো, কিন্তু কিছু লেখা টিকে আছে। একটা অর্ধেক ছড়া—
“একবার যদি ফিরে আসিস
আমি তোর ছায়া হব
তুই যদি না ফিরিস আর
আমি কান্না হব…”
সুজয় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে এটাই শেষ লাইন! ওর অপেক্ষার গান, প্রেমের ছায়া—এবং অভিশাপ একসাথে।”
তখনই আয়নাটা কেঁপে উঠল। ভিতর থেকে আবার সেই মেয়েটার মুখ ফুটে উঠল—কিন্তু এবার আর ভয়ানক না, বরং ক্লান্ত, ধ্বস্ত, যেন অনেককাল পরে একটা কথা শুনে ও মুক্তি চায়।
মেয়েটার ঠোঁটে এবার আর গান নেই—শুধু কান্না।
রোহিনী বলল, “আমরা গানটা শেষ করেছি। এবার তুই যেতে পারিস…”
আয়নাটা ফেটে গেল নিঃশব্দে। তার গা থেকে ধোঁয়ার মত হালকা এক আলো বেরিয়ে জানলা দিয়ে উড়ে গেল। যেন কেউ গুডবাই বলে চলে গেল, ছায়া রেখে।
তখনই ওরা তিনজন দেখল—প্রথমবারের মত জানলার গায়ে ওদের ছায়া পড়ছে।
তিনটে ছায়া। আবার তিনজন।
ছায়ার বাইরে যাদের নাম থাকে না
সেই রাতের পর সকালটা কুঁয়োডাঙায় অন্যরকম ছিল। সূর্যের আলো পুরনো ইটের গায়ে পড়ে যেন নতুন রঙ ছড়াল। বাতাসে পচা গন্ধ নেই, কুয়োর পাশে জাঁকিয়ে বসে নেই কোনও ছায়া। পুরোনো বাড়ির জানলা হালকা খোলা, আর সেই আয়নাটা… সেটার জায়গায় এখন কেবল একটা ফাঁকা দেওয়াল, যেন কিছুই কখনও ছিল না।
সুজয়, রোহিনী আর অলোক তিনজনেই নির্বাক। তারা জানে, কিছু একটা বদলেছে। শুধু স্থান নয়—মানুষও। আর এই বদল কোনও ক্যামেরায় ধরা পড়বে না।
বৃদ্ধ লোকটা আবার সেই কুঁড়েঘরে ফিরে গিয়েছে। যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল, “তোমরা যা করেছ, তা সাহসের নয়, প্রয়াশ্চিত্তের। কিন্তু অমাবস্যার বাড়ি এখনও আছে। শুধু ছায়ারা আর গান গায় না।”
তিনজনেই ফিরছিল কলকাতার দিকে। গাড়ির ভিতর নিঃশব্দ। অলোক জানালার দিকে তাকিয়ে আছে, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে। সুজয় মোবাইল চেক করছিল, রেকর্ডিং ঠিক আছে কি না দেখতে। কিন্তু লাইভ স্ট্রিমটা হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেছে—সেই সময়টা যখন কুয়োর নিচে গান গাইছিল সেই ছায়া।
রোহিনী বলল, “তুই কি কিছু টের পাচ্ছিস?”
অলোক একটু চমকে তাকাল। “টের পাচ্ছি মানে?”
“তোর ছায়াটা পুরোপুরি ফিরেছে তো?”
অলোক নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। “ফিরেছে বটে… কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় ও আমার আগেই দেখে ফেলে আমি কী ভাবছি। আমার ছায়াটা যেন আমার থেকেও বেশি জীবন্ত।”
সুজয় গম্ভীর গলায় বলল, “অমন হলে বলিস। আবার ফিরতে হবে কুঁয়োডাঙায়।”
রোহিনী একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, “আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় সেই মেয়েটা পুরোপুরি চলে যায়নি। শুধু গান থেমেছে, কিন্তু কান্না কি শেষ হয়েছে?”
গাড়ি চলছিল ধীরে ধীরে। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল তাল-খেজুরের গাছ, খড়ের মাঠ, মাটির বাড়ি। হঠাৎ রোহিনীর চোখে পড়ল—একটা ছোট মেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে একটা লাল টিপ। মুখে কোনও ভাব নেই, কেবল শূন্য চাহনি।
“গাড়ি থামা!” রোহিনী চেঁচিয়ে উঠল।
সুজয় ব্রেক চাপল। সবাই নেমে এল। মেয়েটা কোথায়?
“ও তো এখানেই ছিল!” বলল রোহিনী। “আমি স্পষ্ট দেখেছি, ও আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল!”
সুজয় চারপাশে তাকাল। গাছের ফাঁকে শুধু বাতাস। পেছনে এক বৃদ্ধ লোক হেঁটে আসছিল। দেখেই চিনতে পারল—ওই কুঁয়োডাঙার পাহারাদার।
“তুমি এখানে?” জিজ্ঞেস করল অলোক।
বৃদ্ধ হাসল। “তোমরা চলে গেছ ভেবে ভুল করো না। যারা একবার কুয়োর গান শুনে ফেলে, তারা চিরকাল বহন করে তার প্রতিধ্বনি। সেই মেয়েটা—সে চলে গেছে বটে, কিন্তু ছায়ার বাইরে যাদের নাম থাকে না, তারা বারবার ফিরে আসে।”
“মানে?” রোহিনী বলল।
“মানে, তোমরা যদি ভুলে যাও ওই গান, যদি কেউ আবার গাইতে শুরু করে—ছায়ারা ফিরে আসবে। কারণ ছায়ারা মরে না, তারা শুধু অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে আবার কোনও কানে ঢুকবার জন্য। আর ওই মেয়েটা—সে কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছে? নাকি ওর কান্না থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন কিছু?”
হঠাৎ অলোক কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কেউ শ্বাস নিচ্ছে… কে?”
সুজয় আর রোহিনী তাকিয়ে দেখল—অলোকের ছায়া এখন দ্বিগুণ। একটাই শরীর, কিন্তু দুটো ছায়া।
“এটা কী?”
বৃদ্ধ একটানা তাকিয়ে বলল, “তোমার শরীর ফিরে পেয়েছে ছায়া। কিন্তু ছায়াও ফিরে পেয়েছে শরীর। এবার দেখো কে কাকে বাঁচতে দেবে।”
হঠাৎই সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর—ভিন্ন, আরও ভাঙা, কিন্তু স্পষ্ট—
“তুই ফিরলি বটে,
কিন্তু আমি তো রইলাম…
তুই ছায়া নিয়ে চললি,
আমি নামটা নিয়ে নিলাম…”
গাড়ির ভিতর মোবাইল স্ক্রিনে হঠাৎ অটোপ্লে চালু হয়ে গেল—পুরোনো সেই লাইভ ভিডিও, যেটা বন্ধ হয়ে গেছিল মাঝপথে।
স্ক্রিনে সেই বাড়ি, সেই আয়না, আর তার গায়ে এখন এক লালচে দাগে লেখা—
“আবার আসিস। আমি নাম ভুলিনি।”
নামহীন মুখগুলোর দল
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এল। কলকাতার শহরজীবন আবার নিজের ছন্দে ফিরেছে, কিন্তু সুজয়, রোহিনী আর অলোক—তারা আর সেই আগের মানুষ নেই। শরীরটা শহরে ফিরেছে বটে, কিন্তু মনে হচ্ছে কুয়োডাঙার অন্ধকার এখনও তাদের পিছু ছেড়ে যায়নি।
অলোক আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে মাঝে মাঝে থমকে যায়। প্রতিফলিত মুখটা যেন এক সেকেন্ড দেরিতে নড়ে। সে ভাবতে থাকে—এটা কি আমি? না, আমি যার ছায়া ছিলাম, সে এখন আমার ভিতর ঢুকে আছে?
রোহিনী একটা খাতা খুলে বসে। সেই কাগজটা যেখানে গানের শেষ লাইন লেখা ছিল, সেটা নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করতে চাইছে। সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সি, ব্রেইন ওয়েভ, শব্দ-আবেশ—এসব দিয়ে ছায়া কি রেকর্ড করা যায়?
সুজয় চুপচাপ তার ইউটিউব কমেন্ট পড়ছিল। হঠাৎই চোখ আটকে গেল এক অদ্ভুত কমেন্টে—
“তোমরা তিনজন আসলে চারজন ছিলে। একটা মুখ ক্যামেরায় ধরা পড়েনি, কারণ তার নাম কেউ রাখেনি। কিন্তু আমি তাকে দেখেছি।”
ইউজারনেমটা ছিল NamelessWatcher_88
সেই মুহূর্তে ফোনের স্ক্রিন ব্ল্যাক হয়ে গেল।
সুজয় তাড়াতাড়ি কম্পিউটারে ভিডিও ফাইল খুলল। লাইভ রেকর্ডিং-এর একটি নির্দিষ্ট সময় ফ্রেমে থামিয়ে বড় করে দেখল—হ্যাঁ, বাড়ির ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াগুলোর মধ্যে একটা ছায়া অন্যদের থেকে অস্বাভাবিক।
তার মুখ নেই, মাথা নেই, কেবল শরীরের একরকম ছায়া, যেন কোনও ভুলে যাওয়া আত্মা। একে কেউ ডাকেনি, কেউ কোনওদিন নাম দেয়নি। সে শুধু সেইসব ছায়াদের ছায়া। একটি ছায়া যা ছায়ারও ছায়া হতে পারে।
রোহিনী বলল, “আমরা যতটা ভাবছি, এটা ততটা সাধারণ ‘ভৌতিক’ ব্যাপার না। এই ছায়ারা আমাদের ভিতরের স্মৃতি, অপূর্ণতা, অপরাধবোধ—যেগুলো কোনওদিন আলোয় আসে না, কিন্তু মনের ভিতর ঘুরে বেড়ায়।”
সুজয় হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “দেখ! এখানে—এই শটটায়, যখন আমরা কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম—আমার কাঁধে কারও একটা হাত রাখা! অথচ আমরা কেউ তখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম না!”
অলোক মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “আমার মনে পড়ছে… যখন আমি কুয়োর তলায় পড়ে গেছিলাম, তখন কেউ একটা আমার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। বলেছিল, ‘তোর নাম বল, আমি তাকে গাইব।’ আমি ভয়ে নাম বলিনি…”
“কারণ তুই বুঝেছিলি, নাম বললেই ওর গান তোকে নিয়ে নেবে,” রোহিনী বলল।
সেই মুহূর্তে দরজায় বেল বেজে উঠল।
তিনজনেই চমকে উঠল। এত সকালে কেউ আসার কথা না।
সুজয় দরজা খুলে বাইরে তাকাল।
কেউ নেই।
শুধু একটা প্যাকেট রাখা।
ভেতরে ছিল—একটা পুরোনো ক্যাসেট টেপ, আর একটা ছোট কাগজে লেখা:
“আমি ছায়া নই, কিন্তু ছায়ার ভিতর থাকি।
তোমরা ফিরে আসলে এবার নাম তোমাদের চাইবে।
এবার গান নয়—নাম ডাকা হবে।”
ক্যাসেট চালাতে গিয়ে তিনজনের বুক কেঁপে উঠল।
টেপ থেকে আওয়াজ ভেসে এল—
“সুজয়…
রোহিনী…
অলোক…
আর তুই… যে এখনও নিজের নাম রাখিসনি…”
চতুর্থ নামটা শূন্যে থেমে যায়।
তারা বুঝল—ওরা ছাড়া আরও কেউ ছিল সেই বাড়িতে। কেউ, যাকে তারা চোখে দেখেনি, শুধু ছায়ার ভিতর অনুভব করেছে।
সেই নামহীন সত্তা, যে এখন তাদের চারপাশে ঢুকে পড়ছে।
রোহিনী আস্তে বলল, “আমরা তিনজনই তো জানি—ওই রাতের পরে আমি স্বপ্নে কাউকে দেখেছি, যে আমার মুখ দেখে আমার নাম বদলে দিতে চেয়েছে। বলেছে, আমি যদি নিজের পুরনো নাম ভুলে যাই, তাহলে ও আমাকে রাখতে পারবে।”
অলোক বলল, “আমিও। আমার ছায়া আমার সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু এখন সেটা আমার গলায় কথা বলে। মাঝে মাঝে আমি বুঝতেই পারি না, আমি কথা বলছি, না আমার ছায়া।”
সুজয় উঠল। “আমরা চুপ থাকলে চলবে না। আমাদের আবার যেতে হবে কুয়োডাঙায়। কিন্তু এবার আমরা শুধু ফিরে যেতে পারব না। এবার আমাদের নাম দিতে হবে—সেই নামহীন মুখগুলোকে।”
“যারা গান গায় না, শুধু চুপ করে আমাদের ছায়ার ভিতর বসে থাকে।”
মুখ দেওয়া ছায়ারা
কলকাতা থেকে কুয়োডাঙা এবার আর অত দূরে মনে হল না। ট্রেনের জানালায় বসে সুজয় ভাবছিল—সময়টা শুধু ঘড়ির কাটায় চলে না, মনের ভিতরেও একটা সময় থাকে, যেটা যেখানে আটকে যায়, সেখানে ফেরার ইচ্ছে না থাকলেও ফিরে যেতে হয়।
রোহিনী কানে হেডফোন লাগিয়ে ক্যাসেটের রেকর্ডিং বারবার শুনছিল। সেই একই স্বর—তাদের নাম ধরে ডাকার পরে একটুখানি শূন্যতা, তারপর নিঃশ্বাসের শব্দ, যেন কেউ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু এখনও মুখ খুলছে না।
অলোক কাগজে আঁকছিল। কিছু মুখ—যাদের চোখ আছে, মুখ আছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সব মুখের নিচে ছায়া লেগে গেছে। যেন ওর মনে ছায়াগুলো নিজেই রূপ নিচ্ছে।
তারা যখন আবার সেই বাড়ির সামনে দাঁড়াল, তখন বিকেলের আলো পড়ে ইটের গায়ে একটা ছায়া তৈরি করছিল—তিনজনের নয়, চারজনের। চতুর্থ ছায়াটা কিছুটা ছোট, মাথাটা হালকা কাত।
“ও আবার এখানে,” বলল রোহিনী।
বাড়ির দরজা এইবার বন্ধ ছিল। কিন্তু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল—মনে হল কেউ ভিতর থেকে খুলে দিয়েছে।
তারা ঢুকতেই চারপাশে একটা নতুন গন্ধ—জলচৌকি, পুরনো নারকেল তেল, আর হালকা গন্ধ চন্দনের। যেন কেউ এখানে ছিল, কেউ এখনও আছে।
“এই বাড়িতে যদি সত্যি কেউ থেকে থাকে,” সুজয় বলল, “তবে সে চাইছে আমরা ওর নাম খুঁজে দিই। ছায়ারা নিজেদের নাম জানে না, তাই ওরা মুক্তি পায় না।”
তারা তিনজন আলাদা আলাদা ঘরে গেল।
রোহিনী উঠল সেই ঘরে, যেখানে আগে আয়নাটা ছিল। এখন সেখানে একটা খালি ফ্রেম। কিন্তু সেই ফ্রেমের গায়ে হঠাৎ চোখে পড়ল খোদাই করা ছড়া—
“যে মুখে নাম থাকে না
সে আলোয় ফিরতে পারে না
যে মুখে ছায়া থাকে
সে আলো ছুঁতে পারে না…”
ফ্রেমের নিচে একটা অদ্ভুত শব্দ—”তানিয়া?”
রোহিনী পিছনে তাকাতেই দেখল দেওয়ালে লেগে থাকা ছায়া ধীরে ধীরে নিচে নেমে এসে জমিনে ছড়িয়ে পড়ল। ছায়াটা একটা মেয়ের অবয়ব—চুল খোলা, হাত দুটো সোজা, যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
“তুই কি তানিয়া?” জিজ্ঞেস করল রোহিনী।
ছায়াটা হালকা নড়ল। যেন সম্মতি।
“তুই কি সেই নামহীন মুখ, যে আমাদের ছায়ার ভিতর ছিল?”
ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, আর রোহিনীর মুখে এক পলকের জন্য স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে রোহিনীর মাথার ভিতর ভেসে উঠল একটা ছবি—একটা নদীর ঘাট, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা কিশোরী মেয়ে, কাঁধে স্কুল ব্যাগ, চোখে জল।
আর সেই কিশোরী তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার নাম ছিল। কিন্তু কেউ সেটা ডাকেনি, তাই আমি ছায়া হয়েছিলাম। আমাকে মুখ দে, আমি ফিরব না। শুধু নামটা দে।”
রোহিনী গুছিয়ে বলল, “তানিয়া মিত্র। তুমি ছিলে এই গ্রামের স্কুলে। তুমি কুয়োর ধারে একদিন নাম ধরে ডাকতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলে। কেউ বিশ্বাস করেনি, কারণ তোমার নাম কেউ মুখে আনেনি। আজ আমি তোমার নাম নিচ্ছি।”
সেই মুহূর্তে দেওয়ালের ছায়াটা মিশে গেল বাতাসে।
অলোক তখন নিচের ঘরে পুরনো একটি খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। সেখানে খুঁজে পেয়েছে একটা রেজিস্টার—পুরোনো, পোকা ধরা। তাতে নাম লেখা—তানিয়া, মলয়, কণিকা, সুদীপ।
সবার পাশে একটা শব্দ লেখা—“ভানু”।
অলোক সেটা উচ্চারণ করতেই ঘরের দরজা আপনমনে খুলে গেল।
সুজয় তখন উপরের ঘরে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে। স্ক্রিনে ফ্রেমিং ঠিক করতে করতে সে আচমকা দেখল—দু’টো মুখ ফ্রেমে ঢুকছে যাদের সে আগে কখনও দেখেনি।
দুটি বাচ্চা মেয়ে, হাত ধরা, দাঁড়িয়ে বলছে, “আমরা চাই না কেউ আমাদের মুখ ভুলে যাক। আমাদের নাম ছিল চিঠির মতো, কেউ পড়েনি।”
সুজয় বলল, “তোমরা বলো তোমাদের নাম। আমি রেকর্ড করব। পৃথিবী এবার শুনবে।”
দুটি মেয়ে হাসল। তারপর হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গলে গেল, কিন্তু স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠল—
“রূপা ও মিনু ঘোষাল”
ঠিক তখনই সারা বাড়ি জুড়ে একটা ঝাপটা বাতাস। জানলার কাঁচ ভাঙল না, দরজা বন্ধ হল না—কিন্তু সব ছায়া যেন একসাথে নিঃশ্বাস ফেলল।
তিনজন নিচে নেমে এসে দেখল—দেওয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা—
“ধন্যবাদ। এখন আমরা ফিরে যেতে পারি।”
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, তিনজনের মোবাইলে একসাথে একটা মেসেজ এল—
“তুমি যদি কখনও কারও নাম ভুলে যাও,
সে কখনও তোমার ছায়া ভুলে না।”
ছায়ার কাছে চিঠি আসে না
সেই রাতটা আর কোনও ‘ভৌতিক অভিযান’ ছিল না। কুয়োডাঙার সেই লাল ইটের বাড়িটা যেন এবার সত্যিই নিঃশ্বাস নিয়েছে। যেন সে দীর্ঘকাল ধরে নিজের শরীরে বাস করা মুখহীন ছায়াদের নাম পেয়ে কিছুটা হালকা হয়েছে।
তবু কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। অলোক টর্চ নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেই নাম লেখা রেজিস্টারটা হাতে ঘুরছিল। রোহিনী এক কোণে বসে সেই মুখগুলো আঁকছিল, যাদের নাম তারা উচ্চারণ করেছে। আর সুজয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল কুয়োর ধারে—যেখানে প্রথম অলোকের ছায়া হারিয়ে গিয়েছিল।
সেই কুয়োটা এখন নিঃশব্দ। আর কোনও গান নেই। কোনও কান্নাও না। শুধু একরকম ঠান্ডা শূন্যতা।
রাত আড়াইটা নাগাদ হঠাৎ বাতাস উঠল। সুজয় ক্যামেরা হাতে আবার লাইভ চালু করল।
“আজ রাতটা অন্যরকম। ছায়ারা কথা বলেছে। আমরা কিছু মুখকে নাম দিয়েছি। তাদের অস্তিত্ব ফিরেছে, অন্তত স্মৃতিতে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—আরও কি কেউ ছিল, যাকে এখনও আমরা নাম দিতে পারিনি?”
ঠিক তখনই ক্যামেরার লেন্সে একটা ছায়া ধরা পড়ল।
একটি লোক। উঁচু ছায়া, কাঁধে একটা লাঠি, মাথায় টুপি। ঠিক যেন সেই বৃদ্ধ পাহারাদার।
কিন্তু আশ্চর্যভাবে… এই বৃদ্ধটা কিছুটা আলাদা।
সে এগিয়ে এল, হালকা হাঁটুর কষ্ট নিয়ে, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত আলো।
“তোমরা শুনতে পাবে না,” সে বলল, “কিন্তু তোমাদের ছায়ারা এখন কথা বলছে। তারা তোমাদের নিয়ে যাবে এমন জায়গায়, যেখানে নাম দেওয়া যায় না। শুধু চেনা যায় ঘ্রাণে, ছায়ায়, অনুভবে।”
রোহিনী এগিয়ে এসে বলল, “আপনি কে? আপনি পাহারাদার না অন্য কেউ?”
বৃদ্ধ হেসে বলল, “আমি এক নামহীন মুখ। যে এই বাড়ির রক্ষক ছিল না, বরং কুয়োর ছায়াদের প্রথম সঙ্গী। যে তাদের গান শুনত, তাদের কান্না ছুঁত, কিন্তু নিজে কখনও কিছু বলেনি। কারণ আমার নাম কেউ কখনও লিখে রাখেনি। এখন যদি লিখো, আমি চলে যাব।”
“তোমার নাম কী?” অলোক বলল।
বৃদ্ধ কিছু বলল না। শুধু পকেট থেকে একটা ছোট খাম বার করল—চিঠি। পুরনো, হলুদ হয়ে যাওয়া খামে নাম লেখা নেই, শুধু ওপরে একটা অক্ষর—
“ঈ”
রোহিনী ধীরে ধীরে খামটা খুলল। ভিতরে একটা ছোট কাগজ। তাতে লেখা—
“যে নাম কেউ ডাকে না,
সে চিঠি পায় না।
যে চিঠি পায় না,
সে ফিরে যেতে পারে না…”
সুজয় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা কি এবার শেষ মুখটাকেও চেনাতে পারি?”
রোহিনী বলল, “চেষ্টা তো করা যায়।”
সে নাম দিল—“ঈশান।”
বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ রাখার মতো কষ্টের মুখ। তারপর সে বলল, “তোমরা সফল হয়েছ। ঈশান নামটাও এবার ফিরে গেল ছায়ার বাইরে।”
সে এক পা এক পা করে বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর ওরা তিনজন ছুটে বাইরে এসে দেখল—
সেই কুয়োডাঙার ভোর। চাঁদের আলো মিশে গেছে প্রথম আলোর সঙ্গে। আর কুয়োর ধারে ছায়া পড়ছে না। কেউ নেই। কেউ আর অপেক্ষা করছে না।
সেই মুহূর্তে রোহিনীর ফোনে একটা মেসেজ এল—
Sender: UNKNOWN
Message: “তোমরা সবাই নাম পেয়েছ, এবার ছায়ারা কবিতা লেখবে।”
সুজয় ফিসফিস করে বলল, “এটা কি সত্যিই শেষ? নাকি শুধু ছায়ার এক খণ্ড শেষ হল?”
রোহিনী বলল, “যদি একদিন একটা নতুন ছায়া আবার গান গাইতে শুরু করে, তখন আমরা জানব, নামই সব না—মুখের ভেতরেও ছায়া বাস করে।”
তারা তিনজন ফেরার জন্য গাড়ির দরজায় হাত রাখল।
কিন্তু গাড়ির সাইড-মিররে পড়া প্রতিফলনে দেখা গেল—তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও একটা মুখ।
একটা মুখ, যেটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যার ছায়া নেই।
শেষ ছায়ার নাম
সেই সকালটা নিঃশব্দ। চারদিকের হালকা আলোয় কুয়োডাঙা যেন স্বাভাবিক একটা গ্রাম—পাখির ডাক, তালগাছের পাতা নাড়ানো, কুয়োর পাশে কুয়াশা-মেশানো হাওয়া। কেউ দেখলে বলত, এ তো সাধারণ দিনের শুরু।
কিন্তু গাড়ির সাইড-মিররে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মুখটা—ওইটাই ছিল শেষ প্রশ্নচিহ্ন।
তিনজন চুপ করে তাকিয়ে রইল। সেই মুখে কোনও রাগ নেই, না বিস্ময়। বরং একরকম নিবেদন—যেন বলতে চাইছে, “আমাকে রেখে যেও না।”
রোহিনী ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামল। মুখটা তখনো নড়ছে না। পায়ের নিচে কোনও ছায়া নেই। হাওয়ায় সে ভেসে নেই, মাটিতে সে গেঁথে আছে, তবু কিছু একটা ঠিক নেই। যেন এই মুখ জন্মেছে শুধু চেয়ে থাকার জন্য, চাওয়া নয়, বলা নয়—শুধু রয়ে যাওয়া।
সুজয় এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “তুই কে?”
কোনও উত্তর নেই।
অলোক এগিয়ে এসে ক্যামেরার স্ক্রিন ঘুরিয়ে দেখাল—সেখানে ফ্রেমের মধ্যে ওই মুখ নেই। অথচ বাস্তবে তারা সবাই দেখছে!
“এটা কি নতুন এক ছায়া? না কি…” রোহিনী থেমে গেল।
তখন হঠাৎ সেই মুখটা এগিয়ে এল। ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু তিনজনের কানে শুনতে পেল এক কিশোর কণ্ঠ—
“তোমরা নাম দিলেই আমি যেতে পারি।
কিন্তু যদি ভুল নাম দাও, আমি থেকে যাব—
তোমাদের ভিতরে, ছায়ার ভেতর, স্বপ্নে,
ভুলে যাওয়া দরজার পাশে দাঁড়িয়ে।”
রোহিনী চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল। কিছু মনে করার চেষ্টা করল। এমন একটা মুখ… যাকে সে একবার কোথাও দেখেছিল, কিন্তু স্মৃতির কোথাও সংরক্ষিত ছিল না।
সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল—তিন বছর আগে, সে কুয়োডাঙা অঞ্চলের একটা স্কুলে এসেছিল একটি গ্রামীণ প্রকল্পে, শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে। তখন এক ছেলেকে দেখেছিল, যে সবসময় সবার পিছনে বসত, প্রশ্ন করলে কিছু বলত না, আর নাম বললেই চোখ নামিয়ে ফেলত।
সে নিজে একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিল—“তোর নাম কী রে?”
ছেলেটা ফিসফিস করে বলেছিল, “সবাই তো ভুলে যাবে… রাখো না, একটা নতুন নাম। যে কেউ মনে রাখবে।”
রোহিনী বলেছিল, “তুই আমার কবিতার নাম হবি। ‘রুহান’। ঠিক আছে?”
আজ, এত বছর পর সেই মুখ আবার ফিরে এসেছে—নাম পেতে।
রোহিনী ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে বলল, “তুই রুহান। আমার কবিতার নাম। এখন তুই যেতে পারিস।”
সেই মুখটা হালকা হাসল।
তার পায়ের নিচে এবার প্রথমবারের মতো একটা ছায়া তৈরি হল।
আর তারপর, ধীরে ধীরে, সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল—না বাতাসে, না আলোয়—বরং একরকম শব্দহীন নিশ্চিন্ততায়।
সেই মুহূর্তে গাড়ির সাইড-মিররে আর কোনও মুখ ছিল না।
তারা তিনজন ফিরে এল কলকাতায়।
সেই রাতের পর, তিনজনই আলাদা আলাদা কিছু শুরু করল।
অলোক একটি ছবির সিরিজ আঁকল, যার নাম “ছায়াহীন মুখ”—একটি প্রদর্শনীতে সেটাই সবচেয়ে বেশি দর্শক টেনেছিল।
সুজয় তার চ্যানেলের নাম বদলে দিল—“MUKH: Those We Forgot”। আর কোনও হরর ভিডিও নয়, এবার সে মানুষের স্মৃতিকে গল্পে তুলে আনতে শুরু করল।
রোহিনী লিখে ফেলল একটি কবিতার সংকলন, শিরোনাম—“নাম”।
শেষ পাতায় ছিল এই চারটি পঙক্তি—
“নাম নেই যাদের, মুখ নেই তারা,
তবু তারা চেয়ে থাকে সারাদিন
একবার যদি কেউ ডাকে, ‘এই তুই’—
ছায়ার নিচে জন্মায় তারা, আবার মানুষ হয়।”
তবে গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
একদিন অলোক তার নতুন এক ছবির নিচে এক অচেনা মন্তব্য পেল—
“আপনার আঁকা ছবির ভিতরে আমি নিজেকে চিনতে পারি।
আপনি তো আমাকে কখনও দেখেননি!
তবু কি আমার মুখ কোথাও লেখা আছে?”
— স্বাক্ষরহীন
অলোক তখন শুধু লিখেছিল—
“হয়তো তুমি সেই মুখ, যার ছায়া সবাইকে মনে থাকে,
কিন্তু কেউ কোনোদিন নাম দেয় না।”
শেষ




