তন্ময় পাল
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল বর্ষার ঠিক আগের সময়ে, যখন আকাশ সারাদিন ধরেই ঝিম মেরে থাকে আর বাতাসে একটা ভিজে মাটির গন্ধ হালকা হালকা দোলা দেয়। আমি, শীর্ষ, তখন সদ্য কলেজে উঠেছি। আমার বাবা একজন পুরাতত্ত্ববিদ, মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের হাড়গোড় জোগাড় করাই তার কাজ। সেবার বাবার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আমরা গেলাম নদিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, নাম—চৌবাগান। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা ভাঙাচোরা খাজাঞ্চিঘর, যেখানে ব্রিটিশ আমলে নাকি রাজবাড়ির সম্পদ রক্ষিত থাকত। সেই ঘরটা নিয়েই যত রহস্য।
আমরা যে বাড়িটায় উঠলাম, সেটা ছিল একটা পুরোনো বনেদি দোতলা, লাল ইটের দেয়াল, আর জংধরা লোহার দরজা। ঘরের চারদিকে ঘন অশ্বত্থ আর পাকুড় গাছ, আর সেই গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায় পুরোনো খাজাঞ্চিঘরের ধূসর মাথা। শুনেছি অনেকদিন আগে সেই খাজাঞ্চিঘর থেকে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গিয়েছিল এক খাজাঞ্চি—ভোলা গাঙ্গুলি। তার সাথে হারিয়ে যায় একটি ধাতব সিন্দুক, যার ভিতরে কী ছিল, কেউ জানে না। কেউ বলে রত্ন, কেউ বলে নথিপত্র, কেউবা বলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধ গোপন দলিল।
বাবা তখন দিনরাত খাজাঞ্চিঘরের পুরোনো মানচিত্র, নথি আর গোপন সুড়ঙ্গ নিয়ে মেতে আছেন। আমি প্রথমে ভাবছিলাম গ্রামের বাড়িতে শুধু নির্জনতা আর কুয়াশা পাব, কিন্তু এখানকার পরিবেশেই যেন একটা অদ্ভুত টান ছিল। বিশেষ করে খাজাঞ্চিঘরটা—যেন ঘর নয়, একটা ঘুমন্ত শরীর, যার নিঃশ্বাস এখনো টের পাওয়া যায়।
একদিন বিকেলে বাবার অনুপস্থিতিতে আমি আর গ্রামেরই আমার সমবয়সী বন্ধু অর্ঘ্য মিলে ঢুকে পড়লাম খাজাঞ্চিঘরের ভেতরে। বাইরে থেকে সিঁদুরে লাল দেয়াল, কিন্তু ভেতরে একেবারে অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। আমরা টর্চ নিয়ে হাঁটছিলাম আর একের পর এক ঘর পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা দেয়ালে খেয়াল পড়ল—একটা অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা, দেখতে অনেকটা অক্ষরের মতো, কিন্তু ঠিক চেনা যায় না। নিচে ইংরেজিতে লেখা, “Where the gold breathes, the silence ends।” আমি হতভম্ব।
অর্ঘ্য বলল, “শীর্ষ, এইটা তো কবিতার মতো শুনতে, কিন্তু এর মানে কী?”
আমি বললাম, “হয়তো এটা কোনো সংকেত। গোল্ড ব্রিদস মানে? হয়তো সেই হারানো সিন্দুক?”
আমরা ঘর ঘুরে এক কোণে একটা কাঠের সিঁড়ি খুঁজে পেলাম, যা নিচে নামছে। এক ধরনের ঘন গন্ধ নাকে এসে লাগছিল—পুরোনো ধুলো, পচা কাঠ, আর যেন অনেকদিনের জমে থাকা কিছু! আমরা নিচে নামতে শুরু করলাম, কিন্তু ঠিক তখনই টর্চটা নিভে গেল। পুরো ঘরে শুধুই অন্ধকার আর আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দ।
অর্ঘ্য ফিসফিস করে বলল, “শীর্ষ, চল ফিরে যাই, এইখানে কিছু ঠিকঠাক লাগছে না।”
কিন্তু আমি থামিনি। সামনেই একটা দেয়াল, আর দেয়ালের গায়ে স্পষ্ট আঁকা একটি প্রতীক—একটি সূর্য আর তার ভিতরে একটা তালা। এই চিহ্নটা আমি আগেও বাবার মানচিত্রে দেখেছি। মানে, আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আমি দেওয়ালটা একটু ছুঁয়ে দেখলাম, আর সেই মুহূর্তেই দেয়ালের একটা অংশ কাঁপতে লাগল, যেন সে নিজে থেকেই খুলে যাবে।
তারপর… দেওয়ালের ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এলো, আর আমাদের চোখের সামনে খুলে গেল এক গোপন কুঠুরি। কিন্তু ঠিক তখনই আমার গায়ে যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠল—একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। যেন বহু বছর ধরে কেউ আটকে আছে…
আমি আর অর্ঘ্য দাঁড়িয়ে আছি সেই গোপন কুঠুরির মুখে—যেখানে বাতাসে ভেসে আসছে এক চাপা কান্নার ধ্বনি। ঠান্ডা হাওয়া যেন আমাদের শরীরের রন্ধ্রে ঢুকে গেল। আমার হাতের টর্চ আবার কাজ করা শুরু করল, ফ্লিকারের মতো জ্বলে উঠল একবার, তারপর জ্বলে থাকল। আমি আলো ফেলে কুঠুরির ভেতরে তাকালাম—ভেতরটা ছিল ছোট, কিন্তু গোটা ঘরজুড়ে যেন সময় থেমে আছে। মেঝেতে ধুলো জমে আছে, দেয়ালের গায়ে পুরোনো ধাতব হুক, আর এক কোণে বাঁধানো পাথরের বেদি।
বেদিটার উপর একটা কিছুর চিহ্ন—চোখের মতো, চারপাশে সূক্ষ্ম রেখা, যেন কেউ একে একে সেগুলো খোদাই করেছে। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম, বেদির পাশেই একটা ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটলি পড়ে আছে, আর তার ভেতর এক গুটানো কাগজ। কাগজ খুলতেই দেখি আঁকা আছে এক প্রাচীন নকশা—সেই চিহ্নটা আবার এসেছে, সূর্যের মাঝে তালা, আর তার চারপাশে আটটা দিকচিহ্ন, প্রতিটাতে কিছু না কিছু লেখা।
আমি বললাম, “অর্ঘ্য, দেখ তো এটা কী লেখা—দেখো এই জায়গায় লেখা আছে, ‘উত্তর-পূর্ব কোণে বাঁধানো ইট, নীচে প্রথম চাবি।’”
অর্ঘ্য অবাক হয়ে বলল, “তাহলে এইটা তো একটা ক্লু! মানে, এই ঘরেই লুকানো আছে চাবি, যেটা হয়তো ওই রহস্যময় তালার!”
আমরা মাটি খুঁড়তে লাগলাম। খোঁড়াখুঁড়ির পর ধুলো মুছে একটা ইট টেনে বের করতেই শব্দ হল—‘টুক!’ আর তার নিচে ছোট্ট একটা তামার ডিব্বে, যার ভিতরে একটা পুরোনো পিতলের চাবি। চাবিটার মাথায় সূর্যের মতো খোদাই। আমি সেটাকে হাতে নিয়ে অনুভব করলাম—এটা শুধুই চাবি নয়, এর পিছনে আছে ইতিহাস।
কিন্তু এই সময়েই হঠাৎ কুঠুরির বাইরে থেকে কড়া শব্দ—কেউ যেন দরজা ঠেলে খুলতে চাইছে। আমি অর্ঘ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম—সেও ভয় পেয়েছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। আমরা দ্রুত আলো নিভিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম।
কয়েক মুহূর্ত পরে একটা কর্কশ গলা শোনা গেল, “দরজাটা খোলা কে রেখেছিল?”
আলো জ্বলে উঠল বাইরে, আর ধাতব বুটের আওয়াজ মেঝেতে বাজতে থাকল। কেউ একজন ঢুকছে ঘরের ভেতর।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎই একজন মানুষ কুঠুরির মুখে এসে দাঁড়াল—হাতে টর্চ, চোখে সন্দেহের ঝলক, আর কাঁধে ব্যাগ। আমি চিনতে পারলাম—সে হল দীনেশ কাকা, আমাদের গৃহকর্মী, যে এই গ্রামে জন্মেছে আর বহু বছর ধরে জমিদারবাড়ির লোকজনের সঙ্গে থেকেছে।
কিন্তু তার চোখে আজ যে দৃষ্টি, সেটা ছিল অজানা ভয় আর… লোভে পরিপূর্ণ।
সে নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল, “তোরা ভেতরে আছিস জানি… কিন্তু এটা আমার বহু বছরের অপেক্ষার ফল। ওই চাবি… ওই বেদি… সব আমার প্রাপ্য।”
আমি আর অর্ঘ্য আর লুকিয়ে থাকলাম না। বেরিয়ে এলাম অন্ধকার থেকে, হাতে চাবি।
আমি বললাম, “আপনি কী বলছেন, দীনেশ কাকা? আপনি জানেন এইসব ব্যাপারে?”
সে হাসল—ঠান্ডা, রুক্ষ হাসি।
“তোমার বাবা জানেন না, এই বাড়ির খাজাঞ্চি ভোলা গাঙ্গুলি আমার ঠাকুরদা ছিলেন। উনি শেষ দিনগুলোয় আমার ঠাকুরমাকে একটা গোপন কথা বলেছিলেন। সেই কথা, সেই মানচিত্র, সব আমার কাছে আছে। কিন্তু আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না এখানে ঢোকার, এই বেদি খোঁজার, এই চাবি খোলার। তোদের সাহায্যেই এখন আমি পারব।”
আমি বুঝলাম, দীনেশ কাকা সত্যিই জানে অনেক কিছু। কিন্তু তার চোখে এমন এক অস্থিরতা ছিল—যা একটা মানুষকে নিজের অতীত হারিয়ে লোভের জালে আটকে দেয়।
আমি শান্ত গলায় বললাম, “এই চাবি আপনি পেতে পারেন, কিন্তু এই রহস্য শুধু চাবি আর সিন্দুক নয়—এর পেছনে আরও অনেককিছু আছে। হয়তো এমন কিছু, যা প্রকাশ পেলেই গোটা ইতিহাস কেঁপে উঠবে।”
সে চুপ করে রইল। তারপর একটা সাদা খামে কিছু কাগজ আমাদের দিকে এগিয়ে দিল।
“এই নাও, ভোলা গাঙ্গুলির হাতে লেখা শেষ চিঠি—সেখানে আছে শেষ চাবির আসল অবস্থান।”
আমি কাগজগুলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলাম, আর সেখানে লেখা ছিল—
“যে রত্ন কখনো দেখা যায় না, সে-ই আসল রত্ন। খোঁজো, যেখানে সাত জলরাশি মাটির নিচে মিলেছে।”
অর্ঘ্য ফিসফিস করে বলল, “মানে কি, মাটির নিচে সাতটা কুয়া? নাকি নদীর মিলনস্থল?”
আমি বললাম, “হয়তো এই গ্রামের নিচেই লুকিয়ে আছে সেই শেষ রাস্তা… খাজাঞ্চিঘরের অন্তর্ধানের রহস্য।”
আমরা দীনেশ কাকার দেওয়া চিঠিটার দিকে আবার তাকালাম। “যে রত্ন কখনো দেখা যায় না, সে-ই আসল রত্ন”—এই লাইনটা মাথায় ঘুরছিল বারবার। আর ‘সাত জলরাশি মাটির নিচে মিলেছে’—এটা কি কোন প্রকৃত জায়গার কথা, নাকি একটা প্রতীক?
দীনেশ কাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই কথাটা তোমার বাবাও জানে না। আমি অনেক বছর ধরে খুঁজেছি এই ছড়ার মানে, কিন্তু কোনোদিন স্পষ্ট পাইনি। তবে আমার ধারণা, এই খাজাঞ্চিঘরের নিচেই একটা গোপন জলাধার বা প্রাচীন কুয়া আছে, যেখানে জমিদারদের সম্পদ লুকিয়ে রাখা হতো।”
আমি বললাম, “আপনি কি জানেন কুয়াটা কোথায় হতে পারে?”
সে মাথা নাড়ল। “পুরো জমিদারবাড়ির নকশা বদলে গেছে। পুরোনো নকশা একটাই ছিল, সেটাও বহুদিন আগেই ছিঁড়ে গেছে। তবে খাজাঞ্চিঘরের পেছনের যে ছোট্ট বাগানটা, সেখানেই একটা সময় একটা শুকনো পুকুর ছিল—লোকেরা বলে, সেটা আসলে কুয়ো।”
আমরা পরদিন সকালেই সেখানে গেলাম। সূর্যের আলো তখন বাগানের শুকনো ঘাসে ঝিকমিক করছে, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা খাজাঞ্চিঘর যেন সেই আলোতেও কেমন গা-ছমছমে। পুরোনো পুকুরটা এখন প্রায় মাটি দিয়ে ঢেকে গেছে, মাঝখানে একজায়গায় কিছু ইট উঁচু হয়ে আছে।
অর্ঘ্য বলল, “ওই জায়গাটায় যদি কিছু থাকে, তাহলে মাটি সরালেই বোঝা যাবে।”
আমরা তিনজন মিলে মাটি খোঁড়া শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা ধাতব আওয়াজ—‘টাং!’ আমি খুঁড়ে তোলার চেষ্টা করলাম—একটা লোহার ঢাকা পাওয়া গেল, গোল, মাঝখানে একটা ছোট্ট ছিদ্র, ঠিক যেন চাবি ঢোকানোর মতো।
আমার মনে পড়ে গেল সেই পিতলের চাবির কথা। আমি ব্যাগ থেকে সেটা বের করলাম, আর সেই ছিদ্রে চাবি বসালাম। একটা খচখচ শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে ঢাকনাটা খুলে গেল। নিচে নামার মতো সিঁড়ি, অন্ধকারের দিকে নেমে গেছে। বাতাস ভারী, ভিতর থেকে ঠান্ডা একটা ঘ্রাণ।
দীনেশ কাকা বলল, “এই পথেই হয়তো গিয়েছিলেন ভোলা গাঙ্গুলি। আর ফেরেননি।”
আমরা টর্চ নিয়ে নামতে শুরু করলাম নিচের দিকে। সিঁড়িগুলো সরু, ভেজা, আর দেওয়ালে গলানো মোমের দাগ। নিচে নামতেই একটা গন্ধ পাওয়া গেল—পুরোনো কাঠ, ঘাম আর কিছু পোড়া তেলের গন্ধ। মনে হচ্ছিল কেউ এখানে বছর বছর ধরে ঢুকেইনি।
নিচে পৌঁছেই আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম হতবাক হয়ে। এটা কোনো সাধারণ কুঠুরি নয়, যেন একটা গোপন ভাণ্ডার। চারদিকে পাথরের স্তম্ভ, আর মাঝখানে একটি বিশাল পাথরের সিন্দুক, যেটার গায়ে খোদাই করা—“এখানেই থেমে যায় লোভ, শুরু হয় উত্তরাধিকার।”
অর্ঘ্য ফিসফিস করে বলল, “এটা খুললে কী বেরোবে?”
দীনেশ কাকা কাঁপা গলায় বলল, “আমি শুধু ঠাকুরদার বলা কথা মনে রেখেছি—সিন্দুক খুলবে রক্তের উত্তরাধিকার, যিনি জানেন কোনটা আসল ধন, আর কোনটা ছল।”
আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না—এই সিন্দুকের ভেতর কী থাকতে পারে? রত্ন? দলিল? নাকি আরও কিছু ভয়ানক?
আমি সামনে গিয়ে সিন্দুকের ঢাকনা স্পর্শ করলাম। সেই মুহূর্তে পুরো ঘরটা যেন থেমে গেল। হাওয়া নিস্তব্ধ, বাতি নিভে আসছে, কেবল একটা শব্দ কানে বাজছিল—টিক-টিক-টিক—ঠিক যেন সময় গুনে চলেছে।
আমি ঢাকনা তুলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই দেওয়ালের একটা কোণ থেকে হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু সে বলল—
“যদি মিথ্যা হাতে চাবি ধরা থাকে, তবে সত্য গিলে ফেলবে তাকে। ফিরে যাও, রক্ত না পড়া অবধি।”
আমরা পেছনে হটলাম। দীনেশ কাকা থরথর করে কাঁপছে, বলল, “এটা ভোলা গাঙ্গুলির আত্মা… আমার ঠাকুরদা… তিনি আসলে সব জানতেন।”
আমি ফিসফিস করে বললাম, “আমাদের পথ এখন একটাই—সত্যি জানা। পেছাতে পারব না।”
আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই ছায়ামূর্তির সামনে—যার চোখ নেই, মুখ নেই, কিন্তু উপস্থিতি যেন গোটা কুঠুরির বাতাসকে জমিয়ে তুলেছে। তার কণ্ঠস্বর ঘন আর ভারী—কিছু একটা জানানোর জন্য নয়, বরং কিছু একটা গোপন রাখতে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা কোনো সাধারণ অতৃপ্ত আত্মা নয়, বরং একটা সতর্কবার্তা, যা এই গুপ্ত ঘর আর তার রক্ষাকারীর মতো দাঁড়িয়ে আছে বহু বছর ধরে।
ছায়ামূর্তিটি কিছু না বলে সোজা এগিয়ে এল আমার দিকে। আমি থরথর করলেও পিছু হটলাম না। আমার হাতে চাবি, সামনে সেই পাথরের সিন্দুক, আর আমার পেছনে দীনেশ কাকা ও অর্ঘ্য। হঠাৎ করেই বাতাসে এক ঝাঁঝালো ধোঁয়ার গন্ধ—ছায়ামূর্তিটি হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে গায়ে হাত বুলিয়ে দিল আমার—ঠান্ডা, হাড়কাঁপানো এক স্পর্শ। ঠিক তখনই সিন্দুকের ওপরে খোদাই করা লাইনটা আলোকিত হয়ে উঠল, যেন আগুনে লেখা হচ্ছে নতুন করে—
“শুদ্ধ হৃদয়ে খুলবে সিন্দুক, না হলে নিঃশ্বাস রবে না।”
আমি দম বন্ধ করে টের পেলাম, আমাদের সামনে খোলা এই রহস্যের দরজা কতটা বিপজ্জনক।
আমি সাহস সঞ্চয় করে চাবিটা সিন্দুকের পাশে থাকা ছোট্ট ছিদ্রে ঢুকিয়ে ঘোরালাম। একটা গুমগুম শব্দ হল। পাথরের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে উপরে উঠল। ভিতরে থাকা জিনিস দেখে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম।
না, সেখানে সোনা নেই, রত্ন নেই, নেই কোনো রাজকীয় চিহ্ন। বরং ছিল শতবর্ষ পুরোনো কাগজের বান্ডিল—সব নথিপত্র।
অর্ঘ্য চিৎকার করে উঠল, “এই তো, কিছু না! ফাঁকা কাগজ!”
কিন্তু আমি বুঝলাম, এই নথিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে ছিল জমিদারির সমস্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব, প্রজাদের নাম, জমির মাপজোক, এবং সবচেয়ে অদ্ভুতভাবে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় রাজাদের সঙ্গে যোগাযোগের গোপন চিঠিপত্র।
একটা চিঠির হেডিং ছিল—“অঙ্গীকারনামা”।
চিঠির ভিতর লেখা—
“যদি ব্রিটিশদের হাতে পড়ে এই সিন্দুক, তবে সব তথ্য নষ্ট হবে। কিন্তু যদি কোনো উত্তরসূরি এসে সত্য ও শুদ্ধতার সঙ্গে একে খুলে, তবে বাংলার ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।”
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, “এই সিন্দুক কোনো সম্পদের নয়, এটা ইতিহাসের গোপন ভাণ্ডার। যা প্রকাশ হলে প্রমাণ হবে—জমিদাররা কেবল শোষক ছিলেন না, অনেকেই ছিলেন সংগ্রামী।”
দীনেশ কাকা থমকে দাঁড়াল। তার চোখে জল, ঠাকুরদার কথা মনে করে বলল, “ভোলা গাঙ্গুলি নিজে ইচ্ছা করেই হারিয়ে গেছিলেন এই কাগজগুলো রক্ষা করতে। আমি তাকে বিশ্বাস করিনি এত বছর…”
ঠিক তখনই কুঠুরির এক কোণে একটা শব্দ—‘খচ!’—আমরা ঘুরে তাকালাম। অন্ধকার থেকে আবার সেই ছায়ামূর্তি উদিত হল। কিন্তু এবার তার হাতে কিছু নেই, চোখে বিদ্বেষ নেই। বরং সে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
তার ঠান্ডা কণ্ঠে সে বলল,
“তোমরা উত্তীর্ণ। এবার সত্য ইতিহাস জেগে উঠবে।”
আস্তে আস্তে সেই ছায়া মিশে গেল বাতাসে, আর পুরো কুঠুরিতে এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল।
আমরা বুঝতে পারলাম, এই রহস্যের বড় একটা অংশ আমরা উন্মোচন করেছি। কিন্তু এখনও অনেক কিছু অজানা—কে ছিল এই ছায়া? কতদূর ছড়িয়েছে এই নথিপত্রের যোগাযোগ? আর এই ইতিহাস প্রকাশ করলে কী হবে?
আমি চুপ করে বললাম, “শুরুটা হলো। এবার খোঁজ আমাদের ইতিহাসের আদলে।”
আমরা সেই পাথরের কুঠুরির মাঝখানে বসে আছি—চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শতবর্ষ পুরোনো কাগজপত্র, ধুলো-মাখা ইতিহাসের দলিল। বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার পা ফেলছে গ্রামে, আর নিচে এই গোপন কুঠুরির বাতাস ভারী হয়ে উঠছে এক নতুন বোঝাপড়ার ওজনে। আমি আর অর্ঘ্য চুপ করে বসে পড়ছি পাতাগুলো, দীনেশ কাকা আমাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখ মুছছেন।
প্রত্যেকটি কাগজ যেন এক-একটা জীবন্ত সাক্ষী—ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক জমিদারের নীরব বিদ্রোহের, সাধারণ প্রজাদের প্রতি তার অঙ্গীকারের, এবং একজন খাজাঞ্চির আত্মত্যাগের। আমরা বুঝতে পারছিলাম, ভোলা গাঙ্গুলির অন্তর্ধান কোনও দুর্ঘটনা ছিল না—তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক আত্মগোপন, এই ইতিহাস রক্ষা করতেই তিনি অদৃশ্য হয়েছিলেন।
আমি একখানা ছেঁড়া চিঠি খুললাম—তারিখ লেখা ১৮৫৮ সালের মার্চ, ঠিক সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী সময়কাল। সেখানে লেখা আছে:
“আমার সম্পত্তি নয়, আমার চেতনা থাকুক আমার উত্তরপুরুষের হাতে। এই দলিলগুলি কেউ যদি খোঁজে, তবে সে যেন বুঝে—আসল রত্ন কাগজে, চরিত্রে, আর শপথে।”
অর্ঘ্য আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই নথিগুলো যদি প্রকাশ করা হয়, তাহলে তো অনেক কিছুর মোড় ঘুরে যাবে।”
আমি বললাম, “তাই তো ভয়। এতদিন যা ইতিহাস বইয়ে লেখা হয়নি, এখন তা সত্যি হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সত্য সবাই গ্রহণ করবে তো?”
আমরা যখন উঠে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, ঠিক তখনই দীনেশ কাকা একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, “এই বাক্সটা ভোলা গাঙ্গুলির ব্যক্তিগত জিনিস ছিল। আমার ঠাকুরমা বলে গেছিলেন, কখনো যদি তার পদচিহ্ন কেউ খুঁজে পায়, তখন এই বাক্স তাকে দিতে।”
আমি বাক্সটা খুলতেই দেখি—ভেতরে একটা ছোট্ট রুপার চেইনে বাঁধানো রুদ্রাক্ষের মালা, একটি পুরোনো পকেট ঘড়ি, আর একটা ছোট ডায়েরি। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—
“যদি হারিয়ে যাই, আমি থেকে যাবো আমার শব্দে।”
আমি একে একে পাতাগুলো উল্টাতে লাগলাম। ডায়েরির ভাষা অদ্ভুতভাবে আধুনিক, যেন ইতিহাসের মানুষ নয়, একজন কবি কথা বলছেন। কিন্তু ঠিক তখনই আমি থমকে গেলাম—একটা পাতায় আঁকা একটি অদ্ভুত নকশা—খাজাঞ্চিঘরের নিচ থেকে আরও নিচে আরেকটি গোপন স্তর দেখানো হয়েছে, যেখানে লেখা—“মূল ভাণ্ডার এখানেই, যেখানে জল স্পর্শ করে মৃত স্মৃতিকে।”
আমি চমকে বললাম, “এটা তো মানে দাঁড়ায়—আমরা যা পেয়েছি, সেটাও শেষ নয়! এই কুঠুরির নিচে আরও কিছু আছে!”
অর্ঘ্য চোখ কপালে তুলে বলল, “মানে… আরেকটা স্তর? আর নিচে?”
দীনেশ কাকা গম্ভীর গলায় বললেন, “আমার ঠাকুরদাও এই কথাই বলতেন। তিনি বলতেন, খাজাঞ্চিঘরের নিচে মৃতদের একটা সিঁড়ি আছে, যা কেবল হৃদয়ের আলোয় দেখা যায়।”
আমি বললাম, “চলো, আর দেরি নয়। এখনই খোঁজ শুরু করি। যদি সত্যি আরও কিছু থাকে, তাহলে আজকের রাতেই সেই রহস্য আমরা উন্মোচন করব।”
আমরা আবার কুঠুরির মেঝেতে চোখ বুলালাম। ঠিক পাথরের সিন্দুকের নিচে কিছুটা গেঁথে থাকা মাটি ছিল, মাঝখানে এক ঢাকনা-সদৃশ রেখা। আমরা ধুলো সরাতে সরাতে বের করলাম এক গোল ছাঁদের ঢাকনা। আমি হাত দিয়ে ধাক্কা দিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে খচ শব্দে খুলে গেল নিচের দরজা—নিচে একটা সরু কুয়োর মতো পথ, আর বাতাসে ভেসে এলো কাদার গন্ধ, মেশানো সোঁদা পুরোনো জলের ঘ্রাণ।
আমি তাকিয়ে বললাম, “এটাই সেই ‘জলরাশি’র মিলনস্থল। খাজাঞ্চিঘরের অন্তর্ধানের আরও গভীর স্তর।”
অর্ঘ্য বলল, “নামবে তো?”
আমি হেসে বললাম, “না নামলে গল্পটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
আমরা তিনজন আবার নামতে শুরু করলাম অন্ধকারের দিকে, অতীতের স্তরে স্তরে, যেখানে সময় লুকিয়ে রেখেছে আরও কিছু অকথিত ইতিহাস…
নিচের সরু সিঁড়ি ধরে আমরা নামতে নামতে যেন সময়ের গর্ভে প্রবেশ করছিলাম। ঘরের উষ্ণ বাতাসকে ছাপিয়ে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘাম ঠান্ডা হয়ে আসছিল, আর কাদার ঘ্রাণ ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিল। দেওয়ালগুলো ভেজা, জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে গেছে। আমাদের টর্চের আলোয় তেমন কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কেবল ইটের ফাঁকে গড়িয়ে পড়ছিল জলের ছাঁট, আর দেওয়ালে মাঝে মাঝে খোদাই করা রহস্যময় চিহ্ন—সূর্য, অর্ধচন্দ্র, তালা, চোখ।
নিচে নেমে আমরা দাঁড়ালাম একটা অদ্ভুত স্থানে। মনে হল যেন কোনও ভূগর্ভস্থ মন্দির বা গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। চারদিকে পাথরের স্তম্ভ, আর মাঝখানে একটা বেদির মতো উঁচু জায়গা, যা ঘিরে আছে আটটি খাঁজ কাটা গহ্বর। সেই গহ্বরগুলোর নিচে জল জমে আছে—চুঁইয়ে পড়া নিকোনো জল, যা সব গহ্বরকে একযোগে যুক্ত করেছে।
বেদির সামনে একটা ফলক। তার উপর লেখা:
“অগ্নি বলে দেহ, জল বলে আত্মা। যদি দু’য়ে মিল হয়, তবে ইতিহাস হবে উন্মোচিত।”
অর্ঘ্য হতবাক হয়ে বলল, “এটা তো যেন কোনো রিচুয়াল বা পুরোনো আচার। কিন্তু আমাদের করণীয় কী?”
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, প্রতিটি খাঁজের সামনে রয়েছে ছোট্ট একটা গর্ত, যেন সেখানে কিছু বসানোর জন্য বানানো হয়েছে। হঠাৎ আমার চোখ গেল বেদির পাশে রাখা একটা পাথরের বাক্সের দিকে। আমি খোলার চেষ্টা করতেই দেখতে পেলাম ভিতরে আটটা ছোট পিতলের প্রদীপ।
আমি বললাম, “এগুলোই হয়তো বসাতে হবে খাঁজে। আগুন আর জল একসাথে। হয়তো এটাই ‘দেহ-আত্মা’র মিলনের প্রতীক।”
দীনেশ কাকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোখে ভয়, সন্দেহ, আর এক ধরনের আত্মপ্রত্যয়। তিনি এগিয়ে এসে নিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট দেশলাই বার করে দিলেন। “জানি না এটা কাজ করবে কিনা, কিন্তু চেষ্টা করা যাক।”
আমরা একে একে প্রদীপগুলো বসালাম গহ্বরগুলোর সামনে। মোম আর সর্ষের তেলে ভরা প্রদীপগুলো জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে এক আশ্চর্য আলো জ্বলে উঠল—গভীর, সোনালি, কিন্তু যেন জীবন্ত।
জল আর আগুন পাশাপাশি জ্বলতে শুরু করল। সেই আলোয় গোটা ঘর যেন কেঁপে উঠল। বেদির গায়ে খোদাই নিজে থেকেই জ্বলে উঠল—প্রাচীন ভাষায় লেখা কিছু, যা টের পাওয়া যাচ্ছিল চোখে না পড়লেও হৃদয়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘরের ঠিক মাঝখানে মাটি ফেটে খুলে গেল একটা গোল ছাঁদের দরজা, তার নিচে গহ্বর। ধোঁয়া উঠছে, আর তার মধ্যে ভেসে এল একটাই শব্দ—“নির্বাচিত”।
আমি বিস্ময়ে বললাম, “মানে? কে নির্বাচিত?”
একটা কাঁপা গলায় উত্তর এল দীনেশ কাকার মুখ থেকে—“তুই, শীর্ষ। তোর হাতেই এই ইতিহাসের মানচিত্র যাবে। এটা শুধু পিতৃঋণ নয়, এটা সময়ের ঋণ।”
আমি থমকে গেলাম।
“কিন্তু আপনি তো নিজেই ভোলা গাঙ্গুলির উত্তরসূরি, আপনি কেন বলছেন এটা আমার দায়িত্ব?”
দীনেশ কাকা শান্তভাবে বললেন, “আমার ঠাকুরদার হাতে লেখা এক চিঠিতে আছে, ‘আমি যে ইতিহাস রক্ষা করছি, সেটা শুধু রক্তের কথা নয়, সেটা চেতনার কথা। আমার উত্তরপুরুষ যদি তা বুঝতে পারে না, তবে সত্য নিজেই নির্বাচিত পথ খুঁজে নেবে।’ আমি এত বছর ধরে শুধু খোঁজ করেছি, কিন্তু তুমি খুঁজে পেয়েছো। তোমার চোখে লোভ নেই, শুধু জানার তৃষ্ণা। তুমি-ই নির্বাচিত।”
ঘরের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল, আর গহ্বর থেকে উঠে আসছিল এক কুয়াশা, তার মধ্যে একটি ধাতব বাক্স ভেসে উঠল যেন। আমি হাতে তুলে নিলাম সেই বাক্স। ভিতরে ছিল চামড়ায় মোড়া একটি পুঁথি। নাম—“খাজাঞ্চিঘরের অন্তর্বৃত্ত ইতিহাস”।
আমি সেই মুহূর্তে বুঝে গেলাম, এই গল্পের শেষ এখনও হয়নি—বরং শুরু হয়েছে এক নতুন পর্ব। এই ইতিহাস কেবল জমিদারদের নয়, কেবল দীনেশ কাকার উত্তরাধিকার নয়, এ হলো সেই অদেখা ইতিহাস—যা আজও আমাদের ঘিরে রেখেছে, নিরবে, গভীরে।
আমি হাতে ধরে আছি সেই ধাতব বাক্স থেকে ওঠে আসা পুঁথিখানা—চামড়ায় মোড়ানো, ধূলিধূসরিত, আর গায়ে স্পষ্ট লেখা “খাজাঞ্চিঘরের অন্তর্বৃত্ত ইতিহাস”। তার পাতাগুলো নাড়াতে নাড়াতেই বুঝতে পারলাম, এটা কেবল ইতিহাস নয়—এ এক অদ্ভুত সময়রেখা, যেখানে ধাপে ধাপে লেখা আছে জমিদারির উত্থান, পতন, আর প্রতিরোধের কাহিনি।
প্রথম পৃষ্ঠায় একটি চার লাইন লেখা—
“যে পড়ে চোখে, সে বুঝবে না মনে,
যে পড়ে হৃদয়ে, সে চিনবে স্মরণে।
এ শুধু লেখা নয়, এই যে গোপন গান,
যারা হারায়, তারাই তো পায় আসল মান।”
আমি সেই লেখার গভীরতায় ডুবে যাচ্ছিলাম, যখন অর্ঘ্য হঠাৎ বলে উঠল, “তুই এটা নিয়ে কি করবি এখন? এত বড়ো ইতিহাস… বাইরে গেলে তো লোকজন বিশ্বাসই করবে না।”
আমি চুপ করে ছিলাম। দীনেশ কাকা বললেন, “তোর বাবাকে জানাতে হবে। ও অনেক দিন ধরেই এই ইতিহাসের সন্ধানে ছিল। কিন্তু এখন যা পেয়েছিস, তা কেবল তার জন্যই নয়—সমস্ত বাংলা, সমস্ত ভবিষ্যতের জন্য।”
আমরা তিনজন আবার সেই কুয়োর মতো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। সেই ভূগর্ভস্থ স্তর পেছনে রেখে আমরা যখন খাজাঞ্চিঘরের মূল কুঠুরিতে ফিরলাম, তখন ঘড়িতে রাত একটা বেজে গেছে। বাইরের বাতাস থেমে আছে, যেন প্রকৃতিও শুনছিল সেই পুঁথির গল্প।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পরদিন সকালে বাবার কাছে সব খুলে বলা হবে। দীনেশ কাকা বললেন, “সাবধানে বলতে, কারণ এই সত্য বড়। বড়ো সত্য নিয়ে কথা বলার আগে মানুষের হৃদয়কে প্রস্তুত করতে হয়।”
সকালবেলায় যখন বাবা খাজাঞ্চিঘরের মানচিত্রে চোখ গুঁজে বসে ছিলেন, আমি সামনে গিয়ে পুঁথিটা রাখলাম। তিনি প্রথমে অবাক হয়ে তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করলেন। চোখে একটা বিশ্বাস ও বিস্ময়ের মিশেল ফুটে উঠল।
“তোমরা এটা কোথা থেকে পেলে?”
আমি বিস্তারিত বললাম—গোপন কুঠুরি, ছায়ামূর্তি, প্রদীপের আলো, আর সেই ভূগর্ভস্থ স্তরের গল্প। বাবা শুনে কেবল মাথা নেড়ে বললেন, “এইটা যদি সত্যি হয়—and I believe it is—তাহলে আমাদের সামনে দুটো রাস্তা। এক, এটা নিজের কাছে রেখে দিই, নিঃশব্দে। দুই, এই সত্যকে সামনে আনি, ইতিহাসকে তার নতুন মুখ দেখাই।”
আমি বললাম, “তবে তো বিপদও আছে, বাবা। কেউ কেউ মানতে চাইবে না, কেউ বলবে মিথ্যে, কেউ আবার এই সত্যকে থামিয়ে দিতে চাইবে।”
বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সত্য কখনো সহজ নয়। কিন্তু তুই যখন খুঁজে পেয়েছিস, তখন তার ভারও তোর উপরেই পড়ে। আর এই ভার বহন করার মতো শক্তি তোর আছে—আমি জানি।”
আমরা ঠিক করলাম, প্রথমেই একটি গবেষণা রিপোর্ট বানানো হবে, প্রমাণসহ। তারপর যোগাযোগ করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সমস্ত কিছু দলিল ও নথিসহ জনসমক্ষে আনা হবে।
কিন্তু তার আগেই… ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা।
সন্ধ্যাবেলায় আমাদের খাজাঞ্চিঘরের সামনের ফাঁকা জমিতে কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন দৌড়ে আসে, ফায়ার ব্রিগেড ডাকা হয়। কিন্তু সবার চোখের আড়ালে, কেউ একজন আমাদের থাকার ঘরের দরজা চুপিসারে খুলে ঢুকে পড়ে।
আমি আর অর্ঘ্য ফিরে এসে দেখি—ঘর তছনছ, বই উল্টানো, পুঁথির কভার ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে, আর জানালার গ্লাস ভাঙা।
দীনেশ কাকা বললেন, “তারা এসেছে। যারা চায় না এই সত্য বেরিয়ে আসুক। সেই লোকেরা বহু বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল, এখন জেগে উঠেছে।”
আমি পুঁথিটা শক্ত করে বুকের কাছে টেনে বললাম, “তাহলে এবার সময়—লড়াইয়ের, ইতিহাসকে রক্ষার, ইতিহাসকে জীবিত করার।”
রাত্রি নেমে আসতেই আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের প্রতি নজর রাখছে কেউ অদৃশ্য কেউ। ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ছিল রহস্যময় কিছু—একটা চাপা ভয়ের সুর, যেন অতীতের গোপন দস্যুরা আবার ফিরে এসেছে।
আমাদের ঘর-দোর তছনছ করে যাওয়ার পরও, পুঁথিটা যেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম, তা সুরক্ষিত রাখতে অশ্রান্ত চেষ্টা শুরু হল। অর্ঘ্য ও আমি রাত জেগে পাহারা দিতাম, কিন্তু দীনেশ কাকার চোখে ছিল অন্য এক অশান্তি—তার অতীত, তার বংশের গোপন কথা যেন ওড়নার নিচে চেপে চেপে দাড়িয়ে আছে।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আর দেরি না করে এই ইতিহাস প্রকাশ করা উচিত, কারণ সত্যকে চুপ করানো যায় না।
পরদিন সকালে আমরা খবর দিলাম স্থানীয় সংবাদপত্রকে। বাবার সাথে যোগাযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষকদের আসার ব্যবস্থা করলাম।
তবে এরই মধ্যে গ্রামের নানা জায়গায় শোনা যাচ্ছিল নানা কথা—“অন্তর্ধান খাজাঞ্চিঘরের রহস্য আর ভাবলেই শীতল লাগে”, “পুরনো জমিদারদের অভিশাপ কি আবার ফিরে এসেছে?”
আমাদের মধ্যে অনেক চাপ, অনেক প্রশ্ন।
কিন্তু একথা স্পষ্ট—আমরা একমাত্র যারা সেই ইতিহাসের রক্ষক।
যে ইতিহাস গোপনে ঢাকা ছিল, আজ তার নতুন সূচনা হতে যাচ্ছে।
সন্ধ্যায়, যখন গবেষকরা উপস্থিত হলেন, আমরা পুঁথিটি খুলে দেখালাম। কাগজগুলোকে সংরক্ষণে নিয়ে গবেষণায় ঢুকলাম। তাদের চোখে আশ্চর্য, মুখে অবাক এবং মনে স্পষ্ট শ্রদ্ধা।
একজন গবেষক বললেন, “এত দিন যা ইতিহাস বলে আসছিল, তার চেয়ে অনেক বড় এক সত্য এখানে লুকিয়ে আছে। আমরা অবশ্যই এই নথিগুলোকে জনসমক্ষে আনব।”
আরেকজন বললেন, “এই ধরনের আবিষ্কার বাংলাদেশের ইতিহাসেও বিরল, বাংলার জনগণের জন্য এক বড়ো উপহার।”
আমি মনে মনে ঠিক করলাম—এই সংগ্রাম এখানেই শেষ হবে না।
সত্য প্রকাশের জন্য আরও অনেক বাঁধা আসবে, আরও অনেক বাধা পেরোতে হবে।
কিন্তু আমরা প্রস্তুত—কারণ আমাদের হাতে এখন ইতিহাসের মূল কাহিনি, এবং তার সঙ্গে আছি গোপন ভাণ্ডারের নীরব সাক্ষীরা।
আমাদের ধীর গতিতে হলেও সঠিক পথে এগোচ্ছিলাম। গবেষকদের আগমনের পর থেকে পুরো চৌবাগান গ্রাম যেন এক নতুন আলোয় সিক্ত হয়। মানুষজন আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন জমিদারবাড়ির গুপ্ত ইতিহাসের কথা। স্থানীয় পত্রিকার খোঁজখবর আসছিল দেশের বড় শহর থেকেও। কিন্তু এই আগ্রহের পেছনে লুকিয়ে ছিল অন্য এক বাস্তবতা—বিপদ।
এক দুপুরে, যখন আমরা খাজাঞ্চিঘরে নথিপত্রের নতুন কিছু অংশ বিশ্লেষণ করছিলাম, দীনেশ কাকা হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে বলল, “শীর্ষ, তোমরা এটা দেখেছো কি? এটা এক গোপন দলিল, যেখানে একটা পুরোনো চুক্তির কথা লেখা আছে—জমিদার আর ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে।”
আমি ও অর্ঘ্য চোখ বোলাতে লাগলাম। দলিলে লেখা ছিল, ‘১৮৫৫ সালে জমিদার গোবিন্দ চন্দ্র গাঙ্গুলির সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনের গোপন চুক্তি, যা বাংলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ব্রিটিশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিল। তবে এই চুক্তিটি জনসমক্ষে আসেনি।’
গবেষকরা বলল, “যদি এই দলিলটি সত্যি হয়, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বড় অধ্যায় নতুন করে লেখা হবে। এখানে যে গোপন কূটনীতি, লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা লুকানো আছে, তা উঠে এলে অনেকের জন্যই এটা বিপদজনক।”
দীনেশ কাকা আবারও ভয়ে বলল, “আমাদের যাদের শত্রু তারা এই খবর পেয়ে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তোমরা সাবধান থাকতে হবে।”
আমরা বুঝতে পারছিলাম, ইতিহাস উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। তবে থেমে থাকা সম্ভব নয়।
রাতে আমি ও অর্ঘ্য গোপনে গ্রামের আশপাশে পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ অর্ঘ্যের ফোনে একটা বার্তা এল—
“আজকের রাতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব ডকুমেন্টস নিরাপদ রাখো।”
আমরা দ্বিধায় পড়লাম, কারণ এতো বড় খোঁজের সঙ্গে আসছে বড়ো বিপদ। কিন্তু আমাদের মনোবল কমেনি।
একদিন, যখন গবেষকরা একটা বড় সভায় বসে রিপোর্ট প্রস্তুত করছিলেন, গ্রামে এল পুলিশ বাহিনী। তারা জানালো, এক গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা তদন্তে এসেছে। যদিও তারা বিশেষ কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেনি, আমাদের সকলের মনে হলো, তাদের আসার পেছনে অন্য কারণ আছে—এখানে কেউ বড়ো ষড়যন্ত্র করছে।
আমাদের গ্রামের এক বৃদ্ধ বলে উঠল, “জমিদারবাড়ির গুপ্ত কথা বললে আমার বাবা আমাকে যেটা বলতেন, সেটা ভুল নয়। সত্যি সত্যিই অনেকেই হারিয়েছেন তাদের প্রাণ।”
তখন বুঝতে পারলাম, আমাদের এই অভিযান কেবল ইতিহাসের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যও।
আমি একদিন রাতে ডায়েরি খুলে পড়ছিলাম, যেখানে ভোলা গাঙ্গুলির লেখা ছিল,
“সত্য কখনো সহজ নয়, কিন্তু যাঁরা সত্যকে স্বীকার করে, তাঁরা ইতিহাসের প্রকৃত উত্তরসূরি।”
আমরা আরও দৃঢ় হলাম। নতুন করে কিছু তথ্যের খোঁজে আমরা চলে গেলাম গ্রামের পাশের নদীর ধারে, যেখানে একটা পুরোনো বুড়ো কুঁড়েঘর। লোককাহিনী অনুযায়ী, সেই ঘরে এক সময় জমিদারদের গুপ্ত সভা হতো। সেখানে হয়তো আরও দলিল বা প্রমাণ লুকিয়ে আছে।
সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা সেই কুঁড়েঘরে ঢুকলাম। ঘরের মেঝেতে একটি গুপ্ত ঘর ছিল, যেটা চেনা গেল শুধু মাটি থেকে কিছু ভিন্নরকম শব্দ শুনে। আমরা মাটি সরালাম, আর পেয়ে গেলাম একটা পুরোনো কাঠের বাক্স।
বাক্স খুলতেই আমরা দেখলাম, কয়েকটি কাগজের খণ্ডাংশ এবং এক খসড়া মানচিত্র, যেখানে খাজাঞ্চিঘর থেকে শুরু করে গ্রামের বিভিন্ন গোপন পথ চিহ্নিত ছিল।
আমরা বুঝতে পারলাম, এই মানচিত্র আমাদের সাহায্য করবে এই রহস্যের শেষ গন্তব্যে পৌঁছাতে। কিন্তু সেই সাথে একটা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছিল—এই মানচিত্র কাদের তৈরি করেছিল? আর কেন তারা এতদিন এই তথ্য গোপন রেখেছিল?
আমাদের অভিযান এখন শুধু ইতিহাসের গল্প বলার জন্য নয়, সেই গোপন তথ্য খুঁজে বের করার জন্যও। যেখানে লুকিয়ে আছে অতীতের অনেক অজানা সত্য, যা হয়তো ভবিষ্যতকে পাল্টে দিতে পারে।
আমরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম নতুন যাত্রার জন্য—একটি যাত্রা, যা আমাদের গ্রাম, আমাদের ইতিহাস আর আমাদের পরম্পরাকে নতুন রূপ দেবে।
আমাদের হাতে ছিল সেই পুরনো মানচিত্র, যেটা চিহ্নিত করেছিল খাজাঞ্চিঘর থেকে গ্রামের বিভিন্ন গোপন পথ। আমরা জানতাম, এই মানচিত্রের সাহায্যে আমরা পৌঁছাতে পারব সেই গোপন স্থানে, যেখানেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের শেষ পর্বের কাহিনি।
সন্ধ্যার আলো নেমে আসতেই আমরা সেই পথে হাঁটলাম। বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত খুশবু—বৃক্ষের পাতা, মাটির গন্ধ, আর দূরে ভেসে আসা নদীর কলকল ধ্বনি। মানচিত্রের প্রতিটি চিহ্ন অনুসরণ করে আমরা ঘুরে বেড়ালাম পুরনো গলিপথে, যেখানে কখনো কেউ দীর্ঘ সময় ধরে না গিয়েছে।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, আমাদের অন্তর ততই উত্তেজনায় কম্পমান হচ্ছিল। হঠাৎ, আমরা পৌঁছলাম এক গোপন সুড়ঙ্গের মুখোমুখি—সুড়ঙ্গটি ছিল প্রায় অবসন্ন, ঘাসগাছায় ঢাকা, কিন্তু ভিতর থেকে যেন কেবল আমাদের আগমনের অপেক্ষায় ছিল।
দীনেশ কাকা প্রথম সিঁড়ি নামলেন, টর্চ হাতে নিয়ে আলো ফেললেন ভিতরে। আমাদের সঙ্গেই ছিল গবেষক দল। ধীরে ধীরে সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গে, যেখানে সময়ের গতিবেগ থেমে গেছে।
সুড়ঙ্গের দেওয়ালে ছিল একাধিক খোদাই, যা অক্ষরে লেখা নয়, বরং প্রতীক আর আকারের মিলিত ভাষা। আমি মনে মনে বললাম—“এই ভাষা বুঝতে পারলেই হয়তো এই রহস্যের চাবিকাঠি পাওয়া যাবে।”
সুড়ঙ্গের এক কোণে আমরা এক বিরাট কক্ষ পেয়েছিলাম, যেখানে পুরনো কাঠের সিন্দুক, পাণ্ডুলিপি, এবং এক বিশাল ম্যাপ রাখা ছিল। ম্যাপে দেখানো হয়েছিল ব্রিটিশ আমলের বাংলার মানচিত্র, জমিদার ও ব্রিটিশ শাসনের গোপন যোগাযোগ, আর সেই সাথে লুকিয়ে রাখা সম্পদের অবস্থান।
আমরা বুঝতে পারলাম, এই কক্ষটি ছিল সেই গোপন ভাণ্ডার, যেখানে জমিদাররা তাদের সমস্ত গোপন দলিল, অর্থ, এবং রাজনৈতিক তথ্য সংরক্ষণ করত। কিন্তু এর সঙ্গে লুকিয়ে ছিল আরও গভীর এক গল্প—একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা, যা কখনো সফল হয়নি।
দীনেশ কাকা বললেন, “এই ম্যাপের তথ্য যদি প্রকাশ পায়, তাহলে বাংলা ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা শুধু শোষিতই ছিলেন না, লুকিয়ে এক সংগ্রামও করছিলেন।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমাদের দায়িত্ব এটা সঠিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে আনা। ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতা নয়, মানুষের আত্মার গল্প।”
গবেষক দল রাতভর সেই ম্যাপ ও দলিল পরীক্ষা করল। তারা নিশ্চিত হল, এই তথ্যগুলো দেশের ইতিহাসকে নতুন দিশা দেখাবে।
আমরা সেই রাতে বুঝলাম, আমাদের কাজ কেবল গোপন উন্মোচন নয়, বরং সঠিক সময়ে সত্য ইতিহাসের সঠিক প্রকাশ।
পরদিন সকালে আমরা গ্রামের সভা ডাকলাম। সেখানে গ্রামের বয়স্ক থেকে যুবক সবাই একত্রিত হলেন। আমি দাঁড়িয়ে বললাম,
“আজ আমরা এক গভীর সত্যের সন্ধান পেয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম, তাদের ইতিহাস—সবই আজ আমরা জানব। কিন্তু এই ইতিহাস আমাদের গর্ব, আমাদের শক্তি। আমরা সবাই মিলে এর রক্ষক হব।”
গ্রামের সবাই সম্মতি জানালেন, আর আমরা শুরু করলাম একটি গ্রামীণ ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র গড়ার কাজ, যেখানে সকল দলিল সংরক্ষণ ও গবেষণা হবে।
আমাদের সেই সংগ্রাম ও আবিষ্কার শুধু চৌবাগান নয়, বাংলার জন্য নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল।
একবার যখন আমি সেই কুঠুরির পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালাম, তখন বুঝলাম—অন্তর্ধান খাজাঞ্চিঘর শুধু একটা জায়গা নয়, এটি আমাদের অতীত, আমাদের বর্তমান, আর আমাদের ভবিষ্যতের এক অমোঘ সেতু।
আর এই সেতু পার হয়ে আমরা সকলেই ইতিহাসের সঙ্গে একাকার হবো।
শেষ